দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডিসকাশন প্রজেক্টের পক্ষ থেকে বিজ্ঞান বক্তৃতা দিতে গেলে নানা ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। বেশিরভাগই সেখানে কিশোর-তরুণরা থাকেন, তাদের অনুভূতিগুলোকে তুলে ধরে বিষয়ভিত্তিক আলোচনার পাশাপাশি নানা প্রশ্ন করেন। কেউ জানতে চান মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে কী ছিল, তার পরিণতিই বা কী? ডাইনোসররা বিলুপ্ত হলো কীভাবে? ডায়নোসররা বিলুপ্ত না হলে মানুষ কি রাজত্ব করতে পারত? ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের পার্থক্য কী? মানুষে মানুষে এত জটিলতা, এত সংঘর্ষ, হিংস্রতা; তা-কি বিজ্ঞান দিয়ে দূর করা যায় না? এই কিশোর-তরুণরা আরেকটি প্রশ্ন করেন তাদের ভবিষ্যৎ চিত্রটি কী? আমিও থমকে দাঁড়াই আর ভাবি: বিজ্ঞান থেকে দূরে, প্রযুক্তি ব্যবহারে আসক্ত কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে মারাÍক আতঙ্কিত একটি সমাজের গন্তব্য কোথায়? ক্রমান্বয়ে ভুল শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে বিকশিত হওয়া একটি জাতির পরিণতি কী? দেশ তো দূরের কথা, যারা তার নিজের বাসস্থানকে ভালোবাসে না, সেরকম মানুষের মনোস্তাত্ত্বিক গঠন কেমন হয়? মানুষ সমাজের সঙ্গে নিজেকে সংশ্লিষ্ট মনে করে না, প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক তাদের আচরণ প্রকৃতির স্বরূপ কী? সবকিছুকে খণ্ডিত করে দেখা আর ইতিহাস বিচ্ছিন্ন একটা জাতি কী সময় প্রবাহ অনুভব করে? প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্যও যে শহরের মানুষেরা কোনো জায়গা পায় না তারা কী ধরনের স্নায়ুচাপে ভোগে? মানুষের অজ্ঞতা, লোভ আর অসহায়ত্বের সূযোগ নিয়ে যেখানে হাউজিং স্টেটগুলো (অল্প কয়েক বছরের মধ্যে) একটা শহরে অবকাঠামোতে মরণ-কামড় বসিয়ে দেয় তাকে নিয়ে আশা করার কী কিছু থাকে? প্রকাশ্য রাস্তায় মানুষ পুড়িয়ে বা পিটিয়ে মেরে ফেলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া সমাজের জীবনযাপনের বিন্যাস কেমন? যদি আমাদের সোসিও-সাইকো ডাইনামিকস বা সাইকোহিস্ট্রি জানা থাকত বা সামাজিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে গাণিতিকভাবে চিন্তা করতে পারতাম, তবে ভবিষ্যতের ব্যাপারে কিছু বলা যেত। ৪০ বছরের ঘটনাক্রমের নিখুঁত পরিসংখ্যানিক উপাত্ত না থাকলেও কিছু ঘটনাপ্রবাহের সমন্বয় করা গেলে ঢাকা শহরের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ কী হবে তার আনুমানিক চিত্র ধারণা করা যেতে পারে। বোঝা যেতে পারে রাজনৈতিক অস্থিরতা কিভাবে একটি দেশের ইকোলজিক্যালী বিপর্যয় নিয়ে আসে, শুধু পরিবেশের ক্ষেত্রেই নয় মানসিক ক্ষেত্রেও বটে।
এখানে বলা প্রয়োজন যখনই আমাদের বিপর্যয়কর পরিণতিকে বুঝতে পারবো তখনই সত্যিকারভাবে চেষ্টা করবো এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে। এক শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষ যেভাবে দেশ ও সমাজকে বদলে দিতে চায় তারা বোধহয় স্বপ্নে পাওয়া অপার্থিব ঔষধের ফর্মুলার মতোই বদলে দিতে চায়। তারা বোধহয় জানে না এই বদলে যাওয়াটা একটা ক্রমান্বয়িক ব্যাপার। এর সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা, ইতিহাসের সম্পৃক্ততা, রাজনৈতিক স্থিরতা গভীরভাবে যুক্ত। পরবর্তীতে গত ৪০ বছরে শিক্ষা ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত বিকাশ দেখিয়ে এর গন্তব্য কী তা বলার একটা চেষ্টা করা যাবে। তার আগে সাইকোহিস্ট্রি বা মনোইতিহাস বিষয়কি তা জানি।
