তোমাদের এই নগরে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/০২/২০১১ - ১০:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তোমাদের এই শহরে একদা একটি রাস্তার পাশে একটি নাম না জানা বৃক্ষ ছিল। ইঠ-কাঠ-বালিতে ঠাসা এই শহরে রাস্তার পাশে বৃক্ষ থাকা নিতান্তই বেমানান। বৃক্ষ থাকবে না, থাকবে শুধু কিছু কান্ডহীন পাতাবাহারের সমাহার। তাও থাকবে রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডার কিংবা আইল্যান্ডে। অন্য কোথাও থাকার সুযোগে নেই। মানুষ সভ্যতার সবটুকু আবর্জনা নিজে শোষণ করে না কখনও। ফেলে যায় সেসব পাতার উপর জমে থাকা ধূলোর আস্তরণে প্রতিদিন। সময়ের ঘূর্ণিচক্রে তা মাটিতে মিশে যায়, হয়ত ফাল্গুনের শুরুতে কিংবা বর্ষার শেষে। এ শহরের পৃষ্ঠদেশ পুরোটাই প্রায় কংক্রিটের বর্মে আচ্ছাদিত। এ শহরের মাটিকে মানুষ সূর্যালোকের স্পর্শ দেয়না। সে পায়না কোনো বৃষ্টির স্নিগ্ধতা, বাতাসের ঘ্রাণ, বৃক্ষের শিকড়ের বাহুডোর, ফুলের পবিত্রতার ছোঁয়া। মাটির অপেক্ষায় অভাবে আস্তে আস্তে সেগুলো পচে গলে গলে গড়িয়ে যায় নর্দমার ঢাল বেয়ে, মানুষের উচ্ছিষ্টের সাথে। নর্দমাগুলো সে উদ্দেশ্যেই তৈরি।

তারপরও কীভাবে জানি এই বৃক্ষটা রাস্তার পাশে ঐ জায়গাটায় আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে ছিল। দুইপাশে ঠিকই দুইটা বহুতল ভবন। এবং আশপাশে প্রায় পুরোটাই বাণিজ্যিক ভবনে ঠাসা। কিছু ফাস্টফুডের দোকান, কিছু শপিং মল, কিছু আবাসিক ভবন, দু’একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভবন, কিছু অফিস প্রভৃতি ধরনের বিল্ডিং এ সয়লাব রাস্তার দুইপাশ। এর মাঝেই এক ছোট্ট ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে সেটা। কেউ বলতে পারেনা কী গাছ ওটা? কিংবা ওর ইতিহাস। এখানেই বা কেমন করে এলো? শক্ত কংক্রিট ফেঁড়ে মাটির সন্ধান কীভাবে পেলো? কিন্তু সবার নজর ঠিকই যায় এই রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে। রাস্তার উপর সযত্নে তারা ছায়া ফেলে রেখে মানুষের কাছে সারাদিন তার উপস্থিতি ঘোষণা করে চলে নীরবে। ছুটে চলা মানুষগুলোর গায়ে ইতস্তত কাঁপতে থাকে তা সেইসময়। রাতে তেমন সুবিধা করতে পারেনা। সোডিয়াম বাতি আর গাড়ির হেডলাইটের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারেনা। মাঝরাতের পরে, যখন নাগরিক ব্যস্ততা আশ্রয় নেয় ঘুমের ছায়াতলে ধীরে ধীরে; তখন সে খেলা করে জোছনার সাথে, বাতাসের সাথে, অন্ধকারের সাথে, মানুষের অভাবে ঝিমিয়ে পড়া সোডিয়াম বাতির সাথে। মানুষগুলো অযথাই সারাদিন খাটাখাটুনির পরে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন খুজে বেড়ায়, ভাবে সে। স্বপ্ন তো তখন ঘুমের মধ্যে নাই, সে খেলতে বেরিয়েছে আমার সাথে। আমার কাছে এসো, স্বপ্ন নিয়ে যাও। হাঁকপাড়ে সে। তার সে নীরব ভাষা চোখ বুজে থাকা মানুষগুলো দেখতে পায়না। বন্ধ দরজা-জানালা আর কখনও কখনও গেটে প্রহরারত দাড়োয়ান আর এলসেশিয়ান এর কারণে স্বপ্নগুলোও ভয়ে ভেতরে যায়না। সানন্দে নির্ভয়ে খেলতে থাকে বৃক্ষের সাথে।

