ডুবসাঁতার :: ডিজিটাল চলচ্চিত্রের শৈল্পিক উত্তরণ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৭/১২/২০১০ - ৩:০৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘Every work of art is distinct. The form comes out of its theme, philosophy and reflections.’
-Ritwik Ghatak


আমরা যে রেনুর গল্প শুনেছিলাম, হয়তো কিছুটা দেখেওছিলাম, পাঠক সে রেণুর সাথে আপনাদেরও পরিচয় থাকতে পারে। শহরতলীর নিম্নবিত্ত এলাকাটায ওদের বাস। স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় সে মায়ের কাছে ফিরে আসে। বিধবা ময়ের অগোছালো সংসারে আরো আছে দুই জন। অন্ধ বড় ভাই রোকন, যার স্থবির জীবন প্রাণ খুঁজে পায় দাবার ঘুঁটির চলাচলে। বখে যাওয়া ছোটো ভাই রেহান, যার গন্তব্য তখনো ধূসর। তাদের সকলের দাযিত্ব সে তুলে নেয় নিজের কাঁধে। রেণু সুন্দরী এবং ছোট হলেও মাঠ কর্মীর একটা চাকরী আছে তার। রোদ-বৃষ্টি কিছু থাকুক বা না থাকুক একটা ছাতা মাথায় নিজস্ব আশ্রয় তৈরী করে পথ চলে মেয়েটা। সে ছাতাটাও আবার মাঝে মাঝে উল্টে যায় প্রতিকূল বাতাসে। প্রিয় মানুষ হারিয়ে যায়, প্রিয় স্বপ্ন দলিত হয় কতো সহজেই। বেঁচে থাকা না থাকার মাঝে পাথর্ক্য হয়ে থাকে শুধুই শরীর অথবা, শরীরের ভেতরে অন্য শরীর।

শহরতলীর একটা অর্ধনির্মিত একতলা বাড়ির খাবার টেবিলে আটপৌরে যে গল্পের শুরু হয় সে গল্প রেণুর পথ ধরে অথবা, তার অন্তগর্ত অনুভবের সুর ধরে যখন এগিয়ে চলে তখন আর সেটি আটপৌরে থাকেনা। নির্মাতা তার জীবন-দর্শন ও অভিজ্ঞতার সাথে শিল্পকে গেঁথে নিয়ে আমাদের দেখিয়ে দেন অন্যভুবন। তৈরী হয় মন খারাপ করা, বুক হাঁসফাঁস করা সব মুহুর্ত। রেণু কখনো ডুব দেয় তার শৈশবে, আবার ভেসে ওঠে জন্মান্ধ ভাই এর সাহচর্যে। কখনো ডুব দেয় আত্মরতির মতো মগ্ন চৈতন্যে, আবার ভেসে ওঠে অনাগত সন্তানের সাথে কথোপকথনে। সে কখনো বন্ধুর সান্নিধ্যে আনন্দমুখর, কখনো আচ্ছন্ন নীরবতায়। ভাসতে ভাসতে ডুবে যায়, আবার ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠে।
জীবনের প্রতিকূল রাস্তায় রেণুর যে পথচলা, রেণুর অর্ন্তজগত ও বহির্জগত জুড়ে যে আলোড়ন, সেইসব সমস্ত কম্পন ও অনুভূতি নিয়ে নূরুল আলম আতিক ‌‌‍‘ডুবসাঁতার’ চলচ্চিত্রে যে ভ্রমণ সৃষ্টি করেন শিল্পিত প্রয়াসে আমরা সে ভ্রমণে অনায়াসে তার সহযাত্রী হয়ে যাই। রেনুর মতোই অনায়াসে ডুবে যাই, আবার ভেসে উঠি। তীরে পৌছাবার রক্তজাত পিপাসা; ক্লান্ত হই, ভেঙে পড়ি, তবু সাঁতার কখনো থামেনা।

