দিঙমূঢ়

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/০৩/২০১১ - ৯:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঢাকা-ব্যাংকক-ওসাকা-সানফ্রানসিস্কো দীর্ঘ সাতাশ ঘন্টার বিমান জার্নি৷ হৃদি আয়নায় তাকাল৷ তার মসৃণ মুখ ন্#৮৭২২;ান হয়ে গেছে৷ হৃদি লাগেজ খুলে দীর্ঘ চুলে শ্যাম্পু করে শাওয়ার সেরে নিল৷ চুল শ্যাম্পু করার সাথে মন ফ্রেশ হওয়ার একটা যোগাযোগ অবশ্যই আছে৷ মাথা হালকা লাগে৷ ফুরফুরা একটা ভাব তৈরী হয়৷ মনে ফূর্তি আসে৷ কেউ কেউ গান ধরে৷ পঁয়ত্রিশ তালা হোটেল ম্যারিয়ট বিল্ডিংয়ের নিস্তব্ধ ১৩১৩ নম্বর কক্ষ৷ সন্ধে সাতটা৷ হৃদির মাথায় হালকা গোলাপী বাথ টাওয়েল পেঁচানো৷ হৃদির হোটেলে রাত কাটানো আজ প্রথম৷
একাকী রুমে আয়নার সামনে বসে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চোখ পড়তেই হৃদি থমকে দাঁড়াল৷ ভিতর থেকে কিছু ভাবনা হঠাত্‍ করে শরতের শুষ্ক পাতার মত ঝরতে শুরু করল যেন নতুন এক জীবন শুরু হবে বসন্ত দিয়ে- এক পাতা, দুই পাতা, তিন পাতা, অজস্র!
'জীবন কি? কিসের জন্য বড় হওয়া? কি উদ্দেশ্যে?
একেকটি পাতায় একটি করে প্রশ্ন?
কেন এই ভাবনাগুলো হচ্ছে? হৃদি বুঝতে পারছে না৷ কিন্তু ভাবনাগুলো হচ্ছে৷
'মনে এ ধরনের প্রশ্ন আসতে কি বিশেষ পরিবেশ লাগে? সে পরিবেশ জীবনে কোনদিন আসেনি? এখন এসেছে হোটেল ম্যারিয়টের এই ঘরে? নিজেকে কোলাহলমুক্ত একটা নিচ্ছিদ্র সেলের ভিতর আবদ্ধ রাখতে হয়? হোটেলের এই ১৩১৩ নম্বর কক্ষটিকে হৃদির কাছে এমন একটা নিচ্ছিদ্র সেল মনে হলো৷ শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববার নির্জন এই ভাবনাপুরী৷ ঐন্দ্রজালিক এ ভাবনাগুলো ওর মনে চলছে তো চলছেই! ঝাঁকে ঝাঁকে দিকে দিকে৷
হৃদি হঠাত্‍ চমকে উঠল৷ ইন্টারকমে টেলিফোনের শব্দ৷ কেউ একজন কল করেছে৷ রিসিভার কানের কাছে ধরতেই শোনা গেল,
'হ্যালো হৃদি ফ্রেশ হয়েছেন?
'জি৷
'কফি খাবেন?
'ক....ফি? বিমানে আমার তেমন ঘুম হয়নি৷ তাই ভাবছি কফি খাব না৷ থ্যাংক ইউ৷
'ঘুমের ডিষ্টার্ব হয় না এমন কফিও আছে৷ খাবেন?
'ননক্যাফিন কফির কথা বলছেন? ওগুলো আছে?
'হঁ্যা, আমি কফি নিয়ে আসব?
'ভদ্রলোক ভিতরে আসবেন? এর অর্থ কি? পায়ে পায়ে আছাড় খাওয়া হচ্ছে কেন? ভাবনাটা হতেই ইতমাম আবার জিজ্ঞাস করল, 'নীচের ক্যাফেতে যাবেন?
'এই ফ্লোরে ওগুলো পাওয়া যায় না?
'না, অসুবিধা নেই৷ আমি নিয়ে আসছি৷ হৃদি, এবার কিন্তু ফিফটি ফিফটি বলতে পারবেন না৷ আমি খাওয়াবো৷ আপনার ঘড়িতে এখন কয়টা বাজে?
'ও ...., সাতটা সাতাশ৷
'আমি ঠিক সাতটা পঞ্চাশে আসছি, ঙক?
'আচ্ছা৷

হৃদির মাথাভর্তি লম্বা লম্বা চুল৷ শাওয়ারে ভিজে চুল এখনও শুঁকায় নি৷ চুল তোয়ালের ভাজে নিয়ে সে দু'হাতের তালুতে চাপ দিচ্ছে৷ এভাবে চুল শুকাতে তার অনেক সময় লাগবে৷
'ভিজে মাথায় ভদ্রলোকের সাথে কথা বলব? ভদ্রলোক কি মনে করবেন? বেশী ইন্টিমেসি দেখাচ্ছি না? মাত্র ছ'সাত ঘন্টার পরিচিত একজন যুবককে সামনে বসিয়ে রেখে চুল শুকানো যায় না৷ হাতে সময় নেই৷ হেয়ার ড্রায়ারে ভোঁভোঁ শব্দে সে চুল শুকাতে থাকলো৷

জীবনের বৈশিষ্ট কি বিষ্ময়কর! রঙহীন ফুল গন্ধ ছড়ায় রাণী হতে৷ কিছু ফুল গায়ে রঙ ছড়ায় প্রজাপতি কাছে পেতে৷ প্রাণী চায় তার বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীটি তাকে স্থানকাল নির্বিশেষে সুন্দর দেখুক৷ প্রাণীটি মানুষ-ই হোক আর পশুপাখি বা জীবজন্তু হোক৷
হৃদি চুল শুকিয়ে একটা ব্যান্ড লাগাল৷ ফুঁড়ফুঁড় করছে৷ হৃদির নরম রেশমীচুল ফোলে ফেঁপে উঠল যেন ঢেউ বইবে৷ ঠোটে হালকা করে ড্রাই লিপষ্টিক মাখল৷ আয়নায় তাকাল৷ দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তিটা আর নেই৷ সোফায় এসে দু'চোখ বন্ধ করে বসবে ভাবতেই কলিং বেলের শব্দ হলো৷ হৃদি দরজা খুলে দিল৷
'ভিতরে আসব?
'জি৷
'সরি, আমি কি আপনাকে ডিষ্টার্ব করছি ?
'না না, ঠিক আছে৷

ইতমাম টি-টেবিলে কফি রাখল৷ সাথে দু'টো ডিস্পোজিব্যল কাপ৷ সে কাপে কফি ঢেলে দিল৷ ইতমামের চোখমুখ স্বাভাবিক৷
হৃদি লাজুক মেয়ে৷ ঘরে বিশেষ কিছু একটা হচ্ছে৷ যা হচ্ছে তা হল তিনচার ঘন্টার পরিচিত একজন লোক অতিযত্নে হোটেলের এই নিঃশব্দ কক্ষে তার জন্য কাপে কফি ঢেলে দিচ্ছে৷ সে দেড় হাত দুরে তার মুখোমুখি বসে আছে৷ জড়তায় ছেয়ে গেছে হৃদির চোখমুখ৷ মনে হচ্ছে লজ্জার একটা প্লাবন ওর শরীর থেকে চূ'য়ে মাটিতে পড়বে৷ হৃদির চোখ কাপের কফির দিকে৷
ইতমাম পরিবেশটা স্বাভাবিক করল৷ এগুণ ওর আগ থেকেই আছে৷ না হলে কি সে এ ঘরে? মেক্সেিকার কফি৷ ঢাকার হৃদি! এক ঢিলে দুই পাখি! কিছু একটা বলা দরকার৷
ইতমাম জিজ্ঞাস করল, 'তার-প-র - - - ?
'জি-ই?
'আমেরিকায় কেমন লাগছে?
'জি ভালো৷
'কফি নিন৷
হৃদি কফিতে চুমুক দিল৷

এয়ার টাইট রুম৷ আবার নীরবতা৷ একদম পিনপতন নীরবতা! এধরনের নীরবতা অনেককে ভীষণভাবে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়৷ হৃদি অস্বস্তিতে পড়েছে৷ ইতমাম হৃদির দিকে তাকিয়ে আবার বলল, 'কফির স্বাদটা অরিজিনাল মনে হচ্ছে না?
'জি ভালো লাগছে৷
'আপনি কি কো-এডুকেশন সিষ্টেমে পড়ালেখা করেছেন?
'জি-ই?
'আই মীন, আপনি কি ছেলে-মেয়ে একসাথে পড়ালেখা করে এমন স্কুল-কলেজে পড়েছেন?
'না৷
'হু আমি তাই সাসপেক্ট করেছিলাম৷
'কেন? কেন?
'আমার মনে হয় আপনি একটু বিব্রতবোধ করছেন৷
'সরি, আসলে তাই৷
'যাক্ কনফারেন্সতো পরশু শেষ, দেশে ফিরছেন কবে?
'এখান থেকে সরাসরি দেশে ফিরছি না৷
'কোথায় যাচ্ছেন?
'নিউইর্য়ক হয়ে ইংল্যান্ড যাব৷
'একা?
'জি৷
'আগে কখনো গিয়েছেন?
'না৷
'কার কাছে যাবেন?
'আব্বা-আম্মার কাছে৷
'ওনারা কি ওখানকার ইমিগ্র্যান্ট?
'জি৷
'ইন্টারেষ্টিং! কবে যাচ্ছেন?
'আগামী সাতাশ তারিখে৷

পরিস্থিতি মানুষকে বদলায়৷ সময় যাচ্ছে৷ হৃদির চোখেমুখে লজ্জার জড়তা কমতে শুরু করেছে৷ তার কথাবার্তার গতিবেগও স্বাভাবিক হচ্ছে৷
হৃদি পাল্টা জিজ্ঞাস করল, 'আপনি কবে ফিরছেন?
'সাতদিন পর৷
'হৃদি, কনফারেন্সের পর আপনার সাইট সিং (ংরমযঃ ংববরহম) প্রোগ্রাম আছে?
'না৷ তবে কনফারেন্স কমিটির পক্ষ থেকে টেক্সাস যাওয়ার ব্যবস্থ্যা আছে৷
'কি-ই থাকবে সেখানে?
'বারবিকিউ, র-ফিশ পার্টি আছে৷ তারপর মিউজিয়ামে নিয়ে যাবে৷
'যাবেন?
'না৷
'কেন?
'বারবিকিউ, কাঁচা মাছ এগুলো আদিম খাবার মনে হয়৷
'কেন?
হৃদি বলল, 'আমাদের সটমাক তো আর আদিম নেই! তারপরও কেন আদিম খাবার?
'দু'একদিনের জন্য আদিম হওয়া যায় না? ইতমামের চোখেমুখে অন্য রকম ঝিলিক!
'আমার ভাল লাগে না৷
'সত্যি আপনি সিরিয়াস মেয়ে!
'খাওয়ার ব্যাপারে আমি কমপ্রোমাইজ করি না৷
'আপনার কথায় আমি অভিভূত৷ বাঙ্গালী সংস্কার!
হৃদি বলল, 'আপনি মনপুরে খেতে পারবেন না৷ দেখবেন প্রোগ্রামটাই যেন কেমন ভাল যাচ্ছে না৷
'এক্সাট্লী৷ তবে, জীবন মানেইতো বৈচিত্র! খাওয়া-দাওয়ায় একদিন বৈচিত্র আনলে তেমন ক্ষতি হবে?
'ক্ষতি হবে কি না জানি না তবে আমি খাবনা৷
'আমি কি আপনাকে একটা ব্যত্তিুগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?
হৃদি চোখ বড় করে তাকায়৷
'প্রশ্নটা কি?
'যদি কিছু মনে না করেন তবেই ব্যত্তিুগত প্রশ্নটি করব৷
'করুন৷
'সাহস দিচ্ছেন তো! হৃদি, আপনি কি ম্যারিড ?

চুপচাপ পরিবেশ৷ হৃদির মাথায় এখন নিউরনের খেলা চলছে৷ এ খেলাগুলোতে শরীরের নার্ভগূলো অদ্ভুুতভাবে মেতে উঠে৷ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না৷ শুধু ম্ি#৭১৩;্ত্ে#৭১৩;্কর ঢেউগুলো আন্দোলিত হয়৷ দ্রুতগতিতে ঢেউগুলো এই বাড়ছে আবার কমছে৷
'কি হলো হৃদি কথা বলছেন না কেন? ইতমাম নিজের কাপে কফি ঢেলে দিল৷

হৃদি হাসল৷ ও হাসলে পাগলপরা হাসি হাসে৷ ইতমাম বিমোহিত হল৷ কফি খাওয়া হচ্ছে না যেন কাপে হৃদির হাসি ভরে ভরে খাওয়া হচ্ছে৷ সে তন্ময় হয়ে সামনের মানুষটিকে দেখছে৷
হৃদি বলল, 'আই অ্যাম আনম্যারিড৷
'ডু ইউ হ্যাভ বয় ফ্রেন্ড?
'নো৷
'ডু ইউ এক্সপেক্ট?
'নো৷

ইতমাম একটু হোচট খেল৷ সে মনে মনে বলল, 'এত সুন্দরী বয় ফ্রেন্ড নেই! মেয়েটি মিথ্যে বলছে না তো?
ইতমাম জিজ্ঞাস করল, 'হোয়াই নট?

হৃদির মিহি পাতলা ঠোটে বলা কথা মানুষকে আকর্ষন করে৷ সে ইতামের সামনে বসে আছে৷ তার বয়ফ্রেন্ড কেন নেই তা সে জানতে চাচ্ছে৷ ইতমামকে তার এখন আর অপরিচিত মনে হচ্ছে না৷ অনেক চেনা৷ অনেক দিনের পরিচিত৷ না হলে সে এই ১৩১৩ নাম্বার রুমে কেন? বেশ খানিকটা সময় নিঃশব্দে থাকার পর হৃদি মৃদু হেসে বলল, 'নো বলাটা বোধ হয় ঠিক হল না৷
'হোয়াট ডিড ইউ মীন?
'ওয়েষ্টার্ন সোসাইটিতে বয়ফ্রেন্ডশীপ-গার্লফ্রেন্ড সম্পর্ক যেভাবে চলছে তা আমার খুব অপছন্দ৷
ইতমাম বুঝল হৃদি আনএক্সপোজড৷ আসলেই বয়ফ্রেন্ড নেই৷ ইতমামের মনের মধ্যে একটা আল হামদোলি্ললাহ্ শব্দ হলো৷
'ও আ-চ্ -ছা ! তা কেমন এক্সপেক্ট করেন?
'আমার ম্যারিড স্বামীই হবে আমার প্রথম এবং শেষ বয়ফ্রেন্ড৷ হৃদির সোজা সাপটা উত্তর৷
'আপনার চিন্তাভাবনা অর্থোড্#৮৭২৯;দের মত৷ সময় মানুষকে বদলে দেয়৷
হৃদি পাল্টা প্রশ্ন করল৷
'আপনি কবে ফিরছেন?
'উনত্রিশ তারিখে৷
'কোথায়?
'ব্যাংককে৷
'কি করছেন সেখানে?
'একটা হোটেলে কর্মরত৷
'ওখানকার সোসাইটি কেমন?
'আই লাইক দা সোসাইটি ভেরি মাচ৷
'ঢাকার কোথায় বাসা?
'যাত্রাবাড়ী৷
'আপনি বিয়ে করেছেন?
'না৷ তবে, বাসা থেকে প্রচন্ড চাপের মুখে রেখেছে বিয়ে করার জন্য৷
হৃদি হাসল৷
'হাসছেন যে?
'এমনি৷ বিয়েতে আপনার আপত্তি কেন?
'বিয়ে করলে বাইন্ডিংসের মধ্যে পড়তে হয়৷
'বিয়ে তো বন্ধনই৷
হৃদি ইতমামের দিকে তাকিয়ে চোখ নামাল৷
ইতমাম বলল, 'বাব্বা! আপনাকে ভয় করছে৷
'কেন?
'সেটা বুঝিয়ে বলতে পারব না৷
'বিয়ের জন্য পাত্রী খোজা হচেছ আবার বাইন্ডিংসের মধ্যে পড়তে চান না৷ কেমন কথা হলো?
ইতমামের মুখে হাসি৷
এটাই নারী হৃদয়৷ যে কিছুক্ষন আগে লজ্জাবতীর মত নূইয়ে পড়েছিল তার মুখে চড়্চড়্ খই ফোটার মত কথা ফুটছে৷ হৃদির অন্তরিন্দ্রিয় ইতমামের প্ররোচনায় তার চেয়ে এগিয়ে গেল৷ না হলে 'বিয়ের জন্য বাসায় পাত্রী খুঁজা হচেছ আবার বাইন্ডিংসের মধ্যে পড়তে চান না' কথা বেরোয় কিভাবে?
ইতমাম বলল, 'এই বিয়ে-বন্ধনের জন্য আম্মা পাত্রী খুঁজছেন৷

ইতমাম আর হৃদি কথা বলে যাচ্ছে ... ... ... ... ..

বিয়ে পবিত্র বন্ধন৷ যা থেকে শরীরের বন্ধন সৃষ্টি হয়৷

এইমাত্র বৃষ্টি হয়ে গেল৷ কদমফুল নীচে গন্ধ ছড়িয়েছে৷ অচেনা পথিক মাথা উঁচিয়ে উপরে আবেশী চোখে তাকায়৷ উপর-নীচ একাকার করা গন্ধটিতে তার নেশা হয়৷ অপরিচিত গন্ধ অতিপরিচিত গন্ধ হয়ে যায়! পথিক আর কদম! একে অপরকে মন খুলে দেয়৷ যেন গন্ধ দাও! গন্ধ নাও! জাতীয় কোন কিছুর পরিবেশ৷
এ কথাগুলোর সারমর্ম বা সারমর্ম-র অন্তর্নিহিত উত্‍স একজোড়া যুবক-যুবতীর মুখোমুখি একঘরে বসে থেকে কয়েক ঘন্টার আলাপ৷ না হলে এত আকর্ষণ হয় কি করে!

নিঃসংগ হোটেলের রুম৷ কেউ কথা শুনছে না৷ আর শুনলেও বুঝবে না৷ এ পরিবেশে এধরনের আলাপ করা যায়৷ দেশে করা যেত না৷ দেশে দেয়ালের কান আছে৷ দেয়ালের কানের সাথে মানুষের কান পাতা থাকে৷ এখানে কান পাতাপাতির কারবার নেই৷
ইতমাম নিজের রুমে চলে এসেছে৷ সে চলে যাওয়ার পর হৃদি বেশ হালকা বোধ করল৷ দেশ এখন ষোল-সতের হাজার কিলোমিটার দুরে৷ হৃদির কাছে নিজেকে ভিনগ্রহের মানুষ মনে হল৷ বদ্ধ ঘর৷ দু'জন যুবক যুবতী৷ একে অপরকে দেখল৷ একান্ত ব্যক্তিগত আলাপ করল৷ কেউ দেখুক আর না দেখুক ব্যাপারটা হৃদির কাছ খুব ভাল লাগল৷ কেন ভাল লাগল? আগে হৃদি জীবনে কোনদিন এ রকম কারোর সাথে ভাল লাগার চেষ্টা করে নি৷ আজ করেছে৷

মস্কনে কনভেনশন সেন্টার৷ আজ এর বড়বড় হলঘর গুলোতে হোটেল ম্যানেজম্যান্টের উপর সেমিনার হবে৷ হৃদি আজ সেমিনারের ফরমাল পোশাক স্কার্ট পড়েছে৷ নেভিব্লু স্কার্ট৷ বাঙালী ললনার পোশাক শাড়ী আজ স্কার্ট হয়েছে৷
অনাভ্যাসের ফোঁটা কপাল চড়চড় করে৷ নতুন পোশাক পরলে অনেকে অস্বস্তিতে পড়ে৷ কিন্তু স্কার্টে অনভ্যাস হৃদির মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা নেই৷ এটা একটা বিষ্ময়! মনে হচ্ছে স্কার্ট তার পুরনো পোশাক৷ এ পোশাকেই সে বড় হয়েছে৷
চার'টা হলরুমে বক্তৃতা হচ্ছে৷ যার দরকার সে শুনছে৷ যার দরকার নেই সে বাইরে বসে থাকছে৷ সবাইকে সব জানার দরকার হয় না৷ সব জানার চেষ্টা করলে কিছুই জানা হয় না৷ সবজান্তারা এজন্য অনেক কিছুতেই সত্যিকারের অজান্তা!
হৃদি শ্রোতা হিসাবে দু'ঘন্টার দু'টা সেমিনার শুনেছে৷ আর একটাতে ঢুকেছিল কিন্তু বক্তার দুর্বোধ্য ইংরেজীর জন্য বিরক্ত লাগছিল৷ সে বাইরে বেরিয়ে এসেছে৷ কিছু্ক্ষন পরই চা-বিরতি৷

চা-বিরতিগুলোতে সুন্দর সুন্দর ঘটনা ঘটে৷ চারদিকে ঠুংঠাং কাপ-পিরিজের মৃদু আওয়াজ৷ ঝালরে বাতাস লেগে যেন দোদুল্যমান অলংকারগুলো মৃদু মৃদু শব্দ করছে৷ অশান্ত থেকে শান্ত হও অশ্রান্ত থেকে শ্রান্ত হও৷ আর শুরু হয় চা-কফির কাপ নিয়ে এক টেবিল আর এক টেবিলে ঘোরাঘোরি আর গুঞ্জন৷ দাঁতে ঠোট চেপে হ্যালো, হাই! হাই, হ্যালো!
টেবিলে টেবিলে সারা পৃথিবীর 'একে অপরকে না দেখে চেনা' মানুষগুলোর মিলন মেলাটা বেশ জমে উঠেছে৷ এ ধরনের জটলার দিকে হৃদির মন নেই৷ তার ভাল লাগছে না৷ সে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে৷ চায়ে চুমুক দিয়ে সামনে তাকাতেই সে দেখতে পেল একজন লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে৷ 'একজন লোক '-টা হলো ইতমাম৷ দু'জনের মুখেই হাসি৷
'বক্তৃতা কেমন লাগছে?
'ভাল৷
'ক'টা পর্যন্ত শুনবেন৷
'দেখি ক'টা পর্যন্ত শোনা যায়? যতক্ষন ভাল লাগে থাকব!
'সাড়ে চারটা পর্যন্ত শুনবেন?
'না, চলে যাব৷ আগামীকাল হসপিটালিটির (ঐড়ংঢ়রঃধষরঃু) উপর কথা হবে৷ কাল সারাদিন থাকব৷
'হৃদি গোল্ডেন গেট ব্রীজে যাবেন? গোল্ডেন গেট ব্রীজ হলো সানফ্রানসিস্কোর সিম্ব্যল৷ এটা না দেখলে চলবে? সী-বিচে সী-লায়নের আড্ডা হয়! পেইন্টেড লেডিস (চধরহঃবফ ষধফরবং) দেখবেন না? একা বসে থাকার চেয়ে চলুন বেড়িয়ে আসি৷ যাবেন? চলুন, চট করে একটু ঘুরে আসি৷ যাবেন?
হৃদি বলল, 'যাওয়া যায়৷

হৃদি আর ইতমাম মস্কনের সেমিনার থেকে বাইরে চলে এলো৷

অদ্ভূত! অদ্ভূত!! সব কিছুতেই অদ্ভূত দেশ আমেরিকা! আট ফুট মানুষের পাশে সাড়ে তিন ফুট মানুষ, একশ পঞ্চাশ কেজি মানুষের পাশে চলি্লশ কেজি মানুষ হাটছে৷ হাটছে না তো দেঁৗড়াচ্ছে! পার্কের মোড়ে বিবস্ত্র মানুষ গায়ে রং লাগিয়ে মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ ছবি তোল৷ টাকা দাও! ইয়ার এন্ডিং চলছে! কিস দাও! টাকা দাও! ওহ্! যত কিস তত টাকা !!
ধরাম্ ধরাম্ ড্রাম বাঁজছে৷ রাস্তা কাঁপিয়ে স্ট্রিট সিংগাররা অন্ধ স্টিভ ওনডারের গান ধরেছে - ---৷ আহ্ সে কি গান! গানের কথা উদ্ধার করা যাচ্ছে না৷
ক্যান আই হেভ ইউ?
ক্যান আই হেভ ইউ?
ক্যান আই হেভ ইউ?
ফ্রম মি-ই৷
ইউ আর সেক্সফুল,
সো নাইস টু সি-ই !
কাম অন লেডি ---

খেয়েছে! তাড়াতাড়ি ভাগ্৷ গান চলছে চলুক! সবাই চলছে৷ কেউবা দেঁৗড়াচ্ছে৷ কোথায়? যেখানে যার ইচ্ছে! হন্হন্ করে৷ কারোর কোন কিছু জিজ্ঞাস করার সময় আছে? টাইম ইজ মানি৷ মানি ইজ গড৷ গড ইজ এনজয়৷ যায় কই? আমেরিকা৷ হই হই রই রই!!

ওরা প্রথমে সী-লায়ন দেখতে গেল৷
রৌদ্দোকজ্জ্বল ঝকঝকে দিন৷ তাপ মনে হয় আকাশ থেকে খসে খসে পড়ছে৷ ওরা একটা সিড়ি-রাস্তার একপাশে বসল৷ ছায়াটায়া-য় না, রোদের মধ্যে৷ সৈকতের উচ্ছৃংখল বাতাস রোদের তাপকে হালকা করে দিচ্ছে৷
গলা শুঁকিয়ে গেছে৷ পানীয় জাতীয় কিছু খাওয়া দরকার৷
ইতমাম আইস ক্রীম কিনে হৃদির হাতে দিল৷ রোদে ঠান্ডা হওয়া যায় আইস ক্রীম খেয়েই৷
ইতমাম জিজ্ঞাস করল, 'হৃদি পড়াশুনা করছেন?
'পড়াশুনা শেষ করেছি?
'কিসে?
'নিউট্রিশনে এম. এস. সি করেছি ৷
'নিউট্রিশনে? আপনি হোটেল ম্যানেজম্যান্ট কংগ্রেসে এসেছেন? ইন্টারেস্টিং! ইতমামের গলায় বিষ্ময়৷
'আব্বার অনুরোধে এ কংগ্রেসে আসা৷ শেফিল্ডে আমাদের রেস্টুরেন্ট আছে৷ আব্বা আমাকে ওটার হাল ধরতে বলছেন৷
'আপনি সত্যি একজন ডিনামিক এবং সুইট মেয়ে৷ ঢাকা থেকে সানফ্রানসিস্কো পর্যন্ত একা এসেছেন৷ আপনি জীবনে অসংখ্য মানুষের চোখ কেড়েছেন৷ অথচ বিয়ে করেন নি কেন?
'আমার চোখ কেউ কাড়তে পারে নি৷ হৃদি অকপটে কথাটা বলে দিল৷
'আপনার চোখ-কাড়ার কেউ কি জন্মায় নি? আপনার মনের গিরিদূর্গে কেউ প্রবেশ করতে পারেনি?
'জানি না৷
ঘোরাঘোরির চেয়ে গল্প বেশী চলছে এবং সেটা বসে বসেই৷ প্রায় ঘন্টাখানেক এখানেই কেটে গেছে৷
ইতমাম জিজ্ঞাস করল, 'হৃদি একটা কথা বলব?
'বলুন৷
'আমি আপনার বয়ফ্রেন্ড কাম স্বামী হিসাবে আমি প্রার্থী হলে কেমন হবে? চলবে?
হৃদি মনে মনে বলল, 'এটা আবার কেমন প্রশ্ন হলো?

ইতমামের মুখে হাসি৷ এক ধরনের ফান হাসি৷ হৃদি আশা করেনি ভদ্রলোক এত সরাসরি এ প্রশ্নটি তাকে করবে৷ কিন্তু যতটা বিষ্মিত হওয়ার কথা ছিল সে ততোটা হল না৷

স্বাধীনতা মানুষের চরিত্র পাল্টে দেয়৷ বলা হয় বেশী৷ শুনতেও হয় বেশী৷ এমন একটা সরাসরি প্রস্তাব বাংলাদেশে হলে কেমন হত? এপ্রস্তাবে হৃদির মনের ভিতর একটা অনুভূতির সৃষ্টি হল যা জীবনে ও কোনদিন অনুভব করেনি৷
সে সী-লায়নের খেলা দেখছে এবং কথা বলছে না৷
'কি হলো আমাকে চলবে? ইতমামের মনটা অবশী হয়ে উঠেছে৷
হৃদি ইতমামের দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকাল৷ চোখের ভাষা দুর্বোধ্য ঠেকছে ইতমামের কাছে৷
হৃদির মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল৷
'চিন্তা করতে হবে৷
'কবে জানাবেন?
সমূদ্রের ঢেউ পাথুরে-তীরে আছড়ে পড়ছে৷ শুভ্র পানির ফেনা ঝলকে উঠছে আলো পড়ে পড়ে৷ আলো যেখান দিয়ে যেতে পারে না ওই পানির ঢেউ শ্বেতশুভ্র হয়৷
হৃদি কি বলবে? ওর সমস্ত চেতনা পানির ঢেউয়ে আলো আটকে যাওয়ার মত কোথাও আটকে গেছে৷ কি অদ্ভুুত ভাবনার কথা? বসন্ত আগে আসে৷ মৃদু বাতাস দোলে৷ কোকিলরা কোন উঁচু ডালে বসে গান গায়৷ আমাকে আপন করে নিয়ে নাও৷ বসন্ত প্রকাশ হয়ে যায়৷
'হৃদি কি ভাবছেন? কিছু বলছেন না তো?
সে সুললিত গলায় বলল, 'জানি না৷
'জানি না বললে চলবে না৷ আমেরিকাতেই জানাতে হবে!
'পরে বলব৷

স্কার্ট পরা হৃদি সুন্দর করে হাঁটুতে হাঁটু চেপে পাঁ বাঁকিয়ে ইতমামের সামনে বসে আছে৷ পায়ের পাতায় পাতা রেখে এ কোন্ দেবী সমূদ্রের তটে? স্কার্ট পরে এভাবেই বসতে হয়৷ যারা জানে না তারা পায়ের পাতাকে এভাবে পদপদ্মের পাঁপড়ি বানাতে পারে না৷ পাথরের সিড়িতে পদপদ্ম? কার না চোখ কাড়ে?
সমূদ্রের উচ্ছৃংখল বাতাস৷ চুল ওর চোখেমুখে আছড়ে পড়ছে৷ হৃদি সরিয়ে দিচ্ছে৷ আবার পড়ছে৷ আবার সরিয়ে দিচ্ছে৷ মনে হচ্ছে প্রতিযোগীতায় নামা হয়েছে৷ একপক্ষে হৃদি, অন্য পক্ষে সমুদ্রের এলামেলো বাতাস৷ বাতাস বলছে আমি কেশগূচ্ছের দেবতা৷ আমি এভাবেই সৌন্দর্য সৃষ্টি করি, হৃদি তুমি যাকে চাও তার কাছে সেটাকে বিকোবে৷ হৃদি আলগা করে খোপা বাঁধলো৷ ঘাঁড়ের কাছে তার খোপা দুলছে৷ ওখানেও বাতাস!
বাতাস-চুলের এখেলাগুলো ইতমাম অতি মনোযোগ দিয়ে দেখে যাচ্ছে৷ তার চোখ উদাসীন৷ চোখে পলক না ফেলে মানুষ কতক্ষন এভাবে তাকিয়ে থাকতে পারে? ইতমাম হৃদিকে দেখে তাই করছে৷
'কি দেখছেন এভাবে? এভাবে তাকিয়ে থাকলে কথা বলা যায়? হৃদি হাসছে৷
ইতমাম চোখ সরিয়ে নিল৷

'হৃদি আপনাকে শাড়ি পরা শিখিয়েছেন কে?
কথার আড়ালে কথা থাকে৷ ইতমাম 'শাড়ি পরা' দ্বারা কি বুঝাতে চাইল তা সে-ই জানে৷
'শাড়ী পেলেন কোথায়? এখন স্কার্ট পরেছি না?
'বলুন না আপনাকে শাড়ী পরা শিখিয়েছেন কে?
'কেউ না৷
'আপনি কি মডেলিং করেন?
'কেন?
'বলুন না?
'জি না মডেলিং করি না৷
'শুনুন, আপনাকে মডেল করলাম! নীলপরীর মডেল৷ নীলপরী স্বর্গ থেকে নীল আকাশ হয়ে থেকে মর্তে উড়ে আসছে৷ চারদিকে ঝংকার৷ সুর-ঝংকারের বাতাসে রাস্তার মানুষগুলো হাঁ করে আকাশে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে৷ আপনার শাড়ীর আচল বাতাসে উড়ছে, এলোমেলো চুল আপনার কপালে চোখে মুখে... ... ... ...
হৃদির মুখে হাসি৷
'থাইল্যান্ডে আপনি কি নাটক করেন?
'না৷
'আমাকে আকাশে উড়ালেন কেন? আবার সেখান থেকে নামালেন কেন?
'শাড়ীর বিজ্ঞাপন করলাম৷ শাড়ীর বিজ্ঞাপনে দশজন মেয়ের কোমর না দুলিয়ে এভাবে করলে কেমন হয়?
'জানি না৷
তার কন্ঠে অনুরাগ৷ অনুরাগ হলো ছোট ছোট অণু যা থেকে ভালবাসা জমাট বাঁধে৷
'হৃদি আপনি রাজ কপালে৷
'কেন?
'আপনার রূপ সৌন্দর্য মেধাসম্পদ সবই আছে৷ আপনাকে যে পাবে তার ইহজনমে আর কি দরকার আছে?
'এভাবে বলবেন নাতো৷ চোখ লাগবে৷

শতশত সী-লায়নের লীলাক্ষেত্র নাকি যুদ্ধক্ষেত্র? চিঃ চিঃ ঘত্‍ ঘত্‍ শব্দ৷ সমূদ্রের উত্তাল ঢেউ পাথরের তীরে আছড়ে পরছে৷ হাতপাহীন লুলা মানুষের মত বুক দিয়ে সামনে হেটে হেটে আছড়ে পরা ঢেউয়ের নীচ থেকে সী-লায়নরা রোদে উঠে আসছে৷ আলুথালু শরীর ওদের৷ আলুর বস্তার মত গাদাগাদি করে বসে আছে শুয়ে আছে৷ মুখভরা গোঁফদাঁড়ি৷ ওরা কি আফ্রিকার সিংহ'র পুর্বসুরী ছিল? যুদ্ধ করে দাঁতাল সী-লায়নরা তাদেরকে ভুমির জঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়েছে? তা না হলে ওগুলো এমন করছে কেন?
একটা স্ত্রী সী-লায়নের পিছনে দাঁতাল পাঁচ-ছ'টা ছুটে চলছে৷ ভয়াবহ তাদের গতি৷ গা পাথরে ছিড়ে যাচ্ছে৷ পথিমধ্যে মারামারি৷ চেঁচামেচি৷ কামড়া কামড়ি! ওটাকে শুধু আমারই চাই!
চি..চি..ঘত্‍ ঘত্‍! চারিদিকে বিশ্রী শব্দ ৷

ইতমাম ঘড়ির দিকে তাকাল৷ বিকেল পাঁচটা৷
'এবার ওঠা যাক৷
ওরা উঠে এবার গোল্ডেন গেট ব্রীজের দিকে হাটতে থাকল৷ ইতমাম জিজ্ঞাস করলো, 'হৃদি আজ ডিনার কোথায় করবেন?
'আপনি?
'আমার একটা পিজা হলেই চলবে৷
'পিজাতে চলবে? পিজাতে পর্ক থাকে না?
'পর্ক বাদ দিয়ে শুধু চিজ দিয়ে বানাতে বলব৷
'হৃদি আপনি কি খাবেন?
'দেশীয় মশলার খাবার খাব৷
'নো প্রবলেম৷ এ শহরে দ'ুটো দেশীয় মশলার খাবারের দোকান আছে৷
'আপনি এরমধ্যে সব জেনে ফেলেছেন?
যে যা চায় তার জন্য সেটা যোগাড় করে দিতে হয়৷ তা না হলে এ সী-বিচে কেন? ইতমাম মনে মনে যেন কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল৷ সেখান থেকে ফিরে এসে বলল,
'জি?
'আপনি দেখছি সত্যিই কাজের লোক৷
'একটা রেষ্টুন্টের নাম 'নিউদিল্লী'৷ মালিক টাঙ্গাইলের মীর্জাপুরের মিষ্টার রশীদ৷ নিউদিল্লীর মালিকের সাথে কথা হয়েছে৷
'টাঙ্গাইলের লোক রেষ্টুরেন্টের নাম "নিউ ঢাকা" রাখে নি কেন?
'আমি সেটা জিজ্ঞাস করিনি৷ আপনি করবেন? ইতমাম হেসে বলল৷
'আরে আমি তাই মীন করেছি নাকি? তবে শিকড়কে ভুলে যাওয়া উচিত নয়৷
'হৃদি মিষ্টার রশীদ বিয়ে করেছেন হন্ডুরাসে৷ রেষ্টুরেন্টের নাম 'নিউ হন্ডুরাস' রাখলে কি হত?

হৃদির বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরুল৷ মাটি পঁচে গেলে শিকড় আগলে উঠে৷ যে মাটি শিকড়কে ধরে রাখতে পারেনা সেখানে শিকড়কে দোষ দিয়ে লাভ কি?
'আর একটি সালিমার গার্ডেন, ২৪ জোন্স রোডে৷ মালিক একজন পাকিস্তানী৷ পাকিস্তানী মালিকের সাথে কথা বলে ভাল লাগেনি৷ কথা সুপিরিয়রিটিতে ভরা? নিউদিল্লীতে বুফে সিষ্টেমে খাওয়া দাওয়া হয়৷
'কতদুর?
'হোটেল থেকে পায়ে হাটা পথ৷ চলুন আজ ফেরা যাক৷ পরে চাইলে আবার পেইন্টেড লেডিস দেখতে আসা যাবে৷
হৃদি বলল, 'আজ চলুন৷

ওরা হোটেলে ফিরে এসেছে৷
ইতমাম বলল, 'আপনার সময় হলে রাতে টেলিফোনে জানাবেন৷ একসাথে ডিনার করব৷ অপেক্ষায় থাকব৷
'আচ্ছা ৷
ইতমাম নিজের রুম ১৩১৪ তে চলে গেছে৷

রাত ন'টা৷ সী-বীচ থেকে ফিরে এসে শুয়ে শুয়ে হৃদি অনেক কথা ভাবছে৷
কেউ কোনদিন তার চোখ কাড়তে না পারলেও এবার তার চোখ কেউ কেড়েছে বলে তার মনে হচ্ছে৷ মনের দূর্গে কেউ ইতিমধ্যে ঢুকে গেছে!
'আমি কি স্বয়ম্বরা হতে যাচ্ছি? ঢাকায় খালাকে ফোন করব? খালা কি মনে করবেন? কনফারেন্সে এসে কি করা হচ্ছে? আমি যেমন চাই ঠিক তেমনি যে এক স্বপ্নের পুরুষ সে! সারাজীবন মনে মনে যাকে খোঁজে বেরিয়েছে সে এই ম্যারিয়টে এসেছে? ইতমামকে বলতে হবে স্বামী হিসাবে তার প্রার্থিতা চলবে কি না? এটা আমেরিকাতেই বলতে হবে৷
হৃদি উঠে বসল৷ তার 'যেমন চাই ঠিক তেমনি' স্বপ্নের পুরুষটি পাশের রুমে বসে আছে৷ একসাথে ডিনার করতে যাওয়া হবে৷ এখন ডাকতে হবে৷
হৃদি ইন্টারকমে ১৩১৪ নং রুমে টেলিফোন করলো৷ কন্ঠে আড়ষ্টবোধ৷ হৃদির মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুচেছ না৷
ওপাশ থেকে ইতমাম বলল, 'হ্যালো! হ্যালো ? হু ইজ দিস?
'আমি হৃদি বলছি৷ আমি বেরুচ্ছি৷
ইতমাম বলল, 'ওহ্ হৃদি? বের হন! আমিও রেডি৷

ওরা বেরিয়ে হাইস্পীডের লিফটে ঢুকল৷ লিফটের গতি পঁয়এিশ তালা নামতে পঁয়এিশ সেকেন্ড৷ লিফটের এসির ফ্যানের বাতাসে হৃদির নরম রেশমী চুেলর কয়েকটা ইতমামের মুখের উপর এসে পড়েছে৷ ইতমাম চোখ বন্ধ করে আছে৷ হাইস্পীডের লিফটের নেগেটিভ গ্র্যাভিটির জন্য, নাকি বিশেষ কোন আবেশে ভর করে ওজনহীন-হয়ে আকাশে উড়ার অনুভূতি হওয়ার জন্য বোঝা গেল না৷ ইতমাম চোখ বন্ধ করেই ছিল৷ নিমিষেই ওরা নীচ তালায় চলে এল৷
নিউদিল্লী রেষ্টুরেন্টে যাওয়া হবে৷ ওরা ফুটপাত দিয়ে পাশাপাশি হাটতে থাকল৷ শহরের খ্যাতি হিসাবে রাস্তাটা সরু৷ রাস্তার লাইট পোষ্টের সবগুলোতে বাল্ব নেই৷ এখানেও কি লোড শেডিং হয়? রাস্তায় দ'ুপাশে জিগজ্যাগ মডেলে আলো-অন্ধকার করা আছে৷ আমেরিকার আকাশ এমনিতেই পরিসকার থাকে৷ আজ বেশী পরিসকার মনে হচেছ৷ দু'পাশে হাইরাইজিং বিল্ডিং৷ পাশে তাকিয়ে কিছু দেখা যাচ্ছে না৷ আকাশে মিটমিট করে আলো জ্বলছে-ওটা একটা তারার ছাদ৷ ঘাড় উঁচিয়ে উপরে তাকালে আকাশকে তাই মনে হল৷ উপরে তাঁরার ছাদ আর নীচে পীচঢালা পথ৷ পীচপথে সিলিকার চুমকি লাগানো৷ অদ্ভুুতভাবে চুমকিগুলো আলোর প্রতিফলনে জ্ব্ব্ব্ব্ব্বলে জ্ব্ব্ব্ব্ব্বলে উঠছে৷ পরিবেশটা সিনেমার স্বপ্নের দৃশ্যের মত মনে হচ্ছে৷ ধোঁয়া থাকলে আরো ভালো হতো৷ ধুনোকরের পেঁজা তূুলোর মত আকাশে উড়া যেতো৷
ইতমাম বলল, 'এই রাস্তার আইল্যান্ড থেকে নীচে পরে যাবেন তো!
হৃদির সম্বিত ফিরে এলো৷
'সরি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পরেছিলাম৷

ওরা নিউদিল্লী রেস্টুরেন্টে এল৷ ক্যাশে একজন বিখ্যাত ব্যক্তির ছবি টানানো আছে৷ তিনি এখানে বাংলাদেশী খাবার খেয়েছেন৷ লোকটি হলেন আমেরিকার বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন৷ ক্লিনটন সাহেব ম্যানেজারের ক্যাশে বসে টেলিফোন হাতে কথা বলেছেন৷ কা'র সাথে কথা বলেছেন সেটা নীচে লিখা থাকলে ভাল হত৷

হৃদি আর ইতমাম টেবিলে বসল৷ যে আশায় এখানে আসা হয়েছিল তা গুড়ে বালি-র মত মনে হচ্ছে৷ গুড়েবালি মনে করা কম হয়েছে৷ গুড়েবালি না গুড়েপাথর, গুড়ে চিবন দিলে পাথরের নূড়িগুলো দাঁতে লেগে ব্রম্মতালু জ্বলে উঠে৷ নিউদিল্লীর ডিনারের আইটেম সব শেষ! যা আছে বাংলায় তা বেগুনের খাট্টা, ঠান্ডা ভাত, ঠান্ডা বাটার চিকেন, ঠান্ডা কাশ্মিরি পোলাও, সাকবাটা ছাড়া রান্না করা কিছু ঠান্ডা লাবরা৷ কিছু সমুছা, নান, তন্দুরী রুটি, হালুয়া৷ লে হালুয়া! ডিনারের সময় হালুয়া!
ওরা খেতে বসল৷ দু'জনের ভিতর মায়া মায়া পরিবেশ৷ মায়াহীন এই খাবারগুলো স্ব-ইচ্ছেয় নীচে নামতে চায় না৷ জিহ্বার উপর প্রথমে চক্রাকারে ঘুরে তারপর কষ্ট করে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওগুলোকে ভিতরে নামাতে হয়৷ ম্যানেজার মিষ্টার রশীদ এসে বললেন মূল খাবার সাড়ে আটটায় শেষ হয়ে যায়৷ যা থাকে তা ডিসকাউন্টে খেতে দেয়ার জন্য৷ হোমলেস পিপ্যল নামের কিছু আমেরিকানদের এগুলো খুব প্রিয়৷ খাবারের কান্ড কোনটা বোঝা গেল না৷

ডিনার করে ওরা নিউদিল্লী থেকে বেরুল৷ আবার হাটতে শুরু করল হোটেল ম্যারিয়টের দিকে তারার রাস্তার নীচ দিয়ে৷
ইতমাম বলল, 'হৃদি, আগামী দ'ুদিন আপনার সাথে দেখা হবে না৷
'কোথাও যাচ্ছেন নাকি?
'ব্যাংকক থেকে আমার হোটেলের মার্কেটিং ম্যানেজার আসবেন৷ তাঁর সাথে টেক্সাস যাব৷
'ফিরব টু-ডেইস আফটার টু-মোরো৷ ফিরে এসে আপনার মতামত জানতে চাইব৷ আমি আপনাকে.. .. ..৷
ইতমামের 'আমি আপনাকে' শেষ করা হয় নি৷
'আপনি কি সিরিয়াসলী কথাগুলো বলছেন?
'হঁ্যা৷
হৃদি বলল, 'সময় হলে জানতে পারবেন৷ উত্তর 'না' হলে মন খারাপ করতে পারবেন না!
'আমি কিছু মনে করব না৷

ম্যারিয়টে ফিরে হৃদি ইতমাম যার যার রুমে চলে গেল৷

পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ইতমাম তার থাইল্যান্ডি বস্কে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে চলে গেছে৷ আজ ইতমামের সাথে হৃদির আর কথা হল না৷ কনফারেন্স সেন্টারে হৃদি একা গেল৷
হসপিটালিটির (আতিথেয়তার) উপর বক্তৃতা শুনতে হৃদি মস্কনের তিন নাম্বার হলঘরে ঢুকলো৷ আজকের সেমিনারের থিম টাইটেল, হসপিটালিটি মেক্স ইউ রিচার নট লোজার-আতিথেয়তা আপনাকে গরীব করে না ধনী করে৷ খুব সুন্দর টাইটেল! শোনা যাক৷
অনেক কথা শোনা হলো৷ একজন বললেন, আভিজাত্য দেখতে পায়ের জুতার দিকে তাকাও৷ সভ্যতা মাপতে ঐ দেশের টয়লেটে যাও৷ রক্তে পুষ্টির মাত্রা মাপতে তাদের ডাইনিং টেবিলে বসো৷ মন খারাপ হলে জাপানের পেট্রল পাম্পে যাও৷ পেট্রলও পাবে গ্যালন গ্যালন ভালো লাগাও পাবে৷ আতিথেয়তা মাপতে? আতিথেয়তা মাপতে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের হোটেলগুলোর রিসেপশনে যাও৷ বক্তাটি আতিথেয়তায় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মাইকের লাউড স্পীকারের ঊপরে-ই যেন বেঁকে পড়ে যাবেন! আতিথেয়তা কা'কে বলে?
আর একটা কথা বললে ভালো হতো- ক্রেজ দেখতে আমরিকায় এসো৷ তা বলা হলো না৷
আতিথেয়তা কত ধরনের-ই না হয়? কোনটা ভিতর থেকে৷ কোনটা বাইর থেকে৷ কোনটা পেতে কোনটা দিতে৷ হোটেলের আতিথেয়তা শুধু পেতে৷ ব্যবসা আর কত কি নিয়ে মানুষ করবে?
হৃদির টায়ার্ড লাগছিল৷ ভালোও লাগছিল না৷ সে হলঘর থেকে বেরিয়ে এলো৷ চার পাশ শূণ্য৷ কেউ যেন খালি করে দিয়ে গেছে৷ সামান্য আংটি চুরি হলে মানুষের মন খারাপ থাকে! আর মন চুরি?! সে তো অসামান্য চুরি! চারিদিক হাহাকার! উদাসীনতা৷ শুন্যতা৷ মাথা শুন্য৷ বুক শুন্য৷ সব শুন্য ! মনে হচ্ছে ভিতরটা চুরি হয়ে গেছে৷
চা বিরতি হলো৷ পিঁপড়ের মত হলঘর থেকে লোকজন চায়ের টেবিলে ছুটে আসছে৷ হৃদির চায়ের টেবিলে যেতে ভালো লাগছিল না৷ সে আজ আর চা-কফি কিছু খেলো না৷
'গুড বাই মস্কনে সেন্টার৷
হৃদি একা একা মস্কনে কনভেনশন সেন্টার থেকে বেরিয়ে এলো৷ তার মনে হচ্ছে বিমানের শেষ জানালার সে-ই ইতমামকে সে মিস করছে৷ আতিথেয়তার উপর বিকেল চারটা পর্যন্ত বক্তৃতা শুনার কথা থাকলেও বেরিয়ে আসা কেন? যাকে মিস করা হচ্ছে তাকে খোঁজা হচ্ছে? নাকি তাকে বুঝা হচ্ছে? হৃদিই উত্তর দেয়, 'জানি না৷
হৃদি মস্কনে সেন্টারের সামনের রাস্তাাটা পার হতে পারলো না৷ সবুজ বাতি লাল হয়ে গেছে৷ এদেশের মানুষগলো রাস্তার লাল বাতি সবুজ হয়ে গেলে খুব হুঁড়োহুঁড়ি করে রাস্তা পার হয়৷ মেরাথনের দেঁৗড় প্রতিযোগীতা যেন এখান থেকে-ই শুরু হবে৷ দেঁৗড় প্রতিযোগিতা কোথায় না হচ্ছে?
সিগনাল পার হয়ে সে একটা ট্যাক্স িথামিয়ে ওটাতে বসে পড়লো৷ উদ্দেশ্য পেইন্টেড লেডিস দেখতে যাওয়া৷ ট্যাক্স িওকে হেইট স্ট্রীটের মুখে নামিয়ে দিল৷
মনমোহিনী এই 'পেইন্টেড লেডিস' গুলো এ শহরটার আনন্দ-বেদনার মুখচ্ছবি৷ ওয়াল্লার থেকে প্যারনাসাস, ম্যাসোনিক থেকে স্ট্যানিয়ান জায়গাগুলো অতিতের আগুন-মাখা স্মৃতি নিয়ে পোষ্টকার্ডের ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ হৃদি হঠাত্‍ করেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল? সানফ্রানসিস্কোর সী-বিচ থেকে বাংলাদেশের সন্দীপ-হাতিয়া৷ জ্বলোচ্ছ্বাসের কোন মুখচ্ছবি কি ঐ সৈকতে রাখা আছে? পত্রিকার সেই ছবি? আব্রুহীন হতভাগা এক মা'র স্তনে আটকে থাকা এক উলঙ্গ দুধের-শিশুর মৃতু্যঘুম! বিশফুট পানির উপর-নীচ করে করেও মাকে সে ছাড়েনি? ওটাই যে তার স্বর্গ!
হৃদি কল্পনা থেকে ফিরে এলো৷
ইতমামের বলা পেইন্টেড লেডিস সম্পর্কে হৃদির মনের ইমেজ ছিল এমনঃ অপুর্ব রঙে এক প্রেমময়ী রমনী ভাষ্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে কোথাও৷ এরা শুধু প্রেমই বিলাবে৷
এগুলো অন্যকিছু৷ দাঁড়িয়ে আছে ঠিক-ই৷ কিন্তু অন্যভাবে৷ ১৮৫০ সালে শহরের জনসংখ্যার চাপে তৈরী করা ছোট ছোট দু'তালা-তিন তালা ঘর৷ তারপর, ভয়াবহ ভূমিকম্প আর আগুনে পোড়ে রয়ে যাওয়া অবশিষ্টাংশ৷ আদল ঠিক রেখে নতুন করে করা হয়েছে৷ এই শহরের ক্লাসিক ভিউ৷
বিকেলের আগুনে রোদে রঙীন ঘরগুলোকে যেন আকাশে রাখা আছে৷ অসাধারন শান্তির নীড়৷ লাভ হাউস-ভালোবাসার ঘর৷ হানিমুন করতে আসা দম্পতির জন্য এগুলো আদর্শ ঘর হয়েছে৷ কেউ এখানে একা আসে না৷ একা দেখতে আর কত ভালো লাগা? নিঃসঙ্গতা হৃদিকে আক্রমন করে বসলো৷ হৃদি ঘন্টাখানেক ঘোরে ডিনারের উদ্দেশ্যে সরাসরি হোটেল সালিমার গার্ডেনে চলে এলো৷
উদাসীন চোখ শুণ্যে ভাসে৷ ভালো খাবার ভালো লাগে না৷ ভালো গান ভালো লাগে না৷ সন্ধ্যে সাতটা৷ সে সালিমারে একা একা খেয়ে রাস্তায় একাকী হাটতে শুরু করলো৷ আমেরিকার শহুরে রাস্তায় একা হাটা যায়? হৃদি বেশ কিছুক্ষন হাটলো৷ সে হাঁটলেও ইতমামের সাথে হেঁটে গিয়ে নিউদিল্লী রেস্টুরেন্টের ঠান্ডা খাবার খেয়ে যে সুখ পেয়েছিল তা পেল না৷ যার জন্য এত আকর্ষন সে তো সাহচার্যে নেই৷ সে টেক্সাস গেছে৷ অঃঃত্‍ধপঃরড়হ আছে ধঃঃধপযসবহঃ নেই বসঢ়ঃু ষড়াব- শূণ্য ভালোবাসা! ভালো লাগছে না৷ এগুলো কি ভাবছি? হৃদি মাথা ঝাঁকালো৷

দু'দিন পর৷
হৃদি প্রথমবার আবিস্কার করল জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত সহজভাবে দেয়া যায় না৷ জীবন নাকি আগুন নিয়ে খেলা? ভালভাবে খেলতে না পারলে আগুন-ই জীবনকে নিয়ে খেলে! দু'রাত ধরে হৃদি ঘুমাতে পারে না৷
গবেষণা মানুষ কি নিয়ে না করে? ভালোবাসা নাকি মেন্টাল ইলনেস (মনোরোগ)! ভালোবাসা, ক্ষুধা তৃষ্ণা এবং ড্রাগ নেয়ার মত মস্তিষ্কের-ই বিশেষ একটা ক্রিয়া? এই ক্রিয়া মানুষকে মেরে ফেলতে পারে৷ গত রাতে হৃদির একদম ঘুম হয় নি৷ আজ লাঞ্চের পর ঘুম তাঁকে জড়িয়ে ধরেছে৷ সে এখন ঘুমুচ্ছে ..... ... ... ...

ইতমাম টেক্সাস থেকে হোটেলে তার রুমে ফিরে এসেছে৷ বিকেল চারটায় সে হৃদিকে ফোন করল৷
'হ্যালো হৃদি কেমন আছেন?
হৃদির ঘুম ভাঙল কিন্তু সে বিছানা ছেড়ে ওঠলো না৷ শুয়ে থেকেই ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, 'হ্যাঁ ভাল আছি৷ আপনি কেমন?
'ভালো৷
'আসব?
'এ-খ-ন?
'আপনি সাতটার দিকে আসুন৷
'আচ্ছা৷
হৃদি দু'ঘন্টার জন্য বেড-এলার্ম ঠিক করে রাখল৷ নির্ঘুম-দেহে গভীর ঘুম হলে চেহারা ফুটে উঠে৷ সে ঘুম থেকে উঠল জাষ্ট সাড়ে ছ'টায়৷ ইতমাম আসবে সাতটায়৷

হৃদি নেভিব্লু শাড়ী পড়েছে৷ নেভিব্লু ওর প্রিয় রঙ৷ ম্যাচ করে হালকা নেভিব্লুর ফুলহাতা ব্লাউজ৷ হাতার মাথায় আরো হালকা বেগুনি রঙের রেশমী লেস৷ ফুঁড়্ ফুঁড়্ করে রেশমী লেস নড়ে উঠছে৷ ফর্সা শরীরের কালারের সাথে খুব সুন্দর মানিয়েছে ওকে৷ নীলাম্বরী শাড়ী পরে হূদি নীলপরী হয়ে আকাশে উড়ছে৷ তার সুঢৌল গা মেঘ জমিয়ে উপত্যকা বানিয়েছে৷ সেই উপত্যকায় নেভিব্লুর নীলপদ্ম জোড়া হয়ে ফুটে আছে৷ পুজারীরা পুজার চিত্রমন্ডপ এমন সুন্দর করে৷ চিত্রমন্ডপের ব্যাকগ্রাউন্ড নীল শাড়ী৷ এই চিত্রমন্ডপে মাথা রেখে কেউ দেবতার আরাধনা করে কেউ লালসায় সম্ভোগ করে৷ কারণ ওটা নাকি স্বর্গদ্বার! এ স্বর্গদ্বারে কে না মাথা না নোয়াতে চায়?

হৃদি বারবার সোফায় উঠ-বোস করছে৷ আয়নায় বারবার নিজেকে দেখছে৷ বারবার আয়না দেখতে ওর ভাল লাগে না৷ ঘরটার মধ্যে পারফিউমের একটা সুবাতাস ঘুরপাক খাচ্ছে৷ বাতাসটা ঝাঁঝালো না৷ খুব সুমিষ্ট৷ চোখ বন্ধ করে বুক ভরে ভিতরে নেয়া যায়৷
কলিং বেল বেজে উঠল ... ... ... ... ...

ইতমাম এসেছে৷ ইতমাম রুমে ঢুকেই টি টেবিল সংলগ্ন সোফায় বসল৷ সে যা কল্পনা করেনি তার চেয়ে বেশী কিছু দেখছে৷ তার সামনে একটি নীলপরী৷
নীলপরী? নীলপরী কি আসলেই এক্সজিষ্ট করে? ছলনায় দুরে নিয়ে গিয়ে তার রক্তমাংশ খায়? আমি কে? কে আমি? আমাকে সে কি চিনতে পেরেছে? ওর সবকিছু নীল কেন? জুতা নীল? নেইল পালিশ নীল? চুলের ব্যান্ড নীল? কপালের টিপ নীল? ব্রেসলেটের চেইন নীল? ঘড়ির ডায়াল নীল? আংটির পাথর নীল? বেদনার রঙ তো নীল! নীলপরী কি লাল রক্ত খায়? ডাজ হৃদি রিয়ালী এক্সজিষ্ট? বিমানের সেই জানালা থেকে ম্যারিয়টের এই ১৩১৩ নং পর্যন্ত?
হায়রে মানুষ আর মানুষের মন! ইতমামের মনে এপ্রশ্নগুলো বেরুতে থাকলো৷ সে টাশকি খেয়ে বসে রইল৷ সে ভয়ে ভয়ে হৃদিকে দেখছে?
'চোখ? নাহ্ চোখ তো কালো!
মন অকল্পনীয় জিনিস সামনে পেলে ভয় পায়? ইতমাম মাথা ঝাঁকি দিল৷ নীল পরী-টরী কিছু না! সী-বিচে তার নিজের করা সেই মডেল নীলপরী৷ নীলপরী স্বর্গ থেকে মর্তের ১৩১৩ নম্বর রুমে উড়ে এসেছে৷ মডেলে এলোমেলো চুল কপালে চোখে মুখে ছিল৷ এখন ব্যান্ডে বাঁধা৷ সে এভাবেই হৃদিকে দেখতে চেয়েছিল৷ নীলপরীর চেয়েও অসম্ভব সুন্দর এক নীলপরী ইতমামের সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷
হৃদির মুখে হাসি৷
'কি ভাবছেন?
ইতমামের সম্বিত্‍ ফিরে এলো৷ 'কিছু না৷
'তারপর?
মৃদু হেসে হৃদি বলল, 'কি-ই তারপর?
হৃদির বুক থেকেও একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরুল ৷
'হৃদি গত দু'দিন কেমন কাটালেন? সালিমারে খেতে গিয়েছিলেন?
'হঁ্যা৷
'কেমন খেলেন?
'ভাল৷
'কোথাও গিয়েছিলেন?
'পেইন্টেড লেডিস দেখতে গিয়েছিলাম৷
'এখন বেরুবেন?
'না৷
ইতমাম হৃদির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ তার তাকানোটা কথা বলছে৷ হাজার কথা লক্ষ কথা৷ একটু থেমে ইতমাম আ্ে#৭১৩;্ত করে বলল, 'হৃদি কি ডিসিশন নিলেন আমাকে নিয়ে? হৃদি আমি কিন্তু সিরিয়াস৷
'আই হ্যাভ ডিসাইডেড টু মেরী ইউ এস মাই ফ্রে ------------ ৷
হৃদি দেখলো ইতমাম কথা বলতে পারছে না৷ অনাকাংক্ষিত প্রাপ্তি হাতে এলে মানুষ এমন করে? খানিকক্ষণ চুপ থেকে তারপর সে ফাটানি দিয়ে চিত্‍কার করে উঠল, ' ই--য়ে----স!

সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ময়কর কিছু ঘটলো হৃদির ভিতর৷ আজন্ম জমানো অবর্ষিত ভালবাসার রিমঝিম বর্ষা শুরু হলো৷ সারা আকাশ ছেঁয়ে ঝপঝপ বৃষ্টি৷ ফোটা ফোটা৷ ভালোবাসা৷ ভালোবাসা৷ বাঁশি বেহালা শানাই সেতার সব একসাথে -- ভালোবাসা ভালোবাসা৷ রিমঝিম রিমঝিম৷ এ বৃষ্টিতে ভিজে হৃদি মুগ্ধ বনে যায়৷ অবাক হয়ে সে ইতমামের দিকে তাকাল৷ চোখ নিজ থেকেই আবার বন্ধ হয়ে গেল৷
'নীচে যাবেন? হৃদি চমকে উঠলো৷
'কেন?
'ক্যাফেতে চা-কফি কিছু খাব৷
'চলুন৷
কফি শপের টেবিলে ইতমামকে অসংলগ্ন আর অস্থির লাগল৷ মনে হলো সে একটা কিছু করতে চাচ্ছে৷
'কি হলো আপনি অস্থির হয়েছেন কেন? এসির ভিতর মানুষ ঘামে? ইতমাম কপালের ঘাম মুছে বলল,
'হৃদি উপরে চলুন৷ আমার রুমে যাব৷ আমার এখন অনেক কাজ বেড়ে গেল৷
'আপনার রুমে? পরে এক সময় যাওয়া যাবে৷
'এখন চলুন না?
নিজের উপর অধিকার প্রয়োগের গলার স্বর জীবনে প্রথমবার শুনলে অনেকে রোমাঞ্চিত হয়৷
অধিকারের স্বরে ইতমাম আবার বলল, 'চলুন উপরে! হৃদি রোমাঞ্চিত হলো৷
কফি খেয়ে ওরা ইতমামের ১৩১৪ নং রুমে এলো৷ ঘরটা ফুলের গন্ধে ভরে আছে৷ অপরিচিত গন্ধ৷ গন্ধটি বিশেষ ধরনের মাদকতায় ভরা৷ শরীর মনকে শিহরিত করার গন্ধ৷ আপিল অনুভূতি জাগায়৷ ভাল লাগছিল৷
ইতমামের টেবিলে ক্রিষ্টাল ফুলদানীতে ক্যাসাব্লান্কা ফুল সাজানো৷
'হৃদি?
'হু৷
'বসুন৷
'বসবো?
'হঁ্যা৷
ভয়ার্ত দেহমনে হৃদি সোফায় বসল৷ ইতমাম তার পাশে বিছানায় বসল৷ বিখ্যাত কিছু আবেশ ঘরের ভিতর ঘুরপাঁক খাচ্ছে - সন্ধের অন্ধকার৷ বুঁনোফুলের সুবাস৷ সন্ধের অন্ধকারে কুঁড়ে ঘরের এক নিঃসঙ্গ যুবক উঁবু হয়ে তাকে ভাবছে৷ সেই 'তাকে' হলো অস্পর্শা এক কিশোরী৷ কিশোরীটি জানালায় ভিতরে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, 'এই নাও৷
কিশোরীটির হাতে একটি প্রদীপ৷ যুবকটি বলল, 'তোমার হাত না প্রদীপ?
'তোমার যেটা ইচ্ছে!
যুবকটি কিশোরীর হাতও ধরেছে প্রদীপও ধরেছে৷ প্রদীপের শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছে!

১৩১৪ নম্বর হোটেল ম্যারিয়টের নিঃসঙ্গ রুম৷ সন্ধের অন্ধকার নেই৷ ঝোপ ঝাড়ের বুঁনো বৃষ্টির গন্ধ নেই৷ কিছুক্ষন আগে আজন্ম জমে থাকা অবর্ষিত ভালবাসার রিমঝিম বৃষ্টি হয়ে গেছে৷ এ বৃষ্টিতে হৃদির দেহমন ভিজে আছে৷ পরিবেশটা এমন যে ঠিক এমুহূর্তে মানুষ অনেক রিপুর উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে৷ যারা হারায় না তাঁরা অসাধরণ৷ অসাধারণ লোক দুনিয়ার সবদেশেই খুব কম হয়৷ হৃদির ভয় হল৷
'হৃদি আপনার হাতটা এদিকে দেন৷
অজানা ভয়ে-শিহরণে হৃদির বুক কেঁপে উঠল৷ হাত এগিয়ে দিতে হলো না৷ ইতমাম আচমকা হাতটা টেনে নিল৷ নীল ফুলহাতায় রেশমী লেস কেঁপে উঠছে আর হৃদির হাত ইতমামের মুষ্ঠিত হাতে কাঁপছে৷
'এই কি হচ্ছে?
'কিচ্ছু না!
হৃদির কাঁপা হাতের মধ্যমায় ডায়মন্ডের আংটি পরিয়ে হাতের পাতায় ইতমাম ঠোট ছোঁয়াল৷
হৃদির মন চনমন করে উঠলো৷ সে আবেগে চোখ বন্ধ করে রইল৷ মনে হলো তার মাথা ঘুরবে৷
'এ কি-ই করলেন?
'ডায়মন্ডের আংটি পরালাম৷
হৃদির চোখে পানি৷
'আপনি কাঁদছেন কেন?
'আমি কাঁদছিনে!
'চোখের পানি কেন আসছে? কোত্থেকে আসছে?
'পানি না, জমিয়ে-রাখা ভালবাসা পরছে৷
'চোখের পানি ভালবাসা?
'যাকে সারাজীবন খোঁজে বেরিয়েছে তাকে আমি পেলাম৷
'আপনি বেশী মাত্রায় ইমোশনাল৷

হৃদি চোখের পানি মুছলো৷ কে আবার কা'র উপর কতটুকু নিয়ন্ত্রন হারায়? ভয়টা হৃদিকে পেয়ে বসল৷ তার শরীর কাঁপছে৷ উষ্ণ নিঃশ্বাস বের হচ্ছে৷
হৃদি বলল, 'আমি উঠব৷
ইতমামও উঠে দাঁড়াল৷ সে ক্যাসাব্লান্কা ফুলগুলো তুলে সাথে নিল৷
'ফুলগুলো আপনার টেবিলে দিয়ে আসব৷
দ'ুজনই হৃদির ১৩১৩-রুমে এল৷
ইতমাম ফুলগুলো হৃদির টেবিলে সাজাল৷
'হৃদি ডিনার করতে বাইরে যাবেন?
'যেতে চাচ্ছি না৷ আজ পিজা খাব৷ হৃদির হাসি হাসি মুখ ৷
'পিজাতে পর্ক থাকে না?
'পর্ক বাদ দিয়ে শুধু চিজ দিয়ে বানাতে বলব৷
দু'জনই হাসছে৷
'আমার কথা আমাকে ফেরত দিলেন?
'জি৷
'আজ পিজা খেতে হবে না৷ বাইরে যেতে না চাইলে আমি আপনার দরজায় ডিনারের বক্স ঝুলিয়ে দিয়ে যাব৷ আপনি নিয়ে নিবেন৷
'ডলার নিয়ে যান৷
'লাগবে না৷
'আপনার ডিনার বক্সও লাগবে না৷
'সরি, দেন৷
ইতমাম ডিনারের ডলার নিয়ে হৃদির রুম থেকে বেরিয়ে গেল৷

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী কেন খসখসে গদ্যময়? মস্তিস্কের যে নিউরণগুলো ভালবাসার ইমোশন নিয়ন্ত্রন করে গ্লুকোজের অভাবে তাদের অবস্থাই ত্রাহিত্রাহি! তখন মানসপটে প্রেয়সীর ছবি অাঁকতে ওগুলোর সময় কোথায়? নিজে বাঁচলে বাপের নাম? ওহে দেহ আগে নিজে খাও, তারপর আমাকে খাওয়াও৷ গ্লুকোজ ছাড়া আমি যে বাঁচব না৷ ওটাই যে আমি খাই৷
হৃদি তার খালাকে প্রতিদিন খালুর জন্য দুপুরের খাবার অতিযত্নে গুঁছিয়ে দিতে দিতে বলতে শুনেছে, 'খাবারটা খারাপ হোক ভালো হোক, খেয়ে নিবে৷
মানসপটে প্রিয় মুখের ছবি অাঁকার ঈশ্বরের কি সুন্দর ব্যবস্থা!

হৃদির ডিনারের খাবার দরজার নবে ঝুলিয়ে দিয়ে ইতমাম নিজের রুমে চলে এসেছে৷

দু'দিন পরের কথা৷ ভালোবাসার প্রবল আকর্ষন৷ আকর্ষনেই প্রবল বর্ষন হয়৷ বর্ষন-ঝরণা-নদী৷ হৃদির ভালোবাসার নদীতে কুলকুল করে স্রোত বইছে৷ ইতমাম তাকে ডায়মন্ডের আংটি পরিয়েছে৷ হোয়াইট গোল্ডের বেইজে ডায়মন্ড৷ আংটি পরানোর সাক্ষী ম্যারিয়টের এই ১৩১৪ নম্বর ঘর৷ হৃদি পুষ্টিবিজ্ঞানের ছাত্রী৷ রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বাবার অনুরোধে আমেরিকায় আসা৷ ম্যানেজমেণ্টের কংগ্রেস, আমেরিকা, হোটেল ম্যারিয়েটের ১৩১৩, সৈকতের সী-লায়ন, গোল্ডেন গেট ব্রীজ, পেইন্টেড লেডিস, ইতমাম .. ... সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে৷ সবকিছু স্বপ্ন্নের মত মনে হচ্ছে! স্বপ্ন তো হঠাত্‍ করেই আসে৷ হৃদির মন ইতমামের ভালবাসায় দুর্নিবার হয়ে পরলো৷ এক সময় তার গাল বেয়ে চোখের পানি নীচে পড়তে থাকে৷ হৃদি বুঝতে পারে না তার কেন এমন হচ্ছে?

হৃদি নিইউর্ক হয়ে ইংল্যান্ডে তার বাবামা'র কাছে যাবে৷ আগামীকাল ভোরে হোটেল থেকে বেরুতে হবে৷ খুব ভোরে ঘুম যদি না ভাংগে হৃদি তাই হোটেল ফ্রন্টে ফোন করে ট্যাক্স িআর এওয়েক কল (ধধিশব পধষষ) দিতে বলেছে৷ হৃদি এক সময় ঘুমিয়ে যায়৷
ভোর পাঁচটায় ইন্টারকমের স্পীকার প্রহরীর মত বলে উঠলো, 'দিস ইজ ইওর এওয়েক কল, দিস ইজ ইওর এওয়েক কল৷
এওয়েক কলের বিরত্তিুকর ডাকাডাকিতে হৃদির ঘুম ভাঙ্গলো ভোর পাঁচটায়৷ ইতমামকে সে আর ডাকেনি৷ ভালবাসার মানুষকে ডাকতে হয় না৷ তারা এমনি এমনি আসে৷ ১৩১৩-থেকে হৃদি বেরুল৷ ঘরটার জন্য তার খুব মায়া হচ্ছে৷ মানুষ আবেগী প্রাণী৷ এই ঘর সেই ঘর- যেখানে ভালবেসে কেউ তাকে প্রথম স্পর্শ করেছিল৷ কেউ তার শরীরে ঠোট ছঁূইয়েছিল৷ পিছনে তাকাতেই ওর ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠলো৷ ওর চোখে পানি৷
হৃদির দরজা খুলার শব্দে ইতমাম তার রুম থেকে বেরুল৷
'হৃদি কিছু ফেলে গেলেন নাতো?
হৃদির গলা ভারী হয়ে গিয়েছে৷
'জানি না৷
হৃদির অভিমানী গলা৷ কা'র সাথে তার অভিমান? এই চলে যাওয়ার সাথে?

ইতমাম এয়ারপোর্ট পর্যন্ত হৃদির সাথে গেল৷ ইমিগ্রেশনে ঢোকার আগ পর্যন্ত হৃদি তেমন কথা বলল না৷ চাপা একটা ভাব ওর মধ্যে৷ যে কোন সময় ঝড় উঠতে পারে৷ চোখের পানি ঝড়৷ ন্ক
ইতমাম বলল, 'হৃদি ক্যাসাব্লান্কার নতুন তোড়াটা হাতে নিন৷
ক্যাসাব্লান্কার ফাঁক দিয়ে ইতমামের দেয়া ডায়মন্ডের চিকচিক করা জ্যোতি হৃদির চোখে পড়ল৷ তার চোখও চিকচিক করছে৷ হৃদি নিঃশব্দে ছোক ছোক শব্দে ফোঁপাতে থাকল৷
সাড়ে আটটায় ফ্লাইট৷
'হৃদি ঢাকায় দেখা হবে৷
হৃদি ইমিগ্রেশনে ঢুকে পিছন ফিরে তাকাল৷
'আসি.......
তার পিছনে হোটেল ম্যারিয়টের হঠাত্‍ পাওয়া ভালবাসা 'ইতমাম'৷ সব স্বপ্নের মত!
হৃদির দু'চোখের পানি উপছে ঝরঝর করে নীচে পড়ছে৷

হৃদি ইংল্যান্ড হয়ে ঢাকায় খালার বাসায় ফিরেছে৷ খালার নিজস্ব বাসা ইস্কাটনে৷ তিনি নিঃসন্তান৷ খালা ইয়াসমীন হাবিব গৃহবধু এবং খালু আতিকুর রহমান একজন ব্যাংকার৷ সাদামাটা সংসার তাঁদের৷ হৃদি ওর খালার কাছেই বড় হয়েছে৷

মানুষের চোখমুখ হলো টলটলে পুকুরের পানির মত৷ পানির ভিতর গ্যাস থাকলে বুদবুদ হয়ে ভেসে উঠে৷ মনের ভিতর সুখ থাকলে সুখ-বুদবুদ আর দুঃখ থাকলে দুঃখ-বুদবুদ চোখেমুখে ভেসে উঠবেই৷

খালা লক্ষ্য করলেন এবার আমেরিকা থেকে আসার পর হৃদির মনের অবস্থা খুব ভাল যাচ্ছে৷ হৃদির এতটা ভাল মন তিনি ইদানীংকালে দেখেননি৷ হৃদির শোবার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ইয়াসমীন মনে মনে বললেন হৃদির আমেরিকা সফরের কথা শুনা দরকার৷ আমেরিকা ফেরত লোকদের গল্পের যন্ত্রনায় ঘরে থাকা যায় না৷ হৃদি কিছু বলছে না কেন? তিনি দরজায় কড়া নাড়িয়ে শব্দ করে এবার বললেন, 'মা ঘুমিয়ে গেছিস?
'কে খালা?
'হঁ্যা৷
'খালা ঘুমাই নি৷
'আসবে?
'হঁ্যা৷
হৃদি লাইট জ্বেলে দিল৷ খালা তার পাশে এসে বসলেন৷ হৃদি উঠে বসল৷
'খালা কিছু বলবে?
'মা ছোট বেলায় তোর মনের সুখ-দুঃখের একটা অনিবার্য উঠানামা ছিল৷ নদীর চরের মত- এই ভাঙ্গা এই গড়া৷ শুনছিস্ তো? ইয়াসমীনের মুখে হাসি৷
'বলো শুনছি?
'আপা-দুলাভাই ইংল্যান্ড থেকে বেড়াতে এসে এ বাসাতেই উঠতেন৷ তাঁরা মাসখানেক থাকেতেন৷ তোর আনন্দ, হাসি গান.. ইত্যাদি পজিটিভ ইমোশনগুলো তখন খুব পিকে থাকত৷ তাঁরা চলে যেতেন৷ তোর চেহারা ম্লান হয়ে যেত৷ সারা বছরের মনের অবস্থা যদি চার্টপেপারে দেখানো যেত তবে ডিসেম্বরের পনের থেকে জানুয়ারীর পনের তারিখ পর্যন্ত মা তোর মনের অবস্থা খুব পিকে থাকত৷

হৃদি তার খালার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ তার মনে হলো খালা যা বলছেন তা বলতে তিনি এখন তার ঘরে আসেন নি৷
খালা এতক্ষন যা বললেন তা হৃদির ছোটবেলার ইতিহাস৷ বোঝ্ বয়সের পর থেকে ওজাতীয় কোন পিকটিক ওর মনে আর থাকে না৷ বাবা মা দুরে থাকুক আর ঢাকায় থাকুক৷ এখন খালা খালুই ওর সব কিছু৷ ওর সুখ, ওর দুঃখ৷

ইয়াসমীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷
'ইমিগ্রেশন নিয়ে আপা-দুলাভাই ইংল্যান্ডে গিয়েছেন আড়াইযুগ আগে৷ তোর জন্ম ওখানেই৷ ব্রিটিশ নাগরিক হয়েও তুই প্রবাসী হতে চাসনি৷ এখনও চাস না৷ এজন্য তোর বাবামা'র সাথে তোর দ্বন্দ্ব আছে৷ এই দ্বন্দ্বে একবার আমরা জড়িয়ে পরেছিলাম৷ তোর বাবামা'র কথা ইংল্যান্ডের বাসা-সম্পদ এগুলোর উত্তরাধিকার একমাত্র তুই-ই৷ এসব শুধু তোরই জন্য৷ তোকেই ওগুলোর হাল ধরতে হবে৷ তুই ওগুলোর ধার ধারিস না৷ তুই ইংল্যান্ডে যেতে চাস না৷ থাকতে চাস না৷ তুই চাস তোর বাবামা তার সাথে ঢাকায় থাকুক৷
হৃদি নির্জীব গলায় বলল, 'খালা আর কিছু বলবে? তুমি এগুলো বলতে এসেছো?
ইয়াসমীন থেমে গেলেন এবং হৃদির দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট করে হাসলেন৷
'আমেরিকাতে তোর কনফারেন্স কেমন হলো?
'খুব ভালো৷
'আমি ভেবেছিলাম তুই নিজ থেকে বলবি৷ কিছু বলছিস না কেন?
'খালা অনেক কথা আছে৷ ভেবেছিলাম আগামীকাল তোমাদেরকে সব জানাবো৷
'মা একটা কথা বলব? তাঁর কণ্ঠে স্নেহের স্বর৷ তিনি আবার প্রসংগ বদলালেন৷
'বলো৷
'তুই যখন আমেরিকায় ছিলি আপা ইংল্যান্ড থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন৷
'কি কথা হয়েছে তোমাদের?
'তোর মা তোকে জিজ্ঞাস করতে বলেছেন তুই নিজের জীবন নিয়ে কিছু ভাবছিস? এম.এস.সি তো শেষ করলি?
হৃদির জীবনে এমন কথা নেই যেটা তার খালাকে বলা হয়নি৷ হৃদি পা মোড়ে হাটুতে বালিশ রাখলো৷ বালিশে দু'হাত রেখে থুতনিতে ভর করে খালার দিকে তাকালো৷ একটা রহস্যের তাকানো৷
'খালা ভাবছি৷ তোমরা কোন ছেলে পছন্দ করে রেখেছ?
'মা তোকে না জানিয়ে আমরা কি তা করতে পারি? হৃদি, তোর পছন্দের কেউ আছে?
হৃদি লজ্জা নিয়ে বলল, 'হঁ্যা খালা আছে৷
ইয়াসমীনের কাছে এটা একটা মহাবিষ্ময় হৃদির কাউকে পছন্দ হয়েছে৷ তিনি হৃদির মুখ থেকে আজকেই এজাতীয় কথা প্রথম শুনলেন৷ তিনি লম্বাস্বরে জিজ্ঞাস করলেন,
'বাসা কো .. থা .. য়?
'যাত্রাবাড়ী ৷
'ছেলে কি করে? ৷
'ও এখন থাইল্যান্ডের একটা হোটেলের ম্যানেজমেন্টে কর্মরত৷
'ওহ্ দারুন!
'পরিচয় কবে থেকে?
'খালা আগে থেকে পরিচয় ছিল না৷ থাকলে তো তোমাকে জানাতাম৷
'পরিচয় কোথায় হলো?
'এবার আমেরিকাতে যে কনফারেন্স হলো ওখানেই৷
'আ.চ.ছ..া রহস্য নিয়ে ইয়াসমীন ঘাঁড় ঝাঁকালেন৷
'ছবি এনেছিস?
'হঁ্যা৷
'দেখাবি?
হৃদি গোল্ডেনগেট ব্রীজে তোলা ইতমামের ছবি দেখাল৷
প্যানারোমা ছবি৷ সী-বিচের বাতাস ছবিটার গলা থেকে টাই সরিয়ে সরিয়ে নিচ্ছে৷ ব্যাকগ্রাউন্ড নীল পানির ঢেউ৷ পাশে ইন্টারন্যাশনাল অরেঞ্জ কালারের গোল্ডেন গেট ব্রীজ স্বগর্বে দাঁড়িয়ে আছে৷ নির্মল হাসি ভরা ছবিটি যেন কথা বলছে৷
ইয়াসমীন ছবিটা বিন্দু বিন্দু করে দেখতে লাগলেন৷ বাজারে ছাড়া নতুন টাকার নোট যেন প্রথম তাঁরই হাতে এসে পড়েছে৷
ছবিটি দেখতে দেখতে বললেন, 'দেখতে তো হ্যান্ডসাম৷ ওর জন্যই তুই সারা জীবন অপেক্ষায় ছিলি?
হৃদি চোখ বন্ধ করে হাঁ-বোধক মাথা ঝাঁকাল৷
'এই চোখ খোল্ ৷
'আমাকে এখনও ছবিটি দেখাস নি কেন? এ সওদা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলি রে?
হৃদির চোখমুখ হাসিতে ভরে গেল৷
'খালা আমার দেখা এখনও যে শেষ হয়নি?
'ছেলেটাকে এত ভালবেসে ফেলেছিস্?
হৃদি চোখ বন্ধ করে আবার নিমিষেই খুলল৷
মথের বাসা থেকে চঞ্চল নতুন প্রজাপতির বেরিয়ে আসা৷ ফুলে ফুলে বসা৷ এই ফুল ঐ ফুল! কত ফুল! শুধু বসা৷
'সারাজীবন যাকে খোঁজে বেরিয়েছি তাকে কি আর সাত দিনে দেখা হয়?
'পাগলী! ইংল্যান্ড হয়েই তো এলি৷ তোর আম্মার সাথে এছেলের ব্যাপারে কথা বলেছিস?
'বলিনি৷
'আমি ফোনে বলব?
'হঁ্যা৷
'বিয়ে কখন করতে চাস?
'দু'তিন মাস পর৷
'ছেলে ফোন করবে? আমি ওর সাথে কথা বলতে পারি?
'অবশ্যই৷
ইয়াসমীন হৃদির মাথায় হাত বুলালেন৷
'হৃদি? মানুষ কোন্ কাজটি করে সবচেয়ে সুখী হয় জানিস?
'বলো৷
'তোর বাবা আমার কাছে তোকে আমানত হিসাবে রেখে গিয়েছিলেন৷ মানুষ সবচেয়ে সুখী হয় আমানতের উপর অর্পিত দায়িত্ব ভালভাবে পালন করে মরতে পারলে৷ তোকে ভালঘরে বিয়ে দিতে পারলে আমার মত কে আর সুখীরে?
হৃদি তার খালার হাত ধরলো৷
'তোকে আমার কোলে দিয়ে তোর বাবা যেদিন এবাসা থেকে বেরিয়ে ইংল্যান্ড গেলেন তখন তাঁর কান্নার কথা আমি ভুলতে পারি না! তোকে ছুঁয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি তোকে মানুষ করব৷ আমি তোকে মানুষ করেছি৷

হৃদি হাই তুলল৷
'মা তুই ঘুমিয়ে পড়৷ আগামীকাল তোর বাবার সাথে কথা বলব৷
ইয়াসমীন লাইট অফ করে দিলেন৷

আতিকুর রহমান সাহেব তখনও ঘুমান নি৷ ইয়াসমীন শোবার ঘরে ফিরে আসতেই তিনি জিজ্ঞাস করলেন, 'কি ব্যাপার হৃদির সাথে খুব গল্প করলে মনে হয়? এনিথিং নিউ?
'হঁ্যা নিউ৷
'আমি কি জানতে পারি?
মিসেস ইয়াসমীন তাঁর স্বামীকে পুরো ঘটনা বললেন৷ ঘটনা তাঁর স্বামী বললেন, 'ইয়াসমীন ছেলেটাকে নিয়ে হৃদির আরো চিন্তা করা উচিত৷
ইয়াসমীন বললেন, 'আমার মনে হয় হৃদি ভাল ছেলে সিলেকশন করেছে৷ মেয়েরা দ্রুত ছেলেদের চিনে ফেলে৷
'তাই নাকি? মেয়েরা অতি দ্রুত ছেলেদের চিনে ফেলে?
'তোমার মনে সন্দেহ আছে?
'ইয়াসমীন, তাহলে আমাকে বিয়ে করে তুমি ভুল করেছিলে বলো কেন!
'আমি একা বলি না৷ সব স্ত্রীরাই বলে৷ কেন? তুমি বল না আমার মত নারীকে বিয়ে করে তুমি ভুল করেছিলে?
'হ্যা বলি!
'তোমরা পুরুষরা বল মনের সত্যি কথা৷ আর আমরা বলি মুখে মুখে৷
আতিকুর রহমান সাহেব বললেন, 'তোমরা মুখে মুখে বল?
'হঁ্যা মুখে মুখে বলি৷ সংসার কর এটা বুঝতে পার না?
ইয়াসমীনের কণ্ঠে অনুরাগ৷

পরের দিন সন্ধ্যে পাঁচটা৷ ইয়াসমীন শেফিল্ডে হৃদির বাবা হাজী রফিক সাহেবকে টেলিফোন করলেন৷
'হ্যালো...ও...ও৷ হ্যা...লো৷ স্লামালায়কুম৷ দুলাভাই কেমন আছেন?
'ভাল, তোমরা কেমন আছ? হৃদি ভালভাবে পৌঁছেছে?
'হঁ্যা ভালোভাবে পেঁৗছেছে? দুলাভাই বাংলাদেশী লাইন কেটে যেতে পারে৷ লাইন কেটে গেলে ফোন ব্যাক করবেন৷ জরুরী আলাপ আছে৷
'আচ্ছা ব্যাক করব৷
'আপা কোথায়?

