ইউনিভার্সিটি থেকে বের হলে সবার আগে আমরা যাই আশেপাশের ফাস্টফুডের দোকানে। এলাকাটা বাণিজ্যিক, তাই এগুলোর কোন অভাব নেই। আমাদের ক্যাম্পাস কেন্দ্র করেই বেশ কয়েকটা গজিয়ে উঠেছে।
সেমিস্টার কেবল শুরু হল, পড়ালেখার চাপ নাই, থাকলেও কেউ নেই নাই। সবাই বাড়ি থেকে এসে বেশ ফুরফুরে মেজাজে এখানে সেখানে আড্ডা দিচ্ছে, তাস পিটাচ্ছে, আর নতুন কোন মুখ দেখলেই কাছে ডাকছে। দু-চারটা উল্টো-পাল্টা প্রশ্ন করলেই নতুনেরা ঘাবড়িয়ে যায়, আর সেটা দেখে আমাদের কেমন যেন একটা আনন্দ লাগে। আমরা অবশ্য তেমন কষ্ট দেই না, একটু ধমক দিয়ে আস্তে আস্তে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। চার –পাঁচ দিন পর এই নয়া মুখগুলোই আবার নিচের চায়ের দোকানে আড্ডা দেবে।
আমি সিগারেটে টান দিতে দিতে রাস্তা পার হচ্ছি। শরীর তেমন ভালো নেই, বাসা থেকে ফেরার পর থেকেই জ্বর জ্বর ভাব। প্রথম ক্লাস করার প্রশ্নই ওঠে না, দ্বিতীয় ক্লাস টাও অর্ধেক করতে পারি নাই। মেসে যাবার আগে ভাবলাম সবার সাথে একটু দেখা করে যাই, একমাস পর সবাই এলো, দেখি কার কি খোজ-খবর...।
‘স্লামালিকুম!’
প্রথমবার খেয়াল করলাম না। সবে সেকেন্ড ইয়ার, সালাম দেবার মানুষজন এখনো খুব কম। হাঁটতে লাগলাম।
‘নমস্কার দাদা! আরে এই তো আমি!’
এইবার খেয়াল করলাম।
বাঁদিকের গলির মুখে একটা লোক দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে একটা শার্ট, হাতার নিচে বিরাট একটা ফুটো,তাতে তালি মারার ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়েছে। লুঙ্গিটা মালকোঁচা মেরে এমন একটা ভঙ্গি করে রয়েছে যেন এইমাত্র কোন ভারি কাজ করে এসেছে, এখানে দাঁড়িয়ে খানিকটা জিরোচ্ছে। শরীর হালকা হালকা কাঁপছে, অন্তত আঙ্গুলগুলো কাঁপছিল তো বটেই।
আমি তাকাতেই বিরাট এক হাসি দিল। আশ্চর্য রকমের কুৎসিত হাসি। সকল কুৎসিত জিনিষের একটা মন্ত্রমুগ্ধ করা ব্যাপার থাকে। এই হাসিটাও ঠিক তেমন । হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
লোকটা আমার সামনে এসে বলল, ‘তুই কি পড়িস?’
আমি কি পড়ি...? সরল মনে প্রথমে যা মাথায় আসল তাই বললাম, ‘অনার্স’।
হাসিমুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ‘এটা কি মগের মুল্লুক?’
‘কেন?’
"এখন যেখানে সেখানে দোকানে দোকানে অনার্স বিক্কিরি হয়?"
মানেটা বুঝে উঠতে সময় লাগল। একটু রাগ লাগছিল, হাসিও পাচ্ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু বললে এই লোকের কি মনে হতে পারে তার কোন ঠিক নেই। আমি খুব শান্ত গলায় বললাম, ‘দোকান না, আমরা আসলে এই মার্কেটের উপরে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ি’।
‘ও...বিশ্ববিদ্যালয়...হুম,’ বেশ জ্ঞানী ভঙ্গিতে লোকটা কি যেন চিন্তা করতে লাগল। হঠাৎ কি যেন মনে করে বলল, ‘নাহ্ তুই মিথ্যা বলছিস’।
‘মিথ্যে? আমি মিথ্যে বলছি না...। মিথ্যে কেন হবে?’