রেণুকে বেশীর ভাগ সময় পাওয়া যায় খোলা আকাশের নীচেই। কখনো বাড়ির উঠোনে, কখনো ছাদে, কখনো রেল লাইনের ধারে, কখনো রিকশায়, কখনো নৌকায়; কখনো চৈতন্যে আবার কখনো স্বপ্ন-ভ্রমণে। লোকেশনের এই বৈচিত্র্য, চরিত্রের এই বিচিত্র মনোভঙ্গি সবকিছুর সমৃদ্ধ প্রকাশ রযেছে এর চিত্রায়নে। রেণুর গল্পের নকশি-কাঁথায় আঁট-সাঁট হয়ে বুনে থাকে ছোটো ছোটা আরো নানা গল্প। সেলাই কলে মায়ের সংসার সচল রাখার প্রক্রিয়া, অন্ধ হয়েও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রোকনের চুল আঁচড়ানো, নেশার টাকা যোগানে রেহান ও তার বান্ধবী পুণমের কুট-কৌশল, রাতের অন্ধকারে ভাত চোরের আবির্ভাব, পাড়ার মাস্তানের আঞ্চলিক উপদ্রব, বৃষ্টির রাতে চোরের জায়গায় পথচারী খুন হয়ে যাওয়া, রেল লাইনের উপর রাজহাঁসের জীবন বাঁচানোর নিজস্ব কায়দা, সবকিছুই নিমার্তার চিত্রনাট্য অনুযায়ী বিশ্বস্ত ও শৈল্পিক ভঙ্গিতে গৃহীত হয়েছে রাশেদ জামানের ক্যামেরা সঞ্চালনে। এই সময়ের সবচাইতে মেধাবী চিত্রগ্রাহক রাশেদ জামান অনবদ্য তার আলোক পরিকল্পনার নিজস্ব কায়দাতেও।
সমসাময়িক গল্প হওয়ায় নির্মাণের ক্ষেত্রে সেটে, পোষাকে, এবং ব্যবহৃত দ্রব্যাদীর ক্ষেত্রে বাস্তবানুগ থাকবার সুবিধাটি শিল্প নির্দেশক লিটন করের আয়ত্ত্বে ছিল। চরিত্রগুলো যে পোষাক পড়ে হাঁটে, কথা বলে, যে নাম ধরে তাদের ডাকা হয়, যে বাহনে তারা চড়ে সবকিছুই ছিল বিশ্বস্ত ও শ্রেনীসম্মত। মাতিয়া বানু শুকু’র সংলাপ এবং ভিক্টর এর আয়োজনে এ ছবির মনোগ্রাহী সংগীত দৃশ্যের সাথে একীভূত করে অনায়াসে।
ডিজিটাল পদ্ধতীতে ধারন করবার কারনে নির্মাতার সৃজনশীল স্বাধীনতার প্রয়োগ ছিল সবখানে। তিনি স্বাধীনতা নিয়েছেন সম্পাদনার ক্ষেত্রেও। রেণুর অর্ন্তজগতের দোলাচল, শৈশবে চলে যাওয়া ও ফিরে আসার আবহ তৈরীতে সম্পাদনার টেবিলে যে দক্ষ হাতের প্রয়োজন ছিল নিমার্তা সেটি পেয়েছেন। সম্পাদক সামির আহমেদের উজ্জল উপস্থিতি টের পাওয়া যায় দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়ার মসৃণ গতিপ্রবাহে।
খুব ছিদ্রাণ্বেষি না হলে এর শিল্প ও নান্দনিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্নের আঙুল তুলবার সুযোগ হয়না কোনোদিকে। এরপরেও সীমাবদ্ধতার কারনে নির্মাতার নিজের কাছেই হয়ত কিছু অতৃপ্তি থেকে যেতে পারে। যেহেতু আমরা জানি- চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং জটিল সমণ্বয়ের প্রক্রিয়া, সেখানে একজন নির্মাতার সবসময়েই চেষ্টা থাকে একটি নির্ভুল উপস্থাপনার। ডুবসাঁতারে সেই প্রচেষ্টার ছাপ সুস্পষ্ট।

