আমরা আনুমানিক একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল স্মৃতিচারণ এবং চিন্তুন প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে। এরই উপজাত হিসেবে হাতিয়ার ব্যবহার শুরু হয় ৩৮ লাখ বছর আগে। তাতে টিকে থাকার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা তৈরি হয় - সূচনা হয় সাংস্কৃতিক বিবর্তনের। কিন্তু শুধু টিকে থাকার স্বার্থেই নয়, নিজের স্বজাতির সঙ্গে সংঘর্ষের মাধ্যমে প্রয়োজনের বাইরে আরেকটি প্রবণতার সূচনা হয় - অন্যকে পরাজিত করার সেই উচ্ছাস যাকে ক্রুয়েলিটি বা হিংস্রতাও বলা যায়, যা সাংস্কৃতিক বিবর্তনের এক বাঁকাপথ। যেটি আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের মাঝে খাদ্যের প্রয়োজনে কাজে লাগতো। আজ একাবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা অনুভব করছি অন্যকে পরাজয়ের মাধ্যমে নয় সহাবস্থানের মধ্যদিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
আমরা আসলে সুদীর্ঘ ক্রমবিকাশের একটি অংশমাত্র। ৪০ হাজার প্রজন্মের যারা অতীতে ছিলেন তারা রেখে গেছেন আমাদেরকে স্মৃতির বাহক হিসেবে। আর আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মকে রেখে যাব আমাদের স্মৃতির ধারাবাহিকতা হিসেবে। এই উপলব্ধি আমাদেরকে একাকিত্ত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেবে, দৃষ্টি প্রসারিত করবে, সংকীর্ণতা-স্বার্থপরতা থেকে উঠে আসতে সাহায্য করবে, মহাবিশ্বকে আপন চেতনায় ধারণ করবে। বিজ্ঞান সেই ঘটনাক্রমের মধ্যকার সংযোগ রেখা যা কালিক চেতনার মধ্যদিয়ে অসংখ্য আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনার অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ তৈরি করে আর সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে সেই প্রবাহ মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে নতুনবোধের জগতে নিয়ে যায়। এই কারণেই ছায়ানটের মতো একটি দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে ডিসকাশন প্রজেক্ট এর উদ্যোগে বিজ্ঞান বক্তৃতা দেওয়ার আগ্রহ হয়েছিল।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ছায়ানটের সভাপতি সনজীদা খাতুনও এই কথাকে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি কেন তারা এই আয়োজন করেছেন।’ সেদিনকে তাদের বিজ্ঞানচর্চা শুরুর প্রথম দিন বলেই অভিহিত করেছিলেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘মহাজাগতিক প্রেক্ষাপট ও মানব সভ্যতার উষা।’ খুব বেশি বোধগম্য না হলেও মহাবিশ্বের ১৫শ’ কোটি বছরের ইতিহাসকে বলে যাওয়ার সঙ্গে স্থির ছবিগুলো প্রদর্শনে এক ধরনের আবহ, ঘোর তৈরি হয়েছিল। গভীরভাবে অনুভব করেছিলাম ওয়াহিদুল হককে, যিনি এ ধরনের কর্মকান্ডের জন্য দীর্ঘসময় মাঠ পর্যায়ে কাজ করে গেছেন। বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন বা সমন্বয় কতটা জরুরি তা বোঝাতে চেয়েছেন। আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, ছায়ানটের মতো অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এই ধরনের কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিলে বিজ্ঞানকে সমাজের মধ্যে প্রবাহিত করা অনেক সহজ হবে। ১৬ বছর ধরে এক জেলা থেকে আরেক জেলায়, এক শহর থেকে আরেক শহরে, কখনো দ্বীপাঞ্চলে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমি যখন ঘুরে বেড়াই তখন মহাদেশ থেকে মহাদেশে ঘুরে বেড়ানোর অনুভুতি কাজ করে আমার মধ্যে। আর কিশোর-তরুণদের প্রশ্নের মুখোমুখি হলে এমন এক ধরনের আবেগ ঘিরে ফেলে যা আমাকে নিয়ে যায় থেলিস, পিথাগোরাস, ডেমোক্রিটাস, এমপিডকলেস আর অতীশ দীপঙ্করের কাছে। মহাজাগতিক প্রোপটে দাড়িয়ে শুনতে পাই সেই সব মানুষদের রক্তের স্পন্দন যাদের কাছে এই পৃথিবী ঋণী।
