অল্প-স্বল্প-গল্প প্রচেষ্টা: এই গল্পটা আমার

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৪/০৩/২০১১ - ৭:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লোকটা আমার একদম গা ঘেঁষে বসে। আমি বিরক্ত হই। নাগরিক ভব্যতা বজায় রেখে সে বিরক্তি অবশ্য লোকটাকে বুঝতে দিই না। অর্থপূর্ণ একটা হাসি দিই। লোকটা মনে হয় না আমার হাসির অর্থ ধরতে পারে। আমি আগাগোড়া লোকটাকে একবার দেখে নিই। নিম্ন-মধ্যবিত্তীয় একটা ছাপ লোকটার চোখে মুখে স্পষ্ট। এর ব্যাকগ্রাউন্ড বোঝার জন্যে শার্লক হোমস বা ফেলুদা হওয়া লাগে না। একবার দেখেই আপনি বুঝতে পারবেন, এই লোক বেশিদিন হয়নি এই শহরে এসেছে। ভয়াবহ দরিদ্র কোন ফ্যামিলি থেকে লোকটা এই শহরে উঠে এসেছে। এর বাপ-মা নিশ্চয়ই কোন দূরপল্লীতে এর মানি অর্ডারের আশায় মাসের প্রথমার্ধ কাটায়। এর বোনের ভালো কোথাও বিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে। কোন বখাটে ছোড়া হয়তো এর বোনকে মাঝেমধ্যেই বিরক্ত করে। ভালোয় ভালোয় একটা বিয়ে হয়ে গেলে বাপ-মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। খুবই কমন গল্প। এই শহরে আসা হাজার হাজার মানুষের একই গল্প, একই কাহিনী। আমি তাই লোকটাকে গুরুত্ব না দেবার সিদ্ধান্ত নিই। আমার একটি গল্পও আজ পর্যন্ত কোথাও ছাপা হয়নি এবং হবে- এমন আশাও কম। তবুও, নিজেকে আমি লেখক দাবি করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি এবং সবসময় এক্সেপশনাল ক্যারেক্টারের সন্ধানে থাকি। এই লোক আমার 'বিচিত্র চরিত' নামের ডায়রিতে ঢোকার মত কেউ নয়। আমি তাই হেডফোনটা কানে লাগিয়ে সামার অব সিক্সটি-নাইনে ডুব দিই।

"ভাইয়া কী ময়মনসিং মেডিক্যালের স্টুডেন্ট?"
লোকটার অতি আগ্রহ দেখে আমার বিরক্তি চরমে ওঠে। আমি কোথায় পড়ি না পড়ি, তা দিয়ে তোমার কী বাপু। তুমি তোমার মত জার্নিটা এনজয় করো না কেন, আমাকে আমার মত করতে দাও।

লোকটার গেস অবশ্য ভুল হয়নি। আমাকে তাই বাধ্য হয়ে বলতে হয়, "জ্বি।"
"আপনার চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, আপনি ডাক্তার মানুষ। ডাক্তারদের চেহারায় একটা ডাক্তার ডাক্তার ভাব থাকে।"
আমি লোকটার ব্যাখ্যা শুনে মজা পাই। সহজ মানুষের সহজ ব্যাখ্যা।
"আমার আব্বার খুব আশা ছিলো, আমি ডাক্তার হই। দুই মাস ময়মসিং শহরে এক কোচিং সেন্টারে কোচিংও করসিলাম।"
"তা এখন কী করতেসেন?" এই প্রথম আমি নিজে থেকে উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করি।
"এই তো, এক মার্চেন্ডাইজিং কোম্পানিতে আসি আর কি।"
"আপনি কিন্তু পড়া শেষে এই শহরেই ডাক্তারী করবেন। ঢাকা শহরে যাওয়া চলবে না।"
আমার উপর লোকটার এই অধিকারবোধ দেখে বিস্মিত হই। খানিকটা ভালোও লাগে।