উত্তর আর এলোনা৷ লাইন কেটে গেছে৷
'আরে কেটেই গেল? ধেত্‍তেরি! লাইন কাটাকাটির কথা আলাপ করাই ঠিক হয়নি৷

'শুভ কাজের আলাপ হচ্ছিল৷ লাইনটা না কেটে গেলে কি হত? শুভ কাজে বাঁধা? ইয়াসমীনের ভাল লাগল না৷ তাঁর মন চাচ্ছিল না আজ আর কথা হোক৷

কিছুক্ষন পর-ই ওপার থেকে হৃদির বাবা রিং ব্যাক করলেন ৷
...ক্রিং ক্রিং ক্রিং৷
'হ্যালো, ইয়াসমীন তোমার বোন বাইরে গেছে৷ কি ব্যাপার?
'দুলাভাই সুখবর আছে৷ আমরা হৃদিকে বিয়ে দিচ্ছি৷
'আলহামদোলিল্লাহ্্৷ ভাল খবর৷ ছেলে কি করে?
'থাইল্যান্ডের একটা হোটেলের কর্মকর্তা৷
'দেখতে কেমন?
'লম্বা ফর্সা হ্যান্ডসাম৷
'পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে?

ইয়াসমীন হোচট খেলেন৷ নামায পড়া লোক পাপাচার করতে পারে না! খারাপ হতে পারে না! নামাযের কথা এলো কেন?
'কি ব্যাপার! ইয়াসমীন চুপ করে আছ কেন?
তিনি নীচু গলায় বললেন, 'দুলাভাই আমি জানি না ছেলেটা নামাজ পড়ে কিনা?
'সে কি ঈমানদার? পরহেজগার?
'কি দার? 'কি গার?
'ঈমানদার! ছেলে কি ঈমানদার? পরহেজগার? কি বলি কি শুনো?
'সরি দুলাভাই একথাও আমি জিজ্ঞাস করিনি৷
'হৃদিকে জিজ্ঞাস করে আমাকে জানিও৷ ছেলের বাসা কোথায় ?
'যাত্রাবাড়ী৷
'তুমি ফ্যামিলির খোজ খবর নিতে থাকো৷ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রংপুরে ওর চাচা শফিকের সাথে কথা বলো৷ কথা বলেছো?
'এখনও বলিনি৷
'রংপুরে কথা বল৷ যাত্রাবাড়ী যোগাযোগ করে আমাকে জানাবে৷
'আচ্ছা, আপাকে সব বলবেন৷
'আতিক ভাল আছে?
'হঁ্যা ভালো৷ রাখি দুলাভাই৷ স্লামালায়কুম৷

ইয়াসমীন ফোন রেখে হাফ ছাড়লেন৷ দেশের বাইরে ফোন করলে শরীরে একটা স্ট্রেস পড়ে৷ জোরে বলা বা জোরে শুনা এদ'ুটো ব্যাপারই স্বতস্ফুর্ত৷ কেউ বলে দেয়নি ইয়াসমীন জোরে কথা বল, আমি জোরে শুনি৷ এগুলোর সাথে আছে বেদম টাকার টেলিফোন বিল৷ মাথা এমনি এমনি ঘুরতে থাকে৷ পানি খাওয়া দরকার৷

আতিকুর সাহেব বললেন, 'ইয়াসমীন চা খাও৷ একটু রেষ্ট নাও৷ টেলিফোন রেখে তিনি পানি খেলেন৷ পানি খেয়ে ইয়াসমীন এককাপ চা খেলেন৷ মিনিট বিশেক পর রংপুরে হৃদির চাচার সাথে কথা বললেন৷ তাঁকে খুব খুশী লাগছে৷ এমন খুশী তাঁকে ইদানীং দেখা যায় না৷ বাড়ীতে বিয়ে বিয়ে ভাব৷ মনের চারদিকে আনন্দ৷ তিনি ঝলসে উঠলেন৷ মনে হয় বিয়ে কালকেই৷

হৃদি বাইর থেকে ঘরে ঢুকতেই ইয়াসমীন হাসিহাসি ভাব নিয়ে তার দিকে তাকালেন৷
'কিছু বলবে?
'মা তুই ফ্রেস হয়ে ড্রয়িং রুমে আয়৷ তোর সাথে জরুরী কথা আছে৷
'জরুরী কথা?
'হাতমুখ ধোয়ে আয়৷ পরে বলব৷

হৃদি ফ্রেশ হয়ে হাতে কিছু নাশতা নিয়ে ড্রয়িং রুমে এলো৷
'মা আমি আজ তোর বাবার সাথে কথা বলেছি৷
'ভালো করেছো৷
'দুলাভাই জিজ্ঞাস করেিেছলেন ঐ ছেলেটি কি নামাজ পড়ে?
'আমি ইতমামকে এটা জিজ্ঞাস করিনি৷
'কি নাম বললি?
'ইতমাম৷
'ইতমাম আবার কেমন নাম হলো? জীবনে এমন নাম আজকে প্রথম শুনলাম৷ মুখে দাঁড়ি আছে? খালার কণ্ঠে রসিকতা৷
''ত' বাদ দিলে তো হয় ইমাম৷ নামের ভিতর একটা নামাজী ভাব আছে৷ মনে হয় নামাজ পড়ে৷ ঈমানদার পরহেজগার লোক মনে হচ্ছে!
হৃদি অভিযোগের সুরে লম্বা টানে হৃদি বলল, 'খা...লা!
'তুই ফোন করে জেনে নিস ও নামাজ পড়ে কি না?৷
'আমি একথা জিজ্ঞাস করতে পারব না৷ তুমি জিজ্ঞাস করে জেনে নিও৷
'আচ্ছা আমিই জিজ্ঞাস করব ৷

আমেরিকার ম্যারিয়ট হোটেল থেকে ইস্কাটন৷ ভালবাসার একটা পরিণতি অবশ্যই আছে৷ সেটা সাত দিনের হোক আর সাত বছরের হোক৷
ইতমাম ছবি পাঠিয়েছে৷ মুখে চাপ দাঁড়ি৷ ছবিটা ইয়াসমীনের খুব ভাল লাগল শুধু দাঁড়িটা ছাড়া৷ তিনি হৃদিকে বললেন, 'আমি মনে মনে দাঁড়িটা শেভ করিয়ে নিয়ে ছবিটা দেখেছি৷ চেহারায় নূরানী ভাব আছে৷ এ ছবি তোর আব্বার ভালো না লেগে যায় কই? এমন ছেলে-ই তাঁর চাই!
ইংল্যান্ডে ছবি পাঠানো হল৷ ভদ্র ছবি৷ হৃদির বাবমা'র খুব পছন্দ হয়েছে৷ হাজী রফিক সাহেব খুব উচ্ছসিত হলেন৷ তিনি মত দিলেন বিয়ে এখানে-ই হবে৷ তা-ই হচ্ছে৷

ন'বছর পর ইতমাম দেশে এলো৷ হৃদির বাবা-মা ঢাকায় এলেন৷ জমকালো অনুষ্ঠান করে বিয়ে হল হৃদির-ইতমামের৷ বিয়ের পর হৃদি স্বামীর সাথে ইস্কাটনের বাসা ছেড়ে ব্যাংকক চলে গেল৷ ইয়াসমীন হৃদির হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, 'মা প্যাকেটা ব্যাংকক গিয়ে খুলবি৷
ইস্কাটনের ইয়াসমীন খালা আবার নিঃসন্তান হয়ে রইলেন৷

ভালো চাইলেও ভাল হয় না৷ ভালো না চাইলেও ভাল হয়৷ ভালো না চাইলেও ভাল হয় না৷ কারণ ভালরা নিজের ইচ্ছে মত চলে৷
ভালবাসা করে বিয়ে হলেও হৃদির ভাল বাসায় উঠা হলো না৷ হৃদি-ইতমামের দাম্পত্য জীবন শুরু হল - হোটেলের ফ্যামিলি রুমে৷

আবহাওয়া ভালো যাচ্ছে না৷ ঘূর্ণিঝড় না৷ ঘূর্ণিঝড়ের পুর্বাভাস! হৃদির দুনিয়া গুম হয়ে এসেছে৷ হোটেলের জানালায় তাকিয়ে অনেক কিছু দেখা যায় ... আকাশ, মেঘের খেলা, শত শত বিমান, হাইওয়ে, ফ্লাইওভার, ট্রেন, বাস, যাত্রী৷ ফ্যামিলি রুমের এই হোটেল কক্ষে হৃদি যা নেই মনে করে তা হলো-- ভালবাসা!
ইয়াসমীনের প্যাকেটা খুলে যা পাওয়া গিয়েছিল তা হলো সাধারন একটা কাঠের ফ্রেম৷ ফ্রেমটির উপড়ের দিকে ইরেজী লিখা --''হোম সুইট হোম"৷ নীচের দিকে ছোটবড় দু'টি কাঠবৃক্ষ৷ মাঝখানে একটা কাঠের-শিশুকণ্যা বসে থেকে যেন বৃক্ষ দু'টির সাথে কথা বলছে৷ সংক্ষিপ্ত এক সংসার-বাগান৷ বাবা মা এবং তাঁদের একমাত্র মেয়ে সন্তান৷ মেয়েটির জামায় সন্ধা মালতির একটা কাঠফুল৷ নেভিব্লু ফ্রেমে সাদা রঙের হোম সুইট হোম লিখা৷ ফ্রেমটির ব্যাকগ্রাউন্ডটি একটি হার্টের মত৷ ফ্রেমটির দিকে তাঁকালেই হৃদির চোখ পানিতে ঘোলা হয়ে যায়৷ মায়েরা তাঁদের সন্তানদের নিয়ে কেন যে এগুলো করেন?

'হায় বিধাতা! আমায় নিয়ে তুমি এ কেমন গল্প বানালে? হোটেলের নিঃসঙ্গ ফ্যামিলি রুমের একাকী জানালায় দাঁড়িয়ে হৃদি আপন মনে এ প্রশ্নটা আকাশকে জিজ্ঞাস করে৷ হাজার হাজার বার জিজ্ঞাস করে৷
ভালবাসার শরীরিতত্ত্ব্ব! প্রেম অশরীরি কিছু না! যারা অশরীরি মনে করে তারা বোকার স্বর্গে বাস করে৷ ঐ স্বর্গে ইতমাম পা বাড়ায় না৷ জীবন মানেই বৈচিত্র৷ বৈচিত্রটা ভোগে-ই বেশী হয়!
'ইতমাম এগুলো কি-ই বলে?
ইতমামের কথা শুনে হৃদি আকাশ থেকে পরে যায়৷ এ আকাশটায় সে আমেরিকার ম্যারিয়টের ১৩১৩ নম্বর কক্ষ থেকে উড়েছিল৷
'মাত্র তিন মাস হতে চলেছে আমাদের দাম্পত্য জীবন নামে এক সাথে থাকা৷ স্থান-কাল-পরিবেশ এ ডাইমেনশনগুলো মানুষকে এভাবে বদলে দিতে পারে? এর-ই ডামাডোলে ইতমাম কি মিশে গেছে? পেশাগত সম্পর্ক ছাড়াও অনেক মেয়ের সাথে ওর বিশেষ সম্পর্ক৷ যে বিশেষ সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রী ছাড়া হওয়া সম্ভব নয়৷ তাহলে আমি 'হৃদি' কে?
বিয়ের রাত থেকে মহাশক্তিধর অদৃশ্য প্রকৃতি নাকি স্বামী-স্ত্রী একে অপরের চোখমুখ দেখেই ভিতরের কথাটা বুঝার অসীম ক্ষমতা দিয়ে দেন? কেউ সেই ক্ষমতার ব্যবহারিক প্রয়োগ অতি দ্রুত পারে৷ কেউবা একটু দেরীতে৷ দেরীতে হলেও সবাই পারে৷ হৃদির বেলায় দেরী হয়েছে৷
হৃদির কাছে আবিস্কৃত হলো ম্যারিয়টে ডায়মন্ডের আংটি পরিয়ে দেয়া সেই তার নববিবাহিত স্বামী ইতমামের রেজিস্ট্রিকৃত আরো একজন স্ত্রী আছেন৷ অরেজিস্ট্রিকৃত আরো অনেক! হৃদির চোখ বন্ধ হয়ে আসে৷ -------------------

সেই চোখ খুলে যা করা হয়েছে-- তা হলো সে হোটেলের ফ্যামিলি রুম থেকে স্বেচ্ছায় বাংলাদেশে নির্বাসনে চলে এসেছে৷ ঘটনাগুলো হৃদির কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়৷ হৃদি ইস্কাটন থেকে থাইল্যান্ড, থাইল্যান্ড থেকে যাত্রাবাড়ীতে এ শ্বাশুড়ীলয়ে৷ শ্বাশুড়ীলয়-ই তার বর্তমান ঘর৷
সেই আকাশপরীর মত৷ মর্তের এক মানবকে ভালোবাসা হলো৷ মাটিতে নেমে ভালোবাসায় তাকে স্পর্শ করতেই সে পাথরের স্ফিংস্ হয়ে গেল৷ স্ফিংসের চোখ থেকে গড়িয়ে পরা পানি কেউ দেখতে পায়? কেউ কি তার বুকে কান পেতে কিছু শুনে? আমেরিকার সেই ম্যারিয়টের ১৩১৩-১৩১৪-এর সম্পর্কের আর্তনাদ! এখন কি করব? এ জীবনটার শেষ কোথায়? জীবনটা মহাশুণ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে দিকবিদিক ছুটে চলছে? কোথায় ছুটে চলছে?
হৃদি পাঁচতলার লনে একমাত্র ননদ 'অমা'র করা বাগানের নির্মেঘ আকাশে সুযোগ পেলেই তাকিয়ে থাকে৷ সারাদিন নিজেকে প্রশ্ন করে৷
হৃদিই উত্তর দেয়, 'জানি না'৷
জীবনটা নিজের কাছে বড়ই দিঙমূঢ় লাগে৷

আজ অমা হঠাত্‍ করে হৃদির পিছনে এসে দাঁড়াল৷
'ভাবী কা'র সাথে কথা বলো?
'কারো সাথে আমার কথা হয় না তো!
হৃদিকে এবার সে আচমকা জাপটে ধরলো৷
'ভাবী আকাশে এভাবে তাকিয়ে থাকবে না তো?
সে অমার দিকে আশাহত চোখে তাকায়৷
হৃদি নিস্পৃহ কন্ঠে বলে, 'কে--ন?
'আকাশে তাকালে মানুষ উদাসীন হয়ে যায়৷ ভাবী, তোমার মন উদাসীন দেখলে আমার খুব খারাপ লাগে৷
হৃদির মন সত্যি সত্যি-ই খারাপ হয়ে যায়৷

অমার চঞ্চল মনটা তার ভাবীর জন্য জেগে উঠে৷ জলজ প্রাণীকে যেন তার জলে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া৷ ফড়ফড়িয়ে প্রাণীটা তার জল-জগতে চলে যায়৷ আহ্ কি সু .. খ!
'ভাবী তুমি ভাইয়াকে ফোন করে বলো ----
'কি বলব?
'ভাইয়া যেন আগামী মাস থেকে ব্যাংককের আবাসিক এলাকায় একটা বাসা নেন৷ অমা কটমট করে কথাগুলো বললো৷
'আমার পড়ালেখা?
'ভাইয়াকে বলো তোমাকে আর পড়ালেখা করতে হবে না৷ দরকার হলে সে পড়ালেখা করুক৷ আমৃতু্য করুক৷
হৃদির মন আরো খারাপ হয়ে যায়৷

মানুষ মানুষকে নিয়ে যতটা পরিকল্পনা করে অন্যকিছু নিয়ে ততটা পরিকল্পনা করে না৷ সংসার গড়ে পরিকল্পনা করে৷
ইভা হৃদির জা৷ বয়সে হৃদির চেয়ে সাত বছরের বড়৷ ইভার স্বামী ইশমাম৷ ননদ অমা ছাড়া সংসার নামক অতি জটিল এ সংস্থাটির একজন কর্ণধার আছেন৷ তিনি হলেন বিধবা শ্বাশুড়ী ইশতান্না বেগম৷ তাঁর নামটা আনকমন কিন্তু বিদঘুঁটে৷ এতে কা'র কি'বা করার আছে? সংসার মানেই তো জটিল বিদঘুঁটে মহাসংস্থা৷ ইশতান্না বেগমের এ সংসারটা বৈষয়িক দিক দিয়ে এজমালি হলেও বড় ছেলে ইশমাম স্ত্রী ইভাকে নিয়ে আলাদা খাওয়া দাওয়া করেন এবং নিজের মত করে নিজে ব্যবসা করেন৷

ইভার প্রশ্ন একটাই৷ প্রতিদিন একটা৷
'হৃদি ঘরে অলস সময় কাটাও কেন? মুটিয়ে যাবে তো? কিছু একটা করো৷
ইভা জানেন না হৃদির এটা অসাধারন অলসতা, নির্বাসনের অনন্ত অলসতা৷ সেটা বাংলাদেশে মাত্র দু'জন জানে৷ এক, হৃদি নিজে৷ দুই, হৃদির থাইল্যান্ড প্রবাসী স্বামী ইতমাম৷
ফ্যামিলিতে ইতমাম বলে রেখেছে হৃদিকে ব্যাংকক নিতে তার সময় লাগবে৷ কত সময় লাগবে সেটা সুনিদ্দিষ্ট করে বলা হয় না৷ মাথা ব্যথাটা কা'র? এটাই রহস্যময়ীর খেলা!! তিনি হৃদিকে নিয়ে খেলছেন৷ যে সিদ্ধ-স্বামীকে তার ঘৃণা হয় তাকে হৃদি ছেড়ে যেতে পারছে না কেন? কিসের আকর্ষণে?
'হোম সুইট হোম' এর খালার দেয়া সেই বিখ্যাত ফ্রেমটা এখন যাত্রাবাড়ীর হৃদির শোয়ার ঘরে শোভা পায়৷ 'হোম সুইট হোম' আর কাকে বলে?

হৃদিকে নিয়ে ইভার বিশেষ একটা শখ আছে৷ জা'কে কে নিয়ে জা'র শখ? সেটা কিসের শখ? ইভা মনে মনে ভয় পাচ্ছেন তাঁর শখটাকে শ্বাশুড়ী অস্বাভাবিক মনে করতে পারেন৷ তাঁর শখটা হল জা'টাকে দিয়ে টিভিতে মডেলিং করানো৷ শ্বাশুড়ী নিজের পুত্রবধুকে দিয়ে টিভিতে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন করার অনুমতি দিবেন? আহ্ শখ কি? যদি এমন কিছু হয়?
'হৃদি তো বসেই থাকে৷ তা হলে অসুবিধা কোথায়?
হৃদির সাথে তাঁর অনেক বার কথা হয়েছে৷ হৃদি শুধু হাসে৷ মৌনতা সম্মতির লক্ষন৷ হৃদির সমস্যা নেই৷
মনের কথা মনে জিইয়ে চাপা রাখতে নেই৷ অযথা মানসিক চাপ বাড়ে৷ এসপার ওসপার একটা কিছু হবেই!
ইভা মনের কথাটা একদিন শ্বাশুড়ীর কাছে গিয়ে বলে ফেললেন, 'আম্মা? অনেকদিন আপনাকে বলতে এসে একটা কথা বলতে পারিনি৷
ইশতান্না বেগম বড় বউয়ের কথায় হাসলেন৷
'কি-ই বলবে বড় বউ মা?
'আম্মা, হৃদিকে দিয়ে টিভি বিজ্ঞাপনে মডেলিং করাতে চাই৷ অনুমতি দেবেন?
ইভার প্রস্তাবে শ্বাশুড়ী চুপচাপ রইলেন৷ আশ্চর্য হওয়ার মত কোন ভাব ইশতান্না বেগমের চোখমুখে এলো না৷ ইভা ভয় ভয় করে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন৷
শ্বাশুড়ীর মুখে হালকা হাসির রেখা৷ ইভার ভয়-সন্দেহের মেঘ কেটে রোদ এলো৷ ইশতান্না বেগম মুখ খুললেন৷
'বউ মা ইতমাম দেশে নেই৷ স্বামী হিসেবে ওর অনুমতিটাই বড়৷
'জি৷
'এক কাজ কর৷ বড় বউমা, বিজ্ঞাপনের মডেলিংটা তুমিই করে ফেলো না? ইশমামতো দেশেই আছে৷
'আম্মা, বিজ্ঞাপনে হাসি হাইলাইট করা হবে৷ ইভার গলায় অতি বিনয়ী স্বর৷
'তোমার হাসিটা হাইলাইট কর৷
'হৃদির হাসির ভিতরে আল্লাহ সমস্ত সৌন্দর্য দিয়ে পাঠিয়েছেন৷ হৃদিই হাসি৷ হাসি-ই হৃদি ! আম্মা বুঝতে পেরেছেন?
ইশতান্না বেগমর হাসলেন৷
'বউমা আমার পাশে বসো৷
ইভা তাঁর পাশে বসলেন৷
তিনি ইভার দু'হাত তাঁর মুঠিতে নিয়ে বললেন, 'বউ মা, তোমাদের দু'জনের হাসি-ই আমার কাছে পৃথিবীর সেরা হাসি৷ আল্লাহ আমার ঘরে দু'টো শ্রেষ্ঠ হাসি উপহার দিয়েছেন৷ এজন্য আমি আল্লার কাছে সকাল বিকাল শুকরিয়া আদায় করি৷
'আম্মা হৃদির হাসিটি বেশী সুন্দর৷
শুকরিয়া! শুকরিয়া !! এবার ইশতান্না বেগমের মুখে অসাধারন শান্তির হাসি৷
'আচ্ছা তুমি যদি চাও তাহলে হৃদিকে দিয়ে বিজ্ঞাপন করো৷
'আম্মা থ্যাংক ইউ৷
'ইতমামকে অবশ্যই জানিয়ে করবে৷
'আম্মা ইতমামকে আগেই ফোন করেছিলাম?
'ও কি বলেছে?
'ইতমাম বলেছে হৃদি রাজি হলে তার বলার কিছু নেই৷
'ও এভাবে সোজাসাপটা বলে দিল? এটাতো রাগের কথা মনে হলো!
'আম্মা, আমি ভালো করে জিজ্ঞাস করেছিলাম৷ ইতমাম বলেছে ওর নিজের কোন সমস্যা নেই৷ হৃদি বিজ্ঞাপনী মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে৷
'আচ্ছা তা হলে কর৷ কোথায় করবে?
'আমার চাচার এডভার্টাইজিং ফার্মে৷

হৃদিকে দিয়ে মডেলিং করানোর অনুমতি পাওয়া গেল৷

হৃদি মাল্টিনেশনাল কোম্পানীর একটি জেল টুথ পেস্টের বিজ্ঞাপনের মডেলিং করল৷ নাটকের সৌজন্যে টিভি বিজ্ঞাপন, নাকি বিজ্ঞাপনের সৌজন্যে টিভি নাটক হয় তার চেয়ে বড় কথা- হৃদির করা টিভি-বিজ্ঞাপন ঘনঘন রিলে হতে দেখা যায়৷ বাসায় বসে শ্বাশুড়ী ইশতান্না বেগম হৃদিকে টেলিভিশনের পদর্ায় দেখেন৷ প্রতিদিন দেখেন৷ এটা তিনি আত্মতৃপ্তির জন্য করেন৷

বাংলামাতার সন্তানদের একটা সমস্যা আছে৷ মেধা-মননের স্বীকৃতি এদেশের মানুষ সহজে দিতে চায় না৷ সেটা কলাপাতার বাঁশি বানানোতে হোক? আর মাথা খাঁটিয়ে মাটি খুঁড়ে পাতাল থেকে মহামুল্যবান গ্যাস তুলাতেই হোক৷ এগুলোর স্বীকৃতি বহু ঘাম ঝড়িয়ে আদায় করে নিতে হয়৷ ইশতান্না বেগম মনে করছেন তার পুত্রবধূ হৃদি যা করেছে- তা অপূর্ব শিল্পকর্ম! তাঁর পক্ষ থেকে হৃদিকে একাজের স্বীকৃতি দেয়া উচিত৷ একদিন তিনি হৃদিকে ডেকে বললেন, 'ছোটবউমা আমার কাছে আসতো৷
হৃদি তাঁর কাছে এসে বসল৷
'আমি টিভি দেখি শুধু তোমাকে দেখার জন্য৷
'আম্মা থ্যাংক ইউ৷
তিনি উত্তেজনায় হৃদিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন৷
'বউ মা! দুনিয়ার সেরা হাসিই তুমি হেসেছো ৷
সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘটনা ঘটে গেল৷ হৃদি তার শ্বাশুড়ীর বুকের মধ্যে শিশুর মত হুহা করে অনেক কেঁদে উঠল৷
'কাঁদছ কেন? বউমা তুমি কাঁদছ কেন?
শ্বাশুড়ী তাঁর মমতাময়ী বুক থেকে আকড়ে ধরা হৃদিকে সরালেন৷
'বউমা তুমি খুব ভাল করেছো৷ পাগলী, খুশীতে এভাবে কেউ কাঁদে? কাঁদছো কেন?
'আম্মা খুশীতে!
খুশীতে এভাবে আসলেই কেউ কাঁদে না৷ যে কথাটা শ্বাশুড়ীকে বলা হলো না তা হলো ---- সে এদেশে নির্বাসিত হয়েছে তার ছেলের ভালবাসায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে৷ আম্মা আপনাকে আমি কিভাবে বোঝাব এ খুশী আমার বুকের যন্ত্রনার খুশী! আপনার ছেলের দংশনে এ চোখের পানি? হৃদি সশব্দে এগুলোর একটা কথাও বলল না৷
ইশতান্না বেগম হৃদিকে টেনে আবার কাছে নিলেন৷
'বউমা চল ইতমামকে ফোন করি৷
ইতমামকে ফোন করা হল৷ কিন্তু তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি৷ তাকে না পাওয়া গেলেও হৃদির মডেলিং করার ফলে কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়ঃ--
এক, কমার্সিয়াল মডেলিং করার ফলে কোম্পানীটির টুথ-পেস্টের বিক্রি ২৫% বেড়ে গেছে৷
দুই, হৃদির একটা আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ যদি সে এ লাইনে কাজ করে তবে এপেশা তাকে খ্যাতির সাথে অর্থ এনে দিবে৷
তিন, হৃদি নিজেকে মডেল কণ্যা হিসাবে দেখতে চায় না৷ অনেকে মডেল হতে ধর্ণা (!) দিয়ে বেড়ায় হৃদি সেদিকে ফিরে তাঁকায় না৷ সে চায় একটা একান্ত ঘর যেখানে থাকবে সন্তান, স্বামী আর ভালবাসা৷
সবাই সব কিছু চায় না৷ এর নামই জগত্‍সংসার আর সেখানে জন্মানো মানুষগুলোর লীলা খেলা৷
---------------------- এগুলো সব পুরনো দিনের ঘটনা৷

সময় তো বসে থাকে না৷ বসে থাকলে আগামীকাল হতো? বর্তমান? হৃদি এখন পুষ্টি বিজ্ঞানে মাষ্টার্স অফ ফিলোসোফি (এম.ফিল.) করছে৷ তার এম.ফিল.এ ভর্তি হওয়ার একটা ছোট ইতিহাস আছে৷ হৃদির ননদ অমা ইউনিভার্সিটিতে 'আন্তর্জাতিক সম্পর্ক' নামক একটা বিষয়ে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী৷ অমা এক্সট্রাঅর্ডিনারী না কিন্তু সুন্দরী৷ প্রচন্ড রকমের লাবণ্যময়ী এ মেয়েটির মন ভাবীকে নিয়ে-ই সব সময় ব্যস্ত থাকে৷ তার আত্মা হলো নিঃসঙ্গবাসিনী এই হৃদি ভাবী৷ হৃদিকে তার কাছাকাছি চাই৷ সকাল দুপুর বিকেল রাত৷ সব সময়৷
অমা চায় না তার ভাবী শুধু শুধুই ঘরে বসে থাকুক আর আকাশের সাথে কথা বলুক৷ কিছু একটা করা দরকার৷ সে জানে না তার কি করা দরকার? একদিন সে জেনে গেল৷ ইউনিভার্সিটি থেকে এসে অমা দেঁৗড়ে গিয়ে হৃদিকে বলল, 'ভাবী এম.ফিল. কোর্সে স্টুডেন্ট ভর্তি করাবে৷ তোমাকে ভর্তি হতে হবে৷
'এম.ফিল-এ ভর্তি হয়ে কি করব?
'পড়বে!
'পড়ে কি করব?
'জানি না বাবা! তুমি ভর্তি হবে, ব্যাস্৷
'আমি ভর্তি হলে তোমার কি?
'আমার সব৷

হৃদি এম.ফিল.এ ভর্তি হলো৷ অমা ক্যাম্পাসে যাওয়ার আপন সহযাত্রী পেল৷ শুরু হলো ননদ-ভাবী অমা-হৃদির ইউনিভাসির্টিতে আসা যাওয়া৷
ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বর্ষে ভর্তির আনন্দের ঝলকে শরীর মন শিহরিত হয়ে যায়৷ শিরায় শিরায় আন্দোলন! ক্যাম্পাসটা একটা অন্য পৃথিবী৷ হাটবো, দেঁৗড়াবো, হাসবো, খেলবো, পড়বো, পারলে উড়বো৷ এগুলোই জীবনের সমার্থক৷ এম.ফিল.এ ভর্তি হয়ে সে রকম কেউ কিছু অনুভব করে বলে জানা নেই৷ জীবনের সমার্থক ঐ শব্দগুলো তেজপাতার মত শুকিয়ে যায়৷ কারণ জীবনের বয়স সবসময় কমতে থাকে৷ হায়রে জীবন! হৃদিও আলাদা করে কিছু অনুভব করে না৷

এই এম.ফিল. কোর্সের-ই ছাত্র রাতুল আহমেদ কনক, রাশু, ডট চৌধুরী এবং আরো অনেকে -----৷
হারিয়ে-যাওয়া সময় আর জীবনকে ফিরে পাবার চেষ্টা? কখনও সফল হবে? সময় হলো চতুর্থ ডাইমেনশন (ফোর-ডি) যার জানালা দিয়ে বাস্তব জগত (থ্রি-ডি) দেখা হয়৷ এই চতুর্থ ডাইমেনশন-কে মানুষ দেখে না কারণ জানালা খুলে দিয়ে ওটা নিজেই ধ্বংস হয়ে যায়৷ তা না হলে হারিয়ে-যাওয়া সময়কে ফিরে পাওয়া যেতো৷ অফ পিরিওডে এম.ফিল. এর ক্লাসের মধ্যে এ কথাগুলো শোনা যায়৷ এগুলো বলে কনক, রাশু, ডট চৌধুরীরা৷ দার্শনিক কা'রে কয়?
দুনিয়ার ছ'শ কোটি লোক-ই কি দার্শনিক? কেউ কাগজে কেউ অন্তরে? কনক রাশু ডট চৌধুরী? ওদের সাথে ঘুরঘুর করা এজিএম হান্নান বা মন্টু, মালেক? এম.ফিলে ভর্তি না হয়ে তারাও কি দার্শনিক? দার্শনিক হতে হলে এম.ফিল-এ ভর্তি হতে হয়?

পুষ্টি বিজ্ঞানে এম.ফিল-এ ভর্তি হওয়া হৃদির বিষন্ন মনে হাজার প্রশ্ন৷

রাতুল আহমেদ কনক রিকশা করে ইউনিভার্সিটিতে আসছিল৷ সে রিকশা থেকে নেমে হঠাত্‍ এক কান্ড করে বসলো৷ স্থান ফুটপাত৷ ঘটনাটা এমনঃ মধ্যবয়সী একলোক একটি শিশুকে পেটাচ্ছে৷ মার খাওয়া ছেলেটার বয়স সাতের মত হবে৷ লোকটি ওকে ধমাধম পেটাচ্ছে৷ শিশুকে মারলে নাকি খোদার আরশ কাঁপে? শিশুটির চোখের পানি আর মাগো মাগো কান ফাটা চিত্‍কারে আশপাশের কারোর কিচ্ছু হচ্ছে না৷ খোদার আরশ কত দূর? পরিস্থিতি মানুষকে সাহসী করে তুলে৷ কনকের মাথায় রক্ত উঠেছে৷ সে ঝাপ দিয়ে রিকশা থেকে নামল... ... ...
'এই মাংগের পুত ওকে মারছিস কেন?
'আফনের কি-ই? 'আফনেরে মারছি !!
কনক শরীরের যত শক্তি আছে সবটা ব্যবহার করে শুরু করল কিল ঘুষি লাত্থি৷ রাস্তায় ঘুঁষি-যুদ্ধ চলছে৷ কেউ কেউ তাঁকাচ্ছে৷ কারোবা তাঁকানোর সময় নেই৷ ঢাকা শহর চলছে ঢাকার মত৷
'আমারে মারছেন ক্যান?
লোকটার নাক ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হল৷
'উঁ..য়ু.. আপনে আমারে মারছেন ক্যান?
'দেখ্, মারলে কেমন লাগে৷ শুওরের বাচ্চা, আর একটা কথা বলবি তোকে খুন করে ফেলবো!
এ ঘটনা ফিলোসফির ছাত্র কনককে না মানালেও সে এটা করে বসল৷ যাওয়ার সময় একশ টাকার একটা নোট লোকটার বুকে ছুঁড়ে দিয়ে কনক রিকশায় উঠে পড়ল৷

কনক আজ ক্লাসে ঢুকে কারোর সাথে কথা বলেনি৷ বলতেও ইচ্ছে করছিল না৷ অন্যদিন হলে সে এদিক ওদিক তাঁকাবে৷ সামান্য কথাতেই হু হা হা হি... করে হেসে উঠবে৷ কনক সবসময় বয়স্ক ছাত্রদের এই মরামরা এম.ফিল. ক্লাসটিকে রমরমা করে রাখে৷ ও নেই ক্লাস যেন স্তব্ধ হয়ে থাকে৷ আজ সে বিষন্ন হয়েই বসেছিল৷ সে এমন লোক না৷
রাশু জিজাস করল, 'এই কনক তোর কি হয়েছে?
'কিছু না৷
'শোন্, ডট ডট চৌধুরীর এক ঘটনা ঘটেছে!
কনক মনে মনে বলল, 'রিকশায় যা ঘটে গেল তার চেয়ে বড় ঘটনা আর ঘটতে পারে না৷ সে উত্তর করল না৷
রাশু আবার জিজাস করল, 'এই কনক? তোর কি হয়েছে? মনটা এত বিষন্ন দেখছি কেন?
কনক এবার নিষপ্রাণ আর বিরক্তিকর গলায় বলল, 'কি-ই ঘটেছে?
'ডট চৌধুরী আজ সকালে হাইজ্যাক্ড হয়েছিল!
'কি-ই হয়েছিল? কনকের কপালে ভাঁজ আর মুখে বিরক্তি৷
'কনক, একটু পিছনে আয়৷
রাশু কনককে ক্লাসের শেষ বেঞ্চে ডেকে নিয়ে ডট চৌধুরীর কপালে ঘটে যাওয়া সকালের ঘটনাটি বলে দিল৷
ডট চৌধুরীর ঘটনা শুনে কনক হাসতে থাকল উদাত্ত গলায়--- হু হা হা হি...হু হা হা হি...

আর কে পায়!
চৈত্রের নির্জন দুপুর৷ পথিক উদাসীন৷ সে হারজিতের এ সংসারের হিসেবের খাতার বস্তা মাথায় নিয়ে হাটছে৷ তার জীবনের সবগুলো চরায় ঘূঘূ চরানো শেষ৷ হিসেব মিলে না! নাহ্ কিছুতেই কিছু মিলে না৷ আর পারি না! আর পারি না! হঠাত্‍ তার মাথার উপর বাঁশ মট্ মট্ করে ভেঙে পরলো! কে না চমকে উঠে?
কনকের বাঁশ ফাটানি হু হা হা হি...হু হা হা হি হাসিতে ক্লাসের সমস্ত চোখগুলো তার উপর গিয়ে পরল৷
ডট চৌধুরী পিছনে গিয়ে বলল, 'এই কনক ! কনক !! এত হাসিস নে৷
কে কার কথা শুনে?
'কি শুনছিস না? যত হাসি তত কান্না, বলে গেছে লাল শর্মা৷ সত্যিই তোর চাপা একদিন আটকে যাবেরে!
কনক হেসেই চলছে --- হু হা হা হি... ... হু হা হা হি... ...
'ঠিক আছে, হেসে,তোর বিষন্ন ভাবটা ঝেরে ফেল৷ তোর মুড আজ ভালো যাচ্ছে না৷

কনকের হাসি একটা সমস্যা৷ ও সাধারণত খুব একটা হাসে না৷ কনক যখন হাসে তা সহজ হাসি হয় না৷ যা হয় তা হলো অট্রহাসি৷ অপরিচিতদের তখন মনে হবে এ লোকটি স্বর্গমত্যের অট্টহাসির দেবতা৷ তার কাছ থেকে হাসি নিয়েই মানুষ অট্টহাসি হাসে৷ আর পরিচিতদের মনে হয় কনক আর একটু হাসুক- এই শালায় হাসে কম!

যে লোকটা সহজে হাসে না৷ যার মুখ দেখলে পোড় খাওয়া মানুষের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে, যে রাস্তায় মারামারি দেখলে মারামারিতে উদ্ধুধ্য হয়-- তার বাঁশ ফাটানি হাসাহাসির রহস্যটা কি?
'তাই বলে ক্লাসের মধ্যে সে এভাবে হাসবে? না তা উচিত না৷
যাদের জীবনের হিসেব মিলে না তাদের কাছে হাসি কি হাসি? হাসি তাদের কাছে কান্না৷ কান্না তাদের কাছে জগতের কাউকে বোঝানো যায় না এমন একটা শব্দ!
ক্লাসে কনকের বাঁশ-ফাটানি হাসি যারা পছন্দ করে না তাদের কাছে এগুলো অসহ্য ঘটনা৷ তাদের দু'একজন ইতিমধ্যে বলে বসেছে, 'তার এই বাঁশ-ফাটানি হাসি ক্যাসেটে ভরে সিনেমায় বিক্রি করলেই হয়! ভালো পয়সা আসবে৷
কিন্তু যাদের মধ্যে ইন্টিমেসীর অসাধারন গন্ধ থাকে সেখানে এ কথগুলো হয় না৷ ডট চৌধুরীর কথা শুনে তারা হাসবেই৷ ডট চৌধুরীর কপালে যা ঘটে, তা কি আর কারোর কপালে ঘটে?
কনকের ক্লাসমেট ডবি্লউ ডট চৌধুরী (ড. ঈযড়ফিযঁত্‍ু) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের আবাসিক হলের ছাত্র৷ রুম নং দেড়শ৷ ১৫০ নম্বর রুমকে সে দেড়শ বলে থাকে৷ এজন্যই ১৫০ কে দেড়শ বলা৷ তার পুরো নাম ওয়াহিদ চৌধুরী৷ নিজের নামটাকে সে ডবি্লউ ডট চৌধুরী বলতে এক ধরনের থ্রিল অনুভব করে৷ কনক রাশুর মতো সেও মলিকুলার বায়োলজিতে এম.এস.সি পাশ করে পুষ্টিবিজ্ঞানে এম. ফিল.এ ভর্তি হয়েছে৷ পুষ্টিবিজ্ঞান তাকে কোন্ লেবেলের ফিলোসোফার বানাবে তা জানার বিষয় না৷ বড় কথা হলো- ডিগ্রীর বিকল্প নেই৷ যত ডিগ্রী ততো ভালো! ড্রয়িং রুমে সার্টিফিকেটের সংখ্যা বেড়ে যায়৷ মন চাইলে দোকান দেখা যায়৷ আজকাল দোকানেও সার্টিফিকেট পাওয়া যায়৷

আজ সকালে ডট চৌধূরী ঘুম থেকে উঠেছে দশটার দিকে৷ ক্যান্টিনে নাশতা করতে গিয়ে দেখে দরজায় তালা ঝুলছে৷ নাশতা শেষ৷ তার মনে হচ্ছে ক্যান্টিনের সাথে তার আড়ি শুরু হয়ে গেছে৷
সে শব্দ করে বিরক্তি নিয়ে বলল, 'ধ্যে--ত্‍ ভাগ্যটাই খারাপ!
ইদানীং কোন ঘটনা ডট চৌধূরীকে ফেভার করছে না৷ গত দু'সপ্তাহে তার কপালে তিনটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে --
একঃ ও সে দিন মতিঝিলে তার বন্ধুর অফিসে গিয়েছিল৷ উপরের তালায় উঠার জন্য লিফটের ছুইচ নবে টিপ দিতে যাবে ঠিক ঐমুহুর্তে লিফ্ট ওকে ফেলে উপরে উঠে যায়৷ লিফট ঐ দিন আর ফেরত আসে নি৷ উপরেই উঠে নষ্ট হয়ে পড়ে রইল৷ ১৯ তালায় পায়ে হেটে উঠতে হল৷

দুইঃ সাতদিন আগে সে এয়ার মেইলে বিদেশে চিঠি লিখে পাঠাল৷ ভুলে প্রাপক হয়ে চিঠি তার কাছেই ফেরত এলো! জব্বর একটা বিষ্ময়! বাংলাদেশের কারোর কপালে এমনটা কি কখনো ঘটেছে?

তিনঃ চিঠি আর লিফ্ট নিয়ে তার মনটা ভাল নেই৷ তাই গতকাল সে পুরনো ঢাকার মিটফোর্ডে ডাত্তুার ভাতিজার কাছে বেড়াতে গিয়েছিল৷ ভীষন এক সমস্যা এসে ঘাঁড়ে পরলো৷ রুমে ঢুকেই হন্তদন্ত হয়ে সে বলল, 'নেফু কিছু এলকোহল দে [সে তার ভাতিজা অর্থ্যাত্‍ ঘবঢ়যব িকে নেফু বলে ডাকে]৷
'কেন?
'গালে থুথু লেগেছে৷
ডাত্তুার ভাতিজার চোখ কপালে উঠে গেছে৷ সে হা করে তার চাচাকে অনেকক্ষন ধরে দেখলো৷
'কি-ই দেখছিস্?
'চাচু ঘটনা কি-ই?
'ঘটনা কি বুুিঝস না? ছ্যাপ লাগছে ছ্যাপ৷ একদম র-ডেলিভারী দিলাম! এবার বুঝেছিস?
'বুঝেছি৷
'চাচু, চাচির সাথে দেখা হয়েছিল নাকি?
'তুই তো এক যন্ত্রনা! আমাকে বিয়ে দিলি কবে?
'চাচু গালে থুথু লাগা ভাল৷
ডট চৌধুরী ঘাঁড় ঝেঁকে বলল, 'কেন?
'থুথুতে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী এনজাইম থাকে না?
'ডট চৌধুরী পাশের একটা ভবন দেখিয়ে বলল, 'ঐ বিল্ডিংয়ের দোতলার এক মোঁচওয়ালা থুথু ফেলেছে! নন্সসেন্স! ক্লাউন!! রাস্কেল!!! স্টুপিড ব্যাটা! তোর এনজাইম দরকার হলে বোতলে ভরে নিয়ে আয়৷ যা! এক বোতল সমান সমান একলাখ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট! নিবি?
ভাতিজা ঠোট উল্টে বলল, 'বলো কি?
'হঁ্যা, মোঁচওয়ালার চেহারা যতবার চোখে ভাসছে ততবার বমি আসছে৷ নেফু তাড়াতাড়ি এলকোহল দে, নইলে তোর বিছানা বমি করে ভাসিয়ে দেব৷
ভাতিজা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল৷ চাচু, এলকোহল কত লাগবে, নাও৷

ডট চৌধুরী অতিরিত্তু এলকোহল লাগিয়ে গালের ্#৭১৩;কীন পুরে ফেলেছিল৷ গালে পোড়ে যাওয়া স্পটের সাইজ দেখতে এমন হলো যেন কোন মাংশাসী-রাক্ষুসী তার গালে বিরামহীনভাবে কিস করে ধরে রেখেছিল! যাও কই?
ঐ স্পট লুকাতে কত কি করতে হলো? দাঁত ব্যাথা রোগীর মত চাপায় হাত দিয়ে চলতে হলো৷

গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাগুলো অদ্ভুত!
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুল ডট চৌধূরীর বুক থেকে৷ আজও ভাগ্যে নাশতা নেই! নতুন কিছু ঘটবে নাকি? কলাপসিবু্যল গেটে দু'তিনবার ঝাঁকি দিয়ে ক্যান্টিনের সামনের পাইন গাছটার ছায়ায় দাঁড়াল৷ গাছটার উস্কোখুস্ক ডালে কয়েকটা কাক কা কা করছে৷ কাক ডাকছে নাতো মাথার খুলিতে কাকগুলো গর্ত করে যেন বাসা বানানো শিখতে চাইছে৷ ডট চৌধূরী হ্যাত হ্যাত শব্দ করল না৷ কাককে তাচ্ছিল্য করে তাড়াতে চাইলে এরা নাকি মাথায় পায়খানা করে দেয়? বুদ্ধিমত্তায় কাকরা উন্নত৷ কোকিলের মাথায় কাঁঠাল ভাংগতে এরা খুব ওস্তাদ তবে মানুষের মত নয়৷ মানুষরা সারা বছর অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভাংগে আর কাকরা শুধু ডিম পারার সময়ে৷
ডট চৌধূরী মাথা নীচু করে হাটতে হাটতে হলের বাদশার দোকানে গেল৷
বাদশা তাকে এগিয়ে আসতে দেখেই বলল, 'স্যার নাশতা করবেন?
'হু, কি আছে? ডট চৌধুরীর চোখমুখে বিরক্তি ভরা৷
'হোমমেড স্লাইসড্ ব্রেড আছে, স্যার দিমু?
'আপনার হোমমেড স্লাইস্ড ব্রেডে সেদিন স্পঞ্জ পেয়েছিলাম !
'স্যার দু'একদিন থাকলে তেমন আর কি? দেশের যা অবস্থা একটু আধটু.... !
'দেশের অবস্থার সাথে সাথে আপনি স্পঞ্জকে মুরুব্বা বানিয়ে খাওয়াবেন?

ঢাকা শহর নগর হয়েছে৷ কিন্তু তার বাসিন্দাগুলো নাগরিক হতে পারেনি৷ যে শহরে খাওয়ার পানিতে কেঁচো আসে সে শহরে অনেক কিছু হতে পারে কিন্তু তার নাগরিকরা সভ্য হতে পারে না৷ হোমমেড স্লাইস্ড ব্রেডে স্পঞ্জ থাকবে৷ আড়শোলার ডিম থাকবে পাখা থাকবে৷
বেশ খানিকটা সময় চুপচাপ থেকে সে নিঃরস গলায় জিজ্ঞাস করল, 'আর কি আছে?
'বন রুটি৷
'অন্য কিছু নেই?
'স্যার কলা আছে৷
'আপনার কলা ধঁূয়ো দিয়ে জোর করে পাঁকানো৷ একটুও টেষ্ট লাগেনা! এত্তবড় শহরে ভাল কলা ভালো ব্রেড খোঁজে পান না?

ডট চৌধুরী শিশুকাল থেকে পিকি ইটার অর্থাত্‍ বেছে বেছে খায়৷ পিকি ইটারদের ক্যালরী ইনটেক কম হয়৷ এদের স্বাস্থ্য লিকলিকে হালকা পাতলা গড়নের হয়৷ এরা খাবারে খুঁত ধরে বেশী৷ এজন্য ডট চৌধুরীর আর একটা নাম আছে- খুঁতি৷
সে আর কথা বাড়াল না৷ দ'ুটো কলা আর বন রুটি নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে সে হলের গেটের দিকে যায়৷ একহাতে কলা দু'টি, অন্য হাতে মামুর দেয়া বনরুটি৷

মেঘহীন আকাশের কড়া রোদ৷ মাথার ঝাঁকড়া চুলের ছায়াটা পায়ের সামনে সামনে যায়৷ শ্যাম্পু কোম্পানীর কথামত সবার মাথার খুস্কী গেলেও তার মাথার খুস্কী দিনে দিনে বাড়ে৷
বনরুটি ধরা হাতের আঙ্গুল দিয়ে ডট চৌধূরী ওর খুস্কীচুল চুলকাতে থাকে এলোমেলো ভাবে৷ কালো বোমারু বিমানের মত একটা কালোছায়া তার দিকে ধেঁয়ে এলো বলে তার মনে হয়েছিল৷ ঘটনার আকষ্মিকতায় বুঝে উঠতে পারেনি সে কি করবে৷
ডট চৌধূরী -- হুঁউয়ু হুঁউয়ু করে কঁূত দিয়ে শব্দ করছে আর হাতে খন্ডইটা নিয়ে উঁচু ইউকেলিপ্টাসের ডালে বসা চার-পাঁচটা কাকের দলকে টারগেট করে ঢেল ছুঁড়ছে৷
'হুঁউয়ু, নাহ্ হাতও বিট্রে করছে!
কাক থেকে ঢিল বহু দুর দিয়ে যাচ্ছে৷
ওর কেনা ছোট বনরুটি দু'টি এখন কাকের বেদখলে৷
ঢিল ছুড়তে এনারজির দরকার হয়৷ পাজরের হাড়ে চিন করে ব্যাথা লাগে৷ সে ঢিল ছুঁড়া থেকে বিরত থাকল৷
'নাশতা খাব না৷ কলা দরকার নেই! অপমানে হাতে রয়ে যাওয়া কলা দুটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল৷
'কাকগুলোকে ধরে পায়ের নীচে মাড়িয়ে পিশে ভর্ত্তা বানাতে পারতাম!

ডট চৌধুরী আশপাশে তাকাল৷ ঢেলাঢেলি আর কেউ দেখেছে কি? দেখাটা খুব জরুরি৷ হলে পোষ্টার হবে 'ডট চৌধূরী কাক কতর্ৃক অপহৃত'৷ ডট চৌধূরী থেকে নাম আবার 'কাউয়া চৌধূরী' না হয়! ভাগ্য সুপ্রসন্ন ! কেউ দেখে নি৷ থ্যাংক্স গড!

সে গেটের সিড়িতে বসে বুক পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করল৷ ক্যান্টিনের কনিষ্ঠ ম্যাসিয়ার বাচ্চা শামছু দেঁৗড়ে আসছে৷
'ওর সমস্যা কি-ই? ও এদিকে কি করতে আসছে?
সে দেঁৗড়ে এসে ডট চৌধূরীকে অবিশ্বাস্য রকমের সিরিয়াস কণ্ঠে বলল, 'স্যার গাছে উঠুম?
ডট চৌধূরীর ভিতরে ছ্যাত্‍ করে উঠলো৷
'স্যার গাছে উঠুম?
'এমনতো হওয়ার কথা না? তোর ইচ্ছে হলে উঠ্!
সিড়ির গোড়ায় মাথা নীচু করে কাজে ব্যস্ত হলমুচি কালো কুটকুটে লালচান৷ হলে বেড়াতে আসা আফ্রিকান ছাত্রদেরকে লালচানের তুলনায় ফর্সা লাগে৷ তার চুল তেলে জবজব করছে৷ 'ওর খবর কি? এই শালায়ও দেখেছে? কে কা'র খবর করে?
'স্যার, কাউয়া আপনার হাত থেকে বনরুটি নিয়া গ্যাল?
সিগারেটে আর আগুন ধরানো হলো না৷ তার হাত থেমে গেছে৷ এক হাতে ম্যাচ অন্য হাতে দিয়াশলাই৷ ডট চৌধুরী আবার চমকে উঠলো!
'এ শয়তানটাও কাকের ঘটনা দেখেছে?
সে ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেল৷
'আর বলো না৷ আজকাল কাকও বেয়াদব হয়ে গেছে!
কালো কুটকুটে লালচান মাড়িসর্বস্ব মুখে হাসলো৷
'স্যার আর কইয়েন না৷ হলগুলোতে কাউয়া বেশী হইয়া গ্যাছে! মনে হয় কাউয়ার মাংশ খাইতে হইব৷
'হ্যাঁ হ্যাঁ খাও৷ যত খাবে শরীর তত চিকচিক করবে! কাকের শরীরে তেল বেশী তো!
'লালচান?
'জি স্যার?
'কাকের ব্যাপারটা কাউকে বলো না৷ প্লীজ!
লাল চান হাসল৷
'হেসো না তো৷ হাসি নিয়ে এমনি খুব সমস্যায় আছি৷
'স্যার কাউয়ার কথা কমু না৷ 'কমু না, বলেই লালচান বলল, 'স্যার পাঁচটা টাকা হবে?
সে পকেট থেকে লালচানকে পাঁচ টাকা বের করে দিল৷
'শালার মুচি! তুই আমার কাছ থেকে টাকা আদায় করে ছাড়লি? পাঁচ টাকা না, দরকার হলে লালচান তুই পঁচিশ টাকা নে৷ কু্যচ নেহি!

ডট চৌধূরী নিজের রুমে ফিরে এসে এক গ্লাস পানি খেল৷ খালি পেটে সিগারেটে আগুন ধরাল৷ জানালায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের গোলাকার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ডট চৌধূরী কাক-বিশেষজ্ঞ, খোয়া-বিশেষজ্ঞ বন্ধু কনককে স্মরন করল৷ কনক শালার মাথায় বুদ্ধি আছে! কাক নিয়ে কনকের কিছু নিজস্ব গবেষণালব্ধ প্রশ্ন আছেঃ

একঃ কাক কি ডায়নাসোর যুগে মানুষ খেত? কালের বিবর্তনে কাকরা মানুষ খেকো চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে? কাকবোমা নেই! যেটা ফাটালে শুধু কাক মারা যায়? কাকবোমা?

দুইঃ কাকের গলায় কোকিলের কণ্ঠ ঢুকিয়ে দিলে (ক্লোন করলে) কেমন হয়? ডাষ্টবীন, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ময়লার ট্রাক, ঘরের চাল সব জায়গায় ক্থহু কুহু৷ যত ময়লা তত ক্থহু কুহু৷ চারিদিকে শুধু ক্থহু কুহু'র কোরাস, মাঝে মাঝে কাওয়ালি!
কুহু কুহু করে চলে ময়লার ট্রাক ---
দুর্গন্ধ সব ঢাকার বাইরে যাক৷
কুহু কুহু ক্থহু ----
এই ছিল ডট চৌধূরীর কপালে ঘটে যাওয়া সকালের ঘটনা৷ কনকের হু হা হা হি... করে অট্টহাসির ইতিবৃত্ত্ত৷

কনক ডট চৌধূরীকে বলল, 'কি-ই আমার কথায়তো আমল দিস না! কাক-বোমা বানানো কত জরুরী হয়ে পড়েছে, বুঝেছিস? কাউয়া মারব! কাউয়ার মত যারা অন্যকে ছোঁ মারে তাদেরকে মারবো৷
ডট চৌধূরী ফিসফিস করে বলল, 'কনক একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস্?
'কি ব্যাপার?
'তুই হাসলে হৃদি ওমন কটমট করে কেন? ওর সমস্যা কি?
'বিরক্ত লাগলে তো কটমট করবেই৷
'ওর মন-মেজাজের সাথে মিলিয়ে শানাইয়ে করুণ সুর তুলবে কে?
'আরে ওগুলো রাখ্ ৷
কনক রাশুকে উদ্দেশ্য করে সিরিয়াস কন্ঠে বলল, 'এজিএম হান্নান এসেছিল? তোর সাথে দেখা হয়েছিল?
'না৷
'কনক, সাভারে তোদের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে?
'এজিএম হান্নানকে ঐ খবর আনতেই পাঠিয়েছি৷
ডট চৌধূরী বলল, 'কনক, রাশু তোরা খেতে যাবি না?
'দাঁড়াও বাবা, আর একটা লেকচার আছে৷ ওটা শেষ হোক৷

ঘণ্টা খানেক হবে৷
ক...রা...শ করে একটা লম্বা শব্দ হল৷ এজিএম হান্নান হার্ড ব্রেকে গাড়ী থামালেন৷ দ্রুত বেরিয়ে এলেন ফুটপাতের দোকান ইটালিয়াতে৷ কনকদের বিভাগের গেটের ফুটপাতে এই দোকান৷ দোকানের মালিক মধ্যবয়সী 'মামু'৷ বোনের ভাই মামু না৷ আসলেই তার নাম মামু৷ তার ছোট ভাইয়ের নাম কামু৷ ভাগ্য ভালো, কারোর নাম খামু না!
এজিএম হান্নান হন্তদন্ত হয়ে দোকানে এসে বললেন, 'মামু, কনক-রাশুরা কি উপর থেকে নেমেছে?
মামু শুনলেন কিন্তু তত্‍ক্ষণাত্‍ উত্তর দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না৷ মামু ব্যস্ত তাঁর কাষ্টোমার নিয়ে৷ দুপুর বারটা৷ কাষ্টোমার রিকশাওয়ালারা৷ এই ব্যস্ত সময়ে মামু এজিএম হান্নানের দিকে নজর দিতে মনোযোগী নন৷
'কনক-রাশু-মালেকরা উপর থেকে নেমেছে? সপ্তাহের প্রতিদিন এই প্রশ্ন শুনতে মামুর ভাল লাগেনা৷ রিকশাওয়ালাদের চা-রুটি দিতে দিতে বিরক্ত মুখে মামু মনে মনে কথাগুলো বললেন৷
'কি ব্যাপার মামু কনকরা উপর থেকে নেমেছে?
মামু অনিচ্ছাসত্বেও এবার বললেন, 'ওনারা এখনও নামেন নাই৷

এজিএম হান্নান মামুর দোকানের বেঞ্চের এক মাথায় বসলেন৷
'মামু একটা ডাবল পান দেন৷
মামু পান দিলেন৷
এজিএম হান্নান জলহস্তীর মত বড় একটা হা করে পান ঢুকিয়ে দিলেন চোয়ালের গোড়ার দিকে৷ মনে হলো আমিত্তি খেলেন৷ আমিত্তি খেতেও মানুষ এতবড় হা করে না৷ পিছনে দেয়ালের লোহার গ্রীলে ঠেস্ দিয়ে মুখ নাড়িয়ে পান চিবুচ্ছেন৷ পা নাচাচ্ছেন অসম্ভব জোরে - বেঞ্চ কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে৷
অযাচিতভাবে এজিএম হান্নানের দিকে ঘাঁড় ঘুরিয়ে আবার নজর ফিরিয়ে নিলেন মামু৷
দেয়ালের লোহার গ্রীল আর বেঞ্চে ভূমিকম্পের মত কাঁপন হচ্ছে৷ শরীরের বেগের উপর তাঁর কোন নিয়ন্ত্রন নেই৷ পানকেঁৗড়ি পাখির মত একবার বা দিক আবার ডান দিক৷
'স্যারের পায়ে মোহাম্মদ আলীর অসুখ নাকি?
এজিএম হান্নান দ্রুত ঘাড় ঘুড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'মামু কিছু বললেন?
'নাহ্! আমি কি বলুম?

মোহাম্মদ আলীর অসুখের কথাটি অস্পষ্ট করে আওড়িয়ে বেঞ্চের অপর মাথায় বসা রিকশাওয়ালাকে সরতে হল৷ ক্ষুধার্ত দেহে সে চা দিয়ে পাউরুটি খাচ্ছিল৷ এজিএম হান্নানের দাপাদাপিতে তার মুখ থেকে চায়ের কাপ সরে যাচ্ছিল৷
মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর পারকিনসন্স ডিজিজ আছে৷ বিশ্ব অলিম্পিক উদ্ধোধন করার সময় তাঁর মশাল কেঁপেছিল হাতপা কেঁপেছিল৷ রিকশাওয়ালা টেলিভিশনে তা দেখেছে৷
এজিএম হান্নান অচল বেঞ্চে বসে সারা শরীরটাকে সচল অবস্থায় রেখে কনকদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন৷
মারহাবা!
কারো সাথে দেখা করার আগে তাঁর এ রকম অবস্থা হয়৷ আর যাদি দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে তিনি চারপাঁচ হাত পথ দ্রুত সামনে হাটবেন আবার দ্রুত পিছনে ফিরে আসবেন৷ ভয়-আশংকায় এ রকম দাপাদাপি হাসপাতালে ডেলিভারী রুমের দরজায় হয়৷ রাস্তার দোকানে না৷ আধঘন্টার মত হবে এজিএম হান্নানের সময় অস্থিরতার মধ্যে কাটছে৷

কনক, রাশু, ডট চৌধূরী ক্লাশ থেকে বেরিয়ে গেটের দোকানে এল৷ এজিএম হান্নানের শরীরে স্বস্থির ফিরে এল আশ্চর্যজনকভাবে৷ তাঁর ধড়ফড়ানি ভাবটা নাই হয়ে গেল৷ আগুনের সেক লাগা শরীরে যেন বরফের ছোঁয়া লাগল৷ সেক আর বরফ কত ধরনের না-ই হয়?
এজিএম হান্নানকে দেখে কনক খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, 'বস্, ফুলতলী গিয়েছিলেন?
'হ্যাঁ গিয়েছিলাম৷ অবস্থা সিরিয়াস!
'বস্, আমাদের জমির পশ্চিম সীমানায় কয়েক হাত করে পাশের জমিওয়ালা বেদখল করেছে? ইজ ইট ট্রু ?
'হ্যাঁ কিছুটা ট্রু৷ তবে নাছির যেভাবে খবর পাঠিয়েছিল ওমনটা না?
'আপনি থ্রেট দিয়ে এসেছেন?
'না৷ রাজআমিন দিয়ে জমি মেপে দখলে যেতে বলেছি৷
আহ্ ! দুই জমিদারের মধ্যে জমি নিয়ে লাঠালাঠি লেগেছে৷ বড়লাট সাহেব এজিএম হান্নানকে মীমাংসার জন্য পাঠিয়েছিলেন৷
কনক বলল, 'লোকাল মানুষকে বুঝাতে হবে গন্ডগোল করতে আমরা ওখানে যাইনি৷ আর তাদের সাথেও সদ্ভাব বজায় রেখে চলতে হবে৷ তা না করলে ওখানে কিছুই করা যাবে না৷

কনক, এজিএম হান্নান, মন্টু দীপক এবং মালেক এই পাঁচ বন্ধু মিলে সাভারে জনৈক নাছিরের কাছ থেকে চলি্লশ কাঠা জমি কিনেছে৷ স্বাধীনভাবে একটা কিছু করবে৷ এজিএম হান্নানবাদে সবাই একাডেমিক বন্ধু৷ কনকদের সার্কেলে এজিএম হান্নান কিভাবে ঢুকেছেন তা সব বন্ধুই জানে না৷ কারো চাকুরী হয় নি৷ এখন ওরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আধুনিক পোল্ট্রি ফার্ম করবে৷ হাতে টাকা নেই৷ এটা মৌলিক সমস্যা না৷ অর্থমন্ত্রী বলেছেন ব্যাংকে টাকা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ ব্যাংকের এম.ডি'র সাথে কথা বলবে কি পরিমান লোন পাওয়া যায়? ------ এটা কনকদের স্বপ্ন৷ একদল যুবকের স্বপ্ন৷ এই স্বপ্নের অন্বেষণে রাশু এবং ডট চৌধুরী অংশ গ্রহন করেনি৷ কিন্তু কনকদের স্বপ্নের অন্বেষণের ভাষা তারা বুঝে৷ তারা চায়- কনকদের স্বপ্ন স্বার্থক হোক৷
কনক এজিএম হান্নান কে বলল, 'বস, চা খাবেন?
'হঁ্যা খাব৷
এজিএম হান্নান এক গ্লাস পানি দিয়ে ঘুত্‍ঘুত্‍ শব্দে কুলকুচা করে মুখের পানটা ফেলে দিয়ে চা হাতে নিলেন৷ বেশ এরিয়া নিয়ে শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে রাশুকে বললেন,
'রাশু আমাদের ফার্মের মেম্বার হয়ে যাও৷ যখন ষ্ট্যান্ড করবো তখন আফসোস করবে৷
'ইম্পছিবল !! ভাই আমাদের এত টাকা নেই৷

ডট চৌধূরী মামুর দোকান থেকে আট-দশ হাত দুরের একটা আমগাছের উঁচু হয়ে থাকা শিকড়ের উপর বসে আছে৷ কি যেন ভাবছে মুখের মাড়িতে মাড়ি চেপে৷ চোয়ালের মাস্লগুলোর ফোলে ফোলে উঠা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ কাক নিয়ে তার রাগ এখনও থামেনি৷ ও কাক দিয়ে ডাং বারি খেলতে চেয়েছিল৷ ডাং এর এক বারিতে কাকের ঘিলু মস্তক থেকে বের করে দিতে পারত !!
রাশু লম্বা ডাক দিল, 'চৌ--ধূ---রী, তুই ওদের ফার্মের মেম্বার হয়ে যা৷
'আমার আব্বা বাঁশ নিয়ে আসবেন৷ মহেশখালির বাঁশ!
'কেন উনি তো তা আনার কথা না! চাচাকে তো নরম মেজাজের লোক মনে করেছিলাম৷ মহেশখালির বাঁশ কেন?
'মহেশখালির বাঁশ মোটা এজন্য! ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়েছি জমি কিনতে? সাভার কেন? বাড়ীতেই কাজ শুরু করে দাও৷ হাস মুরগী কবুতর ছাগল গরু ভেড়া যা চাও সব দেয়া হবে৷
চা শেষ করে এজিএম হান্নান জিজ্ঞাস করলেন, 'রাশু কয়টা বাজে?
ডট চৌধূরী দুর থেকেই টপাশ করে বলে দিল, 'বারটা দশ৷
তার টপাশ করে সময় বলে দেয়ার ভাব দেখে কনক আবার অবিরাম হাসি জুড়ে দিল৷
হু হা হি হি ৷
ডট চৌধূরী গাছটার শিকড় থেকে উঠে কনকের পাশে এসে বসল, 'এত হাসিস নে তো!
'কেন?
'অট্রহাসি হলো ঝড়ে খুলে যাওয়া জানালার পাল্লার মত৷ ঝড় থেমে যায়৷ জানালার পাল্লা হা করে থাকে৷ অট্রহাসিতে মুখের চাপা অনেক সময় বন্ধ হয় না৷ মরা বোয়াল মাছের মত হা করে থাকে৷ হাসপাতালে নিয়ে প্লাস দিয়ে চাপা ছাড়াতে হয়৷
কনক ওর কথা শুনে আরো হাসতে থাকে৷ হু হা হি হি ৷
'এত দেখি যন্ত্রনা!
ডট চৌধূরীর আর ভাল লাগছেনা৷ ক্ষুধায় পেট চিনচিন করছে৷
কনকের হাসিতে এজিএম হান্নানের মনে কোন ভাবাবেগের উদয় হলো না৷ তিনি বললেন, 'কনক তোমরা ব্যাংক লোনের প্রজেক্ট প্রোফাইল লিখেছ?
'না বস এখনও লিখি নি৷ মন্টু প্রজেক্ট লিখার ভার নিয়েছে ৷
'তাড়াতাড়ি লিখে ফেলো৷ মন্টু কোথায়?
'জানি না৷

ডট চৌধূরীর গ্রুপ-লাঞ্চ করতে মজা লাগে৷ সকাল থেকে খালি মুখে বসে আছে ওদের সাথে লাঞ্চ করবে৷
'তোদের লাঞ্চ করতে দেরী হবে? ডট চৌধূরী সবাইকে উদ্দেশ্যে বলল৷
কনক আর এজিএম হান্নান বললেন, 'আমাদের দেরী হবে৷
রাশু বলল, 'আমি তোর সাথে লাঞ্চ করতে যাব৷
রাশু আর ডট চৌধূরী বেরিয়ে পড়ল৷

বিজ্ঞানী যেখানে শেষ করে ফিলোসোফার নাকি সেখান থেকে শুরু করে? যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারে না ফিলোসোফি সেটা পারে৷ হৃদির সাথে কনক, রাশু, ডট চৌধুরীসহ মাষ্টার্স অব ফিলোসফিতে (এম.ফিল.-এ) মোট বিশ জন ছাত্রছাত্রী পড়ছে৷ পুষ্টিবিজ্ঞান কোথায় শেষ করে আর ফিলোসোফি এই বিজ্ঞানটির কোথা থেকে শুরু করে সেটা ওদের মাথাব্যাথা কি না তা বুঝা মুশকিল৷ তবে এম.ফিল.-এর এই ছাত্রদের প্রতি মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে দেখলে কিছু চিত্র ফুটে উঠে৷
চিত্রটি এমন ... ...

"সুনির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ এম. ফিল-এ পড়ছে বলে মনে হয় না৷ চারজনের বয়স ছাবি্বশ প্লাস৷ ছাবি্বশ প্লাসরা হলো- হৃদি, কনক, রাশু, ডট চৌধুরী৷ বাকীরা বয়স্ক৷ ক্লাসমেটদের মধ্যে সাতজন বিবাহিত একজন বাদে সবাই চাকুরীবিহীন৷ দু'জনের মাথার সামনের দিকে একদম চুল নেই৷ চুলবিহীন দু'জনের একজনকে হতাশা একদম গুঁজো করে দিয়েছে৷ তাঁকে এম.ফিলের ছাত্র মনে হয় না৷ মনে হয় এমএ পাশ করা ছাত্রের বাবা৷ এদের নিয়ে কিছু কথা উল্লেখ করার মত৷ কালবৈশাখীর বাতাস গঅছগাছালিতে না লেগে এদের কয়েকজনের চোখমুখে এসে লেগেছে৷ চোখেমুখে উদ্দেশ্যহীনতার আতংক৷ এই বুঝি দুঃস্বপ্নের আর একটা বোমা এদিকে ধেয়ে আসছে ! পালাও !! পালাও !!! দিক বিদিক৷ দিঙমূঢ় !!

এই চিত্রটা হৃদির মনে ভেসে উঠে৷

ক্লাসে হৃদির আজ একদম ভাল লাগছে না৷ এম.ফিলের ক্লাস করতে ভালো ওর কোন দিনই লাগেনি৷ তবে আজকের মত নয়৷ সে মনে মনে বলল, 'ওরা কেন ভর্তি হলো? এ বয়সে হৈহৈল্লোর করার জন্য? পাশ করার পর দেশের বাইরে চলে যাবে? 'দেশের বাইর' কি ওদের জন্য ফুলের ঢালা সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে? দেশে কোন উদ্দেশ্য? এগুলো আমার চিন্তা না! সুখ যেখানে পারিবারিক বৃন্তে নেই, সেখানে রাষ্ট্রীয় সুখ! ধূর ছাই! এগুলো আমি চিন্তা করছি কেন?'
হাতের উপর থুতনিতে ভর করা মাথা হৃদি ঝাঁকি দিয়ে সরাল৷ মাথা ঝাঁকি দিলেও চিন্তার কুন্ডুলী কি মাথা থেকে সরে? নতুন করে কুন্ডুলী পাঁক খায়৷
'ঘরহীন ঘরে থাকি৷ নিদ্রাহীন নিদ্রায় যাই প্রতিরাত৷ চোখ কান থেকে যেন তাপের দাপদাহ বেরোয়৷ চারদিকে উত্তাপ৷ ভিতরটা গলে যাচ্ছে৷ ঘরটার কোথাও শান্তি নেই৷ ঘরের লাইট-এসি অফ করে দিয়ে জানালা খুলে দেয়া হয়েছে৷ খোলা জানালায় হো হো করে বাতাস ঢুকছে৷ ইতমাম কোথাও ভোগে মেতে আছে৷ আমি শূণ্যে জানালায় তাকিয়ে আছি৷ ও আসুক৷ আসে না৷ আমি জানালা বন্ধ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে ঘুমিয়ে গেছি৷ ঘুম থেকে জেগে দেখি সে এক পংকিল ইতমাম৷ চেনা মুখ অচেনা লাগে৷

হৃদি আবার মাথায় ঝাঁকি দিল৷

আজ ভ্যানিযিয়া এসেছিল৷ এম.ফিলে হৃদির একমাত্র ছাত্রী ক্লাসমেট ক্যাথিরিন ভ্যানিযিয়া৷ ভ্যানিযিয়া এখন দ্বিতীয় স্বামীর ঘর করছে৷ দক্ষিণ আমেরিকান খ্রীষ্টান নাম৷ নামের ভিতর একটা কালিজিরা কালিজিরা ভাব৷ ধর্মে খ্রীষ্টান৷ ভ্যানিযিয়া বলে ওরা আসলে জেনারেশন টু জেনারেশন নাস্তিক৷ ভ্যানিযিয়ার ছেলেমেয়ে দু'জন৷ প্রথমজন প্রথম স্বামীর ছেলে৷ সে জন্ম থেকেই বাকরুদ্ধ্৷ আহ্ সুখ কাকে বলে? দ্বিতীয়জন দ্বিতীয় স্বামীর মেয়ে৷ তাকে ই দু'ছেলেমেয়ে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়৷ তার পড়াশুনার করার সময় কই? অধিকাংশ ক্লাসেই অনুপস্থিত৷ হঠাত্‍ হঠাত্‍ সে ক্লাসে উদয় হয়ে বলবে, 'হৃদি তোমার নোট খাতা দাও৷ ফটোকপি করব৷ ভ্যানিযিয়া হৃদির লেকচার নোট ফটোকপি করে আবার ভ্যানিশ হয়ে যায়৷

ভ্যানিযিয়া আজ চার-পাঁচ মিনিট থেকে ভ্যানিশ হয়ে গেছে৷ ও থাকলে হৃদি কথা বলতে পারত৷ হৃদি ছেলে ক্লাসমেটদের সাথে যেচে কথা বলে না৷ মন চায় না৷ কি কারণে চায়না হৃদিও সেটা বুঝতে পারে না৷ ভাল লাগে না ব্যাস! ভ্যানিযিয়া জিজ্ঞাস করলেও একই উত্তর, 'ভাল লাগে না ব্যাস!
ভ্যানিযিয়া চলে যাওয়ার পর হৃদি আজ একদম চুপচাপ বসে রইল৷ এ চুপচাপটা একদম স্ট্যাচুর মত৷ মানুষ স্ট্যাচু হয়ে থাকতে পারে না! কথাবার্তা ছাড়া স্ট্যাচুর মত বসে থাকলে সবারই চোখে পড়ে৷ ওর দিকে এখন একজনের চোখ পড়েছে৷ একজনটা হলো কনক৷ যাকে দেখলে গা ছমছম করে৷ শুধু দেখলেই না, ও আশপাশে থাকলে গা ছমছম করে৷

হৃদিকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আজ হঠাত্‍ করেই কনক এসে বলল, 'হৃদি আপনার কি মাজার ব্যাথা?
ওহ্ মাই গড! এমন প্রশ্ন করা যায়? শরীরটরীর খারাপ থাকার কথা জিজ্ঞাস করা যায়৷ বিরক্তিকর প্রশ্ন! কিন্তু কনককে নিয়ে বিরক্তির থলের সবটা হৃদির ভিতরেই রয়ে গেল৷ বাইরে কোন লক্ষণ প্রকাশ পেল না৷ হৃদি কনকের দিকে না তাকিয়ে চুপ করে স্ট্যাচুর মতই বসে রইল৷
'এই কনকটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না! সে নাকি মাস্তান! জোর করে চাঁদা আদায় করে৷ বণ্যা দুর্গতের জন্য কাপড় কালেকশন করে দুর্গত এলাকায় যায়৷ প্রতিদিন রাসতায় মারামারির অভ্যাস৷ চট করে রেগে যায়৷ দরকারে অদরকারে ভটভট করে কথা বলে৷ হাসাহাসি করে৷ ক্লাসের মধ্যেও হাসাহাসির বোমা ফাটায়৷ বিরক্ত লাগে৷
কনক আবার জিজ্ঞাস করল, 'কি ব্যাপার হৃদি আপনার মাজার ব্যাথা?
হৃদি এবার ঠান্ডা গলায় বলল, 'আশ্চর্য্য! আপনি মাজার ব্যাথার কি দেখলেন?
'আশ্চর্য্য তো বটেই! চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান না তো৷ তাই ভেবেছিলাম... ব্যাথা ট্যাথা কি না?
'চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেই মাজার ব্যাথা নেই৷ সাহেব, সেটা আপনি বুঝলেন কিভাবে?
'ও আপনি তা হলে কথাতথা জানেন?
'আমাকে বোবা ভেবেছেন?
'সিড়ি দিয়ে যখন নামেন মনে হয় সিড়ির ইট ব্যাথা পাবে৷ আজ আপনি এত মাথা ঝাঁকাচ্ছেন কেন?
'সিড়িতে আমি কি ব্রেক ড্যানস দিয়ে নামব? আর আমার মাথাতো আমাকেই ঝাঁকাতে হবে! না কি?
কনক হেসে উঠল৷
হু হা হি হি৷
'ও এভাবে হাসছে কেন?
'আপনি তাহলে ড্যান্স দেখেন? ভালো লাগল৷ কথাবার্তা ছাড়া যেভাবে চলুন আপনার হার্ট এটাক হতে পারে৷
'আপনি হৃদরোগ স্পেশালিষ্ট নাকি?
কনক এবার নিঃশব্দে হাসল৷
'হৃদরোগ স্পেশালিষ্ট নই৷ গত কয়েক মাসে আমি হৃদি ষ্পেশালিষ্ট হয়ে গেছি৷
হৃদি সিরিয়াস মুখে কিছু কথা বলতে চেয়েছিল৷ তা বলা হলো না৷ উল্টো ঘটনা ঘটলো৷ হৃদির ঠোট থেকে হাসি ফস্কে গেল৷
'কেন কেন? আমাকে নিয়ে অন্যের ভাবনা?
'হুঁ--য়ু৷ কাউকে ভাবতে তো পয়সা লাগে না৷
'লাভ?
'লাভ খোঁজে বেড়ানোর অভ্যাসটা আমার আগ থেকেই নেই৷
হৃদি মনে বলল, 'এ দেখি মহাপুরুষ!
'আরে! মনে মনে গাল দিচ্ছেন কেন?
'কিভাবে বুঝলেন?
'আমি মনের কথা শুনতে পারি৷ আপনি আমাকে মহামানব বা মহাদানব এ জাতীয় একটা কিছু বলেছেন না?
হৃদি মন মনে বলল, 'আরে! আমিতো তাই বলেছি৷

'আশ্চর্য্য !
কনকের সাথে কথা বলে ওর ভালো লাগছে৷ মাথাটা হালকা হয়ে যাচ্ছে৷ এতক্ষন এটা ভারী ছিল৷
হৃদি এবার সশব্দে জিজ্ঞাস করল, 'বলুন আমার সমস্যা কি?
'বলব?
'বলুন৷
'আপনার মনটা পাহাড়ের সমান একটা চাপা ব্যাথা ব'য়ে চলছে৷
'কোন্ পাহাড়ের সমান?
'জাপানের ফুজি পর্বতের সমান ৷
'ফুজি? হিমালয়ের সমান বললেন না কেন?
'হিমালয়ের সমান হলে আপনি মারা যেতেন৷ আপনাকে আমাদের ক্লাসে পেতাম না৷

কনকের কথায় হৃদি ও কনক দু'জনই হাসল৷

হৃদি আরো একটু ভাল ফিল করল৷ একাকীত্ব মনকে পাথরের মত ভারী করে ফেলে৷ মন একাকীত্বের কারণ খুঁজে বেড়ায়৷ একাকীত্বের হতাশা থেকে বিচূ্যত করতে পারলে মানুষের মন ক্ষণিকের জন্য হলেও মুক্তি পায়৷ অনিচ্ছাসত্বেও আচমকা আনন্দে চোখমুখ জ্বলে উঠে৷
ভ্যানিযিয়া চলে যাওয়ার পর হৃদি যে এলোমেলো চিন্তাগুলো করছিল তা থেকে দুরে চলে এসেছে৷
'হৃদি আমরা তো আপনার ক্লাসমেট তাই না?
'হ্ঁ্যা৷
'ক্লাসমেট হিসাবে আপনার উপর আমাদের অধিকার কিছু কিছু আছে! কি নেই?
হৃদি চুপ করে রইল৷
অধিকার প্রয়োগের করার মতো গলায় জোর এনে কনক এবার বলল, 'উঠুন! উপরে লাইব্রেরীতে যাব৷
হৃদি মনে মনে বলল, 'ওবাবা এ দেখি মারাত্মক মানুষ!
'হৃদি উঠুন!
সে এবার শব্দ করে বলল, 'হৃদি উঠুন মানে! কেন উঠবো? তার মুখে অকৃত্রিম হাসি৷
'হৃদি উঠুন বলছি!

