বিবিসি বাজারের সেই কাশেম মোল্লা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৩/১২/২০১০ - ৯:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সালেক খোকন

ঈশ্বরদীকে অনেকেই জানে জেলা হিসেবে। জেলা শহরের প্রায় সব সুবিধাই আছে অতি পুরোন এই উপজেলাটিতে। আছে বিট্রিশ আমলের তৈরী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ১৪ ফেব্রুয়ারী ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে রূপসা-বাগেরহাট সেকশনে প্রথম চালু হওয়া ২ফুট ৬ ইঞ্চি ন্যারো গেজ ট্রেনটি রাখা হয়েছে এখানেই। সাহসী বাঙালির নানা কাহিনীতে ভরা এই ঈশ্বরদী। পাঁচ শহীদের মোড় আর শহীদ পাড়ার গণকবরটি তো আজও ইতিহাসের সাক্ষী। রাখা আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায় নিক্ষিপ্ত বোমার অংশ বিশেষও।
বন্ধু শামীমের বাড়ী ঈশ্বরদীতে। তাঁর সাথে ঈশ্বরদীর নানা ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখছি। কথায় কথায় শামীম জানালো বিবিসি বাজারের কথা। বিবিসি নামে বাজার, শুনেই আগ্রহী হলাম। যেতে যেতে শামীম জানালো বিবিসি বাজার নিয়ে নানা কথা।
১৯৭১ সাল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ক্যাম্প বসিয়েছে পাকশী পেপার মিল ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকাতে। সেখান থেকে খুব কাছেই রুপপুর গ্রাম। সে গ্রামে রাস্তার পাশের এক কড়ইতলায় ছোট্ট একটি চায়ের দোকান বসায় এক দোকানী। সবার কাছে সেটি মোল্লার দোকান। গ্রামের মানুষ কাশেম মোল্লাকেই ভালবেসে ডাকতো ‘মোল্লা’ বলে।
রুপপুরসহ আশপাশের গ্রামের সবাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। অনেক পরিবারেরই যুবক ছেলেরা গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানীরা নির্বিচারে জ্বালিয়ে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। সবাই উৎকন্ঠা আর আতংকে দিন কাটাচ্ছে। দেশের কোন খবর জানে না কেউ। রেডিও পাকিস্তান এ সঠিক কোন খবর নেই। যা খবর পাওয়া যায় তা শুধুই বিবিসি, ভয়েজ অব আমেরিকা, কলকাতা বেতার আর স্বাধীন বাংলা বেতারে।
দশ গ্রামের মধ্যে শুধু কাশেম মোল্লারই ছিল একটি থ্রি ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও। প্রতি সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে বসে তিনি শর্টওয়েভে সবাইকে বিবিসির খবর শোনাতেন। বিবিসিতে দেশের খবর, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের খবর শুনতে চায়ের দোকানে ভীড় লেগে যেত। ক্রমেই ভীড় আরো বাড়তে থাকলো। চায়ের দোকানের পাশে গড়ে ওঠলো আরো বেশ কয়েকটি দোকান। এভাবে তৈরী হয় একটি গ্রাম্য বাজারের।
সন্ধ্যে হলেই রুপপুর গ্রামে হাকডাক শুরু হতো। গ্রামের লোকেরা একে অন্যকে বলতো, ‘চল বিবিসি শুনতে যাই’। এভাবে মোল্লার দোকানে বিবিসির খবর শোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাজারের নাম প্রথমে ‘বিবিসি শোনার বাজার’ এবং পরে তা হয়ে যায় ‘বিবিসি বাজার’।
লালন শাহ সেতু মুখী হাইওয়ে রাস্তা হতে কিলোখানিক পথ পেরোতেই জমজমাট একটি বাজার ঠেকলো। শামীম জানালো এটিই সেই বিবিস বাজার। দেখলাম কাশেম মোল্লার হাতে লাগানো সেই কড়ইগাছটি এখন আকাশ চুম্বি। গোটা বাজারে দোকানের সংখ্যা শতাধিক। কিন্ত সেখানে নেই বাজারেরই প্রবর্তক কাশেমের কোন দোকান।
বিবিসি বাজারে চঞ্চল মিষ্টি ভান্ডারে বসে কথা হয় চর রুপপুরের একজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। নাম মোঃ ওমর আলী। কথা হয় দোকান মালিক আশরাফ মালিতার সঙ্গেও। ১৯৭১ এ কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে বসে বিবিসির খবর শোনার স্মৃতি আজো তাদের কাছে জীবন্ত। পাকিস্তান আর্মিদের গাড়ির শব্দ পেলেই সবাই চায়ের দোকান থেকে সরে পড়তো গ্রামের ঝোপঝারে। তারা জানালো জীবনকে বাজী রেখেই কাশেম মোল্লা সবাইকে বিবিসির খবর শোনাতো । সে সময় মোল্লার দোকানে বিবিসির খবর শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে গিয়েছে শত শত যুবক। এভাবে বিবিসি বাজার, সেই কড়ইগাছ আর কাশেম মোল্লা জায়গা করে নেয় ইতিহাসের পাতায়।
কিন্ত কাশেম মোল্লাকে কোথায় পাবো? একজন জানালো পাকশী রেল বাজারে তার একটি ছোট্ট মিষ্টির দোকান আছে। আমরা আর দেরি করি না। রওনা হই রেল বাজারের দিকে। বিবিসি বাজারের কাশেম মোল্লাকে চেনে সকলেই। তাই দোকান খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
দোকানটিতে কাশেম মোল্লা নেই। বসে আছে তাঁর মেজ ছেলে আব্দুস সামাদ। ভাঙ্গচোরা দোকানের এককোনে ঝুলছে বড় একটি ছবি। ছবিতে কাশেম মোল্লার সাথে সাংবাদিক আতাউস সামাদসহ বেশ কয়েকজনকে দেখা গেল। সামাদ জানালো বিবিসি নামে একটি বাজারের নামকরণের কথা শুনে বিবিসির ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ১৯৯২ সালে এখানে এসেছিলেন বিবিসির তৎকালীন ‘ইষ্টার্ন সার্ভিস সেকশন’ এর প্রধান ব্যারি ল্যাংরিজ, বাংলা সার্ভিস এর উপপ্রধান সিরাজুল ইসলাম, প্রযোজক ও প্রেজেন্টার দীপন্কর ঘোষ এবং সংবাদদাতা আতাউস সামাদ। বিবিসি শোনার সেই রেডিওটি কোথায়? এমন প্রশ্নে সামাদ নিশ্চুপ থাকে। পরে জানালো স্বাধীনের পর অভাবের কারণে তার বাবা কাশেম বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় ৭১ এর স্মৃতি বিজড়িত সেই রেডিওটি।