জাংশন রোডে এসে বাসটা কিছুক্ষণের জন্য থামে। ছোটখাটো একটা বাজার বসেছে এখানে। লোকজন নেমে চা-সিঙ্গাড়া খেয়ে নিচ্ছে। আমি আমার প্রিয় এসএলআরটা সঙ্গে করে এইসব ব্যস্ত মানবতাকে ফ্রেমবন্দী করি। অর্থহীন প্রচেষ্টা। একটার পর একটা ক্লিক করতে থাকি। একটা কি দুইটা হয়তো জীবনকে ছুঁয়ে যায়।
"চা খাবেন?" লোকটার কথায় আমার ক্যামেরাবাজিতে খানিক ছেদ পড়ে।
"খাওয়ান।" আমি খুশিই হই মনে মনে।
চা খেতে খেতে লোকটা তার পূর্বাপর আমার কাছে বলে চলে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি-বললে মিথ্যে বলা হবে। তবে শোনার চেষ্টা করি। লোকটাকে কেন জানি ভালো লেগে যায় আমার।
"গত ঈদে ফ্যাকটরিতে আগুন লাগলো। সবার বেতন-বোনাস বন্ধ। আব্বা একটা ফতুয়া চাইসিলেন। সকালে ঐটা পরে হাঁটবেন। বুড়া মানুষ, রেগুলার হাঁটাহাঁটি করাটা জরুরী। ঐ সময় এই সামান্য জিনিসটাও দিতে পারি নাই। বোঝেন অবস্থা?"
লোকটার শব্দগুলো আমি ধরতে পারি। কিন্তু, অর্থগুলো ধরতে পারি না। হয়তো এরকম কোন পরিস্থিতি কখনো ফেস করতে হয়নি দেখেই শব্দগুলো ধোঁয়া হয়ে আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়।
"ফতুয়াটা দেখবেন?"
লোকটার উৎসাহ দেখে আমি আর না করতে পারি না। বলি, "দেখান।"
ব্যাগের ভেতর থেকে ফতুয়াটা বের হয়। সহজ, সাধারণ, স্বাভাবিক একটি ফতুয়া। ফতুয়া পরিহিত লোকটার বাবার একটা চেহারা দাঁড়িয়ে যায় আমার মনের ফ্রেমে। লোকটার চোখেমুখে বিশ্বজয়ের আনন্দ। যার কিছুটা ভাগ এখন আমার।

বাস ছেড়ে দিয়েছে। লোকটার পূর্বাপর কাহিনী এখনো শেষ হয়নি। আমিও বাধ্য ছেলের মত সেই কাহিনীতে ডুব দিয়েছি।
"আমি তখনো ঠিকমত সাঁতার জানি না। তো একদিন পুকুরে সাঁতার কাটতে গিয়া ডুবে মরার অবস্থা। আব্বাকে ডাকতেসি। কিন্তু গলা দিয়া কোন আওয়াজ বাইর হয় না। একটু পর দেখি, আমার বোন আব্বারে হাত ধরে নিয়া আসতেসে। বোনটার বিচার-বুদ্ধি সবসময়ই ভালো।"

"ও, আপনাকে তো বলতে ভুলেই গেসি, বোনটা এবার একটা বাংলাদেশের জার্সি চাইসিলো। আমার বোন আবার আর দশটা মেয়ের মত না যে ভাইয়ের কাছে সারাক্ষণ এটা-সেটা আবদার করতে থাকবে। বুঝদার মেয়ে। কখনোই আমার কাছে কিছু চায় না। ঈদে-টীদেও না। আমার অবস্থা তো বোঝেন। হাজার টাকা দিয়া জার্সি কিনার সঙ্গতি তো আর নাই। তাই, গুলিস্তান থেকে এইটা একখান কিনা আনলাম।" লোকটা ব্যাগ থেকে সদ্য কেনা জার্সিটা এবার বের করে। সস্তা জার্সি। দামি জার্সি। মূল্যহীন এবং অমূল্য একটি জার্সি।

"সুন্দর হইসে না?" লোকটা এমনিই হয়তো জিজ্ঞেস করে। আমি উত্তরে কিছু বলতে পারি না। লোকটার চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকি। ক্যামেরাটা কাঁধে ঝোলানো আছে। চাইলেই একটা ক্লিক করে মুহূর্তটাকে ফ্রেমবন্দী করতে পারি। কেন জানি মন থকে সাড়া পাই না। কিছু কিছু দ্‌শ্য ক্যামেরার ফ্রেমে নয়, মনের ফ্রেমেই সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। এই দ্‌শ্যটা আমার। একক এবং একান্তভাবেই আমার।

আশফাক আহমেদ


মন্তব্য

chera ghuri এর ছবি

মানুষকে অনুভব করার দৃষ্টিভঙ্গি টা ভাল্লাগছে ।

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ব্লগর ব্লগর করার সময় আম্র হুঁশ থাকে না। যা খুশি, তাই লিখতে থাকি। কিন্তু গল্প লেখার সময় ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, কোনটা লেখা উচিৎ আর কোনটা না

