আওয়াজ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২১/০২/২০১১ - ১:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্কুলের সামনে একটি বিশাল মাঠ। তারই চারপাশ ঘিরে একদল লোক কুচকাওয়াজ করছে। বাজনার তালে তালে তাদের পা উঠানামা করছে।
এরা নাকি সৈনিক? কিন্তু এরা আমাদের স্কুলে কেন?

চৌধুরী সাহেবের বাসায় পত্রিকা আসে। সেই খবর শুনতে বুড়োরা ভিড় করে চৌধুরী সাহেবের বাসায়। চৌধুরীর নাতি পড়ে আমাদের সাথে। তার কারণে আমরা মোটামুটি সব খবরই পাই।
সেই সুবাদে আমরা জানতে পেরেছি যে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে লড়াই বেঁধে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে লড়াই চলছে। আমাদের এই আধা মফঃস্বল আধা গ্রাম এই এলাকার খুব কাছেই সীমান্ত। বলা যায় না, কোন সময় ভারত এই পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে বসতে পারে।
বড়রা খুবই শঙ্কিত, যদি যুদ্ধ বেধে যায়। হয়ত বড়দের শঙ্কা দুর করার জন্য কয়েকজন সৈনিক এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। তারাই সকাল বিকাল দুই বেলা কুচকাওয়াজ করে। আর সেই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় আমাদের স্কুলের মাঠে।

বড়রা যতই ভয় পাক, আমাদের মনে হয় যুদ্ধ খুব একটা খারাপ বিষয় নয়। বিশেষ করে যে সব সৈনিক এ রকম তালে তালে পা ফেলে, এ রকম যদি পা ফেলে ফেলে যুদ্ধ বেশ মজার কিছু একটা হবে। আর মজার হয় যদি স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। স্কুলে পড়তে আমাদের মোটেও ভালো লাগে না। আর আমাদের সবচেয়ে কষ্টের ক্লাশ বোধহয় ব্যাকরণ পাঠ। আর এই মুর্হূতে সেই ব্যাকরণ পাঠের ক্লাশ চলছে।
ব্যাকরণকে যত না ভয়, তার চেয়ে বেশি ভয় যিনি আমাদের ব্যাকরণ পড়ার সেই পণ্ডিত মশাইকে। দেখতে তিনি মোটেও ভয়ঙ্কর নন, বরঞ্চ শান্ত, মাথায় পক্বকেশ, তার পেছনে একটা টিকি। খানিকটা ঝুঁকে হাঁটেন। তাতে স্পষ্ট যে তার বয়স বেশ। কিন্তু কত আন্দাজ করা মুশকিল। তবে তিনি লাঠি ব্যবহার করেন না। মনে হয় এই স্কুলের সকল ছাত্র, থেকে শুরু করে মাস্টারেরাও তার ছাত্র। এমনকি এই এলাকার সবাই তার ছাত্র এবং সবাই তাকে সমীহ করে।

তিনি কখনোই অন্য সব শিক্ষকদের মত লাঠির ব্যবহার করেন না, কিন্তু তারপরেও আমরা তাকে প্রচণ্ড ভয় পাই। এর কারণ তার কাছে রয়েছে মোক্ষম এক অস্র। তার কণ্ঠ। বয়স তার চেহারায় ছাপ ফেললেও কণ্ঠে কোন মরচে ধরাতে পারেনি। তার ভৎসনার বাক্য যেন তীরের মত আমাদের গায়ে এসে বিঁধত। তার নির্দয় তিরস্কার যেন শীতকালের ঠাণ্ডা বাতাসের মত একেবারে ভেতরটা কাঁপিয়ে দিয়ে যেত। কিন্তু তিনি কেবল সেই সময় কঠিন হতেন, যখন আমরা পড়া পাড়তাম না।

পড়া না পড়ার সময় মনে মনে ভাবতাম। যে ভাষায় কথা বলি সেই ভাষায় আবার ব্যাকরণ পাঠ করার কি দরকার। এমনি কাজ চলে যায়। আমি যে ভাবেই কথা বলি না কেন, অন্যরা বুঝতে পারি। ওই যে গ্রাম থেকে আসা লোকগুলো যখন তাদের মত করে কথা বলে, তখন আমরা বলি না শুদ্ধ করে বল বা লেখ।
কিন্তু পণ্ডিত মশাইয়ের কাছে সেই কথাটা বলবে এমন সাধ্য কার আছে। সামান্য ভুল হলেই হুঙ্কার দিয়ে উঠবে, মায়ের গায়ে ছুরি বাসাতে চাস। আর ব্যাকরণও বটে বলিহারি। কি যে কঠিন। তার থাকার কি দরকার ছিল।

