এবারের বইমেলায় প্রথম গিয়েছি তিন তারিখে। প্রথম দুইদিন অনেকটা ইচ্ছা করে যাইনি। কারণ আগের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রথম দিকে স্টল সাজানো আর নতুন বই আসতেই কয়েকদিন চলে যায় মেলার। সেদিন গিয়েও প্রায় একই অবস্থা দেখলাম। নতুন বই তখনও সেভাবে আসেনি। ঢোকার পথে সারি সারি চটপটি, ফুচ্কা, বাঁশি, খেলনা, ব্যাগ, পুরোনো বই প্রভৃতির পসার বসিয়ে যেভাবে রাস্তা দখল করে রেখেছে হকাররা তাতে ভেতরে ঢোকাই তো দায়। তবে একটা উৎসব উৎসব ভাব আছে। সেগুলো কাটাতে না কাটাতেই নতুন উপদ্রব, দাজ্জাল। দুই ধাপ এগোই, আর একজন করে দাজ্জালের সংবাদবাহক চলে আসে। দাজ্জাল নাকি চারশত বছর আগেই চলে আসছে দুনিয়ায়। আর তা বের করতে পেরেছে এই সময়ের ইমাম, The Leader of the Time, ইমাম শামসুদ্দীন না কোন ব্যাটায় জানি। আরে বাবা, বের করছে ভাল কথা। খামাখা এত সুন্দর একটা জায়গায় দাজ্জাল দাজ্জাল করে পরিবেশটা বানচাল করার কোনো মানে হয়? তাও উপযাচক হয়ে একেবারে পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে। আর হাত দিয়ে দেখাচ্ছে দাজ্জাল আবিষ্কারের প্রমাণ। তাও একজন দুইজন হলে হয়, মনে হল শতশত এরকম বাহক। দাজ্জাল দেখানোর জন্যে কোন দাজ্জাল যে জনপ্রতি প্রায় একজন বাহক ঠিক করে রেখেছে কে জানে? কোনোমতে পাশ কেটে আরও একটু সামনে যাই।
এবার চোখে পড়ে মানবিকতার আবেদন আর রক্তদান কর্মসূচী এর প্যান্ডেল। প্রায় দুই তিনটা সাহায্যের আবেদন, জীবন বাঁচাতে। সাহায্য নিচ্ছে মনে হল ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরাই। তবে এই ব্যাপারটা একটু অফিসিয়ালি হলে ভাল হত মনে হয়। অনেকটা রক্তদান কর্মসূচীর মত। মানুষ বিশ্বাস করা বড়ো দায়, আবার মানুষকে বিশ্বাস করেই বেঁচে থাকতে হয়। আমি নিজে এরকম করে প্রতারণা করার উদাহরণ দেখেছি বলে ইচ্ছা হলেও সঙ্কোচ জাগে। টাকা যাওয়াটা মূল ব্যাপারনা, কিন্তু বিশ্বাসের মর্যাদা একবার হারিয়ে ফেললে তা ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর রক্তদান কর্মসূচী ব্যাপারটার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে আমি নিজে এর থেকে দূরে থাকি। ভাই, ইঞ্জেকশন আর রক্তের কথা মনে হলেই আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। যদিও প্রচন্ড দুঃসাহসে কয়েকবার দিয়েছি। তবে প্রথমবার একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমি মানুষের কাটাছেড়া বা রক্ত দেখতে পারিনা। মাথাঘুরে। আমার আব্বু ডাক্তার। যখন বাসায় রোগী আসার খবর পাই, আমি সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ দূরত্বে সরে পড়ি। তো যাইহোক, প্রথমবার রক্ত দিতে যেয়ে দেখলাম ব্যাপারটা ভয়ংকর কিছুনা। তাছাড়া রক্তদানের পরে ফ্রি জুসের অফার আছে। আল্লাহ বলে শুয়ে পড়লাম। বামহাত থেকে নিবে। আমার রক্তফোবিয়া শুনে ডাক্তার অন্যদিকে মুখ করে রাখতে বললেন। সবকিছুই ঠিকঠাক হল, রক্ত দিলাম, জুস খেলাম। কিন্তু পাশের টেবিলে রাখা আমার নিজের রক্ত পলিপ্যাকে দেখেই আমার কামসারা। কী হল কি জানি? রক্তের পরে দেখলাম আমার চোখে পানির ছিটা। আমি তখন শুয়ে আছি। ডাক্তার বলল, আমি নাকি প্রায় পাঁচমিনিট অবচেতন ছিলাম!