মহাজাগতিক প্রেক্ষাপট ও মানব সভ্যতার উষা শীর্ষক বক্তৃতানুষ্ঠানটি মূলত মহাজাগতিক বর্ষপঞ্জিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। এখানে রয়েছে মহাবিশ্বের ক্রমবিকাশ, পৃথিবীতে প্রাণের বিবর্তন ও বিকাশ এবং সাংস্কৃতিক বিবর্তন। যেহেতু আমাদের জীবনকালের ব্যাপ্তি ১০০ বছরের বেশি হয় না তাই এই ঘটনাগুলো সাধারণ সময়ের ভিত্তিতে করতে গেলে তা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে না। কিন্তু তা যদি বর্ষপঞ্জির ভিত্তিতে সাজানো হয় তখন ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা অনেক সরলভাবে দেখা যায়, আবার তা অর্থপূণ হয়ে ওঠে।
যেমন:মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে ১৫ শত কোটি বছর আগে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির জন্ম ১০০০ কোটি বছর আর সৌরগতের জন্ম ৫০০ কোটি বছর আগে। উপরোক্ত সময় ব্যাপ্তিকে আনুপাতিকভাবে কমিয়ে ১ বছরের হিসাবে দেখলে মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে ১ জানুয়ারিতে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির জন্ম ১ মে আর সৌরজগতের উৎপত্তি ৯ সেপ্টেম্বর। যেহেতু বছরের ক্যালেন্ডার দেখতে আমরা সবাই অভ্যস্ত, এইভাবে আমরা বিশ্বের ক্রমবিকাশের চিত্র খুব সহজে তুলে ধরতে পারি। এটাকেই কসমিক ক্যালেন্ডার বা মহাজাগতিক বর্ষপঞ্জি বলে।
এখন আমরা জানি, মহাবিশ্বের উদ্ভব ১৫শ কোটি বছর আগে আর মানুষের লিখিত সভ্যতার ইতিহাস ৫ হাজার বছর। এই বিশাল সময়ের ব্যবধান আমাদের অনুভূত হয় না। কিন্তু কসমিক ক্যালেন্ডারের হিসেবে মহাবিশ্বের উদ্ভব ১ জানুয়ারি এবং মানুষের লিখিত সভ্যতার ইতিহাস মাত্র ১০ সেকেন্ড বলা হলে এটা আমাদের কাছে অনেক তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। আর হিসেবটি মনে রাখলে যেমন ক্রমবিকাশটি মনে রাখতে পারবো তেমনি ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর মধ্যে সম্পর্কগুলো অনুধাবন করতে পারবো।
মানুষ বিবর্তিত হয়েছে বিস্মিত হওয়ার জন্য
প্রচণ্ড দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্য দিয়েও মানুষের ঢলই নেমেছিল সেদিন, বরিশালের অশ্বিনী কুমার হলে, ২৬ জানুয়ারি ২০০৮-এ। বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন ম্যাপ, চার্ট, ছবির প্রদর্শনি ছিল সারাদিন। মানুষ আসলে জন্মগতভাবে কৌতূহলী। জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী কার্ল সাগানের মতো বলতে হয়- ‘মানুষ বিবর্তিত হয়েছে বিস্মিত হওয়ার জন্য আর বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত জ্ঞানের মাধ্যমে সে এই বিস্ময়ের নিবৃত্তি ঘটাচ্ছে’। সভ্যতার ইতিহাসে যেসব বিজ্ঞানী খুবই গুরুত্বপূর্ণ, প্রদর্শনীতে তাদের অনেকের ছবি থাকলেও সবার মনোযোগ ছিল বিবর্তনের চার্টের ওপর। যেখানে মানুষের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর দেড় কোটি বছরের একটি ক্রমপরিবর্তনের ধারা দেখানো হয়েছিল। অন্য প্রাণীর সঙ্গে মানবপ্রজাতি জীববিজ্ঞানগতভাবে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত তা খুব সহজভাবে নিতে পারে না মানুষ।
প্রায় ৪০০ দর্শকের উপস্থিতিতে মহাজাগতিক প্রেক্ষাপট ও মানবজাতির উষা বক্তৃতা পর্বটি শুরু হয়। মহাজাগতিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যায় একের পর এক পরিবর্তন আর শত শতকোটি বছর পেরিয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের সর্বশেষ মানবজাতির আগমনের দীর্ঘ ধারাবাহিক ক্রমচিত্র উপস্থাপনের সময় শ্রোতারা কখনো বিস্মিত, কখনো উচ্ছ্বসিত, কখনো গম্ভীর হয়ে দেখছিলেন আর শুনছিলেন। মহাজগতে শত শতকোটি বছর পেরিয়ে জীবজগতে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মানব প্রজাতির আগমনে যে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটেছে, তা আর্থার সি কার্ক ও স্ট্যানলি কুবরিকের ১১ মিনিটের ভিডিও ক্লিপসের মাধ্যমে প্রদর্শন যেন সেই ইতিহাসের বাঁকে শ্রোতাদের নিয়ে গেলো। জ্ঞানের উন্মেষ ঘটার