আশফাক আহমেদ

প্রশান্ত এর ছবি

গল্পের বর্ণনা খুব ভাল লাগলো চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

আশফাক আহমেদ

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

গল্পের শেষটুকুর প্রকাশভঙ্গি খুব সফট।
ভালো লাগলো।

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, আপু। আমি আরো ভাবলাম, এই গল্প কেউ পড়ে শেষ করতে পারবে না। আগেই ঘুমিয়ে পড়বে হাসি

আশফাক আহমেদ

তিথীডোর এর ছবি

চমত্কার! চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

লইজ্জা লাগে
ধন্যবাদ

আশফাক আহমেদ

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দুইবার পড়লাম। চমৎকার লাগলো! মানবিকতার গল্প। ছুঁয়ে গেল।
লিখুন আরো। নিয়মিত।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার টিপিক্যাল রাইটিং স্টাইলের বাইরে বেরিয়ে এসে লিখার প্রয়াস দেখে আনন্দিত হলাম। ছক্কা হয়নি, তবে বল বাউন্ডারি ছুঁয়েছে নির্ঘাত।
আশা করি আপনার স্ট্রাইকরেট বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।

-----------------
সাত্যকি

-----------------

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখালেখি যে একটি কঠিন কাজ, এই প্রথম তা অনুধাবন করলাম। কোন শব্দই পছন্দ হয় না, মনঃপূত হয় না কোন এক্সপ্রেশন। আপনার ও অন্যান্য গল্পলেখকদের গল্পগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। গল্প লেখা সোজা কম্ম নয়

আশফাক আহমেদ

অতিথি লেখক এর ছবি

নিয়মিত গল্প লিখতে বললেন নাকি? সে ভারী কঠিন কাজ হয়ে যায় হাসি
তার চেয়ে ব্লগর ব্লগরই চলুক

আশফাক আহমেদ

অদ্রোহ এর ছবি

ভাবনাটা ভাল, তবে আরও কিছু সংলাপ যোগ করে লোকটার চরিত্রটাকে আরো খোলতাই করে নেওয়া যেত।

যাই হোক, গল্পকোশেশকে চলুক

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

গঠনমূলক পরামর্শের জন্য চলুক

আশফাক আহমেদ

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা মন ছুয়ে গেলো।

সুপ্রিয় দেব শান্ত

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।

আশফাক আহমেদ

অতিথি লেখক এর ছবি

এইজন্যেই কই তোমারে ইদানিং কম কম দেখা যায় ক্যান চিন্তিত শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং ছাইড়া কি ডাক্তরী ধরলা নাকি? দেঁতো হাসি আবার এসএলআর লইয়া ঘুরতাছ, ব্যাপারটা সন্দেহজনক চিন্তিত

যাইহোক, লেখা নিয়া কিছু কমুনা। আমি শুধু "নতুন মন্তব্য করুন" শ্রেণীভুক্ত। এর উপরে ওঠার যেহেতু ক্যালিবার নাই তাই তা লইয়া কথা কওন ঠিক হইবনা।

-অতীত

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাইয়া, লেখা কম দেয়ার আলাদা কাহিনী আছে। আমার পিসি থেকে লেখা জমা দিলে কেন জানি সেটা মডুদের কাছে যায় না। এই লেখাটা এক ফ্রেন্ডের পিসি থেকে জমা দেয়া। সমস্যাটা কি আমার পিসিতে, না ব্রাউজারে কিছুই ধরতে পারতেসি না।

আশফাক আহমেদ

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ভালো লাগছে


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, ভাইয়া। তবে একটু ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিলে আরো ভালো লাগতো।

আশফাক আহমেদ

নিবিড় এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

শাবাস শাবাস কাকু, শাবাস শাবাস দেঁতো হাসি (আশফাক আমার এক কাকুজানের নাম- খোদার্কসম দেঁতো হাসি )
গল্প ভাল্লাগছে, তবে ঢাকায় মেস্তরি কাম ছাইড়া মমেনসিং গিয়া বৈদ্যের কাম কখন ধরলি সেইটা তো জানাস নাই।
গল্পের নাম, "এই দৃশ্যটা আমার" দিলে মনয় ভালৈতো

ধৈবত

বইখাতা এর ছবি

চমৎকার লেগেছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগলো হাততালি

এম এছ নিলয়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।