সালেক খোকন
ভোর হতেই চারপাশের দৃশ্য বদলে যায়। হালকা কুয়াশার আবরণ চারপাশে। পাহাড়চেরা উঁচুনিচু রাস্তা ধরে ছুটে চলে আমাদের বাসটি। আঁকাবাঁকা সবুজে ঘেরা পথ। সকাল ঠিক ৮টা। সুপারভাইজার চেচিয়ে ডাকে ‘এক নম্বর ঘাট’। এই ঘাটটি দেশের একেবারে শেষ প্রান্ত টেকনাফে। সেখান থেকেই এলসিটি কুতুবদিয়া জাহাজটি ছেড়ে যায় সেন্টমার্টিন দ্বীপে।
চার বন্ধু মিলে রওনা হয়েছি নারিকেল-জিঞ্জিরা খ্যাত সেন্টমার্টিন দ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্য দেখব বলে। নাফ নদীতে ভাসছে এলসিটি কুতুবদিয়া জাহাজটি। জনপ্রতি ছয়শত টাকায় আসা যাওয়ার টিকিট নিয়ে উঠে বসি একেবারে ওপেন ডেক্সে। খানিক বাদেই টান পড়ে পেটে। পাউরুটি আর বাংলা কলায় টপাটপ সেড়ে নেই নাস্তার পর্বটি।
হুইসেল বাজিয়ে সকাল ৯.৩০ টায় যাত্রা শুরু করে জাহাজটি। পাশের ঘাট থেকে ছাড়ে আরো দুটো জাহাজ। নাম দেখলাম কেয়ারী সিন্দাবাদ ও ঈগল-২ । কেয়ারী সিন্দাবাদ সমুদ্রের ¯্রােতকে থোড়াই কেয়ার করে। সবার আগে এগিয়ে যায় সেটি। পেছন পেছন আমাদের জাহাজটিও।
সামনেই বঙ্গোপসাগর । টেকনাফের সবুজ পাহাড় আর নাফ নদী পেরিয়ে জাহাজগুলো এগিয়ে চলে সেদিকটায়। সমুদ্রের ¯্রােতে আমাদের জাহাজটি মাঝে মধ্যেই দুলে ওঠে। ভয়ে অনেক যাত্রী একেবারে জড়সড়। অনেকেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে তার প্রিয়তমার হাতটি। অনেককেই দেখা গেল চোখ বুজে আল্লাহর নাম জপছে। একদল যুবককে দেখলাম এরই মধ্যে দল বেঁধে গান গাইছে। ঢেউয়ের দোলায় তাদের আনন্দ যেন আরো বেড়ে যায়।
প্রায় আড়াই ঘন্টা সমুদ্রে ভেসে থাকার পর চোখের সামনে আচমকা সেন্টমার্টিন দ্বীপ। বন্ধু মনির উৎসাহ নিয়ে দেখায় দ্বীপটি। আমার মধ্যে তেমন উৎসাহ নেই। দূর থেকে আর দশটি দ্বীপের মতোই দেখতে। এ আর এমন কি। এই দ্বীপ দেখতেই কি মানুষ সাগর পাড়ি দেয়?
ধীরে ধীরে আমাদের জাহাজটি দ্বীপের কাছাকাছি এগোয়। ক্রমেই গোটা দ্বীপটির সম্মুখ অংশ দৃষ্টিসীমায় আসতে থাকে। তাকাতে তাকাতে আমার চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। সমুদ্রের নীলাভ পানিতে ভেসে আছে মায়াবি সেন্টমার্টিন। অন্য কোনো দ্বীপের মতো তো নয়ই। বরং বলা যায় স্বপ্নের কোনো দ্বীপ। সারি সারি নারকেল আর ঝাউগাছের সবুজের ওপর অন্যরকম নীল আকাশ। সাগরের ঢেউ এসে বার বার ধুয়ে দিচ্ছে সমুদ্রতীরের পাথররূপী প্রবালগুলোকে।
দ্বীপের জেটিতে বাধা আছে বড় বড় ট্রলার। প্রতিটিতেই পত পত করে উড়ছে লাল সবুজের পতাকা। পতাকাগুলো একেবারেই নতুনের মতো।
সেন্টমার্টিন দেখতে আসে দুই ধরণের পর্যটক। একদল দু-একদিন থেকে ঘুরে দেখে দ্বীপের লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যকে। আর একদল ঘন্টা তিনেক সমুদ্রের পানিতে দাপাদাপি করে। পাথর ভেবে কিছু প্রবাল দেখে । আর সেই আনন্দ নিয়েই ক্লান্ত হয়ে ফিরতি জাহাজ ধরে।
একদিনে কি সেন্টমার্টিন দ্বীপের রূপের দেখা মিলে? আমরা থাকবো কমপক্ষে দুদিন। সে রকমই পরিকল্পনা। পূর্বদিকের বিচ থেকে দেখবো সূর্যোদয় আর পশ্চিম বিচ থেকে সূর্যাস্ত। পূর্ণিমার হিসাব কষেই ঠিক করে রেখেছি সবকিছু।