মানুষগুলোও তাকে দেখে প্রতিনিয়ত একটু অবাক হয়। ঠিক এই পরিবেশে তাকে মানায়না। এমন গতিশীল জীবনে এমন স্থির একটি সত্তা তাদের প্রতিদিন দেখে চলেছে। ভাবতে কেমন অস্বস্তি লাগে। তবে বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে তারা কেমন যেন একটা প্রশান্তি পায়। জানালার কাঁচ দিয়ে মানুষ অবলোকন করে চলে তাকে। অফিসের পিওন দেখে, বস্‌ দেখে, ভার্সিটির ছেলে-মেয়ে দেখে, দোকানের কর্মচারী দেখে, ঘরে থাকা গৃহবধু দেখে, আর দেখে রাস্তায় চলমান মানুষ। ঠাসবুনটের ভীড়ে সেই বৃক্ষ তাদের নিঃসঙ্গ দীর্ঘশ্বাসকে সঙ্গ দিয়ে চলে। বিক্ষিপ্তভাবে মানুষেরা খুজে চলে শৈশবের অবারিত মাঠ, মাটির পরশ, মুক্তি, ভালবাসা, নির্ভরতা, মমতা, আপনজন, স্বপ্নের পৃথিবী সেই বৃক্ষের প্রতিচ্ছবিতে। শত মানুষের ভীড়ে হেঁটে চলা প্রতিটি মানুষ একা, অপরিচিত এবং বেওয়ারিশ এই বৃক্ষের প্রতিবিম্বে খুঁটে খুঁটে আবিষ্কার করে আপন একাকীত্বের অব্যক্ত অন্তঃকরণ। বৃক্ষ কিছু বলেনা। শুধু নীরবে আপন স্বরূপের রঙ বদলায় বর্ণচোরা গিরগিটির মত সেই মানুষগুলোর অভিলাষ অবগাহনে। মাঝেমাঝে কখনও কিছু ভিক্ষুক এসে ক্ষণিকের জন্যে আশ্রয় নেয়, হিসাব মেলায় সারাদিনের অর্জিত অর্থ দিয়ে তাদের এবং সভ্য মানুষদের চামড়ার পার্থক্যের।

আবার কখনও কখনও বৃক্ষের ডালে বসে ক্লান্ত বৃক্ষকে স্বার্থপর এই নগরের কেচ্ছা বলে চলে একদল কাক। আরও বলে, তারা নাকি আগে এমন কালো রঙ এর ছিল না। সভ্যতার ধারক হয়ে এই নগরের কালিমাগুলো হজম করতে গিয়ে তাদের এই দশা। বৃক্ষ কিছু বলে না। শুধু ছায়া আর পাতার ঝিরিঝিরি বাতাস দিয়ে পরম স্নেহে সহমর্মিতা জানায়। কালেভদ্রে বৃক্ষকে দেখতে আসে চড়ুই, শালিক কিংবা দোয়েলের দল। তারা বৃক্ষকে চলে যেতে বলে এ জায়গা থেকে। দিগন্তের পারে অনেক দূরে, যেখানে এখনও মানুষ বাস করে। এ শহরের মানুষের মুখোশধারী নির্জীব নাগরিকতা সেখানে নেই। তারা দেখে এসেছে। সেখানে জীবন অনেক জীবন্ত, বাক্সে বন্দী শূণ্যতা কিংবা সময়ে আটকে থাকা অনুভূতিহীনতা নয়। বৃক্ষের মন আনচান করে ওঠে সেসব শুনে। কিন্তু যেতে পারেনা সে। তার সে ক্ষমতা নেই। জড়িয়ে গেছে শিকড়ের সাথে মাটির মায়াজালে। কিংবা ছুটে চলা মানুষগুলোর দৃষ্টির সাথে তাদের একাকীত্বের বন্ধনে। সেই ধুম্রজাল সে কাটাতে পারেনা। গোধূলিলগ্নে স্তিমিত চোখে চেয়ে দেখে দোয়েল-শালিকের উড়ে যাওয়া, জীবনের পানে।

যার তরে এই মায়া, এই নিরন্তর সময়ে আটকে থাকা, সেই মানুষের কাছে কিন্তু অচেনা রয়ে যায় বৃক্ষটা, পাশের ফ্লাটের প্রতিবেশীর মতই। তারপর একদিন, সকালে আর বৃক্ষটা সেখানে দেখা যায়না, সভ্যতার অভিজাত নিয়মে। মানুষই মুক্তি দেয় তাকে সভ্যতার অত্যাচার থেকে, আপন যান্ত্রিকতার প্রয়োজনে। আশেপাশের বিল্ডিংগুলোর জানালায় পর্দা নেমে আসে ঐ বরাবর। দৃষ্টির প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। ঐ জায়গার মাটিও ঢেকে যায় কংক্রিটে, গড়ে ওঠে কাঠের শোপিসের একটা ছোটখাটো দোকান। সেই দোকানে একটি ফ্রেমে ঝুলতে থাকে সেই বৃক্ষের কান্ডের একটি অংশ, রীতিমত শৈল্পিক একটা অবয়ব পেয়ে, সভ্যতার ধারক হিসেবে। এবং একসময় চড়াদামে বিকিয়ে হারিয়ে যায় তোমাদের এই নগরের অজানা অচেনা কোনো এক ড্রয়িংরুমের দেয়ালে। সেইসাথে হারিয়ে যায় সেই বৃক্ষের আশ্রয়ে খেলতে থাকা মানুষের স্বপ্নগুলো, চিরতরে।

-অতীত


মন্তব্য

বইখাতা এর ছবি

বেশ ভাল লেগেছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-অতীত

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লেগেছে।
---------------------
Sad Quote
Sad Poems

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-অতীত

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

ভালো লাগলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-অতীত

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

শেষের প্যারাটা দারুণ লাগলো!

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

জেনে আমারও অনেক ভালো লাগল দেঁতো হাসি

-অতীত

তিথীডোর এর ছবি

বাহ! চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-অতীত

অতিথি লেখক এর ছবি

মনটা উচাটন হয়ে গেল।

--- নুশান

অতিথি লেখক এর ছবি

ইয়ে, মানে...

-অতীত

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বাহ, বেশ ভালো লাগলো।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অতিথি লেখক এর ছবি

রোমেল ভাই, আপনার মন্তব্য পেয়ে আমারও অনেক ভালো লাগল দেঁতো হাসি

-অতীত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।