এরপরে আরও রক্ত দিয়েছি। কিন্তু এমনটা আর হয়নি, কারণ হয়ত নিজের রক্ত আর দেখিনি। যাইহোক, বইমেলায় রক্তদান কর্মসূচীর তারিফ করে এগিয়ে গেলাম নিরস্ত্র প্রমাণের আয়তচেম্বারে। পাশ করলাম। তখনও মেলাপ্রাঙ্গনের ভেতরে ঢুকিনি। রাস্তার দুইপাশ জুড়ে অসংখ্য দোকান। তবে বেশিরভাগই প্রকাশনী নয়। আর প্রায় প্রত্যেক দোকানের নামের একটা অংশ কমন, বঙ্গবন্ধু। “বঙ্গবন্ধু” শব্দটা এখন আমার মনে হয় যেন ছেলেখেলায় পরিণত হয়েছে। যে যেভাবে পারছে, দেদারসে এর অপব্যবহার করছে। প্রবেশমুখে তোরণ দুটো অসাধারণ লেগেছে আমার কাছে। প্রায় প্রতিদিনই যাচ্ছি। এবং একটি ভাল ছবি তোলার চেষ্টা করছি। কিন্তু লাভ হচ্ছেনা। মেলায় আগত কোনো না কোনো জুটি কিংবা কোনো বালিকা সামনে মডেল হয়ে দাঁড়িয়ে পোজরত। আমার ভাগ্য খারাপ। দেখতে সুন্দর বা পছন্দ হলে ফোকাসে সাথে নিয়েই তোলা যেত, কিন্তু কোনোটাই মেলেনা। অবশেষে গতকাল একটু ফাঁকা পেয়ে তুলে ফেলেছি দুটো ছবি, তবে তড়িঘড়ি করায় অত ভাল হয়নি। ঢোকার পথে বাঁশের খাম্বার সারি দেখে গরুর হাটের মত লাগে। এটা না দিলে কোনো ক্ষতি ছিলনা। বইমেলা আর আট-দশটা মেলার মতোনা। এখানে স্বতস্ফূর্ত বিচরণের সবরকম সুব্যবস্থা থাকা উচিত। বাংলা একাডেমীর ভিতরে যেভাবে বিল্ডিং উঠছে তাতে আগামী বছরগুলোতে মেলার স্থান সংকুলান কীভাবে হবে তা নিয়ে আমি শঙ্কিত। এমন একটা জায়গা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে?
এবারের স্টলগুলোর বেশিরভাগই খুব চমৎকারভাবে সাজিয়েছে। বিশেষকরে শুদ্ধস্বর, অন্যপ্রকাশ, মিজান পাবলিশার্স, শিশু একাডেমী, শিখা প্রকাশনী, পাঠসূত্র, জনান্তিক, পলল ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানেও ছবি তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম। মানুষের ভীড়ের সাথে দুটাকার মোবাইলের ক্যামেরাকি আর পারে? ভেতরের ছোটছোট ভাস্কর্যগুলোও (এগুলোকে কী বলে আসলে আমি জানিনা) চমৎকার। তবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মড়ক লেগেছে নাকি বুঝলামনা। গত তিন বছর ধরে দেখছি এর সাইজ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। বসেছেও প্রায় এককোণায়। আর নতুন বইও এখন পর্যন্ত তেমন নেই। চরম হতাশাজনক। এখন পর্যন্ত আমি মনে হয় এখান থেকে সবচেয়ে বেশি বই কিনেছি। তবে এবারের মেলায় এখন পর্যন্ত কেনা প্রায় সব বই-ই শুদ্ধস্বর আর বাংলা একাডেমীর। আমার মত দিনমজুরদের জন্যেই মনে হয় বাংলা একাডেমী এবার রেশনের চালের মতো পঞ্চাশ শতাংশ ছাড়ে অনেক ভাল ভাল বই দিচ্ছে। যদিও বইগুলো অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। সম্ভবত নতুনভাবে ছাপানোর উদ্দেশ্যে আগের বইগুলো এভাবে দিয়ে দিচ্ছে।