কেন হবে? লোকটা এবার কঠিন চোখে তাকায় আমার দিকে। ‘মরতে দেখেছিস কাউকে? রক্ত দেখেছিস কখনো?
‘রক্ত কেন?’ আমার ভ্রু কুঁচকে গেল। ‘রক্ত কেন দেখব এখানে?’
‘তবে এটা বিশ্ববিদ্যালয় হল কেমনে?
আমি একটু প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেলাম। উল্টো-পাল্টা কিছু বলা যাবে না। যদি বলি, ভাই এইটা প্রাইভেট ভার্সিটি, তখন হয়তো আরেক ঝামেলায় পড়তে হবে। এই লোকটা পাগল তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাকে এখান থেকে কেটে পড়তে হবে । আমি লোকটার কথার সাথে তাল মেলাতে থাকি। বললাম ‘ ঠিক ধরেছেন, এটা কোন ভার্সিটি হল!’
লোকটা আমার উৎসাহ পেয়ে একটু আগ্রহের চোখে আমার দিকে তাকায়। ‘তুই এখানে পড়িস?
আমি বললাম ‘হ্যাঁ পড়ি। তবে বেশিদিন পড়বো না, চলে যাব।
লোকটা একটু সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আমার গায়ে হাত দিয়ে বলে, ‘চলে যা, চলে যা, তোর জন্য এইখানে পড়ার কোন মানে হয় না। এখানে তোদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিচ্ছে, তোদের কুলি-কামলা বানাচ্ছে। এখানে থাকিস না, পোকায় খাবে’। আবার কি যেন ভেবে বলল ‘বাইরেও পোকে খাবে। সেখানে অবশ্য রক্তই আছে, আর কিছু নেই। পুস্তিকা আছে, পত্রিকা নেই, ভাষণ আছে , ডায়লগ নেই, রামদা আছে , ডিস্কো নেই...মাগিও পাবি না, যা পাবি সবাই খুবলে খাবে, বুঝলি?’
কাঁধ থেকে হাত ছাড়ল লোকটা। লুঙ্গির গোঁজ থেকে দোমড়ানো সিগারেট বের করে এগিয়ে দিল আমার দিকে। ‘ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর শোন,’ কানের কাছে এসে বলল, ‘ মাঝে মাঝে মনে মনে গুনবি, কয়টাকে মারলি’।
‘কয়টাকে মারলাম মানে?’ আমি বুঝতে পারছিলাম না লোকটা কি বলছে। কি আবার গুনতে হবে?
‘আস্তে...শসস্,’ লোকটা এদিক সেদিক তাকাল। আবার ফিস্ফিসিয়ে বলল, ‘ সবাই শুনতে পাবে। মারতে না পারলে ক্ষতি নাই, আমার কাছে বলিস, আমিই মেরে দেব। দুইটা ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে মারলেই...’
উত্তেজনায় লোকটার লাল লাল চোখ দুটি জ্বলে উঠে। ‘তুই কোন চিন্তা করিস না, ঠিক আছে? আমি এখন যাই,’ হাতে কোন এক কাল্পনিক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আনমনে সময় দেখল, ‘এখন আমার একটা মিটিং আছে, পারলে আসিস’।
লোকটা চলে যাবার পর পাক্কা দু’মিনিট দাঁড়িয়ে রইলাম। কি বলল কে জানে, কিন্তু কথাগুলো মাথায় ঢুকে গেল। বাস্তবে পাগল দেখেছি খুব কম, সামনা সামনি তো দেখিই নাই বলতে গেলে। তাছাড়া কথাগুলো ওলট-পালট হলেও কেমন যেন লাগছিল, কেমন একটা পরিচিত গন্ধ।
টংয়ে আর গেলাম না। এমনিতেও জ্বর, রুমে গিয়ে আস্তে করে শুয়ে পড়লাম। দু-তিনদিন জ্বরে ভুগে যখন আবার ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করলাম, তখন আর এসবের কিছুই মনে রইল না।
দিন যায়, মাস যায়। আমি আরও দুটো সেমিস্টার চলে গেল। আর আট-দশটা ছেলের মতই এই দেশ ছেড়ে যাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। একসময় সব ঠিকও হল। প্রেমিকা বিয়ের পিড়িতে আর আমি প্লেনের সিটে বসার প্রস্তুতি নিলাম। একদিন অ্যাম্বেসির সামনে দাঁড়িয়ে সিএনজি খুঁজছি, হঠাৎ ...