যথার্থ শিল্পী নির্বাচনের দুরূহ প্রক্রিয়াটি নির্মাতা সেরেছেন যথার্থ সাফল্যের সাথে। সে জন্যে হয়তো প্রধান চরিত্রের অভিনয় শিল্পী জয়া‌র বাহ্যিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার আগেই আমরা পেয়ে যাই পোড়খাওয়া রেণুকে। এমনকি তিনি যখন স্বকন্ঠে গান ধরেন- ‘তোমার খোলা হাওয়ায়…’ তখনো পর্দায় রেণুর মানসিক অবস্থার বর্ণনাই অনুদিত হয়, জয়ার কন্ঠের সাফল্য নয়। একজন সম্পন্ন অভিনয় শিল্পীর সাফল্য। তিনি আরো একবার নিজের প্রতিভায় মুগ্ধ হতে পারেন নিশ্চিন্তে।
রেণুর বন্ধু ইমরানের চরিত্রে আমরা পাই শেহজাদ নামে এক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণের মুখ, যে অপেশাদার হয়েও সহজ, সাবলীল। অন্ধ বড় ভাই রোকনের চরিত্রে আমরা পাই অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত মুখ- অশোক ব্যাপারীকে। ভবিষ্যতের চরিত্রাভিনেতা হিসেবে আমরা হয়তো তাকে নিয়মিত দেখবো, তবে রেণুর বড় ভাই হয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন আরো অনেকদিন। মায়ের চরিত্রে ওয়াহিদা মল্লিক জলি, ছোটো ভাই রেহানের চরিত্রে শাহরিয়ার শুভ, নেশাগ্রস্ত তরুণীর চরিত্রে শ্রাবস্তি দত্ত তিন্নি এবং ভাত চোরের ভূমিকায় দেবাংশু হোর ছিলেন যথার্থই বাস্তবানুগ এবং দ্যুতিময়। স্বল্প উপস্থিতির আরো কয়েকটি চরিত্রে- স্বাগতা, স্বাধীন খসরু, শাহরিয়ার সজীব এবং সুষমা সরকারসহ আরো কয়েকজন ছিলেন যথাযথ ভঙ্গিতে।

‘ডুবসাঁতার’ ছবিটি যদি সাদাকালো করে দেখা যায় তাহলে ঋত্বিক বাবুর ‘মেঘে ঢাকা তারা’র কথা মনে পড়ে যেতে পারে অনায়াসে। নীতার মতোই ছাতা মাথায়, কাঁধের ব্যাগটা বগলে চেপে ধরে রেণুর যে পথচলা, পরিবারের জন্যে তার যে ত্যাগ সে নীতার চেয়ে কম কিছু নয়। নিজের জন্যে তার চাওয়ার থাকেনা কিছুই, কিন্তু যখন চাইবে বলে ঠিক করে তখন আর পাওয়ার জন্যে অবশিষ্ট থাকেনা।
ঋত্বিক ঘটক ১৯৬০ এ নির্মাণ করেছিলেন তার অনবদ্য সৃষ্টি ‘মেঘে ঢাকা তারা’। আর ২০১০ এর নিমার্তা নূরুল আলম আতিক যখন এসময়ের গল্প বলেন তার নিজস্ব ভঙ্গিতে তখন আর তুলনা করবার সুযোগটি অবশিষ্ট থাকেনা। আমরা এর রঙীন দৃশ্যকাব্যসহ অঙ্গিভূত সকল রূপ, রস, গন্ধ অনুভব করবার চেষ্টা করি তার মতো করেই। হতে পারে, এটি হয়তো ঋত্বিকের প্রতি আজকের নির্মাতার শিল্পিত শ্রদ্ধাঞ্জলী।