মূলত তারেকের বদৌলতে সচলায়তনের অনেক সাম্প্রতিক লেখক এর চেহারা দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। বই এর লেখা যতই প্রীতিকর হোকনা কেন, লেখার কারিগর কেনজানি আমার কাছে চরম ভীতিকর একটা বস্তু। সবসময় কোনো স্টলে যাবার আগে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করি কোনো লেখক আছেন কিনা। মনুষ্যজাতির এই অদ্ভুত কল্পনাশক্তির প্রজাতিটিকে আমার কেনজানি সর্বদাই অপরিচিত কিন্তু শ্রদ্ধেয় ভাবতে ভাল লাগে। তাকে পাশে দেখলে ভয় আর অস্বস্তি লাগে। তাই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। আর এ কারণেই মোড়ক উন্মোচনের জায়গায় বটের ছায়াতলে আমি যাইনা। তাঁর সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তাঁর লেখনী। তবে গতকাল বরবাদ তারেকের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেলাম। মৌ, সুহান আর সবুজবাঘের পাশে দাঁড়ানোর ভীতিকর অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। সবজান্তা আর তারেককে ভয় পেলেও তারা আমার বন্ধু বিধায় একটু ছাড় আছে। আগে জানলে কি আর এমন অকাটমূর্খ এহেন বুদ্ধিজীবির সাথে সখ্য গড়তে যায়? আপনভাল তো পাগলেও বোঝে।
এইকয়দিন ঘুরে ঘুরে দুইটা বিরক্তিকর উপদ্রব চোখে পড়েছে আমার। এক, মিডিয়ার তোষামোদকারী চিড়িয়াগুলো আর দুই, রংতুলি নিয়ে ঘুরঘুর করা কতিপয় রংবাজ। পারতপক্ষে আমি এদের ছায়াও মাড়াই না। কিন্তু গতকাল একসময় আফসার ব্রাদার্স এর স্টলে একটা বই দেখছিলাম। খেয়াল করিনি। হঠাৎ পাশের স্টল থেকে আওয়াজ ভেসে আসে,
· আপনি বইমেলায় কী কারণে এসেছেন? (ছাগল, বইমেলায় কী জন্যে আসে জানোনা?)
· আপনি এবারের বইমেলাকে কীভাবে দেখছেন? (কী আর বলব?)
· বইমেলায় কয়টা বই কিনলেন? (কয়টা শুনলে কাটতি বাড়বে? তাছাড়া এখনও তো মেলা কেবল শুরু, তুমি কয়টা কিনছ শুনি?)
· বইমেলা থেকে আপনি কী আশা করেন? (আপনি সরেন)
আজব চিড়িয়ার কথার ঢং আর অঙ্গভঙ্গিতে এতটাই হাসি আসছিল যে বলির পাঁঠার উত্তরগুলো শোনার আর অবকাশ পাইনি। তাছাড়া কোলাহলও ছিল। অনেকে আবার এই তামশা দেখার জন্যে চিড়িয়ার পিছে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। তাড়াতাড়ি এই কয়টা প্রশ্ন কোনোমতে হজম করে কেটে পড়লাম সেখান থেকে।
এরপরে আছে রংবাজগুলো। সবাই না, কিন্তু কিছু এসে যেন যেচে রঙ করে দিতে চায় মুখে। যেন রংমাখতেই এসেছি এখানে, একটু পরে হোলিউৎসব শুরু হবে। আর একটা বিষয় আমার কাছে খারাপ লেগেছে। ভাষাশহীদদের ভাস্কর্যের সামনে যেভাবে মডেলিং আর ফটোসেশন চলছে, তাতে সামান্য হলেও কি একুশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছেনা? তাঁরা আমাদের গর্ব, সম্মান আর অহংকারের বিষয়। আর তাই সে ভাস্কর্যের প্রতিও আমাদের শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। কিন্তু দেখছি ইচ্ছেমত, হেলেদুলে, রীতিমতো পোজ দিয়ে সেখানে ফটোবাজি চলছে। তার সামনে ছবি তুলুক, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু সেখানে শ্রদ্ধাবোধের সাথে থাকা উচিত। এটা কোনো মডেলিং এর ইন্টেরিওর নয়, মনে রাখতে হবে সবাইকে।
