ঝুম বৃষ্টির মধ্যে যখন বাসে উঠলাম তখন বাজে ঠিক সাড়ে চারটা।
'ছাতিটা আজকাল বড্ড জ্বালাচ্ছে বুঝলি', শফিক বাসে উঠেই বলতে লাগল ‘বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই খুলে যায়...এই যে দ্যাখ !'
আসলেই তাই। বলার আগেই হঠাৎ ছাতাটা খুলে গেল। নাহ্, এর সাথে বসা গেল না তাহলে। আমি বাসের মাঝের দিকে চলে গেলাম। সিট পেলাম না। শফিক অবশ্য সিট পেল। আমার দিকে তাকাতেই আমি হাত দিয়ে ইশারা করলাম , আমি এখানেই দাঁড়াই, তুই বস। ও ছাতা নিয়ে বসে পড়ল।
অল্পক্ষণ দাঁড়াতেই আমার পা ব্যথা হয়ে গেল। বাস তাড়াতাড়ি গেলেও হত, কিন্তু সে আশা বৃথা। ঢাকা এখন এমন একখানা পাঁচ-টনী ট্রাক, যার মধ্যে আট টন মাল বোঝাই করা হয়েছে। রাস্তা-ঘাটে মানুষ আর মানুষ। ইদানীং পাখিদেরও আর দেখি না। কে জানে, কোন দেশে গিয়ে নিজের সুখের সন্ধান করছে...পাখিদের তো আর ভিসা লাগে না!
তবে অন্যরকম পাখি দেখি। এই শব্দটা শুনতে একটু কেমন একটা ভাব আসে, একটু খারাপ শোনায় বটে। তবে দেখি যে এটা সত্যি। অনেক রকমের পাখি। ষোড়শী বালিকা থেকে রমণীয় তরুণী কেউই আমার চোখের আড়াল হয় না...অন্তত বাসে তো নাই-ই। আমাকে খারাপ ভেবে কোন লাভ নেই, কারণ সারাদিন জ্যামের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে ওই একটি কাজ করা ছাড়া আমার আর তেমন কিছু করার থাকে না। দুরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখি, চোখের সাথে চোখাচোখি হলে এমন একটা হাসি দেই যেন মনে হয় এই প্রথম একটা মেয়ে দেখলাম। ইদানীং ওনারাও চালাক হয়ে গেছেন, পরিচিত না হলেও একটা মুচকি হাসি দিয়ে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
আজকেও সেইরকম একজনের সিটের সামনে দাঁড়িয়েছি। আসলে আমি ঠিক দাড়াইনি, বাসে দাঁড়ানো মানুষ আমাকে ঠেলে এখানে এনেছে। দু-চার মিনিট এদিক সেদিক তাকিয়ে আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম।
অনেক সময় অনেক লেখক বলেন, লেখার সময় অতিরিক্ত বিশেষণ ব্যবহার করলে আসল কথাটি বোঝা যায় না। তাই আমিও এক কথায় বলি, মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। সুন্দর চেহারা, বয়স কত আর হবে, উনিশ-কুড়ি । গাঢ় সবুজ রঙের ফতুয়া পড়া মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছিলো, সবুজের মাঝে সোনালি বরণ চেহারাটি "তিনি" স্বয়ং নিজ হাতে এঁকেছেন। ঈশ্বরের তারিফ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
জানালার পাশে বসেছে মেয়েটা। জানালাটা খুলে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে একমনে। জীবনে কবিতা লেখা তো দূরে থাক, কবিতার নাম শুনলেই আমার বিরক্ত লাগত। অথচ আজ কেন জানি মনে হচ্ছিল,কবিতা লিখে ফেলব নাকি একটা?
‘এই যে ভাই, গাঁয়ের উপর উইঠ্যা পড়বেন নাকি!’
পাশের লোকটা বিরক্ত হয়ে আমাকে বলল। আসলে মেয়েটিকে দেখতে দেখতে এমন অবস্থা, যে ওনার গাঁয়ের উপরই উঠে পড়েছিলাম। সরে গেলাম বটে, কিন্তু চোখ সরল না। মনে হচ্ছে আজ ফেভিকলের বিজ্ঞাপন আমাকে দিয়ে করালে মন্দ হত না। ডায়লগটা এমন হতো,
“কি এমন মজবুত আঠা হে নাগর,
ও মুখখানি থেকে কেন সরছে না তোমার নজর?”