টেলিভিশনে প্রচারিত ‘চতুর্থ-মাত্রা’, ‘সাইকেলের ডানা’, ‘জোড়া ইলিশ’ কিংবা ‘বিকল পাখির গান’ এর মতো কহিনীচিত্রের কথা যখন মনে পড়ে তখন ভাবতে ইচ্ছে করে- মূলধারার পুর্ণদের্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে নূরুল আলম আতিকের সামনে বাঁধাগুলো কী কী? ফি বছর কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগে যে আবর্জনাসকল তৈরী হয় তা না হলেই হয়তো জাতি বেঁচে যেতো। কিন্তু যারা চলচ্চিত্র মাধ্যমের মেধাবী, শিক্ষিত, পারঙ্গম তাদের সুযোগ না হওয়াটা সুস্থ চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত রাখার জন্যেই ক্ষতিকর। বলা প্রয়োজন- ‘কীত্তর্ণখোলা’র চিত্রনাট্যের জন্যে যিনি ২০০০ সালের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন তার নিজের চিত্রনাট্য ২০১০-এ এসেও কেন অনুদান পেতে পারেনা সেটা ভাবায় বৈকি। তাই বলে একজন সৃষ্টিশীল নিমার্তার নির্মাণ প্রক্রিয়া তো আর থেমে থাকেনা। ক্রমাগত তিনি নিজেই নিজেকে ভাঙেন। সে কারনেই হয়তো প্রথার বাইরে নির্মিত হয় একটি ‘ডুবসাঁতার’।
বলা প্রয়োজন, প্রযুক্তির প্রাগ্রসর সময়ে দাঁড়িয়ে ফরম্যাট নিশ্চয়ই আর কোনো বিষয় নয়। শেষ পর্যন্ত কী উপস্থাপিত হলো সেটাই বিষয়। এই নিবন্ধের শুরুতে উদ্ধৃত বক্তব্যে যেমন ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন- ‘প্রতিটি শৈল্পিক কাজই স্বতন্ত্র। এর ছাঁছ গঠিত হয় এর বিষয় থেকে, এর দর্শন থেকে, এর প্রতিবিম্ব থেকে’।
সে অনুযায়ী নূরুল আলম আতিকের ‘ডুবসাঁতার’ তার ছাঁছ এবং আঙ্গিক খুঁজে নিয়েছে এর নিজের বিষয় থেকেই, নিজের দর্শন থেকেই। সকল বৈশিষ্ট নিয়েই ‘ডুবসাঁতার’ একটি সম্পুর্ণ ও সম্পন্ন চলচ্চিত্র।
ঈদ উপলক্ষে চ্যানেল আই’তে প্রিমিয়ার হয়েছিল ছবিটির। একই সাথে ষ্টার সিনেপ্লেক্সে প্রদর্শন করবার কথা ছিল, কিন্তু ডিজিটাল প্রজেকশনের অবকাঠামোগত প্রস্তুতির অভাবে সেটা সম্ভব হয়নি। তাহলে কি ইমপ্রেস প্রযোজিত অন্যান্য ছবির মতো এটাও বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে থাকবে? একটি চলচ্চিত্রের চূড়ান্ত সফলতা এর বহুল প্রদর্শনের মাধ্যমে, সকল শ্রেনীর দর্শকের কাছে পৌছার মাধ্যমে। তারেক মাসুদ নিমির্ত ‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্রটি নির্মাতার স্ব-উদ্যোগে বিভিন্ন জেলায় প্রদর্শিত হচ্ছে সাধারণ মিলনায়তনে এবং ইতিমধ্যে এটি দর্শকের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পেয়েছে। ‘ডুবসাঁতার’এর নিমার্তাও নিশ্চয় একই ভাবে প্রদর্শনের কথা ভাবতে পারেন। যেখানে একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেখানে সুস্থ চলচ্চিত্রের জন্যে এরকম বিকল্প পন্থা বেছে নেয়া ছাড়া আর উপায় কী?
------------------------------------------------------------------------------
:: প্রসূন রহমান
লেখক, চলচ্চিত্রকর্মী


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

মেটা ব্লগিং হয়ে গেলো মনে হচ্ছে.....!!!

tofayel71@gmail.com

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।