প্রক্রিয়াটা যেন ক্ষণিকের জন্য দেখে নিতে চাইছে শ্রোতারা। শুধু তাই নয় ৪০ হাজার প্রজন্মের পরবর্তী বিস্মৃত মানুষরা তাদের আচরণের মাধ্যমে যেন সেই প্রাচীন পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাইছে, নিজের ইতিহাসকে বুঝতে। এ তো সেই সংগ্রামের ইতিহাস যার মাধ্যমে সূচনা হয়েছিল প্রথম চিন্তা, প্রথম স্মৃতিচারণ, প্রথম হাতিয়ারের ব্যবহার। যা পরিবর্তন ও সময়ের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করেছিল, যার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল ইতিহাসের যাত্রা। মানুষের এই স্মৃতিচারণ এবং এর ভিত্তি তাকে ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর মতা এনে দিয়েছে। এটাই মানবজাতির অর্জন। একথাগুলোই আমি বারবার আমার বক্তৃতায় বলতে চেয়েছি। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ব্যাখ্যাকার জেকব ব্রনোওস্কির উদ্ধৃতিটি মনে এসেছে, ‘মানবজাতির মতার বিরুদ্ধে সংগ্রামই হলো ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতিধারণের সংগ্রাম’।
২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় অশ্বিনী কুমার হলে বিজ্ঞান সংগঠন কসমিক কালচারের উদ্যোগে বরিশালে ডিসকাশন প্রজেক্ট এর ‘মহাজাগতিক প্রেক্ষাপট ও মানব সভ্যতার ঊষা’ শীর্ষক বক্তৃতাটির আয়োজন করা হয়। যে প্রশ্নগুলো নিয়ে এ বক্তৃতা অনুষ্ঠান আবর্তিত হয়েছিল তাহলো: পৃথিবীর বয়স কত? কতদিন বেচে থাকবে সূর্য? ডাইনোসরেরা বিলুপ্ত হলো কীভাবে? মহাবিশ্বের প্রাচীনতম ঘটনা কী? তার আগে কী ছিল? সত্যিই কী প্রাণীরা অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে? কীভাবে ৫৬ হাজার বছর আগে এশিয়ার মানুষ ভেলায় করে মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছেছিল? পৃথিবীর প্রথম শহর, প্রথম বর্ণমালা, প্রথম সংবিধান কবে হয়েছিল? শ্রোতাদের থেকে প্রশ্নও এসেছিল অনেক - বেশিরভাগই সেখানে কিশোর-তরুণরা থাকেন, তাদের অনুভূতিগুলোকে তুলে ধরে বিষয়ভিত্তিক আলোচনার পাশাপাশি নানা প্রশ্ন করেন। কেউ জানতে চায় মহাবিশ্বের আগে কী ছিল? ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের পার্থক্য কী? বাংলাদেশের বিজ্ঞানচর্চার অবস্থা কেমন? তারা স্ক্রীনে প্রদর্শিত এই স্লাইডগুলো কীভাবে সংগ্রহ করতে পারে?
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রশ্নটি সেই সময় মনে হয়েছিল তাহলো তাদের ভবিষ্যত চিত্রটি কী? পৃথিবীর কথা চিন্তা না করে শুধু ঢাকা শহরে গড়ে ওঠা অবকাঠামোর মধ্যদিয়ে সেই ভবিষ্যতের কিছুটা আঁচ করা যায়। চরম বিজ্ঞান বিমুখতা আর ভবিষ্যত নিয়ে আতংকিত মানুষের সমাজ কেমন হতে পারে? সেই সমাজ একটা নগরকে কতটা ধ্বংসের মূখে নিয়ে যেতে পারে তা ঢাকা শহরকে দেখলে অনুধাবন করা যায় - ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন বা মহামারী, ভূমিধ্বস, প্রাকৃতিকভাবে বিচ্ছিন্নতার কারণে মানসিক প্রতিবন্ধী বা মানসিকবিকৃতির বিকাশ। এসব বিষয়ে আমরা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করবে।
আসিফ
ডিসকাশন প্রজেক্ট
*সাইকোহিস্ট্রি নিয়ে একটা বড় লেখার সূচনা পর্ব এটা। গেল পোস্টে মূল লেখার একটা অংশ বিশেষ লিখে আলোচনা করেছিলাম। এখন থেকে ধারাক্রম অনুসরণ করার চেষ্টা থাকবে।
মন্তব্য
অপেক্ষায় থাকলাম।জলদি ছাড়ুন পরের কিস্তি।
রব
খুবই ইন্টারেস্টিং বিষয় এবং আলোচনা। কিন্তু অনেক গুলো বিষয়ের উপর ভাসাভাসা আলোচনা করেছেন। আরো সময় নিয়ে (এবং হয়ত পর্ব করে) আলোচনা করলে পিপাস মিটত। তাছাড়া তথ্যসুত্রের অভাব বোধ করেছি। যেমন:
কিসের ভিত্তিতে এই আনুমানিক সিদ্ধান্তে পৌছেছেন? তথ্য সুত্র কিংবা খানিকটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকলে গ্রহণযোগ্য হোতো।
আসিফ আমাদের দেশের সেরা বিজ্ঞান বক্তাদের মধে্য একজন। তিনি সচলায়তনে লিখছেন দেখে খুবই আনন্দিত বোধ করছি। আপনার অনেক অনেক লেখা চাই।
নতুন মন্তব্য করুন