আদালতের বিচারকাজ বর্ণনা করতে মাত্র দুটো শব্দ যথেষ্ট, "সংক্ষিপ্ত" এবং "নাটকীয়"। প্রধান সাক্ষী হিসাবে ছিল জ্যানেট ম্যাকেঞ্জি, মৃতের গৃহপরিচারিকা, এবং রোমেইন হেইলজার, অষ্ট্রিয়ার নাগরিক, অভিযুক্ত আসামীর উপস্ত্রী। রোমেইন হেইলজারের সদা সত্য বলার প্রহসন মেহার্ন সাহেব চুপ করে শুনলেন শুধু। ভোলের বাসায় যেরকম কাহিনি সাজিয়েছিল, একই ধারাতে সে নিজের বক্তব্য পেশ করল। আত্মপক্ষ সমর্থনের তারিখ নেওয়ার মধ্য দিয়ে মেহার্ন আর লিওনার্দো ভোলের দুর্ভোগের অবসান হল সেদিনের মতো।
মেহার্ন সাহেব সম্পূর্ণভাবে অসহায়। কোন সাক্ষী, কোন যুক্তিই তাঁর মনঃপুত হচ্ছে না। লিওনার্দো ভোলের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতভাবেই অন্ধকারের দিকে ডুবে যেতে বসেছে তাঁর চোখের সামনে দিয়ে। শেষ একটা সম্ভাবনা উকিল সাহেব গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন, ভোলের সততার উপর ভিত্তি করে উনি খতিয়ে দেখবেন জ্যানেট ম্যাকেঞ্জি কার কণ্ঠ শুনে থাকতে পারে সাড়ে নয়টায়।
মিস ফ্রেঞ্চের এক তিলে খচ্চর ভাগ্নে পৃথিবীর কোনো এক কোনায় পড়ে আছে। জ্যানেট ম্যাকেঞ্জির কাছ থেকে উকিল সাহেব জেনেছেন যে এই ছেলে তার মনিবকে সবসময় চাপ দিত টাকার জন্য। কয়েক বছর পরপর এসে খুব চোটপাটও নাকি দেখাতো। হতে পারে যে সেই ছেলে এসেছিল ভোল বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরে। সেই ছেলেকে তার নিজস্ব আস্তানায় পাওয়া যাচ্ছে না, গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা যদি হয়, তাহলে এটা ভোলের জন্য বড় আশার কথা। তারপরেও এত অল্প সময়ে সেই ছেলেকে পাওয়া না গেলে বিপদ। লিওনার্দোকে কেউ তার নিজের বাসায় ঢুকতে দেখেনি, বা মিস ফ্রেঞ্চের বাসা থেকে বের হতেও দেখেনি। অন্য কোনো মানুষকে ক্রিংক্লউডের বাসাটাতে ঢুকতে দেখা যায়নি।
পরবর্তী বিচারের ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় মেহার্ন সাহেব চিঠিটা পেলেন। কাঁচা হাতে লেখা চিঠিটা তাঁর চিন্তাধারাকে সম্পূর্ণ অন্যদিকে নিয়ে গেল। সন্ধ্যা ৬টার ডাকে আসা একটা চিঠি, অসংখ্য ভুল বানান, আর ময়লা একটা কাগজে লেখা। মেহার্ন সাহেবকে দুইবার পড়তে হোল নিজেকে ঠাণ্ডা করার জন্য।
উকিল সাহেবঃ
আপনে তো ওই পোলাডার উকিল। আপনে যদি ওই বদ মাইয়াডার কায়কারবার যানতে চান তাইলে পরে এই ঠিকানায় আইজকে রাতিরে আসপেন ১৬ শ'স রড। ২০০ টাকা খরচা বাবদ নিয়ে আসপেন। এটা মিসেস মগসনের বাসা।