হৃদি কনকের সাথে উপরে উঠল৷ এম ফিলে ভর্তি হওয়ার পর হৃদি আজ প্রথম ছেলে ক্লাসমেটের সাথে লাইব্রেরীতে এসেছে৷ লাইব্রেরীতে রাশু এবং ডট চৌধুরী বসে আছে৷ ওরা হৃদিকে দেখে ছালাম দিল৷ এম.ফিল.এ পড়লে ছালাম দেয়া যায়৷ ফার্ষ্ট ইয়ারে হলে বলা হতোঃ 'এই হৃদ্দ্যা তুই এখানে ক্যান? যা! তোর বই উঠাতে হবে না! এত পড়ে কি হবে ? পড়ালেখা করে যে, গাড়ীর তলে পরে সে ---

কনক লাইব্রেরীতে একটা রিপোর্ট ইসু্য করাল৷ রিপোর্টটির টাইটেল: ঈড়হংঢ়রত্‍ধপু ড়হ সঁংঃধত্‍ফ ড়রষ: ডরষষ সঁংঃধত্‍ফ ড়রষ বীঃরহপঃ ভত্‍ড়স ঃযব ফরবঃধত্‍ু পঁষঃঁত্‍ব ড়ভ ইধহমষধফবংয? টাইটেল শেষে অনেকগুলো প্রশ্নবোধক চিহ্ন৷ প্রশ্নবোধক চিহ্নগুলো বড় থেকে ছোট হয়ে আসছে৷ এক সময় এ প্রশ্নটাও কি উঠে যাবে?
বাংলাদেশের জন্য ইন্টারেষ্টিং টাইটেল৷ দেশীয় গবেষকের গবেষণা রিপোর্ট৷ কনক জিজাস করল,
'হৃদি এটা পড়েছেন? টাইটেল দেখে ভালো লাগছে৷ পড়ে দেখা যায়৷
হৃদি বলল, 'আপনি পড়ুন৷
কনক রিপোর্টটা পড়তে থাকল৷ ইংরেজী রিপোর্টটা পড়ে কনক যা বলল তার সারমর্ম হলো:
সর্ষের তেল এই বাংলার জনপদে অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ভোজন সংস্কৃতিতে এক অনন্য এবং অতি সুস্বাদু খাদ্য তালিকায় থাকা একটি অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ৷ এর সাথে অনেক সংস্কৃতি জড়িত৷ ট্রেন ছুটে চলেছে বিস্তৃর্ণ হলদে সর্ষে মাঠের বুক চিরে৷ জানালায় মাথা বাড়িয়ে বুক জুড়িয়ে নিয়ে এদেশের মানুষরা বলেছেঃ এতবড় ফুল বাগান বাংলার জনপদে আর আছে? মাইলের পর মাইল হরিদ্রাবনে মৃদু বাতাসের ঢেউ? বাংলার এরূপ আর কোথাও আছে? লক্ষলক্ষ মৌমাছির মধুগুঞ্জন৷ রাস্তার পাশে অসংখ্য গাছগাছালিতে মৌমাছিরা বাসা বেধেঁছে৷ ঘরে ঘরে মধু! খেয়ে যাও বধূ!
বিদেশে রিপোর্ট বেরিয়েছে সর্ষের তেলে বিষাক্ত কেমিক্যাল্স আছে? সয়াবীন তেল খাওয়া ভালো৷ রিপোর্টে উল্লেখ করা হলো না বিষাক্ত ঐ কেমিক্যাল্স ধ্বংসকারী (মেটাবলাইজিং) পাচকরসটি (এনজাইমটি) আমাদের শরীরে আছে কি নেই? এনজাইমটি শরীরে থাকলে এ তেল খাওয়া আমাদের জন্য ক্ষতিকর হওয়ার কথা নয়৷ নইলে কি হাজার বছরের খাদ্য সংস্কৃতিতে মিশে থাকা এই সর্ষের তেল খেয়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা বিষক্রিয়ায় মারা যেতেন না? সর্ষের তেল মেখে আমাদেরকে কি রোদে শুইয়ে রাখা হতো না? রোদে শুইয়ে রাখার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো সর্ষের তেল আমাদের স্কীনের সূক্ষ রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয়৷ আমরা সুস্বাস্থবান শরীর নিয়ে বেড়ে উঠি৷ কই তখনতো কিছু হয় নি? বিদেশ থেকে সয়াবীন তেল আমদানী করা হোক৷ ব্যবসায়ীদেরকে কোটি কোটি টাকা ব্যাংক লোন দেয়া হলো৷ কয় কোটি টাকা সর্ষের আবাদের জন্য লোন দেয়া হয়েছে? সর্ষের তেলের জন্য ক'ঘন্টা কেম্পেইন করা হয়েছে? গ্রাম বাজারের ঘরে ঘরে সয়াবীন তেলে সয়লাব হয়ে গেছে৷ সর্ষের তেল বিলুপ্ত হতে চলেছে৷ সর্ষে বাটা ইলিশ! সর্ষে বাটা চিংড়ি! সর্ষের তেলের মুখে লেগে থাকা সে-ই ভর্ত্তা! ঢাকা শহরে কিছুটা পাওয়া গেলেও কৃষি প্রধান দেশের গ্রাম বাংলার ঘরে কি পাওয়া যায়? ভোজ্যতেলের বাজারে আরো কিছু অশনি সংকেত দিচ্ছে পাম ওয়েল এবং গভীর সমূদ্রের প্রাণিবা মাছের তেল৷ সব কিছুর হিসেব কষার সময় এসেছে! হে কান্ট্রিমেন!
গভীর সমূদ্রের মাছ বা প্রাণির তেল নাকি স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে পড়ালেখায় মনযোগী করে তোলে? বাংলাদেশের ছেলেপুলেরা পড়ালেখায় মনযোগ হারিয়ে ইদানীং ভাংচুরে মনযোগী হয়ে উঠেছে৷ তাদেরকে গভীর সমূদ্রের মাছ বা প্রাণির তেল খাওয়ানোর চেষ্টা করা হবে না কি?

বাহ্! ফিলোসোফারের এ ছাত্রটিতো দারুন ইসু নিয়ে কথা বলছে! কারণ বিজ্ঞান যেখানে শেষ করে ফিলোসোফি সেখান থেকে শুরু করে৷ পুষ্টিবিজ্ঞানটির ফিলোসোফি কোথা থেকে শুরু হয় তার একটা উত্তর মোটামোটি পাওয়া গেল৷ এ বিশ্ববিদ্যালয়টির বারান্দায় হাটলেই অনেক কিছু জানা যায়৷ আর ক্লাসে ঢুকলে তো কথা-ই নেই! বিজ্ঞান আর ফিলোসোফি সব এক!
হৃদির কাছে একটা ব্যাপার খুব বিষ্ময় লাগল৷ কনক একটা মাস্তান! ও রিপোর্টটা এত দ্রুত হৃদয়ঙ্গম করে এত সুন্দর করে ওদের বুঝাল? ভেরী গুড! একটা ব্যাপার পরিস্কার হয়ে গেল যে কনক বখাটে নয়৷ বখাটেরা সব পারে৷ যা পারে না তা হলো একটা সুন্দর পড়াকে নিজে বুঝে অপরকে ভালোভাবে বুঝাতে৷
কনক হঠাত্‍ বলল, 'হৃদি নীচে যাবেন?
হৃদি আচমকা থমকে গেল! মনে হল মাথা ঘুরবে৷ সে চোখ বন্ধ করে নিমিষেই তাকাল৷ এধরনের একটা অনুরোধ শুনা গিয়েছিল আমেরিকার হোটেল ম্যারিয়টে -- 'হৃদি নীচে যাবেন?
তখন কফির কথা বলা হয়েছিল৷ এখন চা'র কথা বলা হয়েছে৷
সে চোখ বন্ধ করে নিমিষেই খুলে আস্তে করে বলল, 'কোথায়? কে--ন?
'চা খেতে৷
হৃদি ঘড়ির দিকে তাকাল দ৷ প্রায় দু'টা৷
'বাসায় ফেরার সময় হয়ে গেছে৷ এখন চা খাব?
'চলুন না ?
ওরা সবাই নীচে নামছে৷ কথা বলতে বলতে হৃদি, কনক, রাশু এবং ডট চৌধুরী মেইন গেটের কাছে চলে এসেছে৷
কনক বলল, 'আজ হোটেল ইটালিয়াতে লাঞ্চ করুন?
সে আবার ঘড়ির দিকে তাকাল৷
হৃদি কৃতজ্ঞতার সাথে বলল, 'নো থ্যাংকস৷ বাসায় লাঞ্চ করব৷

ড্রাইভার কায়েস অমাকে নিয়ে এসেছে৷ সে আস্তে করে হর্ন বাঁজালো৷ হৃদি অমাকে ইশারায় গাড়ি থেকে নামতে বলল৷ অমা চোখেমুখে দুনিয়ার বিষ্ময় নিয়ে হৃদির দিকে তাকাল৷ হৃদি কখনো এটা করেনি৷
পদ্ধতিটা সাধারনত এমনঃ হৃদি গেটে আসবে৷ কায়েস গাড়ি থেকে নেমে বাইরে দাঁড়াবে৷ সালাম দিয়ে সে তার মাথাটা দশ ডিগ্রির মত বো করবে৷ কায়েস নয়, ভিতর থেকে গাড়ির দরজা খুলবে অমা৷ হৃদি ভিতরে ঢুকবে৷ কায়েস গাড়ি ছাড়বে৷
আজ অমার কাছে ব্যাপারটা ব্যতিক্রম লাগল৷ ব্যাপারটা ব্যতিক্রম আরো একটা কারণে৷ অমা কখনো হৃদিকে তাদের সাথে দেখেনি এখন যাদেরকে দেখছে৷ 'তাদের' হলো---- কনক, রাশু এবং ডট চৌধুরী৷ সুন্দরী তরুণী ভাবীকে ঘিরে একদল যুবক৷

অমা গাড়ীর জানালা নামাল৷ জানালা দিয়ে মাথা এগিয়ে বলল, 'কি ব্যা-পা-র ভাবী?
'কোন ব্যাপার না৷ বাইরে এসো৷ ওনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই৷
অমা বাইরে এলো৷
কনককে দেখিয়ে বললেন, 'ইনি হলেন রাতুল আহাম্মেদ কনক৷ ও হলো ডবি্লউ ডট চৌধুরী৷ রাশু আপনার পুরো নাম আমি জানি না৷
'আমাকে রাশু বললেই চলবে৷
অমা বলল, 'স্লামালাইকুম৷
হৃদি অমাকে দেখিয়ে বলল, 'ও হলো আমার একমাত্র ননদ একমাত্র বান্ধবী৷ এ রিয়াল ফ্রেন্ড৷
'কচু! আমার কথা তুমি কখনও ভাব?
'হ্যাঁ সকাল বিকাল দুপুর সবসময় ভাবি৷
পরিচয়ের পর হৃদি গাড়ীতে গিয়ে বসল৷
'আমরা আসি, বলে ওরা বিদায় নিল৷

কনক বেলা বারটার দিকে বড় ভাই রনক সাহেবের মোটর বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেছে৷ বাইকের পিছনে রাশু বসে আছে৷ এদু'জন বাসার বাইরে সারাক্ষন একসাথে থাকে৷ ঠিক যেন মানিকজোড়৷ একজনকে পাওয়া না গেলে, অন্যজনকে পাওয়া যায় না৷ কনক কোথায়? রাশুর ওখানে৷ রাশু কোথায়? কনকের ওখানে৷ একসাথে ঘুরে৷ একসাথে ফিরে৷ একসাথে পেপার কাটিং জোগার করে৷ একসাথে বড় ভাইদের কাছে বুদ্ধি পরামর্শ নেয়৷ কি করা যায়? সারাদিন একসাথে এলোমেলো আশা-হতাশার গল্প করে৷ কি হবে? বাস্তবে কিছু হয় না৷ অনেক রাতে যে যার বাসায় ফিরে৷

বাইক চলছে ভটভট করে৷

'কনক আমার কি মনে হয় জানিস?
'কি মনে হয়? কনকের গম্ভীর গলা৷
'আমি আবার যদি আম্মার দুগ্ধপোষ্য শিশু হতে পারতাম?
'যারা কিছু হতে পারে না তারা উল্টপাল্টা অনেক কিছু হতে চায়৷
'কনক এটা তুই ঠিক বলিস নি!
'চুপ কর! তাড়াতাড়ি মরে ভাল একটা দেশে আল্লার কাছে পুনরজন্ম চা যেখানে পাবি উন্নত জীবন এবং মরার নিশ্চয়তা৷
'রাশু আমরা কোথায় যাচ্ছি?
'কনক আম্মাকে বলে এসেছি, আজ দুপুরে আমাদের ওখানে খাবি৷ আমাদের বাসায় যাব৷
'যেতেই হবে?
'হঁ্যা৷ ডট চৌধুরীও যাবে৷ ওকে হল থেকে উঠিয়ে নিতে হবে৷

কনক, রাশু এবং ডট চৌধুরী, একই সাবজেক্ট ব্যাকগ্রাউন্ডের বন্ধু৷ ফাষ্ট ইয়ারে হলের আবাসিক ছাত্র ডট চৌধুরীর সাথে এ দ'ুজনের সখ্যতা ছিল না৷ সময় তখন সমর্থন করেনি৷ পোক্ত বয়সের বন্ধুত্ব পরিপোক্ত হয়৷ কথাবাতর্া, সম্পর্ক, লেনদেন সবকিছু রেশনাল গ্রাউন্ডে চলে৷ এ জন্যই কনক, রাশু এবং ডট চৌধুরীর মধ্যে গলায় গলায় ভাব৷

কনক ডট চৌধুরী খিলগাঁ রাশুর বাসায় এসেছে৷ গেটে ওদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখে রাশু ডেকে বলল, 'পিচ্চি দরজা খোল্৷
রেশমা এসে দরজা খুলে দিল৷
'আব্বা আম্মা খেয়েছেন রে?
'হঁ্যা৷ এত যন্ত্রনা দিস না তো৷ তোর জন্য দু'টা পর্যন্ত না খেয়ে বসে থাকবেন?
রাশু বলল, 'কনক, চৌধুরী ভিতরে আয়৷
কনক আর ডট চৌধুরী ভিতরে রাশুর পড়ার টেবিলে বসল৷
রেশমা বলল, 'ভাইয়া খেতে চাইলে ডাইনিং টেবিলে বোস৷ এখানে খাবার টেনে নিয়ে আসবে কে?
'আমার পড়ার টেবিল খাব৷ পিচ্চি সালাদ আছে?
'সালাদ কেটে রাখলে পানি উঠে৷ তাই কাটা হয়নি৷
'ফাইন, সালাদ করে দিয়ে যা৷ এক জগ পানি দিয়ে যা৷ বাকীটা আমি করব৷

রাশু ভিতরে গেল৷
'রেশমা এক জগ পানি নিয়ে ওদের টেবিলে ঠক্ করে রেখে গেল৷
মেয়েটার মনে আঘাত দিয়ে কথা বলা হয়েছে৷ জগ টেবিলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী শব্দ করল৷ থালা-বাসনের সাথে জড়িতদের রাগ প্রকাশের প্রাথমিক লক্ষন -এই অতিরিক্ত শব্দ৷
ডট চৌধুরী আজ প্রথম রাশুদের বাসায় এসেছে ৷ সে বলল, 'কনক, জগ দিয়ে গেল ও রাশুর ছোট বোন না?
'তোর কি মনে হয়?
কনক হাসছে৷ তবে বাঁশ ফাটা অট্টহাসি না৷ ভাগ্য ভাল!
'আমার যা-ই মনে হোক? রাশুর বোন হলে ওর মন ভালো করে দিব৷ ও রাগ করে আছে৷
'হঁ্যা, ও রাশুর ছোট বোন৷
রেশমা সালাদ নিয়ে এসে কনককে উদ্দেশ্যে করে রেগে বলল, 'কনক ভাইয়া, আমাকে পিচ্চি বলে ডাকা হয় কেন? আমি এখনও কি পিচ্চি? সবার সামনে এধরনের অপমান সহ্য করা হবে না৷
'বোন ও তোমাকে আদর করে ডাকে৷ নাহ্! তুমি তো পিচ্চি না ! ক'দিন পর পিচ্চির ফুপি হবে!
'ভাইয়া এটা কি বললেন? বলে সে হা করে রইল৷

ডট চৌধুরী রেশমাকে ডাক দিল৷ ছোট বোন আমার কাছে এসো৷ আমি তোমার মন ভালো করে দিব৷ বসো৷
রেশমা তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ সে ইতস্তত করে বলল, 'আপনার সাথে আমার পরিচয় নেই৷ আপনি কে?
'আমি একজন মানুষ৷ রাশুর ক্লাসমেট৷ নাম হলো ডট চৌধুরী৷
'ডট চৌধুরী? বলে, রেশমা পিছনের দিকে ঘাঁড় ঝাঁকি দিল৷
'রেশমা, রাশু তোমাকে আদর করে পিচ্চি নামে ডাকে৷
রেশমার ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে৷
'আ ... দ ... র করে ডাকে? পা থেকে মাথা পর্যন্ত আগুন জ্বলে!
'আগুন জ্বলে? আচ্ছা আগুন নিয়েই কথা বলা যাক৷ আগুন এমনই শক্তি শুধু জ্বলতে চায়৷ আগুন অর্থ্যাত্‍ ফায়ার কত প্রকার জানো? ফায়ার ক্লাস এ, বি, সি, ডি এবং ই৷ তোমার ফুট টু লেগ (ভড়ড়ঃ ঃড় ষবম) অর্থ্যাত্‍ পা থেকে মাথা পর্যন্ত যে আগুন জ্বলছে-সেটা কিন্তু এগুলোর একটাও নয়৷ কি দাঁড়াল? আগুন আরো এক ধরনের আছে৷ কি রেশমা ধরতে পারছো তো? তার নাম দিলাম ফায়ার ক্লাস-এইচ৷ অর্থ্যাত্‍ হার্টবার্ন৷ এ আগুনটা অন্তর পুরে দেয়৷
রেশমার মেরুদন্ড সোজা হয়ে গেছে৷ সে লম্বা স্বরে বলল,
'টড ভাইয়া?
'টড ভাইয়া না৷ ডট ভাইয়া ৷
'আচ্ছা, ডট ভাইয়া হার্টবার্ন কিন্তু এন্টাসিড খেলে ভালো হয়ে যায়!
ডট চৌধুরীর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো৷ এখনকার ক্লাস নাইনের পড়ুয়ারা অনেক এগিয়ে৷ না হলে কি রেশমা বলে এন্টাসিড খেলে হার্টবার্ন ভালো হয়ে যায়?
'ইয়েস রেশমা! তুমি আসল জায়গায় হাত দিয়েছো৷ হার্টবার্ন দুই প্রকার৷ এক হার্টবার্ন এন্টাসিড খেলে ভালো হয়৷ আর এক হার্টবার্ন দুনিয়ার সব ওষুধ বেটে খাওয়ালেও ভালো হবে না৷ যেটা তোমার হয়েছে৷ আচ্ছা আমরা যেন কোথায় ছিলাম?
'কোথায় ছিলাম মানে?
'মনে পড়েছে৷ রাশু তোমাকে পিচ্চি নামে ডাকে কে-ন? তোমার নাম তো ভারী সুন্দর! এক অসাধারন নাম! পিচ্চি! বড়ই মমতা ভরা ডাক৷ ডাক দিলেই বুক জড়িয়ে যায়! যেন স্বর্গ থেকে অমৃত ঝড়ছে! আমার ছোট বোনকে আমি কি বলে ডাকি শুনবে?
'কি বলে ডাকেন?
'কেটলী৷ এই কেটলী! কেটলী? চা দিয়ে যা তো! তোর হাতে চা না তো! যেন মধু খাচ্ছি! মমতা ভরা ডাক না?
রেশমা বলল ভ্রু কুঁচকে বলল, 'কে .. ট .. লী ? চাকুরী বাকুরী না পেয়ে আপনাদের সবার মাথা-ই গেছে! আপনারা একদম বাজে !
'না হলে কি দল বেঁধে খেতে আসি?
'ভাইয়া, কেটলী আপনার জন্য চা নিয়ে আসে?
ডট চৌধুরী মাথা ঝাঁকাল৷
'না৷ ও কেটলী ভরে গরম পানি নিয়ে আসে!
'কেন?
'খুঁতির মাথায় ঢেলে দিয়ে গোছল করাতে৷
'ঠিক কাজটি-ই করে৷ খুঁতি কে?
'খুঁতি হলো ডট চৌধুরী৷ আমি খাবারে খুঁত ধরি বেশী তো৷ এ জন্য৷
'খাওয়ায় খুঁত ধরা লোক আমার খুব অপছন্দ৷
'যেমন ধর, কলি ফ্লাওয়ার অর্থ্যাত্‍ ফুলকপি৷ স্বাদহীন রান্নার ফুলকপি এত বেশী খাওয়া হয়েছে যে ফুলকপির কথা শুনলেই গা ছমছম করে৷ মনে হয় আড়তের সমস্ত ফুলকপি কিনে ডেস্ট্রয় করে ফেলি৷ এ রাবিশ ভেজিটেবু্যল!
'ভাইয়া আমি কিন্তু আজ ফুলকপির লাবরা রান্না করেছি৷
'রেশমা, হোয়াট ইজ ল্যাবরা? ল্যাবরা কি? এটা কলি ফ্লাওয়ারের বিশেষ কিছু?
'বিশেষ কিছু মানে? বুঝলেন না! ফুল কপি, পাতা কপি, মুলা, গাজর, শালগম, ভূট্টা সব মিলিয়ে ভেজিটবু্যল এর একটা মিক্সার রান্না৷
'ফাইন! এক বসায় সব ভেজিটবু্যল খাওয়া হবে৷ এ ব্যালান্স্ড ভেজিটবু্যল ডায়েট৷
'সব ঠিকঠাক ছিল৷ ভাইয়া, নামিয়ে দেখি নূন দেয়া হয় নি৷
'আপনি আমার খুঁত ধরবেন?
'না না কি বলছো? তোমার খুঁত ধরবো কেন? মানুষ হলো ফরগেটফুল ক্রিয়েচার৷ ভুলো প্রাণী৷ পাতে কাঁচা লবন নিয়ে খাওয়া যাবে৷

ডট চৌধূরীর মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল৷ মনে হলো তার মুখে ইতিমধ্যে ফুলকপির লাবরা ঢুকে আছে৷ পানসে আ-নূনা একটা অবয়ব তার চোখেমুখে৷
'ছোটবোন, নিজ হাতে আর কি কি রান্না করেছো?
'আপনি খাওয়ার সব আইটেম জেনে নিচ্ছেন?
'তা ঠিক না৷ তোমার রান্না অপূর্ব হবে৷ খুব ভালো হবে৷
'ভাইয়া, আমি নলা মাছ রান্না করেছি৷
'আবার নলা? হলের বাবুর্চি এসে রাশুর বাসায় বাজার করে দিয়ে গেছে নাকি? মালমশলা ছাড়া রান্না করা এই নলা খেতে খেতে এই মাছটির প্রতিও একটা ঘৃণাবোধ সৃষ্টি হয়েছে৷ ও যধঃব নলা৷ নলা! শুনলেই জ্বলে গলা!
'কি ভাবছেন? ভাইয়া, এবার বলুন গরুর মাংশ কেমন?
'খুব ভালো খুব ভালো৷ হাই প্রোটিন৷ গরু গরু গন্ধতো এজন্য একটু অপছন্দ! অসুবিধা নেই রান্ন্া হয়ে গিয়ে থাকলে চালিয়ে নেয়া যাবে৷ রেশমা, বিফ রান্না করার আমার একটা নিজস্ব পদ্ধতি আছে৷ আমি এটাকে উম (ডটগ) মেথড বলি৷ ওয়াটার আনটাচ্ড মেথড৷ নো ওয়াটার ইন মীট৷ রান্না করে দেখো- চেটেপুটে খেতে মন চাবে৷
'ভাইয়া মসুরের ডাল?
'খুব ভালো চলবে৷ প্ল্যান্ট প্রোটিন৷ গরীবের মাছ! প্রোটিন হলো আমাদের দেহ গঠনে খুবই দরকারী জিনিস৷ ঘন করে ডাল করে দেখবে খুব স্বাদ! তুমি অনেক টানতে পারবে৷
'ভাইয়া ডাল আমি খুব পাতলা করে ফেলেছি৷ তিন লিটার পানিতে এক ছটাক ডাল৷
চলবে?
'নো প্রবলেম৷ গরীবের সু্যপ৷ বাটির পর বাটি টানা যাবে৷ আমাদের শরীরে পানি খুবই দরকার৷ ডিহাইড্রেশন হলে আমরা বাঁচবো কি করে?
রেশমা ডট চৌধুরীর চোখের দিকে তাকালো৷ যেন স্নেহময়ী কোন মা প্রবাসে তার সন্তানের খাদ্য-কষ্টের কথা অস্থির হয়ে শুনছেন৷ সে মমতা ভরা গলায় বলল, 'ভাইয়া, আবাসিক হলে আপনার খাওয়ার খুব কষ্ট হয়!
ডট চৌধুরী হঁ্যা-বোধক মাথা নাড়াল৷
'ভাইয়া আপনার সাথে এতক্ষন মিথ্যে কথা বলেছি৷ আমি কিছুই রান্না করে নি৷ আজ আপনাদের জন্য আম্মা কাচ্চি বিরানী রান্না করেছেন, সেগুলো খাবেন৷ রেশমার অনুতপ্ত গলা৷
'নো প্রবলেম৷ এগুলো হোয়াইট লাই৷ এগুলোতে কোন পাপ নেই৷
কিশোরী রেশমা বিষ্মিত চোখে ডট চৌধুরীকে দেখলো৷ তার কচিমন খুশীতে ভরে উঠলো৷ সে অনেক কিছু বলতে চাইল৷ যা বলতে পারল তা হলো--
'আপনি খুব ভালো মানুষ৷
'আমরা সবাই খুব ভালোমানুষ৷ নাম নিয়ে গল্প শুনবে?
'বলুন৷
'কোন এক দেশে ছিল গগগ৷ গগগ দৈত্যটৈত্য কিছু না৷ 'গগগ' অর্থ্যাত্‍ ট্রিপু্যল গ হলো গোবিন্দ'র 'গ', 'গণেশ'র 'গ' এবং গফুরের 'গ'৷ এই গগগ-রা কখনও বিশ্বাস করে না পরামাণুর ইলেকট্রন প্রোটনের চার পাশ দিয়ে ঘুুরে৷ এজন্য তাদের নাম দেয়া হলো ঘাগগগ অর্থ্যাত্‍ ঘাউরা গগগ৷ ওদেরকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়া হলো৷ রেশমা শুনছো তো?
রেশমা খিলখিল করে হাসছে! কিশোরীর হাসি! মুখ থেকে চটচট শব্দে হাসির খই ফুটছে৷
রাশু ভিতর থেকে এলো৷ তার হাতে খাবারের প্লেট৷
'এই পিচ্চি হাসছিস্ কেন? ভিতরে যা আর গল্প শুনতে হবে না৷ তুই ডট চৌধুরীকে কি বলছিস্?
'জাগাইমু' বলছি৷
টিপ্পনি কেটে 'জাগাইমু' শব্দটা বলে রেশমা দেঁৗড়ে ভিতরে চলে গেল৷ তার আর ঘাগগগ এর গল্প শোনা হলো না৷
ডট চৌধুরী বলল 'জাগাইমু' কি রে রাশু?
রাশু হাসছে৷
'রাশু হাসছিস্ কেন? বল্ না জাগাইমু কি? আমার কিছু?
'হঁ্যা, তোরই কিছু মনে হচ্ছে!
'আমার কিছু মানে?
'গাধা, এটা জাপানী শব্দ৷ 'জাগাইমু' মানে আলু৷
'কে শিখিয়েছিল ওকে?
'আমি-ই শিখিয়েছিলাম৷
ডট চৌধুরী টাশকী খাওয়ার মত হলো৷ হঠাত্‍ করে সে রাশুকে বলে উঠল,
'এই তোর আলুর দোষ আছে নাকি?
রাশু লাফিয়ে উঠলো৷ 'চৌধুরী তুই কি বললি?
'তোর আলুর দোষ আছে নাকি?
'শালা খেয়ে ভাগ্!
'কেন?
'আমার আলুর দোষ আছে নাকি?
'না থাকলে রেশমা বলল কেন?
'আমি আলু ভর্ত্তা বেশী পছন্দ করি৷ এজন্য ও আমাকে জাগাইমু বলে৷ আর তুই বলছিস আলুর দোষ!
ডট চৌধুরী জিহ্বায় কামড় দিল৷
'আস্তাকফেরুল্লাহ্ ! খোদা মাফ করো৷ রাশু মাফ করে দেয়৷
'এবার মাফ করা হলো৷

আলুর দোষটা কি বোঝা গেল না৷ কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে মাফ চাওয়া মাফ দেয়া হলো৷
'আচ্ছা রাশু, তুই কি সৌদি আরব থেকে খাবার নিয়ে এলি? গল্পের জালালী খতম শেষ করা হলো৷ তুই খাবার নিয়ে আসছিস নে? তাড়াতাড়ি খাবার দে৷

কনক রাশুর বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে মনে হয়৷ আসলে ঘুমাচ্্েছ না৷ সে হু হা করে উঠবে বলে মনে হলো৷ তার মুখে কেবল হাসির দশ নম্বর সতর্কের পূর্বাভাষ ফুটে উঠেছে৷
ডট চৌধুরী তার দিকে তাঁকিয়ে বলল, 'কনক তুই হাসবি না বলছি৷ হেসে উঠলে তোর চাপা চাপে না৷ খেতে বসব৷

ওরা একসাথে খেতে বসল৷
কনক খেতে খেতে বলল, 'রাশু আগামী সপ্তাহে ফুলতলীতে জমিটা দেখতে যাব৷ তুই যাবি?
'হ্ঁ্যা যাব যাব৷৷ গ্রামে যেতে আমার খুব ভালো লাগে৷
'চৌধুরী যাবি?
'না৷ আপডাউন বাষট্রি কিলোমিটার দুরে গিয়ে জমি দেখার মধ্যে বিশেষ কৌতুহল মেটানোর কিছু নেই৷ ধানপাতার মন দোলানো বাতাসের ঢেউয়ে আমার মন দোলে না৷ কবি কবি ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে এই সবুজ ঢেউ দেখার চোখ আমার নেই৷ আবার ফুলতলির পতিত জমি?
'যাবি না, ব্যাস্ ৷ এত কথা কেন?

পরিবারে ভাইবোনরা একজন আর একজনকে বিকৃত নামে ডাকে৷ এ বয়সে ভাই বোনদের মধ্যে ঝগড়া করার আইটেম থাকে না৷ বিকৃত নামে একজন আর একজনকে ডেকে ঝগড়া করে৷ বাবা-মা নিষেধ করেন৷ কেউ শুনে না৷ মানুষের স্মৃতি শক্তি তার ভবিষ্যতের আয়না৷ ভাই-বোন বড় হয়ে যে যার সংসার করে৷ বাল্যকালের ঝগড়াগুলো মিষ্টিমধুর স্মৃতি হয়ে-সুখ-কষ্ট দেয়৷ একজন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যখন চলে যায় অতিতের ওগুলোই মানুষের বেদনার অশুু ঝরায়৷

বিকেল চারটে৷ কনক ডট চৌধুরীকে বাইকে উঠিয়ে রাশুদের বাসা থকে চলে আসছে৷ কিছুদুর যেতে না যেতেই কনক বলল, 'চৌধুরী চা খাব৷ নাম্৷
'চা রাশুর বাসায় খেয়ে এলি না?
'খেয়েছি, আবার খাব৷ হোন্ডা থামালাম৷

ওরা চা খেতে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকল৷ পড়ন্ত বিকেল৷ ওদের পাশের টেবিলে এসে একজন লোক খেতে বসল৷ লোকটার কাছে তার জীবনটা একটা বিশাল বোঝা মনে হচ্ছে৷ বোঝা মনে হতো না দেহে যদি 'খাওয়া' নামক জিনিসটা না পুরতে হতো? লোকটা বলল,
'দুপুরে খাই নাই৷ এই ভাত দে!
বারতের বছরের ম্যাচিয়ার তাকে খেতে দিল৷
'কি আছে খাওয়ার? লোকটার নিজর্ীব গলা৷
'গরু, খাসি, মুরগী, রুই, কাতলা, ইলিশ, বোয়াল, কাঁচকি---
কতক্ষন চুপ করে থেকে লোকটি বলল, 'কাঁচকি কয় টাকা প্লেট?
'কাঁচকি দশ টাকা প্লেট৷
'ডাল কত?
'তিন টাকা৷
'আমার কাছে টাকা নাই৷ আমাকে ডাল দে ভাতিজা৷
'শুধু ডাইল বিক্রি হয় না, বলে ম্যাচিয়ার ক্ষুধার্ত লোকটির সামনে থেকে ভাতের প্লেট উঠিয়ে নিল৷
কনক পাশের টেবিল থেকে এ দৃশ্যটা দেখছিল৷ সে ম্যাচিয়ারকে ডাকল, 'ভাতিজা এদিকে আয়৷
ডট চৌধুরী বলল, 'ওকে ডাকছিস কেন? এত সংবেদনশীল হলে চলে? রাখ্তো ওগুলো৷
'তুই চুপ করে থাক্ ৷
ম্যাচিয়ারটি এলো৷
'কি-ই কন?
'আমার পাশে বোস৷
সে বসল৷
'বাড়ি কোথায়?
'স্যার বরিশাল৷
'তোর বেতন কত?
'বেতন নাই৷ পেটে ভাতে৷
'মনে কর তুই বাড়ি যাচ্ছিস৷
'স্যার ঢাকা আসার পর আর বাড়ী যাইতে পারি নাই৷
'আচ্ছা মনে কর তুই বাড়ি যাচ্ছিস৷ তোর পকেটে পয়সা নাই৷ তোর ক্ষুধা লেগেছে৷ খাওয়া দরকার৷ শুধু এক প্লেট ভাত আর ডালের পয়সা আছে৷ কিন্তু শুধু ডাল বিক্রি হয় না৷ ভাত সামনে দিয়ে তা আবার ফিরিয়ে নেয়া হলো৷ তোর কেমন লাগবে?
ম্যাচিয়ারটা চুপ করে রইল৷
'কি-ই কথা বলছিস না কেন?
'শোন্, তোর আর ওনার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে? তোরা যদি তোদের দুঃখ না বুঝিস? তবে কে বুঝবে রে? তুই তাঁকে ডাল দিস না কেন? যা ডাল দে৷
'স্যার মালিকের নিষেধ আছে৷
'তোর মালিক কোথায়?
'মালিক নাই৷ দোকানে কয়জন লোক আইছিল৷ হেনাদের দেইখ্যাই মালিক দেঁৗড়াইয়া বাইরে গেছে৷ পেঁদানি দিতে আসছিল মনে হয়৷
'আচ্ছা ঠিক আছে৷ যা ডাল নিয়ে আয়! আর ওনাকে মুরগীর রান দে৷ আমি পয়সা দিব৷
লোকটি খেতে বসলো৷ সে যেন স্বর্গের কোন রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছে৷ স্বর্গের রেস্টুরেন্ট তো! সুখও বেশী তৃপ্তিও বেশী৷ লোকটি পেট পুরে খেয়ে কনকের কাছে এসে বলল,
'বাবারে তোমাকে দোয়া করছি৷ তুমি বড় হবা৷
'আপনি যান৷ দোয়া করতে হবে না৷
'বাবারে তোমাকে দোয়া করি তুমি বেহেস্তে যেন এমন সুন্দর খাবার খাও৷
লোকটি চলে গেল৷

ডট চৌধুরী বলল, 'ভালো দোয়া পেলি৷ বেহেস্তে গিয়ে এই ডাল আর ফার্মের মুরগীর রান দিয়ে ভাত খাবি!
কনক হি হি করে হাসল৷

'তার জীবনের জন্য যা শ্রেষ্ঠ তা-ই সে দিতে বলেছে৷ এর চেয়ে ভালো কি আছে? চৌধুরী আর এক কাপ চা খাবি?
'না৷ কনক তুই কি রাস্তায় ঝগড়া কুড়িয়ে বেড়াস্ ?
'না তো৷ কেন?
'নিজের পেট খালি আবার কুকুর পালি? কে কি খেল আর খেলনা তোর কি? তুই ক'জন কে খাওয়াবি?
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুল কনকের বুক থেকে?
'কাউকে-ই খাওয়াতে পারি না! পারলে ভাল হতো৷
'উঠ্তো! এবার ফেরা যাক৷

কনক-ডট চৌধুরী রেষ্টুরেন্ট থেকে বাইরে এলো৷ চলে যাবে৷ কিন্তু তাদের চলে যাওয়া হলো না৷ একটা পুলিশ জীপ এসে রেষ্টুরেন্টের সামনে হঠাত্‍ থামলো৷ ছয়জন পুলিশ ঝটপট বেরিয়ে এল৷ কনক-ডট চৌধুরীর দিকে তাদের বন্দুক তাক করা৷ মনে হচ্ছে এম্বুশ করে তাদেরকে কেউ ধরার জন্য এ পুলিশগুলো ঘাপটি মেরে বসে ছিল৷
কনক বলল, 'কি ব্যাপার?
কি ব্যাপার বলে কনক হা করে আছে৷ কথা বলার মত পরিস্থিতি নেই৷ তার মুখ দিয়ে শব্দ আর বেরুতে চাচ্ছে না৷
শেষে যা বেরুলো তা হলো, 'আমি বুঝতে পারছিনে আমরা কি করেছি? আমাদের দিকে তাদের বন্দুক তাক করা কেন?
পুলিশগুলোর একজনকে অফিসার মনে হচ্ছে৷ সে শ্লেষ ভরা গলায় বলল, 'কারণ নাই?
কনক বলল, 'জি না৷
'আমাদের কে বলা হয়েছিল জীপ থামিয়ে এই মুহূর্তে রেষ্টুরেন্টে যাকে পাবো তাকেই পেদানী দিতে৷ এদিক ওদিক তাকানো, কারোর সাথে কথা বলা সব পরে হবে৷ আগে ডাইরেক্ট এ্যাকশন৷ থানায় নিয়ে ইন্টারুগেশন৷ পরে ইন্টারসেকশন৷ ইন্টারসেকশন মানে কেটে লবন দেয়া! কিছু বুঝা গেল?
কনক বাইকের একপাশে৷ ডট চৌধুরী অন্যপাশে৷ তার হাত বাইকের হ্যান্ডেলের৷ ডট চৌধুরী বুঝে উঠতে পারছেনা কি হচ্ছে? বড় কিছু একট হবে সেটা আচ করা যাচ্ছে৷ সে ঠোট কাটা মানুষ৷ তার ঠোট এখন কাঁপছে৷ সারাশরীর ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে৷
পুলিশটি বলল, 'আপনাদের ঘামার দরকার নাই৷ আজ মন ভালো৷ তাই পেদানী দিচ্ছি না৷ জিপে উঠুন ৷
'কোথায় যাব?
'থানায়৷ থানায় আমাদের সার বসে আছেন৷ আপনাদের সাথে কথা বলবেন৷ তারপর সব হবে৷
'বাইক?
'বাইক টাইক সব নিয়ে ভিতরে উঠুন৷
অন্যান্য পুলিশরা হাসছে৷ তবে শব্দ করে নয়৷ তারা হাতে একটা কিছু পেয়েছে৷
'আপনাদের এ হোটেলের ম্যানেজারের কাছে থেকে মাল খাওয়া হয়৷ এবার আপনাদের মাল কে খায় দেখবেন?

কনক বিস্ময়ে হতভম্ব৷ তার কি করা উচিত কি বলা উচিত বুঝে উঠতে সময় লাগছে৷
'ভাইয়া আপনারা ভুল করছেন৷ চাঁদা খাওয়ার লোক আমরা নই!
'তা বুঝলাম৷
কনক বলল, 'কাইন্ডলী রেস্টুরেন্টের মালিককে ডাকুন৷ তিনি সত্য কথা বলতে পারবেন৷
'আসল কথা আমরাও বলতে পারবো৷ চোর চুরির কথা স্বীকার করে? হাইজ্যাকার হাইজ্যাকের কথা? সবাই গোবর খাওয়া শালিকের মত৷ খেয়ে মুখ মুছে আর না করে !
উঠকো বিপদ? রফায় আসা দরকার৷ ডট চৌধুরীর সাথে কনকের কানে কানে কথা হলো৷ অপরাধীদের কানকথা সন্দেহের হয়৷
সে পুলিশকে বলল, 'ভাইয়া আমার বাইক নিন৷ আমার বন্ধুকে ছেড়ে দিন৷ তার কোন দোষ নেই৷
'এইতো থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে! চাঁদা খাওয়া হয় না?
পুলিশগুলোও নিজেদের মধ্যে কান কথা বলল৷
'আচ্ছা বন্ধুকে ছেড়ে দিব৷ তবে কিছু মালপানি লাগবে৷
'এটা দেয়া সম্ভব না৷ ছেড়ে দিলে এমনি এমনি ছেড়ে দিতে হবে৷
ডট চৌধুরী বলল, 'কনক তোকে ছাড়া আমি যাব না৷
'ইমোশনাল হলে চলবে না৷ আমাকে ছাড়ানোর জন্য তোকে চলে যেতে হবে৷ তুই রাশু, রনক ভাইয়া আর ইউনিভর্াসিটিতে খবর পাঠিয়ে দে৷ দেখ কে আমার জন্য কি করতে পারে? প্লীজ যা৷ গুড বাই৷
ডট চৌধুরীকে ছেড়ে দেয়া হলো৷

কনককে নিয়ে থানায় আসা হলো৷ তার সাথে কথা বলতে থানায় যে স্যার বসে আছেন বলা হয়েছিল৷ তিনি নেই৷ পুলিশটি মিথ্যে বলেছিল৷

এ এক নতুন জগত্‍! কনককে এনে সরাসরি থানার হাজত ঘরের সাত শিকের গেট থেকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকানো হলো৷ ঘরটায় ইতিমধ্যে বিশপঁচিশ জন লোক ঢুকে আছে৷ কেউ দাঁড়িয়ে৷ কেই বসে৷ কেউ দরজার শিক ধরে বাইরের দর্শনার্থীর সাথে কথা বলছে৷ আটজনের স্থানে বিশপঁচিশ জন৷ আরো আসছে৷ সময় যাচ্ছে ঘরে মানুষ বাড়ছে৷ ঘরটা অদ্ভুত গন্ধে ভরে যেতে থাকলো৷ উত্‍কট গন্ধ! বিড়ির গন্ধ, গোসল না করা শরীরের গন্ধ, পচাঁ চটের বস্তা আর ঘামের মেশানো গন্ধ, বমির গন্ধ৷ নাম না জানা অনেক গন্ধ৷ রাশুর বাসায় দুপুরে যা খাওয়া হয়েছিল তা উথলে উথলে উপরে উঠে আসতে চাচ্ছে৷
হাজত ঘরটার একপাশে একজন শুয়ে কাঁপছে৷ লোকটি তার হাতপা বুকের সাথে শরীরটাকে ধনুক বানিয়ে চেপে ধরে আছে৷ ধনুষ্টংকার রোগীর মত খিচে খিচে কেঁপে উঠছে৷ তার মাথার পাশে বমি পড়ে আছে৷ বমির উপর মাছি ভনভন করছে৷
এক প্রহরী পুলিশ গলা ছেড়ে গালি দিয়ে উঠলো৷
'দেখ্ ঐ শালায় কেমন করতাছে? শালার পাছায় একটা লাত্থি মার৷ এবার কনককে উদ্দেশ্য করে সে বলল, 'এই নতুন মক্কেল! ঐ হালার পাছায় কইষ্যা একটা লাথি মারেন তো৷
কনকের মাথা ঘুরছে৷ কান ভোঁ ভোঁ করছে৷ মাঝে মাঝে চোখের পাতাগুলো নিজ থেকে বন্ধ হচ্ছে আবার খুলে যাচ্ছে৷
কনকের মনে হলো, 'এটা কি নরক? নাকি নরকের দ্বার? নিদের্াষ মানুষ হাজতে ঢুকে? হঁ্যা ঢুকে! না হলে আমি এখানে কেন?
কনক শুয়ে থাকা লোকটার কাছে গেল৷ তার শরীর থেকে পায়খানার গন্ধ বেরিয়ে আসছে৷
প্রহরী পুলিশটি কনককে উদ্দেশ্য করে আবার বলল, 'এই যে নতুন মক্কেল! কি দেখতাছেন? হিরোঞ্চী হালার পাছায় না, সিনা বরাবর কইষ্যা একটা লাত্থি মারেন!
লোকটা উইথড্রাল সিনড্রোমের জন্য এমন করছে৷ তার হিরোইন চাই৷ সে না, তার মস্তিষ্ক নামক অঙ্গটি হিরোইন চায়৷ নিউরোন, পেটমোটা শাখা প্রশাখায় ভরা লক্ষ লক্ষ ক্রিমির দলার মত৷ ওগুলোর রিসপ্টর হিরোইনের জন্য কিলবিল করছে৷ জিরো অর ওয়ান! এভ্রিথিং অর নাথিং! নিউরোন রিসপ্টর + হিরোইন ্#৬১৬৬৪; স্থানজয়ী কালজয়ী পাত্রজয়ী এক অবিশ্বাস্য রিয়াকশন! দেহ কাঁপন ছেড়ে দেয়৷ ঝিঁমুনি থেকে উঠে দাঁড়ায়৷ আর পায় কে? নরকদ্বার থেকে স্বর্গদ্বার! উড়ো৷ ভিতরে ঢোক৷ এক মোহময় জগত্‍৷ কোথায়ও দুঃখ নেই! সব সুখ সুখ আর সুখ!
হায়রে ঈশ্বর! কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? মস্তিষ্কই স্বর্গ! মস্তিষ্কই নরক! মানুষ প্রজাতিটার পুর্বপুরুষরা কি হিরোইন খেত? তা না হলো তার নিউরোনে হিরোইন রিসিপ্টার তৈরী হলো কেন?
প্রহরী পুলিশটি এবার কনককে বলল, 'কি-ই, হিরোঞ্চী নতুন দেখতাছেন? লাত্থি মারেন৷ ভংচং সব ঠিক হইয়া যাব৷
মাথার ভিতর কেমন যেন করছিল? কনক হাজত ঘরটায় ঢুকার পর থেকে নিজেকে নিয়ে আর চিন্তা করার সময় পায়নি৷ চিন্তা কখন যে কা'র জন্য হয়? সে অবচেতন লোকটার পাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় বসে আছে৷ মানুষের মাথায় হিরোইনের রিসিপ্টর?
পুলিশটির ঠাটানি মার্কা কথায় তার দিকে চোখ পড়তেই সে দেখতে পেল লোহার সাত শিকের গেটে কিছু লোক তার দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে৷ একজন বাদে তাদের সবার চোখমুখ স্বাভাবিক৷ স্বাভাবিক চোখমুখের লোকগুলো হলেন কনকের বড় ভাই রনক৷ তার সাথে রাশু, এজিএম হান্নান এবং মন্টু৷ অস্বাভাবিক মুখটা হলো কনকের বড় বোন কনিকার৷
কনক শিক-দরজার দিকে ছুটে এলো৷ খাঁচার পাখি দুনিয়ার ক্ষুধা নিয়ে যেন এ দিকে ধেয়ে আসছে৷ কনক হাত বাড়াতেই কনিকা তার হাত চেপে ধরলেন৷ বাজ পাখি তার শিকার ধরেছে৷ তিনি এভাবে এস.এস.সি.-র পরীক্ষা হলে কনককে বসিয়ে দিয়ে এসেছিলেন৷ তিনি নির্বাক৷ দু'চোখ চোখ থেকে পানি পরছে৷ এই বালকটির হাত যেন আর ছাড়া হবে না৷ বুকে লুকিয়ে রেখে তিনি এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবেন৷ পাশ থেকে রনক গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাস করলেন,
'কনক তুই এখানে কেন?
কনক নির্লিপ্ত গলায় বলল, 'ভাইয়া জানি না আমি এখানে কেন?
'তুই জানিস না? এটা কথা হলো? কে জানবে?
'কে জানবে৷ সেটা আমিও জানি না৷
'কারণ ছাড়া এখানে কেউ আসে?
'আমি জানি না৷
'এটা জানার জন্য এখন উকিল লাগবে৷
এজিএম হান্নান রনককে বললেন, 'ভাইয়া থানায় ঢোকা কোন ব্যাপার না৷ সামনে ইলেকশন৷ পুলিশের ধর পাকড় বেড়ে গেছে৷ কারণে অকারণে অনেককে থানায় আসতে হচ্ছে৷ জামিন নিয়ে চলুন ওকে বা'র করে নিয়ে যাই৷
'ও কি নেতা? সামনে ইলেকশন ও কে ধরে থানায় ভরবে?
এজিএম হান্নান রনকের দিকে তাকিয়ে বললেন,
'ভাইয়া, কনকের দোষ নেই৷ পাবলিকের উপর ইলেকশন-চিকিত্‍সা শুরু হয়ে গেছে৷
কনিকার মুষ্টিবদ্ধ হাতে কনকের হাত আটকে আছে৷ তিনি মুখ দিয়ে কিছু বলছে না৷ তার চোখ থেকে শুধু পানি পরছে৷ ছোট দু'ভাই দু'টিকে বারবার দেখছেন৷ একবার হাজতের বাইরের রনককে৷ আর একবার হাত ধরে থাকা হাজতের ভিতরের কনককে৷ চোখের পানি বলে দিচ্ছে, তিনি কি বলছেন? তিনি চোখে জল নিয়ে রনকের দিকে তাাকিয়ে কিছু বলবেন বলে মনে হলো৷ কিন্তু কিছু বললেন না৷
কনক বলল, 'বড় আপা তুমি কেঁদো না৷ আমি কোন অন্যায় করিনি৷ আমি এখান থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসব৷ এক রাত ই তো!
কণিকার ঠোট কাঁপছে৷ এবার ভেজা গলায় বললেন, 'আমি তোর হাত ছাড়ব না৷
রনক স্বাভাবিক মুখগুলোকে হাজতের গেট থেকে একটু দুরে ডেকে নিয়ে গেলেন৷
'থানায় কথা হয়েছে৷ যে রেষ্টুরেন্ট থেকে কনককে গ্রেফতার করা হয়েছে তার মালিকের ছেলে পুলিশের এসপি৷ তিনি এখন চিটাগাং আছেন৷ সারমর্ম হলো থানা কনককে ছেড়ে দিবে না৷৷ আগামীকাল আদালত থেকে তার জামিন নিতে হবে৷ এই রেষ্টুরেন্টে খুব চাদাবাজি হয়৷ আমার মনে হচ্ছে চাকরকে মেরে ঝি কে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে৷
সিদ্ধান্ত হলো উকিল ধরে আগামীকাল আদালত থেকে জামিনে কনককে ছাড়িয়ে নেয়া হবে৷ সবাই থানা থেকে চলে আসবে৷ মিসেস কণিকাকে জামিনের ব্যাপারটা বলা হলো৷ তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন৷
কনক ভিতর থেকে রনককে ডাক দিল৷
রনক শিক-দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন৷
'ভাইয়া আমার জামিন নিলি না? আমি তোদের সাথে যাব না?
রনকের মনে হচ্ছিল ছোট এই ভাইটির জন্য তাঁর মমতাভরা মনটা হু হা করে কেঁদে উঠবে৷ তিনি তাঁর মন নিয়ন্ত্রন করলেন৷ তাঁর মুখে হাসির রেখা ভেসে উঠলো৷
'ভাইয়া তুই হাসছিস কেন? আমার খুব খারাপ লাগছে৷ এই গন্ধে আর মশার কামড়ে আমি ঘুমাতে পারব?
রনক সাহেব কনকের হাত ধরলেন৷
'কত রাতই তো বাসার বাইরে কাটালি? একরাত কোন ব্যাপার না৷ কাল-ই বাসায় চলে আসবি! আমরা আসি৷ কাল জজ কোর্টে দেখা হবে৷
'জজ কোর্ট কেন?
'থানা জামিন দেয়? জজকোর্ট জামিন দেয়৷ আজ না, আগামীকাল বাসায় যেতে পারবি৷ আমরা তোর জন্য-ই চলে যাচ্ছি৷
'আপা চলো৷
রনক বড় বোনের হাত টেনে নিয়ে বাইরে চলে এলেন৷
ফুলতলীর পোল্ট্রি ফার্মের সদস্য মন্টু, এজিএম হান্নান এবং বন্ধু রাশু হাজতের গ্রিলের দেয়ালে কনকেন মুখোমুখি দাঁড়াল৷ বার্লিন প্রাচিরের ওপারের মানুষ দেখার দৃশ্য! একজনকে কয়েকজন টেনে হিঁচড়ে স্বাধীন পৃথিবীতে নিয়ে আসবে৷
এজিএম হান্নান বলেলেন, 'কনক, একরাত কোন ব্যাপার হলো? জাহাজ ডুবে গেছে৷ তুমি একটা লাইফ বোট নিয়ে তীরে সাঁতরে আসছো৷ আল্লাহর নাম করে সাঁতার থামিও না ভাই৷ তীরে তোমাকে আসতেই হবে৷ আমাদের কুড়িগ্রামের বিপদের কথা মনে নেই?
'বস্ আর কিছু বলতে হবে না৷ খুব তো চোটপাট শুনেছিলাম! থানা পুলিশ কোন ব্যাপারই না৷ কি-ই? কিছু হলো? সারা রাত বমির মধ্যে কিভাবে বসে থাকবো?
রাশু এপর্যন্ত একটা কথা বলেনি৷ তার ভিতর একটা অপরাধবোধ কাজ করছে৷ দুপুরে তার বাসা থেকে খেয়ে এসে এখানে কেন? ওকে আজ দুপুরে বাসায় খাওয়ানোই ঠিক হয় নি? কনকের হাত ধরে নিজের হাতে নিয়ে কয়েকটা চাপড় দিলো৷ এ যেন এক অশেষ শান্তনা! এজিএম হান্নান ঠিকই বলেছেন তীরে ভিতরেই হবে৷
মন্টু থানায় আসার পর সারাক্ষনই সিগারেট টানছিল৷ মুখ দিয়ে ভকভক করে ধুঁয়ো বেরুচ্ছে৷ তার ভিতর বিশেষ একটা অস্থিরতা কাজ করছিলো৷ না হলে পরপর এতগুলো সিগারেট মন্টু কখনো টানে না৷
তাকে দেখে কনক বলল, 'দোস্ত এতদিন পর কোত্থেকে এলি?
'তোর থানায় ঢোকার সংবাদ পেয়ে থাকতে পারিনি৷ ভালো লাগছিল না৷ চলে এসেছি৷
'মন্টু তোকে এখানে দেখতে পেয়ে খুব ভালো লাগছে৷ তোকে বোঝাতে পারছিনে৷ তুই এমফিলে ভর্তি হলি না কেন?
'পোল্ট্রি ফার্ম ভালোই চলছে! শালা, থানায় পোল্ট্রি ফার্ম চলছে! আমি কোন কানেকশন খুঁজে পাচ্ছি না তুই এখানে এলি কিভাবে?৷ তোর মত মানুষ থানায় ঢুকে কিভাবে?
'মন্টু, আধুনিক পোল্ট্রি ফার্ম আমরা করবই৷
'আমি কোন আশা দেখছি না৷
'এ কথা মুখে আনলে শালা তোকে আমার এখানে আর আসতে হবে না৷

রাত প্রায় দশটা৷
থানা থেকে বেরিয়ে আসার আগে অস্থির কন্ঠে মন্টু বলল, 'দোস্ত একটা কথা শুনবি?
কনক থেমে বলল, 'কি কথা?
'একটু হাসবি? বাঁশফাটা একটা হাসি দে! তোর হাসির শব্দ অনেকদিন হলো শুনি না৷ হেসে দেখা না?
কনক হাসলো৷ কিন্তু অট্টহাসি না৷ হাসিটা শুরু হতে না হতেই মিলিয়ে গেল৷ সত্যি জাহাজ ডুবি-ই হয়েছে৷ হতভাগ্য কনক নামের যাত্রীটির কান্নার শব্দ মন্টুর কানে এসে মিলিয়ে গেল৷
মন্টু কনকের হাত ধরল৷ 'মনে খুব কষ্ট পেলাম৷
'কেন?
'জীবনে প্রথমবার তুই এভাবে হাসলি৷ থানায় খুব কষ্টে আছিস!
কনকের মন খারাপ হয়ে গেল৷
সে অনেকক্ষন চোখ বন্ধ করে রাখল৷
'তোরা যা৷ রাশু মন্টু তোরা চলে যা৷ বস্ আপনারা চলে যান৷ আমি খুব ভালো থাকবো৷

পরের দিন দুপুর একটার রোদ৷ একটা মিছিল আসছে৷ পিছনে পুলিশের ভ্যান মিছিলটাকে পাহাড়া দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷ যদি মিছিল থেকে কেউ হারিয়ে যায়? মিছিলকারীর সংখ্যা ত্রিশজনের মতো৷ মিছিলের সামনে ঠোট ছেঁয়ে নীচে নেমে আসা পাতলা গোঁফের একজন পাতলা-মাানুষ লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে৷ জীবনের সমস্ত সঞ্জীবনী সুরা খেয়ে যেন মিছিলে নামা হয়েছে৷ রুখে কে? রোদ কেন? আগুনের বৃষ্টি পড়লেও সামনে যাওয়া হবে৷ লোকটি কনকের অনার্স-মাষ্টার্সের ক্লাসমেট মন্টু৷ তার কথা, কনকের মুখে হাসি ফোটানো হবে৷ পিছনে ডট চৌধুরী৷ মন্টু-ডট চৌধুরীর গলার ধমনীতে রক্ত ফুঁসে ফুঁসে উঠছে৷ মন্টু স্লোগান দিচ্ছে ... ... ... ...
'জ্বালো...রে জ্বা..ল... ও..
আগুন জ্বালো ! আগুন জ্বালো !!
কনক ভাই জেলে কেন?
কতর্ৃপক্ষ জবাব চাই?
কনকের কি-ছু হলে?
জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে !
জেলের তালা ভাঙবো'৷
কনক ভাইকে আনবো৷
মিছিল চলছে স্ববেগে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় রাস্তায়৷ বিভাগে বিভাগে৷ হায় দেশ! কোথায় কনক? কে চাঁদা খেল? কে ধরা পড়লো? কে ধরলো? কেন ধরা হলো? কার কাছে কনককের গ্রেফতারের জবাব জবাব চাওয়া হচ্ছে? প্যাড-সর্বস্ব দল যদি হরতাল ডেকে ঢাকার এক কোটি লোককে ঘরে বসিয়ে রাখতে চায় তবে একটা বিভাগের তিনচার'শ স্টুডেন্টস কিনা পারে? ক্লাস বন্ধ৷ পুরো বিভাগ অচল৷
ঘামে জবজবে ভেজা মানুষগুলোর মিছিলটা এক জায়গায় এসে থেমে গেছে৷ কেউ বসে৷ কেউ দাঁড়িয়ে৷ ডট চৌধুরী কিছু বলবে মনে হলো৷ সে ধন্যবাদ সূচক বক্তৃতা করছে ...... ...'সংগ্রামী ভাই ও বোনেরা আমার৷ আপনাদের সবাইকে রক্ত গোলাপ শূভেচ্ছা (বুঝা যাচ্ছে না এখানে রক্ত এলো কোত্থেকে? কারো হাতে গোলাপও নেই৷ বোন বলতে একজন৷ মিছিলে শুধু ভ্যানিজিয়া এসেছে৷ হৃদি আসে নি৷ সে গত ক'দিন ধরে ক্লাসে অনুপস্থিত)৷ প্রকৃত চাদাবাজদের না ধরে নিরাপরাধ নিরীহ মানুষকে ধরা হচ্ছে৷ আমরা এদেশেরই সন্তান৷ আগামীকালের উজ্জ্বল ভবিষ্যত৷ দিনদিন আমাদেরকে অধিকারহারা করা হচ্ছে৷ আমাদেরকে যেখানে ইচ্ছে সেখানে ধরা হচ্ছে৷ নিষ্ঠুরভাবে মারা হচ্ছে৷ এদেশের পথেঘাটে রেস্টুরেন্টে বসে কি চা-ও খেতে পারি না? এ অন্যায় আচরনের জবাব দেবে কে?
ডট চৌধুরীর কথার মাঝে মন্টু আবার ঝলসে উঠলো৷ তার ডানহাতে সিগারেট৷ বাম হাত উপড়ে৷
'কনক ভাই জেলে কেন?
পুলিশ প্রশাসন জবাব চাই?
কনক ভাই জেলে কেন?
কতর্ৃপক্ষ জবাব চাই? '
ডট চৌধুরী আবার উদ্ধ্যত কন্ঠে বলতে শুরু করলো৷
'সাথী বন্ধূরা আমার! কতর্ৃপক্ষকে ২৪ ঘন্টা সময় দেয়া হলো৷ এই সময়ের মধ্যে কনককে ছেড়ে না দেয়া হলে আগামীকাল থেকে অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য বিভাগে তালা ঝুলবে৷ ভিসি অফিসে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করা হবে৷
মন্টু আবার ফেঁসে উঠলো৷
'জেলের তালা ভাঙবো৷
কনক ভাইকে আনবো৷'
প্রয়োজন বোধে আমরণ অনশন করবো৷ কনককে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ৷

'মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ' এইটুকু না বললে বক্তৃতা কেমন যেন জমে না! একটা যাদু নিশ্চয়ই আছে এই শব্দক'টাতে৷ কোন্ যাদুকর এ শব্দক'টা এ যুবাদের শিখিয়েছিলেন৷ হে যাদুকর লহ্ লহ্ লও ছালাম৷ রাশুর মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো ডট চৌধূরীর বক্তৃতায়৷ নিরীহ রাশু রোদের রাস্তায় বসে তার মুখের দিপ্তী দেখছিল৷ আমরা কি না পারি?
মিছিল হলো৷ বক্তৃতা শেষ হলো৷ কতর্ৃপক্ষকে ২৪ ঘন্টা সময় দিয়ে মিছিলটা ভেঙে গেল৷

ঢাকার-ই এক রাস্তায় রঙ পাংশু হয়ে যাওয়া কালচে-নীল রঙের একটা ভ্যান জ্যাম ঠেলেঠুলে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছে৷ ভ্যানটির চারদিক লোহার রডের নেট৷ কোটি টাকা নিয়ে ভ্যানটি কোন ব্যাংকে ট্রেজারী চালান দিতে যাচ্ছেনা৷ ভ্যানটি দিয়ে মানুষ চালান হচ্ছে জেল হাজতে৷ ভায়া ইংলিশ রোড৷ গন্তব্য সদরঘাটের জজকোর্টের হাজত৷ কেউ জামিন পাবে৷ কেউ জেলে ঢুকবে৷ ভ্যানটির জানালা বলতে মাথাসই আধহাত প্রস্থের লম্বা ভেন্টিলেটর৷ সবাই দাঁড়িয়ে আছে৷ ভেন্টিলেটর দিয়ে জোড়া জোড়া চোখের দৃষ্টি রাস্তায় পড়ছে৷ একবার বা দিকে৷ আবার রাস্তার ডান দিকে৷ দৃষ্টি পড়ছে না তো চোখটা-ই একেকটা মানুষ হয়ে বাইরে ঝাপিয়ে পড়ছে! আহ্ কি সুন্দর পৃথিবী তার রাস্তা আর মানুষগুলো৷ জীবনের শরাব খেয়ে মানুষগুলো কোন্ জগতে? আমরাকোথায়? আমরা কেমন? ওরা কেমন? রাস্তায় আছড়ে পড়া চোখগুলোর মধ্যে কনকের এক জোড়া চোখ আছে৷
কনকের মনে হচেচ্ছ খাঁচায় পাখি আটকিয়ে রাখলে পাখিদের ঠিক এমন লাগে৷ প্রতিটি মুহুর্তে একটা দাফড়ানো ভাব৷ একবার এদিকে আবার ওদিক৷ পাখা ভেঙে যাবে যাক! আমাকে এখান থেকে বেরুতেই হবে৷ আমি তো এখানে থাকার প্রাণী নই৷ আমার অপরাধ কি? পাখি ছাড়া আর একটা বোধ ওকে খুব করে আঘাত করতে থাকলো৷ তা হলো মানুষের স্বাধীনতা৷ কথাটা মনে হতেই ওর গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল৷ স্বাধীনতা হলো মধু৷ স্বাধীনতা শব্দটা-ই হলো যাদু৷ না হলে গায়ের লোম দাঁড়ায় কেন? গতরাত থানা হাজতে জানালাবিহীন বিশ বাই বিশ ঘরে থাকা হয়েছিল৷ পানি খেতে হবে৷ অনুমতি লাগবে৷ বাথরুম পেয়েছে৷ অনুমতি লাগবে৷ কথা বলা দরকার৷ অনুমতি লাগবে৷ মৃতু্যশয্যায় এ রকম লাগে? পাশে আজ্রাইল বসে আছে৷ হিসেব নিকাশ আলোচনা হচ্ছে! এবার কোলাকোলি হবে! যে কোন সময় তিনি আত্নাটা ধরে টান দিবেন৷ পাংশুবিবর্ণ মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকা৷ এই তোর আত্নাটা নিয়ে নিচ্ছি! এই আলো৷ এই অন্ধকার৷

এখন হলো প্রিজন ভ্যান৷ হাজত ঘরের চেয়ে ছোট হয়ে আসছে থাকার জায়গা৷ এরপর কি হবে?
ভ্যানটা জজকোর্টে বেলা দু'টায় এসে থামলো৷ ওদেরকে পুলিশ কাষ্টোডিতে কোর্ট হাজতে রাখা হলো৷ সেখান তেকে আদালতে হাজির করা হবে৷
আদালত প্রাঙ্গনে তার জন্য অপেক্ষা করছে মন্টু, রাশু, এজিএম হান্নান এবং রনক সাহেব৷ ডট চৌধূরী আসেনি৷ এজিএম হান্নান বলেছিলেন ডট চৌধুরী তুমিও চলো৷ সে বলেছে সে আপাতত পুলিশের সামনে যাবে না৷ তার পুলিশের ভয় আছে৷ সে পুলিশকে পয়সা না দিয়ে হাতের মুঠি থেকে পিচ্ছিল শোল মাছের মতো ছুটে চলে এসেছে৷ জজকোর্টে পেলে আবার ধরে ফেলতে পারে! এবার হাতে ছাই লাগিয়ে ধরবে৷ রনক উকিলের সাথে কথা বলছেন৷ হাজত গেটে এজিএম হান্নান ধীরস্থির হয়ে আছেন৷
মন্টু ঘর্ম ক্লান্ত৷ মুখ ঘেমে আছে৷
সে কনককে বলল, 'দোস্ত আরামে আছিস মনে হয়?
'তোর এখনো বুঝার বয়স হলো না৷ কোন্টা আরাম আর কোনটা ব্যা-আরাম?
মন্টু বলল, 'নে বিড়ি খা৷
'সিগারেট টানার মোড নেই৷ তোর ভিতর সিরিয়াস ভাব কোনদিন এলো না৷ এখানে বিড়ি টানা যায়?
মন্টু বাম হাতের আংগুলে সিগারেট রেখে হাতকে মুঠি বানিয়ে সিগারেট টানছে৷ হ্ূক্কো মানুষ এভাবে টানে৷ হুঁউশ করে বিপুল পরিমান ধূঁয়ো বের করে সে বলল, 'কতদুর ভালো তেল? [কতদুর ভালো তেল' দিয়ে মন্টু 'খবর কি' বোঝায়?]
'মানে?
'মানে তুই কেমন আছিস?
'দেখতেই তো পাচ্ছিস?
'কনক তোর বন্দীদশা থেকে মুক্তি হওয়ার আগে কিছু বলার আছে?
'হঁ্যা বলার আছে৷ জীবনে পাখি বন্দী করে খাঁচায় ধরে রাখবি না৷
'আর?
'মানুষের স্বাধীনতায় কখনো হস্তক্ষেপ করবি না৷ সেটা তোর গুরু হোক আর শিষ্য হোক৷ বাসার কাজের লোক হোক৷ রিকশাওয়ালা হোক৷ সবজিওয়ালা হোক৷
'কনক তোর আর কিছু বলার আছে?
'না!
কনকের মুখ অজানা একটা আশংকার ছায়ায় ভরে গেল৷ রাশু কথা বলছে না৷ মনে হয় তার জবান বন্ধ হয়ে গেছে৷ সে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কনককে দেখছে৷ কনক মন্টুর কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল৷
'এই মুখ ঘুরাচ্ছিস কেন? তোর মুক্তির জন্য তো মিছিল করে এলাম৷
'মিছিল?
'হঁ্যা৷
'কোথায়?
'ইউনিভার্সিটিতে৷ আগামীকালের কাগজে দেখতে পাবি৷
'কেন?
'তোদের বিভাগে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছি৷ আগে তোকে এই পাখির খাঁচা থেকে বা'র করবো৷ তারপর তোদের ক্লাস হবে৷
'সন্তু্রাসবাদীদের জন্য মাসের পর মাস যদি ক্লাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে? একজন ভালো মানুষের জন্য নয় কেন? আচ্ছা, আদালতে তোর ডাক পড়ছে না কেন? আর কত দেরী? আমার ভালো লাগছে না৷ কনক গল্প বল্? তোর কেমন লাগছে?
'এখানে কথা বলা যাবে না৷
মন্টু অস্থির চিত্তে বলল, 'সে ব্যবস্থা আমি করেছি৷ কথা বলা যাবে৷ বল্ ৷
'হাজত ঘরে ঢোকার এ শিক্ষাটা আমার জন্য দরকার ছিল৷ নইলে আমি এখানে কেন? থানাটা আমার কাছে গ্রীক পুরাণের স্টিক্স নদীর মনে হচ্ছে৷ নদীটি পার হয়ে আমি মৃতু্যপুরীতে যাব! ঠান্ডা সঁ্যাতস্যাতে অন্ধকার একটা জায়গা৷
'কনক চুপ কর! এটা গল্প হলো? তুই তো আর মরছিস না৷ স্টিক্স নদী পার হওয়ার কথা বলছিস কেন? স্টিক্স নদী পার হতে হয় মৃতু্যর পর৷
'মরছি কি না জানি না৷ আমার তাই মনে হচ্ছে৷

মানুষ যা ভাবে তা কি হয়?
রাশু মন্টু ডট চৌধূরীদের আত্নপ্রশ্ন, একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো! কোথাও একটা গন্ডগোল আছে৷ এমনটা হওয়ার কথা না৷ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আদালতে কনককে বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল৷ বিচারে যা হয়েছে তা হলো কনক জামিন পায়নি৷ পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করেছিল৷ পুলিশের আবেদন মঞ্জুুর হয়েছে৷ কনকের উকিলের আবেদন নামঞ্জুুর হয়েছে৷
কনক হু হা করে কেঁদে উঠলো৷

কান্নার পরই তো হাসি৷
কনক মোট চার দিন আদালত আর থানা করে করে হাজত থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ তাকে হাজত থেকে বেরুতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে৷ তবে কেউ জেলের তালা ভাঙ্গেনি৷ সবকিছু ঠিকঠাক ছিল৷ কনক এখন মুক্ত একটা পাখির মত৷ যে পাখি শুধু রাতে ঘরে ফিরে৷ দিনে সারা আকাশ ঘুরে বেড়ায়৷
দল বেঁধে দুরে কিছু করতে গেলে এজিএম হান্নানের কাছে ঐ কাজগুলো পিকনিকের মত লাগে৷ পিকনিকের মত লাগার আরো একটা কারণ হলো কনক হাজতের শিকঘর থেকে বেরুনের পর আজ প্রথম বাইরে যাচ্ছে৷ কনকরা ফুলতলীতে যাবে প্রজেক্টের জমি দেখার জন্য৷ তিনি কনককে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসবেন৷ রাশু বেড়াতে যাবে৷ ডট চৌধূরী যাবে না৷ সে সবাইকে বিদায় জানাতে এসেছে৷ সাভারে জমির খোঁজ খবরটা ভালো করে নিতে গেলে সকাল সকাল রওয়ানা দিতে হয়৷ রাশু ও ডট চৌধুরী আজ সকাল সকাল মামুর দোকানে চলে এসেছে৷ আপাতত এই হলো আজকের প্রোগ্রাম৷
পেট্রোলের খরচ দিয়ে কনকরা এজিএম হান্নানের গাড়ীটির সার্ভিস পেয়ে থাকে৷ তাঁর প্রতি ডট চৌধূরীর এক সময় প্রচন্ডরকম এলার্জি ছিল৷ দেখার সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া৷ কনক-রাশুর মত শিক্ষিতদের বলয়ে যার অনুপ্রবেশ তাঁকে জানা উচিত৷ তিনি কে? তিনি অমক৷ তিনি কেমন? উত্তর জটিল৷ নানা মনের নানা মত৷ তিনি কে' র উত্তরের চেয়ে কেমন এর উত্তর জানা বেশী জরুরী হলেও সব উত্তর কি মিলে? তাঁকে দেখলেই ডট চৌধূরীর রাগ ধরতো৷ কিছুকিছু লোক আছে এমন হয়৷ আগ থেকে পরিচয় নেই বা কোনদিন দেখা সাক্ষাতও হয়নি অথচ পরে কোথাও তার চেহারা চোখে পরলেই গা জ্বলে৷ মনে হয় এ লোকগুলো কেন যে জন্মায়? অপরিচিতের প্রতি প্রথম দর্শনেই নেতিবাচক ধারনা পোষণ করলে এ সমস্যাটা হয়৷ এজিএম হান্নান ডট চৌধূরীর জন্য এমন ছিল৷

এজিএম হান্নানের বয়স চলি্লশের কাছাকাছি৷ তাঁর ভূড়ি আছে তবে খুব বেখাপ্পা ধরণের নয়৷ খালি গায়ে যতটা বেমানান হবে বলে মনে হয় সার্ট পরা থাকলে ততটা খারাপ লাগে না৷ সাফারী কলারের প্রিন্টের একটা হাফ সার্ট এবং বেল্ট ছাড়া কালো প্যান্ট পরেন৷ দু'হাতে তিন প্লাস তিন করে ছয়টি পাথরের আংটি পরেন৷ কোনটা রুবি, আমেটিষ্ট আবার কোনটা ফিরোজা৷ প্রতিটি পাথরের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং প্রভাব সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে৷ যেগুলো শুনলে অনেকেরই রাগ ধরে৷ পরিমানের চেয়ে বেশী খয়ের ব্যবহার করে সবসময় ডাবল পান কান৷ চমনবাহার জর্দ্দার কৌটা সর্বদা তাঁর প্যান্টের পকেটে থাকে৷

প্রত্যেকটা মানুষের নাকি কমপক্ষে একটা ভাল গুণ থাকে? এজিএম হান্নান প্রচন্ডভাবে মিশুক এবং সহজে রাগেন না৷ এটা তাঁর ভাল গুণ৷ তাঁর প্রতি ডট চৌধূরীর এলার্জিটা একদম কমে গেছে৷ তাঁকে রাশু বা কনক কেন বস্ বলে ডাকে? ব্যাপারটা ডট চৌধূরীর কাছে অজানা৷ তার জানা দরকার৷ সামনে লোকটি বসে বসে থাকবে৷ বন্ধুরা তাকে বস্ বস্ বলবে৷ তাকে জানবে না? তা হয় না৷
ডট চৌধূরী জিজ্ঞাস করল, 'রাশু তোদের সাথে এজিএম হান্নানের পরিচয় কবে থেকে হয়েছিল?
'তিন বছর হবে৷
'তাঁর বাড়ী কোথায়?
'কুড়িগ্রাম৷
'তাঁর কেউ নেই?
'না৷
'তিনি গাড়ী পেলেন কোথায়?
'কনক এজিএম হান্নানের কুড়িগ্রামের বাড়িতে গিয়ে গ্রাম্য শালিশ করে বেদখল হয়ে যাওয়া বাড়িভিটে উদ্ধার করল৷ সেই ভিটে-বিক্রীর টাকা দিয়েই গাড়ী কিনে রেন্টাল কার ক্লাবের সদস্য হয়ে তিনি এখন চলছেন৷
'বুঝলি কিছু?
'বলে যা৷
'কনক বস্কে ব্যস্ত রাখছে৷ এটা না করলে উনি গাঁজার পর হিরোহিন-মারুজুয়ানা ধরতেন৷ হাত পায়ে গ্যাংগরিনের মত দগদগে ঘাঁ নিয়ে ফুটপাতে চটের বস্তা গায় দিয়ে পড়ে থাকতেন৷
'কনকের লাভ?
'কনক কখনও লাভ খুঁজে বেড়ায় না৷
'তাকে বস্ ডাকিস কেন?
'বস্ ডাকলে উনি খুশী হোন৷ শুধু নাম ডেকে যদি কাউকে খুশী করা যায় অসুবিধা কোথায়? তুই যেমন ডট চৌধুরী বললে খুশী হস্৷
'ডট চৌধুরী আর এজিএম হান্নান একটা কথা হলো?
'মানুষ হিসাবে হান্নান বসকে আমার ভাল লাগে৷
'কারণ ছাড়াই ভালো লাগে?
'হু৷
'আমি ভেবেছিলাম তাঁর প্রফেশন হলো শশ্মানঘাটে মরা মানুষ পোড়ানো৷ তাঁর শরীর থেকে মরা মানুষ পোড়ার গন্ধ পেতাম৷
'মরা মানুষ পোড়ার গন্ধ? হে হে হে৷
'রাশু, হে হে হে করলি যে?
'তিনি গাঁজা টানেন৷ তাঁর এ বদাভ্যাসটা আমাকে হতাশ করে৷
'গাঁজাখোরের সাথে উঠবস করিস? তাঁকে গাজা খেতে না করতে পারিস না?
'তাঁকে বলব গাজা না খেতে? তিনি গাঁজার সাধক৷ না করলে পলিটিশিয়ানদের মত গলার রগ ভাসিয়ে গাঁজার উপর বক্তৃতা শুরু করবেন৷
'কি রকম বক্তৃতা?
'তোমরা জানো? গাঁজা খায় দুধরনের মানুষ! এক ধরনের মানুষ গাঁজা খেয়ে মাতলামী করে, ভুংভাং করে ন্যাষ্টি হিরোইজম শো করে৷ তারা মানুষকে ভয় দেখায়, সমাজকে অস্থির করে৷
আর এক ধরনের মানুষ গাঁজা খায় দুনিয়াকে, দুনিয়ার মোহকে ভুলে থাকার জন্য৷ তারা গাঁজা টেনে দুনিয়া থেকে সম্পর্কহীন অন্য রকম মানুষ হয়ে যায়৷ গাঁজাখোর ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে সে কে? কিসের জন্য তার সৃষ্টি? কোথায় তার দায়িত্ব শেষ? মানুষ কি? কে? এক ধরনের পশু! পশু কি? এই মহাবিশ্বের কোটি কোটি গ্রহ৷ তার মধ্যে মানুষ এক ধরনের প্রাণী৷ সব কিছু উলোট পালট হয়ে যায়৷ তালগোল পাঁকিয়ে মাথা লাটিমের মত ঘোরে৷ গাঁজা চাই আরো গাঁজা৷ ভুলে থাকতে চাই আমি আমাকে৷ সব কিছুকে৷ রাশু, আমার দুঃখ হয়! প্রথম ধরনের গাঁজাখোরদের মানুষ সমীহ করে আর দ্বিতীয় ধরনের গাঁজাখোরদের মানুষ করুনা করে এই হল বাস্তবতা৷ ডট চৌধূরী এবার বুঝলে বসের থিম!
'রাখ্ গাঁজাখোরী ষ্টোরি৷ তা হলে তো দুনিয়ার বড় বড় দার্শনিকরা, কোপারনিকাস, ডারউইন'রা সারাক্ষণ গাঁজার টানের উপর থাকতেন! কম হলে গাঁজার ধোঁয়ার চেম্বারে ঘুমাতেন৷
'উনি বিয়ে করেননি?
'জিজ্ঞাস করেছিলাম, বয়সতো কম হলো না কি বস্ বিয়ে সাদী করবেন না?
'উনি কি বললেন?
'বস্ এমন শব্দ তরংগ সৃষ্টি করে, হু...ঊ...হু ...করেছিলেন যার উত্তর পজিটিভ কিনা নেগেটিভ তা আমার পক্ষে বুঝা সম্ভব হয়নি ৷
'এতো দেখি ফাউল মানুষ!
'যে প্রশ্ন উনি আশা করেন না তার উত্তর উনি এভাবে দেন৷ চালচলনে এজিএম হান্নানকে দেখে প্রথম দিনই আমার মনে হয়েছে তিনি এক অদ্ভুত আর্কিটেকচারের মানুষ৷ তাকে নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাই ভালো৷
'রাশু, তিনি বাস্তব জীবন সম্পর্কে কি ভাবেন?
'কিচ্ছু ভাবেন না৷
'সাভারে জমি কিনলেন কেন?
'কনকরা কিনেছে৷ তাই পুলকিত হয়ে উনিও কিনেছেন৷
'জমি কেনার মধ্যে পুলকিত হওয়ার কি আছে?
'কয়েক দিন পর শুনতে পারবি বস্ জমির শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার লোক খোঁজছেন৷ কনক গাড়ী কিনিয়ে তাঁর জীবনের গতি দিয়েছে৷
'যন্ত্রনা! উনি কি জীবনের গতি বুঝেন?
'বস্কে দেখলে এক সময় জীব-জড়র পার্থক্য বিলীন হয়ে যেতো৷ কনক-ই বস্কে জড় থেকে জীবে এনেছে৷
'কনক কাজটা খুব ভালো করেছে৷
'বসের পকেটে দুইশত টাকা থাকলে বন্ধুদের জন্য একশত নব্বই টাকা খরচ করে ফেলেন৷ পকেটে কয়েকটা টাকা এলে মনে হয় নোট গজ গজ করছে৷ খরচ করার জন্য পাগল হয়ে যান৷ উনি যে এটা কেন করেন সে কথা একমাত্র আল্লাহই জানেন৷
'তাঁর এই ফুটানির দরকারটা কি?
'জানি না৷ তাঁর শোচনীয় অবস্থাটা কেটে গেছে৷
'আই সি (ও ংবব)৷

হর্ন বাঁজছে৷ পরিচিত হর্নের শব্দ৷ সামনে চোখ পড়তেই দেখা গেল একটা গাড়ী এ দিকে আসছে৷
এজিএম হান্নান তার গাড়িতে করে কনককে নিয়ে মামুর দোকানে এলেন৷ ফুলতলি রওয়ানা হবেন৷
কনক গাড়ীর ভিতর থেকে বলল, 'চৌধূরী আমরা যাচ্ছি৷ তুই দুপুর দ'ুটোর দিকে এখানে থাকিস৷ একসাথে লাঞ্চ করা যাবে৷
এজিএম হান্নান রাশুকে তুলে নিয়ে চলে গেলেন৷

যার মাবাবা ভাইবোন আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই, পৃথিবীতে তার আর কে আছে? আসলে কেউ নেই৷ থাকলে এতিম এজিএম হান্নানের বাড়িভিটে অন্যের দখলে যায় কেন?
দুপুর দেড়টা৷ ডট চৌধূরী মামুর দোকানে অপেক্ষা করছে৷ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলে দিন লম্বা মনে হয়৷ ক্ষুধা লাগে৷ ডট চৌধূরীর ক্ষুধা লেগেছে৷ সে বার বার ঘড়ি দেখছে৷ জাষ্ট টাইম, নো কপ্লেইন৷ এজিএম হান্নান সদলবলে পেঁৗনে দু'টায় এসে মামুর দোকানের রাস্তার আইল্যান্ডে গাড়ী থামালেন৷
ঝটাপট গাড়ী থেকে নেমেই তিনি বললেন, 'মামু চা দেন তিন কাপ৷
রাশু বলল, 'বস্ আমি চা খাব না৷
কেউ চা খেল না৷ এজিএম হান্নান একাই চা খেলেন৷ ফড়্ফড়্ করে চা শেষ করলেন৷ মনে হল সারাদিনের বুকফাটা তৃষ্ণা নিয়ে তিনি পানি খেলেন৷ অতিরিক্ত পান খেতে খেতে তাঁর জিহবার অনুভূতি কমে গেছে৷ জিহবা ঠান্ডা গরম বুঝার আগেই সব কেল্লাফতে! চা গলার নালী বেঁয়ে নীচে নেমে যায়৷

এজিএম হান্নান বুক পকেট থেকে বলপেন কাম পকেট ঘড়িটি বের করলেন৷ তিনি পথচারি বা আশেপাশের অন্য কারোর কাছ থেকে সময় জানতে চেষ্টা করেন৷ এটা তাঁর একটা বাতিক৷ দুপুর দু'টো দশ বাজে৷
তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'চলো আজ মতিঝিলে খেতে যাব৷
ঢাকা শহরের কোথাও যদি টাকা উড়ে বেড়ায় সেটা মতিঝিলেই৷ সেখানে খেতে যাওয়া মানে মানিব্যাগ থেকে টাকা উড়ে বেরিয়ে যাওয়া৷
কনক বলল, 'বস্ আমার কাছে একশ পঁচাত্তুর টাকা আছে৷ আপনার কাছে টাকা থাকলে আমাকে দেখান৷ তারপর যাওয়া যাবে৷ টাকা না দেখালে আমি আপনার সাথে যাব না৷
'কনক কি বলছো?
'আমার কি সেদিন আছে?
'টাকা না দেখালে আমি আপনার সাথে যাব না৷
তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, 'নো প্রবলেম৷ টাকা দেখাতে হবে না৷ আজ আমি খাওয়ার বিল দেব৷ সো লেটস গো৷ গো!

ওরা আবার গাড়ীতে গিয়ে বসল - উদ্দেশ্য মতিঝিল৷ এজিএম হান্নান ড্রাইভ করছেন৷ তাঁর পাশে ডট চৌধূরী৷ পিছনে রাশু আর কনক৷ কনক পিছনে মাথা হেলিয়ে গুম হয়ে দু'চোখ বন্ধ করে আছে৷ ডট চৌধূরী দেখল এজিএম হান্নানের গাড়ীটা বাইর থেকে যতটা না খারাপ মনে হয় ভিতরের অবস্থাটা আরো খারাপ৷
কু্যচ নেহি!
কনক হাজত থেকে বের হয়েছে৷ এ আনন্দ ওরা রাখে কোথায়?
এজিএম হান্নান গান ধরেছেন৷ প্রথম লাইন থেকে নয়, মাঝখান থেকে ______
এলোমেলো পথ চলা .....
মনে মনে কথা বলা ৷
আকাশ ভ.....রা, স্বপ্ন ঝ ..... রা .....