‘স্লামালিকুম’।
তাকিয়ে দেখি সেই লোকটা।
প্রথমে চিনতে পারিনি। কাছে এসে যখন সেই হাসিটা দিল, তখন চিনতে ভুল হয় নাই। আগের মতই একটা ছেড়া শার্ট আর একটা লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে ছিল অ্যাম্বেসির গেটের পাশের বাস স্ট্যান্ডে । কাছে এসে প্রথমেই বলল,
‘চিনতে পারছিস?’
আমি কি বলব ঠিক বুঝলাম না। চুপ করে রইলাম।
‘চিনিস নাই? সেই যে, তোদের ওই ঢঙয়ের দালানের সামনে, তোকে ডেকেছিলাম? তোদের সেই ভার্সিটিতে এখন কি পড়ায়? প্লেবয়? নাকি ইন্ডিয়া টাইমস্? খুব নাচিস গানের তালে , তাইনা? দরদে ডিস্কো, দিস্টিং দিস্টিং...’
লোকটা নাচতে থাকে। নাচতে নাচতে লুঙ্গিটা খুলে যায়। পাগলটা খেয়াল করেনা। আমি বিব্রত হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। দ্রুত পালাতে পারলে বাঁচি । এদিকে ট্যাক্সি-সিএনজি কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না...ধুৎ!
একসময় পাগল ক্লান্ত হয়ে যায়। জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। তারপর আবার আমার কাছে আসে।
ঠিক আগের মতই কানের কাছে এসে বলে ‘ তুই তো গুনিস নাই, তাই না? আমি গুনেছি। অনেকগুলোকে গুনেছি। কিন্তু জানিস,’ মলিন মুখে পাগল বলে, ‘একটাও মরে নাই। সবগুলো ওই যায়গায় গিয়ে বসে আছে...ওই যে...দেখলি? দেখলি কোন জায়গাটা? যে জায়গায় গেলে তোকে আর আমাকে নাচান যায়, চাইলে দেশের নামটা বদলে ফেলা যায়, বড় বড় টাকার গাছ লাগান যায়, দেশটাকে ধর্ষণ করা যায়... দেখলি সেই জায়গাটা?’
লোকটা দূরে কোথাও আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতে থাকে। আমি একবার তাকিয়েই অন্যদিকে তাকাই। আশেপাশে লোকজন এদিক তাকাতে থাকে। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা টোকাইগুলো আমার অবস্থা দেখে হাসতে থাকে। আমি নিরুপায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
সামনে ট্যাক্সি দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। গাড়িতে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখি লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। ওর দিকে তাকাতে তাকাতেই আমার ট্যাক্সি বাঁয়ে মোড় নিয়ে নিলো।
যাবার আগে এই লোকটাকে আর দেখিনি। তবে খবর পাই, লোকটা দেশের এক শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী আর তার যুদ্ধাপরাধী শ্বশুরকে খুন করেছে। ইতিমধ্যে ফাঁসির আদেশ হয়ে গেছে, ফাঁসি হয়ে যেতে পারে যেকোনো একদিন।
আর আমি? আমি দেশের বাইরে গিয়ে দেশকে উজ্জ্বল করবার মিথ্যে অভিনয় করছি। আমার অভিনয়ে সেদেশের মানুষ এতটাই মুগ্ধ যে আমাকে সেদেশে বাসিন্দা করবার আদেশ দিয়ে দেয়া হয়েছে।
_____________________________________________
মেঘদুত
মন্তব্য
--------------------------------------------------------------------------------
শেষ দুটো প্যারায় ওই কথাগুলো সরাসরি না বললেও বাকিটাই একটা চমৎকার গল্প হত।
... হতে পারে।
অনেক ধন্যবাদ কৌস্তভ ।
____________________________________
মেঘদুত
নতুন মন্তব্য করুন