জাহাজ থেকে নেমে ঘাটের হোটেলগুলোর কাছে আসতেই যেন ক্ষিদে পেয়ে যায়। নানা রকমের সামুদ্রিক মাছ ভাজা হচ্ছে বড় কড়াইয়ের মধ্যে। মাছ ভাজার শব্দে জিভে পানি এসে যায়। চেনা মাছ রূপচাঁদা। কিন্ত সমুদ্রের তাজা কালিচাঁদা, বোল করাল, নাক করাল আর চিৎড়ির স্বাদ কি মিলবে অন্য কোথাও। দেরী না করে ঢুকে পড়ি দারুচিনির দ্বীপ নামের হোটেলটিতে।
টেবিলে বসতে গিয়ে থমকে দাড়াই। একি, দিনের আলোতেও এরা টেবিলে টেবিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে কেন? হোটেলের বাবুর্র্চি হারুন জানালো মাছি তাড়াতেই নাকি এ ব্যবস্থা। সত্যি তাই। যে টেবিলে মোমবাতি নেই সেখানে ভনভন করছে অজ¯্র মাছি।
ঢাকা থেকে বুকিং করে এসেছি সমুদ্র ঘেষা সীমানা পেরিয়ে রির্সোটে। নিরিবিলি এই রিসোর্টটি কোনার পাড়ায়। দ্বীপের পশ্চিম দিকের বিচের ধারে। খানিকটা ভ্যানে গিয়ে, বাকীটা পায়ে হাটা পথ। লাগেজ টেনে বিরক্তমুখে রিসোর্টের ভেতর পা রাখতেই সব বিরক্ত যেন একেবারে উবে যায়। কটেজগুলো দ্বীপের পরিবেশের সাথে মানানসই। কাঠ আর ইটের সংমিশ্রণে অন্য ঢংয়ে তৈরী। ছোট পদ্ম পুকুর, খেতে খেতে সমুদ্র দেখতে কাঠের উচু মাচায় তৈরী করা ঢাইনিং আর নানা রঙের ফুলের বাগান মুগ্ধ করে আমাদের।
রুমে ঢুকে বিছানায় গা হেলে দিতেই দু’পাশের বড় জানালায় দেখি নীল আকাশ। ঝিরিঝিরি বাতাসে নারকেল গাছের পাতা নড়ার শব্দ অন্যরকম লাগে। অপরিচিত দুএকটা পাখির ডাক আর সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দে নিরবতা ভাঙ্গে।
সেন্টমার্টিনের এ পাশের দৃশ্যগুলো বেশ অন্যরকম। পর্যটকদের ভিড় খুব কম। সম্মুখ বিচ থেকে বালুময় পথ পার হয়ে কম লোকেরাই সন্ধান পায় পশ্চিমের এই বিচটির। প্রতিবছর চারুকলার উদ্যোগে ঘুড়ি উৎসব হয় এই বিচটিতে।
বালিময় পথে পা পড়তেই চোখে পড়ে আল্পনা খচিত পথ। সামুদ্রিক কাঁকড়া মাটি তুলে মনের আনন্দে তৈরী করেছে এমন শিল্পকর্ম। দেখতে অবাক লাগে। বিচের তীরটি ঘিরে রেখেছে সবুজ কেয়াফল গাছ। জানা যায় এই কেয়াফল গাছই নাকি দ্বীপটিতে জন্মানো প্রথম গাছ।
ভাটার টানে পানি সরে গেলে বিচের সামনে ভেসে ওঠে পাথরের মতো নানা ধরণের বড় বড় প্রবাল। দেখতে বেশ অন্যরকম। একটির ওপর আরেকটি সাজানো। অধিকাংশই মনে করে এই পাথরগুলোকেই প্রবাল। অথচ তারা জানতেও পারে না কত বিচিত্র জগৎ পড়ে আছে এখানের পানির তলে।
রিসোর্টের ম্যানেজার কামরুল ভাই। তিনি জানালেন প্রবাল বা কোরাল এক ধরনের জীবিত কীট, যা সাগরের তলদেশে তৈরী করে বিচিত্র বর্ণ ও ধরণের বাসা। সেন্টমার্টিন দ্বীপের ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে সাগরে ডোবা একটি প্রবাল প্রাচীর আছে। ধারণা করা হয় এটি মালয়েশিয়ার উপকূলের প্রবাল প্রাচীররেরই একটি অংশ। এই দ্বীপে আছে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল। ইস, যদি পানির নিচে গিয়ে দেখে আসতে পারতাম প্রবালের রাজত্ব।
সাগর পারে হাটতে হাটতে শুনি কামরুল ভাইয়ের কথাগুলো। প্রায় দেড়শ বছর আগে নাকি মায়ানমার থেকে একদল জেলে মাছ ধরতে এসে সেন্টমার্টিন দ্বীপটি আবিষ্কার করে।
এখানকার মানুষের প্রধান পেশা সাগরে মাছ ধরা। সন্ধ্যা হলেই জেলেরা নৌকা বা ট্রলার নিয়ে চলে যায় সাগরে। সারারাত বঁড়শি বা জাল ফেলে অপেক্ষা করে। সকাল বেলা সাগরতীরেই চলে মাছের বিকিকিনি।
সূর্য ডুবতেই চারদিকে জেকে বসে চাঁদের আলো। বিধাতা যেন কোন ঐশ্বরিক আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন আকাশ থেকে। সমুদ্রের পানিতে সাদা চাঁদকে দেখার আনন্দ একেবারেই অন্যরকম।