তাঁর পিকনিকের মুলপর্ব শুরু হয়ে গেছে৷ তিনি নিজেই স্টীয়ারিং উপর তবলচীর কাজ চালাচ্ছেন এবং মাঝে মাঝে স্টীয়ারিংয়ের উপর হেলে পরছেন৷ গাবগুবাগুব ! ডিগ্ ডিগ্ ডগ্ ডগ্৷
আহ্ সে কি সুরবোধ! তিনি গানটির সুরকে যেভাবে মলন দলন করছেন তাতে যে সুরসাধক এগানটির সুর সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর সাথে এজিএম হান্নানের দেখা হওয়া দরকার৷ দেখা হলে যে কোন একজন বেঁচে থাকতেন৷ কারণ, সুরই প্রেম প্রেমই সুর৷ স্বর্গ হতে আসে প্রেম স্বর্গে যায় চলে৷
প্রচন্ড গরম৷ এজিএম হান্নানের গলা থেকে সুরের নহর বেরুচ্ছে৷ নহরের সুরপানি গায়ে লেগে সবার শরীর বিড়বিড় করে ক্রমাগত জ্বলছে৷ রাশু দাঁতে ঠোট চেপে পিছনে হেলিয়ে দেয়া কনকের ঝিমুনি মুখ দেখছে৷ ডট চৌধূরীর মনে হচ্ছে তার গায়ের চামরায় তীব্র জ্বলুনি হচ্ছে৷ একটা কিছু হওয়া দরকার৷ হয়েছেও মনে হলো৷
এজিএম হান্নানের গান হঠাত্‍ থেমে গেল৷ তিনি শক্ত ব্রেক করলেন৷ গাড়ী রিকশার পিছনে কর্কশ শব্দে থেমে গেল৷ রিকশাওয়ালা পা ফস্কে আছড়ে পড়েছে৷ সে ব্যাথা পেয়েছে৷
ঘটনার পিছনে ঘটনা ঘটে৷ আর একটা ঘটনা ঘটেছে৷ কঁ্যাচিকলে ইঁদুর আটকালে যেমন অবস্থা হয় তার চেয়ে তীব্রতর স্বরে হঠাত্‍ ক্যাকরে উঠে ডট চৌধূরী বলে উঠল,
'ঊঁ...হুঁ...রে, মা...রে মরলাম রে! মা...রে ..,
পেছন থেকে রাশু লাফিয়ে উঠল৷ 'কি ব্যাপার ডট?
ডট চৌধূরী কোন উত্তর দিল না৷ সে ব্যাথায় ইঁশপিঁশ করছে৷
কনক পিছনে হেলানো মাথা সামনে একটু এগিয়ে বন্ধ-চোখ খুলে আবার বন্ধ করল৷ ডট চৌধূরী আজ প্রথম এ গাড়ীতে উঠেছে৷ এজিএম হান্নানের গাড়ীতে উঠলে বিশেষ সাবধানতাসহ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়৷
তাঁর গাড়ীতে দ'ুটা ব্রেক কাজ করে৷ একটা অরিজিনাল আর একটি ধোলাইখাল নির্মিত দ্বিতীয় ব্রেক৷ যে ড্রাইভিং শেখে সে একটা ব্রেক নিয়ন্ত্রন আর যে শেখায় সে অন্যটি নিয়ন্ত্রন করে৷ অরিজিনাল ব্রেকের সাথে লোহার পাত ঝালাই করে ড্রাইভারের পাশের যাত্রীর পা পর্যন্ত টেনে নিয়ে সেখানে আরো একটা ব্রেকের আকার দেয়া হয়েছে৷
রিকসাকে গাড়ী চাপা থেকে বাঁচানোর জন্য ব্রেক কষার সাথে সাথে ডট চৌধূরীর ডান পায়ের বুড়ো আংগুলে প্রচন্ড শক্তিতে চাপ পরে৷ চাপ না, তার মনে হয়েছির বিশ কেজি ওজনের পাথর ইচ্ছে করে তার পা'র আংগুলে ফেলা হয়েছে৷
ডট চৌধূরী রেগে ঝেড়ে এজিএম হান্নানকে বলল, 'ধে---ত্‍ মিয়া এটা কি করলেন?
কনক চোখ বন্ধ রেখে নিঃশব্দে হাসছে৷
'ব্রেক কে পাদানী ভাবলে তো সমস্যা? এজিএম হান্নান শীতল উক্তি করলেন৷
ডট চৌধূরী রেগে বলল, 'তার মানে?
কনক চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলল, 'চৌধূরী চুপ কর৷
ডট চৌধূরী বিরক্ত মনে চুপ করে বসে রইল৷ ধারাবাহিকভাবে তার উপর কুফাজাতীয় যতসব ঘটে যাচ্ছে! কাক, চিঠি, থুথু, এখন পা'র বুড়ো আংগুলে আত্মা-লাগানো ব্রেক-পাদানীর চাপ! ও আজকে পায়ে কেডস পড়ে নি, পড়েছে স্যান্ডেল৷ এতে ওর মাথা ঠান্ডা থাকে৷ পায়ে কেডস থাকলে ব্রেক-পাদানীর ব্যাথাটা আরো কম লাগতে পারতো৷
সে মনে মনে বলল, 'দিনগুলো এমন যাচ্ছে কেন? সামনে কোন মৃতু্যকূপ অপেক্ষা করছে?
রাশু পিছন থেকে তাকে আস্তে করে ধাক্কা দিল৷
'কি ভাবছিস ডট?
ডট চৌধূরী কথা বলল না৷ সে ক্রেনের গলার মত আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে ডানে এজিএম হান্নানের দিকে তাকালো৷ চোখমুখে বিরক্তির ঘন কালো মেঘ৷
'কিছু বলবে চৌধুরী?
'ভালভাবে গাড়ী চালান৷ না পারলে কনককে দেন৷ সে চালাবে৷
'গোস্তাকি মাফ করবেন! এ শহরে যারা গাড়ী চালায় তারা জানে কত মিনিটের পথ কতক্ষণে যেতে হয়?
'আপনি গাড়ী বুঝি এমনি চালান?
এজিএম হান্নান নিরুত্তর৷
'হান্নান বসের গাড়ী চালানোর মডেলটা পেংগুইনের সাঁতারের মত৷ পানিতে কাঁথা সেলাই করা৷ শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে দেয়া, শরীর থামার আগে সামনের দিকে আবার ঠেলে দেয়া! একটা গিটকিরি লয়৷
রাশু মন্তব্য করে নিজেই ফ্যাত্‍ করে হেসে দিল৷
রাস্তায় একদম মোরগ-যুদ্ধ হচ্ছে৷ এজিএম হান্নান স্পীডোমিটারে স্পীড উঠান ত্রিশ কিলোমিটারে৷ তিনি এগুতে পারেন না৷ স্পীড দশে নামিয়ে নেন৷ সামনে ত্রিচক্র বেবি ট্যাক্সরি বাধা৷ চড়ূই পাখি৷ শুধু ফুড়ুত্‍ ফুড়ুত্‍ করে সামনে আবার পিছনে৷ একবার এফাঁকে আবার ওফাঁকে৷

কনক ফুলতলী থেকে ফিরে আসার পর একাগ্রচিত্তে রাশুর পাশে ঝিমুচ্ছে৷ হট্টগোলের মধ্যে চোখ বন্ধ করে ঝিমিয়ে নিলে ওর নার্ভাস সিষ্টেমগুলো পুরোপুরি কর্মোদ্দম হয়ে উঠে৷ পরবর্তী সময়গুলোতে কনক সব কিছু মনেেেযাগের সাথে করতে পারে৷
গরমের তাপদাহ বেড়েছে মনে হচ্ছে৷ রোদের তাপ ঝাঁ ঝাঁ করছে৷ রাস্তা থেকে গরম সবার গাএ আছড়ে পড়ছে৷ কনক ঝিমুনি থেকে উঠেছে৷ সে ডট চৌধূরীকে দেখছে৷ রাগ-দুঃখ-ক্ষুধার অবমিশ্রনে ডট চৌধূরীর ভিতর একটা বাজে মুডের সৃষ্টি হয়ে আছে৷ সে রাগে ঘধঘধ শব্দ করছে ৷
'রাশু, আজ ক্যাম্পাসে খেয়ে নিলেই ভাল করতাম, ডট চৌধূরী নিজেই নিজের নিঃশব্দতা ভাঙল৷
'আমারও তাই মনে হচ্ছে৷
'দেখছিস, চোখের সামনে ঢাকা শহর কিভাবে মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে!
'হু৷
'সূূর্য কি বাংলাদেশের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে? নাকি বাংলাদেশের ভূখন্ডটুকু উপরে উঠে সূর্যের কাছাকাছি চলে গেছে?
কনক বলল, 'চৌধূরী কোনটাই হয়নি৷ তোর ক্ষুধা লেগেছে৷ পারলে তুই চৌরাশি কেজি ওজনের এজিএম হান্নানের দেহের পুরোটাকে খেয়ে ফেলবি৷
এজিএম হান্নান বললেন, 'চৌধূরী আর তোমার কষ্ট হবে না৷ আমরা এসে গেছি৷

ওরা এসে ঢুকলো মতিঝিলের একটা রেষ্টুরেন্ট - 'অন দি ওয়াটার ওয়ার্ল্ড'-এ৷ এয়ার কন্ডিশন্ড দোতলা ঘর৷ উপরে ক্যাণ্টিন নীচে একুইরিয়ামের দোকান৷ দোকানটার পুরো চার দেয়ালে সামদ্রিক জলজ উদ্ভিদে আঁকা৷ এখান থেকে সিড়ি বেয়ে আবার দোতালার ক্যাফেতে৷ গাঢ় পিংক কালার টিউলিপ ফুলের ফরমিকা করা টেবিল৷ সাথে কালার ম্যাচ ফোম কভার্ড চেয়ার৷

রেস্টুরেন্টে ঢুকে এজিএম হান্নান ঘাড় বেঁকে ডট চৌধূরীকে বলল, 'উ.য়ু.হু.হু.. এখানে ভদ্রলোকেরা খায়!
ডট চৌধূরী তাঁর দিকে বিরক্তি নিয়ে তাঁকাল৷
'ভদ্রলোকও হতে পারে৷ চোর বদমায়েশ গুন্ডাও হতে পারে৷ বলুন টাকাওয়ালারা খায়৷

রেষ্টুরেন্ট মালিকের সুন্দর রুচিবোধ আছে৷ ক্ষিদের আগে মনের মেজাজটা ঠান্ডা রাখা গুরুত্বপূর্ণ৷ কাষ্টোমারের মেজাজের দিকে খেয়াল রাখা হয়েছে৷ টাকার বিনিময়ে খেতে দেওয়াটাই যে কাষ্টোমারের জন্য একমাত্র সার্ভিস নয় সে ব্যাপারে রেষ্টুরেন্টের মালিকদের পড়াশুনা করার দরকার আছে৷ এজিএম হান্নান গতকাল তাঁর এক শিক্ষাণবীশ ছাত্রের কাছ থেকে এ রেষ্টুরেন্টের সন্ধান পান৷ আজকেই প্রথম আসা এখানে৷

কনক এবং রাশু ফ্রেশ হয়ে টেবিলে বসল৷ এজিএম হান্নান হাতমুখ ধুচ্ছেন৷ তিনি স্নিগ্ধ পরিবেশের এই রেষ্টুরেন্টে উঁচু গলায় ঘড়্ ঘড়্ খেক খক ঘক ঘঘক .. কাশির যত প্রকার শব্দ আছে সবগুলো করে করে মুখ-কুলকুচা করা পানি তুষারের মত শুভ্র বেসিনে ফেলছেন৷ একবার দু'বার নয়, তিনি ন'দশ বার এ কাজটি করলেন৷ ডট চৌধুরী তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে৷
বেসিনে পানির গরম-ঠান্ডা ডাবল লাইন৷ এজিএম হান্নান অনবরত গরম পানি দিয়ে মুখ ধোয়ার কাজটা সারছেন৷
ডট চৌধুরী জিজ্ঞাস করল, 'আপনার কি টনসিলাইটিস?
'তা হবে কেন? এখন কি শীতকাল?
তাঁর ধারনা টনসিলাইটিস একমাত্র শীতকালের অসুখ৷ গ্রীষ্মকালে টনসিলের ইনফ্লেমেশন বা ইনফেকশন হতে পারে না৷
'এত গরম পানি ব্যবহার করছেন কিভাবে?
'তিনি গার্গল করা অবস্থায়ই বললেন, 'মুখটা ভাল করে খ...খ.. খলাচ্ছি৷
'খলান৷ যত পারেন খলান৷ কেরোসিন লাগবে? কেরোসিনে ময়লা কাটে বেশী৷
সাদা ধবধবে বেসিনটার গায়ে চিরনদাঁতা এজিএম হান্নানের পানের ব্যসাইজের অর্চব্য ছোটছোট অংশগুলো আটকে গেছে৷ গাদের মত পান-খয়েরের লাল পানিতে ওগুলো ভাসছে৷
বেসিনের রেষ্টুরেন্ট-জীবনে প্রথম পরিচয় ঘটলো এজিএম হান্নানের মত একজন খক্কখইক্ক্যা কাষ্টোমারের সাথে৷
ডট চৌধুরী বলল, 'পরিচ্ছন্নতা মানুষকে দেবতা করে৷ আপনি কি করলেন?
'আমি কি করেছি?
'মিয়া, বেসিনের প্রাণ-হাত-পা থাকলে আপনার মুখ বরাবর একটা চটকানি দিত৷ মাথা নীচু করে বেসিনের আউটলেট বরাবর পান-পাতার লাল পানিটা ফেলতে পারতেন৷ তা করলেন না৷ আপনি আসলে একটা নোংরা গিধর !
তাঁর কানে একথাগুলো ঢুকছে বলে মনে হলো না৷ তিনি নির্লিপ্ত এবং নিঃশব্দে হাসলেন৷
ডট চৌধুরী ট্যাপ ছেড়ে দিল৷ এজিএম খক্কখইক্ক্যার রেখে যাওয়া পানের সবুজ পাতাগুলোকে সরানো যায় কিনা? কিন্তু নাহ্! ওগলো যাচ্ছে না৷ হাত না চালালে সম্ভব নয়৷ ডট চৌধুরী হাত চালাল না৷ সে মেথর না৷

খাবার টেবিল প্রায় ঘন্টাখানেক কাটল৷ এজিএম হান্নান বত্রিশ শো সাতাশ টাকা গুণে বিল দিয়ে দিলেন৷ তার মুখে তৃপ্তির ছায়া৷
কনক বলল, 'এবার উঠা যাক৷
এজিএম হান্নান সাহেবের খাওয়ার পছন্দগুলোর মধ্যে একটা হলো তিন প্যাচের বড় বড় জিলেপি৷ উনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কমপক্ষে তিনবার জিলেপি খান৷ তাঁর কাছে আর টাকা নেই৷ তিনি দুর্বল সাহস নিয়ে বললেন, 'কনক জিলেপি খাবে?
কনক চটে বিরক্তি নিয়ে বলল, 'বস্ উঠেন? জিলেপি টিলেপি খেতে হবে না৷
জিলেপি খাওয়ার পর্ব এখানেই শেষ৷

কনক হাসল৷ এজিএম হান্নান সত্যিই সাথে টাকা নিয়ে এসেছিলেন৷ তা না হলে কি বিশ্রী ঘটনা ঘটতো? তাঁকে নিয়ে কনকের লজ্জাষ্কর অনেক স্মৃতি আছে৷ যেমন, এজিএম হান্নানের সাথে পরিচয়ের প্রথম দিকের ঘটনা৷ তিনি এক বিকেলে এসে বললেন, 'কনক তোমাকে গরু খোঁজা খোঁজছি৷ চায়নীজ খেতে ইচ্ছে করছে৷ চলো বিল আমিই দিব৷
'চায়নীজ খাওয়া হলো৷
এজিএম হান্নান ক্যাশে এসে বললেন, 'ম্যানেজার সাহেব লিখে রাখেন৷ পরে এসে বিল দিয়ে যাব৷
'আমাদের রেষ্টুরেন্টে বাকী হয় না ভাইয়া!
'বাকী কই? কাল এসে দিয়ে যাব৷
কনকের চোখমুখ কালো হয়ে গেছে৷ কান দিয়ে ধুঁয়ো বেরনো শুরু হলো৷ পা কাঁপছে৷ ক্যাশের এ অভিনব দৃশ্যের দিকে অনেকে তাকিয়ে আছে৷ এজিএম হান্নানের চোখমুখে অপমানবোধের একবিন্দু লেশ নেই৷ তিনি জাবরকাটা ছাগলের মত গুঁয়ামৌরি চিবিয়ে যাচ্ছেন৷ তাঁর জাবর কাটা থামছে না৷ তিনি একটা পলিথিন ব্যাগ ম্যানেজারের ক্যাশে রেখে খচ্খচ্ শব্দে খুললেন৷
'এ তো জুতা! জুতা ক্যাশের টেবিলে? হায় শিট!
তিনি ম্যানেজারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'জুতা জোড়া নতুন৷ দাম সাড়ে বারশ টাকা৷ বিলের বদলে আপনাকে জুতা দিয়ে গেলাম৷
ম্যানেজারের চোখ কপাল ছেড়ে আরো পিছনে দিকে চলে গেছে৷
'আমি জুতা নিব কেন?
'তারমানে? জুতা টাকা দিয়ে কিনিনি?
'আমিতো বলছি না বায়তুল মোকারম থেকে চুরি করে এনেছেন?
কনকের মনে হলো হাতে একটা চাবুক পেলে পিঠ চাপকিয়ে তাঁর চায়নীজ খাওয়ার সাধ মিটিয়ে দেয়া যেতো৷ তাঁর চাইনীজ খাওয়া উচিত পরজনমে৷ ইহজনমে না৷
ম্যানেজার বললেন, 'আমি আপনার জুতা নিতে পারবো না৷
'আপনাকে জুতা নিতে হবে৷
'দঃখিত৷ আমি আপনার জুতা নিতে পারবো না৷
কনক মুখ খুলল৷ তার কন্ঠে বিনয় ভরা৷
'ম্যানেজার সাহেব আপনাকে জুতা নিতে হবে না৷ আগামীকাল আপনি বিল পাবেন৷
কনক রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো৷ একমাস তার সাথে এজিএম হান্নানের দেখা করা নিষিদ্ধ ছিল৷ পরদিন রেষ্টুরেন্ট জমে উঠার আগেই কনক ঐ চাইনিজে গিয়ে হাজির হলো৷
'চিনতে পেরেছেন?
'গতরাতের জুতাওয়ালা পার্টি না?
'আপনার টাকা নিয়ে এসেছি৷
ম্যানেজার বিষ্মিত হলেন৷
'আমি আপনার কাছ থেকে গতকালের বিল নিব না৷
'কেন?
'মালিকের পক্ষ থেকে একটা খয়রাতি বাজেট থাকে৷ গেঞ্জামে না গিয়ে কিছু পার্টিকে মাগনা খাইয়ে দেই৷ আপনারা মাস্তান লোকনা সেটা বুঝতে পেরেছিলাম৷ টাকার জন্য তাই জবরদস্তি করেছিলাম৷
'নেন টাকা নেন৷
ম্যানেজার টাকাটা কনকের হাতের দিকে সরিয়ে দিলেন৷ 'টাকা নিতে চাচ্ছি না কেন জানেন?
'কেন?
'আপনাকে আমার খুব ভালো লাগলো৷
'ধন্যবাদ৷
'আপনার নাম যেন কি ভাইয়া?
'রাতুল আহমেদ কনক৷
'আপনার বন্ধুটি কোথায়?
'জানি না৷
'কনক সাহেব, আপনাদের পকেটে যদি টাকা না থাকে এবং মন যদি সত্যিই চায়নীজ খেতে চায় সরাসরি এখানে চলে আসবেন৷
'খুশী হলাম৷
আর কখনো ওদের ঐ রেষ্টুরেন্টে চায়নীজ খেতে যাওয়া হয়নি৷
'ক্যাশের টেবিলে জুতা'র ঐ ঘটনা কথা কনক ভুলতে পারেনা৷
আজকে কোন অবাঞ্জিত ঘটনা ঘটেনি৷ সব ঠিকঠাক ছিল৷ হান্নান বসের পকেটে সত্যিই টাকা ছিল৷
গুড ফরচুন!

কনকবাদে সবাই এজিএম হান্নানের সাথে যার যার উদ্দেশে চলে গেছে৷

লাঞ্চ করে কনক আজ আর এজিএম হান্নানের গাড়িতে উঠেনি৷ রেষ্টুরেন্ট থেকে পায়ে হেটে বেরুল৷ হাটতে হাটতে সে একটা দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়াল৷
দেয়ালে বাগান বিলাসের গাছ৷ স্থানে স্থানে বাগান বিলাসের ঝুপরি দেয়ালের বাইরে চলে এসেছে৷ কনক নীচে এসে দাঁড়াল৷ পুরো শরীরে ছায়া ফেলা সম্ভব না৷ সে মুখমন্ডলের উপর ঝুপড়ির ছায়া রাখলো৷
একটু ঝিমিয়ে নিতে পারলে ভালো হতো৷ ব্যস্ত রাস্তায় ঝিমুনের জায়গা কোথায়?
সে ঝিমুতে পারল না৷
কনক একধ্যানে উপরে তাকিয়ে তাপ-ঢেউয়ের খেলা দেখতে থাকলো৷ শুণ্যে তাপের ঢেউ উঠানামা করছে৷ আলো থেকে তাপ নিয়ে বাতাস যদি রং ধারন করতো- আকাশে অসংখ্য রঙের ঢেউ বইতো! কেমন লাগতো? বেষ্টনী দেয়ালে ঠেস দিয়ে কনক কথাগুলো ভাবতে থাকে৷
'আচ্ছা আমি এগুলো ভাবছি কেন?
তার মন আবার অন্য কোথাও হারিয়ে গেল৷
মানুষকে একটা অসীম শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে৷ এই শক্তিটা হলো তার চিন্তা শক্তি৷ মানুষ এটা ব্যবহার করে জীবনের গন্তব্যে পেঁৗছার চেষ্টা করে৷ কেউ পথিমধ্যে এসে বাকী পথটা আর চলতে পারে না কেউবা পারার ইচ্ছেও পোষণ করে না৷ জীবন যেমন চলে তেমনি চলতে দেয়৷
কনক কারো সাথে বসে যেন তার জীবনের হিসেব কষতে শুরু করলো৷ 'কারো' টা কে?
'কারো' টা হলো আমি৷
'আমি কে?
'আমি ঘটনা৷ আমার অন্য নাম সময়৷
'সময়?
'হঁ্যা৷
'সময় বলতো, হিসাব অনুযায়ী জীবন চলে?
'জীবনে কিছুকিছু সময় আসে যখন কোন কিছুর হিসেব মিলে না৷ যেমন এখন হৃদি এসেছে! হিসেব মিলিয়ে দেখ্! কিছু মিলে?
'এই সময় তুই আসিস কেন?
'আমাকে দোষ দিচ্ছিস কেন? তুই চাচ্ছিস তাই আমি আসি৷ আসলে তুই-ই আমি আমি-ই তুই৷ বলতো, প্রতিজনের মধ্যে দু'জন করে বাস করে, সে কোন্ প্রাণী?
কনক বলল, 'সে এই মানুষ প্রাণী৷

কনক নিজে নিজে হাসে৷ ওর সহপাঠি হ্নদি এমন একটি ঘটনা এমন একটি বিষয় যা ওকে জড়িয়ে ধরতে আসছে৷ তাপ ঢেউয়ের খেলা দেখতে দেখতে কনক- হ্নদির কথা ভাবছে৷ হ্নদিকে দেখলে ভাল লাগে৷ অসম্ভব ভালো লাগে৷ যেন তাকে দেখার জন্যই কনক প্রহর গুণছিল৷ হ্নদি চোখের সামনে থেকে চলে গেলে বিষন্নতায় তার মনটা ছেঁয়ে যায়৷ মনের একি খেলা?

হৃদির শ্বাশুড়ী ইশতান্না বেগমের বাড়িটা পাঁচতলা৷ হৃদি-অমা'রা পাঁচতালায় থাকে৷ পাঁচতলা-বাড়ির মালিক হয়ে ক'জন পাঁচতলায় থাকেন? শতকরা নিরানব্বই ভাগ মালিকরা দু'তালায় থাকেন৷ ইশতান্না বেগম তা-ই চাইতেন৷ একটা বিশেষ পরিস্থিতির জন্য তাঁকে পাঁচতালায় উঠতে হয়েছে৷ নিজের জমি নিজের জায়গা৷ বাসার ভিতর থেকেও শান্তি নেই৷
সকাল সাতটা থেকে দুপুর দু'টা পর্যন্ত প্রতিদিন পঙ্গপালর আক্রমন করে৷ পঙ্গপালরা হলো একদল হকার৷ তাদের গলা শুনতে হয়ঃ
'এই...তর..কা..রী!
'এই...আদা.. রসুন.. পেয়াজ!

'এ..ই গুড়া..মাছ!!
'এই মুরগী!!!
লেটেষ্ট এডিশন হল- নতুন এক মহিলা হকারের ডাক, 'এই...ছাই, কালো ছাই!!!!

ঝিঁঝিঁ পোকার চিঁচিঁ করা চিকন কন্ঠটা ভুল করে এই মহিলা হকারের গলায় চলে এসেছে৷
মাঝে মাঝে তিনচার জন হকার এক সাথে মরিয়া হয়ে চিত্‍কার দিয়ে উঠে৷ শুনো! শুনো, আমারটা আগে শুনো৷ আমারটা আগে খাও!
নতুন করে আরো একটা যন্ত্রনাদায়ক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে৷ এক বাসার পর একজন প্রতিবেশী রেন্টাল ভিডিওর দোকান দিয়ে বসেছে৷ তার দু'পাশে দু'টা চারশ আশি ওয়াটের স্পীকার৷ ওরা শুধু নিজেরাই গান শুনে না৷ আশপাশের সবাইকে গান শুনতে বাধ্য করে৷ দু'তালায় অমার পড়াশুনার দারুন ডিষ্টার্ব হয়৷
অমার ধৈর্যের বাধ একদিন ভেঙ্গে যায়৷
সে রেগে ইশতান্না বেগমকে গিয়ে বলল, 'আম্মা তুমি নীচে গিয়ে ঐ লোকদের লো ভলিয়ু্যমে গান বাজাতে বলে এসো৷ ইশতান্না বেগম আকাশ থেকে পরলেন৷
'আমি ঐ অসভ্যদের সাথে তর্ক করতে যাব?
'তাহলে আমি যাব?
'তোর যাওয়ার দরকার নেই', বলে ইশতান্না বেগম উল্টো শাসনের সুরে তাঁর মেয়েকে বললেন,
'অমা গোন্ডগোলের ভিতর থাকার অভ্যাস কর৷ লেদ মেশিনের শব্দের ভিতর মানুষ ঘুমাচ্ছে না?
'আম্মা লেদ মেশিনের শব্দের ভিতর মানুষ ঘুমাতে পারে কিন্তু পড়ালেখা করতে পারে না৷
'পড়ালেখা করতে পারার অভ্যাস কর৷
'সাউন্ড পলিউশন খুব ভীতিকর ব্যাপার তা তোমাকে কতবার বুঝাবো? হাসপাতালে উঁচু কণ্ঠে কথা বললে রোগী রোগীকে চাকু দিয়ে খুন করে ফেলে! ইশতান্না বেগমের চোখ কপালে উঠে গেছে৷
'তুই কি চাস্ আমি সবজি কাটার ছুরি নিয়ে এবয়সে ওদের দিকে তেড়ে যাই?
'আমি তাই মীন করেছি?
'তুই কি মীন করেছিস্?
'যাও ওদেরকে বলে এসোনা, প্লীজ৷

গান তো খোলা মঞ্চে হচ্ছে না৷ ঘরে বসে গান নিজেকে শোনতে হয়৷ অপরকে জোর করে শুনানোর সুযোগ নেই৷ ইশতান্না বেগম থানায় ফোন করেছিলেন৷ ফোন করে লাভ হয়নি৷ থানা থেকে বলে দেয়া হয়েছে, 'কি আর করবেন? ধৈর্য ধরে যেমন আছেন তেমনি থাকুন! অর্থ্যাত্‍ হাই ভলিয়ু্যমে গান শুনুন৷
এরকম একটা সিরিয়াস সমস্যার সমাধান হলো না৷
অমা তার বড় ভাই ইশমাম কে বলল, 'ভাইয়া ভিডিও দোকানের লোকজন আমার পড়ালেখার খুব ডিষ্টার্ব করছে৷
'তাই নাকি?
'তাই নাকি মানে! ভাইয়া তুমি ওদের গানের শব্দ শুনো না?
'শুনি!
'ওদেরকে গান থামাতে বলে এসো৷
হৃষ্টপুষ্ট স্বাস্থবান ভাই থাকলে ছোট বোনদের সাহসের মাত্রা একটু উচুতে থাকে৷ অমা অনেক আশা নিয়ে বললেও ইশমাম বললেন, 'ওদের সাথে পারব না৷ বরং তুই এক কাজ কর৷
'কি করব?
'তোর কানকে সেইফ করে চল৷ সাউন্ড তোর কানে যাবে না৷
অমা আশা করেনি তিনি এ ধরনের একটা সমাধান দেবেন৷
সে কপাল ভাজ করে বলল, 'ভাইয়া তুমি যে কি ব..লো...?
'সিরিয়াসলী বললাম৷ সাউন্ড প্রটেক্ট করার জন্য ইয়ার র্কক (বধত্‍ পড়ত্‍শ) বা কানের ছিপি পাওয়া যায়৷ শুধু রোগীরাই না৷ উচ্চ সাউন্ড সেন্সেটিভ সুস্থ লোকরাও এটা ব্যবহার করতে পারে৷ যদি চাস আমি ইতমামকে বলে ব্যাংকক থেকে আনিয়ে দিতে পারি৷
'আচ্ছা ঠিক আছে৷ তুমি এখন গিয়ে একটু বলে এসো না?
ইশমাম আস্তে করে নিষপ্রাণ গলায় বলল, 'এখন পারব না৷ আগামীকালও পারব না৷ কোনদিন-ই পারব না৷

ইতমাম ব্যাংকক থেকে ইয়ার কর্ক পাঠাল৷ ভিডিওর দোকানের অত্যাচার থেকে মনে হয় বাঁচা গেল! সবাইকে ইয়ারকর্ক কানে লাগাতে বলা হলো৷ কেউ অমার কথা শোনেনি৷ শুধু তার মা ইশতান্না বেগম ছাড়া৷ ইয়ার কর্ক মা-বেটির কথা বলার বা শোনার ক্ষেত্রে নতুন এক অভিনব সমস্যার সৃষ্টি করল৷ কেউ কারো কথা স্পষ্ট করে শুনতে পায় না৷ মনে হয় কানে তালা লাগানে হয়েছে৷ দুনিয়াটাকে স্তব্ধ মনে হয়৷ ইশতান্না বেগম যদি বলেন, 'মা, অমা শুনে যাবি? অমা শুনতে পায়, 'অমা শুতে যাবি? 'ন' আর 'ত'-র লিসেনিংএ ভীষন সমস্যা হলো৷ আরো কিছু বিশ্রী ঘটনা ঘটেছিল৷ ইয়ারকর্ক শব্দের ইনটেনসিটি কমিয়ে দেয়৷ এক শব্দকে অন্য শব্দে রুপান্তরিত করতে পারার কথা নয়৷ অথচ তাই হচ্ছে৷ ধ্যেত্‍তেরি তোর এয়ার কর্ক! ইশতান্না বেগম এগুলো ফেলে দিলেন৷

অমার কথা হলো ----- ঢাকা শহরে ভূপৃষ্ঠ থেকে যত উপরে থাকা যায় ঝুট ঝামেলা ততো কম পোহাতে হয়৷ তখন থেকেই ইশমাম-ইভারা চার তালার এক ফ্লাট নিয়ে থাকছেন৷ হৃদি, অমা এবং ইশতান্না বেগম থাকছেন পাঁচতালায়৷ পাঁচতালায় এক ফ্লাট৷ বাকী অর্ধেকটা খালি, চার তালার ছাদ৷ ইতমাম বিয়ে করেছে এই পাঁচতালাতেই৷ পাঁচতালার ঘরগুলো গরমে আগুন হয়ে থাকে৷ এসি লাগানো হয়েছে৷

পাঁচতালার সামনের খোলা যায়গাটা অফহোয়াইট কালারের ষ্টীলের গ্রীল দিয়ে ঘেরা৷ খালি জায়গাটা জুড়ে অমা বাগান সাজিয়েছে৷ বিকেলে আড্ডা করে চা খাওয়া হয়৷ ওদের পছন্দের ফুল বুঁনোফুলের শংকর-- ক্যাসাব্ল্যান্কা৷ ইতমাম থাইল্যান্ড থেকে ফুলের চারা পাঠিয়েছিল৷ শীত-গ্রীষ্ম সব দেশেই জন্মায়৷ টবে টবে গঁজিয়েছে৷ বৃষ্টির পরে ক্যাসাব্ল্যান্কার সুগন্ধ ওদের ঘর ভরিয়ে দেয়৷ অমা একই ঘরে হৃদির সাথে ঘুমায় এবং পড়ালেখাও করে থাকে৷

হৃদি-অমা ইউনিভার্সিটি থেকে এসে দুপুরের খাবার খেল৷
হৃদির হাতে ক্লাসের লেকচার নোট৷ সে তাতে চোখ বুলাচ্ছে৷ অমা কাত হয়ে পাশে শু'য়ে আছে৷ তার হাতে ছোট ছোট অক্ষরের ডিকশিনারী সাইজের ইন্ডিয়ান বাংলা উপন্যাসের বই৷ অমার চোখ ঘুমে ছেপে ধরেছে কুয়াসা যেমন ধরে পর্বতের শীর্ষকে৷ ঘুমই মরন৷ মরনই ঘুম!
অমার ঘুমের অষুধ যেন বড় বড় উপন্যাসের বই৷ উপন্যাসের চরিত্রের সংখ্যা যতবেশী ওর ঘুমের গতিবেগ ততবেশী৷ খাওয়ার পরে হলে আরো সমস্যা৷ ব্রেইনে রক্ত কমে গিয়ে ষ্টমাকে বেড়ে যায়৷ লাঞ্চের পর এজন্যই মানুষের পারফরমেন্স ড্রপ করে৷ সেটা পড়ালেখায় হোক অন্য কোন কাজেই হোক৷
দীর্ঘসময় ধরে তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণের জন্য নিউরনের উত্তেজনাকে ক্রিয়াশীল করে রাখা হলো এল.টি.পি. (লং টার্ম পটেনশিয়েশন)৷ এল.টি.পি কমলে রেফারেনস মিমোরী কমে যায়৷ রেফারেন্স মিমোরী কমা মানে আগে যা পড়া ছিল ভুলে যাওয়া৷ রেফারেন্স মিমোরী পাখীদের খুবই ষ্ট্রং৷ এই মিমোরীর জন্য-ই সাইরেরিয়া থেকে আসা অতিথি পাখীরা গুলিস্তানের জাতীয় ষ্টেডিয়ামে না বসে প্রতি বছর জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকে বসে৷
অমা ঘুমিয়ে গেছে৷ হৃদির ঘুম আসে না৷ ঘুমাতে পারলে সময় কাটত৷ এম.ফিল.এ ভর্তি হওয়ার আগে হৃদির সময় কাটানো খুবই মনঃকষ্টের ব্যাপার ছিল৷ সময় কাটানোর সমস্যাটা কিছুটা কেটেছে৷
নতুন করে আর একটা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে৷ ইতমাম চেপ্টার তাকে নতুন করে তাঁড়িয়ে বেড়াচ্ছে৷ ব্যাংককে কি হয়েছিল? ব্যাংককে এখন কি হচ্ছে?
হৃদির চোখ শূণ্যে হারিয়ে গেল৷
নাইট ক্লাব৷ ওর সাথে ইতমাম৷ ভালো লাগছে না৷ হৃদি ক্লাবের দেয়াল ঘেষে চেয়ারে বসে রইল৷ মানুষে ঘর ভরে যাচ্ছে৷ সাদাকালো জীবনকে রঙীন করার জন্যই নাকি এখানে আসা? ইতমাম উঠে দাঁড়াল৷ সে এবার একজনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল৷ সে-ই বলে সে সবার হাত ধরে না৷ নাইট ক্লাবের এই 'একজন'টার শরীরের জোয়ার যে কোন নিষ্কাম পুরুষকেই দুমড়ে মুষরে দিবে৷ আর ইতমাম! এমনি নাচে, তার উপর ঢোলের বারি!
ইতমাম বলল, 'আপনার হাত দেখব৷
মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিল৷ ইতমাম মেয়েটির হাত দেখল৷ উল্টায়ে-পাল্টায়ে দেখল৷ নরম হাত৷ কলার মত তার হাতের আংগুল৷
'আরে? আপনার হাততো সার্জনের হাত?
নরম কলার মত আংগুল হলে সার্জনের হাত হয়? পৃথিবীতে কত জন সার্জনের হাতের আংগুল কলার মত? মেয়ে সার্জনের হাত-আঙ্গুল দেখার পর ইতমাম বলল,
'আপনার প্রথম সন্তান ছেলে হবে৷ ইট'স এন ইনজয়েব্যল ইভেন্ট৷ সো লেটস্ ড্যান্স৷

হৃদি শুধু দেখছে! শব্দ করছে না৷ যা করতে ওর মন চাইল তা হলো-হোটেলের ফ্যামিলি রুমে ফিরে গিয়ে ওটার বড় জানালা দিয়ে নীচে ঝাঁপ মেরে ম্যারিয়টের ডায়মন্ডের প্রায়শ্চিত্য করতে৷ ইতমাম তার দিকে তাাকাল৷ আমি হাসছি৷ মনের ভিতর আগুনের স্ফুলিংগ৷ আগুনের স্ফুলিংগ-হাসি৷ উজ্জল আলো নিভে গেল৷ উজ্জল আলো নিভে গেলে ঘর নিকষ কালো হয়৷ কয়েক মুহুর্তে নিজের হাত নিজের কাছেও অস্পষ্ট লাগে৷ অনুজ্জ্বল লাল নীল আলো জ্বলে উঠেছে৷ ড্রিংকিং ক্লাব খেলায় জমে উঠল৷
হৃদি পাশে ঘুমন্ত অমার দিকে ফিরে তাকালো৷ অমার শ্রান্তির ঘুম ঘুমুচ্ছে৷ হৃদির বুক ফোলে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বেরুলো৷ সে যাত্রাবাড়ীর আকাশের দিকে তাকাতেই দু'চোখ আবার বন্ধ হয়ে গেল৷
আবার সেই ড্রিংকিং বার! এ এক অন্য পৃথিবী! লাল নীল সবুজ বেগুনী আলোয় রহস্যে ভরা ঘর৷ সিডিতে সেলিন ডিওনের গান বাঁজছে.. জবধষ বসড়ঃরড়হ৷ গান না চিত্‍কার! কিন্তু ওগুলো হচ্ছে..
ণড়ঁ ফড়হড়ঃ যধাব ঃড় মরাব সব ত্‍রহমং ড়হ সু ভরহমবত্‍ং
চত্‍ড়সরংব সব ঃযব সড়ড়হ ধহফ ংঃধত্‍ং রহ ঃযব ংশু
ঙত্‍ নত্‍রহম সব ত্‍ড়ংবং লঁংঃ ঃড় ংযড় িসব ুড়ঁ ষড়াব সব
ঞযধঃ ধরহ্থঃ মড়হহধ রিহ ঃযরং যবধত্‍ঃ ড়ভ সরহব

বিশপঁচিশটা পেয়ারের সাথে ইতমামও উঠে দাঁড়িয়েছে৷ ইতমামের বুকের কাছে মেয়েটার বুক মুখ৷ একজনের উষ্ণ নিঃশ্বাস আর একজনেরটার সাথে শ শ করে মিশে যাচ্ছে৷ ওর ডান হাত মেয়েটার বাম হাতে৷ বাম হাত মেয়েটার মাঁজার পিছন থেকে পেঁচিয়ে আছে৷ মাজা পেঁচিয়ে থাকা হাতটা কোন কিছুকে আক্রমন করার জন্য ওঁত পেতে অপেক্ষা করছে৷ জবধষ বসড়ঃরড়হ, রাত গভীর হচ্ছে৷ নাচো! নাচো!! ইতমামের পেঁচানো হাত খুলে খুলে যাচ্ছে৷ এক সময় মেয়েটার বিশেষ জায়গায় তার হাতের অনুপ্রবেশ ঘটল! হস্তরেখা দেখার নাম করে যে মেয়েটার হাত ধরা হয়েছিল তার বুকের উপর সেই পামিষ্টের হাত! 'দে ক্যান টাচ ইউ, ইউ ক্যান নট টাচ দেম', বারের এই নীতিকথা গুলো কাজে লাগছে না৷

পামিষ্ট ইতমাম গলা পর্যন্ত মদ গিলেছে৷ নাচছে৷ বলছে, 'হৃদি নাও, গ্লাস নাও! নাচো! তোমাকে কন্ডিশনিং করার জন্যই আমার এখানে আসা! এগুলো দেখা যায়? যারা দেখে দেখুক! ------ এ দৃশ্য দেখার জন্যই সারা জনম এই মহাপুরুষকে খুঁজেছিলাম!!

হৃদি তার মাথাটা ঝাঁকি দিল৷ মন শিউরে উঠে বুক থেকে আরো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুল৷ অজান্তে প্রশ্ন জেগে উঠে শেফিল্ডে জন্ম নিয়ে ইংল্যান্ডে না থেকে ভুল করা হয়েছিল৷

বন্ধচোখে বার বার তার মনে একটা প্রশ্ন জেগে উঠে,
'মানুষকে জোড় করে সৃষ্টি করা হয়? আমি একা? আমার জন্য কেউ আছে! আছে?
'কহে না কহে'- কনক৷ হৃদির ভিতরে আসে 'কহে না কহে'৷ কনককে ওর যতটা অপছন্দ হয়, মুহূর্তেই তার চেয়ে দ্বিগুণবেগে পছন্দ হয়৷ মনের এ কোন্ খেলা?

কনক হাজতে ঢূকেছিল৷ তাতে আমার কি? কিন্তু খবরটা শুনার সাথে সাথে বুক ফেটে কান্না চলে এলো কেন? চোখ ছেপে এতো পানি এলো কেন? ভ্যানিজিয়া বলেছিল, হৃদি চোখের পানি আর ভালবাসা হলো সমার্থক৷ তোর চোখ থেকে ওগুলো ভালবাসা বের হয়৷ থাইল্যান্ডের জন্য মন কাঁদে এক অর্থে আর কহে না কহে'র জন্য মন কাঁদে এক অর্থে৷ দুই অর্থ-ই তুই বুঝিস৷ তোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সিদ্ধ-বন্ধনে ভেলায় চড়ে শুধু বিষ খেয়ে বেড়াবি? নাকি অসিদ্ধ বন্ধনের সূতোয় বাঁধা কাউকে কাছে টেনে বুকে নিবি৷ জীবন তো বার বার আসে না? না কি আসে?
অনেকক্ষন হলো হৃদি চোখ বন্ধ করে আছে৷ চোখ মেলে যখন তাঁকাল তখন সে বুঝলো তার চোখ ভিজে উঠেছে৷ জীবনের হিসেব কোথায় মিলে?
হৃদি বিছানা থেকে উঠে বেসিনে হাতমুখ ধোঁয়ে এলো৷

অমা ঘুম থেকে জেগে উঠল সাড়ে পাঁচটায়৷ শিশু চিত্‍কার দিয়ে ঘুম থেকে উঠে (ক্ষুধা বা নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে)৷ বড়রা ঘুম ভাংগার সাথে সাথে শব্দ করে না৷ তারা কিছুটা সময় নেয়৷ অমা ঘুম থেকে উঠে চুপচাপ জানালায় বাইরে তাকিয়ে রইল৷ তার চোখও উদাসীন৷
ক্যামেরার ছবি বন্দী হয় ফিল্মে৷ মানুষের চোখ একটা বিষ্ময়কর ক্যামেরা৷ জেলির মত লেন্স আর রেটিনার কিছু যন্ত্রাংশ দিয়ে ছবি তুলে চোখ সেটা পাঠিয়ে দেয় মস্তিষ্কের পিছনের দৃশ্যপটে (ারংঁধষ ভরবষফ)৷ ওখানেই প্রিয় মুখটির ছবি বন্দী হয়ে থাকে৷ যে যতদিন চা'বে সে ছবি তত দিন ওখানে থাকবে৷ স্পষ্ট করে থাকবে৷ না চাইলে ওখান থেকে মুছে যাবে৷
ঈশ্বর কোন 'কাজ' সৃষ্টি করেন নি যেটা 'ভালোবাসা'র চেয়ে কাউকে বেশী অনভূতিশীল করে তুলে৷ শূণ্য ভালোবাসা (ঊসঢ়ঃু ষড়াব)-য় যেখানে প্রতিশ্রুতি আছে কিন্তু ইন্টিমেসী নেই সেখানে কি এই অনভূতি বেশী কাজ করে? মাসখানেক হলো অমার এমন হয়েছে৷ সারাবেলা একটা বিশেষ অনভূতি তার মনের মধ্যে কুঁড়ে কুঁড়ে কাজ করে৷ সবসময় সবদিকে একটা ছবি দেখা যায়- আকাশে ঘরে বাইরে ড্রয়িংরুমে দেয়ালে জানালায় বইয়ের পাতায়৷
অদ্ভুত! অদ্ভুত হলেও সত্যি৷ সংগোপনে রাশুর মুখচ্ছবিটি তার মস্তিষ্কের দৃশ্যপটে নিয়ত ভেসে উঠছে৷ অমার মনে হচ্ছে সেটা তার প্রিয় ভাবী হৃদির অজান্তে-ই৷

বাইর থেকে উদাসীন দৃষ্টি ফিরিয়ে হৃদির দিকে তাঁকাতেই সে জিগ্যাস করল,
'কি ঘুম হলো ?
'হঁ্যা ভাবী৷
হৃদি তখন খাটে দু'পা মুড়ে সাথের টেবিলে একটা বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে৷ বইয়ের পাতা উল্টালেও মনের চোখটি এতক্ষন ধরা ছিল ব্যাংককের ইতমাম-চেপ্টার দিকে৷ হৃদির ভাষায়- এ ন্যাষ্টি ভিশন ইন হার ভিশন ফিল্ড৷
সিড়িতে খটখট করে জুতার হাইহিলের শব্দ হচ্ছে৷ ইভা উপরে আসছেন৷ তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাস করলেন, 'বাইরে যাচ্ছি, অমা বাইরে যাবে?
'না৷
'কিছু লাগবে?
'হঁ্যা৷ আমার জন্য একটা রেভলন লিপষ্টিক নিয়ে এস৷
'কালার?
'মেরুন৷
তিনি হৃদির দিকে তাঁকালেন৷
'হৃদি তোমার কিছু?
'না৷ ভাবী থ্যাংক ইউ৷
অমা ইভাকে জিজাস করল, 'ভাবী চা খেয়ে যাবে না?
'না৷ তাড়া আছে৷ তোমরা খাও৷
ইভা খট্খট্ করে নীচে নেমে এলেন৷

অমা হৃদিকে বলল, 'ভাবী উঠ চা খাব৷
'বুয়াকে এখানেই কিছু নিয়ে আসতে বলব৷ আজ ছাদে যাব না৷
'ভাবী প্লীজ বাইরে চল না? রোদটা ভাল মনে হচ্ছে৷ বাইরের ক্যাসাব্ল্যান্কার বাগানে-ই চা খাই৷ আজকে কি গরম ছিল না?
অমা কোন ব্যাপারে সাধারনত জোরাজোরি করেনা৷ যেদিন করে সেদিন নির্দিষ্ট একটা উদ্দেশ্য নিয়ে করে৷ ইচ্ছে না থাকা সত্বেও সে বলল, 'আচ্ছা, চলো তোমার বাগানে-ই চা খাব৷
'ভাবী এসো৷
অমা আর হৃদি ছাদের ক্যাসাব্ল্যান্কার টব-বাগানের চায়ের টেবিলে এসে বসল৷ বুয়া চায়ের সাথে দু'টা ডোনাট আর পিরিজে কিছু কর্নফ্লেক্স দিয়ে গেছে৷

ডোনাটে কামড় দিতে দিতে অমার মুখ থেকে যে বাক্যটি প্রথম বেরুল তা হলো, 'ভাবী তোমার ক্লাসমেটগুলো তো খুব ভদ্র!
'হঠাত্‍ ক্লাসমেটদের নিয়ে কথা কেন? অমা চা খাবে কিছু বলবে কিন্তু ক্লাসমেটদের নিয়ে কথা তুলবে এটা হৃদি আশা করেনি৷ অমা কোন্ উদ্দেশ্যে এটা বলল? সে মনে মনে আশ্চযর্্য হল৷
অজানা আশংকায় হৃদির বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসও বেরুল,
'আমার ক্লাসমেটগুলো ভদ্র, কিভাবে বুঝলে?
'দেখে তাই মনে হয়৷
'আমি সাত-আট মাস হল ওদের সাথে ক্লাস করছি৷ আমি এখনো বুঝতে পারছিনে? এত দু্রত তুমি কিভাবে বুঝলে?
'মর্নিং শোস দা ডেস৷
'পূর্বাভাস ছাড়াই দুপুরে সাইক্লোন শুরু হয়ে যেতে পারে৷ পারে না?
'ভাবী সে তো ব্যতিক্রম৷
'ব্যতিক্রমের ভোরটা যদি শুরু হয় তোমার জীবনের প্রথম ভোরটা দিয়ে?
'তাহলে তো নরকবাস!
'আমার ক্লাসমেটগুলো নিয়ে অমার ইন্টারেষ্ট কেন? সে এবার উূয়ূ করে কেশে নিয়ে শব্দ করে বলল, 'অমা, ওদের পাশে ইতমামকে দাঁড় করালে কা'কে সবচেয়ে আইডিয়াল মনে হবে?
'নো ডাউট, আমার ভাইয়াকে! অমার চোখেমুখে অগাধ আত্মবিশ্বাস৷
'তাই নাকি?
'অবশ্যই৷
'ভাবী তোমার এসেসমেন্ট কি ভুল ছিল?

'ব্যাংককের ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর৷ জিন্সের হাফ প্যান্ট টি-শার্ট পরা একদল মেয়ে ইন্টারটেইনার৷ ইতমাম ট্রলি থেকে শপিং বাস্কেট হাতে নিয়ে ওদের পিছু নিল৷
'এই হড়্ হড়্ করে কই যাচ্ছ?
ইতমাম একটা ঘটনা ঘটালো! চোখকে বিশ্বাস করা যায় না? মানুষ বাড়ছে৷ ইন্টারএকশন বাড়বে৷ এসব নস্যি৷ টেক ইট ইজি! হৃদির মাথায় ছাদ ভেংগে পড়ল ইতমামের টেক ইট ইজি শুনে৷ তার বোনকে ঘটনাটা শুনাবো? আত্মবিশ্বাসের পাহারটা এখনই ধ্বসে পরবে৷ অমা থাকুক না তার আইডিয়াল ভাইকে নিয়ে!
'ভাবী কি ভাবছ?
হৃদি কোথা থেকে যেন ফিরে এলো৷ সম্বিত্‍ পেয়ে সে বলল, 'কিভাবে তুমি-আমি বুঝব আমরা চোখে যা দেখছি তা সত্যি? নিজের চোখও তো বিশ্বাস করা যায় না৷
অমা বলল, 'নিজের চোখকে অবিশ্বাস করা যায়?
'একটা এক্সপারিমেন্ট করে দেখ না ভাই? কাগজ কলম নিয়ে এসো৷
অমা ভিতর থেকে দেঁৗড়ে কাগজ কলম নিয়ে এলো৷
হৃদি বলল, 'দুই ইঞ্চি একটা লম্বা দাগ টানো৷ অমার মুখে হাসির চ্ছটা৷
'হুয়ু, ভাবী টেনেছি৷
'এবার এই লাইনটার একদম মাঝখান দিয়ে দুই ইঞ্চি একটা খাড়া দাগ টানো৷ টেনেছো? এবার লাইন দু'টার দিকে তাঁকিয়ে দেখো৷ লাইন দু'টার দৈর্ঘ্য সমান হওয়া সত্বেও বাস্তবে সমান লাগছে না৷ লাগছে?
অমা টি-আকারের লাইন দু'টার দিকে তাঁকিয়ে বলল, 'অদ্ভুত তো! ভাবী, তুমি তো যাদু দেখালে?
'অদ্ভুত তো বটেই! নিজের চোখকে সবসময় বিশ্বাস করা যায়?
'ভাবী তুমি কি ভাইয়াকে এখনও বুঝনি? অমা প্রশ্নের সুরে জানতে চাইল৷ হৃদি অমার প্রশ্ন এড়িয়ে গেল৷
'ইতমাম সম্পর্কে তোমার, ভাবীর, ভাইয়ার, আম্মার কি এসেসমেন্ট ছিল? এ মানুষগুলো চারদিকের মানুষগুলোর বিশ্বাসের খাদে নোঙর গেরে যাচ্ছে তা-ই করতে চায়৷ এরা মিনকা শয়তান৷ সরি কথাগুলো এভাবে বলার জন্য৷
হৃদি বেশ সিরিয়াস মুডে কথাগুলো বলল৷ এভাবে বললে চা খাওয়ার পর্বটা নিঃরস ভাবে মাঠে মারা যাবে৷ অমার মনে কষ্ট লাগতে পারে৷
'অমা কি বলতে চাচ্ছে আগে সেটা শুনা যাক৷
হৃদি ওর গালে টোল পড়া হাসি তুলল৷ অমার থুতনিতে বাম হাতে এগিয়ে দিয়ে একটু নাড়িয়ে বলল, 'তোমার ভাইয়াকে নিয়ে কথা বললাম, অমা মাইন্ড করলে?
'ভাবী না৷
'ভাইয়ার চেয়ে আমি তোমাকেই বেশী পছন্দ করি! সেটা অস্বীকার করতে পারবে?
'অমা, পুরুষরা বিয়ের আগে ভাব নেয়৷ সে যদি হ্যান্ডসাম হয় তো কথাই নেই৷ ভিতরের কুত্‍সিত রূপতো দেখা যায় না? এরা ভাল ছাত্র হলে আরও প্লাস পয়েন্ট৷ গল্প উপন্যাসে পড়না? এই ধরনের চরিত্রগুলো খুব ইন্টারেষ্টিং হয়?
অমা হৃদির কথাগুলো মন দিয়ে শুনল৷ যাকে ভাল লাগে তার কথাগুলোকে জীবনের মাইল ফলক মনে হয়৷ আরো এক মাইল! আরো! আরো!! তারপর গন্তব্যে৷
'অমা, চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷ চায়ে চুমক দিচ্ছ না যে?
অমা আনমনা ভাব থেকে ফিরে এল৷

ভাবী-ননদ চা খাচ্ছে৷ এটা সিরিয়াস কোন ব্যাপার না৷ অথচ পরিবেশটা এমন যেন দু'জনই অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে৷ কিন্তু বলা হচ্ছে না৷ অব্যক্ততার ছাপ দু'জনের চোখে মুখেই৷
'হুঁ, বলে অমা ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিল৷
'অমা তুমি কিছু বলবে না?
'না৷
হৃদি একটু মুচকি হাসল৷
'অমা মিথ্যে বলছ কেন? তোমাকে আমি রিড করে ফেলেছি৷
'কি রিড করেছ? মিলে গেলে স্বীকার করব৷ বলো৷
'চিমটি দিবে না কিন্তু! তোমার চিমটিতে চামরা ছিঁড়ে যায়!
'চিমটি দেব না৷ বলো৷
'আমার ক্লাসমেট রাশুকে তুমি ভালবাস৷
অমার মনের মধ্যে একটা রিনঝিন শব্দ হলো৷ সে মাথা নীচু করে 'হঁ্যা' সূচক ঘাড় ঝাঁকাল৷ ভালোবাসার কথা ভাষায় বলতে হয় না৷ ভালোবাসা নিজেই একটা ভাষা৷
হৃদি জিজ্ঞাস করল, 'ফার্ষ্ট সাইটে-ই?
গত কয়েকমাস ধরে অমা রাশুকে দেখছে মামুর দোকানে বেঞ্চে বসে থাকতে৷ দেখেছে একটা মাত্র জিন্সের প্যান্টে৷ সার্ট যদিও মাঝে মাঝে বদলানো থাকে৷ এক প্যান্ট-দুই সার্টের রাশুকে অমার মনে ধরেছে৷
'ডেটিং হয় নাকি?
'ভাবী কি যে বল না? এটা হলে তুমি-ই প্রথম জানতে পারবে৷
'এখন শুধু আমিই ভাবছি৷
'ওকে ভাল লাগল কেন?
অমা মাথা নীচু করে জবাব দিল, 'বলতে পারব না৷ তুমি সমর্থন করবে?
'অমা, ফার্ষ্ট সাইট ফার্ষ্ট লাভ এর ভালমন্দ বলতে পারব না৷ ডিসিশন হল তোমার৷
'ভাবী তোমার মতামত কি?
'আরো চিন্তা করে দেখ৷ ইতমামকে আমি ফার্ষ্ট সাইট-এই ভালবেসেছিলাম৷
অমা চোখেমুখে দুনিয়ার তাবত্‍ বিস্মিয় নিয়ে বলল, 'এ.. ফলস! কোনদিন বলনি তো?
'প্রেম কি বলার বিষয়?
'তাতো বুঝলাম৷
'বলো না? প্রথম কোথায় দেখা হয়েছিল তোমাদের?
'আকাশে৷
'ধ্যেত্‍, ভাবী ঢং কর না৷ সত্যি করে বলো তোমাদের কোথায় দেখা হয়েছিল? শপিং সেন্টারে? কারোর বিয়েতে? কখন? কবে?
'সত্যি আকাশে৷
হৃদি অন্যমনস্ক হয়ে গেল৷ বুক ফোলে উঠল দীর্ঘশ্বাসে৷
অমা আবার বিস্মিত হয়ে বলল, 'সত্যি..ই..ই!
'হঁ্যা, ইউনাইটেড ইয়ার লাইন্সের বিমানের ফ্লাইটে৷
অমা তার চেয়ারটা হৃদির কাছে টেনে নিয়ে একটু ঘেষে বসল৷ হাসল বেশক্ষণ৷
'ভাবী রিয়ালী ইনটারেষ্টিং! বলো না৷
দীর্ঘশ্বাসে হৃদির বুক আবার ফেঁপে উঠল৷
হৃদি এ অতীতটাকে টেনে হিচরে সামনে আনতে চায় না৷ নতুন করে মন খারাপ হয়৷ হৃদি-ইতমামের মাত্র ৬-৭ দিনের পরিচয়৷ কাছ থেকে দেখার বা বুঝার অবকাশ ছিল না৷ পাগলতো একজনকে হতেই হয়! সেটা আমিই হয়েছিলাম৷ অমা রাশুকে কাছ থেকে দেখবে জানবে বুঝবে৷ রাশু অসাধারণ ছেলে৷ সাদামাট সংসার৷ লাইফ ষ্টাইল সিম্প্যল৷ রঙীন জীবন তাকে হাত ছানি দেয় না৷
হৃদি অনেক্ষণ ডুবুডুবু সূর্যটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবল৷ ডুবুডুবু সূর্য অনেকের মনকে খারাপ করে দিয়ে যায়৷ কাল কি ভোর হবে? হলে কেমন ভোর?
অমা বলল, 'ভাবী খারাপ লাগলে বল না৷
'বলছি৷
'হোটেল মেনেজমেন্ট এর ইন্টারনেশনাল সেমিনারে আব্বা আমাকে সানফ্রানসিস্কো পাঠিয়েছিলেন৷
'এ ধরণের একটা কনফারেন্সে ভাইয়াও ব্যাংকক থেকে আমেরিকা গিয়েছিলেন৷
'আমি ঢাকা থেকে যাচ্ছি৷ ওয়েষ্ট কোষ্ট দিয়ে আমেরিকায় ঢুকছিলাম৷ জীবনের সবচেয়ে বরিং যাত্রা ছিল এটাই৷ আমাদের সাবকন্টিনেন্টের একজন যাত্রীও চোখে পড়েনি৷
'ইংল্যান্ডে তোমাদের বাসায় ট্রানজিট করে যেতে পারতে?
'হু৷
হৃদি মনে বলল, 'ও দিক দিয়ে গেলেই হয়তো বা ভাল করতাম৷ জীবনটা অন্য রকম হতে পারত! জীবনের কঠিন যাত্রা-ই যে আমেরিকার এপথের যাত্রা দিয়েই শুরু হবে তা কে জানতো? কথাগুলো হৃদি মনে ভেবে খুব কষ্ট পেল৷
'তারপর কি হল?
'বিমান যাচ্ছে যাচ্ছেতো যাচ্ছেই৷ যাত্রাটা অনন্ত মনে হলো৷ হাঁপুশ হুপুশ লাগছে৷ পথ শুধু শেষ হবার অপেক্ষা৷ হাত পা অবশ হয়ে আসছিল৷ এক সময় পেসেজ দিয়ে হেঁটে বিমানের টেইলে গিয়ে ছোট জানালায় বাইরে তাকিয়ে র'লাম৷ প্যাসিফিকের মেঘহীন নীল আকাশ৷ নীচের নীল সাগর খুব ভালো লাগছিল৷ যাত্রার ক্লান্তি কাটিয়ে মনটা সজীব হচ্ছিল৷
অমা খুব মনোযোগ দিয়ে হৃদির কথাগুলো শুনছে৷
'হঠাত্‍!
'হঠাত্‍ কি ভাবী?
'পিছনে একটা ডাক শুনলাম, এক্সকিউজ মি৷ ভেবেছিলাম কোন ওয়েটার অন্য কাউকে ডাকছেন৷
'আবার এক্সকিউজ মী! ইন্ডিয়ান স্বরের ইংলিশ৷ পিছন ফিরে তাঁকালাম৷ তোমার ভাইয়া ইতমাম৷ ওকে দেখার সাথে সাথে আমার ভালো লেগে গেল৷ খু-উ-ব ভালো লাগল৷ মনে হলো সারাজনম যাকে খুঁজছি আমার সেই স্বপ্নের রাজপুরুষকে আমি দেখছি৷ নীল প্রশান্ত'র নীচ থেকে নীল আকাশে এ জানালায় আমার ঠিকানায় উঠে এসেছে৷ ফর্াষ্ট সাইটে প্রেমে পড়ে গেলাম৷ তারপর কিভাবে জড়িয়ে গেলাম আমি নিজেও বুঝতে পারি নি৷

হৃদির চোখে পানি এসেছে৷ হৃদির কথা বলার ধরন আমার মনকে পীড়া দিল৷
'অমা, আমরা পরিচয়ের তিন মাস পর বিয়ে করে ফেললাম৷ অমা তোমার একটা কথা মনে আছে?
অমা ধীর গলায় জিজাস করল, 'কি কথা ভাবী?
'এ বাসায় আমি-ই প্রথম ফোন করেছিলাম তোমাদের সাথে পরিচিত হতে?
'হঁ্যা ভাবী, আমার মনে আছে৷ তোমার সে ফোনটা আমি রিসিভ করেছিলাম৷
'একজন অপরিচিতা হঠাত্‍ ধূমকেতুর মত কোত্থেকে কিভাবে উদয় হলাম তোমরা কিন্তু জানতে না! এখনও জান না৷
'হঁ্যা, আমরা জানতাম না৷ কেউ জানতে ইচ্ছে করিনি৷ আমরা শুধু চেয়েছি একজন ভাল মানুষ! একজন ভাল ভাবী!! একজন ভাল বধূ!!! এগুলোর সবগুলোই তুমি৷
'ভাবী?
'বলো৷
'তোমাদের বর্তমান সম্পর্ক দেখে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে৷ যদিও ব্যাপারটা তোমাদের ব্যক্তিগত৷

সূর্য যাত্রাবাড়ীর দিগন্তের নীচে নেমে গেছে৷ অমা-হৃদি কেউ কারোর মুখ স্পষ্ট করে দেখছে না৷ আবাসিক-অনাবাসিক যাত্রাবাড়ীর সব ঘরগুলোতে সান্ধ্যবাতি জেলে উঠছে৷ পানির উপর আলোর কিছুটা প্রতিফলন হয়৷ হৃদির চোখ চিকচিক করছে আলোর প্রতিফলন পড়ে৷
অমা প্রথম হৃদির কাছে তার ভালবাসার বিয়ের গল্প শুনল৷ অমা রাশুকে ভালবেসে ফেলেছে৷ পরাশ্রিত লতার মত অমা হৃদির কাঁধে মাথা রাখল৷ খাঁড়া পর্বতে ভর করে নীচে নামা লতানো নদীর মতো৷ সে কাঁধে মাথা রেখে আস্তে করে ডেকে বলল, 'ভা-বী৷
হৃদি অমার হাত গাল চিবুকে ভালবাসায় স্নেহ পরশ ছুঁইয়ে দিল৷
'অমা তোমার ভাইয়ার সাথে আমারও ফার্ষ্ট সাইট ফার্ষ্ট লাভ হয়েছিল৷
অমা তার সমস্ত ভালবাসা আর শ্রদ্ধা যোগ করে হৃদির কাঁধে মাথা রাখল৷
'ভাইয়া সেই যে বিদেশ চলে গেল আর দেশে এলো না? ভাবী তুমি এ বাড়ীতে এলে৷ আব্বার মৃতু্যর পর আম্মা আবার হাসতে শুরু করলেন৷ বিশ্বাস করবে? আম্মা হাসতে ভুলে গিয়েছিলেন৷ তুমি না এলে হয়তো আম্মাকেও আমি হারাতাম৷
হৃদির চেয়ে অমাকেই বেশী নাড়া দিল বিকেলের চা খেতে বসে এই কথাগুলো৷
ইশতান্না বেগম ভিতর থেকে ডেকে উঠলেন,
'বউ মা? অমা? ভিতরে এসো৷ অন্ধকার নেমে এসেছে৷ এখনো বাইরে কেন?
হৃদি অমার খোঁপায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, 'অমা! অমা!! উঠ আম্মা ডাকছেন৷

দক্ষিনা বাতাস৷ আকাশ ভরা জোত্‍স্না৷ সাদা মেঘরা গায়ে জোত্‍স্না লাগিয়ে খেলছে! সামনে নিষপ্রাণ দেয়ালে একটা জীবস্ত জানালা দাঁড়িয়ে আছে৷ জানালা কখনো ডেকে বলে না? ওহে! আমাকে ছঁূয়ে আমার দ্বার খুলে দাও৷ চোখ মেলে মেঘ-জোত্‍স্নার খেলা দেখ৷ কিন্তু জানালা খোলা হয়ে যায়৷ উদাসীন চোখে আকাশের মেঘ-জোত্‍স্নার খেলা দেখা হয়৷ মনতো এমনই৷ এই দেখব এই দেখব না৷ এটাই অনেক মনের দুর্বোধ্য রহস্য৷
এমন কিছু ঘটনা ঘটছে৷ ক্লাসের লেকচার শেষ হয়৷ সবাই ক্লাস থেকে চলে যায়৷ কনক হৃদিকে কখনো ডেকে বলে না, 'হৃদি চল নীচের গেট পর্যন্ত যাই৷ কিন্তু যাওয়া হয়ে যায়৷ আর যাওয়া না হলে, মনটা যেন এই মেয়েটা সাথে করে নিয়ে চলে যায়৷ তারপর সব শুণ্য৷
ইদানীং কনক হৃদিকে নীচের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়৷ রাশু কাছে থাকলে সে ও সাথে যায়৷
ওরা নীচে নামতে না নামতেই হৃদিকে নেয়ার জন্য ড্রাইভার অমাকে নিয়ে চলে আসে৷
হৃদি বলে, 'কনক! আসি৷ রাশু আসি৷
অমা গ্লাস নামিয়ে গাড়ীর ভিতর থেকেই নি:শব্দে হাসবে৷ সে হেসে অদ্ভুদ সুন্দর ভঙ্গীমায় ঘাঁড় বাঁকাবে৷ এবং হাত উঠিয়ে ইশারায় কনক রাশুকে ধন্যবাদ জানায় ৷ অমার দ্বিতীয় চোখের দৃষ্টি থাকে রাশুর দিকে৷ অমার দ্বিতীয় চোখের দৃষ্টি হৃদি ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না৷ কনক-রাশুও হাত নেড়ে ওদেরকে বিদায় জানায়৷
এভাবেই চলছে হৃদির সাথে কনকের সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন৷ যতই সময় যাচ্ছে ভিত্তিটা ততই একটা আকার নিয়ে বিশেষ দিকে এগুচ্ছে৷ কোন্ দিকে? কেউ বুঝতে পারে না৷

পানির সাথে ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করে এদেশের মানুষ বড় হয়৷ আলোর নীতি সামনে যাওয়া৷ আলোর দিশারী পেতে এদেশের মানুষ কষ্টে করে শিক্ষিত হয়৷ দেশ তাকে চাকুরী দেয় না৷ তাদেরকে দিকহীন করে তুলে --- এগুলো কনক গংদের আড্ডার বিষয়বস্তু৷

বেকার জীবনের হাহাকার ক'জন শুনতে পায়? কনক বেকার৷ বেকারদের পকেট মিসকিনদের পকেটের চেয়েও গরীব হয়৷ কনককে চলতে হয় বড় ভাই মিতুল আহমেদ রনকের মানি ব্যাগের উপর নির্ভর করে৷ রনক আগে ভর করতেন তাঁর কর্মজীবি বাবার পকেটের উপর, তাঁর বাবা করতেন দাদারটার উপর ভর৷ এ দেশে একজন আরেক জনের উপর উপর ভরাভরির ব্যাপারটা বেশী হয়৷
কনক থাকে ঢাকায় বড় বোন মিসেস কনিকার ভাড়া বাসায়৷ রনক থাকেন কনিকার পাশের ফ্লাটে খাওয়া দাওয়া করেন তিন ভাইবোন এক সাথে শেয়ারে৷ কনক রনক একে অপরকে তুইমুই বলে ডাকে৷ ভাইয়ে-ভাইয়ে অসাধারন বন্ধুত্ব৷ কনক ও রনক একসাথে সিগারেট টানে৷
এখন খোলা বাজার অর্থনীতির যুগ৷ যা মানুষ খায় না তা নিয়ে বাজারে বসে থাকলে চলে না৷ বড় ডিগ্রী নিয়ে বসে থাকলে পেটে ভাত যাবে না৷ যা দরকার তাই পড়৷ কনক মলিকু্যলার বায়োলজিতে পড়েছে৷ এটা হল বেসিক বায়োলজিকাল সাইন্স৷ গবেষণা করার সাবজেক্ট৷
রাত্রে খাওয়ার টেবিলে রনক কনককে বললেন, 'কনক এবার একটা কিছু কর৷ গোকুলের ষাঁড় হয়ে কত দিন চলবে?
কনক শুণ্য দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকায়৷
কনক বলল, 'যে দেশের ভাত খাওয়ার সমস্যা সে দেশে রিসর্াচ জব পাব কোথায়?
'এই সাবজেক্টে তুই পড়লি কেন?
কনক আকাশ থেকে পরার মত আর্শ্চয্য হলো৷
'আরে! এই সাবজেক্টে তুই-ই নিতে বলেছিলি না?
বড় ভাই যে সাবজেক্ট নিতে বলেছিলেন কনক তাই নিয়েছে৷ নদীর পানি যে দিকে ছুটে চলেছে সে দিকে গা ভাসিয়ে দে! এইম অফ লাইফ আর কা'কে বলে?
রনক চুপ হয়ে গেলেন৷ সাবজেক্টের দোষ দিয়ে লাভ কি? দোষটা হলো দেশের অথবা দেশ যারা চালায় তাদের৷
কনক বলল, 'তুই রিপোর্টার৷ এশিয়ার কয়টা দেশে বেসিক রিসার্চ হয়? এশিয়ার টোকিও থেকে রিয়াদ পর্যন্ত শুধু জাপানেই প্রফেশনাল রিসর্াচ হয়৷
'পৃথিবীর সবাই রিসার্চ করে না৷ রিসর্াচ-ওরিয়েন্টেড জব না পেলে অন্য কিছুতে ঢুকে যা৷
'চেষ্টার ত্রুটি করছি না ভাই৷ বি পেশেন্স, ওয়েট এন্ড সী৷

কনকের ওয়েট এন্ড সি এক বছরে আসেনি৷ রনক সাহেব সাংবাদিক৷ তিনি সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা নিয়ে ভাল সংবাদ সংস্থায় চাকুরী করছেন৷ তাঁর পকেটের কমবেশী টাকা থাকার কারণ তিনি অবিবাহিত৷ বাড়তি খরচের মধ্যে সিগারেট টানেন৷ রনকের মানিব্যাগ আর বড় বোনের ভ্যানিটি থেকে টাকা উধাও হওয়ার অর্থই হলো- সেখানে কনকের দু'আংগুলের এক্সসারসাইজ হওয়া৷ এই দু'টি জায়গায় অঘোষিতভাবে কনকের আংগুলচর্চার অনুমতি আছে৷ কিন্তু এ চর্চা আর কত দিন? বসে খেলে রাজার ভান্ডার শেষ হয়ে যায় আর পকেট !