মেয়েটা কিন্তু একমনে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে, তাই বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। চুলগুলো ঠিক খোলা নয়, সামনের দিকের চুলগুলো কেমন যেন ছাড়া ছাড়া। জানালা দিয়ে ঢোকা বাতাস সেই চুলগুলোই এলোমেলো করতে লাগলো। পাগল হয়ে গেলাম। আজকে আমার এই মেয়েকে জানতেই হবে, এর সাথে পরিচিত না হয়ে বাস থেকে নামবো না আমি।
হঠাৎ দেখি পকেটে মোবাইলটা কাঁপছে। শফিক ফোন করছে কেন? ওর দিকে তাকাতেই ও আমার দিকে কিটকিট করে হাসতে লাগল। চোখ দিয়ে মেয়েটার দিকে ইশারা করে কি যেন বলল...ঠিক বুঝলাম না। শয়তানি করছে হয়তো...।
বনানীর এদিকটায় কখন যে এসে পড়লাম , ঠাহরই করতে পারলাম না। এত দ্রুত সময় চলে গেল...? আর মেয়েটাই বা কেমন, এতক্ষণ ধরে তার দিকে তাকিয়ে আছি, সেটা তার কোন নজরেই পড়ছে না? নাকি কেয়ার ই করছে না আমাকে? যাই হোক না কেন, আজ আমার চোখ সরবে না গো মেয়ে, আমি তোমার মন ভোলানো হাসি দেখেই বাড়ি ফিরব।
ধুর...! খালি পিছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে। দাঁড়ানোই মুশকিল হয়ে পড়ল। কিন্তু অমন জায়গা ছাড়ব কেন? এমন ভাব করে দাঁড়িয়ে রইলাম যেন এইমাত্র কোণ রিয়েল এস্টেট কোম্পানী থেকে বুকিং দিয়ে কিনেছি, কাজেই নড়বার প্রশ্নই ওঠে না !
কি আর করবার, লোকজন আমাকে ডিঙ্গিয়ে যেতে লাগল। একজন তো আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন ভিন গ্রহের প্রাণী দেখছে ! আমি পরোয়া করছি না। মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষার আগে যেমন বই পড়তে থাকি, ঠিক তেমনি মেয়েটাকে দেখতে লাগলাম।
তাকাল নাকি মেয়েটা আমার দিকে? হ্যাঁ, তাকালই তো। আমি প্রস্তুত ছিলাম এর জন্য, শুধুমাত্র এই একটি মুহূর্তের জন্যে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হাসিটা উপহার দিলাম। এমন হাসিতে আমার বাবার পেনশনের ফাইলটা হয়তো টেবিলে টেবিলে ঘুরত না,সরকারী কর্মকর্তা কলমের এক খোঁচায় সই করতেন, হয়তো আমার এনার্জি কনভার্সনের তাওহীদ স্যার মুচকি হেসে আমার দেরিতে জমা দেয়া অ্যাসাইন্মেন্ট নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না...কিংবা মা হয়তো রাতের বেলার হিন্দি টিভি সিরিয়ালের স্লটে আমাকে খেলা দেখার সুযোগ করে দিতেন। এ হাসিতে সবই সম্ভব ছিল।
কিন্তু মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল না। কেমন যেন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ভয় পেয়ে গেলাম। মেয়েটা কি টের পেয়েছে যে আমি তাকে এতক্ষণ ধরে দেখছি? নাকি টের পেয়েছে, কিছু বলেনি। এবার এমন সাইজ করবে যেন লজ্জায় আমি এই বাস থেকে নেমে যাই।
আমি ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেললাম। এখন আর তাকান যাবে না, তাকালেই হয়তো বলে উঠবে, ‘এই যে মিস্টার, খুব তো তাকাচ্ছিলেন আমার দিকে, জীবনে মেয়েমানুষ দেখেননি?’ কিংবা, ‘এই ব্যাটা, ঘরে বোন না থাকলেও মা তো আছে, তাদেরকে ইজ্জত দিতে শিখিস নাই?’