উকিল সাহেব আরেকবার পড়লেন এই অদ্ভুত চিঠিটা। প্রথম ধাক্কায় উনি ধরেই নিয়েছিলেন যে এটা প্রতারণার কোনো কৌশল। কিন্তু তারপরেই আবার ভাবলেন, এই চিঠি যদি সত্যি হয় তাহলে এই সূত্র থেকে পাওয়া কোনো তথ্য তো তাঁর মক্কেলের কাজেও আসতে পারে। রোমেইন হেইলজারের সাক্ষী তাঁর সব যুক্তির সব রাস্তা আটকে দিয়েছে। এই মহিলার অনৈতিক কোনো আঙ্গিক যদি সবার সামনে তুলে ধরা যায় তাহলে একটু হলেও মামলায় একটা নাড়া দেওয়া যাবে। মেহার্ন সাহেব ঠিক করলেন তিনি যাবেন এই অদ্ভুত চিঠির লেখকের সাথে দেখা করতে। মক্কেলকে যে কোন মূল্যে বাঁচানো একজন উকিলের কর্তব্য।
বাড়ীটা খুঁজে পেতে একটু কষ্ট হোল, ঘুপচি এক বস্তির মধ্যে ভাঙ্গাচোরা একটা বিল্ডিং। চারদিকে কেমন যেন অপরাধের একটা গন্ধ। মিসেস মগসনের খোঁজ করতে তিনতলার একটা ঘর দেখিয়ে দেয়া হোল তাঁকে। প্রথমে কড়া নেড়ে কোন উত্তর পাওয়া গেল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার কড়া নাড়লেন উকিল সাহেব। এবার ভেতর থেকে একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, দরজাটি খুব সন্তর্পণে সামান্য একটু ফাঁক করে ভিতর থেকে কেউ একজন উঁকি দিল। দরজাটা আরো খুলে গেল, ভিতরে আবছা অন্ধকারে দাঁড়ানো একজন মহিলা।
"আপনে আসছেন তাইলে" খ্যান খ্যানে গলায় বলল মহিলাটি। "সাতে আর কেউ আসেনি? না তো। আসেন আসেন, বিতরে আসেন।"
খানিকটা অনিচ্ছা নিয়ে মেহার্ন সাহেব নোংরা, অনুজ্জ্বল ঘরটার চৌকাঠ পার হলেন। জ্বলন্ত চুলা আর একটা মিটমিটে বাল্ব ঘরের অপ্রতুল আলোর উৎস। এক কোনায় একটা এলোমেলো বিছানা, ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল আর অতি জীর্ণ দুটি চেয়ার। মেহার্ন সাহেব তাঁর মনোযোগ ফেরালেন মহিলাটির দিকে। প্রৌঢ়া, কুঁজো শরীর, মাথা ভর্তি আলুথালু কাঁচাপাকা চুল, মুখের বেশিরভাগটাই ওড়না দিয়ে ঢাকা। মহিলাটি আবারো সেই বিশ্রীভাবে হেসে উঠলো, "ভাবতেসেন আমার এত সোন্দর চেহারা লুকায় রাখসি ক্যান, হ্যা? দ্যাখাই, খাড়ান।"
মুখের উপর থেকে ওড়না সরাতেই উকিল সাহেব নিজের অজান্তেই শিউরে উঠলেন বিকৃত পোড়া চেহারাটা দেখে। মুখটা আবার জলদি ঢেকে নিলো মহিলাটি। "চেহারা পসন্দ হয়নি?" আবার সেই খিক খিক হাসি। "কিন্তু আমিও সময়কালে সোন্দর ছিলাম। ওই শয়তানটা এই কাজ করসে। কিন্তু এইবার আমি পিতিশোদ -"
মহিলা খিস্তির ঝাঁপি খুলে বসলো যেন, উকিল সাহেবের কান গরম হয়ে উঠলো সেই অশুচি কথার তোড়ে। অবশেষে মুখ বন্ধ করলো মহিলা, কিন্তু উত্তেজনায় হাতের শক্ত মুঠ তখনো কাঁপছে।
"অনেক হয়েছে," উকিল সাহেব এবার কঠিন গলায় বললেন। "আমি এখানে একটা কাজে এসেছি। আপনি আমাকে কিছু তথ্য দিতে পারবেন, চিঠিতে সেরকমই বলেছিলেন। লিওনার্দো ভোলের উপকারে আসতে পারে এমন কিছু।" মহিলার চোখ উকিল সাহেবের দিকে বেশ কিছুক্ষণ আটকে থাকল।
"আমার ট্যাকা আনসেন? দুইশত ট্যাকা আনতে বলসিলাম না।"
"আপনি বলছিলেন আমাকে কিছু তথ্য দিবেন। আমি তার মূল্য পরিশোধ করবো।"
"তা কি আর হয়। আমি বুড়া ধুড়া মানুষ, আমি কীইবা আর জানি। দুইশত ট্যাকা দিলে আমি এট্টু আট্টু বলতে পারি যে খবর কোথায় পাওয়া যাবে।"