এমফিল-এ ভর্তি হওয়ার আগে কনক বহুজাতিক অষুধ কোম্পানীতে কোয়ালিটি কন্ট্রোলে চাকুরী নিয়েছিল৷ নিজের খরচ চলত৷ টুলের উপর সারাদিন বসে কোন্ অষুধে কোন্ রাসায়নিক উপাদান কি পরিমান আছে তা টেষ্ট করতে হয়৷ কাজে আনন্দ নেই৷ সবার আনন্দ এক নয়৷ কনক নদী পার হবার জন্য সাঁতার দিল৷ সামনে তাকিয়ে দেখে পাতালে নদী দীঘল হয়ে গেছে৷ কোম্পানী বিক্রি হয়ে যাবে৷
কোম্পানীটির দু'টি শাখা- অষুধ এবং প্রসাধনী৷ অষুধ ভাল চলছে না৷ কোম্পানীর অষুধ শাখার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে গেল৷ কোম্পানী কে কিনবে? এম.ডি. ভার্সাস মাকর্েিটং ম্যানেজারদের মধ্যে দলাদলি, পেলাপেলি, শেষে মারামারি হলো৷ মৃতু্যমুখে পতিত অষুধ শাখাকে লেঅফ ঘোষণা করা হল৷
কনকের চাকুরী চলে গেল৷

অন্ধকারে সুন্দরী রমনী দেখার মধ্যে যেমন আকর্ষণ নেই বিজ্ঞাপন ছাড়া ব্যবসাও তেমন অর্থহীন- একথাটা কোম্পানীর মার্কেটিং ম্যানেজাররা নতুন করে ষ্টাডি করতে শুরু করল৷ প্রসাধনীর নতুন বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন বের হচেছ দেশের মিডিয়াগুলোতে৷ টেলিভিশনে ঘন ঘন দেখাচ্ছে৷ প্রসাধনী শাখা খুব ভাল ব্যবসা করছে৷
কোম্পানীর প্রসাধনী শাখার জেল টুথ পেষ্টের মডেলিং করা সেই মেয়েটি- এই হৃদি৷ মহাকাল কত কালকে এক করে ফেলেছে? সময়ের চাকায় গড়িয়ে গড়িয়ে হৃদি কনকের এম.ফিলের ক্লাসমেট৷
প্রত্যেকটি মানুষের ভিতর যে দ্বিতীয় আর একটি মানুষ বাস করে! হৃদির ভিতর থেকে আরো একটা হৃদি হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে৷ হৃদির ভাল লাগে কনককে৷ এই কনক লোকটি অদ্ভুত! যা বলে সরাসরি মুখের উপর বলে দেয়৷

ক্লাস থেকে সবাই বেরিয়ে গেছে৷ যে মেয়েটি সব সময় সবার পরে বেরোয় সে হলো হৃদি৷ আজ কনক হঠাত্‍ করে তার কাছে গিয়ে বলল, 'হৃদি চলুন চা-টা কিছু খাই৷
'না চা খাব না৷
'কেন? চা খান না? কম পয়সায় সবচেয়ে বেশী খাওয়া হয় এই চা-তেই৷ তাই না?
'হু উয়ু৷ তবে এখন চা খাব না৷
'আমার সাথে চা-খেতে ভয় করে নাকি?
হৃদি কনকের দিকে চেয়ে নিঃশব্দে হাসল৷
'এক সময় ভয় আসলে-ই করত৷ এখন করে না৷
'কি-ই চা খাবেন না?
হৃদি মাথা ঝেঁকে আবার বলল, 'না৷
হৃদির মুখে হাসির চ্ছটা৷
'তাহলে চলুন উপরে লাইব্রেরীতে যাই৷
'যাব না৷
'কেন?
'এমনি৷ উপরে যেতে ভাল লাগছে না৷
'হৃদি অনেক ভাল না-লাগা আছে যেগুলো ভালবাসার৷ ওগুলো করতে ভাললাগে৷ মনও চায় করতে৷ কিন্তু করা হয় না৷
কনকের কথা শুনে হৃদির চোখ বড় হয়ে গেল৷
হৃদি বলল, 'যেমন?
'বলব?
'বলুন৷
'কবি কবি ভাব নিয়ে বলব?
'যেভাবে মন চায় বলুন৷
কনক হাত উঁচিয়ে আংগুল তুলে বলল, 'পর্বতের শীর্ষে কষ্টে জমে থাকা বরফ ভালবাসে তাপ পেয়ে গলে ঝরনা হতে৷
'আচ্ছা ! তারপর? হৃদির কন্ঠে বিষ্ময়৷
'ঝরনা ভালবাসে নদী হতে৷ নদীর ভাললাগে সমুদ্রে যেতে৷ আর সমুদ্রের ভাললাগে তার বুকের জোয়ারকে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়তে৷
'তারপর?
'চাঁদের ভাল লাগে সমুদ্রের জোয়ারকে নিজের বুকে টেনে নিতে৷ সব চাওয়াই কি পুরণ হয়? ঠিক বলি নি?
'ও বাব্বা! এগুলো কঠিন কথা৷ আমার মাথায় ঢুকে না৷
'মিথ্যে বললেন৷ মাথায় ঢুকে কিন্তু আপনারা বলতে চান না৷ এজন্যই নাকি মেয়েলোক কে মানুষ মারার কল বলা হয়? ট্রয় নগরী কি এমনি ধ্বংস হয়েছিল?
হৃদি চেয়ে দেখল কনক নিজের বুকে হাত দিয়ে বলছে, 'এ মনটা বেলজিয়ামের কাঁচের গ্লাসের মত স্বচ্ছ৷ ক্রিস্টাল ক্লিয়ার!
'ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হলে তো ভিতরের সবকিছু দেখতে পারার কথা৷ শরীর সিলিকন দিয়ে তৈরী হলে ভিতরের সবকিছু দেখা যেত৷ বুঝতে পেরেছেন সাহেব?
কথাটা বলে হৃদি আবার হাসল৷ আগের মতই নিঃশব্দে৷
কনক বলল, 'এক সময় সত্যভাষী এই ছেলেটাকে খুব ফিল করবেন৷
'আচ...ছা...., তাই নাকি?
কনক গলার স্বরে জোড় খাটিয়ে বলল, 'উঠুন নীচে গিয়ে চা খাব৷
হৃদি চেয়ার থেকে উঠে কনকের সাথে ক্লাসের বাইরে এলো৷
কনক বারান্দায় রাশুকে বলল, 'রাশু এদিকে আয়৷ চা খেতে নীচে যাব৷
রাশু এসে জিজ্ঞাস করল, 'তুই শুধু চা খেতে যাবি?
'না৷
'তাহলে উদ্দেশ্য কি?
'গল্প করা৷ চা খাওয়া৷
'তোর তৃতীয় উদ্দেশ্য কি?
'এত উদ্দেশ্য উদ্দেশ্য করবি না তো! চল্ নীচে যাই৷

হৃদি কনক রাশুর সাথে নীচে এলো৷ মামুর দোকানে গেল না৷ বিভাগের লনে বসল৷ লনটা গোলাপ গাছে ভর্তি হয়ে আছে৷ ফুল নেই৷ দু'একটা আছে তা আবার সাইজে অতিক্ষুদ্র এবং অপুষ্টি আর পোকায় ভরা৷ এক হাতের তালুতে দশটা ধরবে৷ সারা দুনিয়ার সমুদ্র পৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বাড়লেও ঢাকা শহরের ভূ-পৃষ্ঠের পানির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে৷ একথা মালী শরাফতকে বুঝানো যায় না৷ শরাফত গাছে পানি দেয় কিনা তা জানে গাছ আর শরাফত৷
লনে মামুর দোকানের চা এলো৷
কনক ওর নোট খাতার প্লাষ্টিকের ফোল্ডার মাঠের ঘাসের উপর রাখল৷
হৃদি বলল, 'থ্যাংক ইউ৷
'আপনার ব্যবহারটা খুব ফরমাল মনে হয়৷ কথায় কথায় থ্যাংকস দেন৷ এটা অ্যাভয়েড করার বুদ্ধি৷ ইনফরমাল কন্ডিশনে ইনফরমাল ব্যবহারটাই ভাল৷ আপন আপন ভাব থাকে৷ কি বলেন?
হৃদি আশ্চর্য্য হল৷
'আচ্ছা কনক সাহেব কোনকিছু মনে না করে আমাকে এভাবে কথাটা বলে দিলেন৷ এ রকম ষ্পষ্টবাদীতার জন্য পরে অনুতপ্ত হোন না?
'হৃদি আপনাকে পেয়ে আমার খুশি লাগছে৷ খুশি হলো প্রকাশের জিনিস৷ খুশি লাগছে তাই বললাম৷
হৃদি হাসল৷
কনক ওর নিজের সাটের কলারটা ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, 'হুঁ..উুঁ.. এটা অরিজিনাল জিনিস৷
রাশু বলল, 'অরিজিনাল না ভুয়া --ভয়েজ অফ আমেরিকা৷ কহে না কহে- কনক৷ কিছু বলতে চায় না৷ বলতে শুরু করলে সব বলে দেয়৷ মুখে কিছু আটকায় না৷ ইটের খোয়া বিশেষজ্ঞ৷ শুধু খোয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে৷
হৃদি জিজ্ঞাস করল, ' ইটের খোয়ায় কি আছে?
'এটা আপনি বুঝবেন না৷
'আচ্ছা কনক সাহেব?
'সাহেব বলতে হবে না৷
'কনক তুমি চাকরি খোঁজ না?
'চাকরি করতাম, ছেড়ে দিয়েছি বা চাকুরী আমাকে ছেড়ে দিয়েছে৷

কনক রাশু হৃদি একে অপরকে তুমি সম্বোধন শুরু করে দিয়েছে৷ সহপাঠি হয়ে যারা আপনি আপনি সম্বোধন করে থাকে তারা একে অপরকে দুরে রাখার জন্য করে৷ হৃদি তা করছে না৷
জোর করে কনক তাকে নীচে নামালেও ব্যাপারটা হৃদির জন্য ভালো হয়েছে৷ মনের উপর থেকে ভারী কিছু সরে যাচ্ছে বলে তার মনে হচ্ছে৷ মন হালকা লাগছে৷
নারী বড় বিষ্ময়কর! যাকে দেখলে এক সময় গা ছমছম করত৷ যে তাকে মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে নীচে টেনে নামাল সেই কনকের সাথে কথা বলতে তার ভাল লাগছে৷ মন চাচ্ছে আরো কথা বলি৷ যত কথা ততো মাথার ব্যাথা কমছে! পেইন কিলার আর কাকে বলে?
'কনক কোথায় চাকরি করতে?
'তুমি যে কোম্পানীর মডেল হয়েছিলে আমি সেখানকার অষুধ ডিভিশনে কোয়ালিটি কন্ট্রোলে চাকরি করতাম৷
'ও আচ্ছা, আচ্ছা৷ ফার্মসিউটিকাল ডিভিশনতো উঠে যাওয়ার কথা ছিল?
'আলরেডী গন কেস৷ তোমার মডেলিং কসমেটিক ডিভিশনের জন্য রাইট টাইমে গিয়ার আপ ছিল৷
'এক আইটেমে-ই?
'কোম্পানী উঠতে এক আটটেম-ই সাফিসিয়েন্ট৷ এদেশে একটা গ্লু ইম্পোর্ট করে কোটিপতি হওয়া যায়৷
হৃদি আবার হাসল৷
'কনক ব্যবসায় ভাল করবে৷ শুরু করে দাও৷ মডেলিং আমি বিনে পয়সায় করে দিব৷
'তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না৷ বিজনেস ফ্লপ করবে৷
'কেন?
'আরে আমি এমনি বললাম৷ তুমি হলে রাজ কপালে৷ তোমাকে জড়ানো মানে শাই শাই করে উপরে উঠা৷ পেছন ফিরে তাকাতে হবে না৷ তুমি ঐ কোম্পানির তিন কোটি টাকা কামিয়ে দিয়েছ৷
রাশু বলল, 'হৃদি দুলাভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিও৷
'আচ্ছা দেব৷ ও তো ব্যাংকক থাকে৷ দেশে খুব একটা আসে না৷ আমি ব্যাংককে গিয়ে এক-দুই সপ্তাহ করে থেকে আসি ৷
'এজন্যই তুমি মাঝে মাঝে নাই হয়ে যাও?
'জি স্যার৷
'জি স্যার' বলে হৃদি সবার অজান্তে ভিতরে ভিতরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল৷
কনক বলল, 'হৃদি যদি মন চায় তবে আমাদের সাথে হাটাহাটি করতে পার৷ এ এলাকার
রাস্তাঘাট চেন? যে এলাকায় এত আসা হয় সেখানকার পথঘাট চেনা উচিত না?
'হাটাহাটি করব? আমি কি মুটিয়ে গেছি?
'শুনো এক অখ্যাত লেখকের বইয়ে পড়েছিলাম৷ মানুষের মৃতু্য নাকি এই পা থেকেই শুরু হয়! পা যতদিন ঠিক ততদিন সব ঠিক৷ ক্লাসের লেকচার তো মাত্র তিনটা৷ চেয়ারে আঠা লাগিয়ে বসে না থেকে হাট৷ শরীরের কলকব্জা ভাল থাকবে৷
কথাবার্তার ফাঁকে হৃদিকে অমনোযোগী লাগল কনক-রাশুর কাছে৷ হৃদি বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে৷
'কনক! রাশু! চল উপরে যাই৷ আমার ননদ অমা চলে আসবে৷
কনক বলল, 'অমা এলে তুমি এখান থেকেই গাড়ীতে উঠবে৷

ড্রাইভার কায়েসের ঘড়ি কখনও স্লো হয় না৷ ট্রাফিক জ্যাম, রেড সিগনাল সব পেরিয়ে কায়েস সঠিক সময়ে এসে হাজির হয় প্রতি দিন হৃদি-অমাকে নেয়ার জন্য৷ অমা বলে, বাংলাদেশের সব ড্রাইভার যদি কায়েসের মত হতো তবে নয়টা ট্রেন কয়টা ছাড়বে কথাটার প্রচলন হতো না৷ কায়েস চলে এসেছে৷ গেটে এসে সে আস্তে করে হর্ন দিল৷
অমা কায়েসকে বলল, 'তুই গাড়ী পার্ক করে দাঁড়া৷ আমাদের ফিরতে একটু দেরী হবে৷
'আপা, আম্মা দেরী করতে নিষেধ করেছেন৷
'সেটা আমি দেখবো৷ তুই গাড়ী ছেড়ে বাইরে যাসনে৷
অমা নিজ থেকেই বেরিয়ে কনক-হৃদিদের বসে থাকা যায়গাটায় আসল৷
হৃদি বলল, 'অমা বেরিয়ে এলে যে?
'স্লামোলাইকুম৷
'আমাকে ফেলে রেখে শুধু ফিলোসোফারদের আড্ডা হচ্ছে?
'তুমি এম.ফিলে ভর্তি হয়ে যাও? একসাথে আড্ডা দিতে পারবে৷
'পারলে কি আর বসে থাকতাম? তোমার আগে ভর্তি হতাম৷
রাশু অমাকে বলল, 'কি ভাই চা চলবে?
'শুধু চা না৷ ক্ষুধা লেগেছে৷
'আর কি খাওয়া চলবে?
'এমনি বললাম৷ শুধু চা হলে-ই চলবে৷
'কোন্ সাবজেক্টে পড়া হয়?
'প্যাসিভ ভয়েচে কথা বলছেন?
রাশু এবার বলল, 'কোন্ সাবজেক্টে পড়?
'ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসিপ এ৷
'গু...ড৷
'এমনভাবে গুড বললেন যেন ভাইভাতে দশে দশ পেয়েছি৷ থ্যাংক ইউ৷

অমা লনের আশেপাশে তাকালো৷ শুধু গোলাপের গাছ৷ গোলাপ গাছে কোন ফুল নেই৷
অমা বলল, 'কি ব্যাপার? বাগানের এগুলোকি সব পুরুষ গোলাপের গাছ?
অমার মন্তব্য শুনে পরিবেশটা হঠাত্‍ করে একটু নীরব হয়ে গেল৷ মূহুর্তেই রাশু হৃদি একসাথে হেসে উঠল৷
কনক অট্রহাসি হাসল, হু হা হি.. .. .. ..৷
'ইয়েস অমা, তোমার মত মেয়ে আমার খুব ভালো লাগে৷ ইয়েছ নট ফটাফট৷ ডাইরেক্ট কথা বলো৷
'ভাইয়া এটা আমার সমস্যা৷ মুখে কিছু আটকায় না৷ ব্রেক নেই বলতে পারেন৷ চটচট কথা বেরোয়৷ তবে অবস্থা বেগতিক দেখলে হার্ড ব্রেক করে ফেলি৷
রাশু বলল, 'গোলাপ গাছের স্ত্রী-পুরুষ আছে নাকি?
'কা'কে বলছেন? আমাকে?
'হঁ্যা তোমাকে৷
'আচ্ছা, আমি একজন বোটানিস্টের সাথে কথা বলে আপনাকে জানাবো৷
রাশু হা করে অমার দিকে তাকালো৷ বুঝে উঠতে পারছে না তার কি বলা উচিত৷
অমা লম্বা নি:শ্বাস ফেলল৷
'ভাবী চলো৷ গোলাপবিহীন গোলাপ বনে থেকে আর লাভ নেই৷ ঐ যে কায়েস হর্ণ দিচ্ছে৷ ওর তর সইছে না৷

হৃদি আর অমা উঠে দাঁড়াল৷
অমা বলল, 'আপনারা বাসায় আসবেন ৷
কনক রাশু এক সাথে হাঁ-বোধক মাথা ঝাঁকাল৷
'আচ্ছা যাব
কনক জিজ্ঞাস করল, 'কবে যাব?
হৃদি বলল, 'আরে! আরে উচ্চারন করে হৃদির আর কিছু বলা হলো না৷
অমা বলল, 'আপনাদের যেদিন সময় হবে সে দিন৷ অবশ্যই ফোন করে আসবেন৷ ফোন না করে এলে বাসার গেটে লক দেখতে পাবেন৷

কায়েস হৃদি আর অমাকে নিয়ে বাসায় ফিরল৷

আজ বাসায় ফিরতে দুপুর পেরিয়ে গেছে৷ ইশতান্না বেগম ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন৷ মমতাময়ী মা'র ভালবাসার অপেক্ষা৷ হৃদি-অমা বাসায় ঢুকতেই তিনি উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
'কি-ই ব্যাপার? তোরা ইদানীং দেরী করিস কেন? তোদের জন্য বসে থাকতে থাকতে আমার পেটে ঘা হয়ে যাবে!
অমা বলল, 'আম্মা তোমাকে প্রতিদিন বলা হয় আমাদের ফিরতে দেরী হলে তুমি খেয়ে নিও৷ তুমি তা না করে অযথা ক্ষুধায় কষ্ট কর৷
'একা খেতে ভাল লাগেনা৷
কেন?
'অমা এখন বুঝবি না৷ যেদিন মা হবি ঠিক সেই মুহুর্ত থেকে বুঝতে শুরু করবি৷ এখন যতভাবে বুঝাই না কেন তোদের বুঝা সম্ভব না ৷
'আম্মা তুমি ভাইয়ার ছেলে ইফতিকে ডেকে নিয়ে এসে একসাথে খেতে পার?
ইশতান্না বেগম ভেজা গলায় বললেন, 'এই পিচ্চি ছেলেটা বলে আমার সাথে খেতে তার নাকি ভাল লাগে না৷
তিনি হৃদির দিকে তাকিয়ে বললেন, 'বউমা আমি কি করব?
হৃদি বলল, 'আম্মা আর দেরী হবে না৷
সারারাত হাতে পানি নিয়ে মা'র বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ক'জনের বেলায় ঘটেছে? এখন উল্টো হয়৷ এখনকার যুগে খালি পেটে অপেক্ষারত মার জন্য কেউ তাড়াতাড়ি বাড়ী ফেরে না৷ কাল বদলে গেছে৷

লাঞ্চ করে অমা হৃদি তাদের রুমে চলে গেছে৷ ইশতান্না বেগম নীচে ড্রাইভার কায়েসের রুমে নেমে এলেন৷ কায়েসের রুম বলতে বলতে কিছু নেই৷ নীচতালার সিঁড়ির নীচে ছাদে পানি উঠানোর পাম্প মেশিন৷ মেশিনটার পাশে একটা ছোট টেবিল এবং চেয়ার রাখা আছে৷ এ বাসায় ওটাই কায়েসের রেষ্টরুম কাম ডাইনিং রুম৷ কায়েস ঘুমায় ভাড়া করা গ্যারেজের পাশের ছোট একটা ঘরে৷
'কায়েস? কায়েস আছিস?
'জি আম্মা?
'খেয়েছিস?
'আম্মা খাচ্ছি৷
'কায়েস খেয়ে উপরে আসিস ৷
'জি আম্মা, আসব৷
কায়েস ড্রাইভারের লেবাস পড়ে উপরে এসেছে ৷
ইশতান্না বেগম কায়েসকে দেখে বললেন, 'কি ব্যাপার তোকে আমি ড্রাইভারী লেবাস পড়ে আসতে বলেছি?
'আম্মা কোথাও যাবেন না?
'আমি তোকে তাই বলেছি?
'আম্মা ড্রেস খুলে আসি?
'তা আর দরকার হবে না৷ কথা শুনতে ড্রেস গায়ে থাকলে অসুবিধা হয় না৷ বোস৷
কায়েস বসল৷
'কায়েস তুই এবাসায় এসেছিল আট বছর বয়সে৷ তুই কাজের ছেলে ছিলি৷ ড্রাইভারী শিখলি৷ তারপর থেকে ড্রাইভার হিসাবে এখানেই রয়ে গেছিস৷
কায়েসের অতি বিনয়ী গলা৷ মনে হলো সে মাটির সাথে মিশে যাবে৷
'জি আম্মা৷ আমি আপনার কথা সবসময় সবার কাছে বলি৷ আপনি আমার কাছে যে কি তা বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা আমার নাই৷
'দিনকাল ভাল না৷ তুই হৃদি আর অমার দিকে খেয়াল রাখবি৷ ক্লাস শেষে আমার কথা বলে ওদেরকে সরাসরি গাড়ীতে উঠিয়ে নিয়ে চলে আসবি৷ শুধু এটুকুই দায়িত্ব৷
'পারবি না? আচ্ছা কায়েস আজকে ফিরতে দেরী হলো কেন?
' আম্মা, আমি তাড়াতাড়ি ফিরতে চেয়েছিলাম ৷
'সমস্যাটা কি ছিল?
'অমা আপা আমাকে দেরী করতে বলে গাড়ী থেকে নেমে গেলেন৷
'কোথায়?
''ছোট ভাবীর ওখানে৷
'কেন?
'ছোটভাবী তাঁর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন৷ আপা নেমে হনহন করে সেখানে চলে গেলেন৷ আমি বলেছিলাম আপা আম্মা রাগ করবেন! আপা শুনলেন না৷
'আচ্ছা৷
ইশতান্না বেগম আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন কায়েসকে৷ কিন্তু তাঁর আর কিছু বলা হলো না৷
'আচ্ছা তুই ভালোই করেছিস৷ এখন যা৷

হৃদি-অমা হাসাহাসি করে গল্প করছে৷ ইশতান্না বেগম ওদের হাসির শব্দ শুনলেন৷ একটা ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার নিয়ে যে ওরা হাসছে ইশতান্না বেগম তা পরিষ্কার বুঝলেন অমার হাসির পরিমান দেখে৷ অমার বয়সের মানুষরা হাসে বেশী কাঁদে কম৷ শরীর-মনে তাপজ্বালা কম হলে এমন হয়৷ তাপজ্বালাটা উপরের বাবামা'র গা-য়েই থাকে৷ যেমন আজকে ওদের দেরীতে ফেরার ব্যাপারটা ইশতান্না বেগমকে জ্বালাচ্ছে৷ রাস্তাঘাটের অবস্থা দিনদিন খারাপ হচ্ছে এটা ওরা বুঝতে চায় না৷
ভরা পেটে ওদের এই হাসির কারণটা অমা৷
হৃদি বলল, 'অমা গোলাপ গাছের স্ত্রীপুরুষ আছে?
'ভাবী আমি জানি না৷ তাহলে তুমি ওদের সামনে এ কথাটা বলতে পারলে?
'ভাবী স্লিপ অফ দি টাংগ হয়ে গেছে৷ তুমি কম কথা বল৷ আমি গিয়ে ষ্টান্ট মেরে ব্যালেন্স করে দিলাম৷
'তুমি আসলে পার!
'শোন, মানুষকে চিনতে হলে ভিতরে ঢুকতে হয়৷ শুণ্য হাড়ি বাজে বেশী৷ ভারী হাঁড়ি বাজে না৷ নিঃশব্দে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়! আমি রাশুকে বুঝে নিতে চাই৷

মাথা কনুইয়ে ভর করে অমার বলে যাওয়া কথাগুলো হৃদি শুধু শুনছে৷ দূর থেকে অনেক কিছু ভাল লাগে৷ রংগীন মেঘ আকাশে উড়ে৷ মেঘের কাছে গেলে ওটাকে আর রংগীন মনে হয়? সাদাসিদা পানির বাষ্প ছাড়া ওগুলো আর কিছু না৷ সব কালার ইল্যয়ুশন৷ রঙিন হাত ছানি৷
চোখকেও বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে৷ মেঘের রঙ আলোর খেলা৷ আলো থেকেই আলেয়ার সৃষ্টি৷ আলেয়ার পিছনে দেঁঁৗড়ানো ইল্যয়ুশন৷ আমি পারি নি৷ রাশুকে অমার ভাল লাগে৷ অমা রাশুকে বুঝতে চাইছে এভাবে মিশে মিশে৷ অমার চিন্তার একটা সুন্দর লজিক আছে৷ হৃদির নিজের যা ছিল তার চেয়ে ভাল৷ হৃদি মনে মনে এতক্ষণ এ ব্যাপারগুলো ভাবছিল৷
অমা জিজ্ঞাস করল, 'ভাবী তোমার ঘুম পাচ্ছে?
'আমাকে দিনে ঘুমুতে দেখেছ?
'ভাবী আমি কি বলেছিলাম মনে আছে?
'হঁ্যা ৷
'কি-ই? বলতো৷
'প্রথম দিন কনক-রাশুকে দেখে বলেছিলে কনক-রাশুরা খুব ভাল মানুষ!
'ভাবী ঠিক বলেছিলাম না?
হৃদি মাথা ঝাঁকাল৷
'অমা তুমি ঠিকই বলেছিলে৷ ওরা নির্লোভী সাদাসিদা ভদ্র লোক৷ অমা রাশু ছেলেটা খুব ভাল৷ ওকে পছন্দ করতে পার৷
'তাঁর ফিউচার প্ল্যান কি?
'বিদেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে৷
'বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন কেন? দেশে চাকুরি পান না?
'পেলে করত৷ আমি কনকের মাধ্যমে রাশুকে প্রস্তাব দিতে পারি৷ আম্মাকে রাশুর কথা বলব?
'এখন বলো না৷ ওনারা বাসায় আসবেন?
'আমার মন বলছে ওরা আসবে৷
'তাহলে আম্মা রাশুকে দেখুক৷ তারপর রাশুর কথাটা আম্মাকে বলবে৷ এখন এগুলো অন এক্সপারিমেন্টেশনে থাকুক৷
'অমা, ডিসিশন ইজ ইওরস৷
'ভাবী, এন্ড সাপোর্ট ইজ ইওরস৷
হৃদি হেসে হেসে বলল, 'আই এম অলওয়েজ উইথ ইউ৷
অমা কৃতজ্ঞভরা হাসি দল৷
'ভাবী আমি জানি৷

সীমাহীন মহাশূণ্য দিয়ে আলো-অন্ধকারের বুক চিরে চিরে পৃথিবী ধেঁয়ে চলছে৷ এর পৃষ্ঠের মানুষগুলোও ঘুরছে বিশাল মহাশূণ্য দিয়ে৷ নক্ষত্রের প্রতিক্রিয়া এভাবেই মানুষের উপর পরে? নক্ষত্রের ক্রিয়া বলতে আলোর প্রভাবকে বুঝায়৷ আলোই শক্তি৷ এই শক্তি মানুষের প্রাণঅনুতে প্রতিক্রিয়া করে মানুষকে বদলায়৷ মানুষের মনকে বদলায়৷ হৃদির মন এক অজানা ক্রিয়ায় নতুন করে ক্রিয়াশীল হচ্ছে৷

হামাগুড়ি দিয়ে ভিতর থেকে কে যেন বেরিয়ে এলো?
'প্রতিদিন নীচের গেট পর্যন্ত কনক এগিয়ে না দিলে মনটা খারাপ হয়ে যায়! সারাবেলা মন বিষন্ন থাকে৷
কেন?
'কেন! কারণ হলো, মন প্রতিদিন কনককে দেখতে চায়৷ ব্যাপারগুলো বলে বুঝানো যায় না৷
'একি পাপ?
'জানি না৷
'কি করব? পাপ হলেও মন যে দেখতে চায় 'কহে না কহে কনককে'! এক সত্য!! এক ভালবাসা!! এ সবগুলোর সমার্থক কনক কে!!!
অমা পাশে ঘুমিয়ে আছে৷

ফোন বাঁজছে ভোর ছ'টায়৷ অনেকক্ষন হলো বাঁজছে৷ থাইল্যান্ড এদেশ থেকে একঘন্টা এগিয়ে৷ এসময়টা ইতমামের ফোন করার সময়৷ যদিও বিয়ের পর থেকে ইতমাম একাজটি খুব কমই করছে৷ হৃদি ফোন ধরল৷ আই.এস. ডি.ফোন কানে ধরলেই বুঝা যায়৷ তেমন কিছু না৷
রিসিভার কানে ধরেই গলার স্বর হৃদি বুঝতে পারল৷ এটা দেশী কল৷
'কি ব্যাপার কনক এত সকালে ফোন করেছ ?
'ফজরের নামাজ পড়লাম৷ ভাবলাম এখনই ফোন করি৷ হৃদি, ঘুম থেকে উঠনি?
'না ৷
'সকালে ঘুম থেকে উঠলে শরীর ভাল থাকে৷
'আমার খারাপ থাকে৷
'হুঁ, প্রথম ক'দিন খারাপ থাকে৷ একটু আফসোসও হয়৷ ঘুমটা না ভাঙ্গলেই বোধ হয় ভাল হত৷ পরে ধীরেধীরে সব ঠিক হয়ে যায়৷ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবে৷
ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে হৃদি বলল, 'আচ্ছা চেষ্টা করব৷
'অমা কোথায়?
'পাশে ঘুমুচ্ছে? অমাকে বলবে আমরা আজ বিকেল ছ'টায় আসব৷
'বলব৷
'ও আর একটা কথা?
'বল৷
'আমি এত সকালে ফোন করতাম না৷ বাইরে বেরুচ্ছি৷ যেখানে যাচ্ছি ওখান থেকে ফোন করার কোন ব্যবস্থা নেই৷ আমি তোমাকে ঘুম থেকে উঠানোর জন্য দুঃখিত৷
হৃদি লম্বা টানে বলল, 'হয়েছে, ঢং ... ...
অমা মোচর দিয়ে হৃদির দিকে পাশ ফিরে বলল, 'ভাবী কে ফোন করেছিল? ছোট ভাইয়া?
'না৷
'কে?
'কনক৷
'কি বললেন?
'আজ বিকেল ছ'টায় ওরা বাসায় আসবে৷
'ও তাই?
অমার ঘুমঘুম ভাবটা বিদু্যত্‍ গতিতে চলে গেল৷
'ভাবী সত্যি আসবেন?
'হঁ্যা আসবে৷
অমা দু'হাত ছড়িয়ে দিয়ে জোরেসোরে বিছানায় উঠে বসল৷
'আমি উঠি৷ ড্রয়িং রুমের অবস্থা একদম বিশ্রী হয়ে আছে৷ ওগুলো ঠিক করতে হবে৷
'যাও ওগুলো গুছগাছ কর৷ হৃদির ঘুমমুখে হাসির রেশ৷
'ভাবী তুমি আরো ঘুমাবে?
'হঁ্যা ৷
'আমি উঠছি৷
ঘুম মুখে হৃদি আবার হেসে বলল, 'যাও৷

অমা পাশের ঘরে গেল৷ ইশতান্না বেগম ফজরের নামাজ পড়ে বসে আছেন৷ হাতে তজবি নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন৷ অমাকে দেখে বললেন, 'কি ব্যাপার অমা আজ এত সকালে ঘুম থেকে উঠলি?
'আম্মা তোমাকে বলা হয়নি৷ আজ হৃদি ভাবীর ক্লাসমেটরা বেড়াতে আসবেন৷
'তাই নাকি? তেমন বিশেষ কোন প্রয়োজন আছে?
'আম্মা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মানুষ মানুষের বাসায় আসে না বুঝি? আমিই তাঁদেরকে বেড়াতে আসতে বলেছিলাম৷
'তা হলে কিছু মিষ্টিটিষ্টি নিয়ে আসতে বলিস৷
'আচ্ছা৷ আম্মা ওনারা রাতে খেয়ে যাবেন৷
'খেয়ে যাবে? কখন আসবে?
'সন্ধে ছ'টার দিকে৷
'তাহলে, কাঁচা বাজার করতে কায়েসকে পাঠাতে হবে৷
'আম্মা তুমি একটু তাড়াতাড়ি কর৷

কায়েস দশটার দিকে ভারী বাজার করে দিয়ে গেছে৷ অমা আর হৃদিকে আজ মনে হল বাবুর্চি৷ প্রফেশনাল বাবুর্চির এপ্রোন ওদের গায়ে৷ আজ কাজের বুয়ার দায়িত্ব- ডিরেকশন অনুযায়ী দাগ দেওয়া কাপে করে পাতিলে পানি ঢালা৷ কথামত গ্যাসের চুলার আঁচটা কমানো-বাড়ানো৷ বুয়া তরকারি কাটতে পারে না৷ কাটলে মনে হয় তরকারীগুলোকে দা এর নীচে রেখে নিষ্ঠুরভাবে কোপানো হয়েছে, বিশ্রী লাগে৷ কারো সামনে পরিবেশন করা যায় না৷ একাজগুলো আজ অমাই করেছে৷ তার ভিতর বিশেষ উত্তেজনা কাজ করছে৷ অমা হৃদি বিকেল চারটার ভিতর রান্না সারল ৷

আজকের সকাল থেকে সব আয়োজন অমার গরজে৷ ভাবীর বন্ধূরা বাসায় বেড়াতে আসবে৷ এটা অতি সাধারন ঘটনা৷ কিন্তু সময় যত ঘনিয়ে আসছে অমার ভিতর বিশেষ একটা টেনশন কাজ করছে৷
অমা আজ স্বপ্নের জাল বুঁনছে৷ মনটা এমন একটা জিনিস! কখন যে কার জন্যে জাল বুঁনে? এ জালে স্বপ্নকে আটকাতে হয়! অমা সময় গুণছে৷ তাকে রাশুর বাতাস দোলা দিচ্ছে৷ অমাই কনক-রাশুদেরকে আসতে বলেছিল৷ অমার ভাল লাগছে না৷ তার চেহারা দেখে হৃদির তাই মনে হল৷
সে জিজ্ঞাস করল, 'অমা তোমার খারাপ লাগছে?
'ভাবী বমি বমি লাগছে৷
'ও মা, বমি বমি লাগার তো কথা না! কিছুই হলো না বমি আসে কোত্থেকে?
'ভাবী এমন লাগছে কেন?
হৃদি হাসলো৷
'বেশী টেনশন হলে এমন হয়৷ সেটা খুশীতে হোক আর দুঃখেই হোক৷ ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি খেয়ে শুয়ে একটু রেষ্ট নাও৷ সময় হলে আমি ডাকব৷

অমা হৃদির ঘরে গিয়ে পা লম্বা করে দিয়ে শটান শুয়ে রইল৷ হৃদি তাকে সোয়া পাঁচটায় ডেকে উঠালো৷

কনক-রাশু ছ'টায় সময় এলো৷ অতিথি যেভাবে বাসায় আসে সে ধরনের কোন ছাপ নেই ওদের আসার ভিতর৷ পাঁচতালা উঠার সিড়িতে হাসি আর জুতার শব্দের ঢেউ উঠেছে মনে হলো৷ ধপ্ ধপ্ থপ্ থপ্ শব্দ হচ্ছে৷
হৃদি দরজা খুলে দিল৷ কনক রাশু ড্রয়িং রুমে বসল৷ ইশতান্না বেগম ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন৷ হৃদি তার শ্বাশুড়ীর সাথে কনক-রাশুকে পরিচয় করিয়ে দিল৷ কনক ইশতান্না বেগমের পা ছুঁয়ে ছালাম করল৷ সাথে সাথে রাশুও গিয়ে ছালাম ঠুকল ইশতান্না বেগমের পায়ে৷
ওদের সম্মানবোধ দেখে ইশতান্না বেগম মন থেকে খুব খুশী হলেন৷ আধুনিককালের ছেলেপুলেরা মুখে স্লালামুআলায়কুম বলেই সালামের কাজটা সেরে ফেলে৷ ইশমাম-ইতমামের বন্ধুরাও তাই করেছে৷
ইশতান্না বেগম বিষ্মিত হলেন৷ তাঁর মুখে বিষ্ময়কর হাসি৷ তিনি আর্শিবাদ জানিয়ে বললেন, 'বাবারা তোমরা ছোট বউমা হৃদির ক্লাসমেট না?
'জি খালাম্মা৷
'তোমাদেরকে দেখে খুশী হলাম৷
তিনি বসলেন৷
অমা ভিতরে গিয়ে আবার কিছুক্ষন পরই ফিরে এলো৷ তার শরীর মনে বিশেষ উত্তেজনা৷ অমার হাতে চা৷ সাথে কিছু নাশতা৷
'কনক ভাইয়া এখন শধু চা দিচ্ছি৷ রাত্রে ডিনার কারে যাবেন৷
উত্তম প্রস্তাব! না চাইতেই হাতে৷ কে না চায়?
কনক বলল, 'আচ্ছা৷

ড্রয়িং রুমে পাঁচ জন বসে আছে৷ জমিয়ে আড্ডার আসর বসানোর পরিবেশ৷ এখন বৃষ্টি হলে ভাল হতো৷ বাইরে ঝপ্ ঝপ্ বৃষ্টি পড়ছে৷ ড্রয়িং রুমের সামনের ছাদে ক্যাসাব্ল্যানকার টব-বাগান৷ বৃষ্টি ফুলের গন্ধকে তাড়িয়ে ড্রয়িং রুমের ভিতরে নিয়ে আসতো৷
'তুমি এসেছো মনটা কেমন যেন করছে? তুমি টা কে? তুমি টা হলো রাশু !!
অমা জিজ্ঞাস করল, 'রাশু ভাই কেমন আছেন?
'ভাল, তুমি কেমন?
অমা ঘাড় দুলিয়ে বলল, 'হুঁ.. ভাল৷
ওর ঘাড় ঘুরানোয় অসাধারন একটা রোমান্টিসিজমে ভরা ছিল৷ এটা বুঝে নিতে হয৷ রাশুর পক্ষে ওটা বুঝা সম্ভব নয়৷ ফুল দেখে কারোর মাথা থেকে কবিতা বের হয়৷ কারোর মাথায় ওটার অষুধীগুণ নিয়ে চিন্তা হয়! হায়রে কত ধরনের মাথা! ফুলের অষুধীগুণের জিন কাঠাল গাছে ক্লোন করা যায়? জিন ক্লোনিং! অসম্ভবকে সম্ভব করা৷
রাশু নিঃরস গলায় বলল, 'অমা, আর কি খবর?
'কি খ-ব-র?
'পড়াশুনা কেমন চলছে?
অমার ভিতর চূঃ চূঃ শব্দ হলো৷ এখানেও পড়াশুনা?
সে এবার শব্দ করে বলল, 'জি খুব ভালো চলছে৷
ইশতান্না বেগম কনকের পাশে বসেছেন৷ তিনি জিজ্ঞাস কনককে করলেন, 'বাবা তুমি কি করছ?
'খালাম্মা আমি চাকুরী খুঁজছি৷ আমরা কয়েক বন্ধু মিলে নিজেরাও কিছু করার চেষ্টা করছি৷
'বাবা কি করার চেষ্টা করছ?
অমা চটে বলল, 'আম্মা তুমি ইন্টারভিউ নিচ্ছ কেন?
'ইন্টারভিউ না গল্প করছি মা৷
কনক বলল, 'অমা থামো৷

অপরিচিতের সাথে গল্পের কোন নির্দিষ্ট পয়েন্ট থাকে না৷ পরিচিত হওয়ার পর গল্প শুরু হয়৷ প্রথম প্রথম গল্পে কোন ধারাবাহিকতা থাকে না৷ এই ঘরের খবর এই জাতিসংগের খবর৷ আবার নিউইয়র্কের জাতিসংঘ ভবন থেকে কেরানীগঞ্জের দুবরার চর৷
'খালাম্মা আমরা কয়েক বন্ধু মিলে সাভারে জমি কিনেছি৷ পোল্ট্রি ফার্ম জাতীয় কিছু একটা করা যায় কিনা ভাবছি৷
'হঁ্যা বাবা কর৷ নিজেরা কিছু করতে পারাটা সবচেয়ে বেষ্ট৷ গাড়ী কর বাড়ি কর ব্যবসা কর বা চাকুরী-ই কর সব সময় ফেয়ার ভাবে করতে চেষ্টা করবে৷
'জি৷
'এটা করতে গিয়ে শান্তি পাবে৷ করার সাফল্যে আরো শান্তি পাবে৷ শান্তিতে চোখে পানি আসবে৷ ফল ভোগটা হয়তো নিজেরা পাবে না৷ নেক্সট জেনারেশনের জন্য তোমাদের কর্মফল কাজে দেবে৷
'জি, আপনি ঠিকই বলেছেন৷
'আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটা-ই এমন৷
অমা তার মা'র দিকে তাকিয়ে বলল, 'এই যে বাড়ীটা, এই যে বাড়ীটা শুরু হলো৷ আম্মা ঢাকা শহরে বাড়ী শুধূ তোমারই আছে?
কনক বলল, 'অমা চু.উ.প কর৷

ইশতান্না বেগম বললেন, 'এই যে বাড়ীটা৷ এটা আমাদের সারা জীবনের শ্রম-কষ্টে গড়া৷ আমার গহনাপত্র, দেশের জায়গাজমি, ওর আব্বার সব টাকাপায়সা এখানে ঢালতে আমাদের খুব কষ্ট হয়েছিল৷ একদিন এই বিশুদ্ধ বাড়ীটা কমপ্লীট হলো৷ কিন্তু শুদ্ধ মানুষটি চলে গেলেন৷ এখন অমারা এগুলো ভোগ করবে৷ সুতরাং সর্বদা ফেয়ার থাকবে৷
'আ-ম-মা, এসময়ে এগুলো বলছো কেন?
'অমা, খালাম্মাকে গল্প করতে দাও৷
'আমি তোমাদেরকে আমার কষ্টের গল্প শোনালাম৷ কষ্টের দিরে গল্পগুলো সাধারনত কেউ কাউকে শুনাতে চায় না৷
'জি৷
'খারাপ দিনের সময়গুলোকে ঢেকে রেখে সুখের অংশটুকুই একে অপরকে শুনায়৷
রাশুকে উদ্দেশ্য করে তিনি এবার জিজ্ঞাস করলেন, 'বাবা তুমি কি করছ?
হৃদি বলল, 'আম্মা ও খুব ভাল ছাত্র৷ ও এখনও কিছু করে না৷ বিদেশে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করবে৷ তাপর চিন্তা করবে কি করা যায়?
'বাবা খুব ভাল৷ শোনে খুব ভাল লাগল৷ বাবা আমাদের দেশে দু'টো পাওনা এক সাথে পাওয়া দূষ্কর৷ বলতে পার পাওয়া যায়ই না৷ টাকাওয়ালা পরিবারের ছেলে মেয়েরা ক'জন উচ্চশিক্ষিত হতে পেরেছে? হাতে গুণা যাবে৷ টাকা থাকলে পড়ালেখা হচ্ছে না, পড়ালেখা করতে থাকলে ঐ ফ্যামিলির টাকা পয়সা থাকছে না৷ এদু'টো জিনিস একসাথে হচ্ছে না৷ পরের দলটা সবচেয়ে বেশী কষ্ট করছে৷ বাবা দেখেছ? ঘটনাগুলো কেমন উল্টো? বাবা উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে এসে কি করবে?
রাশু হতবিহ্বল হয়ে গেল৷ এই অতি সাধারন প্রশ্নটির সুস্পষ্ট উত্তর ওর জানা নেই৷ উত্তর দিলে প্রশ্নকর্তা নিজেই হতাশ হন৷ প্রশ্নকর্তা হতাশ হলে উত্তরদাতার অবস্থা কি? তাকে থকথকে কাদা থেকে টেনে তুলতে হয়৷ হায়রে কপাল! রাশুকে মনে হলো কাদা থেকে টেনে তুলা হয়েছে৷ গলায় জোর নেই৷
সে হতাশ কন্ঠে বলল, 'খালাম্মা আসলে আমি জানিনা দেশে ফিরে এসে আমি কি করব?
'দেখেছ? দেখেছ বাবা? ব্যাপারগুলো চিন্তা করলে কত বিস্মিত হতে হয়? আমাদের দেশের শিক্ষার হার কত কম? অথচ শিক্ষিত লোকদের চাকুরী হচ্ছে না? চোখ বন্ধ করে একবার ধীরস্থির মনে চিন্তা করলে মানুষ পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে যায়!!
ইশতান্না বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন৷
'যাক বাবা তোমার উচ্চ শিক্ষার কথা শুনে ভাল লাগল৷ তোমার আব্বা-আম্মার বাইরে তোমার কথা শুনে যে সবচেয়ে বেশী খুশী হবে- সে হলো আমি৷ বাবা তুমি বড় হও৷
ইশতান্না বেগম ঘড়ি দেখলেন তাঁর এশার নামাজের সময় হয়ে গেছে৷
'আমি উঠি তোমরা গল্প কর৷ রাতে তোমরা রাতে খেয়ে যেও৷
ইশতান্না বেগম উঠে ভিতরে চলে গেলেন৷

অমা বলল, 'কনক ভাইয়া দেখেছেন, আম্মা কেমন বক্তৃতা দিয়ে গেলেন?
'অমা তোমার আম্মাকে আমার খুব ভাল লাগল৷ বিশেষ করে উনার সেন্স অফ রিয়ালিটি দেখে৷ ইট ইজ আউটস্ট্যান্ডিং৷
'আপনারা ভাল শ্রোতা৷ আপনাদের গল্প আগামী কয়েক সপ্তাহ ধারাবাহিকভাবে এ বাসায় চলবে৷ আমি শুনতে পাবো৷
সে হৃদিকে বলল, 'ভাবী, বড় ভাবী বাসায় নেই?
'আছেন৷ এশার নামাজের পর আসবেন৷

এশার নামায হলো৷
অমার বড় ভাবী ঘরে ঢুকলেন৷
অমা তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিল৷
ইভা বললেন, 'স্লামোলাইকুম আপনারা কেমন আছেন?
'কেমন আছেন' পূর্বপরিচিতদেরকেই বলা হয় অথবা কারো সাথে দ্বিতীয় সাক্ষাতে বলা যায়৷ ইভার সাম্বোধন কনক রাশুর খুব ভাল লাগল ৷
'জি আপা খুব ভাল আছি৷ আপনি ভাল?
'জি৷
আড্ডার সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়৷
রাত ন'টার বেশি বেজে গেছে৷ কনক বলল,
'আর গল্পের দরকার নেই৷ ক্ষুধা লেগেছে৷
ওরা একসাথে খেল৷
রাশু বলল, 'অমা খালাম্মাকে ডেকে নিয়ে এসো৷
'কেন গল্প করবেন?
রাশু চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকাল, 'নো! বিদায় নেব৷
অমা রাশুর 'নো'-বলা, বন্ধ চোখ, মুখ, হাত মনোযোগ দিয়ে দেখলো৷ মনে লাগা মানুষের সবকিছু মনোযোগ দিয়েই দেখা হয়৷ নাহ্ কোথাও কিচ্ছু নেই! বিদায়ের বেদনা নেই৷ শুধু বিদায়৷ অমার ভিতর থেকে হতাশার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুল৷
ইশতান্না বেগম এলেন৷ রাশু আর কনক দাঁড়িয়ে বলল,
'খালাম্মা অনেক ডিষ্টার্ব করলাম৷ আসি৷ আপনাকে, আপনার কথা আমাদের খুব ভাল লাগল৷ অনেক দিন মনে থাকবে৷
'দোয়া করবেন৷
'বাবারা সময় পেলে তোমরা আবার এসো৷

হৃদি অমা ওদেরকে সিড়ির গোড়ায় এগিয়ে দিল৷

ফজরের আজান হলো৷ কনক ফজরের নামাজ পড়বে৷ অযু করে পাক পবিত্র হওয়া দরকার৷ সে বাথরুমে ঢুকে দেখল বাল্ব জ্বলছে৷ শ্যাওলার সঁ্যাত স্যাঁতে উত্‍কট গন্ধ নাকে লাগল৷ শ্যাম্পুর মধ্যে শ্যাওলার পুষ্টি উপাদান আছে? রাত্রে ওগুলো খেয়ে শ্যাওলা ক্ষুদ্র অক্টোপাসের মত ডালপালা গঁজিয়ে বড় হয়েছে৷ মেঝে পিচ্ছিল হয়ে আছে৷ চিত্‍পটাং হওয়ার সম্ভাবনা আছে৷ অযু করার জায়গা কনকের মনঃপুত হল না৷ সে ডাইনিংয়ের বেসিনে অযু করবে৷ সমস্যা হলো৷ পা ধুঁতে গেলে লুংগি হাটুর উপর উঠে যায়৷ তাতে অযু থাকে না৷
কনক ডাইনিং চেয়ার টেনে তার উপর দাঁড়িয়ে ট্যাপের পানি ছেড়ে দিয়ে পায়ের গোড়ালী ধু'লো৷ এদেশের চেয়ারের পায়ায় রাবারের ক্যাপ থাকে না৷ চেয়ার এদিক ওদিক টান দিলে বিশ্রি শব্দ হয়৷ কনকের টানে চেয়ারের পা মেঝেতে করাশ করে শব্দ উঠল৷
কনকের বড় আপা মিসেস কনিকার ঘুম হঠাত্‍ ভেংগে গেছে৷ তিনি ধড়মড়িয়ে উঠে জিজ্ঞাস করলেন, 'কে--এ?
কনক বলল, 'আপা আমি কনক!
'এত বিশ্রী শব্দ হল কিসের?
'আপা আমি অযু করছি৷
কনক সশব্দে নামাযে বসে গেল৷

কণিকা ঘুম থেকে উঠলেন৷ তিনিও নামায পড়বেন৷ কনক নামায পড়ছে৷ এই দৃশ্যটা দেখতে তাঁর খুব ভাল লাগছে৷ বিপদে সবাই নাকি সৃষ্টিকর্তাকে ডাকে? নাস্তিকরাও বলে, গড সেইভ আস৷ কনকের কোন বিপদ যাচ্ছে?
কনকের নামায শেষ হলো৷

কনিকা নামাযের চৌকিতে বসে নামায শুরু করবেন৷ তিনি তা না করে কনককে জিজ্ঞাস করলেন, 'কনক এখনই হাটতে বেরুবি?
'হ্যাঁ আপা৷
'আজ যাসনে৷ আমি নামায পড়ে নিই৷ একসাথে দু'জনে চা খাব আর গল্প করব৷
'আচ্ছা৷
কনক ডাইনিং টেবিলে এসে অপেক্ষা করছে৷ নামায শেষে দু'ভাইবোন নাশতা করল৷ মিসেস কনিকা দু'কাপ চা বানিয়ে এনে টেবিলে এসে বসলেন৷

কনকের জন্মের সময় তার মা সংসারের মায়া ত্যাগ করেছিলেন৷ কনককে তখন তার বড় আপা মিসেস কনিকার কোলে তুলে দেয়া হয়েছিল৷ সে-ই কনক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকু্যলার বায়োলজিতে এম.এস.সি ডিগ্রী লাভ করেছে৷ লহ্ লহ্ লও ছালাম৷ বড় আপা লও ছালাম! জন্ম থেকে মা-হারা শিশুকে কোন্ বোন বড় করেছে?

সুপ্রভাত৷ ভাইবোন চা খাচ্ছে৷ চা না! তাঁরা যেন স্বর্গের কোন সরোবরের অমিয় সূধা কাপে ভরে পান করছেন৷ বড় আপা! ছোট ভাই!! বয়সের পার্থক্য আঠার বছর৷ যে ছোট ভাই জন্মের পর অসংখ্য রাত কাটিয়েছে এই বোনটির পবিত্র বুকে৷ দু'জনের চা খেতে এত ভাল লাগছে! তাদের চোখমুখে অসাধারন স্বর্গীয় তৃপ্তির ছোঁয়া লেগে আছে৷ পবিত্র হে শুভ সকাল৷

আবহাওয়া পাল্টে গেল মনে হচ্ছে৷
কনিকা বললেন, 'কনক এবার একটা চাকুরী নে৷
'নিব৷
'কবে?
'যেদিন পাব সেদিন নেব৷
'আমার পার্টসে আর হাত দিবি না! তোর দুলাভাই রাগ করেন৷
'কেন?
'কেন বুঝিস না?
'আপা, তুমি আব্বার পকেটে হাত দিতে না?
'দিতাম৷ তোর পকেটেতো হাত দিতাম না!
'আপা তুমি আগে জন্মেছ৷ আগে চাকুরি নিয়েছ৷ আগে টাকা দিবে৷ আগে মরবে৷ আমি আগে জন্মালে তাই করতাম৷
'তোর কথার সাথে পারি না!
'হঁ্যা৷ আমি সবার পরে জন্মেছি৷ সবার পরে চাকুরি নিব৷ সবার পরে টাকা দিব৷ আমলনামায় সবার কথা লিখে রাখছি৷ পাই পাই করে সবার ঋণ শোধাব৷
চা শেষ৷
কণিকার মুখে হাসির ঝলমলে দু্যতি৷
'আর এক কাপ চা খাবি?
'না৷
'উঠছিস কেন? বস৷ তোর সাথে কথা আছে৷ জরুরী কথা৷ কনক, একটা সত্যি কথা বলবি?
কনক হাসল৷
'আপা আমি তোমার সাথে কখনও মিথ্যে কথা বলেছি?
'হঁ্যা, কোনদিন বলিস নি৷
'তাহলে?
'এখন যে প্রশ্নটা জিজ্ঞাস করব সেখানে তোর মিথ্যে বলার সম্ভবনা আছে৷
'কি কথা আপা?
কনিকার কপালে ভাজ পড়লো৷
'ইদানিং তোর কি হয়েছে?
'নাহ্ কিছু হয়নি তো? কনক ফড়ফড়িয়ে উঠল৷
'তোর মন যেন কেমন কেমন দেখছি?
'কেমন দেখছ?
'আগে যেমন দেখেছি ও রকম না৷ কিছু যে হয়েছে সেটা আমি বুঝতে পেরেছি৷
'কিচ্ছু হয়নি?
'তুই এখন কিন্তু মিথ্যে বললি!
'আপা সত্যি বলেছি৷
'আমার চোখের দিকে তাকা৷
'তাকালাম৷
'কনক মিথ্যে বলেছিস৷ সত্যি করে বল তোর কি হয়েছে?
'আপা আমার কিছু ভাল লাগে না৷
'এবার পথে এসেছিস৷ ও বাবা, এটা তো খুব খারাপ! তোর আবার কি হলো?
'জানি না৷ আমার কিছু ভাল লাগে না৷
'প্রেমে পরেছিস? পড়লে দেখেশুনে পরিস?
'আপা তুমি যে কি-ই?
'কি টি বুঝি না৷ উল্টোপাল্টা কিছু করবি গ্রামে বাবাকে খবর পাঠাব৷ বাবাকে তো চিনিস! আপা কিসের মধ্যে কি ঢুকিয়ে খিচুরি পাকাচ্ছ?
'খিচুরি পাকাচ্ছি না৷ পাক ছাড়াচ্ছি৷ কথাগুলো খেয়াল রাখিস৷
কনক নীচের দিকে তাঁকিয়ে আছে৷
'কনক? বাড়ী থেকে এক লাখ টাকা এনে শেয়ারে জমি কিনেছিস তার কি হলো?
'সব হবে ইনশাল্লাহ্৷
'তোকে আমার খুব ভয় করছে৷
'কেন?
'সেটা বুঝাতে পারব না৷ তুই হাজতে ঢুকেছিলি সে কথা মনে আছে?
'আছে৷
'কি মনে আছে?
'আমি অনেক কেঁদেছিলাম৷
'কেন? কান্ন্া এসেছিল কেন?
'তুমি বাসায় বসে কাঁদছো৷ এ কথা মনে করে৷
'আমি কেন কেঁদেছিলাম জানিস?
'কেন?
'বাবার বিছানার পাশে একটা বাঁধানো ফ্রেম ঝুলে আছে৷ সেটা মনোযোগ দিয়ে কখনো পড়ে দেখেছিস্ ?
'হঁ্যা, কালো কাপড়ে সাদা সূতোয় লেখা আছে ---
'এনেছিলে সাথে করে মৃতু্যহীন প্রাণ৷
মরনে তাহা তুমি করে গেলে দান৷'

'তুই জন্মানোর সময় আমি মা'র পাশে ছিলাম৷ পেট ছিড়ে তুই বের হয়ে এলি তোকে মা'র কোলে দেয়া হলো৷ মা নিস্তেজ হয়ে গেলেন৷ মা নিজে মরে গিয়ে তাঁর ভিতরের প্রাণটকে বাঁচিয়ে গিয়েছিলেন৷
'কনক তার বড় আপার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ তাঁর চোখেমুখে স্নেয়ময়ী মমতার এক মহাসমদ্র৷ কনক সেই স্নেহমমতার সমুদ্রে হারিয়ে গেছে ৷
'কনক শুনছিস্ ?
'হঁ্যা বড় আপা৷
'আমার তো সন্তানাদি নেই৷ কিন্তু সন্তান কি আমি তা তোকে বড় করতে গিয়ে বুঝেছি৷ সন্তান হলো হাজারো নিঘর্ুম রাতের কষ্টে বানানো কিশোরীর একটা জীবন্ত খেলনার মত৷ যে খেলনা বেড়ে বড় হলেও মা'র কাছে সে খেলনাই থেকে যায়৷ তুই জেলের মতো একটা জায়গায় গিয়েছিস৷ মা বেঁচে থাকলে তাঁর সে খেলনার কথা ভেবে কি কষ্ট পেতেন সেটা ভেবেই আমি সারাক্ষন কেঁদেছিলাম৷ তুই ছিয়ানব্বই ঘন্টার মতো হাজতে ছিলি৷ আমি পানি ছাড়া আর কিছু স্পর্শ করিনি৷ তোর দুলা ভাই জোর করে গ্লুকোজের শরবত খাইয়ে দিতেন৷ আমি কেন খাই নি জানিস? তুই কি খাচ্ছিস না খাচ্ছিস সেটা ভেবে৷
কণিকার কথাগুলোয় কনক যেন জ্বলে উঠলো৷
'তোমরা আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না৷ আমি ঠিক আছি এবং থাকব ইনশাল্লাহ্৷
'তোর প্রতি আমার সে বিশ্বাস আছে৷ টাকা নিয়ে যাস৷ ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আসার সময় বাজার করে নিয়ে আসিস৷
'আচ্ছা৷
কণিকা চলে গেলেন৷ কনক অনেকক্ষন গুম হয়ে ডাইনিং এ বসে রইল৷

ন'টায় ইউনিভার্সিটিতে এসে কনক সরাসরি ক্লাসে ঢুকেছে৷ আজ একটানা তিন ঘন্টা ক্লাস৷ হৃদি ক্লাসে ঢুকেই কনককে দরজার বাইরে ডেকে নিয়ে এলো৷
'কনক আজ বাইরে হাটতে বেরুব৷
কনক বলল, 'রাশু যাবে? ডট চৌধুরী?
'কাউকে নিব না৷
'শুধু তুমি যাবে৷ অনেক কথা আছে৷
'খুব জরুরী?
'হঁ্যা, খুব জরুরী৷ তোমার ব্যস্ততার কথা শুনতে চাই না৷ বেরুবে?
কনক ধীর গলায় বলল, 'হঁ্যা৷
ক্লাস শেষ হল৷

কনক রাশুকে ডেকে বলল, 'আমি হৃদির সাথে বাইরে বেরুলাম৷ তুই এদিকে থাকিস৷
রাশু বলল, 'আমি ডট চৌধুরীকে নিয়ে জিপিও যাব৷
'জিপিও তে তুই একটা বাড়ী বানিয়ে নিই! আর কত চিঠি চালাচালি করবি? এবার একটু দম নিই৷ তোর শ্বাস তো বন্ধ হয়ে যাবে রে?
'কনক আমাকে যেতেই হবে৷
'যা৷ আমার ফিরতে দেরী হলেও তুই মামুর দোকানে বসে থাকবি৷ জরুরী আলাপ হবে৷ কি ব্যাপারে জরুরী আলাপ হবে যদিও সেটা জানি না৷ তবে হবে৷
কনক দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে হনহন করে নীচে নেমে এলো৷

হৃদি কনকের জন্য ফুটপাত দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে৷ কনক আসতেই সে বলল,
'চলো৷
হৃদি-কনক হাটতে থাকল৷
'কনক রাস্তা ক্রস কর৷ পার্কের ভিতর দিয়ে যাব৷ ঘরের কাছে পার্ক অথচ একদিনও ঢোকা হয়নি?
'বিশ্ববিদ্যালয়' ধারনার (কনসেপ্টের) সাথে বড়বড় পার্কের অবস্থানের বোধ হয় বিনেসূতোর মালার মত একটা যোগাযোগ আছে! মুক্ত৷ সব উনমুক্ত৷ এখানে সার্বজনিন মুক্ত বুদ্ধিবৃত্তির উদ্ভব ঘটবে৷ বুদ্ধি যেন বহমান নদীর মত৷ শুধু বহিবে৷ আর তীর থেকে সবাই তা টেনে নিবে৷ এখানে ফুল ফুটবে৷ পাখিরা গাইবে৷ মন উতলা বাতাস বইবে৷ স্বপ্ন আঁকবে পার্ক নামের এ স্বপ্নগঙ্গায়৷ সব ধরনের মানুষের পদচারণা হয় এ স্বপ্নগঙ্গার ভিতর৷ বুদ্ধিজীবি থেকে নেশাখোর পর্যন্ত সব মানুষের চাহিদা এ পার্কটা কিছু না কিছু মেটায়৷ না হলে মানুষ এমনি এমনি ওখানে আসে না৷

কনক হৃদির সাথে এ স্বপ্নগঙ্গার ভিতর ঢুকল৷ ফুটপাত দিয়ে হৃদি আর কনক পাশাপাশি হাটছে৷ নিঃশব্দের পদচারণা৷
কিছুক্ষন যেতেই হৃদি বলল, 'চল একটা বেঞ্চে বসি৷
কনক আশ্চর্য্য হওয়ার মত করল৷ 'বেঞ্চে বসব?
'হঁ্যা৷
'হাটবে না?
'বস তো...ঢং৷

বাংলা ভাষায় যতগুলো শব্দ আছে তার মধ্যে হৃদির বলা এই ঢং...শব্দটার একটা শ্রেষ্ঠত্ব আছে৷ হৃদির বলা ঢং..শব্দটা কনকের অসম্ভব ভাল লাগে৷ দূরে কোথাও থেকে হৃদির গলা-ঘন্টার ঢং বেঁজে উঠছে৷ আর তা কনকের কানে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে৷
দুপুড় দেড়টায় এখানে ভীড় কম৷ এসময় বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ এখানে আসে না৷
কনক একটা বেঞ্চে বসল৷
'কি ব্যপার হৃদি তোমার জরুরী কথার কিছু বলবে?
'কেন? বলার কিছু না থাকলে বেরুতে মানা আছে? আমি মুটিয়ে যাচ্ছি না?
'আমি কি তাই বলেছি?
'আমাকে দেখে ইদানীং কোন চেঞ্জ লক্ষ্য কর?
'তোমার মধ্যে ডিপ্রেশন কমে গেছে৷
'তুমি সত্যি হৃদি স্পেশালিষ্ট!
'কি..ই...ই? তা হলে স্বীকার করলে?
'ডিপ্রেশনটা কেন কমে গেছে বুঝতে পার?
'জানি৷ কনকের স্পষ্ট গলা৷
'বলতো কেন?
'এমনি বললাম৷ আমি টেলিপ্যাথিষ্ট নাকি যে তোমার মনের খবর জানব?
'তুমি ক---ন----ক৷ কহে না কহে---এর এব্রিভিয়েশন৷ 'কহে' এর ক, 'না' এর 'ন', আর 'কহে' এর ক --- কনক৷ কনক, তুমি আমাকে কিছু বলতে চাও না?
কনকের চোখেমুখে রহস্যের হাসি৷
'হাসছো কেন?
কনক তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, 'হৃদি হাটব৷ কনক উঠে দাঁড়াল৷
হৃদিও উঠে দাঁড়াল৷
উদ্দেশ্য হাটাহাটি৷
ওরা বেশ খানিকটা সময় হাটলো৷ হৃদির কথাবার্তার গতিবেগ হঠাত্‍ কেন যেন কমে গেল৷ তার মনের ভাব একদম নিস্পৃহ৷ কনক হৃদি থেকে একটু সামনে হাটছে৷
'ক..ন..ক,
কনক হৃদির দিকে তাকাল৷ মানুষের মন এত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হতে পারে? কিছুক্ষণ আগের দেখা হৃদির চেহারাটা নেই৷ ওর চেহারার হঠাত্‍ এই পরিবর্তন কেন?
'হৃদি তোমার সমস্যা কি?
'ক..ন..ক, আমি প্রচন্ড অসুখী মেয়ে হয়ে যাচ্ছি ----৷
কথাটা বলে হৃদি ঘাসের উপর বসে পড়ল৷
মানুষ এভাবে শক্তিহীন হয়ে বসে পড়ে প্রিয়জনের মৃতু্য-সংবাদে৷ হৃদির ঘাসে বসে পরার দৃশ্যটা কনকের ভিতর খুব কষ্ট দিয়ে ঢুকল৷ ওর সুন্দরের নীচে এমন অ-সুখ লুকিয়ে আছে? কনক পাশে গিয়ে বসল৷
'তোমার কি হয়েছে? তোমার সমস্যা কি?
'অনেক কথা মানুষকে বলা যায় না৷ শুধু সারাংশটুকুই বললাম৷
'সব শুনতে চাইনা৷ কি হয়েছে বল?
'আমি আমার স্বামীর সেকেন্ড ওয়াইফ৷
কনক হতভম্ব৷
'ইম্পছিব্যল!
'এটা আমার জীবনে ঘটেছে৷
'কি বলছ তুমি? বিয়ে তোমার ইচ্ছেতেই হয়েছিল না?
'আমি পাগলের মত একটা কাজ করে ফেলেছিলাম৷ ভালবাসার পাগল৷ যে পাগল এখন পরম প্রায়শ্চিত্য করছে...!
কনক হৃদিকে থামিয়ে দিল৷
'তোমার ননদ শ্বাশুড়ী তাঁরা জানেন না তোমার স্বামী আগে একটা বিয়ে করেছিলেন?
'দেশের কেউ জানে না৷ কোন দিনই জানবে না!
'তুমি বলনি?
'না৷
'তুমি জানালে না কেন?
'আমার জানতে দেরী হয়ে গেছে৷ আমি এখন প্রমাণ করব কিভাবে?
'তোমার হ্যাসবেন্ড আরও একটা বিয়ে করে আছেন আর তুমি প্রমাণ করতে পারবে না? এটা কেমন কথা? মেয়েটা কে? বাসা কোথায়?
'সে বিদেশী মেয়ে?
'ইনক্রিডিবু্যল?
'কাকে আগে বিয়ে করেছেন?
'বিদেশিনীকে৷
'তোমাকে বিয়ে করলেন কেন?
'জানি না৷ আমি তাকে ভালবেসেছিলাম৷
'বুঝতে পেরেছি৷
'তুমি তার সাথে মেলামেশা করনা?
হৃদি চুপ করে রইল৷ ওর চোখ থেকে হঠাত্‍ বৃষ্টির মত পানির ঢল নামলো৷
'এটা জানতে চাচ্ছ কেন?
কনক হৃদির প্রশ্ন এড়িয়ে গেল৷
'তারপর?
'ভালবাসা কি ভাগ করা যায়? বুঝার পর থেকে ওকে আমার কাছে আসতে দেই নি৷
'তুমি একদিন বলেছিলে ব্যাংক গিয়ে থেকে আস?
'বাসার সবাই জানে আমি ওর ওখানে গিয়ে উঠি৷ সেটা মিথ্যে৷
'সত্যিটা কি?
'আমি অন্য হোটেলে গিয়ে উঠি৷
'উনি কি বলেন?
'সেটা তোমাকে বলতে পারবো না৷
'তুমি কি বল?
'আমি শুধু কাঁদি৷
'যে প্রতারণা করেছে তার জন্য চোখে পানি আসে কেন?
'আমার ভালোবাসা আমাকে প্রতারিত করল কেন?
'যে প্রতারিত করল তার জন্য চোখে পানি আসে? নাকি ভালোবাসার জন্য?
'জানি না৷
'তাকে ফিরে পেতে চাও?
'জানি না৷
'আমি ভালোবাসা ফিরে পেতে চাই৷
'তোমার শ্বাশুড়ীকে পুরো ঘটনা খুলে বল ৷
'এতদিন পর তাঁকে কিভাবে বিশ্বাস করাবো? তাছাড়া এ খবর শুনলে উনি শক্ড হবেন৷ দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে৷
'ননদকে বল৷
'ভাবছি কি করব?
'কি করবে?
হৃদি চুপ করে রইল৷ ইতমাম বাসায় একজন আদর্শ সুপুরুষ৷ অতীতের একজন আদর্শ ভাল ছাত্র৷ মা'র কাছে টাকা পাঠানোর সবচেয়ে পটেনশিয়াল প্রেরক- সুসন্তান! সেই সুসন্তানের কথা তার মা'কে কিভাবে বলব? হৃদির এগুলো ভাবনা হচ্ছে৷ সে কথা বলতে পারছে না৷
'হৃদি চুপ করে আছ কেন? বোমার মত ফেটে পড়?
হৃদি জলের ভার চোখে নিয়ে বলল, 'ডাল ভাংগা ফুল কি চিরদিনের জন্য শুকিয়ে যায়? ডালটাকে ভালো করে দেয়া যায় না?
কনক বলল, 'জানি না৷
'কনক আমি তোমাকে ভালবাসি৷
সে এবারও চুপ করে রইল৷
'কনক আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন?
কনক ওর দু'হাতে হৃদির দুই পাশ থেকে দুই তিন বার জোরে জোরে ঝাঁকি দিল৷
'হৃদি?
হৃদি চোখে জল নিয়ে কনকের দিকে তাকাল৷
'তুমি ভাল মেয়ে৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷ ভালবাসা তোমাকে কাঁদাবে!
'উঠ৷ হাটব৷
'আমি হাটতে চাই না৷ তুমি না বলেছিলে মানুষের মৃতু্য পা থেকে শুরু হয়! আমার মৃতু্য শুরু হোক পা থেকেই৷
কনক হাত এগিয়ে দিল৷ হৃদি কনকের হাত ধরল৷ হৃদির নরম হাতের তালু৷
'কনক তুমি আমাকে পছন্দ কর না?
'আমি একজন বখাটে হাজতবাসী ! আমার মন আছে?
'কনক, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো তুমি আমাকে পছন্দ কর না৷
হৃদির চোখের দিকে তাকানো হলো না৷
'হৃদি সামনে হাট৷ দু'টো বেজে গেছে অমা চলে আসবে৷ সে কনকের হাত থেকে নিজের হাত গুটিয়ে নিল৷
'অমা আজ আসবে না৷

নিঃশ্চুপ পরিবেশ৷ হৃদি নীরবতা ভাঙলো৷
'কনক, আজ যে জন্য আমি তোমার সাথে বেরিয়েছি সেটা বলা হয়নি৷
কনক হেসে উঠল, 'হা হা হা ...,
'এতক্ষণ কি বললে?
'সুযোগ পেয়ে স্বার্থপরের মত নিজেকেই বলে ফেললাম৷ আমি ইদানীং নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না৷
জমে থাকা পানি নীচে নামার জন্য সব সময় পথ খুঁজে৷ হৃদির চোখে আবার পানি টলমল করে উঠল৷
'সত্যি, ননদ অমার কথা বলার জন্য আজ তোমার সাথে বেরিয়েছি৷
'হৃদি, কান্নাকাটি দেখতে আমার ভাললাগে না৷
হৃদি চোখে ওড়না চেপে ধরে মাথাটা দু'তিন বার ঝাঁকি দিল৷ দ'ুচোখের পাতা মুছে নিয়ে বলল, 'অমা রাশুকে বিয়ে করতে চায়৷ রাশুকে ও খুব ভালবাসে৷
'অমা তোমাকে বলেছে?
'হ্যাঁ৷
কনক ওর সাইফনিং মার্কা হাসি দিয়ে পরিবেশটা কাঁপিয়ে তুলল৷ হৃদি এটাকে ভারী করে রেখেছিল ৷
'হাসির কি কিছু বলেছি?
'আমরা দুজনই এখন ট্র্যাপে পড়ে গেছি?
'হয়েছে ! হৃদির ঠোঁটে হাসির একটু রেশ ফুটে উঠল৷
'ননদের কথাটা রাশুকে একটু বলবে?
কনক আবার হাসল৷ হা হা হি-----
'তুমি এত নির্মল সুখের হাসি হাসো কিভাবে?
'প্রশংসা করতে হবে না, আমি তোমাকে এমনি খুব ভালবাসি৷
'রাশুর কোন মেয়ের সাথে কোন এফেয়ার টেফেয়ার আছে?
'রাশুর সাথে মেয়ে লোকের এফেয়ার?
'হৃদি তুমি ইভোলুশন থিউরী জান? জিরাফের ঘাড় এত লম্বা হয়েছে কেন জান?
'কেন?
'জিরাফ-ভুমিতে এক সময় ঘাস শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ উঁচু গাছের পাতা খেতে হবে৷ ঘাড় ছোট হলে গাছের পাতা খাওয়া যায় না৷ বেঁচে থাকতে হলে ঘাড় লম্বা হতে হবে, ঘাড় ধিক্ ধিক্ করে উপরের দিকে উঠানোর অভ্যাস করতে হবে৷ জিরাফ তাই করল, তার ঘাড় লম্বা হল৷
'জিরাফের কথা আসছে কেন?
'প্রেমিক হিসাবে ওর কোন ইভোলুশন হয়নি৷
হৃদি হাসছে৷
'মেয়েদের সাথে ও কথা বলতে পারে না৷
'মেয়েদের সাথে কথা বলার অভ্যাস না থাকলেই সব ঠিক? এরা মিনকা হয়৷ ওরা দেখায় কম কাটে বেশী৷ কেটে সব কিছু ছিন্নভিন্ন করে ফেলে৷
'তা ঠিক৷
'কনক ব্যাপারটা তুমি অন্যভাবে নিবে না৷ আমার জীবনটা কেমন হয়েছে? আমি কি চাইব প্রিয় মানুষটির জীবনটা আমার জীবনের আর একটা কপি হোক?
'রাশু ভাল ছাত্র, ভাল মানুষ৷
'ও কি আমার ননদকে পছন্দ করবে?
'সেটা বলতে পারব না৷
'কনক আমার একদম ভাল লাগছে না৷ কেন খারাপ লাগছে সেটা বুঝাতে পারব না৷ চলো ফিরে যাব৷
'গল্প শুনবে?
'গল্প শুনার অবস্থা এখন আমার আছে?
'শোন মন ভাল হয়ে যাবে৷
'গল্পটার নাম 'এ থান্ডারবোল্ট ফ্রম এ লেডি'৷
'শুনবে?
'বলো?
'স্থানঃ জিরো পয়েন্ট অফ বাংলাদেশ __ জিপিও-র সামনে ৷ হঠাত্‍ আকাশে কালো মেঘ৷ তুফান আসবে মনে হল৷ এসেও গেল৷ সাথে বড় ফোটার বৃষ্টি শুরু হল৷ ঘন্টা খানেক বৃষ্টি হল৷ রাস্তা ঘাট পানিতে ডুবে গেছে৷ এক যুবক জিরো পয়েন্ট থেকে পশ্চিম দিকে আসছে৷ সে সামনে তাকাল৷ এক অপূর্ব সুন্দুরী মেয়ে তার দিকে আসছে৷ বৃষ্টি ভেজা শরীর৷ জামা আটসাঁট হয়ে গায়ে আটকে আছে৷ ভেজা চুল৷ মুখের উপর চুল৷ পানির ফোটা তাদের গাল বেয়ে নীচে পড়ছে৷ আকাশে জোয়ার! মেয়েটার শরীরেও জোয়ার এসেছে! যৌবনের উন্মত্ত মাদকতা তার হাঁটায়, বুঝলে?
'হু বলে যাও?
কনক বলল, 'এমনভাবে হু বললে গল্প বলা যায় না৷ হু তে জোর থাকতে হয়৷
'বলো৷
'মেয়েটা কাছে এলো৷ যুবকটার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে৷ কি রাখবে? কি বলবে? স্থির করতে পারছে না৷ মেয়েটা একদম কাছে চলে এসেছে৷ পাঁচ হাত, তিন হাত৷ আর মাত্র মাত্র এক হাত! এবার সে মেয়েটাকে বলল, এই যে শু...
'শু... কি?
'শু ... মানে, সে শুনন বলতে চেয়েছিল৷
মুহূর্তেই সে আবার বলল, 'এক্স?
'এক্স কেন?
'এক্সকিউজ মী'র এক্স৷ সে এক্সকিউজ মী'র পুরোটা শেষ করতে পারেনি৷
'একটা ঘটনা ঘটে গেল৷
'কি-ই?
ছেলেটা প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল৷ 'এক্স' বলার সাথে সাথে লে হালুয়া ! এ থান্ডারবোল্ট অন হিজ হেড! সে রাস্তার আঠার ইঞ্চি আইল্যান্ড থেকে ঠাস্ করে সে নীচে পড়ে গেল৷ পাশে কনষ্ট্রাকশনের কাজ চলছিল৷ সে ভেবেছিল জগন্নাথ হলের মত তার মাথায় ছাদ ভেঙ্গে পড়েছে৷ রাস্তার ময়লা পানিতে পরে ইশ্ ইশ্ শব্দ বেরুচ্ছে তার মুখ দিয়ে৷ তারপর ভল্টারিন ইনজেকশন খেতে ঢাকা মেডিকেলের জরুরী বিভাগে যেতে হয়েছিল৷

হৃদি ওর হাসি থামাতে পারছে না৷ হাসি নিয়ন্ত্রনের বাইরে গেলে ঐ হাসি আর ভাললাগে না৷ মনে হয় শিম্পাঞ্জী হাই তুলেছে৷ কিন্তু হৃদির হাসি অন্যন্য৷ যত হাসে মনে হয় হাসির ততো জোত্‍স্না খসে পড়ে হৃদির মুখ থেকে৷ আরো হাসি আরো জোত্‍স্না৷ জোত্‍স্নার প্লাবন চূইয়ে চূইয়ে পড়ছে৷ কনক তন্ময় হয়ে হৃদির হাসি দেখছে৷
'হৃদি থামো!
'কনক তোমার গল্পটার কিছু অসম্পন্ন অংশ আছে৷
'কি রকম?
'মেয়েটার গায়ে বড় সাদা ওড়না পেঁছানো ছিল৷ বৃষ্টিতে সারা শরীর ভিজে তার হাঁটায় সমস্যা হলো৷ ভিজে শরীর থেকে সে ওড়নাটা সরিয়ে ফেলল৷ এমন সময় কড়্ কড়্ মট্ মট্ শব্দে কান ফাটা একটা আকাশভাঙ্গা বজ্রপাত হলো! ছেলেটা মাথায় হাত দিয়ে রাস্তার পানিতে ধড়াশ্ করে পড়ে গেল৷্ ওই দিন টা ছিল মেয়েটার বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.ফিলের তৃতীয় দিন৷ বৃষ্টিতে গাড়ী নষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ তাই সে হেটে হেটে জিপিও থেকে যাত্রাবাড়ীর বাস ধরে বাসায় পেঁৗছেছিল৷
'হৃদি কি বলছ? পরিস্কার করে বল৷
'ওই মেয়েটা ছিল হৃদি৷
'গল্পের ওই ছেলেটা কনক তুমি ছিলে?
কনক হা হা করে হেসে ইঠলো৷
'ওহ্ মাই গড৷
হৃদির চোখমুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে গেল৷
'রাশুকে অমার ব্যাপারটা প্রপোজ করবে? আমার ননদের মানসিক অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে৷ অমার হাসিখুশী ভাবটা মিলিয়ে গেলে আমার খুব সমস্যা হবে৷
'আমি বলব তবে রাশুকে ইনসিষ্ট করতে পারব না৷
'ইনসিষ্ট করতে বলছি না৷
'হৃদি উঠ তোমার ড্রাইভার কায়েসের সময় হয়ে গেছে৷

হৃদি আর কনক মামুর দোকানে এলো৷ কায়েস গাড়ী নিয়ে বসে আছে৷
কনক গাড়ীর কাছে এসে বলল, 'কি কায়েস ভাল আছ?
'জি স্যার৷
'আজ একটু হাটতে বেরিয়েছিলাম৷ ত্রিশ মিনিট লেট করিয়ে দিলাম৷
'অসুবিধা নেই স্যার৷ ঠিক আছে স্যার৷ স্যার আসি৷
হৃদি গাড়ীর ভিতর থেকে হাত নেড়ে বিদায় দিল কনককে৷
কনকও বাম হাত উঠিয়ে আংগুল নাড়াল, 'গুড বাই৷

রাশু জিপিও থেকে ফিরে আসে নি৷ কনক মামুর দোকানের বেঞ্চে বসল৷ কনকের অভ্যাস- একধ্যানে তাকিয়ে থাকবে কিছু কিছু ছোট জিনিসের প্রতি৷ হাত-মুখ হাটুর উপর ভর করে নিষ্পলক চোখে কনক পাশের বেঞ্চের নীচে পড়ে থাকা এক খন্ড ইটের খোয়ার দিকে তাকিয়ে আছে৷ কনকের এই অভ্যাসটা আগে অতটা ছিল না৷ ইদানীং বেড়ে গেছে৷ এখনকার চিন্তাগুলো এমন হলো ঃ

১৷ হৃদি অপূর্ব সুন্দরী৷ হৃদির কথায়-ই সে খুব অসুখী৷ কি হলো? হৃদির সৌন্দর্য+সুখ (বাইর থেকে সবাই যা দেখে)/ হৃদির মনের হাহাকার+হৃদির প্রতি স্বামীর ভালবাসাহীন ভোগ (বাইর থেকে সবাই যা দেখেনা)৷ লব ভাগ হর৷ সমান সমান এক৷ কি হলো?

২৷ আমি কনক পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা একজন মানুষ৷ আমার আকার যদি এক ন্যানো মিটার (এক ন্যানোমিটার = ১০-৯ মিটার) হত? সাইজ রেশিওতে ইটের এ খোয়াকেই মনে হত বিশাল এক পর্বতশ্রেণী৷ খোয়াপর্বতকে ডিংগাতে আমার বছরের পর বছর সময় লাগত৷ এক পিকো মিটার (এক পিকো মিটার = ১০৩ ন্যানোমিটার) আকারের এক হাজার জীব আমার শরীরে ধরত৷ কনক নিজে নিজে নিঃশব্দে হাসল৷ ব্যাপারগুলো কত আপেক্ষিক?

৩৷ হাজতের সেই হিরোঞ্চি? মানুষের জীবন কি?
মানুষ + হিরোইন = ?
হিরোইন + ? = পশু
প্রশ্নের উত্তরগুলো জানা দরকার৷ এজিএম হান্নানের কাছে উত্তরগুলো থাকতে পারে৷ তিনি মাঝে মাঝে এমন কিছু বলেন যে কথাগুলো কোটেশন হিসাবে রেকর্ড করে রাখা উচিত৷
৪৷ ক্লাসমেট কাম বন্ধু মালেক? সোনার কাঠি মুখে নিয়ে ও জন্মেছে৷ ওর কিছু ভালো লাগেনা৷ কি হলো? সোনার কাঠি মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া + পকেটে টাকা গিজগিজ করা / পাঁচতালা থেকে তার ঝাঁপ দেয়া + সে চেষ্টায় একপা ভেংগে গুঁড়ো ছাঁতু হয়ে ন'মাস বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকা৷ মাথায় কিছু ঢুকে না! ওখানকার অবস্থা আরো সিরিয়াস৷ ফাইনালী কি হলো?
যন্ত্রনা!
মামু কনকের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ৷
'কনক স্যার আজ কি বিশেষ কোন সমস্যায় আছেন? স্যার এতক্ষণ চুপ থাকার কথা না?
মামু জিজ্ঞাস করল, 'স্যার কিছু খাবেন?
কনকের সম্বিত্‍ ফিরে এল৷ ফাইনাল কনক্লুশনে কিছুই পাওয়া গেল না৷ তার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুল৷
'কিছু খাব না৷ মামু, রাশু ডট চৌধুরী ওরা এসেছিল?
'না৷
'ওরা এলে বলবেন আমি ভিতরে আছি৷
'বলব৷

দুপুরে লাঞ্চ করতে দেরী হয়ে গেছে৷ কনক, রাশু, ডট চৌধুরী আজ মামুর হোটেল ইটালিয়ায় খেতে বসল৷
এ তিনজন একসাথে খেতে বসলে মামুর হোটেলটা খুব সরব থাকে৷ ওদের বাস্তব-তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতাপূর্ণ ঘটনাগুলোর রিভিউ-আলোচনা হয়৷ মামু উদগ্রীব হয়ে কখন কি কথা হয় শুনেন৷ তখন মনে হয় ওদের আলোচনার উপর মামুর বার্ষিক পরীক্ষা আছে৷ পরীক্ষার খাতায় ওদের আলোচনা না লিখতে পারলে পরীক্ষায় ফেল!
খাওয়া দাওয়া শেষ হলো৷
মামু বলল,
'স্যাররা পান খাবেন?
মামু মাঝে মাঝে ফ্রি পান খাওয়ার অফার দেন৷ শুধু কনক বলল, ' দেন৷
কনক পান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, 'ডট চৌধুরী তুই চলে যা৷ আমি রাশুর সাথে বাইরে যাব৷
ডট চৌধুরী চলে গেল ৷

কনক রহস্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে র'ল৷
'কি দেখছিস্?
'রাশু তোর মনটা আজ কেমন?
'ভালো৷ খুব ভালো!!
রিকসায় উঠ্৷
'কোথায় যাওয়া হবে?
'কোন দিকে না৷ যে দিক ইচ্ছে যাওয়া যাবে৷
ওরা রিকশায় উঠল৷ রিকশা চলছে উদ্দেশ্যহীনভাবে৷
'রাশু তোকে একটা বিশেষ কথা বলার জন্য সাথে নিয়ে বেরিয়েছি৷
'বিশেষ কথা বলার জন্য? কি কথা?
'অমাকে তোর কেমন লাগে?
'হৃদির ননদ অমাকে? ভালো লাগে৷ চৌখুস মেয়েরে! খুব স্মার্ট৷ খুব ভালো লাগেরে!!
'ওকে বিয়ে করবি?
রাশুর মনের মধ্যে জীবনে প্রথমবারের মত একটা বিদু্যতের ঝলক বইয়ে গেল৷ এই ঝলক বাইরে থেকে দেখা যায় না৷ রাশু বিশেষ কিছু অনুভব করল৷ সে উত্তেজিত হয়ে বলল,
'হৃদি তোকে বলেছে?
'হঁ্যা৷
'কি বলেছে?
'অমা তোকে ভালবাসে৷ সে তোকে না পেলে পাগল হয়ে যাবে?
'আরে বলিস কি? তাই নাকি? এক ডালে দুই পাখি!! দারুন তো!
'এত গাবান দিও না? এতো দেখি মেঘ জমার আগেই বৃষ্টি?
'উঁয়ু খুব ভালো লাগছেরে!
'রাশু ভেবেচিন্তে কথা বলবি৷ তোর মতামত হৃদিকে জানাতে হবে৷
'কনক এডভাইস মী৷ এ মুহুর্তে বিয়ের কথা বাবামাকে প্রপোজ করাটা কেমন হবে?