ঘন্টা খানিক পরে দোকানে আসেন কাশেম মোল্লা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। হানাদার বাহিনীর আঘাতে জখম হওয়া পা নিয়ে চলছেন খুড়িয়ে খুড়িয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে। চা খেতে খেতে কাশেম মোল্লা বলেন মুক্তিযুদ্ধের সে সময়কার কথাগুলো।
অভাবের কারণে ক্লাস সেভেনের বেশী পড়া হয়নি কাশেমের। ফলে জীবন টিকাতে নেমে পড়েন টুকিটাকি ব্যবসায়। এক সময় পাকশী রেল বাজারে দেন একটি মুদি দোকান। ৭১ এর ২৫ মার্চের পরে পাকিস্তানী আর্মি বাজার পুড়িয়ে দিলে তিনি চলে যান নিজ গ্রাম রুপপুরে। নিজের হাতে লাগানো কড়ইতলীতে বসান ছোট্ট একটি চায়ের দোকান।
বিয়ের পরে স্ত্রী আনোয়ারা বেগম আবদার করে একটি রেডিও কিনার। রেডিও শোনার প্রতি কাশেমেরও এক ধরনের ঝোক ছিল। তাই টাকা জমিয়ে তিনি কিনলেন একটি থ্রী ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও। কাশেম মোল্লার সেই রেডিওই হয়ে যায় ইতিহাস।
কাশেম জানালেন ৭১ এ পাকিস্তানীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চায়ের দোকানে তিনি রেডিওতে বাংলা খবর শোনাতেন। রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিবিসি, ভয়েজ অব আমেরিকা ও কলকাতা বেতারের খবর শোনার জন্য আশপাশের মানুষ দুবেলাতেই নিয়মিত ভীড় জমাতো তাঁর চায়ের দোকানে। গোপনে মাঝে মধ্যেই দল ভেদে আসতো মুক্তিযোদ্ধারা। রাজাকার আর পাকিস্তানীদের নানা খবর জেনে যেত কাশেম মোল্লার কাছ থেকে। চা খেতে আসা নানা লোকের নানা তথ্য থাকতো কাশেমের কাছে। তিনি সে সব খবর দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
হাসতে হাসতে কাশেম জানালেন সে সময় বিবিসির খবর শুনে শুনে এমন অবস্থা হলো যে কেউ অধিবেশন শুরুর পরে এলেও ঠিক ঠিক বলতে পারতেন কার কন্ঠ শুনছেন? সিরাজুর রহমান,নুরুল ইসলাম,শ্যামল নাকি কমল বোস। এমন কি কেউ কেউ তাদের কন্ঠ এবং ভঙ্গি পর্যন্ত অনুকরণ করতে পারতো। বিবিসি শুনতে আসা গ্রামের মানুষেরা শুধু খবর শুনতেনই না পর্যালোচনা করতেন, বিশ্লেষণ করতেন।
কাশেম জানালেন স্বাধীনের ঠিক কয়েকদিন আগে রাজাকারদের তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানী আর্মি হানা দেয় তার চায়ের দোকানে। সে দিনের কথা মনে হলে আজো তিনি আৎকে ওঠেন। কাশেম আপন গতিতে বলতে থাকেন। পাকিস্তানী আর্মি এসে তাকে হুংকার দিয়ে বলে ‘এ মাদার চোত, তোম এদার আও, তোমারা দোকান মে রেডিও বাজতাহায়, শাল্যে, তুমকো খতম কারদে গা, তুম রেডিও নিকালো’। কাশেম বলেন সেনাদের কথায় আমার জানে তো পানি নাই। ভেবেছিলাম মাইরে ফেলবি। আমি কলেম ‘ও চিজ হামারা নেহি হে, আদমি লোক খবর লেকে আতা হে শুনালকে লেকে চলে যাতা হে’। কথা শুনে আর্মিরা রোলার দিয়ে কাশেমের ডান পায়ে বেশ কয়েকটা বাড়ি দেয়। আর্মিদের সেই বাড়ির কারণেই এখন আর তিনি ডান পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারেন না।
কাশেম মোল্লার চায়ের দোকান ছিল খুবই ঝুকির জায়গা। পাশেই ছিল আর্মি ক্যাম্প আর চারপাশে রাজাকারদের পদচারণা। এরই মধ্যে তিনি রেডিওতে বিবিসি খবর শুনাতেন আর মুক্তিযোদ্ধাদের নানা খবর দিতেন গোপনে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। কাশেম সম্পর্কে এভাবেই বললেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঈশ্বরদী উপজেলা কমান্ডার জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক। তার মতে কাশেম মোল্লা একজন ত্যাগি মুক্তিযোদ্ধা। যার হাতে অস্ত্র হিসেবে ছিল রেডিও আর নানান সংবাদ। তিনি দুঃখ করে বলেন যার কারণে বা যিনি ঐতিহাসিক বিবিসি বাজারের প্রবর্তক সেই বাজারে তার একটি দোকান নেই এটা জাতি হিসেবে আমাদেরই ব্যর্থতা। কাশেম মোল্লাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানিত করা এবং তার সুচিকিৎসার বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তার পাশে থাকবে বলে তিনি অঙ্গীকার করেন।
৪০ বছর আগের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছেন কাশেম নামের অন্য রকম এই মুক্তিযোদ্ধা। জখম হওয়া পায়ের দিকে তাকালে আজো তার মনে পড়ে সে সব দিনের কথা। বিবিসি বাজারের ইতিহাস জানতে মাঝে মধ্যেই সাংবাদিকরা ভীড় জমায় কাশেমের কাছে। সংবাদ প্রকাশও হয়। কিন্ত কাশেমের অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটে না। উপজেলায় বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস পালন হয় ঘটা করে। কখনো কখনো স্বাধীনতা বিরোধীরাও দাওয়াত পায় সসম্মানে। কিন্ত একজন কাশেম মোল্লার খোঁজ রাখে না কেউ। কাশেমের ভাষায় ‘ভিক্ষুকের মাতো বাড়িতে পইরে আছি’। তবু ৭১ এর স্মৃতি আর বিবিসি বাজারের কথা উঠলেই গর্বে বুক ভরে যায় তার। বেঁচে থাকার জন্য এই তার একমাত্র অবলম্বন।