আস্তে আস্তে আমি পিছন দিকে সরে আসলাম। বাস এয়ারপোর্টের দিকে এগুচ্ছে...উত্তরায় যেতে আর বেশিক্ষণ বাকি নেই। ততক্ষণ নাহয় এদিকেই দাড়াই...সিট তো আর পাওয়াই গেল না...।
‘এয়ারপোর্ট...ওই এয়ারপোর্ট!’ সমগ্র এয়ারপোর্টকে ডাক দিতে দিতে কন্ডাক্টর জানিয়ে দিল যে এয়ারপোর্ট এসে পড়েছে। যাক বাবা, দু চার মিনিট বসার সুযোগ পাওয়া যাবে।
আরে, ওই মেয়েই তো উঠে যাবে দেখছি...আতিপাতি করে কি যেন খুঁজছে।
এই তো পেয়েছে মেয়েটা।
একটা সাদা লাঠি।
পাশের লোকটা চট করে গালের মধ্যে একটা থাপ্পড় দিল, গালে একটা মশা বসেছিল বোধহয়।
আমি ঠিক কি ভাবব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। চুপচাপ মেয়েটির জায়গায় বসে পড়লাম।
বাসের কন্ডাক্টর যখন অন্ধ মেয়েটাকে নামিয়ে দিচ্ছিল, তখন কেন যেন মেয়েটা পিছনে ফিরে তাকাল। ওই দুটি চোখে কিসের ছায়া? বিষণ্ণতা? ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
ঠিক করেছি বাসে উঠলে আর কারো চোখের দিকে তাকাবো না...যদি ওই মায়াকাড়া বিষণ্ণ দৃষ্টি ভুলে যাই?
__________________________________________________________
মেঘদুত
মন্তব্য
নায়কের মনের কথা পড়তে পারলাম বলে "নারী নির্যাতনকারী" আখ্যা দিলাম না। অবশ্য তা না দিলেও তার আচরণ সবটুকু আমার কাছে গ্রহনযোগ্য মনে হয়নি!
নায়কের মানসিকতা ভালো না লাগলেও আপনার লেখা ভালো লেগেছে। লেখা ভালো লেগেছে বলে এবং ট্যাগে অণুগল্প লেখা আছে বলে পাঁচতারা দিলাম। আপনার আরো লেখা পড়ার আশায় রইলাম।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
খুব সাধারণ একটা গল্প। নায়কের মানসিকতা আসলেই খুব ভালো নয়...
ভালো থাকুন অনার্য সঙ্গীত, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
________________________________________
মেঘদুত
ভালো লাগলো। আপনার দোমনা ভাবটা এখন বুঝতে পারছি। ভাল লিখেছেন। -রু
...আমার নামটার সুচনা আপনার নিকের মতোই।
ভালো থাকবেন।
__________________________________
মেঘদুত
পাঁচ তারা দাগালাম!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
ধন্যবাদ রোমেল ভাই...
__________________________________
মেঘদুত
বাহ, কেমন বিষাদভরা একটা গল্প ! সুন্দর খুব।
একটা সওয়ালঃ নিজের নিক আপনি "মেঘদূত" না লিখে "মেঘদুত" লিখেন কেন? খুবই দৃষ্টিপীড়ক একটা বানান।
---------------
সাত্যকি
---------------
সওয়ালের জবাবঃ
খুব তাড়াহুড়ো করে নিকটা দেয়া। দেবার পর মেইল চেক করে দেখি এই কান্ড। আমি ঠিক জানি না এই মুহূর্তে নিক পরিবর্তন করলে লেখাগুলো পরবর্তীতে আমার অ্যাকাউন্টে দেয়া হবে কিনা (যদি অ্যাকাউন্ট হয়, এখনও নিশ্চিত নই)।
অতিথি সচল হবার পর নিক চেঞ্জ হবার সম্ভাবনা আছে, তার আগে বোধহয় নেই ভাই... ।
ভালো থাকুন সাত্যকি, আপনাকে এই সওয়াল করার জন্য তো বটেই, লেখাটি পড়বার জন্যও অনেক ধন্যবাদ।
____________________________________
মেঘদুত
সাবলিল ভাবে বর্ণিত লেখা পড়তে ভাল লাগে। আশা করছি আরও লিখবেন। (: আমারও লিখতে ইচ্ছে হয় খুব! কিন্তু সবার দ্বারা সব কিছু হলে তো! ধন্যবাদ (:
শাফি।
লিখতে ইচ্ছে হলে লিখে ফেলুন...দেরি করবেন না..:)।
_____________________________________
মেঘদুত
ভাল লাগছে অনেক..................।
নায়ক কি সত্যি সত্যি আর কোন মেয়ের দিকে তাকায় নি ?
তবে তাকাক আর না তাকাক, আপনার লেখাটি তাকানোর মতই।
হয়তো তাকিয়েছে...হয়ত তাকায়নি। তবে ওই চোখ সে আর ভুলবে না...
আপনাকে ধন্যবাদ তানসীম।
_______________________________________________
মেঘদুত
ভাল লাগলো।
নতুন মন্তব্য করুন