রাশু জিপিও থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর সাথে করে নিয়ে এসেছে৷ সে আমেরিকায় স্কলারশীপ পেয়েছে৷ ওর মনে আশার আলো জ্বলজ্বল করছে৷ কনককে স্কলারশীপের খবরটা এখন পর্যন্ত দেয়া হয়নি৷ ওকে কি সে কথা বলা উচিত না?
'কি ব্যাপার রাশু চুপ হয়ে গেলি? কনক রাশুকে পাশে আস্তে করে ধাক্কা দিল ৷
'কনক রিকশা থামা৷ কনক রিকসা থামাল৷
'নাম্৷
'কেন সিগারেট খাবি?
'দে৷
'চল ফুটপাতে বসবো৷
রাশু আর কনক ফুটপাতের আইল্যান্ডে বসল৷
সিগারেটে লম্বা করে দু'তিন বার টান দিয়ে রাশু বলল, 'তোকে একটা কথা বলা হয় নি৷
প্রতিটি মানুষের একান্ত একটা আলাদা ভুবন আছে৷ যে ভুবনের খবর সে ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ জানে না৷ রাশুর কি এটা আছে?
'ওর কোন এফেয়ার আছে কিনা? কনক সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হৃদির এ কথাগুলো ভাবছে৷ রাশু কি তা হলে বুক্ড?
কনক বলল, 'কি কথা দোস্ত?
'আমি কিভাবে তোর কাছে প্রেজেন্ট করব সেটাই ভাবছি?
'আমি কি সারপ্রাইজ্ড হব?
'হঁ্যা৷
'হৃদির কথা পুরোপুরি ঠিক? শালা! তলে তলে পানি সবাই খায়৷ এ পানি খেতে প্রাকটিস করতে হয় না৷ মেয়েদের সাথে কথা বলার অভ্যাস থাকতে হয় না৷
'রাশু তুই কি বলতে চাস্ বল্?
'ফ্যাক্স এসেছে৷ আমি হনলুলু ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশীপ পেয়েছি৷
কনক সিগারেট ফেলে দিল৷
'ই--------য়---------আ !!!!!
সে রাশুকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরল৷
'এ খবর!! আমাকে এখনও বলিস নি? আমার খুব খুশী লাগছে৷
'খুশীতে নাচ৷ খবরটা তোকেই প্রথম বললাম৷
'চাচা-চাচীকে বলিস নি?
'এখনও বলিনি৷
'বাসায় যা৷ ওনাদেরকে তাড়াতাড়ি বল৷
'হঁ্যা বলব৷
কনক রাশুর পিঠে একটা চড় বসিয়ে দিল৷
'তোকে একটা কথা বলেছিলাম না?
'কি যেন বলেছিলি?
'আমাদের সবকিছুই হবে৷ তবে ভাঙচুর হওয়ার পর৷
'হু,ঁ আমাদের কপালে স্মুথলী কিছু আসে না৷ খুব কষ্ট দিয়ে আসে!
রাশু বলল, 'দোস্ত উঠ৷ আজ অনেক রাত পর্যন্ত রিকশায় ঘুরব৷

কনক রাশু আবার রিকসায় চাপল৷ প্রায় দু'ঘন্টা রিকশা চলছে দিকবিদিক৷ রিকশায়ালা তার ইচ্ছেমত চালাবে৷
রাশু বলল, 'কনক, আমি অমাকে বিয়ে করব৷
'সেটা তোর ডিসিশন৷ আমি হৃদিকে বলেছি৷ তোকে ইনসিষ্ট করব না৷
'রাশু কাল ইউনিভার্সিটিতে যাবি?
'না৷ এম্বাসীতে যাব৷ আমার ডিপার্চার-প্রিপারেশন নিতে হবে৷
'তুই হৃদিকে বলবি৷ আমি অমাকে নিয়ে সিরিয়াসলী ভাবছি৷
'রাশু মিষ্টি খাবি? তোকে আমি মিষ্টি খাওয়াব৷
ওরা রিকসা থামালো একটা মিষ্টির দোকানের সামনে৷ টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চম চম৷ ঢাকায় বানালে সেটাও টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চম চম? টমটম গাড়ীতে করে ঘোরার ইচ্ছে করেছ৷ চমচম যে কোন জায়গার হলেই চলে! মন চনমন করছে৷ ওরা একটা মিষ্টির দোকানে বসলো৷ নাম রসমুঞ্জুরী৷
কনক বলল, 'বোস৷ যত পারিস খা৷
'হঁ্যা খাব৷
'মুক্তাগাছার মান্ডাও খা৷ নাটোরের কাঁচা গোল্লা নিই৷ রসমুঞ্জুরী খা৷ মুখে লাগলে রসে টস্টস্ করে৷ শেষে মামা হালিম দিয়ে শেষ করব৷ মাংশের চাপ খাবি?
রাশু বলল, 'আজ সব খাওয়া হবে৷
রাশু-কনকের মুখ হাসিতে ছেঁয়ে আছে৷ মানিকজোরের এ সুখ দেখে কে?
'কনক, তুই তো দেখি আমার চেয়ে বেশী টানছিস৷
'হলো একই কথা৷ একজন বেশী খেলেই হলো৷
'রাশু, খেয়ে বাসায় মিষ্টি নিয়ে যা৷
'পকেটে টাকা নেই৷
'নো প্রবলেম৷ আমি কর্জ দিচ্ছি৷

রাশু তিন কেজি চমচম নিয়ে রাত এগারটায় বাসায় ফিরল৷ মনটা খুশী খুশী৷ পারলে উড়া যেত৷ পাখা নেই যে!
দরজা খুলে দিয়েই ছোট বোন রেশমা বলল, 'তুই মিষ্টি কিনে আনলি? ভাইয়া তোর বিয়ে নাকি?
'যা পিচ্চি! আন্দাজে কথা বলিস!
'মিষ্টি খাবি?
'খাব৷
'হা কর৷
রাশুর রেশমার মুখে মিষ্টি ভরে দিল৷ উম্উম্ শব্দে রেশমা মিষ্টি গলাধঃকরন করল৷

রাশুকে বিদায় দিয়ে কনক বাসায় এলো৷ বাজার করার কথা থাকলেও সে খালি হাতে ফিরেছে৷ বাজারের টাকায় সে রাশুকে মিষ্টি কিনে দিয়েছে৷ হাতে টাকা নেই৷

মিষ্টি গভীর রাতে কিনে নিয়ে আসার জিনিস না৷ রাত সাড়ে এগারোটায় রাশু মিষ্টি কিনে বাসায় এসেছে৷ নিজ থেকে মিষ্টি ধরনের কিছু কিনে বাসায় ফেরা রাশুর জীবনে আজ প্রথম৷ সো কনগ্রেচুলেশনস!! দেরিতে বাসায় ফিরে রাতে ঠান্ডা খাবার খায়৷ বিতৃষ্ণা আর বীতশ্রদ্ধ মন নিয়ে বিছানায় যায়৷ আজ ঠান্ডা খাবার খেলেও ওর মন খুব ভাল৷ মনে হয় পেট পুরে বিরানী খাওয়া হয়েছে৷ তৃপ্তির ঢেকুর আসতে চাচ্ছে৷ বিরানী না খেলেতো আর ঢেকুর আসে না? পেটে রসমুঞ্জুরী পড়ে আছে৷ অসাধারন একটা তৃপ্তির ছায়া রাশুর চোখেমুখে৷

রাশু বিছানায় শু'তে গেল৷ তার সমস্যা হচ্ছে৷ অন্যদিন শু'লে পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যে ঘুম চলে আসে৷ আজ তার ঘুম আসছে না৷ রাশু সময় দেখল৷ রাত একটা৷ মনের ভিতর উঁশপিশ করছে৷ দেড়হাত বাই সাতহাত বারান্দায় প্রস্থের টিন-শেডের একটা বারান্দা আছে৷ রাশু বারান্দার নেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ খালি বারান্দায় ভাংগা টবে দেড় হাত একটা গাছ লুলা মানুষের মত মাঁজা বাঁকা করে দাঁড়িয়ে আছে৷ মানিপ্ল্যান্টের গাছ৷ গাছটা বাঁচেও না আবার মরেও না৷ গাছটা রেশমা ফেলে দিতে চায়৷ রাশু নিষেধ করে৷ থাকুক না? মধ্যবিত্ত ঘরের অনেক কিছুই আধামরা হয়ে বেঁচে থাকে৷ ভাঙ্গা হয়৷ এটা নতুন কোন ব্যাপার না৷
রাশু মানিপ্ল্যান্টের টবের পাশে বসল৷ হাত দিল ওটার গায়ে৷ একটা পাতা ধরল৷
'এই গাছ বিদেশে যাবি?
'আমি যাব৷
'ঐ দেশের গাছকে নাকি শীতে লেপকাঁথা দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়? ঝড়ে ঠিকনা দেয়া হয়! ওরা শীতবৃষ্টি ঝড়ে মাটিতে নুঁইয়ে পড়ে না৷ কষ্ট পায় না৷ তোর মত আমারও অনেক কষ্ট হলো ! কষ্ট আর কষ্ট!!! বিষন্ন সকাল বিষন্ন দুপুর বিষন্ন রাত৷

গতরাত পর্যন্ত রাশুর মন খারাপ-ই বেশী থেকেছ৷ সকালে বাসা থেকে বেরুনোর সময় মন বেশী খারাপ দেখলে ওর মা রৌশনারা বেগম বলতেন, 'বাবা আজ তুই সকাল সকাল ফিরে আসিস৷ মা-বেটা দু'জন গল্প করব৷
রাশু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরত৷ রৌশনারা বেগম ছেলেকে নিয়ে এ বরান্দায় গল্প করতে বসতেন৷
কথাতেও নাকি নেশা আছে? ওর মা'র বলা প্রতি রাতের গল্পের কথাগুলো রাশুর মাথায় ক্যাসেটের ফিতার মত বাঁজত৷ রাশু নেশার মত ওগুলো শুনতো৷
'আম্মা আমি দেশের এই লম্বা হায়ার এডুকেশন শেষ করব না৷
'কেন?
'একটা চাকুরী নিয়ে তোমাদের ঋণ শোধ করব৷
'এমন লক্ষিছাড়া কথা কোন দিন বলবি না৷ কখনো না! তোকে নিয়ে আমার আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন আছে৷
'আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন আমাকে নিয়ে?
'বাবা, বড় হতে হলে কাউকে না কাউকে তো বামন হতেই হয়! কষ্ট পেতেই হয়!
'আম্মা আমার কষ্ট তুমি বুঝতে পার?
'বুঝতে পারি৷ তোকে টাকার জন্য বড় হতে হবে না৷ তোকে আমার সুসন্তান হতে হবে৷ তোকে নিয়ে আমি যে স্বপ্ন দেখেছি তা মিথ্যে হতে পারে না৷

বরান্দায় এই গভীর রাতে রাশু তার মা'র কথাগুলো ভাবতে থাকল৷ সে বারান্দার গ্রীলে নাকমুখ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷

'রাশু, তখন তোর বয়স কেবল দু'বছর৷ আমি গ্রামে তোর নানার বাড়ি আর তোর আব্বা ঢাকায় থাকেন৷ তোর নানা তোকে সাদা ধবধবে একটা সার্ট কিনে দিয়েছিলেন৷ ওটা গায়ে পরিয়ে আমাদের পুকুর পারের আমগাছের নীচে বেঞ্চে বসে তোকে কোলে নিয়ে খেলছি৷ আমের বোলের দিন৷ গুঁড়িগুঁড়ি আমের বোল ফুটেছে গাছে৷
দুপুরের পরের রোদ৷ আমরা বসে থাকা জায়গাটায় হঠাত্‍ ছায়া পড়ল৷ আমি দাঁড়িয়ে আকাশে তাঁকালাম৷ একখন্ড নীল মেঘ দুল দিতে দিতে নীচে নেমে আসছে৷ মেঘটা আমার বুক বরাবর নেমে এলো৷ আমাকে আরো আশ্চর্য করে দিয়ে সেই মেঘ খন্ডটা বলল,
'রৌশনারা, তোমার রাশুর সার্টটা খুলে আমাকে দাও৷ আমি তোর সার্টটা খুলে মেঘটাকে দিলাম৷ মেঘ ওটাকে নীল করে দিয়ে হেসে হেসে উড়ে গেল৷ মেঘ কথা বলছে! মেঘ কাছে পেয়ে তুই খিলখিল করে হেসে দু'হাত ছুঁয়ে দিচ্ছিলি৷ আমার যে কি ভাল লাগছিল বাবা! আমি সে অনুভুতির কথা বর্ণনা করতে পারি না৷

কি-ই অশ্রুতপূর্ব স্বপ্ন! রাশুর মেঘ ছুঁয়ে দেয়ার এস্বপ্নটা রৌশনারা দেখেছিলেন৷ স্বপ্নেটির কথা রাশুকে বলতে গিয়ে তাঁর চোখে পানি আসে৷ তখন তাঁর মনে কি এক অজানা আবেশ! স্বপ্নটার কথা তিনি এ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাশুকে দু'বার বলেছিলেন৷ দ'ুবারই কেঁদেছিলেন৷ এমন সুন্দর স্বপ্ন মানুষ দেখে!
'আম্মা এ স্বপ্ন কেন দেখেছিলেন? রাশুর চোখ পানিতে ভিজে উঠেলো৷ সে সিগারেট ধরাল৷ অন্ধকার বরান্দা৷ সিগারেটের ধূঁয়ো হাত দিয়ে তাড়াতে দু'তিনবার থাপ্পর দিল৷ ধঁূয়োকে থাপ্পর দিলে ওর আয়তন বাড়ে৷ ধূঁয়ো ছড়িয়ে পড়ল আগের চেয়ে বেশী আয়তনে৷
বারান্দায় রাশুর খচখচ শব্দে রেশমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে৷
রেশমা চুপিসারে উঠে জানালার কাছে গেল৷
'উঁয়ু গন্ধ!
দরজায় নিজেকে আড়াল করে সে তাকিয়ে রাশুকে দেখছে৷
'এত রাতে চোরের মত এখানে সিগারেট টানা হচ্ছে?
রাশু এলোমেলোভাবে মাথার চুল চেপে চেপে টানছে৷ মাঝে মাঝে কানের ভিতর আংগুল ঢুকিয়ে মনে হয় কানের তালা লাগান ছাড়াচ্ছে৷
'ভাইয়া এত অস্থির হয়েছে কেন?
রাশু অনবরত সিগারেটের ধূঁয়ো ছাড়ছে৷ রেশমা এখন রাশুর পিছনে দাঁড়িয়ে৷ একটা শেষ করে রাশু আরও একটা সিগারেট ধরাল৷
রেশমা হঠাত্‍ বলে উঠল, 'ভাইয়া তোর কি হয়েছে?
রাশু চমকে উঠল৷
'কে কে কে?
'ভাইয়া আমি৷ তুই এমন করছিস কেন? তোর কি হয়েছে?
'কিচ্ছু না! তুই ভিতরে যা!
'তুই কাঁদছিস কেন?
'মন চাচ্ছে তাই কাঁদছি৷ তুই ভিতরে যা!
'কাঁদতে সিগারেট লাগে?
'হঁ্যা, আমার সিগারেট লাগে!
'দাঁড়া তোকে সিগারেট খাওয়া দেখাচ্ছি, বলেই রেশমা বলে উঠল, 'আ..ব..বা! আ..ব..বা?
রাশুর বাবা ঘুমের ঘোরেই বলে উঠলেন, 'হুঁ-উ----য়ুঁ !
রাশুর হার্ট ঢক করে লাফ দিয়ে উঠল৷ সে জ্বলন্ত সিগারেটটাকে চেপে বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে বিড়ালের মত পা টিপে ঘরে ঢুকল৷ রেশমা আগেই ঘরের ভিতর চলে গেছে৷ একই ঘরের হার্ড বোর্ডের পার্টিশন দেয়া অন্য প্রান্তে রেশমার বিছানা৷ মাঝখানে ছোট দরজা কাটা৷ রেশমা শুয়ে আছে৷ মোশারফ সাহেব রেশমাকে ডাকলেন, 'রেশ..ম..আ..কি হয়েছে?
'আব্বা কিছু হয় নি৷
ঘুম আর বিরক্তি মিশানো গলায় মোশারফ আহমেদ সাহেব বললেন, 'শয়তানরা এত রাত্রে কি-ই করে?
রাশু রেগে নিঃশব্দে জ্বলে উঠল৷
'সকাল হোক, তোকে আব্বা ডাক দেওয়া দেখাব৷

বিছানায় গিয়ে তার আর এক চিন্তা শুরু হলো৷ বিষয় অমা৷ রাশু অমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে হাবুডুবু খাচ্ছে৷ সিগারেটের ধোঁয়োয় মুখটা তেতো লাগছে৷ সারাদিন অনেকগুলো সিগারেট টানা হয়ে গেছে৷ রাশু আবার উঠল৷ অন্ধকারে একগ্লাস পানি দিয়ে শব্দহীন গার্গল করল৷ রাশুর আজ ঘুম সহজে আসছে না৷ এটা এক ধরনের উত্তেজনা৷

সকালে রাশু ঘুম থেকে উঠে দেখল রেশমা নিজের ঘরে নেই৷
রাশু ডাক দিল, 'রেশমা?
রৌশনারা বেগম বললেন, 'ওকে ডাকছিস্ কেন? রেশমা তোর আব্বার ওখানে পড়ছে৷
'আজ ওখানে পড়ছে কেন?
'জানিনা বাবা৷ তুমি জিজ্ঞাস কর গিয়ে?
'রেশমা? রেশমা? রাশু হাক ছেড়ে রেশমাকে ডাকছে৷
রেশমার সারাশব্দ নেই৷
রাশু ওর বাবার ঘরে গেল৷ রাশুকে দেখেই রেশমা বলল, 'ভাইয়া আমি অংক করছি৷ পাটি গণিতের অংক৷ আব্বা আমাকে করাচ্ছেন৷ তুইতো জানিস আব্বা অংকে খুব ভালো৷
মোশারফ আহমেদ বললেন, 'ওকে ডাকছিস কেন? তোর কি হয়েছে?
'এমনি আব্বা৷
'এমনি কেউ ডা---কে? রাশুর বাবার মুখ বিরক্তিতে ভরা৷
রাশু তার বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাঁকে বলল, 'আব্বা তুমি অফিসে কখন যাবে?
'আধঘন্টার মধ্যে৷
'আজ আধঘন্টা পরে গেলে খুব অসুবিধা হবে?
'কেন? তোর কোন সমস্যা হয়েছে? রাতে ঘুমাস নি? চোখ লাল কেন?
'সমস্যা না৷ একটা সাবমিটিং আছে- এবাউট এ গুড নিউজ৷
'চাকরি পেয়েছিস নাকি?
'তা না৷
তিনি এবার নিস্পৃহ গলায় বললেন, 'তাহলে আর কিসের গুড নিউজ?
রাশু গুড নিউজ সম্পর্কে তার বাবাকে কিছু বলল না৷
'রেশমা আমার ঘরে একটু আয়তো৷
রেশমা অসহায়ের দৃষ্টি দিয়ে রাশুর পিছু পিছু গেল৷
'চেয়ারে বস্৷
রেশমার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে৷
রাশু রেশমার দিকে তাকিয়ে একটু মিষ্টি করে হাসল৷ রেশমা রাশুর রহস্যের দিকে খেয়াল করল না৷
'ভাইয়া আই অ্যাম সরি৷ এত গভীর রাতে আব্বা জেগে আছেন এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল! বিশ্বাস কর তোকে ভয় দেখানোর জন্যই এ ডাক দেওয়া! মন থেকে আমি চাই নি আব্বা শুনতে পাক৷
'তুই এত্তবড় মাতবর হয়েছিস কবে থেকে?
'আমার জন্ম থেকেই৷
রাশুর উদ্ধত হাত রেশমার গালের উপর ---
'ভাইয়া মারিস না৷ প্লীজ..৷ গতকাল ক্লাসে হেসে দিয়ে মার খেয়েছি৷ বোনটির জন্য রাশুর খুব মায়া হলো৷ থাক না আজ!
'যা কিছু বললাম না! মনটা আজ খুব ভালো৷ যা পিচ্চি মাফ করে দিলাম৷ ভাগ্ ৷
রেশমা দ্রুত রাশুর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ঠোট ভেংচিয়ে বলল, 'মাদব-র!!
রাশু ওর বাবার ঘরে এসে জিজ্ঞাস করল, 'আব্বা, আম্মা কোথায়?
'তোর নাশতা নিয়ে আসছে৷
রৌশনারা নাশতা নিয়ে এলেন৷
'আম্মা গতরাতে আমি মিষ্টি নিয়ে এসেছি৷ যাও তো বেশী করে মিষ্টি নিয়ে এসো৷
রাশুর বাবা বললেন, 'রাশু কি ব্যাপার তোমার গুড নিউজটি কি বলবে?
রাশুর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল৷
'বলব?
রৌশনারা মিষ্টি নিয়ে এসেছেন৷
'হঁ্যা, বল্৷
রাশু ওর মার দিকে তাকিয়ে বলল, 'আম্মা আমি আমেরিকাতে স্কলারশীপ পেয়েছি৷
মিষ্টি রেখে রৌশনারা রাশুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন৷ বিয়ের পর প্রতিটি নারীর চিরন্তন স্বপ্ন থাকে৷ দুনিয়ার সবচেয়ে কষ্টের ব্যাথ্যা দিয়ে গর্ভকুসুম ছিড়ে বের হয়ে আসা তাঁর সন্তান হোক শ্রেষ্ঠ সন্তান! সত্যিকারের সুসন্তান!
রৌশনারার চোখ পানিতে ভরে গেল৷ তিনি কান্না জড়ানো কন্ঠে বললেন, 'বাবা তোকে আমি বলেছিলাম না? তুই বড় হবি, এগিয়ে যাবি-ই৷
মা'র হাতে গড়া শিশুই জগতের ভাগ্যবিধাতা৷
স্ত্রীর চোখে টলমলে পানি দেখে মোশারফ আহমেদ সাহেবের মুখে একটা জীবন্ত সুখ-হাসি ফুটে উঠল৷ তাঁর চোখও ভিজে উঠেছে৷ ভেজা কন্ঠে তিনি বললেন,
'রৌশনারা আমার কি মনে হয়েছে জান?
রৌশনারা কান্না-হাসি কন্ঠে বললেন, 'কি-ই?
'আমার মনে হচ্ছে সে-ই দু'বছরের রাশু তোমার বুকে মুখ রেখে আগের মত করে বলছে, আম্মু আমার ক্ষুধা পেয়েছে! দুধু দাও৷ আমার যে কত ভাল লাগছে! রৌশনারা আমি তোমাকে বুঝাতে পারব না৷ রাশুর বাবার চোখের পানি গাল বেয়ে মাটিতে পড়ল৷
রাশু ইউনিভার্সিটিতে ঢুকার পর সে আজ তার বাবার মুখে এমন সুখ-হাসি দেখল৷ সুখের সাথে আজ চোখের জল মিশে গেছে৷ এ সুখ দেখে কে?
মোশারফ আহমেদ এবার বললেন, 'রাশু ইউ ডিড এ্যাট লাষ্ট৷
'আব্বা, তুমি খুশী হয়েছো তো? তুমি আমাকে সবসময় সাকসেসফুল ফেইলরিষ্ট বলতে? তোমার এ কথাটা আমার কাছে অমৃতের মত লাগতো৷ আব্বা, তোমার সেই সাকসেসফুল ফেইলরিষ্ট ছেলেটা সাকসেস এর সন্ধানে এবার তোমাদের ছেড়ে বহু দুরে চলে যাবে!
রাশুর বাবার চোখমুখ থেকে হাসির জু্যতি মিলিয়ে গেল৷ ছেলে দুরে চলে যাবে কথাটা শুনে তাঁর মনের ভিতর হঠাত্‍ ঠং করে বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠলো৷ তাঁর চোখ আবারো ভিজে উঠল৷ তাঁর ঠোট কাঁপছে৷
'বাবা এভাবে বলিস না৷ মানুষ জন্মায়৷ জন্মের পর থেকেই সে কষ্ট করে৷ সবকিছু করে সে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য৷ তুই সততার সাথে সেটা করেছিস৷ এটা আমার আনন্দের চোখের পানি৷ এটা আমার গৌরব!
'আব্বা তা হলে মানুষ জন্মায় কেন? তার এতো কষ্ট কেন?
রাশুর চোখে পানি৷
রাশুর বাবা কাঁদছেন৷
'রাশু, আফটার ক্লাউড্স কাম্স ফেয়ার ওয়েদার- দুঃখের পর সুখ আসে৷ তুই অনেক কষ্ট করেছিস বাবা!
রেশমা বলল, 'তোমরা এমন করলে আমি কোথায় যাব? আব্বা হাসো তো!
রাশুর বাবার মুখে হাসি ফুটে উঠেলো৷ তিনি চোখ মুছলেন৷
'আব্বা তোমার কাছ থেকে এম.ফিলের খরচ আর নিব না৷ আমার এম.ফিল. এর আর দরকার নেই৷
রৌশনারা রাশুর মুখে চমচম ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, 'বাবা গতকাল খবরটা বলিস নি কেন?
'আম্মা বলার পরিবেশ খুঁজে পাই নি৷
মোশারফ আহমেদ বললেন, 'খবরটা গতকাল দিলে একরাত আগে থেকে সুখ পেতে পারতাম৷ ভালো করে ঘুমাতাম৷ দুঃসংবাদ বাতাসে উড়ে সুসংবাদ নাকি বলতে হয়৷
'আব্বা সরি৷
'আমি এখনই বেরুচ্ছি কলিগদের মিষ্টি খাওয়াবো৷ রাশুর কথা সবসময় কলিগদের বলতাম৷ রৌশনারা, আমি দুপুরে ছুটি নিয়ে চলে আসব৷ রাশু তুই বাইরে যাসনে৷ সবাই একসাথে দুপুরে খাব৷ রাশু তোর কাছে ভাল গানের ক্যাসেট আছে? বাসায় আজ ভালো ভালো গান বাঁজাতো৷ রাশুর বাবার মুখে কথার খই ফুটছে৷
'আব্বা আমার কাছে অনেক ভালো গানের ক্যাসেট আছে৷ তুমি যাও কলিগদের মিষ্টি খাইয়ে আস৷ আমি বাসায়ই থাকব৷
মোশারফ আহমেদ সাহেব রাশুর হাতে টাকা দিয়ে বললেন, 'কাঁচা বাজারে গিয়ে তোর ইচ্ছেমত বাজার কিনে নিয়ে এসো৷
মোশারফ আহমেদ সাহেব দ্রুত অফিসের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন৷

রাশু বাজার করে দিয়ে ঘরে শুয়ে আছে৷ রৌশনারা রান্না করছেন৷ তিনি তাঁর ছেলেকে ডেকে বললেন,'রাশু এদিকে আয়তো বাবা৷
রাশু রান্না ঘরে গেল৷
'রাশু তুই বললি দেশে আর একদেড় মাস আছিস৷ বিদেশে গেলে তো আর তোকে দেখতে পাবনা৷ একটা টুল এনে আমার পাশে বসে থাক৷ এ ক'টা দিন বাইরে ঘোরাঘুরি করিস নে৷ আমি তোকে বেশী করে দেখব৷
'আম্মা এই সাতাশ বছর তো দেখেছ৷
'সন্তান মার কাছ থেকে দুরে গেলে- ঐ সন্তানের জন্মের মূহুর্ত থেকে বিদায় পর্যন্ত অনেক স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠে৷ বুঝছিস তো?
'শুনছি বলো৷
'মাতৃস্তন থেকে সন্তানের দুধ-টানার ভংগি৷ মায়ের বুকে সন্তানের ঘুমানোর ব্যাকুল আঁকুতি৷ মাকে ঘিরেই তার জগত - এসমস্ত চিন্তাগুলো মা'র মনের পর্দায় ভেসে উঠে৷ সন্তানকে বিদেশে পাঠানোর পর অনেক ইমোশনাল মায়ের অকাল মৃতু্যর কারণ এটা৷ বুঝতে পেরেছিস্ ? মা'র মন তোরা বুঝবি না৷ বাবা হলে একটু বুঝবি৷ কিন্তু মা'র মত না৷
রৌশনারা বেগমের সন্তানের প্রতি দুর্বল মুহুর্ত চলছে৷
রাশু মনে মনে বলল, 'এবার বলা যায়৷
'আ..মম..আ...৷ রাশুর ডাক আকুতিতে ভরা৷
রৌশনারা বেগম ছেলের আবেদনময়ী 'আ..মম..আ' ডাক শুনলেন৷ কিন্তু অনুবাদে ব্যর্থ হয়েছেন বলে রাশুর মনে হল৷
'আচ্ছা রাশু ঐ দেশের খাওয়া দাওয়া কেমন?
'আম্মা আমি বিস্তারিত জানি না৷
'জাপানীরা নাকি পানি খায় কম মদ খায় বেশী?
'আম্মা আমি তো জাপানে যাচ্ছি না৷
'তাতো জানি৷ হাওয়াই এর বেশীর ভাগ লোকতো জাপানীজ৷ পার্ল হারবারের দেশ না ওটা?
রাশু আশ্চর্য্য হয়ে তার মা'র দিকে হা করে তাাকাল৷
'তোমাকে এমন আজগবী কথা কে বলেছে!
'কোন আজগবী কথা?
'ওরা পানি খায় কম মদ খায় বেশী?
'কেউ বলে নি৷ আমি পত্রিকার প্রবাস কলামে পড়েছি৷ ঐ দেশ তো সাগর দিয়ে ঘেরা৷ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ওদের খাওয়াপরার খুব কষ্ট হয়েছিল৷ ওরা তাই কাঁচা মাছ শুকর-গন্ডার শামুক ঝিনুক কাঁকড়া অক্টোপাস যা পায় সব খায়৷ ছিঃ মানুষ এগুলো খায় কিভাবে?
'এটা ওদের কালচার৷ এতে মন্দের কিছু নেই৷ দেখ না, একদেশের বুলি আর এক দেশের গালি৷ এক দেশের খাদ্য আর এক দেশের অখাদ্য?
'বাবা এত বুঝি না৷ তুই যেন হারাম না খাস৷ মদ না ছোঁস- এটা তোর কাছে আমার অনুরোধ৷ পরকালে স্থান পাবি না৷
'আম্মা আমি ওগুলো খাব না৷
'মনে রাখিস আমার কথা৷
যে কারণে রাশু মনে মনে অাঁকুপাঁকু করছে তা এখনও বলা হয় নি৷ কথাবার্তার লাইন অন্য দিকে চলে গেছে৷
'আম্মা একটা কথা বলব?
'কি কথা বাবা?
'আচ্ছা আম্মা, 'আমি যদি বিয়ে করে সাথে নিয়ে যাই কেমন হয়?
রৌশনারা বেগম কড়াইয়ে মাছের ফ্রাই উল্টাতে উল্টাতে বললেন, 'বাবা এত তাড়াহুড়ো করে মেয়ে পাবি কোথায়? তোর নিজস্ব পছন্দের কোন মেয়ে আছে?
'আম্মা নেই৷ ম্যানেজ করা যাবে৷ আমার ক্লাসমেট হৃদি আছে না?
'কোন্ হৃদি?
'ঐ যে একসময় টিভিতে মডেলিং করতো৷ ওর ননদ আছে৷ নাম অমা৷
'সে-ও মডেলিং করে? মডেলিং করা ফ্যামিলিতে যাবি?
'আম্মা ও মডেলিং করে না৷ অমা দেখতে শুনতে খুব ভাল৷ হলে ভালোই হতো৷
রাশু অমার কথা বলে কড়াইয়ে গরম তেলের টগবগ দেখায় মনোযোগ আকর্ষণ করল৷
কয়েক মুহুর্তে চুপ থেকে রৌশনারা বললেন,
'তোর সাথে মেয়ের কথা হয়?
রাশু তড়াক করে বলল, 'না না৷ কথা হয় না৷ একদিন ক্যাম্পাসে শুধু পরিচয় হয়েছিল৷
'বাবা আমাদের সাদামাটা ফ্যামিলি ওর পছন্দ হবে? তোর স্কলারশীপের খবর ওরা জানে?
'এখন পর্যন্ত ওরা জানে না৷
শিশুর মত রাশু ওর মার আচঁল টেনে নিয়ে মুখের সামনে রেখে বলল, 'প্রবাস খুব কষ্টের জায়গা আম্মা! তুমি আব্বাকে একটু বল না?
রৌশনারা টানা আঁচল ফিরিয়ে নিয়ে রাশুর ঘর্মাক্ত কপালেমুখে হাত বুলালেন৷
'আচ্ছা, আমি তোর আব্বাকে বলব৷ মুখে এত সুন্দর সুখ-হাসি তুই ইউনিভার্সিটিতে ঢুকার পর আর কোনদিন দেখিনি বাবা৷ তুই সুখী হলে আমরা খুব সুখী হব৷ মাছের ফ্রাই খাবি?
রাশু হাসল৷
'দাও৷
রাশু মাছের ফ্রাই মুখে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো৷

মোশারফ আহমেদকে কোনদিন এতটা খুশী দেখা যায় নি৷ হতাশার বন্যা জীবন থেকে উচ্ছ্বলতা দুরে ছুঁড়ে দেয়৷ তাঁর আজ সুখ-খবরের হাওয়া লেগেছে৷ দুপুরের মধ্যে রাশুর বাবা বাসায় ফিরে এলেন৷ হাতে মিষ্টির বাক্স৷ তিনি রৌশনারা রৌশনারা করে চিত্‍কার করে রান্না ঘরে ঢুকলেন৷
'রৌশনারা একটা মিষ্টি খাও?
'এখন খাব না৷ মিষ্টি খেলে দুপুরে ভাত খেতে পারব না৷
'একটা খাও না?
মোশারফ আহমেদ স্ত্রীর মুখে মিষ্টি তুলে দিলেন৷
'ঘেমে গোসল করে ফেলেছ৷ গোসল কর৷ সবাই একসাথে খাব৷
'যাচ্ছিগো যাচ্ছি৷
'রাশু? রাশু মিষ্টি খাবি? হাক ছাড়লেন মোশারফ আহমেদ৷
রাশু এসে বলল, 'দাও একটা খাই৷
'হা কর৷
রাশু মিষ্টি খেল৷
'আব্বা তুমি খাও৷ রাশু ওর বাবার মুখে মিষ্ট তুলে দিল৷
শুধু পিতাই শিশুর অন্তরে ঘুমিয়ে থাকেনা৷ শিশুও পিতার অন্তরে ঘুমিয়ে থাকে৷
ক্যাসেটে গান বাঁজছে.. .. .. .. .. .. ..
'আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ----
দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে মোশারফ আহমেদ বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছেন৷ তিনি স্ত্রীকে ডাকলেন, 'রৌ-শ-না-রা এ দিকে আসবে?
রৌশনারা এলেন৷
'ডাকছ কেন?
'পাশে বস৷ দুপুরে খাওয়াটা একটু বেশী হয়ে গেছে৷
'বেশী খেলে কেন?
'রৌশনারা একটু পান খাওয়াবে?
'পান পাব কোথায়?
'রাশুকে দিয়ে রাস্তার মোড় থেকে একটু আনিয়ে দাও না?
'দাঁড়াও, বলে মিসেস রৌশনারা আবার রাশুর ঘরে এলেন৷
'রাশু? রাশু? তোর আব্বা আজ পান খাবেন৷ বাইরে থেকে এনে দে৷
রাশু তার মা'র হাত ধরল৷
'আম্মা, আব্বার মুড খুব ভালো আছে৷ ঐ ব্যাপারটা আব্বাকে একটু বলো না?
'তুই পান দিয়ে যা৷ আমি বলব৷

রাশু এক খিলি পান কিনে দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে৷
রাশুর বাবা পান চিবুচ্ছেন৷ তাঁর হাতে পত্রিকা৷ রৌশনারা পাশে গিয়ে বসলেন৷
'কি ব্যাপার? তুমিতো দিনের বেলায় পত্রিকা পড় না৷
'আজ পড়ছি৷
'পড়৷
মুখে সুগন্ধি পান৷ হাতে পত্রিকা৷ মনে সুখ৷
'আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ----
পরিবেশটা খুব ভালো যাচ্ছে৷ ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হয়৷
রৌশনারা বললেন, 'ওগো একটা কথা বলব?
'একটা না, যত ইচ্ছে যা ইচ্ছে আজ বলতে পার৷
মোশারফ আহমেদ সাহেব স্ত্রীকে অভয় দিলেন৷
'রাশু বিয়ে করে বিদেশে যেতে চায়৷
কথাটা শুনে রাশুর বাবা তাঁর হাতের পত্রিকা এলোমেলো ভাঁজ করতে থাকলেন৷ উনি রাগ করলেন কি উত্তেজিত হলেন রৌশনারা বুঝতে পারলেন না৷ তাঁর পান চিবানো আগের মত আর আয়েশের সাথে হচ্ছে না৷
'আমি এমন কিছুর অবতারনা করেছি তুমি স্তব্ধ হয়ে গেলে?
তিনি আস্তে করে বললেন, 'রাশু বিয়ে করবে মেয়ে কোথায়?
'আছে৷
এবার রেগে বললেন, 'আছে বললেই হলো? মেয়ে কি দোকানে পাওয়া যায় বিদেশে যাচ্ছি শপিং করে নিয়ে গেলাম?
'তুমি ব্যাপরটা এত কঠিন ভাবছ কেন? রৌশনারা বিয়ে ব্যাপারটা সিম্প্যল না৷
'হঁ্যা সিম্প্যল৷ মাথা ঠান্ডা করে আমার কথাটা শোন৷
'এত তাড়াতাড়ি করে ওর বিয়ে করার দরকার কি? বিদেশে যাচ্ছে যাক, পি.এইচ.ডি. করে আসুক তারপর ভেবে দেখা যাবে৷
রৌশনারা বেগম স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন৷
'তুমি তাড়াতাড়ি-বিয়ে বলছ কেন? ওর বয়সতো কম হল না? এবার সাতাশে পড়েছে৷
'এ আর কেমন বয়স?
'তুমি কি বলছ? পড়াশুনা শেষ করে আসতে ওর বয়স সাড়ে বত্রিশ হবে৷ তখন বুড়ো লাগবে দেখতে৷ মেয়ে আর খুঁজে পাবে না!
'বয়স সাড়ে বত্রিশ হলেই বুড়ো হয়ে গেল? ছেলের আবার বয়স কি?
তিনি স্বামীর চিবুক ধরে উপরে তুলে ধরলেন৷ 'ছেলের আবার বয়স কি মানে? মনে নেই?
'কি মনে নেই?
'তুমি তো বাইশ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলে!
'কিসের মধ্যে কি বলছ?
'রাশুর জন্মের পর তুমি কি বলেছিলে?
'কি বলেছিলাম?
'ছেলেকে একুশে বিয়ে দিবে, ভুলে গেছ?
মোশারফ সাহেবের কঠিন মুখমন্ডলে হাসির রেশ ফুটে উঠল৷
'পানটা খাও৷
রৌশনারার চিবুক ধরা হাত সরিয়ে তিনি বললেন, 'তুমি সব সময় ছেলেকে ডিফেন্ড কর৷
'করব না?
'ও আমার রাশু না ?
রাশুর বাবার রাগ কমেছে মনে হল৷
'রাশুর পরিচিত মেয়ে আছে?
'আছে৷
'মেয়ের বাসা কোথায়?
'যাত্রাবাড়ী৷ রাশু-কনকের ক্লাসমেট হৃদির ননদ৷ প্রস্তাবটা ঐ পক্ষ থেকেই এসেছে৷
'ননদরা এখন তো এগিয়ে আসবেই? আমার ছেলে যে বিদেশে যাচ্ছে!
'ঘটনা ওমন না৷ ওরা এখনও জানে না রাশু স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে৷ ওর স্কলারশীপ পাওয়ার খবরের আগেই প্রস্তাব এসেছে৷
'হাতে তো সময় নেই৷ এত তাড়াতাড়ি কোন বিয়ে হয়? তুমি রাশু-কনককে বল আমরা মেয়ে দেখতে যাব৷
'কবে যাবে?
'আজ কি বার?
'সোমবার৷
'আগামী শুক্রবার যাব৷ ক্যালেন্ডারে রেড মার্ক দিয়ে রাখ৷
রৌশনারা বেগম হেসে বললেন, 'তুমি যা বল তাই হবে৷

ড্রাইভার কায়েস উপরে এসেছে৷
অমা জিজ্ঞাস করল, 'কায়েস কিছু বলবি?
'আপা একটু চা খেতাম৷
'পাঁচটা বাজে৷ নীচে যা৷ আমি বুয়াকে দিয়ে চা নাশতা পাঠিয়ে দেব৷
'আচ্ছা৷
চা পাঠিয়ে দেয়া হবে বলা হলেও সে নীচে গেল না৷
'কায়েস আর কিছু বলবি?
'আম্মাজান কোথায়?
'টাকা চাস?
কায়েস হঁ্যা বোধক মাথা ঝাঁকালো৷
'কত টাকা?
'পঞ্চাশ টাকা৷
'এই দিচ্ছি নিয়ে যা৷
'আম্মার কাছ থেকে নিব৷
'আচ্ছা তোর আম্মাজানের কাছে থেকেই নিস৷ আম্মা নামাযের ঘরে আছেন৷ এখানে বোস৷ নামায এখনই শেষ হবে৷ আমি চারতালায় বড় ভাবীর ওখানে গেলাম৷
'আচ্ছা৷
ইশতান্না বেগম নামাযের ছালাম ফিরিয়ে ডাকলেন, 'কে? কায়েস?
'জি আম্মা৷
'বস্৷
ইশতান্না বেগম নামায শেষ করলেন৷
কায়েস নীচু গলায় বলল, 'আম্মা আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি৷
'কি কথা?
'আম্মা হৃদি ভাবীকে কনক সাহেবের সাথে পার্কে বসে গল্প করতে দেখেছি৷ মনে হল কান্নাকাটিও করেছেন৷
'কি বলছিস?
'জি আম্মা সত্যি৷ কায়েস মাথা নীচু করে রইল৷

কথাটা শুনে ইশতান্না বেগম বজ্রপাতের মত ফেটে পড়লেন৷
'আম্মা?
'এই বেয়াদপের বাচ্চা! তুই চুপ কর! তাতে তোর কি?
বজ্রপাত আকাশ থেকে পড়ে৷ ইশতান্না বেগমের কথা শুনে কায়েস আকাশ থেকে পড়ল৷ তিনি কাঁপছেন৷
'এমনটা হওয়ার কথা না৷ নামাজ থেকে নেমে আম্মা এভাবে ক্ষেপলেন কেন?
বুঝা যাচ্ছে না ইশতান্না বেগম হৃদির উপর ক্ষেপে কায়েসের উপর ঝারছেন? নাকি তার ছেলের বউকে ড্রাইভার পার্কে দেখেছে বলে তিনি রাগে ফেটে পড়লেন৷
মানুষের মন বড়ই অদ্ভূত! এই আগুন! এই পানি ! ইশতান্না বেগম নিজেকে সামলে নিলেন৷ কিন্তু তাঁর চোখমুখ হতবিহ্বলে ভরা৷
তিনি শান্ত গলায় কায়েসকে ডাক দিলেন৷ 'কায়েস উপরে তাঁকা৷
'জি আম্মা৷
কায়েস ভয়ে ভয়ে তাঁর দিকে তাকালো ৷
'আর কাউকে এ কথাটা বলেছিস?
সে ভয়ার্ত গলায় বলল, 'আমি কাউকে বলি নি৷
'আচ্ছা৷
ইশতান্না বেগমের মন খারাপ হয়ে গেল৷ তিনি মনে মনে বললেন, 'বউ হল ঘরের লক্ষ্নী৷ অন্যের সাথে পার্কে গিয়ে গল্প কিসের?
'শোন আমি ফোন করছি৷ তুই বউমাকে ইস্কাটন থেকে নিয়ে আয়৷
'ভাবী বলেছেন ওখানে চারপাঁচ দিন থাকবেন৷
'সেটা তোর চিন্তা না৷ আগামীকাল আমি ওদের ইউনিভার্সিটিতে যাব৷
কায়েস সমস্ত বিষ্ময় নিয়ে বলল, 'আম্মা আপনি ইউনিভার্সিটিতে যাবেন?
'তাতে তোর অসুবিধা আছে?
কায়েস চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল৷
'সকালে যাব না৷ দুপুরে হৃদি-অমাকে যখন আনতে যাবি তখন যাব৷ আমি বউমাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি৷

ইশতান্না বেগম ইস্কাটনে হৃদির খালা ইয়াসমীনকে ফোন করলেন৷
হৃদিই ফোন ধরেছে৷
'বউমা তোমাদের ইউনিভার্সিটিতে বেড়াতে যাব৷ হৃদির গলায় বিষ্ময়৷
'আম্মা ইউনিভার্সিটিতে যাবেন?
'হঁ্যা বউমা৷
'আম্মা আমার খুব ভাল লাগছে৷
'তোমার ক্লাসমেট কনককে থাকতে বলবে৷
'কবে যাবেন আম্মা?
'আগামীকাল৷
'আগামীকাল? আম্মা আগামীকাল আমি ইউনিভার্সিটিতে যাব না৷ খালাম্মার গ্রামের বাড়ী বেড়াতে যাব৷
'চল না বউমা? কোন দিন তোমাদের ইউনিভার্সিটিতে ঘুরিনি৷ কাল একটু ঘুরবো৷ বিয়াইনকে একটু দাওতো৷
ইয়াসমীন হৃদির হাত থেকে টেলিফোনর নিয়েই জিজ্ঞাস করলেন, 'বিয়াইন কেমন আছেন?
'ভালো৷
'আপনি ভালো আছেন? বিয়াই সাহেব?
'হঁ্যা আমরা ভালো আছি৷ হৃদিকে কাল একটু পাঠিয়ে দিবেন? বউমার সাথে কাল ইউনিভার্সিটিতে ঘুরব৷
'তাই নাকি? আচ্ছা, হৃদিকে পাঠিয়ে দেব৷
মেয়ের মা আর ছেলের মা'র মধ্যে পার্থক্য এটাই৷ মেয়ের মা'র গলা এভাবেই নীচু হয়ে যায়৷ মেয়ের মা'র তাঁর মেয়েকে নিয়ে বেড়ানোর পুর্বপরিকল্পনা মুহুর্তে বদলে যায়৷

ফোন রেখে ইশতান্না বেগম চারতালার ইভার ফ্লাটে নেমে অমাকে বললেন, 'অমা আগামীকাল ইউনিভার্সিটিতে মা-মেয়ে-বউ মিলে একসাথে বেড়াব৷
অমার চোখে দুনিয়ার বিষ্ময়৷
'তুমি আমাদের ইউনিভার্সিটিতে যাবে?
'হঁ্যা যাব৷
'আম্মা আমি আগামীকাল ইউনিভার্সিটিতে যাব না৷ ভাবীও যাবেন না৷
'হৃদির সাথে কথা হয়েছে৷ ও যাবে৷
'আমি যাব না৷

পরদিন৷ ইশতান্না বেগম কায়েসকে নিয়ে সরাসরি ইউনিভার্সিটিতে গেলেন৷ হৃদি ইষ্কাটন থেকে রিকশায় আসবে৷
কনক মামুর দোকানে বসে চা খাচ্ছিল৷ সে ইশতান্না বেগমকে দেখে প্রথমে একটু অবাক হওয়ার মত করল৷ মুহুর্তেই এগিয়ে গিয়ে ছালাম দিয়ে বলল, 'খালাম্মা আপনি?
'হঁ্যা বাবা৷
'কেমন আছেন?
'ভাল৷
'খালাম্মা ঐ দিন খাওয়ানোর জন্য ধন্যবাদ৷
'কি খেয়েছ না খেয়েছ বুঝতে পারি নি৷ বাবা হৃদি এসেছে?
'না, হৃদি খালাম্মা ও আজ ইউনিভার্সিটিতে আসবে না৷
'ও ইস্কাটন থেকে আসার কথা৷ আসেনি?
'তাহলে চলে আসবে৷
'বাবা হঠাত্‍ সিদ্ধান্ত নিলাম তোমাদের ভার্সিটিতে ঘুরবো৷
'খালাম্মা কোনদিন ঘুরেন নি?
'ঘোরা হয়নি৷
'তা হলে হৃদি আসুক আমরা ক্যাম্পাসে ঘুরবো৷

মিনিট দশেকের মধ্যে হৃদির রিকশসা মামুর দোকনে এসে থামল৷
কনককে দেখে সে বলল, 'কনক আম্মা ইউনিভার্সিটি ঘুরে দেখবেন৷ তোমার কোন সিডিউল থাকলে ক্যানসেল করে দাও৷
'আমার কোন সিডিউল নেই৷
'কোথায় যাবেন খালাম্মা? বান্দা হাজির!
ইশতান্না বেগমের মুখে হাসি৷
'তোমরা কোথায় পড়ালেখা করেছ?
'খালাম্মা আমরা কার্জনহল ক্যাম্পাসে পড়তাম৷
'চল বাবা ঐ দিকে যাওয়া যাক্ ৷
কায়েস চায়ের ফ্লাষ্ক হাতে নিয়ে পিছু পিছু হাটতে থাকল৷
'খালাম্মা অমা এলো না?
'কত করে বললাম সবাই একসাথে ঘুরে আসি৷ মেয়েটা এলো-ই না৷

ইশতান্না বেগমকে নিয়ে বড় একটা রাস্তা দিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ ডানপাশে কার্জনহল ক্যাম্পাস৷ আগাছা লতাপাতা ক্যাম্পাসটির বাউন্ডারী দেয়ালটিকে গ্রাস করে যেভাবে বেড়ে উঠছে, পুরো ক্যাম্পাসটিকেই না একসময় খেয়ে ফেলে? কনক সবার সামনে হাঁটছে৷

রাস্তার দুর্গন্ধ৷ ইশতান্না বেগম শাড়ীর আঁচল দিয়ে নিজের নাকমুখ চেপে ধরেছেন৷ নিজেই নিজেকে যেন শ্বাসরূদ্ধ করে মারতে চাচ্ছেন৷ হৃদি দ্রুত হেটে কনকের পিছু গিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বলল,
'কনক, এ কোন্ রাস্তা দিয়ে তুমি হাটতে বেড়িযেছো?
'কেন? এই যে বায়ে তাঁকিয়ে দেখ শিশু একাডেমি! ওটার সামনে দিয়ে এসেছি৷
'শিশু একাডেমির সামনে দিয়ে এসেছো? আম্মার দিকে তাকিয়ে দেখতো?
কনক ইশতান্না বেগমের দিকে তাঁকাল৷ ফুটপাতের গন্ধে তিনি দিশেহারা হয়ে গেছেন৷ মনে হল তিনি দু'তিন মিনিট পর পর শ্বাস নিচ্ছেন৷
এ রাস্তায় তাঁজা-বাসী-শুটকি সব ধরনের বিষ্ঠা থাকে! ভাষাহীন অবুঝ কোন প্রাণীর নাদা না, খাস আদমের গু৷ মনে হয় শুধু ঢাকা না, টংগী থেকেও কিছু গুখুরি লোক এসে প্রাকৃতিক একাজটা এখানে এসে সেরে যায়৷
শরীরের ওজন কমানোর জন্য এ রাস্তায় বারবার আসা ভাল৷ হাটতে না চাইলেও দেঁৗড়াতে হবে৷ মেদ ভুরি এখন কি করি? চর্বি না পুরে যায় কই?
কনক তাঁর পিছনে এলো৷
'সরি খালাম্মা, ভিতর দিয়ে গেলেই ভাল করতাম৷ অবস্থা এতটা খারাপ চিন্তা করিনি৷
'ঠিক আছে বাবা হাটো৷ কথা বলো না৷
ইশতান্না বেগমের মুখ শাড়ীর আঁচল দিয়ে ঢাকা৷
'কনক এখানে ফুল পাওয়া যাবে?
'জি, হাইকোর্টের গেটে ফুল পাওয়া যাবে৷
'আমাকে কিছু ফুল কেনার ব্যবস্থা করে দাও৷
'আচ্ছা দেয়া যাবে৷

ইশতান্না বেগম ফুল কিনতে চাচ্ছেন কেন? ফুল দিয়ে কাউকে বরণ করবেন? ঘটনা কোন্ দিকে যাচ্ছে কেউ আন্দাজ করতে পারছে না৷ তবে সিরিয়াস একটা কিছু হবে৷ তাঁর ইউনিভার্সিটিতে আসার কারণ কি? ঢাকা শহরে হাজার মানুষ হাজার কারণে ঘুরে৷ কেউ উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ উদ্দেশ্য ছাড়া৷ কেউ কারোর উদ্দেশ্য জানে?

ফুল কিনে ইশতান্না বেগমের হাতে দেয়া হলো৷ ওরা কার্জন হলে ঢুকল৷ কার্জনহল কোন আবাসিক হল না এটা একটা ক্যাম্পাস৷ লর্ড কার্জনের এসেম্বলী হলের সামনে ইশতান্না বেগম ছবি তুললেন৷
'কনক এখানে ফজলুল হক হল কোথায়?
'ফজলুল হক হলে যাবেন?
'হঁ্যা ওদিকটায় একটু ঘুরে আসব৷
'চলুন৷
কনক ফজলুল হক হলের মুল ভবনের পাশের রাস্তা দিয়ে ইশতান্না বেগমকে নিয়ে যাচ্ছে৷ রাস্তায় সারি সারি নারকেল গাছের ছায়া৷
কনক হৃদিকে দেখিয়ে বলল, 'হৃদি এটা, এ-টা!
'এটা কি-ই?
'এই...যে! এ জানালাটাই ডট চৌধুরীর রুম৷ মনে হয় রুমেই আছে৷ ডাকব?
'ডাক৷
কনক ডেকে উঠল, 'চৌ-ধু-রী---? এই ডট চৌধু-রী?

রাস্তা থেকে জানালার দুরত্ব চারপাঁচ হাত৷ কোন দেয়াল নেই৷ গলা পরিষ্কার করতে কাশি দিলে এ রাস্তার পথচারী চমকে উঠে! মনে করা হয় তার উপর কফ ফেলার প্রস্তুতি চলছে৷ সুতরাং দৌড়াও!
ডট চৌধুরী তার পড়ার টেবিল থেকে জানালায় তাকাল৷ চোখের সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা না৷ তার চোখে অবিশ্বাস্য বস্তু দেখার বিষ্ময়! সম্বিত্‍ ফিরিয়ে সে বলল, 'হৃদি কেমন আছ?
'ভাল৷
কনক জিজ্ঞাস করল, 'চৌধুরী বাইরে আসবি?
'আসব৷

ওরা পুকুর ঘাটে এলো৷
কনক ইশতান্না বেগমকে দেখিয়ে বলল, 'খালাম্মা এটাই ফজলুল হক হল আর এটা হলের পুকুর ঘাট৷
'থ্যাংক ইউ৷
'কনক, উনিশ শো বায়ান্ন সালের ২০শে ফেব্রুয়ারীর রাতে এ পুকুর ঘাটে বসে ভাষা সৈনিকরা মিটিং করেছিলেন৷ ২১শে ফেব্রুয়ারীর সকালে ১৪৪ ধারা ভাংগতে হবে তো! সে জন্য৷ আমি এখানে ফুল দিব৷
কনক দুনিয়ার তাবত্‍ বিস্মিয় নিয়ে বলল, 'ইশতান্না বেগম ওরফে আমার প্রিয় খালাম্মার এই ঐতিহাসিক স্থানটা দেখার প্রস্তাবে কে না বিস্মিত হবে?
ইশতান্না বেগম হাসলেন৷ হৃদি আশ্চর্য্য হল৷
'হৃদি, ঐতিহাসিকভাবে খ্যাত এ ঘাটটা বাস্তবে অতিশয় অখ্যাত আছে৷ পরিচয়ের জন্য সাইনবোর্ড লাগে৷ সেটাও নেই৷ এই পুকুর ঘাটের নাম হওয়া উচিত ''একুশে ঘাট"৷
সেই রাতের এই ঘাট৷ পরদিনের সেই সকাল! তারপর, প্রতি বছর সেই সকালে আবেগে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় এমন একটি সুর-গানের প্রভাত ফেরীতে হাটা-- রোদ নেই ক্লান্তি নেই ভীড় নেই ঘাম নেই ---------
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি?
ইশতান্না বেগম অনেকক্ষন ধরে হাটছেন৷ তিনি হাঁপিয়ে উঠার ক্লান্তি নিয়ে বললেন, 'কনক আমি এখানে বসব৷
'খালাম্মা বসুন৷

বিকেল চারটা৷ রোদের কড়া ভাবটা তেমন নেই৷ ইশতান্না বেগম স্যান্ডেল খুলে ঘাটের সিড়ি বেঁয়ে নীচে নামলেন৷ তিনি গম্ভীর হয়ে বসলেন৷ ফুলগুলো পাশে রেখে একুশে ঘাটের শ্যাওলা সিড়িতে তাকিয়ে রইলেন৷

হৃদি-কনক পারের কংক্রিটের বেঞ্চে বসল৷
'হৃদি, তোমার শ্বাশুড়ী একজন অসাধারন নারী৷
'কিভাবে বুঝলে?
'তিনি সত্যি একজন জিনিয়াস শ্বাশুড়ী! অনেক বাবামা ইউনিভার্সিটিতে বেড়াতে আসেন৷ কেউ এ ঘাটের সিড়িতে বসতে চেয়েছেন? আমি কাউকে দেখি নি৷
'কনক আমারও জানা ছিল না এত গুরুত্বপূর্ণ এ পুকুর ঘাটটার কথা৷
'আমিও জানতাম না৷
'কনক, অমার ব্যাপারে রাশুর মতামত কি?
'আমি মামুর দোকানে এজন্যই বসে ছিলাম৷ ওর খবর পাচ্ছি না৷
'বাসায় যাও৷
'এব্যাপারে ওর বাসায় যাব না৷
'খালাম্মা এ ব্যাপারেই আলাপ করতে এসেছেন?
'না৷
'না মানে?
'না মানে না৷ আম্মা গতকাল ফোন করে বললেন ইউনিভার্সিটিতে যাব৷ ব্যস চলে এলাম৷ আম্মার সাথে অমার ব্যাপারে কথাই হয়নি৷
'বলো কি?

হাসিহাসি একটা মুখ কনক-হৃদির দিকে আসছে৷ হাসি হাসি মুখটা হলো ডট চৌধুরীর৷ সে হল থেকে বেরিয়ে পুকুর ঘাটে এল৷
'হৃদি তোমরা বেড়াতে এসেছ৷ খুব খুশী হয়েছি৷
সে ঘাটের সিড়ির নীচে বসে থাকা ইশতান্না বেগমকে দেখে এবার বলল, 'কনক, খালাম্মা ওখানে কেন?
কনক চোখ বড় করে তার দিকে তাকাল৷
'কনক, খালাম্মা তেলাপিয়া মাছ দেখছেন? দাঁড়িয়ে দেখতে বল৷ বস্তির পোলাপানরা পুকুরে গোসল করতে এসে পেশাব করে ঘাট ডুবিয়ে রাখে৷
কনক হি-শ্-শ্ করে ঠোটে আংগুল ঠেকিয়ে ইশারায় শাঁসিয়ে বলল, 'চৌধুরী চু..উ..প!

এই পুকুরে তেলাপিয়া মাছের খুব প্রভাব৷ পানিতে পা নামালে শুঁড়শুঁড়ি দেয়৷ মনে হয় ওদের সাথে কাতুকুতু খেলা হচ্ছে৷ সিড়িতে বসে অনেকেই তেলাপিয়া মাছের খেলা দেখে৷ কঠিন চর্মরোগে শরীর পানিতে ডুবিয়ে রেখে নাকি মাছের কামড় খাওয়ানো হয়? এ পুকুরের তেলাপিয়াকে কামড়ানোর সুযোগ দিলে ফল তাড়াতাড়ি পাওয়ার কথা৷

ইশতান্না বেগম বেশ খানিকটা সময় পর উপরে উঠে এলেন৷
ডট চৌধুরী বলল, 'খালাম্মা চলুন আমাদের ক্যান্টিনে চা খাব৷ আমি খাওয়াবো৷
'বাবা আমরা চা নিয়ে এসেছি৷ এখানে বসে সবাই একসাথে চা খাব৷

দু'জন পাশাপাশি বসার মত কংক্রিটের বেঞ্চগুলো৷ কনক ডট চৌধুরী পাশে দাঁড়ালো৷
কনক বলল, 'খালাম্মা রাশু স্কলারশীপ পেয়েছে৷ ডক্টরাল ডিগ্রী করতে ও হনলুলু যাচ্ছে৷
হৃদির মনটা অমার জন্য আনন্দে চনচনিয়ে উঠল৷ তার মনে হলো নিজের জীবনে যা-ই ঘটুক অমা একজন ভালো মানুষের কাছে যাবে৷ এর চেয়ে বড় সুখ আর কি আছে? সে কনককে বলল, 'রাশুকে দেখতে মন চাচ্ছে৷ ও কোথায়?
আধুনিককালের বন্ধু বলয়ের সমাচার ইশতান্না বেগম জানেন? তিনি নিজের পুত্রবধূকে বলতে শুনলেন যে ক্লাসমেটকে তার দেখতে ইচ্ছে করছে৷ তিনি পুত্রবধূর দিকে তাকালেন৷ সে তাকানোর অর্থ একমাত্র তিনিই জানেন৷
ইশতান্না বেগম বললেন, 'খবরটা শুনে খুব খুশী হলাম বাবা৷ কনক, সেদিন তোমার সাথে আমাদের বাসায় গিয়েছিল সে-ই রাশু না? ওকে দেখছি না তো?
'ও ইউনিভার্সিটিতে আসেনি৷
'বউমা কায়েস কোথায়? চায়ের ফ্লাস্ক তো ওর হাতে৷
ডট চৌধুরী বলল, 'ওনাকে তো হলের দোকানের সামনে দেখলাম৷ আমি ডেকে নিয়ে আসছি৷
মালিকরা গাড়ী থেকে বেড়িয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে কায়েসরা এই সুযোগে বিড়ি টানে৷
কায়েস এল৷ চা খাওয়া হচ্ছে৷ চা খেতে খেতে তিনি জিজ্ঞাস করলেন, 'কনক?
'জি খালাম্মা?
'প্রতিটি বাবামা'র উচিত তার সন্তানদের এগুলো ঘুরিয়ে দেখানো৷ যে দেশের মুক্ত-বাতাস বুক পুরে সবাই ভিতরে নিচ্ছে সেটা কিভাবে এলো? সবার জানা উচিত না?
'জি, আপনি ঠিকই বলেছেন৷
'খালাম্মা আর কোথাও বেড়াবেন? অপরাজেয় ভাষ্কর্য দেখবেন?
'চলো ও দিকে যাব৷

ইশতান্না বেগম অপরাজেয়-এর পাদদেশে এসে একই কাজ করলেন৷ তিনি নীরব হয়ে
বসে রইলেন৷
'কি উদ্দেশ্যে ইউনিভার্সিটিতে আসা হলো? কি করা হলো? কেন করা হলো? হায়রে মেয়েলোকের মন! তাদের নামে এমনি কি আর আঠারটি বিশেষণ আছে? ঈশ্বরই ও জায়গাটা বুঝেন না৷ আর মানুষ!

বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে৷ অপরাজেয়-এর পাদদেশে আধা ঘন্টার মত সময় কাটানো হলো৷
ইশতান্না বেগম কনককে বললেন 'বাবা আমার টায়ার্ড লাগছে৷ এখন ফেরা যাক৷ অন্যদিন আবার আসা যাবে৷
'বউমা তুমি যাত্রাবাড়ী যাবে না?
'আম্মা আমি খালার সাথে কয়েকদিন থাকব৷
'চল না যাত্রাবাড়ী ?
'আম্মা আমি না ফিরলে খালা যে কাঁদবেন!
ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুল ইশতান্না বেগমের বুক থেকে৷
'চলো তোমাকে ইষ্কাটনে পেঁৗছে দিয়ে আমরা যাত্রা বাড়ী ফিরে যাব৷

ইশতান্না বেগম হৃদিকে ইষ্কাটনে ওর খালার বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাত্রাবাড়ী রওনা দিলেন৷ রাস্তায় জ্যাম৷ বড় মগবাজারের মোড়ে বড় জ্যাম৷ চারপাশের দোকানপাট কাটছাট করে মগবাজারের এ মোড়ের আয়তন যত বড় করা হচ্ছে মনে হয় জ্যাম এখানে ততই বাড়ছে৷ সিষ্টেমের আয়তন যত বাড়ে কেওয়াজ এর পরিমান বোধ হয় ততো বাড়ে৷ জ্যামের কেওয়াজ ছাড়তে বেশ লম্বা সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে৷ গাড়ী ডেড মোশনে চলছে৷
ইশতান্না বেগম বললেন 'কায়েস তুই ওদের ব্যাপারটা যে রকম ভাবছিস৷ আসলে তা না৷ দেখলি তো ভার্সিটিতে ছেলেমেয়েরা কেমন করে এক সাথে জটলা করে বসে থাকে? বাইরে থেকে অনেক কিছুই মনে হয়৷ ওদের সাথে মিশবি তোর ভুল ধারনাটা চলে যাবে৷ অমা-হৃদির ব্যাপারে তোকে কোনদিন কিছু বলতে হবে না৷
'আচ্ছা আম্মা৷
'মনে থাকবে?
'হ্যা আম্মাজান৷
জ্যাম ছাড়ল৷
'কায়েস তাড়াতাড়ি চল৷ আসরের নামাযটা কাযা পড়ে আবার মাগরেব এর টা পড়ব৷

অপেক্ষা করা কষ্টের কাজ৷ অপেক্ষা করাটা যদি হয় রাস্তার ফুটপাতে বসে তবে তা আরো মারাত্মক ব্যাপার৷ হাত পা উঁশপিশ করে৷ কেউকেউ পটপট করে হাতের আংগুল ফোটায়৷ গত দু'দিন ধরে রাশুর অপেক্ষায় কনক মামুর দোকানে বসে থাকছে৷ হৃদি বলেছে সে তার খালার শশুরবাড়ী সালনা যাবে৷ সেখান থেকে ফিরে এসে সে রাশুর চুড়ান্ত মতামত জানতে চাইবে৷
আজ তৃতীয় দিন৷ কনক মামুর দোকানে রাশুর দেখা পাওয়ার আশায় বসে আছে৷ সন্ধের অন্ধকার পড়া শুরু হয়েছে৷ রাস্তায় রিকসার যাত্রীর দিকে কনক চোখ ফেলে -- এটাই বুঝি রাশুর রিকশা? রিকশা কাছে আসে কনক হতাশ হয়৷ আজ এভাবে রাস্তায় রিকশা গুণতে গুণতে রাশুর উপর কনকের খুব রাগ হলো, 'নন্সসেন্স!
মামু বাসা থেকে এসে বললেন, 'স্লালামুআলায়কুম৷ সার কেমন আছেন?
'ভাল৷ মামু রাশুর সাথে দেখা হয়েছিল?
'জি স্যার দেখা হয়েছিল৷
'ম্যাসেজ দিয়ে গেছে?
'জি৷ রাশু স্যার কিছক্ষণ বসে থেকে আপনাকে চিঠি লিখে গেছেন৷
'তাড়াতাড়ি চিঠিটা দেন!
বিস্কুটের খালি কৌটা থেকে রাশুর চিঠিটা কনকের হাতে দেয়া হলো৷
রাশু লিখেছেঃ
কনক, মাই ডিয়ার,
তোকে সব জানাতে চেয়েছিলাম৷ ব্যস্ততার জন্য পারিনি৷ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি অমাকে বিয়ে করবো৷ আগামী শুক্রবার আব্বা-আম্মা অমাকে দেখতে যাবেন৷ সাথে তুই আর আমি যাব৷ সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আব্বা-আম্মা আংটি পড়াবেন৷ পরের শুক্র বার বিয়ে৷ তুই হান্নান বসের গাড়ীটা ম্যানেজ করিস৷ গাড়ী একটা হলেই চলবে৷ খবরটা হৃদিদের ফ্যামিলিতে তুই ফরমালি জানিয়ে দিস৷ আর্জেন্ট পার্সপোট করতে দিয়েছি৷ চবি্বশ ঘন্টার মধ্যে পাওয়ার কথা কিন্তু আজ তিন দিন হল পার্সপোট হাতে পাই নি৷ পার্সপোট হাতে পেলে ভিসার সীল লাগবে৷ আমি মীরপুরে দালালের বাড়ীতে গেলাম৷
ইতি
রাশু ৷

হা - হা - হা--- হি-হি-হি--
'স্যার এত হাসছেন?
'রাশুর বিয়ে৷
'কবে?
'হবে, তবে আগামী মাসে৷

রাশু চুড়ান্ত মত দিয়েছে৷
হৃদিকে ইস্কাটনে খবরটা দিতে হবে৷ কনক ফোন কর্ণারে গিয়ে হৃদির খালার বাসায় ফোন করল৷
'হ্যালো, কে বলছেন?
'খালা আমি হৃদির ক্লাসমেট কনক৷
'খালা সালনা থেকে কখন এসেছেন?
'আধঘন্টা হয়নি৷
'কনক তুমি ফোন করেছিলে?
'আমি ফোন করিনি৷ খালা, হৃদিকে দিবেন?
'দাঁড়াও দিচ্ছি৷
হৃদি রিসিভার হাতে নিয়ে বলল, 'হ্যালো, কি খ-ব-র?
'রাশু মত দিয়েছে অমাকে বিয়ে করবে৷
'সত্যি!
'হঁ্যা৷ খবরটা তোমার শ্বাশুড়ীকে জানিয়ে দাও৷
'আচ্ছা৷
'আমি আগামীকাল তোমার শাশুড়ীকে আর বড় ভাইয়ার সাথে কথা বলব৷
'কাল কখন যাবে?
'দুপুরে৷
'লাঞ্চ করবে?
'না, চা খেয়ে চলে আসব৷
'তুমি যাত্রাবাড়ীতে এখন যেতে পারবে?
হৃদি ঘড়ি দেখল৷ সাড়ে ছ'টা৷
'আচ্ছা আমি যাচ্ছি৷ কনক কাল দেখা হবে৷
'রাখি৷

হৃদি ফোন রেখে তার খালাকে বলল, 'খালা আমাকে যাত্রাবাড়ী যেতে হচ্ছে৷
'এখন যাবি মানে? সকালে যাস্৷
'খালা এখনই যেতে হবে৷ অমার বিয়ের কথাবার্তা হবে৷
'ফোনে কথা বল৷
'আমি স্বশরীরে না থাকলে চলবে না৷
হৃদির খালা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন৷
'তোরই শুধু শশুরবাড়ী আছে! ভেবেছিলাম রাতে একসাথে খাব৷ তা আর হলো না৷ দাঁড়া তোকে কিছু খাবার দিয়ে দিচ্ছি৷ হৃদি যাত্রাবাড়ী চলে গেল৷

হৃদি বাসায় ফিরে প্রথমে ইভার ঘরের কলিং বেল টিপল৷
ইভা বেরিয়ে এলেন৷
'চলে এলে যে?
'ভাবী জরুরী কাজে এসেছি৷ ভাইয়া কোথায়?
'কেন? ও এখনো ফিরে নি৷
'ভাবী, অমার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা হবে৷৷
'পাত্রটা কে?
'আমার ক্লাসমেট রাশু৷ ও সেদিন বাসায় এসেছিল৷
'আচ্ছা! এখন বুঝতে পারছি তোমার ক্লাসমেট! অমা এত ব্যস্ত কেন?
হৃদি হাসল৷
'আম্মাকে রাতে কথাটা বলতে হবে৷ বিয়েটা তাড়াতাড়ি হবে৷
'একমাত্র ননদ আমাদের৷ ওকে হাই স্পীডে বিয়ে দিচ্ছ কেন?
'বিয়ে দিচ্ছি না৷ অমাই বিয়ে করছে৷ রাশু স্কালারশীপ নিয়ে আমেরিকা চলে যাবে৷
'জরুরী মিটিং তা হলে করতেই হয়৷ উপরে যাও আমি আসছি৷
'ভাইয়াকে সাথে নিয়ে এসো৷

হৃদি 'অ...মা..., অমা করে ডেকে উপরে উঠতেই ইশতান্না বেগম দরজা খুলে দিলেন৷ তাঁর মুখে হাসি৷
'বউমা?
'অমা কি আর আমাকে থাকতে দিবে?
'বউমা তুমি বাইরে থাকলে এঘরটা একদম শুণ্য হয়ে থাকে৷ তোমার জন্য চালতার আচার বানিয়েছিলাম৷ তুমি নেই আর কেউ চেখেও দেখে নি৷
'নিয়ে আসুন এখন খাব৷ আম্মা অমা কোথায়?
'আর কোথায় থাকবে? তোমার ঘরে ঘুমুচ্ছে৷
'এখন ঘুমুচ্ছে কেন?
'জানি না কেন? মেয়েটার যেন কি হয়েছে?
'আম্মা আমি দেখছি৷

ঘরের দরজা চাপানো৷ হৃদি নিঃশব্দে দরজা আগলিয়ে ভিতরে ঢুকল৷ লাল ডীম লাইট জ্বলছে৷
'এত তাড়াতাড়ি কেউ ঘুমায়?
অমার মাথার পাশে গল্প উপন্যাসের কোন বই নেই৷ উপন্যাস পড়ার সময় অমার ঘুম আসবেই৷ কিন্তু আজ সে কোন বই পড়া ছাড়াই ঘুমিয়ে গেছে এবং সে এখন অঘোর ঘুমে৷
হৃদি ঘরে আলো জ্বালিয়ে দিল৷ উজ্জ্বল আলো চোখে পড়লে চোখ কেঁপে উঠে৷ অমার এগুলো কিছু হলো না৷
'অ...মা, অ...মা ? কি-ই ঘুম? হৃদি কেঁশে উঠল, 'হুঁ.. উঁয়ুু৷
অমা মোচড় দিয়ে উঠল৷
'ভাবী কখন এলে?
অমার চোখেমুখে হতাশার মেঘ৷ কন্ঠ নিষপ্রাণ৷
হৃদি হাসি হাসি মুখ করে বলল, 'ওঠো! বিরহে আর কষ্ট করতে হবে না৷
'ভাবী তোমারতো আসার কথা না?
'এত কথা বলতে পারব না৷ আমি খুব টায়ার্ড৷ সেদিন আম্মার সাথে ইউনিভার্সিটিতে গেলে না কেন?
'তুমি বাসায় নেই৷ আর যাওয়া হয়নি৷
'আমি নেই তাই কি হয়েছে? চিরজীবন তোমার সাথে থাকবো?
'মনটা একদম ভালো নেই৷ কিচ্ছু ভালো লাগে না৷ তোমাকে বুঝাতে পারি না!

হৃদি মনে মনে বলল এগুলো আমাকে বুঝাতে হবে না৷ আমেরিকার হোটেল ম্যারিয়টে আমার এ অসুখ হয়েছিল৷ কিচ্ছু হয়নি৷ সবকিছু হয়েছে৷ সব কিছু আছে৷ কি যেন নেই! যদিও সে আমার অসুখটা এখন ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে৷
'ভাবী কি দেখছ আমার চোখে?
হৃদি রহস্যে ভরা হাসি দিল৷
'অমা আমার চোখে তাঁকাও৷ মন ভাল হয়ে যাবে৷ অষুধ নিয়ে এসেছি৷
'কি অষুধ?
'রাশু রাজী৷
'অমা হৃদির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না৷
'খুব তাড়াহুড়ো করে তোমাদের বিয়ে হবে৷ আগামী মাসে রাশু স্কলারশীপ নিয়ে আমেরিকা চলে যাবে৷ সাথে তুমিও৷
'ভা..ব..ঈ..ঈ.. ডেকে অমা হৃদিকে আকড়িয়ে ধরল৷ অমার চোখে পানি এসেছে৷
'এই! চোখে পানি কেন?
'জানি না৷
'পানি মুছ৷
হৃদির ওড়না দিয়ে অমা তার চোখমুখে হাত বুলাল৷
'সালনা থেকে এলাম৷ ওড়নায় ধুলোবালির বাজে গন্ধতো!
'আমি ওড়নায় পেলাম বোনের-রক্তের গন্ধ৷ সৌরভে ভরা বন্ধুর আন্তরিকতার গন্ধ৷ তুমি বলছো বাজে গন্ধ!
'এই মেয়ে এত সুন্দর সুন্দর কথা বলো না তো! সত্যি ইমোশনাল হয়ে যাই! আর কি গন্ধ পেলে?
'এক মমতাময়ী ভাবীর ভালবাসার গন্ধ! মাতৃত্ব্বের গন্ধ! চোখ বন্ধ করে শুধু ভিতরে নিতে মন চায়৷
'অমা, তুমি কি জানো তুমি কত ভালো মেয়ে?
'ভাবী না৷
'তোমাকে পেলে কারোর আর কিছু দরকার আছে?
অমা তার ভাবীর দিকে তাকালো৷ আরো কিছু বলবে মনে হলো৷
'এত ইমোশনাল কথার দরকার নেই৷ হাত মুখ ধূয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো৷

অমা হাত মুখে ফ্রেশ হয়ে হৃদির কাছে এলো৷
'অমা, কাল কনক বাসায় আসবে৷ ও আনুষ্ঠানিকভাবে ভাইয়া এবং আম্মার সাথে কথা বলবে৷
'কখন আসবেন?
'দুপুরে৷
'কনকের জন্য কিছু করতে হবে না৷ ও চা খেয়ে চলে যাবে৷
'কনক ভাইয়াকে দুপুরে লাঞ্চ করে যেতে বলো৷
হৃদি বলল, 'দ.. র ..দ !
'ভাবী?
হৃদি অন্য চোখে তার দিকে তাকালো ৷
'কিছু বলবে?
'আমার একজন বোন থাকলে কনক ভাইয়ার হাতে তাঁকে উঠিয়ে দিতাম৷
'দ.. র ..দ উথলে পড়ছে!
অমা লজ্জা-হাসি দিল৷

ইশমাম সাহেব রাত আটটার দিকে বাসায় ফিরলেন৷ ইভা দরজা খুলে দিতে দিতেই বললেন, 'এই তোমার কি ক্ষুধা লেগেছে?
'তার মানে?
'মানে, আর ইউ হাংগ্রী?
'কেন দরজায়-ই খেতে দিবে?
'আমি তাই বলেছি?
'তেমন ক্ষুধা লাগেনি৷
'তোমার ক্ষুধা না লেগে থাকলে কাপড় চোপড় আর খোলার দরকার নেই৷ চল উপরে যাই৷
'সু্যট প্যান্ট না খুলে উপরে যেতে পারব না৷
ইশমাম সাহেব ভিতরে ঢুকলেন৷
ইভা সিরিয়াস কন্ঠে বললেন, 'দুনিয়াদারির খবর-টবর রাখ?
'কোনটা শুনতে চাও? ন্যাশনাল না ইন্টারনেশনাল নিউজ?
ইভার চোখ কপালে উঠে গেছে৷
'নেশনাল খবর হলোঃ যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে গতরাতে আইডেন্টিক্যাল জমজ দুই বালকের মৃতু্য! ওরা দুনিয়াতে এসেছিল অভিন্ন সত্তায় আবার চলেও গেল অভিন্ন পন্থায়৷ মোঃ আব্দুল বায়েছ এম.এস.সি পাশ করে ঘটকের চাকুরিতে যোগ দান৷
আর ইন্টারনেশনাল হলো ------
ইভা প্রচন্ড বিরক্তবোধ করলেন৷
'তোমার সাথে কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা মানেও অর্থহীন বকবক করা৷
'সরি, 'বল কি খবর?
ইভা রেগে বললেন, 'নিজেতো ঠিকঠাক মতনই বিয়ে করেছ৷
'তার মানে? বিয়ে তুমি করনি?
'শুধু তর্ক-ই পারো! ঘরের বোনকে বিয়ে দিতে হবে৷ ছোট ভাই বিয়ে করে বউ রেখে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তুমি এগুলো নিয়ে কখনো ভাব?
'ইভা শোন, এগুলো নিয়ে ভেবে কোন লাভ নেই৷ যত ভাববো সমস্যা তত বাড়বে৷
'আগামীকাল দুপুর বারটায় হৃদির ক্লাসমেট রাতুল আহমেদ কনক অমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে৷
'ভাল৷
'ভদ্রলোকের সাথে প্রয়োজনীয় কথাবর্তা বলো৷ সঙ্গ দিও৷ পাত্র কনকের বন্ধু৷ নাম রাশু৷ ছেলেটা স্কলারশীপ নিয়ে আমেরিকা যাবে৷
'খুব ভালো৷ ইশমাম ক্লান্ত দেহে হাসলেন৷
'হাসলে যে?
তিনি আবার হাসলেন৷
'ইভা বহুদিন পর একটা ভাল খবর পেলাম৷ সত্যি আমার খুব ভাল লাগছে৷
ইভার কন্ঠে তিরস্কার৷
'শুধু ভাল খবর পেলে চলে না৷ ভালো খবর সৃষ্টি করতে হয়৷ এগুলো সৃষ্টি করতে অনেক ঘাম ঝড়ে অনেকের শরীর থেকে৷ বুঝলে?
'আচ্ছা, চল উপরে যাই৷

ইশমাম আর ইভা উপরে এলেন৷ হৃদি ইশতান্না বেগমের সাথে বসে আছেন৷ অমার বিয়ের কথাবার্তা হবে৷
ইশমাম তাঁর মাকে জিজ্ঞাস করলেন, 'আম্মা আগামীকাল কে নাকি অমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে?
ইভা বললেন, 'কে নাকি মানে? তোমাকে না বলা হলো হৃদির ক্লাসমেট কনক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে৷
'সরি৷
'আম্মা ছেলে কেমন?
'ছেলে কেমন জানি না বাবা৷ দেখতে ভাল৷ সে হৃদির ক্লাসমেট৷
'হৃদি, তুমি কি ছেলেটাকে চেন?
'ভাইয়া এমফিলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে চিনি৷
'বাসা কোথায়? ছেলের বাবা কি করেন?
'ওদের বাসা খিলগাঁ৷ রাশুর বাবা সরকারী সত্‍ কর্মচারী৷
ইশতান্না বেগম তাঁর ছেলেকে বললেন, 'শুন বিয়েটা হয়ে যাক৷ শিক্ষিত মেয়েদের বিয়ে দেয়া কঠিন৷ কেমন যেন মিলে না৷ বাবা জীবিত থাকলে ঘরের অবিবাহিত মেয়েকে নিয়ে তাঁরা ব্যস্ত থাকতেন৷ সে ভাগ্যতো আমার মেয়ে অমার নেই৷ তুই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকিস৷ ইতমাম কোন কিছুর আগপিছে নেই৷ পিতৃহারা মেয়েদের জন্য এটা যে কি যন্ত্রনা! কখনো ভেবে দেখেছিস্? হৃদি বউমাকে ধন্যবাদ, ও একটা ভাল বিয়ে এনেছে৷
'আম্মা, একদিনের পরিচয় থেকে রাশুকে অমার-ই ভালো লাগে৷ আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম৷ রাশু হঁ্যা বলেছে - এটুকুই৷ বাকীটুকু আপনারা দেখবেন৷ রাশু উচ্চতর পি. এইচ.ডি করতে আমেরিকা চলে যাবে৷
'কবে নাগাদ যাবে বউমা?
'আগামী মাসে চলে যাবে৷
'তোরা আর দেরী করিস না৷

রাতের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল কনকের বয়ে আনা প্রস্তাব ইশতান্না বেগম কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহন করবেন৷

কনক পায়জামা পাঞ্জাবী পরে বড় ভাই রাশেদ আহম্মেদ রনককে জিজ্ঞাস করল, 'ভাইয়া তোর বাইকের চাবিটা দিবি?
রনক সাহেবকে পেশাগত কাজে অফিস থেকে বাসায় আসতে হয়েছে৷ অসময়ে তাঁর বাইক নেওয়ার প্রস্তাবে আর্শ্চয্য হয়ে তিনি কনকের দিকে তাঁকালেন৷
'সকাল এগারটায় বাইক দিয়ে তোর কি হবে? রনকের ভারী গলা৷
'কাজ আছে৷
'মানুষকে উপকার করে বেড়াবি? আবার থানায় যেতে চাস্? কনক নিজের উপকার কর৷ কাজে দিবে৷ আজ ওয়ার্কিং ডে৷
'সে টা জানি৷
'এখন আমি অন-ডিউটিতে আছি৷
'তুই এখন রিকশা নিয়ে অফিসে যা৷ রাশুর বিয়ের ব্যাপারে আমাকে ঘোরাঘোরি করতে হবে৷ রিকশা ভাড়ায় পোষাবে না৷
রনক সাহেবের ইচ্ছে হচ্ছিল না চাবিটি দিতে৷ কিন্তু রাশুর কথা শুনে তিনি চাবিটি দিয়ে দিলেন৷
'কাজ শেষে অফিসে বাইক দিয়ে যাস৷

কনকের পরিবহন সমস্যা মিটল৷ বাইক নিয়ে কনক প্রথমে রাশুর বাসায় খিলগাঁ এলো৷ পাত্রের সাথে ফেস টু ফেস কথা বলা দরকার৷
কনক রাস্তা থেকে ডাক দিল, 'রাশু? রা-শ--উ?
রৌশনারা বেগম বারান্দায় এলেন৷
'স্লামোআলায়কুম৷
'চাচী, রাশু কোথায়?
'ও বাইরে গেছে৷ বাবা ভিতরে এসে বসো৷
'চাচী এখন বসব না৷ যাত্রাবাড়ী যাচ্ছি৷
'যাও বাবা৷ রাশু তোমাকে-ই যেতে বলেছে৷
'চাচী আপনারা আগামী শুক্রবার মেয়ে দেখতে যাচ্ছেন তো? কোন সমস্যা নেই তো?
'বাবা আমরা অবশ্যই যাব৷

কনক বাইক ঘুরাল৷ ওর মনে স্ফূর্তি৷ অনেক বন্ধু ছিল কিন্তু রাশুর মত বন্ধু সে পায়নি৷ মানুষ মানুষের জন্য৷ কনক রাশুর জন্য৷ ওর জন্য আরো অনেক কিছু করব৷ চোখ দরকার হলে চোখ দিব৷ রক্ত দরকার হলে রক্ত দিব৷
হু হা --- হু হা --- ৷
বাইক হেলে দুলে যাত্রাবাড়ীর দিকে ছুটে চলছে ৷

একটা মিষ্টির দোকনের সামনে এসে কনক বাইক দাঁড় করাল৷
দোকানদার 'এখানে হুন্ডা রাখা উচিত না' ভংগিতে তাকাতেই কনক হেসে দু'আংগুল দিয়ে ঠ (ভি) বানিয়ে বলল,
'ভাইয়া জাষ্ট টু মিনিটস৷ আমাকে চার ভ্যারাইটির চার কেজি মিষ্টি দেন৷
'বেল মাথার দোকানদার একটা মুখখোলা কৃত্রিম হাসি দিল৷
'দিচ্ছি ভাইয়া৷
মিষ্টি কনকের হাতে দেয়া হলো৷
দোকানদার এবার মুখখোলা না, প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলল, 'আর কি লাগবে ভাইয়া?
'থ্যাংক ইউ আজ আর কিছু লাগবে না৷ অন্যদিন কিছু নেয়া যাবে৷
'আচ্ছা স্লামুআলাইকুম৷ আবার আসবেন৷

কনক মিষ্টির প্যাকেট বাইকের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে যাত্রাবাড়ী অমাদের বাসায় এলো৷ সে এখন হৃদিদের ড্রয়িং রুমে বসে আছে৷ ওর মনটা হঠাত্‍ করেই কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল৷ এই রৌদ্দোকজ্জ্বল ঝলমলে দিন! এই অন্ধকার কালো মেঘ! ভাল লাগছে না৷ এখানে আসার আগের সে-ই স্বাভাবিক ভাবটা ওর মধ্যে নেই৷ মনতো এরকমই, এই ভালো এই খারাপ৷ রাশু ওকে দায়িত্বপূর্ণ কাজে পাঠিয়েছে৷ মন ভাল করতে হবে৷ কনক মন ভলো করল৷ মনটা আসলে কি ? এটা মানুষ নামের প্রাণীদের কেন যে দেয়া হলো?
'স্লামুআলায়কুম! অমা ড্রয়িং রুমে এসে কনককে সালাম দিল৷
কনক চমকে উঠল৷ এমন হওয়ার কথা না৷ কিন্তু হলো৷ সে নিমিষেই নিজেকে সামলে নিল৷
'ও অমা! তুমি ভালো আছ?
'জি ভাইয়া৷
অমা চলে গেল৷
ইশতান্না বেগম ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন৷
কনক দাঁড়িয়ে সালাম দিল, 'স্লামুআলায়কুম!
'বাবা বস৷
তিনি কনকের পাশে বসলেন৷
'খালাম্মা আগামী শুক্রবার অমাকে রাশুর বাবামা দেখতে আসবেন৷ সাথে আংটি আনবেন৷ আপনারা মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে থাকবেন৷ আমি এ খবরটা দেয়ার জন্যই এসেছি৷
'আচ্ছা৷
'রাশুর বাবা-মাকে আমি চাচী বলে ডাকি৷ ওনারা আমাকে খুব স্নেহ করেন৷
'ওনাদেরকে আমার ছালাম দিও৷ বলবে তাঁদের জন্য অপেক্ষায় থাকবো৷ বাবা, আমরা কেউ এখনো দুপুরে খাই নি৷ চলো আজ একসাথে খাব৷
'খালাম্মা হৃদি কোথায়? ভাবী, বড় ভাইয়া?
'বসো৷ ওরা আসবে৷ প্রথম দিন পরিচয়ে তোমার সাথে অনেক কথা হয়েছিল৷
'জি৷
'আমি গল্প করব৷ তোমার সাথে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে৷ সময় হবে?
'জি হবে৷ বলুন৷
ইশতান্না বেগম সোফায় কনকের পাশে এসে বসলেন৷ একটা স্বল্পদৈঘ্যর্ের নিঃশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন,
'কনক, আমি জানি তুমি খুব লজিকাল ছেলে৷ খুব ইথিকাল ষ্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে চলো৷
'কে বলেছে? কনকের মুখে সন্দেহের হাসি৷
'অমা বলেছে৷
'তোমার ইথিকাল ফাউন্ডেশন খুবই উঁচু৷ এজন্য তোমাকে মনে মনে আমি খুব শ্রদ্ধা করি৷
'থ্যাংক ইউ খালাম্মা৷
'উনি এগুলো বলছেন কেন? এগুলো কি বলার কথা? এগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ কি? বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা কাউকে এগুলো বলা যায়?
'কনক?
'জি!
'আমি অনেকক্ষণ ধরে বলব৷ তুমি শুনবে৷ তোমার সময় আছে তো?
'জি আমি শুনব আপনি বলুন৷
'কনক মনে করো তুমি হলে আমি অর্থাত্‍ 'ইমতান্না বেগম'৷ বুঝতে পেরেছ?
'জি৷
'ব্যক্তি হিসাবে উল্টো তুমি আমাকে ভাবো৷
'খালাম্মা আমি বুঝতে পেরেছি আপনি বলুন৷
'সত্‍ জীবন যাপন করা তোমার স্বামী এই বাড়ীঘর, বাচ্চাদের পড়ালেখা ইত্যাদি মাঝখানে ফেলে, স্ত্রীর সাথে নিজের সুখস্বপ্নটুকু অসম্পূর্ণ রেখে হঠাত্‍ করে মারা গেলেন! কনক ব্যাপারটা কেমন?
'খালাম্মা, ঈশ্বরের এক নাম্বার নিষ্ঠুরতম খেলা বোধ হয় এটাই৷
'তারপর তুমি নিজের জীবনকে অর্থহীন করে সবকিছু স্যাক্রিফাইস করলে৷ সন্তানদেরকে তিলে তিলে কষ্ট করে মানুষ করলে৷ এই মানুষ করার পিছনে তোমার অনেক রাত চোখের জলে কেটেছে৷ অসংখ্য রাত এক সেকেন্ডও ঘুমাওনি৷
কনক ধরতে পারছে না ইশতান্না বেগম তাকে কি বুঝাতে চাচ্ছেন? কিন্তু ধরতে না পারলেও তাঁর বলা কথাগুলো সূর্যের মত সত্যি মনে হচ্ছে এবং অসাধারন লাগছে৷
তাঁর জন্য কনকের খারাপ লাগছে৷ কেঁদে দিতে পারলে বুকটা হালকা হতো৷ ইশতান্না বেগমের কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে শুনতে কনক অনুভব করল সে নিজের ভিতর নেই৷ অতিতের সেই অশ্রুসিক্ত ইশতান্না বেগমের ঘরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে তাঁর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ এসে বলছে- তোমার চোখের জলটুকু দাও মা৷ ঐ জল নিয়ে আমি গোসল করব৷ তোমার মত অসম্ভব প্রাণশক্তি নিয়ে আমি জীবনের পথ হাঁটব৷
ইশতান্না বেগম কনকের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'কনক, শুনতে বিরক্ত লাগছে?
কনক কল্পনা থেকে চমকে ফিরে এলো৷
'খালাম্মা আমি খুব মন দিয়ে আপনার কথা শুনছি৷ বলুন৷
'তোমার একমাত্র মেয়ে হল অমা৷
'জি৷
'অমা 'বিধবা মা'কে অথর্াত্‍ 'তোমাকে' ভালবাসার চেয়ে তার মৃত বাবাকে বেশী করে ভালবাসতে শিখলো৷ মৃত বাবার প্রতি ওর ভালবাসার প্রতিটি শব্দ বিধবাটিকে ইলেকট্রিক স'র মত ফেঁড়েফেঁড়ে কাটতো৷ মেয়েটি বিধবাটাকে তাঁর জীবিতবস্থার স্বামীর চেয়ে মৃত স্বামীকে বেশী করে ভালবাসতে শেখালো৷ জীবিত এর মৃতকে ভালবাসা! সেই ভালবাসা আগুনের মত জ্বালাময়৷
'কনক?
'একটা কথা তুমি বিশ্বাস করবে?
'কি কথা?
'বয়স বাড়লেও মনের বয়স ওভাবে বাড়ে না৷ বৃদ্ধবৃদ্ধাদের মাথাটা ঠিকভাবে কাজ না করলেও মন আগের মত-ই আবেগ দিয়ে সবকিছু অনুভব করতে পারে৷ অন্ধ'র আলোকিত পৃথিবীকে অনুভব করার মত ব্যাপার৷
'জি আমি বিশ্বাস করি৷
'কনক তোমার সেই অমা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে৷ ও স্বপ্নে পাগলিনী! তুমি ছাড়া অন্য কেউ দেখলে তা অনুভব করতে পারে না৷ বিধবা মা ওর আনন্দের জোয়ার দেখে চোখে পানি নিয়ে নীরবে কাঁদে৷ প্রতিদিন পানিতে ঝাপসা হয়ে যায় তোমার ক্লান্ত চোখ জোড়া৷
'খালাম্মা! আমি বুঝতে পেরেছি৷
ইশতান্না বেগমের চোখে পানি এসেছে৷
চোখে পানি নিয়ে তিনি জিজ্ঞাস করলেন, 'কনক চোখে এত পানি কেন আসে?
'মেয়ের সুখ আনন্দটা এখন আপনার আনন্দ- এ জন্য৷
তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন৷
'কনক এবার মেয়েটির খুব ভালো একটা বিয়ে এসেছে৷ বিধবাটির আনন্দ মাপতে পার?
কনক কথা বলছে না৷
'কনক আমি মাপতে পারি৷ তুমি পারবে না৷ কারণ আমি আসল মা৷ কনক?
'জি৷
'আমার আনন্দ স্থায়ী হয় না৷ কেন যেন হয় না! কনক বিষ্মিত হয়ে তাঁকে দেখছে৷
সে অসহায়ের মত জিজ্ঞাস করল, 'কেন খালাম্মা?
'সেটা আমি বোঝাতে পারব না৷ কেউ যেন একটা সূতো দিয়ে আমার সুখ টেনে নিয়ে চলে যায়!
কনক ইশতান্না বেগমের মুখ থেকে তার দৃষ্টি সরাতে পারছে না৷
'অনেক কথা বলে ফেললাম৷ আমি কাউকে এসব বলিনি৷ বেশ কিছূদিন যাবত্‍ এগুলো কাউকে বলার জন্য মাথায় পাক খাচ্ছিল৷ বিশেষ করে তোমাকে৷ তুমি খুব সেন্সেবু্যল মানুষ৷
কনক তাঁর চোখ থেকে দৃষ্টি নামালো৷
'কনক আমি বোধহয় একটু ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম৷
'ঠিক আছে৷
'বাবা তুমি যে উপকার করলে বর্তমানে তা অনেকেই করে না৷
'খালাম্মা এগুলো বলবেন না৷