"কী রকম খবর।"
"কয়েকটা চিডি আর কি! মাইডার চিডি। আমি কীভাবে পাইলাম, অইটা আর জিগায়েন না, কমু না, অইটা আমার ধান্ধা। কিন্তু আমার ট্যাকা চাই।"
মেহার্ন সাহেব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে বললেন, "আমি আপনাকে দশ টাকা দিব, এর থেকে এক পয়সাও বেশি না।"
"দশ ট্যাকা?" মহিলা চিৎকার করে প্রায় তেড়ে আসলো।
"ঠিক আছে, বিশ টাকা, কিন্তু এটাই আমার শেষ কথা।" বলে উনি দরজার দিকে পা বাড়ানোর একটা ভান করলেন। মহিলা কিছু বলছে না দেখে মেহার্ন সাহেব পকেট থেকে একুশ টাকা বের করে বললেন, "আমার কাছে এই সব আছে। নিলে এটাই নিতে হবে, নাহলে আমি যাচ্ছি।"
সামনে টাকা দেখে মহিলার ভাবে পরিবর্তন চলে এসেছিল ততক্ষণে। নীচুস্বরে আবার কিছু গালমন্দ করে সে বিছানাটার দিকে এগিয়ে গেল, ছেঁড়াখোঁড়া জাজিমের তলা থেকে বের করল কিছু একটা।
"নেন, ধরেন!" মহিলার গলায় চরম বিরক্তি। "উপরেরটা আপনের কাজে লাগব।"
চিঠির বান্ডিল। বাঁধা ফিতা খুলে মেহার্ন সাহেব খুব যত্ন নিয়ে ভাবলেশহীন মুখে প্রত্যেকটা চিঠি পড়লেন। সবকয়টি পড়া হয়ে গেলে উনি প্রথম চিঠিটা আবারো পড়লেন। কয়েকটা প্রেমপত্র, রোমেইন হেইলজারের লেখা, কিন্তু লিওনার্দো ভোলকে উদ্দেশ্য করে নয়। ভোলকে যেদিন গ্রেফতার করা হয় সেদিন লেখা হয় শেষ চিঠিটা।
"দেখলেন তো আমি সত্য কইসিলাম।" খনখনে গলায় বলল সে। "ওই ডাইনীটা এইবার মজা বুঝবো।"
মেহার্ন সাহেব কাগজগুলো পকেটস্থ করল। "এগুলো আপনি কোথায় পেলেন?"
মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানালো, "আমি আরও জিনিষ জানি। সেইদিনকা ওই ছেমরি আদালতে কইলো দশটা পরে বাসায় ছিল। লায়ন রোডের সিনামা হলে খোঁজ নিয়া দ্যাখেন। অদের মনে থাকবে - এত রঙঢঙ করলে সবার মনে থাকে।"
"চিঠিগুলো ম্যাক্স নামের একজনকে লেখা। এই লোকটা কে, জানেন?" মেহার্ন সাহেব জানতে চাইলেন।
প্রশ্নটা মহিলাকে বেশ নাড়া দিল। তার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে উঠলো, সাথে বদ্ধ মুঠি কাঁপতে লাগলো। অবশেষে সে কথা বলল।
"ওই লোকটা আমার এই সব্বনাশ করসে। অনেক বচ্ছর আগের কথা। ওই ডাইনীটা অরে আমার কাছ থাইক্যা নিয়া গিসে - এক্কেরে বাচ্চা একটা মাইয়া ছিল তখন। আমি ফিরাইয়া আনতে চাইসি অরে - অনেক কইসিলাম - কান্নাকাটি করসি। শয়তানটা রাগ দ্যাখায়া আমারে পুড়ায় দিল! মাইয়াডা তখন হাসতেসিল! অনেক বচ্ছর আগের কথা - কিন্তু আমার নজর সরাই নাই। এদ্দিনে পাইসি। এইবার পস্তাইবো! মাইয়াডার জেল হইব না, উকিল সাব?"
"মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার অপরাধে এক বছরের জেল হবে।" শান্ত কণ্ঠে বললেন মেহার্ন সাহেব।
"তাই সই! আপনে যাচ্ছেন গিয়া? আমার ট্যাকা দিলেন না তো! আমার ট্যাকা কই?"