লেখক আড্ডার জায়গাটাকে রীতিমত সুসজ্জিত একটা খোঁয়াড়ঘর মনে হল আমার। কতিপয় বিশিষ্ট ব্যাক্তি সেখানে আটকে আছে যেন। তারা বিরস বদনে এদিকে ওদিকে দেখছে, মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে, আর একটু পরপর চা চিবাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে জোর করে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের সেখানে। তাদের কষ্ট দেখে আমার মায়া লাগল একটু।
বই আর বইমেলা নিয়ে লিখতে গেলে সময় হয়ত শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু লেখা ফুরোবে না। আরও আসব। আরও হয়ত নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা হবে। লেখক, পাঠক আর তার যোগসূত্র এই মিলনমেলা চলতে থাকুক। তাতে কিছুটা হলেও আমার মত ফাঁপা কলসীর কিছু লাভ হবে। কিছু হয়ত ভেতরে পানি নিতে পারব। সচলায়তনের লেখকদের পড়ার বিস্তৃতি দেখে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। কী করলাম এ জীবনে। বাংলাদেশের গড় আয়ু হিসেবে প্রায় অর্ধেক জীবন শেষ। অথচ পড়েছি কত নগন্য পরিমাণ। আমার কিছু বন্ধু যেমন আদনান, তানিম, মনসুর, রকিব, তারেক আর সচল সবজান্তার সঙ্গে কিছু ঘুরে এই হতাশা আরও পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। তারা বিভিন্ন বই নিয়ে কথা বলে, আর আমি বলদের মত হাঁ করে শুনি। আমি যেগুলোর কথা বলি সেগুলো তারা মাতৃগর্ভেই পড়ে এসেছে। বলদই থেকে গেলাম, কলুর বলদও হইলামনা। কী আফসোস! এখন আমার দরকার সময়মেলা। যেখানে অনেক সময় পাওয়া যাবে, শুধু বই পড়ার জন্যে।
-অতীত
মন্তব্য
আর তারেক ভাই লোক খ্রাপ এনার সাথে বেশি ঘোরাঘুরি না করাই ভাল
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
হ, আমিও আগে বুঝি নাই, আগে জানলে আগেই হলের রুম এফিডেভিট কইরা ফেলতাম
-অতীত
হুম, তারেক জ্যোতি, কদু, মউ এদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি না করাই ভালো! এরা মনে হতাশার জন্ম দেয়!
লেখা ভাল্লাগলো। আরো লিখুন।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
আপনার সান্ত্বনা পেয়ে ভাল লাগছে এখন একটু
-অতীত
বইমেলার দাজ্জাল হিসেবে দাজ্জাল বিক্রেতারা আবির্ভূত হয়েছেন। দুই পা এগোলে তিনটে করে দাজ্জাল এসে হাত বাড়িয়ে দেয়...
কবি চর্মাবৃত উন্মাদ জনাব ত্রেক্রহিমের সাথে চলাফেরা করেন জেনে আপনার জন্যে সহানুভূতি রইলো।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে ত্রেক ব্যাটায় একটা আস্ত অগার, পূর্বজন্মে শ্রেক এর জাতভাই ছিল
-অতীত
---------------------------------
Sad Songs
-অতীত
বইমেলা কড়চা ভাল্লাগলো, তবে আপনার সাথে তাড়েক ভাইয়ের দহরম মহরম আছে জানলে লেখাটা পড়তামনা
--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
ক্যান ভাই, সব দুষ তো ত্রেকের, আমি কী করলাম?
-অতীত
বেশ ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ সবুজ পাহাড়ের চিরসবুজ রাজা
-অতীত
নতুন মন্তব্য করুন