কনকের মন নিজের কাছে ভারী লাগছে৷
হৃদি ড্রয়িং রুমে এসেছে৷ শ্বাশুড়ী অমার বিয়ের কথাবার্তা ছাড়াও অনেক কিছু বলেছেন ৷ এটা তাঁর চোখমুখ দেখে-ই বুঝা যাচ্ছে৷ ইশতান্না বেগমের মুখ স্বাভাবিক না৷
হৃদি বলল, 'কনক চা খাবে?
'হঁ্যা দাও৷
ইশতান্না বেগম বললেন, 'চায়ের কথা বলছ কেন? ও দুপুরে খেয়ে যাবে বলেছি৷
'খালাম্মা আমি শুধু চা-ই খাব৷
কনক আর একটু বসো৷ আমার বড় ছেলে আর বড় বউমা আসছে৷ তাদের সাথেও তোমার কথা বলার দরকার৷
ইশতান্না বেগম ভিতরে গেলেন৷
হৃদি ট্রে হাতে চা বিস্কুট নিয়ে ঘরে এলো৷
'কনক লাঞ্চের সময় চা দিয়ে বিদায় করছি৷ আমাকে পরে দোষবে না৷
'দোষাদোষির কিছু নেই৷ আমি ইনফরমাল মানুষ৷
হৃদি কনকের দিকে ভালো করে তাকালো৷ হতাশার চোখ চোখে পরলে হাতাশা বাড়ে৷ তার নতুন করে চেনা পৃথিবীটা আবার অচেনা লাগছে৷ শ্বাশুড়ী কনকের সাথে অনেকক্ষন কথা বলেছেন৷ কি বলেছেন? চায়ের ট্রে তার হাতেই ধরা আছে৷ হৃদি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷
'তাকিয়ে কি দেখছো? চা টা দিবে?
'কনক তোমাকে বিমর্ষ লাগছে কেন? কনক তার কথার উত্তর করল না৷
'চা নাও৷
হৃদি কনকের হাতে চা উঠিয়ে দিল৷
হৃদির ভিতরের মানুষটি বেরিয়ে এলো৷ 'কনক আর একটু বস৷ তোমাকে শুধু দেখতে মন চায়! চল এক সাথে লাঞ্চ করি? হৃদির পক্ষে তার মনের কথাগুলো ক্লাসমেট কনককে বলা হল না৷
ইভা-ইশমাম ঘরে ঢুকলেন৷
'কি হলো হৃদি বন্ধুকে শুধু চা দিয়ে বিদায় করছ?
'আমি শুরু চা-ই চেয়েছিলাম৷ ভাবী, আমরা কিন্তু শুক্রবার আসছি৷ ভাইয়া ঠিক আছে তো?
'হঁ্যা আপনারা আসুন৷ অপেক্ষায় থাকবো৷
'হৃদি তা হলে আসি! ভাবী আসি৷ হৃদি কাল ইউনিভার্সিটিতে যাবে?
'বলতে পারছি না৷
ইভা কনককে জিজ্ঞাস করলেন, 'সত্যি ভাই দুপুরে খাবে না৷
'আপা সত্যি খাব না৷ বড় ভাইয়ের বাইক চেয়ে নিয়ে এসেছি৷ এখন অফিসে গিয়ে এটা ফেরত দিতে হবে৷
কনক ইশমাম সাহেবকে বলল, 'ভাইয়া আমাকে একটু গলির মাথা পর্যন্ত এগিয়ে দিবেন?
'সরি আমাকেই এ কথাটা বলা উচিত ছিল৷
ইভা মৃদু চটে গেলেন৷
'বলা উচিত ছিল কি? তোমার আই. কিউ. (ও.ছ) নেই?
ইশতান্না বেগম ভিতর থেকে প্লাষ্টিকের ছোট একটা বক্স নিয়ে এসেছেন৷ বক্সটা কনকের হাতে দিয়ে বললেন, 'বাবা তুমি দুপুরে খাবারগুলো খেয়ে নিও৷ খেলে আমি খুব খুশী হব৷
'আচ্ছা আমি খাব৷ উঠি খালাম্মা৷ হৃদি যাই৷ ইভা আপা আপনি খুব ভাল মেয়ে৷
বিদায় নিয়ে ইশমাম সাহেবের সাথে কনক নীচে নেমে এলো৷
হুন্ডা ষ্টার্ট দিয়ে বলল, 'ভাইয়া পিছনে বসুন গলির মাথায় নামিয়ে দেই৷
কনক চলে গেল৷

এজিএম হান্নান বিকেল চারটায় রাশুদের বাসায় নিজের গাড়ী নিয়ে আসবেন৷ রাশুর বাবা মা তাঁর গাড়ীতে করে পাত্রী দেখতে যাবেন৷ তাঁরা আংটি পড়াবেন৷ কনক মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাশুর সাথে সে যাবে না৷ ইশতান্না বেগম এমন কিছু কথাবার্তা বলেছেন যেগুলোর অনর্্তিনহিত অর্থ সে খোজে পাচ্ছে না৷ বাঁধ সাধল রাশু নিজেই৷ কনক না গেলে রাশু যাবে না৷ রাশু না গেলে কা'র বিয়ে কে করবে? কনক তাই যাচ্ছে রাশুর একান্ত অনুরোধে৷
সন্ধ্যে পাঁচটায় পাত্রীর বাসায় পৌঁছার কথা৷
খিলগাঁ এসেই এজিএম হান্নান কনককে বললেন, 'ড্রাইভার সহ একদম নতুন গাড়ী নিয়ে এসেছি৷ নিউ ব্র্যান্ড৷ ফোর হুইল ড্রাইভ৷ নিশান কম্পানীর চকচকে সাদা সেড্রিক৷ তাঁর দেরীতে আসার কারণ এই গাড়ীটিই৷ বন্ধুর জন্য পাত্রী দেখতে যাবেন তাঁর চাই একটা নতুন গাড়ী৷
'বস্ আপনি ড্রাইভার নিয়ে এসেছেন কেন? আপনাকেই গাড়ী নিয়ে আসতে বলেছিলাম না?
'বন্ধুর বিয়েতে আমি ড্রাইভার হয়ে যাব?
কনক উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল৷
'সব কিছুতেই আপনি বাগড়া বাঁধান?
'বাগড়া বাঁধান হলো কিভাবে?
'আপনার খারাপ লাগলে আমি ড্রাইভ করতাম?
এ জি এম হান্নান এবার অনুতপ্ত হওয়ার স্বরে বললেন, 'কনক এখন কি করব?
'দক্ষিন আকাশে তাকান৷ বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে৷ বস্ টাইম কিল করে এসেছেন৷ এসেও সমস্যা বাধালেন?
'ড্রাইভার মোশাদ্দোহাকে মাইনাস করে দেই?
'বিয়ের শুভযাত্রার আয়োজনে কাউকে বাদ দিতে নেই৷
কনক রাশুকে বাসার বাইরে ডেকে নিয়ে এলো৷
'আমার ব্যক্তিগত সমস্যা আছে৷ তাছাড়া গাড়ীতে বড়জোর পাঁচজন ধরবে৷ তোরা যা, আমি থেকে যাই৷
'কনক কি বলছিস তুই? রাশু টাশকি খাওয়ার মত করল৷
'কি বলছি বুঝিস না৷ আমি যাব না৷
'তুই আর আমি বেবীতে চড়ব৷ বেবিকে বলব গাড়ী ফলো করতে৷ ল্যাটা চুটে গেল৷ তুই না গেলে আমি যাব না সোজা কথা৷

মোশাদ্দোহা গাড়ী ছাড়ল৷ কনক-রাশুর বেবীট্যাক্স িসেড্রিকের পিছনে৷ বর বেবীতে৷ বরের বস্ (!) এজিএম হান্নান এয়ার কন্ডিশন্ড সেড্রিক গাড়ীতে৷
খিলাগাঁ পার না হতেই এজিএম হান্নান বললেন, 'মোশা গাড়ী থামা (মোশাদ্দোহাকে এ জিএম হান্নান মোশা বলে ডাকেন)৷
মোশাদ্দোহা গাড়ী সাইড করল৷
কনক বলল, 'রাশু সামনে তাকিয়ে দেখ্৷ বস্ গাড়ী থেকে নামলেন কেন?
'আরে সত্যিতো!
এজিএম হান্নান আয়েশী ভংগীতে বেবীর কাছে এলেন৷
'রাশু আমি কিছু রাজনীগন্ধা ফুল নিব৷
কনক বিরক্ত মনে রাস্তায় তাকিয়ে রইল৷ এজিএম হান্নানের হাবভাবে মনে হচ্ছে পাত্রী সারারাত ভরে দেখা যাবে৷ তিনি রজনীগন্ধার একটা তোড়া কিনে নিয়ে এসে গাড়ীতে ঢুকলেন৷
'মোশা তাড়াতাড়ি গাড়ী চালা৷ এমনিতেই তুই লেট করে ফেলেছিস৷ রাশুর মাকে বললেন, 'খালাম্মা পাত্রী দেখতে যাচ্ছি৷ ফুল কিনলাম৷ ভাল হলো না?
'হঁ্যা বাবা খুব ভাল হয়েছে৷ তাড়াতাড়ি করো, রাত হয়ে যাবে৷
এই মোশা গাড়ীর স্পীড বাড়িয়ে দে৷

অমাদের বাসার গলির মোড়ে এসে সেড্রিক থেমে আছে৷ গাড়ী ঢুকবে না৷ রাশুর বাবা গাড়ী থেকে নামলেন৷ যাত্রাবাড়ী বড় ফোটার সংক্ষিপ্ত একটা বৃষ্টি হয়ে গেছে৷ খন্ডমেঘের বৃষ্টি৷ খন্ডমেঘের বৃষ্টির বিশেষ শোভা আছে৷ উঁচু জায়গা থেকে খন্ডমেঘের পতিত বৃষ্টিকে রুপালী বাজির পতনের মত লাগে৷ রুপালী বাজির বৃষ্টিতে অমাদের বাসায় এই গলিটা ভিজে আছে৷ রোদ উঠেছিল৷ মিষ্টি রংগীন রোদ৷ এই রোদে পাত্রী দেখতে ভাল লাগে৷ সুন্দর লাগে৷
হৃদি মনে মনে ভীষণ খুশী হয়েছিল৷ গোধুলীর আগুনে রঙের এসময়টাতে অমাকে ছাদের লনে দেখাবে৷ পাশে থাকবে পাত্রীর নিজের করা বাগানের কাসাব্লাংকা ফুলের সারি সারি টব৷
হৃদির ইচ্ছে পূরণ হলো না৷ গেষ্ট দেরিতে এসেছেন৷
মোশারফ সাহেব আর রৌশনারা বেগম অমাদের বাসা পর্যন্ত হেঁটে এলেন৷
কনক বলল, 'রাশু তুই মাটির দিকে তাকিয়ে থাক্৷
'মাটির দিকে তাকিয়ে থাকব কেন?
'থাকনা? মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলে মেজাজ শীতল থাকে চেহারাও প্রফুল্ল থাকে৷
'আচ্ছা থাকলাম৷
হৃদি সবাইকে ভিতরে নিয়ে গেল৷

'কনক এত দেরী করলে যে?
'দেরী কোথায় দেখলে? বিয়ের অনুষ্ঠান শুরুর ইতিহাস হিসাব করলে দেখবে উই আর দি ফাষ্টটেষ্ট পার্টি৷
'তোমার সাথে পারব না৷
কনক হৃদিকে বলল, 'হৃদি উনি আমাদের বস এ.জি.এম হান্নান৷ যা বলবেন মন দিয়ে শুনবে৷
হৃদি তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'হান্নান ভাই বলুনতো কেমন লাগে? কনককে বিকেলের রোদ থাকতে থাকতে আসতে বলেছিলাম৷ বিয়ের পাত্রী দেখার সুন্দর লাল-হলুদ রোদও উঠেছিল৷ ভেবেছিলাম ঐ রৌদ্রেই ননদকে দেখাব৷
'কা'কে কি বলছ? জিজ্ঞাস করে দেখ দেরীটা কা'র জন্য হয়েছে?
এজিএম হান্নান বললেন, 'এটা ফক্স ম্যারেজের রোদ৷ এই রোদে শিয়াল শিয়ালীকে বিয়ে করে৷ রাশু একজন অতি নরম সাদাসিদে ভাল মানুষ৷ আমি তাই চাচ্ছিলাম না রাশুকে একটা ফক্স টাইমে আপনার কাছে নিয়ে আসি৷
হৃদি একবার ছাদের দিকে আবার কনক-রাশুর দিকে তাঁকাল৷

ইশতান্না বেগম রাশুর বাবা-মা কে আসার জন্য ধন্যবাদ জানালেন৷ অমাকে দেখাতে নিয়ে আসা হবে৷
এজিএম হান্নান রাশুর বাবাকে ডেকে বললেন, 'চাচা জাষ্ট এ মিনিট৷ একটু বাইরে আসুন৷ কনক তুমিও এসো৷
তিনি ছাদের লনে গিয়ে রাশুর বাবাকে জিজ্ঞাস করলেন, 'চাচা পাত্রী দেখার জন্য কত টাকা দিবেন?
'তোমরা যত দিতে বলবে আমি তাই দিব৷
কনক বলল, 'চাচা পাঁচশত টাকা-ই মোর দেন এনাফ৷
এজিএম হান্নান ভ্রু কুঁচকালেন৷ 'কনক! এটা কি বলছ? রাশু আমেরিকা যাচ্ছে না? এট লিষ্ট পাঁচ হাজার টাকা দেয়া উচিত৷
'আপনার সব কিছুতেই বাহাদুরী! দাতা হাতেমতাই হয়েছেন! আপনি দেন?
'বাবারা তোমরা রাগারাগি করো না৷ এখন রাগাাগির সময় না৷
কনক বলল, 'চাচা বেশী দিতে চাইলে এট বেষ্ট এক হাজার টাকা দিবেন৷
'বাবারা ভিতরে চলো৷ এগুলো নিয়ে আর কথা বলো না৷
এজিএম হান্নান বললেন, 'চাচা দাঁড়ান৷
তিনি পকেট থেকে এক টাকার একটা নোট বের করে রাশুর বাবার হাতে দিলেন৷
'এক টাকা দিয়ে কি করব?
'চাচা জোড়া টাকা দিতে নেই৷ জোড়া টাকা ইনষ্ট্যান্টলী দু'অর্ধেক করা যায়৷ বিয়ে ভেংগে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ ইনভেলাপে এক হাজার টাকার সাথে এই এক টাকার নোটটা ঢুকিয়ে দিবেন৷
কনক অট্রহাসি দিয়ে উঠল৷
'বলা সহজ করা কঠিন! এক টাকা বের হলো কেন বস্?

পাত্রী দেখানো হলো৷ পাত্রীর হাত-পা-চুল দেখে যেভাবে পাত্রী দেখা হয় সে ধরনের কিছু হলো না৷ অমাকে পাত্রী হিসাবে দেখাটা একটা মমতাময়ী পরিবেশে হলো ঃ

অমাকে ড্রয়িং রুমে আনা হলো৷ রৌশনারা বেগম এবং মোশারফ সাহেব একসাথে উঠে অমার কাছে গেলেন৷ রৌশনারা বেগম অমার মধ্যমায় আংটি পড়ালেন৷ রাশুর বাবা বললেন, তোমাকে আমরা দোয়া করছি মা তুমি সুখী হও৷ অমা দু'জনের পাঁ ছুঁয়ে সালাম করল৷ সালাম করে উঠার সময় অমা ওর নিমীলিত চোখের পাতার পাঁপড়িগুলো খুলে ঘাঁড় বাঁকা করে উপরে মোশারফ আহমেদ সাহেবের চোখ-মুখের দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইল৷ ঘটনাটা নিমিষেই ঘটলো৷ এজাতীয় অনুষ্ঠানে পাত্রী কখনো ছেলের বাবার চোখের দিকে সরাসরি এভাবে কেউ তাকায় না৷ অমা এবং রাশুর বাবার চোখেচোখে কি কথা হলো বুঝা গেল না৷ রাশুর বাবা অমাকে স্নেহে টেনে ধরে বুকের কাছে নিয়ে বললেন, মা, ছেলের বউ হিসাবে তোমাকে আমার ভাল লাগবে৷ কথাটা বলার সংগে সংগে তাঁর চোখে পানি এসেছে৷ সাথে অমারও৷

পাত্রী দেখার পরিবেশ পাত্রীবাদে সবার কাছে আনন্দমুখর হয়ে থাকে৷ পাত্রীরা মেঝেতে ফাঁক খুঁজে বেড়ায়৷ একটা ফাঁক পেলে ওটা দিয়ে যদি ভিতরে লুকানো যেত? এখানে অভূতপুর্ব একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল৷
ড্রয়িং রুমের আরো দু'জনের চোখে পানি এসেছে৷ একজন হলো রাশু অন্যজন হলেন অমার বিধবা মা ইশতান্না বেগম৷ সবাই স্তম্ভিত! কথাবার্তাহীন নীরব পরিবেশ ড্রয়িং রুমে৷
এজিএম হান্নান কেঁশে উঠলেন, 'হু..হু..উঁ৷
কারোর কথা বলার দরকার হল না৷
ইশতান্না বেগম অমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন৷ মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি মেয়েকে জিজ্ঞাস করলেন, 'মা তুই ওখানে কাঁদছিলি কেন?
অমা ওর মার বুকে মাথা রেখে অষ্ফুট করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷
'আম্মা, আব্বা মারা যাবার পর অন্য কাউকে আপন করে এত কাছ থেকে দেখে নি৷
মেয়ের কথায় ইশতান্না বেগমের চোখ পানিতে ছেপে উঠলো৷ তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠবেন বলে মনে হলো৷ কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রন করলেন৷
মনের গতি হলো অসীম৷ রাশুর বাবার পায়ে সালাম করে উঠার সময় অমা অবচেতন মনে তার বাবার কাছে চলে গিয়েছিল৷
ইশতান্না বেগম অমাকে রেখে আবার ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন৷ বিয়ের পাকা কথা হলোঃ ঢাক ঢোলের দরকার নেই৷ অনুষ্ঠানাদি খুবই সাধারন হবে৷ দু'পক্ষ থেকেই যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেলা হবে৷
এজিএম হান্নান বললেন, 'যা করবেন হিট এন্ড রান বেসিস'এ করুন৷ সব ঠিকঠাক মতই শেষ হবে বলে আমার বিশ্বাস৷
হৃদির প্রচেষ্টা সফল হলো৷ শীঘ্রই অমার শুভ বিবাহের শানাই বেঁজে উঠবে৷ বিয়ে আগামী শুক্রবার৷
শুভ বিদায়৷ ইশমাম সবাইকে রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন৷

কনকদের আরও একটি প্রোগ্রাম আছে৷ কনক এজিএম হান্নানকে নিয়ে মামুর দোকানে এলো৷ ওদের পোল্ট্রি ফার্ম বিষয়ক জরুরী আলোচনা হবে৷ ইদানীং আলোচনা বেশী হচ্ছে৷ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না৷ সবকিছু যেন কেমন ঊদ্দ্যেশ্যহীন হয়ে যাচ্ছে? ফার্মের অপর তিন মেম্বার দীপক, মন্টু এবং মালেক মামুর দোকানে বসে থাকার কথা৷ সবাই একসাথে বসে জরুরী কথা বলবে৷ বাকী মেম্বারদের খবর কি?
দীপক নেই৷ তার ডান হাতে খুব ব্যাথা৷ হাতে যন্ত্রনা নিয়ে ফুটপাতের দোকানে কতক্ষন বসে থাকা যায়? সে চলে গেছে৷ তার হাতে সময়ও নেই৷ এক ছেলে এক মেয়ে রেখে পাইলট বড়ভাই মারা গেছেন চার মাস হলো৷ বাসায় ভাবীর চোখে মুখে তাকানো যায় না৷ ভাতিজা-ভাতিজী বাবার মৃতু্য কি এখনও বুঝে না৷ ওরা আগের মতই খেলে৷ তাদের প্রিয় খেলা টেবিল টেনিসের পিংপং বলকে টেবিলে নয় দেয়ালে পিটাতে হবে৷ পিংপং এর এই স্কোয়াশ ধরনের খেলাটা এখন দীপককে খেলতে হয়৷ সে খেলে বাচ্চা দু'টি খিল খিল করে হেসে উঠে৷ এই খেলা সকাল থেকে শুরু হয় রাত দশটায় শেষ হয়৷ হাতে ব্যাথা হলেও খেলতে হয়৷ দীপক স্কোয়াশ খেলতে মামুর দোকান থেকে চলে গেছে৷
দীপক চলে যাওয়ার পর মালেক এসেছে৷ মন্টু দু'ঘন্টা ধরে একা একা বসে আছে৷ কাজ ছাড়া শুধু বসে থাকার কোন চাকুরি থাকলে মন্টুর জন্য ভালো হতো৷ ওর এমনি এমনি বসে থাকতে একটুও খারাপ লাগে না৷
মামুর দোকান কনকগং এর কাছে অসীম মহাশুন্যে ভেসে থাকা শাটল ষ্টেশনের মত৷ কোথাও কিছু নেই সেই শুণ্যে দরকারী কাজে বসার মত জায়গা৷ কারোর বাসায় কনক, এজিএম হান্নান, মন্টু, দীপক, মালেক এর মত পাঁচজন অবিবাহিত পুরুষের মিটিংএ জড়ো হওয়া সম্ভব নয়৷ এমন বাসা মালেকের বাবার ছাড়া আর কারোর নেই৷ মালেকদের বাসায় একদিন বসাও হয়েছিল৷ মালেকের বাবা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, 'এই ধুনফুন নিয়া বাসার আশপাশে যেন কেউ না আসে! ধুনফুন শব্দটা বাংলা ভাষায় কবে থেকে হঠাত্‍ ঢুকে গেল খোঁজ নেয়া দরকার৷ এর অর্থ কি?
'একদল যুবকের স্বপ্ন --- ওরা ফার্ম করবে৷ নিজের পায়ে দাঁড়াবে৷ এগুলো নাকি ধুনফুন! যুবকদল মালেকের বাসার দিকে আর কোন দিন পা মাড়ায় নি৷ খোলা পার্কে বসে আলোচনা করবে-সে সুযোগ নেই৷ বসলে টহল পুলিশরা আড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে৷ তাদের ধারনা ওরা হাইজ্যাক করার প্ল্যান করছে৷ পশুদের যেমন অভয়ারণ্য থাকে৷ এই কনকগংদের জন্য অভয়ালয় জাতীয় কিছু থাকলে ভালো হতো৷ ওরা যাবে কোথায়? মামুর দোকানটা ওদের কাছে তাই একটা পরিকল্পনা দপ্তর৷

মন্টু এজিএম হান্নান আর কনককে দেখেই বলল,
'কি জমিদার নারায়নদত্ত চৌধুরীরা কোথায় থাকা হয়? খুঁজে পাওয়া যায় না৷
এ নামের কোন জমিদারকে মন্টু চেনে না৷ ও কাউকে কোথাও দেরী করতে দেখলে জমিদার নারায়নদত্ত চৌধুরী বলে ডাকে৷
মন্টু কনককে জিজ্ঞেস করল, 'মামুর কাছে শুনলাম রাশু বিয়ে করছে? পাত্রীটা কে?
'হৃদির ননদ৷
'হৃদিটা কে?
এজিএম হান্নান বললেন, 'হৃদিকে চেন না?
'না৷
'কনকের এম.ফিল. এর ক্লাসমেট৷
'ও-হ্, দাঁতের এডভার্টাইজ করতো ওই টা৷
'হু৷
'শালারা আমাকে কিছু জানালে না৷
কনক বলল, 'দোস্ত সব জানতে পারবি৷ দু'এক দিনের ভিতর বিয়ের দাওয়াত পেয়ে যাবি৷ মন্টু তুই এতদিন কোথায় ছিলি?
'সিলেটে ছিলাম৷ তিন মাসের একটা চিল্লা মেরে এলাম৷

অপর মেম্বার মালেক কনকদেরই ক্লাসমেট৷ মালেক যখন সবচেয়ে ভালো থাকে তখন ওর সর্দি আর জ্বর থাকে৷ বেশী তাপমাত্রার জ্বর না৷ নিরানব্বই দশমিক পাঁচ এর মতো হবে৷ এই টেম্পারেচারকে মালেক জ্বর বলে৷ সে ছোক ছোক করে নাক টানে আর কথা বলে৷ মালেককে দেখে কনক লাফ দিয়ে ওঠার মত করল৷ এর একটা কারণ আছে৷ মালেকের সাথে দেখা হলে সে প্রথম যে বাক্য দিয়ে কথা শুরু করবে তা হলো, 'দোস্ত আমার কিছু ভালো লাগে না৷
আজও তার কোন ব্যতিক্রম হলো না৷
কনক বলল, 'মালেক কেমন আছি?
'ভালো না৷
'তোর শুধু ভালো লাগে না কথাটা ঠিক না৷
'কেন?
'তোকে আর কত বুঝাবো? যে ভাল আছে সে বলছে ভাল নেই৷ যে ভাল নেই সে বলছে ভাল আছি৷ আমার মনে হয় সবাই ভাল আছে অথবা কেউ ভাল নেই৷ কিছু বুঝলি?
'না৷
'ব্যাপারগুলো আপেক্ষিক৷ তুই সমুদ্রের পানিকে কি দেখিস?
'নীল দেখি৷
'দুনিয়ার অনেক মানুষ আছে যারা সমুদ্রের পানিকে লাল দেখে৷
'তাদের চোখের সমস্যা আছে৷
'ঠিক আছে৷
'একটা পাখি সমূদ্রের পানিকে কি রঙে দেখে৷ একটা মাছ? একটা বিড়াল?
'আমরা যেমন দেখি ওরা ওমনি দেখে৷
'সেটা তো তোর চোখের দেখার সাথে তুলনা করে করে বললি৷
'কথাটা কি ঠিক? আচ্ছা আমি কেমন আছি?
'দোস্ত, তোর মত সুখী লোক আমি জীবনে দেখিনি৷ তোকে দেখে খুব ঈর্ষা হয়!
'আমার মধ্যে তুই সুখ দেখিস? সকালে টাকা চুরি করি বড় ভাইয়ের মানি ব্যাগ থেকে৷ আর বিকেলে টাকা চুরি করি বড় আপার ভ্যানিটি থেকে৷ এরকম একটা ডাবল-স্টার চোরকে তোর কাছে খুব সুখী মানুষ মনে হলো?

নিষ্ঠুর অনুশাসনের মধ্যে বড় হওয়া মালেক ওর বাবার ইন্ডাষ্ট্রিতেই অফিসার হিসাবে চাকুরী নিয়ে আছে৷ ভাল বেতন পায় বোনাস পায়৷ বাবার পাজেরো গাড়ী ব্যবহার করে৷ মালেকদের ঢাকা শহরে বিশাল বিশাল বাড়ি আছে৷ মাসিক আদায়ী বাড়ী ভাড়ার পরিমানটা পাঁচ ছয় লাখ টাকার মতো৷
কনকের খোয়ার দিকে তাঁকিয়ে থাকার সময় মালেকও অন্যতম চরিত্র৷ চরিত্র কত ধরনের না-ই হয়? অনেক কিছু থাকার পরও মালেকের কিছু ভাল লাগে না৷ কনক ফুলতলী প্রজেক্টে মালেককে জোর করে সদস্য বানিয়েছে৷
হঠাত্‍ সংবাদ এলো মালেক পা পিচলে ছাদ থেকে নীচে পড়ে গেছে৷ আসলে সেটা মিথ্যে৷ মালেক সুসাইড করতে পাঁচ তলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল৷ কনক ছাড়া সবাই জানল মালেক পা পিচলে ছাদ থেকে পড়ে গেছে৷
ঈশ্বর মালেকের সুসাইড নামঞ্জুর করলেন৷ ঝাপ দেয়ার পজিশন ঠিক হয়নি৷ মাথা নীচে পড়লে ইনষ্ট্যান্টলি ব্রেইন ইনজুরী হয়ে মৃতু্যর কোলে ঢলে পরতো৷ ভালো না থাকা একবারে কেল্লাফতে হতো৷ নিজেদেরটা আর পাশের বিল্ডিংয়ের জানালার শেডে ড্রপ খেয়ে খেয়ে পা নীচে পড়েছে ৷ দু'পা আবার একসাথে না৷ আগে ও পরে৷ মৃতু্যর আগে ও পরে নামের একটা বই আছে৷ ঐ রকম৷ ওর শাস্তি দু'সময়েই হয়েছে৷ ঝাপ দেয়ার আগেও পরেও৷
মালেকের কোটিপতি পিতা বাহার উদ্দীন চৌধুরীর কথা- মালেককে সে মরতে দিতে পারে না৷ এটা তার চ্যালেঞ্জ! কা'র সাথে? তাঁর ছেলের চিন্তার সাথে৷ যে চিন্তাটা মালেককে ভালো লাগে না বলে তার মাথা খেয়েছে৷
বিজ্ঞানের অবদান বাহার উদ্দীন চৌধুরীদের ঘরে আগে আসে৷ মালেকের পা একদম অচল হলেও সমস্যা হতো না৷ বিকল্প চিন্তাও করা হয়েছিল৷ ব্রেনডেথ পেসেন্টের কাছ থেকে এক পা কেটে নিয়ে ওর শরীরে লাগানো হবে৷ তেমন কিছু হয়নি৷ মালেকের বাবা ওকে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে সব ঠিকঠাক করে এনে দিলেন

মালেক ড্রাইভারকে নিয়ে মামুর দোকানে এসেছে অনেকদিন পর৷ কনক ছিল না৷ মন্টুর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে সে এখানে বসে আছে৷
কনক মালেককে বলল, 'শালা সুখে থাকতে ভুতে কিলায়৷ সুপার ম্যান হতে চাও?
মন্টু কনককে থামিয়ে দিয়ে বলল, 'বন্ধু ওগুলো ওকে বলিস না৷ ও লজ্জা পায়৷ বুড়ো বয়সে সে পিচলা খায়!
কনক বলল, 'মালেক, আমাদের সাথে জমি কিনেছিস৷ ওখানে কিছু করতে হবে না?
'দোস্ত আমি মিটিং সিটিংএ নেই৷ ওগুলো তোরা করবি৷ না করলে না করবি৷ আমার কিছু ভালো লাগে না৷
'আবার!
মন্টু বলল, 'কনক থাম্৷ আপন চরকায় তেল দাও৷ ও পোল্ট্রি ফার্ম দিয়ে কি করবে? মুরগীর গন্ধ নাকে গেলে ওর এলার্জি হয়৷ ও করবে পোল্ট্রি ফার্ম?
মালেক বলল, 'কনক, এবছর পুরো ইউরোপ ঘুরতে বেরুবো৷
'যা ঘুরে আয়৷
'শুনলাম রাশু হনলুলু যাচ্ছে৷ আগামী বছর ওর ওখানেও বেড়াতে যাব৷
'যা হনলুলু গিয়ে মন ভাল করে আয়৷ দেখে আয় জীবনে অনেক কাজ করার আছে৷
'মন্টুর বুক থেকে দীর্ঘ নিশ্বাস বেরুল৷
সে আনমনে গান ধরল ----
'মানুষ মরে পয়সা গুণে,
আমি মরি পয়সার ঝুঁনঝুঁনি শুনে৷
মানুষ মরে পয়সা গুণে------
গানের কথাগুলো আর সুরটা যা-ই হোক৷ মন্টুর কন্ঠে গানটা অসাধারন লাগছিল৷
কনক বলল, 'মন্টু তুই কি বলছিস? এ গান তুই কোথায় পেলি?
'ডিস্টার্ব করছিস কেন? শুনছিস না গান গাইছি!
'ফুলতলীতে কিছু কাজ করতে হবে৷ চাদা লাগবে৷
মন্টু তার গান থামিয়ে বলল, 'সব বলবি, শুধু পয়সা দে বলবি না৷ খুব কষ্টে আছি৷ শেয়ার বিক্র করে দিতে হবে মনে হচ্ছে৷
'কেন?
'বাসায় পোল্ট্রি ফার্মের কথা তুলতেই পারছি না৷ আমার পোল্ট্রি সেক্টর আপাতত অফ৷
'বলিস কি?
'দুলাভাই এম.পি. ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন ক্যাম্পিং করতে মফস্বলে চলে যাব৷
'মন্টু তুই ব্যাংকে গিয়েছিলি?
এজিএম হান্নান বললেন, 'হঁ্যা মন্টু গিয়েছিল৷
'চিল্লায় মারার আগে আমি ব্যাংকে গিয়েছিলাম৷ গতকাল আবার যেতে বলেছিল৷ গতকালও গিয়েছিলাম৷
'ব্যাংক-মিটিংয়ে কি হলো?
'ব্যাংক থেকে বলে দিয়েছে আমাদেরটা প্রজেক্ট প্রোফাইলই হয়নি৷ টাকা মেরে দেয়ার ধান্দা৷
'এটা কথা হল?
'আমরা নাকি লোনের টাকা পয়সা খেয়ে বিদেশে কাট্ মারব?
'এই গরুত্বপুর্ন সময়ে মন্টু তুই মফস্বলে চলে যাবি?
'যাব না? আর চিল্লায় চলতেছে না৷ আমার চাকুরীর দরকার৷ বসে থাকার চাকুরী হলে ভালো হয়৷ দুলাভাই এম,পি হতে পারলে তাঁর এপিএস পদে চাকুরী ম্যানেজ করে শুধু বসে থাকার ব্যবস্থা করা যাবে৷
'তোর দুলাভাই ইলেকশনে জিতবেন?
'এবার মাফ নাই৷ ইলেকশনে ককটেল-বোমা বানানোর বিলই হয়েছে তের লাখ টাকা৷ সব ফর্মূলা রেডি৷ দুলাভাই ইলেকশনে জিতবেন-ই৷
কনক বলল, 'আমার কপালে যে কি আছে?
মন্টু বলল, 'তোর কপালে চিকেন ষ্টুল আই মীন মুরগীর নাদা আছে৷ আর আছে শুণ্যের মত হেন'স এগ! গোল গোল সাইজ মুরগীর ডিম৷
'আমি খুব আশাবাদী মানুষ৷ যদিও মাঝে মাঝেই আশার সব খেই হারিয়ে ফেলি৷
মন্টু ওর সার্টের ঢিলা ঘড়ায় বোতাম লাগাতে লাগাতে হেসে বলল 'জ্ঞানীরা বলেছেন অনিশ্চিতের আশায় নিশ্চিত পরিত্যাগ করিও না৷
'তুই কি করবি?
'কনক, আমি নিজে একটা সাইড বিজনেস শুরু করে দিব ভাবছি৷ তোদের ফুলতলী প্রজেক্টের আশায় থাকলে নাখাল পাড়ায় আমাকে শুটকী হয়ে মরতে হবে৷ একদম লইট্ট্যা শুটকী!
'কি সাইড বিজনেস করবি?
'ইন্ডিয়া থেকে কাশির সিরাপ এনে ঢাকায় বেঁচবো৷
'পোল্ট্রি প্রজেক্ট বাদ দিয়ে কাশির সিরাপ?
এজিএম হান্নান বললেন, 'প্রসপেক্ট ভালো৷ দেশে কালো ধোঁয়ার গাড়ীর পরিমান বাড়ছে৷ কাশীও বাড়বে৷ মন্টু তুমি শুরু করে দাও৷
'আমার ফাষ্ট টারগেট ঢাকা সিটির বস্তির চার পাঁচ লাখ লোক৷ তারপর চিটাগাং৷ চিটাগাং সাকসেসফুল হলে রাজশাহী৷
'তোমার প্ল্যান ভাল৷
'রাশুতো আমেরিকা যাচ্ছে৷ এখন স্যাকারিনে চলে না৷ এসপারটাম পাঠাতে বলব৷ ক্ষুধার উপর স্যাকারিনের খারাপ প্রতিক্রিয়া হয়৷ এসপারটামের হয় না৷ রাশু যদি ওটা পাঠায়, তাহলে নিজেই কাশির সিরাপ বানানো শুরু করে দিব৷

রাত এগারটা৷ ওদের বিভাগের নাইট গার্ড পুত পুত করে বাঁশী বাঁজাচ্ছে৷ যদিও নাইট গার্ড জানে এখানে কে কে বসে আছে?
কনক বলল, 'পোল্ট্রি ফার্মের আধুনিক প্ল্যানটা কি ভেস্তে যাচ্ছে?
'জ্ঞানহীন উত্‍সাহ নাকি লাগামহীন ঘোড়ার মতো? কিন্ত এদেশের জ্ঞানী লোকরা কে কি করেছে আমাদের জন্য? হিসাব নিই৷
মন্টুর কথাগুলো কনকের খুব ভালো লাগছে৷ অসম্ভব ভালো!
'ঝড়ঝড় করে তোর মাথায় এত প্ল্যান আসছে কোত্থেকে?
ফোঁশ করে ধোয়ার কুন্ডুলী ছেড়ে এজিএম হান্নান বললেন, 'হালকা গাঁজা টানা হয়েছে৷
'ও গাঁজা পেলো কোথায়?
'আমার সিগারেটে ঢোকানো ছিল৷ কনক তোমার লাগবে? এজিএম হান্নান ঘনঘন সিগারেটে টান দিচ্ছেন৷
'আমি গাঁজা টানার লোক না তা আপনি ভালো করেই জানেন৷
'সরি কনক!
মন্টু এখন ওদের সাথে সম্পর্কহীন অন্য রকম মানুষ হয়ে গেছে৷
মন্টু বলল, 'কনক তুই যে গাঁজা টানিস না সে কথা আমি জানি৷ আমার কথা শুন্৷
'কি কথা?
'দেখ্তো পাশের স্বপ্নগঙ্গাটা খোলা আছে কিনা?
'পার্কের কথা বলছিস্? এই রাতের বেলায় তুই পার্কে যাবি?
'পার্ক বলিস না৷ স্বপ্নগঙ্গা বল, স্বপ্নগঙ্গা৷
'আচ্ছা স্বপ্নগঙ্গা বললাম৷
'ওখানে এখন বাতাস বইছে? ডাল নড়ছে? পাখি গান গাইছে?
'পাখির খেয়ে কাজ নেই? এত রাতে পাখি ডাকে?
'জোত্‍স্না আছে?
'ঢাকা শহরে জোত্‍স্না দেখা যায়?
'তারা? হান্নান বস্ আমাকে আর একটা সিগারেট দিন৷
'কনক, আকাশে তারা নেই?
কনক এজিএম হান্নানকে বলল, 'বস্ ও কে আর সিগারেট দেয়া যাবে না৷ মন্টু তুই বাসার ছাদে গিয়ে তারা দেখিস৷
মালেক বলল, 'মন্টু বেশী করে দুধচিনি দেয়া এই চা টা এক চুমুকে খেয়ে নিই৷ আবেগ চলে যাবে৷
মন্টু চা খেলো৷ মাথার ঝিমুনি একলাফে পালাচ্ছে মনে হলো৷ তার লাল চোখে রাস্তার আলো পরে চোখ চিকচিক করছে৷ সে কয়েকবার মাথা ঝাঁকি দিল৷ রাস্তার গর্তে জমে-থাকা পানিতে চড়ূই পাখি গোসল করে যেন শরীর-মাথা ঝাঁকছে৷ আহা কত সুখ! মন্টুর পাতলা গোঁফে ঢাকা মুখে হাসি ঝিলিক দিল৷
'কনক, বিদেশ থেকে আরো একটা অষুধ আমদানী করার ধান্দায় আছি!
'কি অষুধ আমদানী করতে চাস্ ?
'ধাতু দুর্বলতার অষুধ!
'কি-ই?
'দোস্ত, এদেশের মানুষগুলোর প্রচন্ড ধাতু-দুর্বলতা আছে! নইলে এদেশের মানুষগুলো এরকম হয়ে যাচ্ছে কেন?
'কি রকম?
'মেরুদন্ড সোজা করে কেউ দাঁড়াতে পারছে?
'মন্টু তুই কি বলছিস্?
'হঁ্যা, মানুষগুলো জেগে উঠে না কেন? তাই ধাতু দুর্বলতার অষুধ খুঁজছি৷ মানুষগুলোর ধাতু শক্ত হলে চাকরি আমাদের খোঁজে বেড়াবে৷ মলিকু্যলার বায়োলজিষ্ট আর কোথায় আছে রে? অষুধটা আমার পেতেই হবে৷ কিছু বুঝলি?
মালেক হুঁ হুঁ করে হেসে দিল৷ মালেক মোটা৷ মালেকের গলা মোটা৷ কন্ঠটা একই প্যারালালে মোটা ভষ্কালে৷ তার উপর গলায় ঠান্ডা লেগেই আছে৷ তার হাসিটা মনে হয় ভাংগা টিনের চোংগা দিয়ে ভুঁ ভুঁ করে বেরিয়ে আসছে৷
মালেক চোংগা-হাসি দিয়ে মন্টুকে সমর্থন দিয়ে বলল, 'তোর আইডিয়াগুলো এক্সেিলন্ট৷ দু'টো আইটেম-ই মহৌষুধ! জনগনের মুখে দিতে পারলে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না৷ চালিয়ে যা৷
মালেক কনককে বলল, 'দোস্ত তুই এখন খুব ব্যস্ত?
'এই রাত সাড়ে এগারটায় কি নিয়ে ব্যস্ত থাকবো?
'সবাইকে কিছু খাওয়াবো৷ অনেকদিন হলো তোদের সাথে যোগাযোগ নেই৷ খাওয়ানো টাওয়ানো হয় না৷
মন্টু ওর ঠোট ঢাকা পাতাল গোঁফে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, 'মালেক একদিন মরবেই৷ ওর কুলখানীর খাওয়াটা আজ খেয়ে নেই৷ পরে দাওয়াত নাও পেতে পারি৷

মালেকের কথায় কনক মন্টু এজিএম হান্নান খাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লো৷ প্রজেক্ট প্রোফাইল নতুন করে লিখে অন্য ব্যাংকে জমা দেয়া হবে৷ প্রজেক্টের আলাপ আজ ব্যাংক পর্যন্তই হলো৷

মেয়ে দু'টা শপিং করতে গেছে৷ বিয়ের বাজার৷ বিয়ের বাজারঘাট আজকাল মেয়েরাই ভালো করতে পারে৷ দোকানদার আহ্লাদে আটখানা৷ পনেরশ টাকার শাড়ীর দাম হাকা হয় পাঁচ হাজার৷ পাঁচশ থেকে কচ্লাকচ্লি করে শাড়ীর দাম বারশ টাকায় নামানো হয়৷ কোথায় পাঁচ হাজার কোথায় বারশ?
হৃদি-অমা বিয়ের বাজার করতে বেরিয়েছে সকাল সাড়ে দশটায়৷
ইশতান্না বেগম হৃদির ঘরের বারান্দায় চেয়ারে বসে আছেন৷ বাইরে রোদ৷ ছাদের টব বাগানে গতরাতে পানি দেয়া হয়নি৷ এগুলোর তদারকি অমা-হৃদিই করে থাকে৷ মেয়ে দু'টা বিয়ের ঝামেলায় অস্থির! ইশমাম-ইতমামের দায়িত্ববোধ দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান! যার যা কাজ সে সেটা করলে-ই তো সমস্যা হয় না৷
বারান্দায় বসে ইশতান্না বেগমের মাথায় কিছু চিন্তা এসে গেলো৷
'ইতমাম এমন হলো কেন? ভালো আর্থিক অবস্থা মানুষকে গতি দেয়৷ গতি মানুষের সময় কমিয়ে দেয়৷ খারাপ অর্থনৈতিক কারণে কিনা সেটা বুঝা মুশকিল? এদেশের মানুষগুলোর পারিবারিক বন্ধন কত সুন্দর! কর্মক্লান্ত স্বামীর অপেক্ষায় স্ত্রীরা না খেয়ে ঘরে বসে থাকে৷ আমি বসে থেকেছি৷ অনেক দেশে এটা নাকি সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু না? ঐদেশগুলোতে সবার মধ্যে 'আমি একমাত্র আমার-ই' ধরনের মানসিকতা? ইতমাম চৌদ্দ বত্‍সর বয়স থেকে থাইল্যান্ডে থাকছে৷ থাইল্যান্ডের কি অবস্থা?
'দেশের প্রতি পরিবারের প্রতি রক্তের টান সৃষ্টি হোক - এ আশায় ছেলেকে বিয়ে দেয়া হলো৷ ইতমাম সুন্দরী স্ত্রীকে দেশে ফেলে রেখে আগের মতই রইল৷ ওর সমস্যাটা কোথায়?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইশতান্না বেগম হঠাত্‍ ঘরে ঢুকলেন৷ তিনি ছেলের সাথে কথা বলার জন্য ব্যাংককে ফোন করে বসলেন৷ অন্যদিন ফোন করে তিনি প্রথমে ছেলের স্বাস্থ্য নিয়ে কথা তুলবেন৷ কেমন আছিস? ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া হচ্ছেতো? সময়মত ঘুমুতে যাস্ .. ইত্যাদি ইত্যাদি৷ তিনি আজ তা না করে সরাসরি বললেন,
'বাবা তুই ফ্যামিলিটাইসে খুব ফরমাল৷ তুই এমন হলি কেন? তোর বড়ভাই ইশমাম বিয়ে করল তুই দেশে আসিস নি৷
'আম্মা আমার পক্ষ থেকে যা যা দেয়ার দরকার পার্সেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল৷
'দেশে বেড়াতে এসে এক রাতের বেশী ছুটি কাটাস না৷ আমার খারাপ লাগে না?
'দু'তিন সপ্তাহ ছুটি! আমি এটা কল্পনা করতে পারি না৷ এ রকম ছুটি কাটানো যায় অসুস্থ হলে হাসপাতালে আর কোথাও নয়৷
'তোর একমাত্র বোন অমার বিয়ে৷ বাবা দেশে আয়৷
'এখন ছুটি নেয়া অসম্ভব! আমি আসতে পারব না৷ অমাকে যা দেয়ার দরকার সব পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷
'তোদের বাবা নেই৷ তোরা দ'ুটো ভাই যদি একসাথে অমার বিয়েতে না থাকিস কেমন দেখায়?
'আম্মা আমি মাফ চাচ্ছি৷ তোমার অনুরোধ রাখা সম্ভব না৷
'বউমা এখানে আছে৷ তুই এলে অমাও খুব খুশী হবে৷ অমার স্বামীকে তুই দেখবি না?
'অমার হাসবেন্ড আমেরিকা যাওয়ার পথে ব্যাংকক হয়ে গেলে এয়ারপোর্টে তার সাথে দেখা করা যাবে৷
ইশতান্না বেগমের বুক পোড়ে দুঃখের একটা হাওয়া বেরুলো৷
তিনি ফোন রেখে দিলেন৷

হৃদি, অমা এবং ইশতান্না বেগম রাতের খাবার খাচ্ছেন৷ কারোর-ই মন খুব ভাল যাচ্ছে না৷
সুখ একা ভোগ করার জিনিস নয়৷ মাঝে মাঝে দুঃখও৷
ইশতান্না বেগম খেতে খেতে হৃদিকে বললেন, 'ইতমামের সাথে কথা বলতে আমার খুব কষ্ট হয়!
'হৃদি তার শ্বাশুড়ীর দিকে শুণ্য দৃষ্টিতে তাকাল৷
'আম্মা ফোন করেছিলেন?
'দুপুরে ফোন করেছিলাম৷ বউমা, শেষবারের মত তুমি আর একবার ফোন করে দেখবে ও আসে কি না?
'আম্মা ও আপনার কথার সম্মান দেখায় নি৷ আমি বললেও ও আসবে না৷
'তা ঠিক৷ ও আসবে না৷ শয়তানটাকে থাইল্যান্ডে পড়তে কেন যে পাঠিয়েছিলাম?
অমা বলল, 'ভাইয়া না এলে আর কি করবে?

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুলো অমার বুক থেকে৷ প্রবাসী এই ভাইটাকে নিয়ে তার নিজস্ব কিছূু সুখ-স্বপ্নের পরিকল্পনা ছিল৷ সেগুলো কল্পনাতেই রয়ে গেল৷

ইদানীং কষ্টসাধ্য কাজগুলোর মধ্যে ঢাকা শহরের মার্কেটগুলোতে শপিং করা অন্যতম৷ হৃদি আজ সারাদিন অমার বিয়ের শপিং করছে৷ সে ক্লান্ত হয়ে গেছে৷ ভাই হিসাবে ইতমামের কাজটা যেন মনেপ্রাণে সে-ই করছে৷
হৃদির পরিশ্রান্ত চোখমুখ দেখে ইশতান্না বেগম বললেন, 'বউমা তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে৷ মনটাও বিষন্ন লাগছে৷ খেয়ে দেয়ে শু'য়ে পড়গে৷ জেগে পড়াশুনার দরকার নেই৷
'আচ্ছা৷
'বউমা তুমি কনকের সাথে যোগাযোগ করে যে কাজটা করলে তা আমার ধারনার বাইরে ছিল৷
'আম্মা আমি অমাকে খুব ভালবাসি৷
হৃদির চোখ ভিজে উঠলো৷ ইশতান্না বেগম বুঝতে পারেন নি৷
অমা বলল, 'খাওয়ার সময় চোখে পানি আসা ভাল না৷
হৃদির চোখে পানি দেখে পাশ থেকে সে হৃদিকে বাম হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল৷

হৃদি আর কথা বলল না৷ অমা হৃদি খাওয়া দাওয়া সেরে ঘরে ঘুমুতে গেল৷

ভাবী আর ননদ৷ সম্পর্কটা প্রতিযোগিতামুলক৷ কষ্টে গড়া সংসারে ভাবীরা এসে নোঙর করে৷ মাঝে মাঝে এমন নোঙর (!) করা হয় যেন সংসারের অন্যান্য নৌকোগুলো নোঙরগুলো ছিঁড়ে অথৈই পানিতে হারিয়ে যায়৷ কিন্তু হৃদি-অমা এক অনন্য ভাবী-ননদ সম্পর্ক নিয়ে তাদের জগতে বাস করছে৷ না হলে কি অমা এমনি হৃদির ভিতরে বোনের, বান্ধবীর আর মাতর্ৃত্বের গন্ধ পায়?
ভাবী আর ননদ- জয় জয়তু!

হৃদি ক্লান্ত৷ অন্যদিনের মত ঘুমানোর আগে অমা আর হৃদির তেমন কথাবার্তা হচ্ছে না৷ হৃদির মনে হচ্ছে তার কিছু একটা হবে৷ কি হবে? কিভাবে কি হবে সে কিছু উঠতে পারছে না৷
অমা হাসিমুখ করে জিজ্ঞাস করল, 'ভাবী আমার বিয়ের পর আমি কি করব শুনবে?
হৃদি পাশ ফিরলো৷ 'কি করবে?
'ট্র্যানজিট ভিসা নিয়ে ব্যাংককে কয়েক রাত থাকব৷
'উদ্দেশ্য?
'ভাইয়ার জন্য বাসা খুঁজবো৷ বাসাটা হবে টু লিভিং রুমস উইথ টু এটাষ্টড বাথস, ওয়ান ডাইনিং এন্ড ওয়ান কিচেন এর৷
'তারপর?
'ও বাসায় তোমাকে দিয়ে নোঙর গাড়াবো৷ তারপর হনলুলু যাব৷ হনলুলু থেকে ও সময় না পেলে আমি একা চলে আসব৷ তোমার সাথে গল্প করব আর ঘুমুবো৷ এই দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনবো৷ কি ঘুমুতে দেবে না?
'তখন আমার সাথে ঘুমুতে ভাল লাগবে?
'ভাবী, তোমাকে আমার আমৃতু্য ভাল লাগবে৷
'তোমার কথা শুনে খুব ভাল লাগল৷
'সত্যি?
'হঁ্যা৷
'হেসে বললে না যে?
হৃদি হাসলো৷
'অমা তোমার হাতটা আমার হাতে দাও৷
হৃদি অমার হাত ধরে বলল, 'তোমার স্বপ্ন সফল হোক৷ লাইট অফ করো৷ আম্মা বকবেন৷
'ভাবী, আমি আব্বাকে বেশীদিন পাইনি৷ মৃত-বাবাকে এত বেশী করে ভালোবাসতে শিখলাম কিভাবে?
'এটা আল্লা করে দেন৷
'এই আব্বা আব্বা করতে গিয়ে আম্মাার প্রতি অবিচার করে ফেলেছি৷ অসংখ্যবার দেখেছি আম্মা আব্বার ছবি দেখে কাঁদছেন৷ তোমাকে পেয়ে বাবার ভালোবাসা আবার আমি ফিরে পেয়েছি৷ ভাবী আমার হাতটা শক্ত করে ধরো৷
হৃদির হাতের মুঠিতে অমা হাত রেখে ঘুমিয়ে গেল৷

রাত দ'ুটো৷ অমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে৷ ও চোখ খুলে তাকাল৷ কিছুকিছু ঘুমে মানুষের চোখ কোন কারণ ছাড়াই হঠাত্‍ করে খুলে যায়৷ কিছু ঘুমে ভুতপেত্নী বা খুনখারাবির ভয়ে মানুষ ইচ্ছে করে চোখ খুলে তাকায়৷
এসমস্ত কারণে অমার ঘুম ভাঙ্গেনি৷ হৃদির নাক টানার হিঁশ হিঁশ শব্দে অমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে৷ ওর বাম হাত হৃদির ডান হাতে ধরা আছে৷ অন্ধকারে হৃদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে৷ অমা তার ডান হাত হৃদির উপর রাখল৷ হৃদির চোখের নীচে মুছিয়ে দিতে দিতে সে জিজ্ঞাস করল, 'ভাবী খারাপ স্বপ্ন দেখছিলে?
হৃদি কথা বলল না৷
হৃদির বালিশে হাত লাগতেই অমা চমকে উঠল৷ বালিশের অনেকটা জায়গা ভিজে আছে৷ ভিজে যাওয়ার পরিমান থেকে ওর মনে হলো হৃদি অনেক্ষণ ধরে কাঁদছে এবং এ পর্যন্ত ঘুমায় নি৷
অমা উঠে হৃদির পাশের বেডসুইচ জ্বালাতে গেল৷ অমা আলো জ্বালাতে পারল না৷
হৃদি বাঁধা দিয়েছে৷
বাঁধা দিয়ে হৃদি নাঁকি গলায় বলল, 'অমা লাইট জ্বালিওনা৷
অমা অন্ধকারেই হৃদিকে আরো কাছে টেনে নিল৷ 'ভাবী কেঁদ না৷

হঠাত্‍ ঝড় উঠলো! এরপর যা ঘটল তা অমার কাংখিত ছিল না৷
অমার বুকে হৃদি তার মুখ চেপে ধরেছে৷ কষ্টের চাপে মনে হলো হৃদির বুকের পাঁজর ভেঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছে৷
হৃদি কেঁপে কেঁপে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল, 'অ-মা আমার কপাল এমন কেন রে! আমি খুব অসুখী হয়ে গেছি !
'ভাবী কি বলছ?
'সত্যি বলছি!
'এমন করে বল না ভাবী৷ অমার খুব খারাপ লাগছে৷ আর দু'এক সপ্তাহ৷ আমি নিজে তোমাকে নিয়ে ব্যাংকক যাব৷ ভাইয়ার সাথে আমি যুদ্ধ করব৷ বোনরা কখনো ভাইদের কাছে হারে না৷
অমার শান্তনা বাণী হৃদির জন্য কোন কাজে দিল না৷
'বোন আমার আমি ব্যাংকক গেলেও কোন লাভ হবে না৷
'কি-ই উল্টোপাল্টা বকছ?
'হঁ্যা অমা কোন লাভ হবে না৷
'অসম্ভব! লাভ অবশ্যই হবে৷
হৃদির মুখ ফস্কে একটা কথা বেরিয়ে গেল৷
ঝড়টা শুরুই হয়ে গেল৷
'তোমার ভাইয়ার আর একজন বউ আছেন' কথাটা বলে হৃদি অমাকে আগের চেয়ে শক্ত করে আকড়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগল৷
'ভাবী! না ভাবী! না!! না!! তা হতে পারে না!!! আমি বিশ্বাস করি না৷ অসম্ভব! অসম্ভব!! অস্বাভাবিক হাহাকারের একটা শব্দ!
অমা শাঁরাশির মত হৃদিকে বুকে জড়িয়ে ধরে হৃদির চেয়ে বিকট শব্দে হাউমাউ করে কাঁন্না শুরু করে দিল৷
কিছুকিছু দুঃসংবাদ মানুষের ঘুম-অবস্থার অকস্মাত্‍ পরিবর্তন করে মস্তিষ্ককে অস্বাভাবিকভাবে জাগিয়ে তুলে৷ হৃদির কথা শুনে অমার তাই হলো৷

গভীর রাত৷ অমা-হৃদির মত দু'জন যুবতীর একসাথে হু হু করে কান্নার শব্দে ইশতান্না বেগমের ঘুম এক লাফে ভেঙ্গে গেছে৷ তিনি ধচমচিয়ে বিছানা থেকে উঠলেন৷
ভয়ার্ত গলায়, কেঁদে কেঁদে ইশতান্না বেগম বারবার ডাকছেন,
'দরজা খোল্, খোল্্ অমা? বউমা? তোমাদের কি হলো? কাঁদছ কেন তোমরা? দরজা খোল্ অমা!
'সামনে বিয়ে৷ মেয়ের কি অঘটন ঘটল?
তিনি হৃদির ঘরের দরজায় অনবরত কড়া নাড়ছেন৷
অমা হৃদিকে কান্না-অবস্থায় বিছানায় রেখে লাইট জ্বেলে ঘরের দরজা খুলে দিল৷
ইশতান্না বেগমের চোখেমুখে আতংক৷
'কি হয়েছে তোদের? কাঁদছিস কেন? বউমা কাঁদছ কেন?
'আম্মা সে কথা তুমি ভাবীর কাছে জানতে চেয়ো না?
দেয়ালে মুখ রেখে অমা আবার হাউমাউ কাঁদতে শুরু করল৷
কান্নার হৈহুল্লোর৷ আর এই তিনজনের শব্দে নীচ থেকে ইশমাম আর ইভা উপরে উঠে এসেছেন৷
ইশমাম ডেকে বলছেন, 'আম্মা দরজা খোল৷ কি হয়েছে এখানে?
ইশতান্না বেগম হৃদির ঘর থেকে এসে বাইরের দরজা খুলে দিলেন৷
ইশমাম রেগে জিজ্ঞাস করলেন, 'কি ব্যাপার আম্মা? এই গভীর রাতে মানুষ এভাবে কাঁদে? কিছু হলে মানুষ ডাকাডাকি করে৷ এভাবে কেউ হাউমাউ করে কাঁদে না!
'ইশমাম তুই নীচে যা৷ শুধু বউমা থাকবে৷
ইশমাম হতবাক হলেন৷
'আম্মা তুমি কি বলছো?
'তুই নীচে যা৷
ইশমাম নিজের ফ্লাটে নেমে এলেন৷
ইভা অমাকে জিজ্ঞাস করল, 'অমা তোমাদের কি হয়েছে?
'ভাবী শোনবে?
'বলো!
অমা কেঁদে কেঁদে বলল, 'ভাইয়া থাইল্যান্ডে অনেক আগ থেকেই আর একজনকে বিয়ে করে আছেন৷
'নাউজুবিল্লাহ' বলে ইশতান্না বেগম হৃদির চেয়ারে বসে পড়লেন৷ মেয়ের কথা শুনে তাঁর শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে৷ তাঁর মনে হচ্ছে তিনি চেয়ার সহ নীচে পরে যাবেন৷
ইশতান্না বেগম তাঁর বুকের মধ্যে দ্বিতীয় বার ছুঁরির আর একটা ঘাঁ খেলেন৷ প্রথমবার এ রকম ঘাঁ খেয়েছিলেন স্বামীর অকাল মৃতু্যতে৷
'খোদা তুমি কোন্ পাপিষ্ঠকে আমার গর্ভে দিয়েছিলে? আমাকে খুশী রাখার জন্যই শয়তানটা এদেশে বিয়ে করেছে?
ইভা বললেন, 'অমা আগামী সপ্তাহে তোমার বিয়ে৷ এখন এব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাটি করো না৷ প্লী..জ৷
অমা দেয়াল থেকে মুখ ফিরাল৷ তার চোখমুখে আগুনের শিখা৷ সব শেষ! কিন্তু অগি্নমূর্তিটির চোখ থেকে পানি ঝরছে৷
সে দৃঢ় কন্ঠে বলল, 'কিসের বিয়ে? আমি বিয়ে করব না৷ এরকম হিরের টুকরো ভাবীকে এঅবস্থায় রেখে আমি বিয়ে করব? নাহ্! অসম্ভব!
সে বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকা হৃদিকে জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদতে লাগল৷
ইশতান্না বেগমের মাথায় বাঁজ পড়ল৷ তিনি দু'চোখ বন্ধ করে আছেন৷
ইভা অমার হাত ধরলেন৷ 'অমা ওঠ৷ ভাড়াটেরা প্রশ্ন করবে, শুনবে, জানবে৷ ছিঃ ছিঃ করবে!
'ছিঃ ছিঃ করুক৷ থুথু ফেলুক! এই বাড়ীটা পাপের ঘর হয়ে গেছে!
'অমা তুমি কি-ই বলছো?
'পাপের ঘর না হলে নাকি গভীর রাতে বাড়ীর নিষ্পাপ বউ কাঁদে না? আমি বিয়ে করব না৷ আমি বলে দিচ্ছি আমাকে কেউ যেন বিয়ের কথা না বলে!

হৃদি বিছানা ছেড়ে উঠলো৷ ঝড়ে আহত পাখি উড়ার চেষ্টা!
চোখমুখ মুছে সে অমার হাত টেনে ধরে বলল, 'অমা ওঠ৷ এমন কথা মুখে এনো না৷ রাশু একটা ভাল ছেলে৷ আমার কথা চিন্তা করে তোমার নিজের সিদ্ধান্ত বদলিও না৷ এটা করলে আমি আরো কষ্ট পাবো৷
অমা উঠে হৃদিকে কেঁদে জড়িয়ে ধরল৷ 'ভা-বী...., তোমাকে আমি খুব ভালবাসি৷
'অমা, আমি জানি৷
ইশতান্না বেগম হাতের তালুতে থুতনি ভর করে চোখ বন্ধ করে কাঁদছেন৷ নিঃশব্দের কান্না৷ চোখের পানি তাঁর গাল বেয়ে পড়ছে৷
হৃদি তাঁকে পিছন থেকে জাপটে ধরে কান্না আটকে যাওয়া কন্ঠে বলল, 'আম্মা কাঁদবেন না৷
ইশতান্না বেগম হৃদিকে জড়িয়ে ধরে এবার 'হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন৷ কান্নার-নদী যেন নীচে নামার জন্য পথ খুঁজে পেয়েছে৷ চোখের পানির ঢল আর কা'কে বলে?
'মা! মাগো ! বউমা তোমাকে আমি কষ্ট দিচ্ছি কেন?
'আম্মা আপনি এভাবে কাঁদবেন না৷
'বউমা বয়সের ভারে বয়স্কাদের কাঁদতে কষ্ট হয়৷ সেই কান্না যদি অসংখ্য নিঘর্ুম রাতের গড়া একটা সংসার ভাংগার কান্না হয় তার অর্থ খুব করুণ হয়৷ ইশতান্না বেগম কেঁদে কেঁদে প্রলাপ বকছেন৷
'আম্মা আপনি এভাবে কাঁদবেন না৷ অমা খুব ইমোশনাল মেয়ে৷ ও পাগল হয়ে যাবে৷
'বউমা আমি ভেবেছিলাম অমার দু'হাতে দু'টো শ্রেষ্ঠ হাসি৷ আসলে তা না৷ আমার এক হাতে কান্নার আগুন৷
হৃদি ফুঁপিয়ে উঠল৷ 'অ-ম-মা৷
'বউমা এতবড় একটা সংবাদ তুমি আমাকে এপর্যন্ত বলনি কেন? কে-ন?
'আম্মা আমি ব্যাংকক গিয়ে ওকে বার বার ফেরাতে চেষ্ট করেছি৷
হৃদির কথায় ইশতান্না বেগম কেঁপে কেঁদে উঠলেন৷ 'মা তুমি এখন পর্যন্ত ওকে ফেরাতে পার নি?
হৃদির বুক দুমরে যাচ্ছে৷ তারও চোখের পানি বাঁধ ভেংগেছে৷
ইশতান্না বেগম হুঁ-উঁ্তয়ু হুঁ-উঁ্তয়ু ---- করে কাঁদছেন৷
'বউমা আমাকে আর কিছুদিন সময় দাও৷ দিবে? আমার এ সোনার সংসারকে আমি বেঁচে থাকতে ভাঙ্গতে দেব না৷ আমি খুব কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছি এটাকে৷ আমার এটা আনন্দভেলা৷ বউমা আমাকে সময় দেবে না?
ভারসাম্যহীনতা আর অসহায়ের মত ইশতান্না বেগম হৃদির কাছে এই আবেদন করলেন৷
হৃদির চোখ থেকে পানির যে জোয়ার বইছে তা থামছে না৷

অমার বিয়ে হয়ে গেছে৷ সে এখন খিলগাঁ শ্বশুরবাড়ীতে৷ যেভাবে তার বিয়ে হবে এবং বিয়ের পরের সময়টা কাটবে বলে অমা আশা করেছিল তা হয় নি৷ এ বাড়ীতে আসার প্রথম দিন শ্বাশুড়ী তাকে কাছে ডেকে নিয়ে একান্ত অনুরোধ করে একটা কথা বলেছেন,
'বউমা আমরা রাশুকে কোন দিন সুখ দিতে পারিনি৷ তুমি ওকে সুখ দিতে পারবে না গো?
সুখ কি দেয়ার জিনিস? হায়রে সুখ! কে কোথায় না খোঁজে?
অমা বলেছে, 'আম্মা আমাকে দোয়া করবেন৷
যে সমস্যা হৃদির ছিল তা এখন অমাকে পেয়ে বসেছে৷ তা হলো উদাসীনতা৷ কিছু হলেই সে আকাশ দেখে৷ আকাশের সাথে কি কথা হয়?
'শ্বাশুড়ীর প্রশ্নের উত্তরে আমি আর কি বলতে পারি? রাশুকে সুখী করার চেষ্টা করব৷ এটা আমার স্বপ্ন৷ ওকে তো আমি-ই ভালবেসে বিয়ে করেছি৷
পরমুহুর্তেই হতাশার দীর্ঘশ্বাসে অমার বুক ফোলে উঠে৷

সাত সকালে অমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে৷ মনটা পরে আছে হৃদির কাছে৷ নিজে নিজে অনেক কথা বলে৷ ভাইয়া দেশে নেই৷ সেটা মারাত্মক কোন বিষয় না৷ ভাবীতো মাঝে মাঝে ব্যাংকক যেতেন? এম.ফিলের কোর্সটা শেষ করে একেবারে ব্যাংকক চলে যাওয়ার কথা৷ দুনিয়ার সব স্ত্রীরা-ই জীবনের প্রতিটি দিনরাত স্বামীদের সাথে থাকতে পারে না৷ সংসারের প্রয়োজনে এটা হয় না৷ ভাইয়া ব্যাংককে আর একজন বউ রেখে চলেছেন! এটা গ্রহনযোগ্য না৷ এটা শঠতা! কত শ্রদ্ধা করতাম ভাইয়াকে? কথাগুলো মনে হতেই বুকে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস পুড়ে বেরিয়ে আসে৷
বিয়েতে 'কবুল' নামে মন্ত্র পড়িয়ে বিনেসূতোয় দু'টো আত্মার একটা যোগাযোগের রাস্তা খোলা হয়৷ এক আত্মার কিছু হলে অন্য আত্মায় সূতোয় টান পড়ে৷ কষ্ট লাগে৷ তা না হলে অমার কষ্টে রাশুর মনে প্রশ্ন জাগে কেন?
রাশু হঠাত্‍ করেই পিছনে এসে জিজ্ঞাস করল, 'অমা তোমার মন উদাসীন দেখছি! এখানে তোমার কষ্ট হচ্ছে?
অমা হচকচিয়ে উঠলো৷
'না না কষ্ট হবে কেন? ভাবীর জন্য মনটা ভালো লাগছে না, এই তো!
'এই চা দাও না? নাশতা করে চা খাওয়া হয়নি৷
'সরি, চা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম৷
শুধু ভালোবাসলে হয়? ভালোবাসার উপাদানলোকে কাজে (একশনে) অনুবাদ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ অনুবাদে ব্যর্থ হলে বিখ্যাত ভালোবাসার-ও মৃতু্য ঘটে৷
অমা রাশুকে চা করে দিল৷ যে চা আগে তাকে কেউ বানিয়ে দিয়ে যেত সে চা এখন নিজে বানাতে হয়৷ ভুল তো হবেই৷
রাশুকে চা দিতে তো ভালো লাগে! সমস্যা অন্যখানে৷ নিজের ভাইয়ের কু-কর্মের কথা কেউ বলতে চায়? রাশুকে অমা তার ভাবীর সংসারের খবরটা এখনও বলে নি৷
রাশু বলল, 'অমা, হৃদির জন্য তোমার আসলেই খুব কষ্ট হচ্ছে৷
'ভাবীকে একটু বলো না আসতে?
'ঠিক আছে হৃদিকে আজ আসতে বলব৷
অমা ভিতরে চলে গেল ৷
এজিএম হান্নান সকাল এগারটার দিকে তাঁর গাড়ী নিয়ে খিলগাঁ এসেছেন৷ রাশুকে বাইর থেকে ডেকে বললেন, 'রাশু, রা-শ-উ বাসায় আছো?
রাশু বাইরে এলো৷
'বস্ ভিতরে আসবেন?
'না, তোমাকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে যেতে এসেছি৷
'কেন?
'ঘরের কোণে বসে না থেকে বাইরে বেড়াও৷ দেশ ছেড়ে চলে গেলে পরে আফসোস করবে৷ আমরা ফুলতলী যাচ্ছি৷ যাবে?
'কে-ন?
'তেমন কাজ নেই৷
'কখন ফিরবেন?
'সন্ধের আগে৷
'ডট চৌধুরী যাবে? কনক?
'হঁ্যা, ওরা দু'জনই যাবে৷
'তা হলে যাওয়া যায়৷

রাশু হড়হড় করে তাঁর গাড়ীতে গিয়ে বসল৷ বিয়ের পর রাশু আজই বাসার বাইরে যাচ্ছে৷ এজিএম হান্নান কনক-ডট চৌধুরীকে তুলে নিতে যাচ্ছেন৷
তিনি রাশুর দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকালেন৷ আবার তাকালেন৷ আবার!
'কি ব্যাপার এ দিকে বারবার তাকাচ্ছেন কেন? আমাকে নতুন দেখছেন? ধ্যেত্‍ গাড়ী চালানতো !
'রাশু, তুমি লাল সার্ট পড়েছো কেন?
'লাল সার্ট দেখলেন কোথায়? এটাতো খয়েরি!
'রাশু, লাল রঙ এর অর্থ জানো?
'না৷
'লাল রঙ যৌন-ভালোবাসার কামশক্তি বুঝাতে ব্যবহূত হয়৷ বেগুণী হলো কর্তৃত্ব, সবুজ তারুণ্য, কমলা সন্তোষ্টি, সাদা পবিত্রতা, কালো অজানা-মৃতু্য৷
'বস্ আপনি গাড়ী থামান৷ আমি সার্ট বদলিয়ে আসবো৷ গাড়ী থামান৷
'মুশকিল তো? ক'জন বাংগালী এটা জানে? তোমার সার্ট বদলাতে হবে না৷
'রঙ এর ব্যাপারে একটু খেয়াল রেখো৷
রাশু এজিএম হান্নানকে দেখছে৷
'রান্নাঘরের দেয়াল হলুদ হলে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া থামে না৷ যে বাচ্চা কাঁদে না সেও অযথা কান্নাকাটি করে৷ নীল হতাশা দুর করে শান্তি এনে দেয়৷
'বস্ আপনি আমার কাছে একটা বিষ্ময়!
এজিএম হান্নান নিঃশব্দে হাসলেন৷
কনক এবং ডট চৌধুরীকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে এজিএম হান্নান যখন সাভারের দিকে রওয়ানা হলেন তখন বিকেল তিনটে৷ টাইম কিলার আর কা'দের বলে?
গাড়ী গাবতলী ছেড়ে আসতেই কনক বলল, 'বস্ ষ্টিয়ারিং আমার হাতে দেন৷ আমি লং ড্রাইভ করব৷
কনককে ড্রাইভ করতে দিয়ে এজিএম হান্নান পিছনের সীটে রাশুর পাশে বসলেন৷ ডট চৌধুরী এখন কনকের পাশে বসে আছে৷ ওর গায়ে বাতাস বেশী লাগানো দরকার৷ তাই ওকে জানালার পাশে বসতে হয়৷
এজিএম হান্নান রাশুকে জিজ্ঞাস করলেন, 'বিয়ে সাদী করলে কোন কিছু বললে না যে?
রাশু থতমত খাওয়ার মত করল৷ দুনিয়াটা যেমন একটা বিষ্ময় এর বাসিন্দা এজিএম হান্নান তেমন আর একটা বিষ্ময়কর জীব! তিনি না গাঁজা খেয়ে মরমিয়া-তত্ত্ব নিয়ে ডুবে থাকেন? সে এবার শব্দ করে বলল,
'বস্, এটা কেমন প্রশ্ন? কি বলব?
'কোন ইন্টারেষ্টিং ঘটনা আছে?
'বিয়ে মানেই তো ইন্টারেষ্টিং ঘটনা!
'সাংঘাতিক না হলে একটা বলো৷ বলা যাবে?
'একটা বলা যাবে৷
'বলো বলো! এজিএম হান্নান মনে হলো লাফিয়ে উঠলেন৷
'বলছি৷ ব্যাপারটা আপনাদের কাছে পুরাতন হতে পারে৷
এজিএম হান্নান রাশুর পাশে চেপে বসলেন৷
'বলো শুনব৷
'আমি অমাকে বললাম আমাদের বিয়ে হলো৷ আজ হলো অমারজনী! ও আমার দিকে বিষ্ময়ে তাকালো৷ তার চোখের পলক পড়ছে না৷
'আরে! আজ চন্দ্রকলা অদৃশ্য হলো না? আমি কোন্ লাইনে কথা বলছি ও ধরতে পারছে না৷ আজ অমাবশ্যার রাত না? অমা এবার হাসলো৷ বিধাতার কাছে তোমার চাওয়ার কিছু আছে?
'ও বলল, আগে তোমার চাওয়াটা বলো৷ আমি বললাম, আগে তোমারটা শুনি৷ ও বলল না৷ নতুন বউ! যদি বেঁকে যায়? বুঝেনই তো! আমাকেই আগে বলতে হলো৷
'তোমারটা কি ছিল?
'বস্, আমাদের দু'জনের জন্মদিন মিলে গেছে৷
'তাই নাকি?
'আমি বললাম, বিধাতার কাছে আমার চাওয়া হলো প্রথম সন্তানের জন্ম দিন যেন আমাদের বিয়ের তারিখেই হয়৷
এজিএম হান্নান বললেন, 'লাভ?
'ম্যারেজ ডে আর বাচ্চার বার্থডে একই দিনে পালন করতে পারব৷ এক ঢিলে দুই পাখি, গাহি আর গাহি৷
'তারপর?
'কথাটা শুনে অমা আমার কাঁধে শারাশির মত একটা চিমটি দিল৷ নিঃশব্দে চি-ত্‍-কা-র দিয়ে উঠলাম __ উঁহু . হু . রে ! মা .রে! মরছিরে __ নতুন বউ! বুঝেনই তো!
এজিএম হান্নান চোখ বন্ধ করলেন৷ 'ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নালিল্লাহে রাজেউন!
নতুন বউ! এটা কি করল? তোমার আগে বিড়াল মারল?
'আমি জিজ্ঞাস করেছিলাম চিমটি দিলে যে? অমা বলল চিমটির অর্থ হলো বিধাতার কাছে ওর চাওয়া আর আমার চাওয়া মিলে গেছে৷ মনের কথা মিলে গেলে চিমটি দিতে হয়৷

কনক গাড়ী ড্রাইভ করছে৷ সে রাশুকে বলল, 'ফুলশয্যা রাতের তোদের এ ইচ্ছেটা দারুন! এটা অনেকে উইশ করবে৷
এজিএম হান্নান উথলিয়ে উঠলেন৷
'রাশু, ভাল কথা মনে করেছো৷ ফুলশয্যার ফুল কেমন ছিল? ফুল কিন্তু হাইকোর্টের গেট থেকে আমিই কিনে দিয়েছিলাম!
রাশু বাম হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরলো৷ বুঝা যাচ্ছে না সে এ রাস্তার বিচিত্র সব গন্ধের অত্যাচারে মুখে হাত দিয়ে আছে নাকি অন্য কোন কারণে৷
সামনের সীট থেকে ডট চৌধুরী রাশুর দিকে মাথা ঘুঁরাল৷ রাশু হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে৷
'কিরে হাতে মুখ ঢেকে ফিকফিক্ করছিস কেন? হাসতে চাইলে হেসে ফেল্৷
রাশু এজিএম হান্নানের দিকে তাঁকিয়ে বলল, 'ধু্যর বস্ ! ফুল নিয়েও কাহিনী হয়েছে!
'আবার কোন্ কাহিনী?
'গভীর রাত! আমার খুব ঘুমঘুম ভাব৷ গেঞ্জির নীচে কিছু একটা নড়াচড়া করছে৷ উপরে পাঞ্জাবী নীচে গেঞ্জি৷ শুঁরশুঁরি লাগছে৷ নতুন বউ! বুঝেনই তো! খপ্ করে হাত চালালাম৷ নাহ্, নতুন বউয়ের হাতটাত কিচ্ছু না! বেড সুইচ জ্বালিয়ে দিলাম৷ অমা পাশে ঘুমাচ্ছে৷ গেঞ্জির নীচে হাত দিয়ে দেখি দু'টা শুঁয়া পোকা৷ সাপের চেয়ে শুঁয়া পোকাকে আমি এক হাজারগুণ বেশী ভয় পাই৷ যায় কই? দে দেঁৗড়! মশারি, মশারির দড়ি, স্ট্যান্ডম্যান্ড সহ বিছানা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে নীচে পড়লাম৷
'ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নালিল্লাহে রাজেউন!
'নীচে নেমে দেখি আমি জাটকা ইলিশের পোনা মত মশারির জালে আটকে আছি৷ আমাকে কারেন্টের জালে ধরা হয়েছে৷
'বিছানায় জব্বর একটা ভূমিকম্প চালালে! নতুন বউ ভয় পায় নি? ভয়ে হাউমাউ করে চিত্‍কার দিয়ে উঠে নি ?
'না ও ভয় পায় নি৷ ভেবেছিলাম অমা ঘুমাচ্ছে৷ মশারির জাল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দেখি অমা বিছানায় পা-মোড়ে বসে তন্ময় হয়ে আমাকে দেখছে৷ ওহ্ ওকে তখন কি যে ভালো লাগছিল! পবিত্র ফুল শয্যায় যেন নিষ্পাপ এক ঋষি বসে আছে৷ ও মুশিকের খেলা দেখছে৷ বস্ আপনি পোঁকাওয়ালা ফুল কিনেছিলেন?
'নাহ্! পোঁকায়ালা ফুল কেনার পোলা এজিএম হান্নান না৷
'পোকা এলো কোত্থেকে?
'ফুলে পোকা ডিম লুকিয়ে রাখে৷ ফুলশয্যার রাত উত্তাপ আর আর্দ্রতায় ভরা থাকে৷ তখন ডিম থেকে পোকা বেরিয়ে আসে৷ এই তো!৷ ফুলশয্যার সুবাস, তোমার .. 'আজি এই বসন্তে এত ফুল ফোটে'...এই গান পোঁকাকেও পাগল করে দেয়! বুঝইতো নতুন বউ৷ ফুলশয্যা! আর ফুলশয্যার রাত!

কনক আর ডট চৌধুরী হাসছে৷ নিরন্তর সে হাসি৷ থামাথামি নেই৷
ডট চৌধুরী কনককে বলল, 'কনক তুই মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালা৷ আজ কিছু একটা ঘটবে বলে মনে হচ্ছে৷
কনক রাশুকে বলল, 'রাশু তুই বারবার নতুন বউ! বুঝেনই তো! বলছিস্৷ তুই কি বুঝাতে চাচ্ছিস পরিস্কার করে বলবি?
'কনক এটা বুঝানোর জিনিস না৷ ফুলশয্যার রাত! নতুন বউ! বুঝিস-ইতো!
'এতো মোর জ্বালা ! তুই কি বুঝালি? আমি কি বুঝ্লাম?
'বুঝসিতো নতুন বউ!!
'বাংলাদেশে তুই-ই প্রথম বিয়ে করেছিস্? এটা বুঝানোর জিনিস না বলছিস?