আর কথা না বাড়িয়ে মেহার্ন সাহেব একুশ টাকা ভাঙ্গা টেবিলের উপর রেখে হাঁটা দিলেন। উনার ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই মহিলাটি টাকার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
নোংরা বস্তি এলাকা থেকে বের হয়ে উনি সোজা চলে আসলেন লায়ন রোডে, সিনেমা হল খুঁজে পেতে বেগ পেতে হোল না মোটেই। একজন টিকেট বিক্রেতা রোমেইন হেইলজারের ফটো দেখে শনাক্ত করতে সময় নিলো না। সেদিন রাতে এক ব্যক্তির সাথে এসেছিল রোমেইন, দশটার শো দেখতে। লোকটাকে আলাদাভাবে মনে না থাকলেও রোমেইনকে মনে আছে ঠিকই।
এতক্ষণে শান্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মেহার্ন সাহেব। রোমেইন হেইলজার মাথা থেকে পা পর্যন্ত মিথ্যা দিয়ে ঢাকা। খুব সম্ভবত ভোলের প্রতি তার প্রচণ্ড ঘৃণা থেকে এসবের সূত্রপাত। কিন্তু এত ঘৃণা পাওয়ার মতো ভোল এমন কী অবিচার করেছে রোমেইন প্রতি? লিওনার্দো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি, যখন মেহার্ন সাহেব প্রথম রোমেইনের আচরণের কথা বলেছিল তাকে। তার পরেও মেহার্ন সাহেবের কেন যেন মনে হচ্ছিল, ভোল কিছু একটা লুকাচ্ছে। লিওনার্দো এবং রোমেইনের ভিতরের রহস্য বোধহয় সারাজীবন চাপা পড়ে থাকবে। কখনও জানা হবে না ভেবে আফসোস হোল মেহার্ন সাহেবের। ঘড়িতে তখন অনেক বাজে। জলদি একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়লেন তিনি, কালকের জন্য তাঁর অনেক কাজ জমে গেল।
এমিলি ফ্রেঞ্চের খুনের বিচার চারদিকে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। প্রথমত প্রধান আসামী বয়সে তরুণ এবং সুদর্শন, দ্বিতীয়ত রোমেইন হেইলজারের মতো এক চরিত্র যাকে নিয়ে অনেক রহস্য গল্প ফাঁদা যায়। এর মধ্যেই পত্র পত্রিকাগুলো রোমেইনের ফেলে আসা জীবন নিয়ে উড়া খবর ছাপাতে শুরু করেছে।
পরেরদিন আদালতে নিয়মানুযায়ী বিচারকাজ শুরু হোল। প্রথমে কিছু কৌশলগত প্রমাণাদি পেশ করা হোল। তারপর জ্যানেট ম্যাকেঞ্জি এসে দাঁড়ালো কাঠগড়ায়। আসামী পক্ষের উকিল অতি নৈপুণ্যের সাথে জ্যানেটকে বেশ কয়েকবার বিভ্রান্ত করে তার নিজের বক্তব্যের সাথে দ্বিরুক্তি প্রকাশ করতে বাধ্য করলেন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে জ্যানেট একজন লোকের কণ্ঠস্বর শুনেছে কিন্তু কাউকে দেখেনি; এবং লিওনার্দো ভোলের উপর জমা হওয়া বিরক্তি তার সাক্ষ্যকে প্রভাবিত করেছে।
পরের সাক্ষীকে ডাকা হোল। বাদীপক্ষ জেরা শুরু করলেন।
"আপনার নাম রোমেইন হেইলজার?"
"জ্বী।"
"আপনই অষ্ট্রিয়ার নাগরিক?"
"জ্বী।"
"গত তিন বছর আপনি লিওনার্দো ভোলের স্ত্রী হিসাবে থেকেছেন?"