কিন্তু তিনি তা মানতেই চান না। তিনি বলেন ব্যাকরণ হচ্ছে নদীর দু-পারের মত। যদি দুটি পার নদীকে বেঁধে না রাখে, তা হলে সে যেমন ভেসে যায়, ব্যাকরণ না থাকলেও ভাষা ভেসে যায়।
কিন্তু আমরা ভেসে যেতেই চাই বোধহয়। স্কুল, পড়ালেখা, ব্যাকরণ এ সব না থাকলে মনে হয় জীবনে অনেক শান্তি। কিন্তু স্কুল ফাঁকি দেব তার উপায়টি নেই। এই বয়সেও তিনি সবার নাম মনে রাখতে পারেন, এবং কে কার পুত্র, তাও তিনি অবলীলায় বলে দিতে পারেন, যার ফলে ক্লাশে অনুপস্থিত থাকা মানেই পিতার কাছে সংবাদ চলে যাওয়া। তার যে বয়স তাতে তিনি অবসরে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু ছাত্রদের পড়িয়ে, আর স্পষ্ট করে বললে বকুনি দিয়ে আনন্দ পান। তিনি ভারতেও চলে যেতে পারতেন, কিন্তু যেখানে জন্মেছেন সেটাই নাকি তার কাছে মা, তাই আমরা ধরেই নিয়েছি যে তার শিক্ষা থেকে মুক্তি নেই।

আর ঠিক এহেন পণ্ডিত মশাইয়ের ক্লাসের সময় কিনা সৈনিকেরা শুরু করল তাদের কুচকাওয়াজ।

আমরা ঠিক জানালা দিয়ে বাইরে তাকাবো নাকি পণ্ডিত মশাইয়ের উপর চোখ রাখবে, সেই ভাবনা ভাবতেই মনে হল উনি যেন বিমর্ষ। কিছু একটা বলতে চাইলেন, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হল না। আমরা সবাই তাকালাম তার দিকে।
ছাত্ররা, আমরা প্রিয় ছাত্ররা, (এর আগে কখনোই তিনি এই ভাষায় কথা বলেন নি)? এই কথা কয়টি বলেই তিনি থামলেন।
কি বলবেন, তিনি যেন তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না।
আমি আর তোমাদের পড়াতে আসব না।
গোটা ক্লাসের মধ্যে যেন একটা বজ্রপাত হল। আমরা যারা দীর্ঘ সময় চেয়েছি তিনি যেন একদিন অসুস্থ হয়ে আর ক্লাশে না আসেন, সেই আমরাই যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
গোটা ক্লাশ নীরব। সেই নীরবতা যেন সুচের মত এসে বিঁধছিল।
তিনি আবার নিরবতা ভাঙ্গলেন।
আসলে আমাকে আর স্কুলের দরকার হবে না। আসলে তোমাদের আর বাংলা ব্যাকরণ পড়ার কোন দরকার হবে না। সরকার এক নতুন নিয়ম চালু করেছে। তাতে বাংলা হরফের বদলে অন্য ভাষায় ব্যবহার করা হবে। তোমরা নতুন শিক্ষক পাবে। হয়ত ভাষার চেহারাটাও নতুন হবে। ......

আমরা সবাই নিশ্চুপ হয়ে রইলাম। আমি ঠিক তার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। মাথা নিচু করলাম। বেঞ্চের উপর সেই ব্যাকরণ বই। কতবার ভেবেছি-যদি এই ব্যাকরণ না থাকত. তা হলে ব্যাকরণ পড়ানোর জন্য এই পণ্ডিতেরও আর্বিভাব হত না। আজ বইটা যেন আমাকে বিদ্রুপ করছে।
মনে পড়ল গতকাল রাতে মামাকে বলতে শুনেছিলাম, আমাদের এদেশে নাকি নতুন পদ্ধতি চালু হচ্ছে। তাতে আমাদের ভাষার চেহারাটা নাকি নতুন হবে। বাংলা ভাষাটা জটিল, তাই নাকি অন্য হরফে লেখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু স্কুলে নাকি সেই ভাবে পড়ানো শুরু হবে।
ও এটা তা হলে সেই ব্যাপার।