ছবি: লেখক সালেক খোকন


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

এক বীর মুক্তিযোদ্ধার বিজয় গাঁথা পড়ে মনটা ভারী হয়ে গেল। মনটা খুশী হতে পারতো যদি শুনতাম কাশেম মোল্লা ভালো আছে। আমাদের দেশের বেশীর ভাগ মুক্তিযোদ্ধারা কাশেম মোল্লার মত হাল। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি, তাদের আদর্শ আর স্বপ্নের কথা বলি, আসলে বাস্তবে তার কিছুই ঘটে না। সবাই কথার পটু, কাজের বলায় সবাই সমান।

মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিকের স্মৃতি শেয়ার করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

কামরুজ্জামান স্বাধীন।

সাধু এর ছবি

গল্পের আবেদন মর্মস্পর্শী। ভাষা ঝরঝরে। সবচেয়ে বড় কথা মুক্তিযোদ্ধাদের কথা সব সময়ই ভালো লাগে। ধন্যবাদ।

দিগন্ত বাহার [অতিথি] এর ছবি

বেঁচে থাকুক বিবিসি বাজারের স্মৃতি।
লেখাটা ভালো লেগেছে, শেয়ার দিলাম। হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ধন্যবাদ লেখাটির জন্য
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ফেরদৌস ৬৯ [অতিথি] এর ছবি

এক কথায় অসাধারন

তাসনীম এর ছবি

খুব ভালো লাগলো লেখাটি। ইতিহাস ধরা দেয় এই সমস্ত ঘটনায়...ধন্যবাদ আপনাকে।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

কাশেম মোল্লার মতো হয়তোবা এইরকম হাজার হাজার ঘটনা পড়ে আছে বাংলাদেশের মাঠে প্রান্তরে।

লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।

পাগল মন এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে এরকম একজন মানুষের খোঁজ আমাদের দেয়ার জন্য।
এরকম অনেক নাম না জানা মানুষের কথা আমরা হয়তো এখনো জানিনা, স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরেও, তাদের ঋণ শোধতো অনেক পরের কথা।
_________________________________________________
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।