রোমেইন এক পলকের জন্য লিওনার্দোর দিকে তাকাল। "জ্বী।"
একের পর এক প্রশ্ন চলতে থাকল। রোমেইন হেইলজার বলতে লাগলো কীভাবে লিওনার্দো সেদিন তাদের শাবলটি নিয়ে গেছিল। দশটা বিশে তার বাসায় ফেরা, শার্টের হাতায় রক্তের দাগ। শার্ট চুলায় পুড়ানো হয়। এমিলি ফ্রেঞ্চকে খুনের কথা রোমেইনকে তখনই জানায় এবং নিজের প্রাণের ভয়ে রোমেইন কিছু করতে পারেনি।
আদালতে যে দুই একজন লিওনার্দোর পক্ষে একটু নরম ছিল, মিস হেইলজারের সাক্ষীর কারনে সব এক ধাক্কাতে উড়ে গেল। মেহার্ন নিজেও মাথা নিচু করে রেখেছিলেন আপাতহারের চিহ্নস্বরূপ। বাদীপক্ষ শেষে মেহার্ন সাহেব উঠলেন, এবার তাঁর পালা। শুরুতেই উনি বললেন রোমেইন হেইলজারের প্রতিটি সাক্ষ্য মিথ্যা, বানোয়াট। এমনকি সে যেরকম বলছে যে সে দশটা বিশে বাসায় ছিল, সেই সময় সে বাসাতে পর্যন্ত ছিল না। সর্বোপরি, রোমেইন হেইলজার খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভোলকে দোষী সাজাচ্ছে এমন একটি অপরাধের জন্য, যেটা সে করেইনি।
অতি অবশ্যই রোমেইন উকিল সাহেবের প্রতিটি অভিযোগ অস্বীকার করলো। মেহার্ন সাহেব এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, এত সব নাটকীয়তার শেষ অংকটি, উনি রোমেইনের লেখা চিঠিগুলো বের করলেন, সবাইকে পড়ে শোনালেন ম্যাক্সকে লেখা রোমেইনের শেষ চিঠিটা।
প্রিয়তম ম্যাক্স, এতদিনে ভাগ্যদেবী আমাদের দিকে চেয়েছেন। আজ ওকে খুনের অপরাধে ধরে নিয়ে গেল - ওই বুড়িকে খুনের অপরাধে। লিওনার্দো, যে কিনা একটা মাছি পর্যন্ত মারে না! আমি আমার প্রতিশোধ নিতে পারলাম। আমি ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিব, বলব যে লিওনার্দো আমার কাছে স্বীকার করেছে খুনের কথা। ও মরার আগে জানবে রোমেইন ওকে ফাঁসীর দড়িতে ঝুলিয়েছে। আমাদের মধ্যে আর কোন বাঁধা থাকবে না। অবশেষে আমরা এক হতে পারবো।
চিঠিটা যদিও লেখা বিশারদকে দেওয়া হয়েছিল হাতের লেখা মিলিয়ে দেখার জন্য, তার আর কোন প্রয়োজন ছিল না। চিঠির উপস্থিতিতেই রোমেইন ভেঙ্গে পড়ে। স্বীকার করে নেয় লিওনার্দো নয়টা বিশে বাসায় ফিরেছিল। তার বলা পুরো গল্প বানোয়াট। রোমেইনের সাথে সাথে পুরো মামলাটাও ভেঙ্গে পড়ে। এরপর যা হয় তা শুধু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। উভয় পক্ষ তাদের শেষ বক্তব্য দেওয়ার পর, জুরীবৃন্দ মামলার রায় ঘোষণা দেন -
"লিওনার্দো ভোলকে নির্দোষ সাব্যস্ত করা হোল।"
লিওনার্দো ভোল বিনা দোষের সাজা থেকে মুক্তি পেল। মেহার্ন সাহেব এগিয়ে গেলেন তাঁর মক্কেলের কাছে। কে যে কাকে বেশি অভিনন্দন জানালো ঠিক বোঝা গেল না।
সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে আসলে, মেহার্ন সাহেব নিজের অফিসে এসে বসলেন, এতো বড় ধকল অনেকদিন পর তাঁর উপর দিয়ে গেল। মাত্র কয়েকটা দিন, কত ঘটনা। উনি ভাবছেন আর স্বভাবসিদ্ধভাবে চশমা পরিষ্কার করছেন। অভ্যাস, গত রাতেই উনার স্ত্রী তাঁর এই অভ্যাসটার কথা বলছিল। খুব অদ্ভুত এই জিনিষ, অভ্যাস, নিজের অজান্তেই মানুষকে পেয়ে বসে।
খুব চাঞ্চল্যকর একটা মামলা ছিল। একই কথা রোমেইন হেইলজারের প্রতিও খাটে বই কি!