এরই মধ্যে ঘড়ির কাটায় রাত নয়টা। জোয়ারের চাপে সমুদ্রের পানি উঠে এসেছে অনেকদূর। রিসোর্টের দিকে ফিরতে যাব হঠাৎ দেখি একজন লোক। বালির মধ্যে কিছু একটা খুজছে সে। কাছে গিয়ে পরিচিত হই তার সাথে। সিএনআরএস নামক এনজিওতে কর্মরত লোকটি নিজের নাম জানালো নুর আলম। জোয়ারের সময় কাছিমের ডিম সংগ্রহ করাই তার কাজ। সেন্টমার্টিন বিচের এই অংশে জোয়ারের টানে ডিম পারতে উঠে আসে বিরল প্রজাতির গ্রিণ টার্টেল ও অলিভ টার্টেল। এক একটির ওজন নাকি এক থেকে দেড় মন। ডিম পাড়ার পর কুকুর কিংবা অন্য কেউ যেন এই ডিম নিয়ে যেতে না পারে সেকারণেই ডিম সংগ্রহ করা হয়। ৫৫ দিন পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে তা আবার সমুদ্রে ছেড়ে দেয়া হয়। কাছিমরা যেন নির্বিঘেœ ডিম পারতে আসতে পারে সে কারণেই উপকুলের অধিকাংশ আলো রাত ৯ টার পর নিভিয়ে দেয়া হয়। অন্ধকারে দু একটা ডিম দেখে আমরা ফিরতে থাকি রির্সোটে। ফেরার পথেই সেরে ফেলি পরের দিন সূর্যোদয় দেখে ছেড়া দ্বীপে যাওয়ার পরিকল্পনাটি।
রির্সোটের মাঠে বিশেষ কায়দায় আগুন জ্বালানো। চেয়ার নিয়ে আমরা গোল হয়ে বসি বারবি কিউর আনন্দ উপভোগ করতে। মৃদুল তার গীটারে সুর তুলে আপন মনে। আমাদের সাথে জেগে থাকে সমুদ্রের গর্জন আর মায়াবী চাঁদ।
ছবি : লেখক
মন্তব্য
খুব সময়মতো দ্বিপ্তায় ঘুরে এসেছেন| এই মাসের পর থেকে রাত্রিবাস আর জাহাজে করে দ্বীপে যাওয়া যাবেনা| ভালো লিখেছেন|
সেন্টমার্টিন ভ্রমণ নিয়ে যে কোন লেখা কেন জানি ভাল্লাগে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
চমৎকার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা। বাক্যগঠনে একটু সচেতন হলে রচনার বিভা বেড়ে যায় অনেকগুণ। কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করিঃ
১। পাহাড়চেরা উঁচুনিচু রাস্তা ধরে ছুটে চলে আমাদের বাসটি > পাহাড়চেরা উঁচুনিচু রাস্তা ধরে নাগরদোলার মতো এগিয়ে চলে আমাদের বাসটি
২। আঁকাবাঁকা সবুজে ঘেরা পথ > সবুজে ঘেরা আঁকাবাঁকা পথ
৩। সেখান থেকেই এলসিটি কুতুবদিয়া জাহাজটি ছেড়ে যায় সেন্টমার্টিন দ্বীপে > সেখান থেকেই এলসিটি কুতুবদিয়া জাহাজটি ছেড়ে যায় সেন্টমার্টিন দ্বীপের উদ্দেশ্যে
এগুলি মামুলি প্রমাদ। আপনার কল্পনার তেজ আছে, পুরো মাত্রায় সচেতন হলে অল্প সময়ের মধ্যেই অসাধারণ হয়ে উঠবেন।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
আরো কিছু ছবি দিলে ভালো লাগতো...
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
সুন্দর লিখেছেন। সচলে স্বাগতম। আরও কিছু ছবি থাকলে ভালো লাগতো।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
নীড়'দার কথাটাই পুনরাবৃত্তি করলাম।
লেখা ভাল হয়েছে নিঃসন্দেহে তবে আর দুই চারটে ছবি হলে আরো ভাল লাগতো
বন্দনা
আমি দেশে গিয়ে কক্সবাজার গিয়েও সেন্টমার্টিন যেতে পারিনি আবহাওয়া খারাপ ছিল বলে। এই আফসুস কোথায় রাখি?
আর ছবি ছাড়া সেন্টমার্টিনের লেখা দিলে ক্যামনে কী?
পোস্টে দেন নাই, এখন মন্তব্যে দেন, দিতি হবে।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
ভালো লাগলো
...........................
Every Picture Tells a Story
নতুন মন্তব্য করুন