একুশে ফেব্রুয়ারিঃ প্রথম প্রহরের আগের প্রহর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২১/০২/২০১১ - ১১:৪৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শিক্ষা ভবনের সামনেই নেমে যেতে হ'লো। রাস্তা বন্ধ। অল্প কিছু মানুষ হেঁটে ঢুকছে ক্যাম্পাসে। আর সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেলের গাড়িগুলি ঢুকতে পারছে। আমার দেড় বছরের ভাতিজা-কে বললাম, চল বাবা দৌড় দেই...। দুজনে দৌড়ে এসে শিশু একাডেমির সামনে, আমার তিন বছরের ভাতিজা কার্জন হলের সামনে লাগানো বিশাআআল পতাকাটা দেখিয়ে প্রবল চিৎকার দিয়ে ব'লে উঠলো "ফুপিইইই, জঅঅয় বাংলাআআদেএএশ!" (ব'লে রাখি আমাদের শেখানো আর তার শুনে শেখা "জয়বাংলা"-ই, কিন্তু খুব আবেগের তোড়ে সব সময়ই হড়বড় করে বাংলার শেষে দেশ বসিয়ে দেয়।

দোয়েল চত্বরে কাছে এসে বুঝলাম যে শহীদ মিনারে যাওয়া যাবে না। নিরাপত্তা পাশ ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেয়া হ'চ্ছে না। এক সার বেঁধে কালো পোষাকে RAB সদস্যদের ২৫ জনের একটা দল পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। এদের দেখে ফিক করে হাসি চলে আসলো, ভাইয়ের ছেলে-কে শেখালাম, "বাবা ব'লো তো কালো পিপড়া!"

বাংলা একাডেমির দিকে হাঁটা শুরু করলাম যখন তখন রাত সাড়ে দশটা। বইমেলা গুটিয়ে গেছে, রাস্তাজুড়ে বারোয়ারি বিক্রেতারা তখনো তাদের সরঞ্জাম গুটাতে ব্যস্ত। কেউ কেউ একুশের এই প্রহরে আমাদের মত আসা দর্শনার্থিদের কাছে এটা সেটা বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলা একডেমির মূল ফটকের সামনে হঠাৎ কে যেন বিকট শব্দে ভাইয়ার নাম ধরে হাঁক দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। এমদাদ ভাইয়াও ভাবি-বাচ্চাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছেন।

৭ জনায় মিলে টিএসসির দিএকে এগুতে থাকলাম। যত এগুই মানুষ দেখি যেন তত বাড়ছে। একুশের এই প্রহরে তাহলে এমন-ই থাকে? প্রায় সাড়ে ছ'বছর এ এলাকাতেই থেকে এসেছি। সময়ের বাধ্যবাধকতার কারণে সাড়ে নয়টার পরের চিত্র কখনো দেখবার সৌভাগ্য হয়নি। আজ তাই অন্য রকম একটা অভিজ্ঞতা হ'লো।

শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দেয়া হ'লো না। পথেই পতাকা কিনে নিজের আর বাচ্চাদের মাথায় বেঁধে ফেললাম, সাথে থাকা দুটো দুরন্ত পিচ্চিকে এক ক'রে একুশের গান গাওয়ালাম, চা খেলাম, ভুট্টার খৈ খেলাম। ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত দুই বন্ধুর সাথে এই বেলায় হঠাৎ দেখায় নিরাপত্তা পাশ জুটিয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত ঘুরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেও শেষ বেলায় বাদ দিলাম।

এই ক'টা দিন যে কি যাচ্ছে! বিশ্বকাপ ক্রিকেট, দেশের দামাল ছেলেদের জন্য শুভকামনা আর খেলার উন্মাদনা মিলিয়ে দেশাত্ববোধের একটা ভিন্নমাত্রা নিজের ভেতরেই নতুন করে আবিষ্কার করছি। উত্তেজনাটুকু খুব স্পষ্টভাবে পার্থক্যযোগ্য, অনুভবযোগ্য-এমন কি মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে স্পর্শও করতে পারছি!

টিএসসির দেয়ালে রাজুর দিকে মুখ করে যখন ব'সে ছিলাম তখন এক রাজ্যের অনুভূতি এসে গ্রাস করলো। মনে হ'লো, এই আমি এই খানে চুপ করে ব'সে থাকি।দুঃখবোধ, লুকানো কোন বিষাদ কিংবা কোন ক্ষণে কুড়িয়ে পাওয়া আনন্দানুভূতি নয়- এই ভীড় , এই জনস্রোত, আর এই কোলাহল সবকিছু ছাপিয়ে ব্যক্তিগত ভাবনায় আচ্ছন্ন হলাম।
যেহেতু নৈর্ব্যাক্তিক থাকতে চাই-তাই ব্যক্তিগত অনুভূতির বিবরণ লিখবো না। তারচেয়ে আবুল হাসান এর লেখা প্রিয় একটা কবিতা জুড়ে দিলাম (খুব জানাশোনা হয়ে কবিতা থাকলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)-

"যখন সকল কথা শেষ হয়ে যায়
না-বলা কথার ভার মূক স্তব্ধতায়
কাঁপে ভীরু প্রদীপের শিখার মতন।
দিনে যত আনাগোনা
কথা দিয়ে জাল বোনা
থেমে যায় একদিন হঠাত্ কখন।
থামে না তো স্রোত, শুধু
সরে যায় ঘোলা জল।
কাটে না তো সুর, শুধু
পড়ে যায় ঝরা দল।
তখন হূদয়ে নামে ভোরের আকাশ
পাখা মেলে বুনো বালিহাঁস,
সকালের রোদ গায়
কালো মেঘ ছেড়ে যায়
ভুলে গেছে বাসা তার
জানে শুধু সে সাঁতার
।"

-আমি


মন্তব্য

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

কিছু কিছু লেখা সত্যি ছুঁয়ে যায়

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

হলে থাকার সময় দুইবার গেছি প্রথম প্রহরে। নিরাপত্তার বাড়াবাড়িতে ত্যক্ত হয়ে আর যাওয়া হয়নি!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

২১ শে ফেব্রুয়ারি ভোরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাওয়াটা ছিলো চরম আনন্দের। কিন্তু নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ব্যাপারটাকে এখন এমন একটা অবস্থায় নিয়ে গেছে... গত কয়েক বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ওমুখো হতেই পারি নাই মন খারাপ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।