পণ্ডিত মশাই আজ আর পড়াবেন না। আর কোনদিন তিনি পড়াতে আসবেন না।
তাঁর রুদ্ধ কণ্ঠস্বর হয়ে এসেছে। তার মধ্যে দিয়ে যে যেন আমাদের কানে এসে বাজল সেই আওয়াজ: মনে রাখবে ভাষা হচ্ছে জাতির পরিচয়। তার আত্মা। আমি জানি পড়ানোর সময় আমি কঠিন আচরণ করেছি, এ কারণে তোমরা তোমাদের মাতৃভাষায় লিখতে গিয়ে ভুল না কর। তোমরা যেন সবাই নিজের ভাষায় পণ্ডিত হয়ে উঠ।
আমরা জানি তার কথা কতখানি সত্যি। আমাদের স্কুল আশেপাশের অনেক স্কুল থেকে সেরা। এমনকি এই স্কুলের কয়েক জন জেলায় গিয়ে রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পর্যন্ত লাভ করেছে। আমরা জানি এই অর্জনের পেছনে পণ্ডিত মশাইয়ের বকুনির অবদান আছে অনেকখানি। তারপরেও আমরা চাইতাম তিনি চলে যান।
তিনি পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পরই ভারতে চলে যেতে পারতেন, যাননি, থেকে গেছেন। কারণ পড়ানোই তার ধর্ম। আত্মীয় স্বজনরা তাকে রেখে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে, কিন্তু তিনি আত্মীয়দের পরিত্যাগ করেছেন, মাতৃভূমিকে করেননি।
ব্যাকরণের বই থেকে চোখ তুলে সামনে তাকালাম। পণ্ডিত মশাইকে এই প্রথম যেন ভালো করে দেখলাম। একেবারে হালকা পাতলা মানুষ। কিন্তু যেনে পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে আছেন। অনেক প্রবীণ, একজন কিন্তু তিনি যেন বহমান।

সৈনিকদের কুচকাওয়াজের প্রস্তুতির জন্য ড্রামের বাজনা শুরু হয়েছে। কিন্তু আমাদের চোখ আর কান সেই দিকে নেই।
তার আওয়াজ এবার এতটাই পরিস্কার হয়ে এলো যেন, গোটা ক্লাশ জুড়ে গমগম করতে লাগল।
তারা ভেবেছে এভাবে মাতৃভাষাকে গলাটিপে মারার মধ্যে দিয়ে জাতিকে মেরে ফেলবে। তারা তা পারবে না। তোমরা সবাই মনোযোগ দিয়ে পড়বে। পড়ায় কখনো অবহেলা করাবে না। তোমরা ভালো থাকবে। মাকে ভালোবাসবে। ভাষাকে ভালোবাসবে।
সবশেষে সবাইকে চমকে দিয়ে জোরে বলে উঠলেন, “বাংলা ভাষা দীর্ঘজীবী হোক”।

সমস্ত শব্দ যেন এই আওয়াজে চাপা পড়ে গেল।

(আলফঁস দোদের, শেষ ক্লাশ গল্পের ছায়া অবলম্বনে)

বিজয় মজুমদার
bijoy999অ্যাটgmail.com


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

দোদে-র গল্পটার শেষটা অনেক জোরালো ছিলো, যেখানে বাইরে জার্মান সৈন্যদের বুটের আওয়াজ একটু একটু করে কাছে আসছে, আর স্কুল মাস্টার পায়ের পাতার ওপর ভর করে বোর্ডের সবচেয়ে উঁচুতে গায়ের সারা শক্তি দিয়ে চক ঘষে লিখছে ভিভ ল্য ফ্রঁস ... সেই এনার্জিটা এই গল্পে যেন ঠিকমতো পেলাম না।

সচলায়তনে স্বাগতম। আরো লিখুন।

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

স্বাগতম বিজয়দা। হাসি

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

চলুক
সচলায়তনে স্বাগতম।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

মূল গল্পের আবহটা মোটামুটি বুঝতে পারছি, কিন্তু এই গল্পে সেটা প্রত্যক্ষ করতে পারলাম না কেনো জানি।...

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

মূল গল্প আমার পড়া নাই। তবে এটা পড়ে ভালোই লাগলো!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মূল গল্পটা পড়া নাই...
তবে এটা পড়ে মুগ্ধ... ভালো লাগলো অনেক
বাংলা ভাষা দীর্ঘজীবী হোক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।