সাইকোহিস্ট্রি এমন একটি বিষয় যা ইতিহাস ও বর্তমান ঘটনার মনস্তাত্ত্বিক গতিপ্রকৃতি (psychological motivation) নিয়ে কাজ করে। সাইকোহিস্ট্রির বাংলা করলে দাঁড়ায় মনোইতিহাস। এখনও এটি ফিকশনাল সায়েন্সের পর্যায়ে ফেলা হয়। স্যার আইজ্যাক অসিমভের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ফাউন্ডেশনে একে ঘিরে প্রায় ২৪ শ পৃষ্ঠার ৭ খন্ডে কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। তিনি এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে: ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান এবং গাণিতিক পরিসংখ্যানকে একত্রিকরণের মাধ্যমে অনেক বিশাল এক জনগোষ্ঠীর প্রায় নিখুত ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব।
সাইকোহিস্ট্রি বা মনোইতিহাস
সাইকোহিস্ট্রি মূলত গড়ে ওঠে ওই ধারণার ভিত্তিতে যেখানে কেউ কোন নির্দিষ্ট স্বাতন্ত্রকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না। কিন্তু পারিসংখ্যানিক নিয়মগুলোর সাহায্যে হয়তো ভবিষ্যত ঘটনাগুলোর সাধারণ প্রবাহকে অনুমান করা যায়। তবে তা বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর উপর প্রয়োগ করতে হবে। গ্যাসের গতিতত্ত্বের সাদৃশ্যতা মাথায় রেখেই আইজ্যাক অসিমভ ধারণাটিকে নিয়েছিলেন। একজন পর্যবেক্ষকের কাছে গ্যাসের কোন একক অণুর ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যাপারে অনেক জটিলতা থাকলেও বিশালসংখ্যক গ্যাসাণুর ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ের সূক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। পদার্থবিজ্ঞানীরা জানেন একে গতিতত্ত্ব হিসেবে। অসিমভ ফিকশনাল গ্যালাক্টিক এম্পায়ারের জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এই ধারণাটি প্রয়োগ করেছিলেন যে-জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১ হাজার ট্রিলিয়ন বা ১ কোটি বিলিয়ন। এটি করতে গিয়ে অসিমভ তার বিশাল কাহিনীর মুল চরিত্র গণিতবিদ হ্যারি সেলডনের মাধ্যমে দুটি স্বতসিদ্ধকে প্রতিষ্ঠা করেন: ১/ যে জনগোষ্ঠীর উপর এই ধারণাটি প্রয়োগ করা হবে তাদের সংখ্যা হবে খুবই বিশাল। ২/ সাইকোহিস্ট্রিক্যাল বিশ্লেষণ প্রয়োগের ফলাফল সম্বন্ধে ওই জনগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকতে হবে।