সত্যি বলতে পুরো মামলাটি এই মহিলাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল। প্যাডিংটনের বাসায় তাঁর শান্ত-ক্লান্ত রূপটি দেখেছে, একই মানুষ আদালতে সাক্ষী দিতে কী শক্ত একটা রূপ ধারণ করলো। চোখ বন্ধ করলে এখনো মেহার্ন সাহেব দেখতে পান কাঠগড়ায় দাঁড়ানো রোমেইন হেইলজারকে। দীর্ঘাঙ্গী, উদ্বেলিত মনকে সামলাতে শরীরটা একটু সামনে ঝুঁকে আছে, হাত দুটো মুঠো করে ধরেছে, কাঁপছে একটু একটু।
অভ্যাস খুব অদ্ভুত একটা জিনিষ। রোমেইনের এই হাত মুঠ করাটা হয়ত তার অভ্যাস, মেহার্ন সাহেব নিজের মনেই ভাবলেন। কিন্তু তিনি মনে হয় এটা আগেও দেখেছেন - অন্য কাউকে করতে দেখেছেন - কিছুদিনের মধ্যেই। কাকে দেখেছেন? কিছুদিনের মধ্যে -
চমকে উঠলেন মেহার্ন। ভাঙ্গা বাড়ীর সেই মহিলাটি...
তাঁর মাথা ঘুরে উঠলো। এটা হতে পারে না - অসম্ভব - কিন্তু রোমেইন হেইলজার একজন অভিনেত্রী।
মেহার্ন সাহেব ছুটলেন। রোমেইনের সাথে তাঁর দেখা করতে হবে, এখুনি। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনি দেখা পেলেন, স্থানটি মোটেও উল্লেখ্য নয়।
"আপনি ধরে ফেলেছেন," সে বলল, উকিল সাহেবের কাছ থেকে সব শোনার পরে। "পোড়া মুখটা! অল্প আলোতে ওই সামান্য মেকাপেই কাজ হয়ে গেছে।"
"কিন্তু কেন - কেন -"
"কেন আমি একা এই পথ চলার সিদ্ধান্ত নিলাম? তাই জানতে চাচ্ছেন?" হাল্কা হেসে বলল রোমেইন। মেহার্ন সাহেবের মনে পড়ল শেষ কখন এই কথাটা তিনি শুনেছিলেন।
"এত নাটক কেন!"
"প্রিয় উকিল সাহেব - আমার তো ওকে বাঁচাতে হতো। একজন অনুগত স্ত্রীর সাক্ষ্য আদালত মানবে না - আপনি নিজেই সেটার আভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি আমজনতার মন জানি। একই কথা যদি আমার ভিতর থেকে টেনে বের করা হয়, সবার সামনে হেয় করে আমার বলতে বাধ্য করা হয় - সেটা আসামীর পক্ষে চলে যাবে।"
"ওই চিঠিগুলো?"
"ওগুলো লিখতে আর কী লাগে।"
"ম্যাক্স কে?"
"কেউ নেই।"
"আমার এখনো মনে হয়," মেহার্ন সাহেব বেশ অপমান আর অভিমান মিশ্রিত গলায় বললেন, "আমরা স্বাভাবিক নিয়মে ভোলকে বের করে আনতে পারতাম।"
"আমি সেই ঝুঁকি নিতে চাইনি। দেখেন, আপনি ভেবেছিলেন যে সে নির্দোষ -"
"আমি ভেবেছিলাম আর আপনি জানতেন? বুঝতে পেরেছি।" বললেন মেহার্ন সাহেব।
"প্রিয় মেহার্ন সাহেব," রোমেইন মিষ্টি হেসে বলল, "আপনি কিছুই বোঝেননি। আমি জানতাম - যে সেই খুনি।"
-রু
মূল বইঃ The Witness for the Prosecution
মন্তব্য
ভাল লাগছে।
--------------------------
Sad Stories
ধন্যবাদ। -রু
অগাথা ক্রিস্টির নামটিও জুড়ে দিন।
অনেক আগে সেবা প্রকাশনীর কোন রহস্য রোমাঞ্চ গল্প সংকলনে বা, রহস্য পত্রিকায় এই গল্পের অনুবাদ বের হয়।
আপনার অনুবাদও সেরকম হয়েছে।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ট্যাগে ক্রিস্টির নাম দিয়েছি। নিচে আরেকবার দিলে আসলে ভালো হত। -রু
আগের পর্বের অনুবাদ এই পর্বের চেয়ে বেশি ভাল লেগেছিল। অনুবাদে একটু তাড়াহুড়ো করার ছাপও পেলাম মনে হয়।
মনে হয় বুঝতে পারছি কী বলতে চাচ্ছেন। যদি কোনদিন হাচল হই তবে একটু ঘষামাজা করে দিব। পড়ার জন্য ধন্যবাদ। -রু
ভাল লাগলো, আরেকটু মন দিয়ে অনুবাদটা করলে আরো উপাদেয় হতে পারত।
জুলফিকার আলি
নতুন মন্তব্য করুন