এ প্রসঙ্গে অসিমভ বলেছেন, ‘সেইসময় রোমান সম্রাজ্যের ক্রান্তিকাল ও পতন নিয়ে লেখা একটি গ্রন্থ দ্বিতীয়বারের মতো আমি পড়ছিলাম।’ আসিমভ এটাকে তার মতো নিয়ে গ্যালাক্টিক এম্পায়ারের মতো বিশাল মাত্রায় তা প্রয়োগ করেছিলেন। গ্যালাক্টিক এম্পায়ার হলো সেই একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর জগৎ যা একটি গ্রহ বা একটা সৌরজগতে আবদ্ধ নয়, পুরো গ্যালাক্সি জুড়ে বিরাজমান মানবসভ্যতা। এই মানব সভ্যতার পতন নিয়েই কাহিনীটির অবতারণা করেন। ধারণাটি ভাবারও ৪০ থেকে ৪৩ বছর পরে তার প্রিলিউড ফাউন্ডেশন ও ফরওয়ার্ড ফাউন্ডেশনে সোসিও সাইকো ডিনামিকস বা সাইকোহিস্ট্রি সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন। ভাবলে অবাক হতে হয় বিষয়টি নিয়ে কত দীর্ঘ সময় অসিমভ ভেবেছেন! তিনি এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘যদিও আমার এই কাহিনীতে তেমন আশাব্যাঞ্জক কিছু দেখাতে পারি নি। তবে আমি মনে করি বর্তমানের কিছু সমস্যাকে অতিক্রম করে সামনে তাকালে অনেক বড়ো দূর্ঘটনাকে এড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়। মানবজাতিও আবার একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।’ বর্তমানে সাইকোহিস্ট্রির ধারণা নিয়ে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে কিছু কিছু ব্যাক্তি, দল কাজ করে যাচ্ছেন। এই ধরনের পরিসংখ্যানিক গবেষণা ইতিহাসের গাণিতিক সূত্রায়ন সম্ভব করতে পারে, ব্যবহƒত হতে পারে ইতিহাসের গতিধারা ভবিষ্যৎ বাণী করার হাতিয়ার হিসেবে। ‘The psychohistory Project’ শিরোনামে এক দল গবেষক এ ধরনের কাজ করছেন। ২০০২ সালে গ্রিসে এরকম একটি বই বের হয়েছিল, Òpsychohistory (A tool of Historical Prediction) by Prediction) by Christos Z. Konstas ।
ইতিহাসের গতিধারা গভীরভাবে প্যাঁচানো দড়ির জটিল কুন্ডের মতো - সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল যা ¯পষ্ট করা খুবই দূরহ ব্যাপার। অসংখ্য ছোট ছোট, ভবিষ্যদ্বাণীর অযোগ্য ও বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটে চলেছে অবিরাম যেগুলোর বেশিরভাগেরই কোনো সুদুর প্রভাব বা ফলাফল নেই। কিন্তু সভ্যতার জটিলমোড়গুলোতে ওই ধরনের কিছু সাধারণ ঘটনাই ভবিষ্যত ইতিহাসের বিন্যাস পরিবর্তন করে দিতে পারে।
কোনো সাহিত্য সমালোচক বর্ণনা করেন ভালো মন্দ যাই হোক না অসিমভের সাইকোহিস্ট্রি আসলে কার্ল মার্কসের বস্তুবাদী ইতিহাস তত্ত্ব (historical materialism) বা ইমানুয়ের কান্টের নিয়ন্ত্রনযোগ্য ইতিহাস তত্ত্বের (controllable history) পুনসূত্রায়ন। যদিও অসিমভ এ ধরনের কোনো প্রভাবকেই স্বীকার করেন নি।
আসিফ
বিজ্ঞান বক্তা
ডিসকাশন প্রজেক্ট
*সাইকোহিস্ট্রির ওপর একটা বড় লেখার অংশ হিসেবে লেখাটি তৈরি করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি অংশ দেয়ার চেষ্টা করবো।
মন্তব্য
বেশ! আসিমভের এই সাইকোহিস্ট্রি ছিল একটি চমৎকার বৈজ্ঞানিক চিন্তা। বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ অদেখা পর্যবেক্ষণের পূর্বাভাস, সে লক্ষ্যেই এর পদচারণা। প্রেক্ষাপট হল মানব সমাজ। মানব সমাজ প্রকৃতি থেকে ভীষণরকমভাবে জটিল। তাই প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ, পূর্বাভাস ও নিয়ন্ত্রণের জন্যে বিজ্ঞানে যতটা উন্নয়ন হয়েছে, মানুষের আর তার সমাজের আচরণের ক্ষেত্রে তা হয়েছে ঢের কম। মানে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, বেশ কঠিন, তাও বেশ করতে পারছি আমরা। কিন্তু মানবগোষ্ঠির আচরণের পূর্বাভাসের খুব ধারে কাছে আমরা নেই। আরও লিখুন!
পড়লাম। লিখতে থাকুন।
পড়ে মজা পেলাম!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
সচলে স্বাগতম আসিফ ভাই। নিয়মিত লিখুন।
আসিফ ভাইকে এখানে দেখে ভালো লাগলো। নিয়মিত লেখার অনুরোধ জানিয়ে গেলাম
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পরবর্তী পর্বের আশায় রইলাম।
সচলে আপনাকে স্বাগতম। আপনার বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য হয়নি। এখন অন্তত লেখা পড়তে পারবো জেনে খুবই ভালো লাগছে।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
আপনার কথা প্রথম শুনেছিলাম বহুবছর আগে। বাংলাদেশে জন্মে বিজ্ঞান বক্তৃতাকে কেউ পেশা হিসাবে নিতে পারে এটা আপনার কথা না শুনলে কোনদিন বিশ্বাস করতাম না। আপনাকে একবার স্বচক্ষে দেখার বড় শখ আমার।
আপনাকে সচলায়তনে পেয়ে খুব ভাল লাগছে। আশা করছি নিয়মিত লিখবেন।
আপনার বিজ্ঞান বক্তৃতাগুলো ইউটিউবে আপলোড করার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়।
সচলে স্বাগতম।
নিয়মিত লিখুন।
পোস্ট ভালো লাগলো।
আসিফ ভাই, ভাল জায়গায় লিখালিখির ডিসিশন নিয়েছেন।
এই লেখাটা আরেকটু ডিটেইলে হলে ভাল হইত...আপনার কাছে তো আরও তথ্য আছে, পরের কিস্তি তাড়াতাড়ি দিয়েন...
আসিফ ভাই, একটা চমৎকার ও জটিল বিষয়ের অবতারণা করলেন। আকর্ষণীয় ভূমিকাংশটি পড়ে অতৃপ্তিবোধ চারিয়ে ওঠলো কেবল। এখন লেখাটা এগিয়ে নেয়ার দায়বদ্ধতায় আটকে গেলেন কিন্তু, এটা ভুলে গেলে চলবে না !
আগে লেখায় ডুব দিয়ে স্নাত হয়ে নিই, তবেই আপনার লেখায় মন্তব্য করার যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব হতে পারে হয়তো, তার আগে নয় !
তবে সচলে আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। ভালো লাগছে। আশা করছি অভিনন্দন জানাতে জানাতে আপনাকে ভারাক্রান্ত করে ফেলবো !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আপনাকে নিয়মিত লেখা দেবার অনুরোধ জানিয়ে গেলাম।
আপনার বিজ্ঞান বক্তৃতা প্রথম শুনেচিলাম ১ যুগ আগে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে ।
আর আসিমভের ফউন্ডেশন টা পারলে আমি সমাজ বিজ্ঞানের জন্য পাঠ্য পুস্তক বানাতাম ।
আপনি একবার সামাজি বিজ্ঞানের সামাজিক পরিবর্তনের তত্ব গুলা ও দেখতে পারেন :বিশেষত ইবনে খালদুনের সভ্যতার জন্ম বিকাশ মৃত্যূ( স্পেংলার ও পরে ব্যবহার করেছেন ) আর একটা World System Theory. Immanual Wallerstein টা ও দেখতে পারেন সাইকোহিস্ট্রি রুপরেখা বুজতে মনে হয় কাজে লাগবে
নতুন মন্তব্য করুন