রাশু চুপ করে রইল৷

এজিএম হান্নান কনককে বললেন, 'রাশুকে আমার পক্ষ থেকে কোন গিফ্ট টিফ্ট দেয়া হলো না৷
'বস্ আমি আর চৌধূরী একটা করে দিয়েছি৷ আপনার মন তো সমুদ্রের মত বড়৷ আপনি বড় একটা কিছু দিন না?
এজিএম হান্নান রাশুর দিকে তাকিয়ে ঘাড় ঝাঁকালেন৷ 'পেন ইজ বেটার দেন সোর্ড, রাশু কি বলো?
'অবশ্যই৷
'আমার কাছে বাঁশের কঞ্চির কলম থেকে শুরু করে আধুনিককালের অনেক ধরনের নামী দামি কলমের কালেকশন আছে৷ সেখান থেকে বেছে তোমাকে একটা কলম দিব৷
'আচ্ছা৷
'তোমার জন্য একটা কলম সিলেকশন করে রেখেছি৷ এই কলম দিয়ে সোভেয়েত ইউনিয়ন ব্রেকার 'ফাদার অফ পেরেস্ত্রোইকা'- মিখাইল গর্বাচভ পদত্যাগ করেছিলেন৷
রাশু তাঁর কথা শুনে কোন মন্তব্য করল না৷

ডট চৌধুরীর সমস্যা হচ্ছে৷ তার মনে হলো নাকের মধ্যে শিড়্শিড়্ করে কি যেন ভিতরে ঢুকছে৷ ঢুকেই পুরোনো হান্নান-এলার্জিটা সেনসেটিভ হয়ে উঠলো৷ সে চুপ করে থাকতে পারল না৷ হাঁচি বেরিয়ে গেল৷
'ফুটেন মিয়া! চাঁপা ছাড়ার জায়গা পান না? এ গল্প ছাড়বেন ঐ যে রাস্তার রিকশাওয়ালা আছে তাদের কাছে৷ গর্বাচভ আপনাকে তাঁর কলম পাঠিয়ে দিয়েছেন?
এজিএম হান্নান নিরাগী ঠান্ডা মাথার মানুষ৷ রাশু-কনক তাঁকে কোন দিন রাগতে দেখে নি৷ ডট চৌধুরীর কথায় এখন এজিএম হান্নান মনে হল রাগ করলেন৷
তিনি রাগী স্বরে বললেন, 'ডট চৌধুরী অনার্স-মাষ্টার্সে ফার্ষ্ট ক্লাস পাও৷ আর যাই পাও না কেন? এ.জি.এম. হান্নানকে চিনতে তোমার অনেক সময় লাগবে৷ ইউ হ্যাভ এ লং ওয়ে টু গো৷
'ইংরেজী ছাড়লেও আপনাকে চেনার দরকার নেই৷
'আছে দরকার আছে৷
'বয়স কমতো! যা ইচ্ছে ফস্ করে বলে ফেলো৷ লিসেন, গর্বাচভ যখন পদত্যাগ করলেন তাঁর পকেটে তখন কলম ছিল না৷ সি.এন.এন.এর প্রেসিডেন্ট টম জনসন নিজের পকেট থেকে মন্টব্ল্যান্ক কলম বের করে এগিয়ে দিলেন৷ সেটা দিয়েই গর্বাচভ পদত্যাগ করছেন৷
রাশু বলল, 'বস্ অনেক খবর রাখেন দেখি?
কনক হেসে বলল, 'বস্ যা বললেন সত্যি নাকি?
'হঁ্যা সত্যি৷
'রাশু তোমাকে আমি সেই মন্টব্ল্যান্ক কলমটা গিফট করব৷
কনক জিজ্ঞাস করল, 'চৌধুরী, তুই কি গর্বাচভের পদত্যাগের দৃশ্য টিভিতে দেখেছিলি?
'আমি দেখিনি৷
এজিএম হান্নান বললেন, 'তা হলে পটকা মাদবরি কর কেন? পটকা মাদবরি চেন? যে মাদবরি কিছুক্ষনের মধ্যেই ফট করে ফেটে যায়৷ বলতো ভার্সাই চুক্তি হয়েছিল কোন কলম দিয়ে?
চৌধূরীর চোখ কপালে উঠে গেছে৷
'আরে! ভার্সাই চুক্তি কি আমি তাই জানি না৷ আবার চুক্তিপত্র লেখার কলম? আমি কি গোপাল এর ছেলে?
'জানলে গোপালের ছেলে হতে হয় না৷ গণেশের ছেলেরাও পারে৷
'আপনি বুঝলেন আমার কচু!
'কচু শুধু তোমার আছে আমার নেই?
'আপনার কচু নেই! কচু তো আছে? হাটে নিয়ে যান ভালো দাম পাবেন৷
'ডট চৌধুরী তুমি কিন্তু অশ্লীল কথা বলছো ?
'আপনি শ্লীল অশ্লীল বুঝেন? আমি গোপাল (এড়.চড়ষ.) অর্থ্যাত্‍ সরকার ও রাজনীতি (এড়াবত্‍হসবহঃ ্ চড়ষরঃরপং) নিয়ে পড়েছি? আমি মলিকু্যলার বায়োলজি এর ছাত্র৷
'ডিপার্টমেন্ট টু হল করতে করতে দুনিয়াদারীর খবর রাখো নাকি?
'খবর রাখি না মানে?
'চোখকান খোলা রাখলে কে কোন্ কলম দিয়ে কি লিখলো সব বুঝতে পারবে৷
ডট চৌধুরী চুপ মেরে গেল৷ মিনিট খানিক পর সে এজিএম হান্নানকে বলল, 'গর্বাচেভের পদত্যাগের কলমটি নয় বরং বলুন সেই ব্র্যান্ডের কলম দিব৷
'একই কথা হল৷ কলমটির দাম চার হাজার টাকা৷
'একই কথা হল কিভাবে? আগরতলা আর জুতারতলা এক কথা? শিল্পকলা আর বিচিকলা এক কথা? যা বুঝেন না তা নিয়ে কথা বলবেন না!

ফুলতলীতে যাওয়া হলো৷ সীমানা মাপা হলো৷ এর আগেও মাপামাপি করা হয়েছিল৷ মেপে ঢাকায় আসা হয় সীমানা আবার ভিতরের দিকে চলে আসে৷ পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে৷ যাদের লোক নেই তাদের জমি ছোট হয়ে আসে৷ মনে হয় সীমারেখার নিজেরই পা আছে? ছোট আর ক'ধরনের আছে?
জমিতে চেন টানতে টানতে ওরা ক্লান্ত হয়ে গেছে৷ মলিকু্যলার বায়োলজিতে পাশ করে ওরা আর কত কি-ই করবে? ডিমের মধ্যে ভিটামিন এ ঢুকাবে, ভিটামিন ই ঢুকাবে? চালে ভিটামিন এ ঢুকিয়ে গোল্ডেন রাইস করা গেলে আর ডিম! সোনার ডিম পারাবে ওরা মুরগী থেকে৷ সোনার ডিম কে না চায়? চারদিকে হৈচৈ পড়ে যাবে৷ দিন কানা রাত কানা গেলো কৈ? আর ভিটামিন ই -র বিক্রি ঢাকা শহরে যেভাবে বাড়ছে? ডিমে ঢুকাতে পারলে ওগুলোর লাগামছাড়া দাম একলাফে নীচে পড়ে যাবে৷ আর কত স্বপ্ন ঐ যুবকদের!

রাত আটটা৷ ঢাকা পর্যন্ত গাড়ীতে ওদের মধ্যে আর তেমন কথাবার্তা হল না৷ এজিএম হান্নান প্রথমে রাশুকে খিলগাঁ নামিয়ে দিলেন৷
রাশু কনককে বলল, 'কালকে সকাল সকাল বাসায় আসিস৷ এম্বেসীতে যাব৷
'গুড নাইট৷
একটা দুঃশ্চিন্তা রৌশনারা বেগমের মাথায় ঘোর পাক খাচ্ছিল৷ রাশুকে ফিরতে দেখে তিনি উদ্বেগ নিয়ে বললেন, 'বাবা তুমি বাইরে যাবে বউমাকে বলে যাবে না?
রাশু অপরাধীর মত কোন কথা বলল না৷
সে অমাকে জিজ্ঞাস করল, 'এই হৃদি এসেছিল?
'না৷
'আসার কথা ছিল না?
'আগামীকাল আসবে৷
রৌশনারা তাঁর ছেলেকে বললেন, 'আমেরিকা থেকে তোমার ফ্যাক্স এসেছে৷
'আম্মা কোথায় ফ্যাক্স?
অমা রাশুকে থামিয়ে দিল৷
'যাও গোসল করে এসো, খাব৷ এখন ফ্যাক্স পড়তে হবে না৷ ধুলোর রাস্তায় শুয়ে ছিলে?
'অমা সরি৷
অনেক রাত বেজে গেছে৷ রাশুর ফ্যাক্স পড়া হয়নি৷ অমা পড়েছে৷ ফ্যাক্সরে সারমর্ম হলো রাশুকে আপাতত একাই আমেরিকা যেতে হবে৷ ঘুমন্ত রাশুর দিকে তাকিয়ে অমা বলল ভাগ্য আমাকে তোমার সাথে বাইরে নিল না৷

পরদিন কনক সকাল সকাল রাশুদের বাসায় চলে এসেছে৷ সে এসেই বলল, 'রাশু! হারি আপ৷ এম্বাসী থেকে ফিরে আমি ইউনিভার্সিটিতে যাব৷ আমার অনেক ক্লাস মিস হয়ে গেছে৷
রাশু হতাশ কন্ঠে বলল, 'কনক ক্লাসে চলে যা৷ এম্বাসীতে যেতে হবে না৷
কনক আশ্বর্য্য হল৷
'তোর বউয়ের জন্য কাগজপত্র রেডী করবি না?
'গতকাল আমেরিকা থেকে ফ্যাক্স এসেছে৷ অমা আপাতত আমার সাথে যেতে পারছে না৷
'ওহ্ ব্যাড নিউজ! আর কি করবি? তা হলে চলি৷

কনক ইউনিভার্সিটিতে চলে গেল৷

'অমা? অমা?
রাশুর গলায় অমা ডাক-টাতেই অদ্ভুত ধরনের আকর্ষন৷
অমা যেন দেঁৗড়ে ভিতর থেকে এলো৷ তার মুখে হাসি ভরা৷ রাশুর গলায় 'অমা' ডাক-টাতেই অদ্ভুত ধরনের আকর্ষন আর সাহচার্য৷
'কি যেন কিনতে যাবে? হৃদি এলে তুমি ওর সাথে কিনতে যেও৷ যাত্রাবাড়ী যাবে?
'তুমি যেতে বললে যাব৷

রাশু হাসল৷ সকালের নির্মল হাসি৷ নির্ভরতা বিশ্বস্থতার সৃষ্টি করে৷ বিশ্বস্থতা ভালবাসার পূর্বশর্ত৷ দাম্পত্য জীবনের প্রারম্ভে রাশুর মতামতের উপর অমার এই নির্ভরতা দেখে রাশুর অসাধারন ভাল লাগল৷ এখন শপিং এ যাওয়ার মত সামান্য বা্যাপার৷ সামান্য থেকেই বড়র সৃষ্টি৷ তাই রাশু হাসল৷ পুং চরিত্রগুলো এমনই!
অমা হেসে জিজ্ঞাস করল, 'হাসলে যে?
'এমনি৷
'অমা?
'বলো৷
'কখনো কোথাও যেতে চাইলে যাবে৷ আমার পক্ষ থেকে কোন বাঁধা নেই৷ হৃদির সাথে যাত্রাবাড়ী যেয়ো৷
অমা রাশুর দিকে তাকিয়ে আছে৷ ভালবাসার আকর্ষণে ভরা সে তাকানোটায়৷ দু'জনের মুখেই হাসি৷
'অমা দুপুরে আমার বাসায় খাওয়া হবে না৷ ফিরতে দেরি হবে৷
'সাবধানে যেয়ো৷

রাশু বাসা থেকে বেরুলো৷ রাশুকে একা বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে রাশুর মা দেঁৗড়ে এলেন৷
'বউমা তুমি রাশুর সাথে গেলে না? ভিসা আনতে একসাথে গেলে ভাল হতো না?
অমার হতাশা ভরা গলা৷
'আম্মা ওর সাথে আমার আমেরিকা যাওয়া হচ্ছে না৷
রৌশনারা অমার কথায় টাশকি খেলেন৷
'বউমা তুমি যাবে না? ছেলেটা বিদেশে একাএকা থাকবে? বউমা, দাম্পত্য জীবনের শুরুতে স্বামী-স্ত্রীকে কাছে থাকতে হয়৷ পরস্পরের প্রতি আকর্ষন সৃষ্টি হয় এই কাছে থাকার মাধ্যমেই৷
অমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মন খারাপ করে বলল, 'আমিও যেতে চাই৷ আমাকে কয়েক মাস পরে যেতে হবে৷
রৌশনারা বেগম খবরটা কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন৷
'বউমা ও তোমাকে সাথে নিবে বলেই তো বিয়ে করল?
অমা হতাশ চোখে শ্বাশুড়ীর দিকে তাকালো ৷
'আর কি? বউমা মন খারাপ করো না৷ দোয়া কর ও যেন ভালভাবে পেঁৗছতে পারে৷ ছয় মাস দেখতে দেখতে কেটে যাবে৷

গাড়ীর হর্নের শব্দ হল৷ রৌশনারা বাইরে তাকালেন৷ হৃদি এসেছে৷ অমা দেঁৗড়ে গেট খুলে দিয়ে হৃদিকে জড়িয়ে ধরলো৷
'ভাবী কেমন আছ?
'ভালো৷
ঘরে ঢুকে হৃদি অমার শ্বাশুড়ীকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল৷
'কেমন আছ মা? বিয়াইন ভালো আছেন?
'আমরা সবাই ভালো আছি৷ আপনি কেমন আছেন?
'ভাল মা৷ বসো৷ আমি চা নাশ্তা কিছু নিয়ে আসছি৷
'মাঐ আমি নাশতা করে এসেছি৷
নতুন আত্মীয়কে কিছু না কিছু খেতে দিতে হয়৷ হৃদির কথা রৌশনারা বেগম শুনলেন না৷
অমা হৃদিকে বলল, 'ভাবী আমি রাশুর সাথে আমেরিকা যেতে পারছি না!
অমার কথা শুনে মনে হল একটা ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস হৃদির গায়ে এসে লাগল৷ খবরটা তার একদম ভাল লাগল না৷ মন খারাপ করে হৃদি বলল, 'কেন?
'এই যে ফ্যাক্স দেখ৷
রৌশনারা বেগম চা মিষ্টি নিয়ে এলেন৷ 'মা কিছু খাও৷
তিনি হৃদিকে ফ্যাক্স পড়তে দেখে বললেন, 'ফ্যাক্স পড়ছো? ভেবেছিলাম রাশু আর বউমাকে একসাথে বিদায় দেব৷ তা আর হলো না৷
আনমনে হৃদি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল৷ 'তাই তো দেখছি মাঐ৷
হৃদি অমার বাঁ কাঁধে হাত চাপড়ে বলল, 'মন খারাপ করো না৷ ছ'মাস কিচ্ছু না৷

হৃদি অমাকে নিয়ে বেরুলো৷ বেরুনোর পাঁচ মিনিটের মাথায় অমা বলল, 'কায়েস গাড়ী নিয়ে বাসায় যা৷
হৃদি বলল, 'অমা কি যেন কিনবে বলেছিলে?
'ভাবী, প্রথমে বাসায় যাবো৷ আম্মাকে দেখব৷ তোমাদের সাথে গল্প করব৷ তারপর বাজারঘাট৷

অমা যাত্রাবাড়ীতে এসেছে৷ আকাশে ঘুড়ির সূতো কেটে গেছে৷ দিকবিদিগ উড়ছে৷ অমা সিড়িতে দেঁৗড় দিল৷ এক দেঁৗড়ে ইভার ঘরে কড়া নেড়ে লম্বা করে বলল,
'ভাবী...ঈ...ঈ.! আমি এসেছি৷ উপরে এসো৷
অমার শরীরমনে অবিশ্বাস্য রকমের চঞ্চলতা৷ সে ঘরে ঢুকেই ইশতান্না বেগমের গলা জড়িয়ে ধরলো৷
'আম্মা তোমাকে অনেক দিন দেখি না৷
মা-মেয়ে দু'জনের চোখেই পানি৷ চোখে পানি নিয়ে ইশতান্না বেগম হাসছেন৷ হেসে বললেন, 'সাত দিন হয় নি তুই তোর শ্বশুড়বাড়ী গিয়েছিস? রাশু কেমন আছে মা?
'ও খুব ভাল আছে আম্মা৷

হৃদি নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে৷ অমা তার মা'র সাথে কথা বলতে বলতে- হঠাত্‍ করে তার চঞ্চলতা কোথাও যেন থিতিয়ে পড়লো৷ দিকবিদিগ উড়া ঘুড়িটা পাঁক দিয়ে দিয়ে কোথাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছে৷ না হলে আর উড়ে না কেন?
কিছু মানুষের মনের গতি অতিদ্রুত পরিবর্তনশীল৷ অস্থির চিত্তের এমানুষগুলো একমুহুর্ত আগেও জানে না তাদের পরের চিন্তাটা কি হবে? স্থিরচিত্তের মানুষ পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু করে৷ অমার চোখেমেুখে বাসায় ফেরার এতক্ষণ যে অসাধারন হাসি ধরে ছিল তা হঠাত্‍ করে উধাও হয়ে গেল৷ চোখমুখে সিরিয়াস ভাব৷
'আম্মা তুমি ব্যাংকক ফোন করেছিলে?
'হঁ্যা৷
'ভাইয়ার সাথে কি কথা হলো ?
'ইতমাম তোর বিয়েতে খুব খুশী হয়েছে৷
'আমাকে নিয়ে ভাইয়ার চিন্তা করতে হবে না৷ আমি জানতে চাচ্ছি ভাবীর প্রসংগে ভাইয়া কি বললেন?
তিনি মন খারাপ করে বললেন, 'হৃদির প্রসংগ আসতেই ও তেমন কথা বলল না৷ আমি বললাম তুই নাকি ওখানে আগ থেকেই বিয়ে করে আছিস? ও চুপ করে রইল! তাহলে হৃদিকে পছন্দ করে বিয়ে করলি কেন?
'তারপর?
'মনে হলো ইতমামের জবান বন্ধ হয়ে গেছে৷
'তখন তুমি কি বললে?
'অনেক্ষণ টেলিফোনেই কাঁদলাম৷
ইতমাম বলল, 'আম্মা ভাল লাগছেনা ফোন রেখে দেই৷ আমিই কষ্ট করে ফোন রেখে দিলাম এ প্রান্ত থেকে৷

অমার জেদী কন্ঠ৷ 'কল বুক করো৷ আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলবো!
'ইতমাম বলেছে ও কে ফোন করে পাওয়া যাবে না৷
'কেন?
'ও নাকি আগামী সাতদিন থাইল্যান্ডে থাকবে না৷

মাথা ব্যাথা হলে কথা বলতে কষ্ট হয়৷ মাথা টনটন করে৷ কথা বলতে গেলে আপনা আপনি চোখ ছোট হয়ে আসে৷
হৃদির প্রসংগে এলে অমার এমন হয়৷ মনে হয় মস্তকের রক্তনালীগুলো বন্ধ করে দিয়ে মাথাকে কেউ শক্ত করে চেপে ধরেছে৷
অমার কষ্ট হচ্ছে৷
'সব মিথ্যে! সব মিথ্যে আম্মা! ভাইয়া পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং উনি ব্যাংককই থাকবেন৷ আচ্ছা আম্মা, ভাবীকে নিয়ে তুমি কি সিদ্ধান্ত নিলে?
'আমি বউমাকে নিয়ে ব্যাংকক যাব৷
'ইউ উইল নেভার গেট হিম ইন ব্যাংকক! ভাইয়াকে কোনদিনই ব্যাংকক পাবে না৷ তাঁর সবসময় ব্যস্ত সিডিউল থাকবে৷ আম্মা, ছোট ভাবী ভদ্র মেয়ে বলে চুপ করে আছেন৷ আমি কিন্তু চুপ করে থাকতাম না৷ না-হ্!
'অমা তুই আমাকে তুই দোষ দিচ্ছিস কেন? আমি কি এ জন্য দায়ী?
অমার ভিতরটা হাহাকার করে উঠলো৷
'আম্মা, ভাবীর কি হবে?
'মাগো, তোর মত আমিও বউমাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসি৷ ও আমার আর একটি মেয়ে৷
ইশতান্না বেগমের চোখ পানিতে ভরে গেল৷
অমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, 'আম্মা কেঁদে কোন লাভ হবে না৷
'আমি ইতমামকে হৃদির হাতে তুলে দিতে চাই৷ তা না করতে পারলে আমি মরেও শান্তি পাব না৷
'কিভাবে তুলে দিতে চাও?
'ভুল যখন একটা হয়েই গেছে! বউমা, ইতমামকে গ্রহন করতে পারবে না? আমি হৃদির পা ধরবো৷
'তুমি কি বুঝাতে চাও? বাজে কথা বলবে না৷ ভাইয়ার আগের বউয়ের সন্তান আছে, জানো?
ইশতান্ন্ বেগম শিউরে উঠলেন৷
'আমাকে কিছু না জানালে আমি কি করে জানবো?
'তোমার যে ছেলে হারিয়ে গিয়েছিল তাকে আবার বুকে জড়ালে কেন? মা'র পেট থেকে জন্ম নিয়ে যে মা'কে ভুলে যায় তার বিয়ে তুমি সমর্থন করলে? কেন? বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারলে না?
'আমার হারানো ছেলেকে আমি আবার ফিরে পেতে চেয়েছিলাম বলে৷
'এটাই হলো মমতাময়ী মা'দের সমস্যা৷ শয়তান সন্তানদের জন্য তাঁদের মন বেশী করে কাঁদে৷
'সন্তান হলে পরে বুঝবি!
'খিলগাঁ গিয়ে যদি দেখতাম রাশুর একটা বউ আছে! আমার কেমন লাগতো? আমি বিষ খেতাম! যে আমার ভালবাসাকে মুল্যহীন করে দেহকে বুঝায়, তার কাছে দেহ রেখে চলে যেতাম৷
ইশতান্না বেগম কাঁদছেন৷
'মা তুই এভাবে কথা বলিস না৷ আমার খুব কষ্ট হয়!
'শরীরে ঘা হয়েছে কষ্ট হবেই !
অমা তার মা'র সাথে আর কথা বাড়াল না৷
সে হৃদির ঘরে এলো৷

হৃদি মন খারাপ করে শুঁয়ে আছে৷ অমা তার বিছানায় বসে হৃদির হাত টেনে ধরল৷
'ভাবী উঠ৷ এখন শুয়েছ কেন? এখন শুয়ে থাকার সময় হলো?
হৃদি দু'হাতে অমার দু'হাত ধরল৷
'অমা তোমাকে একটা মিনতি করব৷ রাখবে?
মিনতি নিজেই একটা করুন শব্দ৷ অমা কেঁপে উঠলো৷
'ভাবী, এভাবে কথা বলো কেন? কি মিনতি?
'আমার ব্যাপারে আম্মাকে আর কখনো কিছু বলবে না৷ তাঁর খুব কষ্ট হয়! এটাই আমার শেষ মিনতি!
'ভাবী আমি কিছু বললে সবকিছুর সমাধান হবে তা কিন্তু নয়৷ তারপরও চুপ করে থাকতে পারি না৷
'অমা চুপ করে থাকো৷ শোন, রাশু তোমাকে সাথে নিতে পারছে না বলে মন কখনো খারাপ করে রাখবে না৷
'ভাবী তোমার জীবন দেখে আমার কষ্ট হয়! ভয় হয়!
'অমা বাইরে গেলে সবাই ইতমাম হয়ে যায় না৷
'তুমি তোমার সরল মন দিয়ে সবকিছু বিশ্বাস কর এবং এভাবেই ভাইয়াকে বিয়ে করেছিলে৷
'ওসব কথা রাখ৷ দুপুরে খেয়ে কি কিনতে চেয়েছিলে? ওগুলো কিনে তোমাকে খিলগাঁ পৌঁছে দিব৷
'ভাবী, ভাইয়া কি বিয়ের অর্থ বুঝেন?
অমার কথায় এবার হৃদি কেঁপে উঠলো৷ মনে হলো সে চোখমুখের উপর তার নিয়ন্ত্রণ হারাবে৷ হাউমাউ করে কান্নার বাঁধ ভাংগবে৷ অসীম শক্তি নিয়ে হৃদি নিজেকে সামলালো৷
'কেন?
'ভাবী, মানুষ কেমন হ-য়? ভাইয়াকে কত ভালবাসি! এ বাড়ী থেকে যখন বাইরে পা ফেলি তখন কা'দের কথা মনে পরে চোখে পানি আসে? আত্নবিশ্বাস ছিল ভাইয়া আমার বিয়েতে না এসে থাকতে পারবেন না৷ কিছুতেই না৷
'রাশুকে ব্যাংকক হয়েই যেতে হবে৷ এয়ারপোর্টে ট্রানজিট আছে পাঁচসাত ঘন্টার মত৷ এই সময়ে তোমার ভাইয়াকে বলা হবে এয়ারপোর্টে এসে সে যেন রাশুকে দেখে যায়৷
'ভাইয়া চিনবেন রাশুকে? অসংখ্য বাংগালী থাইল্যান্ডে ট্রানজিট করে না? রাশুকে ভাইয়ার ছবি নিয়ে ট্রানজিট লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে থাকতে বলা যাবে?
'ওকে ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না৷
'কেন?
'আমি রাশুর সাথে থাইল্যান্ড পর্যন্ত যাব৷
'ভাবী তুমি যাবে?
'হঁ্যা৷
অমার চোখ ছেপে পানি এসেছে৷ সে হৃদির দু'হাত নিজের গালে ধরে কেঁঁদে বলল,
'ভাবী তুমি আমার বোন হয়ে এলে না কেন?
'চোখে আবার পানি এলো? এই মেয়ে নতুন বিয়ে হয়েছে! এতো কাঁদলে মন ভাল থাকবে?
'ভালো না থাকলে না থাকুক!
'শ্বশুর-শ্বাশুড়ী কি মনে করবেন? রাশু কি ভাববে?
'যা ইচ্ছে মনে করুক৷ যা ইচ্ছে ভাবুক৷
'ভাবী?
'বলো৷
'ভাবী একটা অশ্লীল কথা বলবো? মনে কষ্ট পেলে মাফ করে দিও৷
'অশ্লীল হলেও তোমার কথা শুনবো৷ বলো৷
অমা আচমকা বলল, 'তুমি এবার ভাইয়াকে বলবে যে তুমি আর ফিরে যাওয়ার জন্য আস নি৷ তুমি আমাকে নাও৷
'পাগলী এটা অশ্লীল কথা হলো কিভাবে?
অমা শুণ্য দৃষ্টিতে হৃদির দিকে তাকালো ৷
'ভাবী, আমার কথায় মনে কষ্ট পেলে?
হৃদি আচমকা ননদকে তার বুকে জড়িয়ে ধরলো৷
'ভাবী, শুধু আমি কাঁদছি? তোমার চোখে পানি কেন?
'তুমি আমাকে ভালবাসো৷ এজন্য তোমার অনেক কিছু মনে হয়৷
অমাকে হৃদি তার বাহুবন্ধন থেকে ছাড়াল৷
'অমা, আমার কথা ভেবো না৷ জীবন থেমে থাকে না৷ একটা কিছু হবেই৷
'আমাদের দেশে জীবন থেমে থাকে৷ বদ্ধ পুকুরের পানির মত পঁচে যায়৷ চার পারের মানুষরা ওগুলো উপভোগ করে৷
'অমা?
'হু-য়ু বলো৷
'আমি একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছি৷ আমাকে ক্ষমা করবে তো?
'কি অন্যায় করেছো?
'তোমার এংগেজমেন্টের রাতের ঘটনাটার জন্য আমি লজ্জিত৷ ইচ্ছে করে আমি ওমন করি নি৷ আবেগ আমার নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গিয়েছিল৷ অমা আমাকে ক্ষমা কর৷ ঐরাতে কান্নাকাটি না করলে সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলতো৷ তোমার কষ্ট হতো না৷ আম্মা এতবড় দুঃখ পেতেন না৷
'ভাবী কথাগুলো এভাবে বলো না৷ আমি সত্যি কষ্ট পাই৷
হৃদি অমার হাত টেনে ধরল৷
'উঠ খেতে বসব৷ এগুলোর শেষ নেই!

লাঞ্চ করে অমা-হৃদি কায়েসকে নিয়ে শপিং এ চলে গেল৷

মন খারাপ থাকুক আর ভাল থাকুক অমা যখন এ বাসায় থাকত হৃদির সময় কেটে যেত৷ ও শ্বশুড়বাড়ী চলে গেছে৷ একা ঘুমাতে হয়৷ ঘরে একা থাকলে ঘরের সব জিনিসপত্রকে একা একা লাগে৷ কেউ কাউকে দেখছে না৷ সবই পর পর৷
হৃদির ঘুম আসছে না৷ ওর ঘুম ইদানীং একদম কমে গেছে৷ চাখ বন্ধ করলেই ঘুম আসে না৷ তা হলে ঘুমের অষুধ থাকত না৷ এলোমেলো অসংখ্য কথা ভাবতে ভাবতে হৃদি ওর সমস্ত চিন্তা কেন্দ্রিভূত করল ঘুমের দিকে৷ হৃদি অনেক কষ্ট করে ঘুমালো৷
দেরিতে ঘুমিয়ে হৃদি ঘুম থেকে উঠল বেশ দেরিতে৷ ইশতান্না বেগম একা নাশতা সেরেছেন৷
তিনি হৃদিকে ঘুম থেকে উঠতে দেখেই বললেন, 'বউমা আমার পেটের ব্যাথা ইদানীং খুব বেড়েছে৷ নাশতা একা একা করে ফেলেছি৷ তুমি হাত মুখ ধোঁয়ে এসো৷ টেবিলে সব দেয়া আছে৷

নাশতা খেয়ে হৃদি তার শ্বাশুড়ীকে বলল, 'আম্মা আমি কিছুদিন ইস্কাটনে থেকে আসব৷
'ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করবে না?
'হ্ঁ্্যা করব৷
'ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে দেয়ার জন্য গাড়ী পাঠাবো?
'না, আমি রিকশায়-ই ক্লাসে যেতে পারব৷

হৃদির চোখের অশ্রু গ্রন্থিগূলো মনে হয় ক'দিন ধরে পানিতে টইটুম্বর থাকে৷ হৃদিকে নিয়ে কথা উঠলে বা তাকে কেউ কিছু বললে ও খুব স্পর্শকাতর হয়ে উঠে৷ চোখমুখে কান্নার ভাব চলে আসে৷ মেঘ জলে ভরা৷ একটু বাতাস বইলেই ঝড়বে৷ ইশতান্না বেগম হৃদির কাঁধে হাত রেখে বললেন, 'যাও বউমা৷ ভাল থেকো৷
তাই হলো৷ মেঘ থেকে হঠাত্‍ বৃষ্টি পড়ার মত মনে হলো৷ হৃদির চোখ থেকে টপ টপ করে দু'তিন ফোটা পানি বের হয়ে দ্রুত মেঝেতে পড়ল৷

রিকসা নিয়ে হৃদি ইস্কাটনে সরাসরি খালার বাসায় চলে এসেছে৷ বাসায় ঢুকতেই ওর খালা ইয়াসমীন যেন আকাশ থেকে পড়লেন৷
'কি ব্যাপার মা তোর চোখমুখের এমন অবস্থা কেন? ঘুমাস নি?
'খালা, অমা শশুড়বাড়ী চলে যাওয়ার পর থেকে খুব খারাপ লাগছিল৷ ক'দিন ধরে ঘুমও কম হচ্ছিল৷ তোমার এখানে থাকব৷ খালা তোমার অসুবিধা হবে?
হৃদি এ বাসাতে বড় হয়েছে৷ এখান থেকেই ওর বিয়ে হয়েছে৷ অনেক বছর পর্যন্ত হৃদি মা হিসাবে খালাকেই জানতো৷ এ ধরনের কথা হৃদির মুখ থেকে খালা কোনদিন শুনেন নি৷ মানসিক দিক দিয়ে অসহায় হয়ে পড়লে মানুষের কথাবার্তার ধরনটা অসহায় হয়ে যায়৷
ইয়াসমীন বিষ্মিত হয়ে পড়লেন৷ 'মা তোর কি হয়েছে? এই খালাটিকে এত তাড়াতাড়ি পর করে দিলি?
'খালা আমার কিছু হয়নি৷
'সত্যি করে বল্! শ্বশুরবাড়ী তোর কিছু হয়েছে?
'খালা কিছুই হয়নি৷
'যা ঘুমিয়ে নি৷ তোর ভাল ঘুম হয়নি৷ উল্টোপাল্টা বকছিস!
হৃদি ওর খালার বিছানায় শুয়ে পড়ল৷
খালা বললেন, 'মা মাথা বুলিয়ে দেব?
'দাও৷
খালা অকৃত্রিম মমতাময়ী স্নেহের পরশ দিয়ে হৃদির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন৷ এস্নেহের পরশটা তার ঘুমের জন্য মহৌষুধ৷ একসময় এখালার বুকটি ছিল হৃদির জন্য রাজ্যের শান্তির সুখ৷ তার মন চাইছে আবার যদি ওখানে মুখ রেখে ঘুমানো যেতো?
'মা তোর কিছু হয়েছে ?
হৃদি ওর খালার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল৷ ঘুম চেপে ধরেছে দু'চোখে৷ সে ঘুম কাতুরে গলায় বলল, 'খালা আমাকে দুপুর বারটার দিকে ডেকে দিও৷ ইউনিভার্সিটিতে যাবো৷
'ইউনিভার্সিটিতে আজ না গেলে হয় না মা?
'খালা যাবো৷ অনেকদিন হলো ভার্সিটিতে যাওয়া হয় না৷
'আচ্ছা যাস্৷
'মা?
'বলো৷
'তুই একটা বাচ্চা নিয়ে নি৷ বাচ্চা হলো ঘরের চাবি৷ এই চাবিটা হাতে থাকলে ঘরটায় আর কে থাকলো আর না থাকলো কে দেখেরে! এভাবে একা একা থাকা যায়? বাচ্চাকে তোর মানুষ করতে হবে না৷ যতদিন বেঁচে আছি তোর বাচ্চা আমি মানুষ করব৷
জীবনেরও একটা আবহ সঙ্গীত থাকে৷ সে সঙ্গীতের ছন্দ পতন হলে আর জীবন রইল কই? হৃদির হাউমাউ করে কান্না চলে এসেছিল৷ সে সেটা করল না৷
'খালা, সন্তান ছলনা-ভালবাসার সৃষ্টির জিনিস না৷ আমি যাকে সারাজীবন খুঁজে বেড়িয়েছি - তাকে ভুল করে পেয়েছি৷ কার সন্তান আমি নেব? তা-র?
কথাগুলো সশব্দে খালাকে বলা হলো না৷ তাঁর কাছে যে আমানত জমা রাখা হয়েছিল সেটা খেয়ানত হয়ে গিয়েছে৷ খালাকে কষ্ট দেওয়া পাপ! মহাপাপ! খালা থাকুক নির্ভাবনাময়- তাঁর সুখী-হৃদিকে নিয়ে৷ তাঁর মেয়ে তাঁর দেয়া সুইট হোমে খুব ভালো আছে৷ হৃদি ঘুমিয়ে গেছে৷

ইয়াসমীন হৃদিকে দুপুর বারটায় ঘুম থেকে ডেকে তুললেন৷ সংগে সংগে জিজ্ঞাস করলেন, 'মা আর একটু ঘুমিয়ে নি?
হৃদি উঠে বসল৷
'আর ঘুমুবো না৷
হৃদি আর ঘুমালো না৷ গোসল সেরে বেরুতেই খালা বললেন, 'মা, কখন ফিরবি ঠিক নেই৷ খেয়ে যাস্৷
'আচ্ছা৷

হৃদি লাঞ্চ করে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছে৷ মামুর দোকানে কনক নেই৷ ওর মনে একটা প্রবল ইচ্ছে কাজ করছে৷ ইচ্ছেটা হলো কনককে হৃদির দেখা চাই৷ দেখা চাই!
সে দেখল এজিএম হান্নান মামুর দোকানে বসে আছেন৷ সে তাঁকে জিজ্ঞাস করল,
'হান্নান ভাই আপনার সাথে কনকের দেখা হয়েছে?
'আজ এখনও দেখা হয় নি৷
'আপা আপনি বসুন৷ চা খান৷ আমি কনককে উপর থেকে ডেকে নিয়ে আসছি৷ মামু হৃদি আপাকে কাপ ধুঁয়ে এক কাপ চা দেন৷

এজিএম হান্নান দু'হাত প্যান্টের দু'পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে হৃদিদের বিভাগে ঢুকলেন৷ তিনি ছাত্র নন৷ তাঁর বয়সী ছাত্রদের সাথে এজিএম হান্নান মিশে যান৷ অবসর জীবনে বাগানের রাস্তায় অতীতের স্মৃতিচারণ করার ভঙ্গিমা তাঁর হাটার ভিতর৷
মামু হৃদিকে বললেন, 'আপা কনক স্যারের মনটা একদম ভালো না৷
'তাই নাকি?
'হঁ্যা৷
'কেন?
'কনক স্যার শুধু ইটার দিকে তাঁকিয়ে থেকে ধ্যান করেন৷ ইটখোয়ার ভিতরে কি আছে আপা বলুন?
হৃদি হাসল৷
'আপা ওনাদের দলটা ধীরে ধীরে ভেঙ্গে দিকবিদিক হয়ে যাচ্ছে৷ কেউ এখানে আর তেমন আসে না৷
এজিএম হান্নান সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসেছেন৷ লাইব্রেরীর দরজায় শরীরটাকে আড়াল করে কচ্ছপের মত ঘাড় বাড়িয়ে তিনি ভিতরে তাকালেন, 'হঁ্যা কনক আছে৷ তাঁর এই ঘাড় ঘোরানোর দৃশ্যটা খুব বিরক্তিকর৷ সাবধান করা হলেও তিনি শুনেন না৷
কনক গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে৷ এজিএম হান্নান কনকের টেবিলের অপর প্রান্তে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ কিছুক্ষন পর হঠাত্‍ করে শব্দ করে বললেন,
'কিসের পড়া পড়ছো?
কনক চমকে উঠল৷ সে ঠান্ডা গলায় বলল,
'কি ব্যাপার আপনি এখানে কেন?
'এটা কোন ব্যাপার না৷
ফুলতলীর জমিতে দেয়াল তৈরীর জন্য সিমেন্টের অর্ডার দেয়া হয়েছিল৷ সব-করা সম্ভব এজিএম হান্নানের পক্ষে সিমেন্টের বস্তা ঠেলায় তুলে ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না৷ তাঁর কাছে পৃথিবীর সব কিছুই স্বাভাবিক৷
'বস্ আপনাকে বলেছি সিমেন্টের বস্তা ফুলতলী নিয়ে যাবেন৷ এখানে নিয়ে এলেন কেন?
'আগে নীচে চলো৷ পরে বুঝবে৷
সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে তিনি বললেন,
'কনক হৃদিকে ভাগিয়ে বিয়ে করে ফেল৷ মেয়েটা বিয়ে হয়েছে তাই কি হয়েছে?
কনক চটে গেল৷
'এ কথা আমাকে বলবেন না৷ আর একবার বললে আপনার সাথে সম্পর্ক চিরদিনের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে৷
'কনক তুমি রাগ করলে? আমি এমনি বললাম৷
'এমনিও বলবেন না৷
'মাইন্ড ইট, হৃদি তোমাকে ভালোবাসে৷ খু-উ-ব ভালোবাসে৷
'আমার ব্যাপার আমাকেই ডিল করতে দিন৷ ডন্ট ইন্টারফেয়ার৷
'সরি ৷

নীচে এসে কনক দেখল হৃদি মামুর দোকনে বসে চা খাচ্ছে৷
'কি হৃদি ফুটপাতে চা খাচ্ছ? ডায়রিয়া হবে না৷
'তোমাদের ডায়রিয়া হয় না?
'আমরা ইমুনাইজ্ড হয়ে গেছি৷
'আমিও ইমুনাইজ্ড হবো৷
'শুনে ভাল লাগল৷
'শুনে ভাল লাগার কিছু নেই৷ হৃদির গলা উত্তেজিত মনে হলো৷
এজিএম হান্নান বললেন, 'হৃদি আপার হাতে আমি চা ধরিয়ে দিয়ে গেছি৷
'ভাল করেছেন৷
'বস্ সিমেন্টের বস্তাগুলো ফুলতলীতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যাবস্থা করুন৷ আশুলিয়া হয়ে যেতে বলবেন৷
'একথা শুনতেই এসেছিলাম৷
ফুলতলীতে সিমেন্ট পাঠানোর দায়িত্ব নিয়ে এজিএম হান্নান চলে গেলেন৷

কনক জিজ্ঞাস করল, 'হৃদি কোথাও যাবে?
'আমার যাওয়ার জায়গা আছে?
'রেগে আছো মনে হয়?
রাগটা কা'র উপর ?
'হৃদি আমার ক্ষুধা লেগেছে লাঞ্চ করবো৷ তুমি করবে?
হৃদি শীতল গলায় বলল, 'আমি লাঞ্চ করে এসেছি৷
'আজ ক্লাস করলে না৷ এখন এসেছো কেন?
'তোমার অসুবিধা হচ্ছে?
কনকের মনে হলো হৃদি বোতলে বোতলে হতাশা গিলে এখানে এসেছে৷ তা না হলে অতি স্বাভাবিক কথাগুলো ও এমনভাবে বলছে কেন? হৃদিতো এমন মেয়ে না৷ কনক আস্তে করে বলল,
'আমার ক্ষুধা লেগেছে৷ নিরামিষ রেষ্টুরেন্টে যাবে? ভর্তা ভাত খাব৷ যাবে?
'চলো৷

কনক আর হৃদি রিকশায় উঠল৷ ওরা আজই প্রথম একসাথে রিকশায় উঠেছে৷ উদ্দেশ্য নিরামিষ রেষ্টুরেন্ট৷ কনক হঠাত্‍ করেই জিজ্ঞাস করল, 'হৃদি আমার সাথে রিকশায় উঠলে যে?
'নেমে যাব? অন্য রিকশা নেব?
'সরি, আমি কি তাই মিন করেছি?
'তুমি কি মিন করলে?
হৃদি আসলেই উত্তেজিত হয়ে আছে৷ নরম প্রকৃতির মানুষগুলো রেগে গেলে সর্বনাশ হয়ে যায়৷ অনেকে নিয়ন্ত্রন হারায়৷ রাস্তায় অদ্ভুত অদ্ভুত দৃশ্যের সৃষ্টি হয়৷ সাবধানে কথাবার্তা বলাই ভালো৷ কনক চুপচাপ হৃদির পাশে বসে রইলো৷ রিকশা চলছে নিরামিষ রেষ্টুরেন্টের দিকে৷ নিঃশব্দতা হৃদিই ভাঙ্গলো৷
হৃদি বলল, 'তুমি হলে কহে না কহে !
'তুমি বুঝতে পার?
আবার চুপচাপ৷
কনক প্রসংগ বদলাল৷
'হৃদি, তোমার মন সেই আগের মত হয়ে গেছে৷
পানিতে টইটুম্বর হৃদির চোখ যেন বাঁধ ভাঙতে চাইছে৷ তার চোখ পানিতে ভরে গেল৷
'কেমন আগের মত?
'প্রথম প্রথম তোমাকে যেমন দেখতাম ঠিক তেমনি৷ মনের মধ্যে ফুজি পর্বত না হিমালয় ব'য়ে বেড়াচ্ছ৷ হৃদি মন এত খারাপ কেন?
কনক তার চোখের দিকে তাকাল৷
'এই হৃদি তোমার চোখে পানি কেন?
'পানি কোথায় দেখলে? বলে হৃদি আবার বলল, 'কনক মনের মধ্যের হিমালয়টি আমাকে মেরে ফেলবে মনে হচ্ছে৷ আমার আর সহ্য হচ্ছে না৷ আমার কিছু ভালো লাগে না৷
'হৃদি, ফিলিং ব্যাড হ্যাছ বীন দা বার্থ রাইট অব বাংলাদেশীজ (ভববষরহম নধফ যধং নববহ ঃযব নরত্‍ঃয ত্‍রমযঃ ড়ভ ইধহমষধফবংযরং)৷ এদেশে খুব কম লোকই আছে যাদের ভাল লাগে৷ সেটা সামাজিক কারণে হোক৷ আর রাজনৈতিক কারণেই হোক৷
হৃদির দৃষ্টি চলমান রিকশার চাকায় আটকে আছে৷ জীবন যেমন জন্ম থেকে মৃতু্য পর্যন্ত শুধু ঘুরে!

হোটেল নিরামিষ'র সামনে ওদের রিকশা থামলো৷ কনক হৃদি মুখোমুখি খেতে বসলো৷ কনককে পাশে দেখতে হৃদির মন সারা আকাশ চষে বেড়াতো৷ সেই কনক এখন একান্তে তার সামনে৷ সে তাকে দেখছে অন্য দৃষ্টিতে৷ জীবনের সমস্ত চাওয়া নতুন করে কনকের চোখে যেন সে খুঁজে পেয়েছে৷ মন বার বার এ কোন্ খেলা খেলছে?
হৃদি তো একটা নদী৷ সৌন্দর্যে টইটুম্বর এ নদীরা যেপথ দিয়ে যেখানে যায় সবাই তার সৌন্দর্য উপভোগ করে৷ চার পাশের টেবিল থেকে অনেকগুলো চোখ ওদের দিকে পড়েছে৷ পড়ুক তাতে কি? যার যার পৃথিবী নিয়ে নিজেকে থাকতে হয়৷
কনক বলল, 'একজন ওপাশে মন খারাপ করে বসে থাকবে৷ এপাশে অন্যজন খাবে৷ তা কি করে হয়? হৃদি মন ভালো করতো৷ নইলে আমি খাব না৷
হৃদি সম্বিত্‍ থেকে ফিরে এলো৷ সে তার ভ্যানিটি থেকে পানির বোতল বের করে বলল, 'কনক, এই পানি খাও৷ আমার মন ভালোই আছে৷ তুমি খাও৷
'হৃদি সত্যি খাবে না?
'না৷ তোমার খাওয়া শেষ হলে একসাথে ড্রিংক্স করব৷

কনকের খাওয়া হলো৷ হৃদির ফেভারিট ড্রিংক্স ফানটা এলো৷ হৃদি ষ্ট্রতে ড্রিংকস টান দিতে দিতে বলল, 'আমার সাথে রংপুর যাবে?
'র..ং..পু..র? রংপুর কেন?
'রংপুর আমার দাদার বাড়ি৷ ওখানে আমার চাচা আছেন৷ অনেকদিন হলো যাওয়া হয় না৷ কনক যাবে?
'ভাববো৷
'ভাবার কি আছে? তুমি তো আর আমাকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছ না? প্লীজ চলো না৷ তুমি সাথে থাকলে আমি মনের জোর পাই৷
'আমি তোমার ক্যালরিমেট নাকি? কনক হাসলো৷
'ক্যালরিমেট না, ক্লাসমেট৷ আইদার অর বোথ৷
হৃদির বলা আইদার অর বোথ কনকের ভিতর একটা প্রতিক্রিয়া হলো৷ ভিতর তো এমন জায়গা-ই শুধু জ্বলে! কেউ দেখেও দেখে না৷ কেউ না দেখেও দেখে৷ কনকের প্রতিক্রিয়া অপ্রকাশিত রয়ে গেল৷
'কি যাবে? আবেদনের সুরে হৃদি আবার বলল৷
'কবে যাবে?
'আজ৷
'আ-জ?
'হ্যাঁ আজ রাতে৷
'কিসে যাবে? বাসে না ট্রেনে?
'কনক, তোমার চয়েস কি?
'হৃদি আমি বাসে জার্নি করি খুব কম৷ বাস উল্টে কষ্টে ধরে রাখা জীবনটাই না কখন যায়?
'জীবনকে খুব ভালবাস?
'কে না ভালবাসে? পিঁপড়ে থেকে হাতি, অল লাভ দেয়ার লাইভ্স৷ সবাই জীবনকে ভালবাসে৷ তুমি ভালবাস না?
'না৷ হৃদির নিষপ্রাণ গলা৷
'নিজেকে না ভালোবাসলে অপরকে ভালোবাসা যায় না৷ তুমিও জীবনকে ভালবাস৷ কিন্তু বুঝতে পার না৷
হৃদি এবার শুষ্ক হাসি দিল৷
'কনক ট্রেনেই যাব৷ আজ রাত্রের ট্রেনে ৷
'পাগলী! রাতে তোমার সাথে বের হব? তোমার শ্বাশুড়ী কি মনে করবেন? তোমার খালা?
'শ্বাশুড়ী কি মনে করবেন জানি না৷ আমার খালা আমাকে যেতে বারণ করবেন না৷ রাতই ভাল৷
'রাত ভাল কিন্তু কালো৷
'কনক?
'বলো৷
'কালো জগতের আলো৷
'কারণ কনক কালো৷
হৃদি হাসলো৷
'কহে না কহে, ঢাকায় রাত হলেও রংপুরে ভোরের আলোতে পেঁৗছবো৷ ওটাই ভালো না?
'ও তাইতো!
'ও তাইতো! তা হলে প্রমিজ, ইউ আর গোয়িং টু রংপুর উইথ মী৷ আমি খালা-খালুকে নিয়ে রাতে কমলাপুর ষ্টেশনে আসব৷ রাত বারোটার ট্রেন৷ সো ডন্ট মিস ইট৷
'চেষ্টার ত্রুটি করব না৷

রাত সাড়ে এগারোটায় কনক কমলাপুর ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে হৃদির জন্য অপেক্ষা করছে৷ হৃদি সাতআট মিনিটের মধ্যেই ষ্টেশনে এসে পেঁৗছলো৷ তার সাথে খালাখালু৷ বেবিটেক্স িথেকে ঝটপট করে নেমে হৃদি বলল,
'কনক উনি আমার খালা আর উনি খালু৷
কনক নিজের পরিচয় দিল৷ হৃদির খালা-খালু কনককে টেলিফোন-কন্ঠে চেনে৷
খালা বললেন, 'বাবা তুমি একটু খেয়াল রেখো৷
'জি রাখব৷ হাতে সময় নেই খালাখালু৷ সময় থাকলে কথা বলা যেত৷ ভালো লাগত৷
ট্রেনে সীট খুঁজে নিতে হয়৷ সীট নাম্বার অনুযায়ী প্লাটফর্মে চিহ্ন দেয়া থাকে না৷
কনক বলল, 'হৃদি ট্রেন মিস করতে না চাইলে এবার তাহলে চলো৷ কয়েক মিনিট সময় হাতে আছে৷
'হৃদি তার খালা খালুকে বলল, 'তোমরা যাও৷ আমি ভালো থাকবো৷

কনক-হৃদি দেঁৗড়ে আন্তঃজেলা এক্সপ্রেস ট্রেন তিস্তায় উঠল৷ দু'জনই হাঁপাচ্ছে৷ ভরা পেটে দেঁৗড়ালে হাঁপানি বেশী হয়৷ ট্রেন ছেড়ে দিল৷ মনে হলো ওদের জন্যই ট্রেনটা এতক্ষন অপেক্ষা করছিল৷
শীত চলে এসেছে অথচ ঢাকায় গরম৷ কনক-হৃদি বসল মুখোমুখি জানালায়৷ খোলা জানালা৷ শো শো করে ঠান্ডা বাতাস আসছে৷ দেঁৗড়ে আসার জন্য শরীর থেকে ঘাম শুকাচ্ছে৷ ঠান্ডা অনুভুতি ভালো লাগছে৷ হেলেদুলে ট্রেন চলছে৷
হৃদি জিজ্ঞাস করল, 'কনক তিস্তা রংপুরে ক'টায় পৌছবে?
'কি বলছ তুমি? এটা তোমার ভালো করে জানার কথা৷
'কনক, আমি আজই প্রথম তিস্তায় উঠেছি৷

আধঘন্টা পরই ট্রেন থামলো৷ থামার জায়গাটা ষ্টেশনের মত লাগছে না৷ লাইনের দু'পাশ ঘন অন্ধকারে ঢাকা৷ জায়গাটা কোথায় বুঝা যাচ্ছে না৷ আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেন৷ পথের মাঝখানে যাত্রী উঠলো৷ নামলো তার চার গুণ৷
'হৃদি ঘুমাতে চাইলে সীটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাক৷
'কনক ট্রেভেলে আমার ঘুম হয় না৷
'ঘুম না হলেও চোখ খোলা রেখ না৷
'কেন?
'চোখ খোলা রাখলে চোখের সামনে যা পড়বে তার উল্টো প্রতিবিম্ব চোখের রেটিনায় পড়বে৷ রেটিনার অপটিক নার্ভ ব্রেইনকে সিগনাল দেবে- ছবিকে সোজা করে দাও৷ ব্রেইন নিরন্তর কাজ শুরু করে দেবে৷ কিছু না করেও মানুষ টায়ার্ড হয় এভাবেই৷ তুমি টায়ার্ড হয়ে যাবে৷ চোখ বন্ধ কর৷
হৃদি চোখ বন্ধ করে আবার খুলল৷
'বন্ধ চোখ তার সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখে না৷ চোখ যা দেখে না তা নিয়ে ব্রেইন চিন্তা করতে চায় না৷ সুতরাং ঘুম তোমার অবশ্যই আসবে৷
হৃদি হেসে দিয়ে সীটের সাথে মাথা লাগিয়ে কনককে আস্তে করে ডাক দিল,
'ক-ন-ক!
'বলো৷
'তোমার কখনো খারাপ লাগে না?
কনকের মনটা এবার সত্যিই খারাপ হয়ে গেল৷ পতপত করে আকাশে উড়া পাখিটা হঠাত্‍ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো৷ মনে হলো সে বুকে কষ্ট চেপে রাখার চেষ্টা করছে৷ কনকের শুণ্য দৃষ্টি হৃদির চোখের দিকে৷
'হৃদি, আমার মনে হয় আমার মত খারাপ পৃথিবীর আর কারোর লাগে না! কি করব বল? এগুলো বলে টলে আর কিছু সামাজিক কাজ করে মনোযোগ অনত্র সরিয়ে রাখি৷
'চুপ কর৷ তুমি এভাবে কথা বললে আমার খুব খারাপ লাগে৷
'যাক হঠাত্‍ করে কোন্ এডভেঞ্চারে রংপুর যাচ্ছ?
'কোন এডভেঞ্চারে না৷ মন চাচ্ছিল তোমাকে নিয়ে কিছুদিন রংপুরে বেড়িয়ে আসি৷
'আমাকে নিয়ে! আর রংপুরে বেড়ানোর কি আছে?
'যা আছে তাই দেখবে৷ কনক তেতুলিয়া যাবে?
কনক বিস্মিত হওয়াব ভাব নিয়ে বলল, 'তেতুলিয়া? জাফলং-টেকনাফ হলেও একটা কথা ছিল? তেতুলিয়ায় কি দেখব?
'বর্ডার সব সময়ই ভাল৷ দু'চোখ প্রসারিত করে.....ওপার দেখবে৷ ওপারের মানুষ, ঘাস-জমি, পাহাড়, আকাশ...সবকিছু ভাল লাগে৷ এভারেষ্টের পিক দেখতে পারবে৷ যাবে? শুভ্র আকাশে শুভ্র হিমালয়! মন ভালো হয়ে যায়৷ যাবে?
'না, যাব না৷ তোমাকে রংপুরে রেখেই আমি ঢাকা চলে আসব৷ বাসায় বলে আসি নি৷
'বলে আসনি কেন?
'বলার পরিবেশ পাইনি ৷
'রংপুর থেকে ফোন করে জানিয়ে দিও৷

ট্রেনের লং জার্নিতে সব সময় কথা হয় না৷ যাত্রার প্রাক্কালে মানুষ গল্প করে বেশি৷ ট্রেনের কামরাগুলো হট্টগোলে ভর্তি থাকে৷ সময় এগিয়ে যায়৷ ধীরে ধীরে হট্টগোল কমতে থাকে৷ কেউ ঝিমায়৷ কেউ ঘুমায়৷ আবার কেউ চুপচাপ বই পত্রিকা পড়ে৷ এই পরের দলটাও ক্লান্ত হয়ে এক সময় অন্যের ঘাড়ে নেতিয়ে পড়ে৷ ধূলো, বালি, কূয়াসা, অন্ধকার চিরে ঝক্কর ঝক্কর ট্রেন চলছে৷ সবাই চুপ হয়ে যায়৷
ষ্টীমার পার হয়ে ওরা এক সময় রংপুর ষ্টেশনে এলো৷ কনক তড়াক করে লাফিয়ে নেমে পড়ল৷ মনে কিশোর কালের চঞ্চলতা৷ সময় সময় মন লাফাতে চায়৷
হৃদি বলল, 'কনক পা ভেঙ্গে যাবে৷ যেভাবে লাফিয়ে পড়লে আমার ভয় করেছিল৷
হৃদি ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের হাত সামনে বাড়িয়ে দিল৷
'কনক আমার হাতটা ধরো৷
কনক হাত এগিয়ে দিল৷ হৃদি ওর হাত ধরল৷
কনকের শরীরে নতুন এক বিদু্যত ব'য়ে গেল৷ এর আগে কোনদিন ওর এমন হয় নি৷ হাত থেকে পায়ে কি যেন নীচে নেমে গেল৷
চারদিকে ধূধূ সাদা বন৷ কাঁশ বন৷ কাঁশফুলে বাতাসের ঢেউ৷ দুলছে দুলছে দুলছে৷ ঢেউ আর ঢেউ! কেউ নেই৷ পুরো ট্রেনে শুধু দু'জন৷ আমি আর হৃদি৷ ট্রেন এসে থামলো কাঁশবন ষ্টেশনে৷ আমি আগে নেমে ওর হাত ধরলাম৷ সবসময় ঐহাত যদি ধরে রাখা যেত! এ কেমন ছোঁয়া?
মস্তিষ্ক এত দ্রুত চিন্তা করতে পারে? পারে, আলোর গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে পারে৷ না হলে আমি পারলাম কিভাবে?
'এই তোমার কি হলো? কি ভাবছো? ভালো করে হাত ধর! হাতপা ভাঙ্গতে চাও?
'কিছু ভাবছি না৷
হৃদি কনকের হাত ধরে ট্রেন থেকে নামলো৷
'চলো তোমাকে বাসায় পেঁৗছে দেই৷
'এখন? এখন, বাইরে যাওয়া যাবে না৷
'কেন?
'এখন বের হলে হাইজাকার ধরে সব কেড়ে নিয়ে নেবে?
'এই রংপুরেও?
'হ্যাঁ রংপুরেও৷ হাইজাকারদের ঢাকার ভূতের গলি আর রংপুর একই কথা৷ ষ্টেশনে চা নাশতা খেয়ে রেষ্ট নিয়ে তারপর বেরুব৷
'আমি ষ্টেশনে কিছু খাই না৷ এরা কষাই! দাম নেয় না তো যেন গলা কেটে দেয়৷
'আমি খাওয়াবো৷
'খাওয়ালেও খাবো না৷
'তোমার ক্ষুধা লেগেছে?
'না, তা নয়৷ খেলে ভালো লাগতো৷
'তুমি ওয়েটিং রুমে বসো৷ আমি আসছি৷
'একা ভীষন ভয় করছে যে!
'আমি দশ মিনিটে ফিরে আসবো৷ ওয়েটিং রুমে ঢুকতে না চাইলে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকো৷ আমি আসছি৷

কনক ষ্টেশনের দোকানে গিয়ে এক কাঠি সিগারেট কিনল৷ সিগারেটে আগুন ধরাল৷ প্লাটফর্মে অসংখ্য বস্তা গাদাগাদি করে পরে আছে৷ ওগুলো থেকে পেয়াজের ঝাঁজালো গন্ধ বেরুচ্ছে৷ কনক একটা বস্তার উপর বসল৷ ষ্টেশনটা কুয়াশায় ঢাকা৷ কনক জীবনে প্রথম এ এলাকায় এসেছে৷ রংপুর এত কুয়াশা পড়ে কনকের জানা ছিল না৷ পনের বিশ হাত দুরের মানুষও ঠিক বুঝা যাচ্ছে না৷ এ এলাকা নাকি মরুভুমি হয়ে যাচ্ছে৷ এগুলো কি তার পূর্ব লক্ষণ?
হৃদি ওয়েটিং রুম থেকে বেরিয়ে কনকের কাছে এসেছে৷
'এখানে একা বসে আছো কেন? কি ভাবছ?
'এমনি বসে আছি৷
'কনক খারাপ লাগছে?
'আমি ঢাকায় ফিরে যাব? ষ্টেশন মাষ্টার বললেন দিনাজপুর থেকে দশ মিনিটের মধ্যে যমুনা এক্সপ্রেস ঢাকার দিকে যাবে৷
'কি বলছ? তুমি ঢাকায় ফিরে যাবে? ঐ যে আযান হচ্ছে!
'হঁ্যা নামাজ পড়ে 'রিটার্ন টু ক্যাপিটাল' করব৷
হৃদির মন খারাপ হয়ে গেল৷
'কনক তুমি চলে গেলে আমি খুব কষ্ট পাব৷
'তোমাকে নিয়ে আমার বড় জ্বালা!
হৃদি হাসল৷ কাছের মানুষ এ ধরনের কথা বলে৷
'কনক ত্রিশ মিনিট পর কুয়াশা কেটে যাবে৷ বাসায় গিয়ে তুমি ঘুমিয়ে নিও৷ ভালো লাগবে৷

রোদ উঠেছে৷ কনক হৃদির সাথে রিকশায় বেরুলো৷ বাসায় এসে হৃদি ওর চাচীর সাথে কনককে পরিচয় করিয়ে দিল৷
'কনক তুমি গোছল করে নাশতা কর৷ তারপর লম্বা ঘুম দাও৷
কনক বলল, 'আমাকে ঘুম থেকে ডাকবে না৷
'আচ্ছা৷ যখন উঠতে চাও উঠবে৷ উঠে আমাকে ডাকবে৷ আমি খেতে দিব৷

কনক ঘুমিয়ে গেছে৷ হৃদি বিয়ের পর আজ দ্বিতীয় দিন রংপুরে এসেছে নিজের বাড়ীতে৷ এ বাসায় থাকেন ওর চাচা শফিক উদ্দিন, চাচী আর এক মাত্র ছোট চাচাতো ভাই৷ বাড়ীটা বড়বাড়ী৷ শহুরেদের মফশ্বলের বড় বাড়ী মানে উঠোনে ঘাস জঙ্গল থাকবে তা নয়৷ ঘরের দেয়াল ভাংগা নয় তবে এ বাড়ীর কেউ বিদেশে থাকেন তা বাড়ীর হালত দেখে বুঝা যায় না৷ বিদেশে থাকা মানে দেশে ডলার-পাউন্ড পাঠানো৷ ডলার-পাউন্ড পাঠানোর প্রথম পরিচয় ঘটে বাড়ীর চেহারা দেখে৷ পুরোন ঘর ভেঙ্গে নতুন নতুন ঘর উঠবে৷ দেয়াল জানালায় রং লাগবে৷
ইংল্যান্ড প্রবাসী হৃদির বাবা রফিক সাহেব তা করেন নি৷ বাড়ীর বাইরের আদল আগের মতই৷ বর্তমান মালিক হৃদির বাবা এবং চাচা শফিক সাহেব৷ ঘর ছ'টা৷ দাদার সুত্রে পাওয়া৷ বাবা-চাচা কেউ নিজে ঘর করেননি৷ রংপুরে এগুলোর দেখাশুনা শফিক উদ্দিন-ই করে থাকেন৷ হৃদির বাবা এ বাড়ীর অংশীদার হলেও তাঁর কোন দাবী নেই৷ তিনি ইংল্যান্ডের শেফিল্ডে সেটেল্ড৷ হৃদি যতদিন বাংলাদেশে থাকবে ততদিন ইচ্ছে মত এ বাড়ীটা ব্যবহার করতে পারবে৷
ঢাকায় বড় হওয়া শিক্ষিত মেয়ে হৃদির কোন ব্যাপারে ওর চাচা-চাচী নাক গলান না৷ চাচা-চাচী মানসিক দিক দিয়ে দুরে থাকেন৷ হৃদি রংপুরে গিয়েছে৷ ওর চাচা বাসায় নেই৷ তিনি ব্যবসায়িক কাজে সিলেট গেছেন ৷

কনক ঘুমাচ্ছে হৃদির ঘরে৷ সবগুলো ঘরই ভিতরের দরজা দিয়ে ইন্টারকানেক্টটেড৷ বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকলে শেষ ঘরের পিছনের দরজা দিয়ে এ বাড়ী থেকে বের হওয়া যায়৷ কোন্ পরিকল্পনায় হৃদির দাদা এমনভাবে ঘরগুলো তৈরী করেছিলেন তা কারোর মাথায় খেলে না৷

রান্না ঘর৷ দুপুরের রান্না হচ্ছে৷
হৃদি ওর চাচীকে জিজ্ঞাস করল, 'চাচা সিলেট থেকে কবে ফিরবেন?
'ও গতকাল গিয়েছে এক সপ্তাহ থাকবে৷ তুমি আসবে তা ও জানে না৷
'চাচী, মন ভাল ছিল না৷ তোমাদেরকে দেখতে এলাম৷
'মা খুব খুশী হয়েছি৷ চাচাকে দেখার আমার খুব ইচ্ছে ছিল৷
'এক সপ্তাহ থাকলে দেখা হবে৷ মা তুমি থাকবে? থাকো!
'আমার ননদের বিয়ে হয়েছে দেড় সপ্তাহ হলো৷ ওর স্বামী বিদেশ যাবে৷ তাকে বিদায় দিতে হবে৷ তাই চলে যাব৷
'মা তোমার সাথে ঐ ছেলেটা কে?
'আমার ক্লাসমেট৷ অনুরোধ করে নিয়ে এসেছি৷ ষ্টেশন থেকে চলে যাচ্ছিল আমি যেতে দেই নি৷
'ভাল করেছো মা৷ ছেলেটাকে ডাকো৷ খাবে না?
'চাচী ও নিজ থেকেই উঠবে৷ তারপর খেতে দেব৷

কনক সোয়া একটায় ঘুম থেকে উঠল৷ বহুদিন পর কনক আজ দুপুরে ঘুমালো৷ ঘুমালে ক্ষুধা লাগে বেশী৷ ঘুম থেকে উঠে সে হৃদির চাচীকে জিজ্ঞাস করল, 'চাচী হৃদি কোথায়?
'বাবা ও বাইরে গেছে৷ বলেছে আধা ঘন্টার মধ্যে চলে আসবে৷
আধা ঘন্টার মধ্যে বাইরে থেকে এসে হৃদি কনকের কাছে গেল৷
'কনক ঘুম হলো?
'হঁ্যা৷ বেশী ঘুম হলে ক্ষুধা লাগে বেশী৷ ক্ষুধা লেগেছে৷
'এখন খাবে?
'হঁ্যা৷
কনক দুপুরের খাবার খেল৷ খেয়ে দেয়ে সে আবার ওকে শু'তে দেয়া ঘরে গেল৷ হৃদি ওর পিছু পিছু ৷
'হৃদি কষ্ট দিচ্ছি তোমাদেরকে৷ এবার আমি আসব৷
হৃদির মুখে হাসি৷
'কিভাবে যাবে ট্রেন তো নেই! হৃদির চোখমুখ কন্ঠ চঞ্চলা কিশোরীর মতো৷
'বাসে যাব৷
'বাসে তুমি তো উঠ না!
'বাসেই যাব৷
'কনক তুমি চলে গেলে আমি কাঁদবো৷ সত্যিই কাঁদবো৷
'আমার জন্য?
'হঁ্যা তোমার জন্য?
কনকের মুখে নিঃশব্দের হাসি৷
'আগামীকাল যেও? আমিও তোমার সাথে ঢাকায় ফিরে যাব৷ রাশুকে বিদায় দিতে হবে না?
'তুমি দু'তিন রাত থেকে মনটা ভাল করে যাও৷
'তুমি চলে গেলে মনটা আরো খারাপ হয়ে যাবে৷ বিলিভ মি কনক৷

কনক কথা বাড়াল না৷ সে টেবিলের দিকে তাকাল৷
'হৃদি এখানে তো ফুল ছিল না?
'আমি বাইরে ফুল কেনার জন্যই গিয়েছিলাম৷
'আমার জন্য?
'না আপনার জন্য নয়! টেবিলের জন্য৷
'যাক, আমার জন্য টেবিলও ধন্য৷
কথাটা বলে কনক আবার হাসলো৷ তবে নীচু কন্ঠে৷

বৈধব্য (রিফড়যিড়ড়ফ) এবং দুর্বল মনস্তাতি্বক স্বাস্থ (সবহঃধষ যবধষঃয) সরাসরি সম্পর্কিত৷ ষ্ট্রেসফুল ঘটনা বিধবাদেরকে মানসিকভাবে বেশীমাত্রায় ভেঙ্গে দেয়৷ কম বয়সী বিধবারা ষ্ট্রেসফুল ঘটনার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে পারলেও বয়স্কা বিধবারা তা পারেন না৷
যাত্রাবাড়ীতে ইশতান্না বেগমের মাথা ঘুরছে৷ গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর দু'বার বমি হয়েছে৷ গতকাল হৃদির খালার কাছে তিনি ফোন করে যখন জানলেন হৃদি কনকের সাথে রংপুর গিয়েছে৷ আবার রাতে! তখন থেকে তাঁর এ অবস্থাটা বেশী করে শুরু হয়েছে৷
রংপুর ফোন করবেন কি করবেন না এ দ্বিধায় আজ বিকাল পর্যন্ত করা হয়নি৷ মানসিক চাপে ইশতান্না বেগমের শরীরটা খুব দুর্বল হয়ে গেছে৷

তিনি মনে করেন ফ্যামিলি থেকে গৃহবধু চলে গেলে সবচেয়ে কষ্টের ঘটনা হয়ে থাকে ঐ পরিবারের মা-বাবার৷ মানুষের সাংসারিক জীবনে এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কোন ঘটনা হতে পারে না৷
বৈঠা যার নৌকা তার৷ কার নৌকা কে বয়ে বেড়ায়? ইশতান্না বেগম হৃদিকে নিয়ে এমন একটা কিছু ভাবছেন৷
তাঁর শরীরের অবস্থা আর অস্থিরতা দেখে গত রাতে ইভা জিজ্ঞাস করেছিলেন, 'আম্মা আপনার কি শরীর খারাপ?
'বউমা আমার শরীর ঠিকই আছে৷
শ্বাশুড়ীর শারীরিক অবস্থা জানানোর জন্য ইভা ইস্কাটনে হৃদিকে ফোন করেছিলেন৷ তিনি টেলিফোনে হৃদিকে পাননি৷
সংসার তো এমনই একটি সংস্থা যে সংস্থায় বউ-শ্বাশুড়ী একে অপরের চোখমুখ দেখে অনেক কিছু বুঝে নিতে পারেন৷ এটাই সংসার নামক মহাসংস্থাটির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য৷ ইভা মনে করছেন হৃদির রংপুর যাওয়াটাই তাঁর শ্বাশুড়ীর শরীর খারাপ হওয়ার একমাত্র কারণ৷
ইশতান্না বেগম প্রেসারের ট্যাবলেট দু'বার খেলেন৷
ঊড় বউ বললেন, 'আম্মা প্রেসারের ট্যাবলেট বেশী খেলে প্রেসার একদম কমে গিয়ে রোগী মারা যায়!
'বউমা বেশীদিন বেঁচে থাকলে বেশী কষ্ট! প্রেসার বেড়ে গেছে এখন আর কি করা?
ইভা নির্বাক চোখে শ্বাশুড়ীর মুখের দিকে তাঁকিয়ে তাঁর কথা শুনলেন৷
ইভা তাঁর স্বামী ইশমামের কাছে শ্বাশুড়ীর শরীর খারাপ হওয়ার ব্যাপারটা এখন পর্যন্ত চেপে আছেন৷ তাঁকে জানালে হৈচৈ বেঁধে যাবে৷
ইশতান্না বেগম দুপুরে কায়েসকে পাঁচতালার সিড়ি থেকে ডাক দিলেন, 'কায়েস? কায়েস?
তাঁর স্বরে অস্বাভাবিক রুক্ষতা৷ অন্যান্য দিন তিনি নীচতালা পর্যন্ত নামবেন৷ ধীরে সুস্থে কায়েসকে ডাকবেন৷ আজ উপর থেকেই ডাকলেন৷ কায়েস ধচমচিয়ে উপরে উঠে এলো৷
'কায়েস যা বলবি মন দিয়ে শুনবি৷
'জি৷
'খিলগাঁ যা৷ এভাবে আমাকে দেখছিস কেন? বাসায় নতুন এসেছিস্? অমার কাছ থেকে কনকের বাসার টেলিফোন নাম্বার আর ঠিকানা নিয়ে আসবি৷ বুঝতে পেরেছিস?
'জি৷
'নিজ থেকে কোন আলাপ টালাপ কিছু করবি না৷ অমাকে বলবি আমার শরীর ভাল আছে৷
তিনি ঠোটে বিড় বিড় করে বললেন, 'নতুন বিয়াই বাড়ীতে তো এ আলাপ করা যায় না৷ কনক মেয়ের জামাই রাশুর প্রিয় বন্ধু এবং পুত্রবধূ হৃদির ক্লাসমেট৷ বিয়াই-বিয়াইন কি মনে করবেন? ঘটনাটা তাঁরা কি চোখে দেখবেন?
'আম্মা আর কিছু বলবেন?
'আমি বলেছি আর কিছু বলব? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা৷

কায়েস খিলগাঁ অমার শশুড় বাড়ীতে এলো৷ যাত্রাবাড়ীর সবাই ভাল আছেন৷ সব ঠিকঠাক আছে৷ কায়েস আধঘন্টার মধ্যে ফিরে এসে ইশতান্না বেগমকে কনকদের বাসার টেলিফোন নাম্বারটা দিল৷ ইশতান্না বেগম কনকদের বাসায় ফোন করলেন৷

কনক বাসায় নেই৷ কনক বাসায় নেই জেনেও ইশতান্না বেগম ফোনে প্রথমে কনককে-ই চাইলেন৷ কনকের বড় আপা ফোন ধরে বললেন, 'কনক বাসায় নেই৷
ইশতান্না বেগম মাত্র কয়েক মিনিট কথা বললেন৷ তাঁর টেলিফোন কন্ঠে খুব উদ্ধেগ ছিল৷ কনিকা ফোন ধরেই বুঝতে পেরেছিলেন কনক ঐ ভদ্রমহিলাদের পারিবারিক ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছে৷
ইশতান্না বেগমের টেলিফোন কনকদের বাসায় নতুন করে এক টেনশন রাজ্যের সৃষ্টি করল৷ টেনশন রাজ্যের রাণী হলেন কনকের বোন-মা কণিকা৷ যিনি কনকের বিপদে না খেয়ে থাকেন৷
কণিকা সংগে সংগে তাঁর রিপোর্টার ভাই রনককে তার অফিসে ফোন করে বসলেন৷
'হঁ্যা, আপা বলো৷
'কনক কাল রাতে বাসায় ফেরে নি৷ কোথায় গেছে ফোন করে জানাবে! সেটাও করে নি৷ ভেবেছিলাম বাবাকে দেখতে গ্রামে গেছে৷ সে গ্রামে যায়নি৷
'আপা তাতে হয়েছেটা কি? ওকে তো আর ছেলেধরা ধরবে না৷
'বেশ কিছুদিন ধরে কনকের মনটা খুব খারাপ দেখছি৷
'এটা স্বাভাবিক৷ বেকারদের মন ভাল থাকে না৷
'এক ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলেন৷
'কে ফোন করেছিল?
'চিনি না৷ বয়ষ্কা এক ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলেন৷ পরিচয় দিলেন কনকের ক্লাসমেট হৃদির শ্বাশুড়ী৷ টেলিফোনে বাসার ঠিকানা দিয়েছেন৷ তিনি সেখানে কাউকে যেতে বলেছেন৷ আমি বলেছি কাউকে পাঠাব৷ এখন তুই যা৷

রনক যাত্রাবাড়ী এসে ইশতান্না বেগমের সাথে দেখা করলেন৷ ঘটনা শুনলেন৷ ছোট বউ হৃদি কনকের ক্লাসমেট৷ তাদের মধ্যে খুব সুসম্পর্ক৷ ভদ্রমহিলা খুব টেনশনে আছেন৷ রনক বাসায় ফিরে কণিকাকে পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন৷ রনক হাসছেন৷
মিসেস কণিকার খুব ঘৃণাবোধ হলো কনকের উপর৷ তিনি মন্তব্য করলেন,
'কনক কিনা অবশেষে একজন বিবাহিতা মেয়েকে নিয়ে পালালো -----!!
'আপা, আন্দাজে মন্তব্য করা ঠিক না৷ তুমিও তো দেখি ইশতান্না বেগমের মত-ই ভাবছো৷ আরো একটু খোঁজ খবর নেয়া যাক৷ সিরিয়াস কিছু ভাবছো কেন? সে তো ভাল কাজেও যেতে পারে?

রনক বাইক নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে কনকদের আড্ডার দোকানে এলেন৷ তাঁর সাথে কারোর দেখা হল না৷ তিনি সাংবাদিক পেশায় চলে গেলেন৷ তাঁর মনে কোন টেনশন নেই৷

রাত বারোটা৷ দুপুরের খাবারের পর কনক আবারো ঘুম দিয়েছিল৷ এডাল্ট মানুষের চবি্বশ ঘন্টায় ছয় ঘন্টা ঘুম হলে যথেষ্ট হয়৷ আজ প্রায় দশ ঘন্টা ঘুমালো৷ কনকের ঘুম আসছে না৷ ও অন্ধকার ঘরে চুপচাপ শুয়ে আছে৷ ভাবছে৷ মনে অগণিত ভাবনা৷ এজাতীয় ভাবনার কোন আগামাথা থাকে না৷ অন্ধকারে ঘরের সাদা দেয়ালের প্রতিচ্ছবি থেকে শুরু করে ঢাকায় ফিরে কাজের পরিকল্পনার কথা৷ আধুনিক পোল্ট্রি ফার্মের কথা৷ ভাবছে বন্ধু রাশুর কথা৷ রাশুকে বিদায় দিয়ে একা হয়ে যাবে৷ আরো ভাবছে হৃদিকে নিয়ে৷ ভাবছে, তাকে নিয়ে হৃদি কি ভাবছে?
এমন সময় দরজায় ঠক করে একটা শব্দ হলো৷
কনকের হার্ট ডক করে উঠল৷ মনে হলো দরজা খুলে কেউ ঢুকছে৷ কনক চোখ বড় করে দরজায় তাকাল৷
'মনে হলো না' - সত্যি দরজা খোলে এবার একজন ঘরে ঢুকলো৷ সে হকচকিয়ে উঠল৷ মানুষের অবয়বী একটা ছায়া! ছায়াটা ওর বিছানার দিকে আসছে৷ চূড়ির রিনঝিন মৃদু শব্দ৷ হৃদি ফসর্া মেয়ে৷ অন্ধকারে বুঝা গেল ছায়াটা হৃদির৷ কনকের হৃদপিন্ডটা আবার একটা লাফ দিয়ে উঠল৷
এ সমস্ত সিচু্যয়েশনে শরীরে নরএড্রেনালিন নামক হরমোনের পরিমান আকস্মাত্‍ বেড়ে যায়৷ বুক ধড়্ফড়্ করে৷ আসলে এ হরমোনটা শরীরকে ঋরমযঃ ড়ত্‍ ঋষরমযঃ করার জন্য প্রস্তুত করে৷ হয় যুদ্ধ করো অথবা পালিয়ে যাও৷ কনকের কোনটা-ই করা সম্ভব হলো না৷ ঈশ্বর মানব প্রাণীটিকে নিয়ে কত ভাবে-ই না খেলেন?
হৃদি নিঃশব্দে বলল, 'কনক ঘুমিয়েছো? কনক নিরোত্তর রইল৷
সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে জেগে আছে৷ ওর চোখ এতক্ষণ ধরে এঘরে অন্ধকারের আলো দেখছিল৷ অন্ধকারের আলো হলো কালো৷
হৃদি টেবিলের চেয়ারে বসল৷ ওর শরীরের উত্তাপ গন্ধ কনক স্পষ্ট বুঝতে পারছে৷
সে দুনিয়ার তাবত্‍ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাস করল, 'হৃদি তুমি এসময়ে?
হৃদির গলা ভেঙ্গে ফঁ্যাসফেঁসে হয়ে গেছে৷ কষ্টের কান্নায় গলা ফঁ্যাসফেঁসে হয়ে গেলে অনেকের খুব মায়া হয়৷ হৃদি ভাংগা ফঁ্যাসফেঁসে গলায় বলল, 'কেউ জেগে নেই৷
জীব হয়েও মানুষ মাঝে মাঝে জড় হয়ে যায়৷ সে যে কথা-বলা প্রাণী তা সে ভুলে যায়৷ বিষ্ময়ে অভিভূত হলে মানুষ এমন হয়৷ কনকের এমন লাগছে৷
'কনক, আমি জানি তুমি বিস্মিত হয়েছো! তোমার কল্পনার বাইরে আমার এসময়ে এখানে আসার এ ঘটনা? সারা পৃথিবী কোথাও এমন ঘটনা ঘটেছে?
কনক হতভম্ব৷ তার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুচ্ছে না৷
বেশ সময় নিয়ে কনক বিছানায় উঠে বসলো৷
'তোমার খুব ঠান্ডা লেগেছে৷ হৃদি গতরাত থেকে এখন পর্যন্ত তুমি একটুও ঘুমাও নি৷ ঘুমুতে যাও অসুখ করবে৷
হৃদি চেয়ার টেনে অন্ধকারে কনকের পাশে এসে বসল৷
'কনক তোমার হাত দু'টো আমার হাতে দাও৷
কনকের দু'হাত হৃদির দু'হাতের শক্ত মুঠোয় আটকে আছে৷ কনকের মনে হচ্ছে অন্ধকারের অথৈই পানিতে ডুবে যাওয়া কেউ তাকে ধরে বেঁচে থাকার জন্য অক্সেিজন নিতে চাচ্ছে৷ অন্ধকার-ই নদীর পানি৷ কালো ঘন অন্ধকার!
'কনক আমার হাতটা শক্ত করে ধরো৷ খুব শক্ত করে৷
'কনক আমি অনেক রাত এক সেকেন্ডও ঘুমাই নি৷ আমাকে ঘুমাতে বলো না৷
কনক বুঝে উঠতে পারছে না কি ঘটতে যাচ্ছে?
কনকের হাত তার কাছে ভালবাসায় বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন মনে হচ্ছে৷
'আমি শেফিল্ডে যাব কেন? আমার ঘর এদেশে থাকবে৷ এই বাংলাদেশে৷ আমার জীবন-ঘরের বাতি কই? চাবি কই?
কথাগুলো হৃদির চিত্‍কার করে ঘরের ছাদে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল৷ বড় গলায়৷ খুব চিত্‍কার করে৷ কিন্তু সে বলতে পারল না৷
কনক শুনে যাচ্ছে৷
'কনক তোমাকে কত যে ভালবাসি তা যদি একটুও বুঝতে?
'আমি জানি৷
হৃদি নিঃশব্দে ফুঁসিয়ে উঠল৷
'না! তুমি জান না! জানলে আমাকে নিয়ে তুমি পালাতে! তোমার মনে প্রশ্ন জাগতো না এত রাতে আমি এখানে কেন?
দু'জনই চুপ করে র'ল৷ তারা যেন এক মহানিস্তব্ধতার গভীরে হাতরাচ্ছে! অনেকটা সময় চলে গেছে৷
'ক..ন..ক?
'বলো৷
'আমি জীবনে যা আশা করি সব কি ভুল?
কনক হৃদির কথার জবাব না দিয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে আবার ওটাকে একটা উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস করে ছেড়ে দিল৷ যন্ত্রনায় ভরা তার দীর্ঘশ্বাস৷
অবিবাহিতরা বিবাহিতদের চেয়ে বেশী ইমোশনাল হয়৷ বিয়ে মানুষের ভালবাসার ইমোশনকে ক্ষয় করে দেয়৷ কনক হৃদির চেয়ে বেশী ইমোশনাল হয়েছে৷ কিন্তু তা অপ্রকাশিত রয়ে গেল৷ হৃদিই বেশী ইমোশনাল হয়েছে৷
হৃদি কাঁদছে৷

কনক অনর্্তদৃষ্টি উন্মোচন করলো৷ এ দৃষ্টি ভিতর থেকে টেনে এনে বাইরের চোখের দৃষ্টির সাথে যোগ করতে হয়৷ কনক যোগ করলো৷
অনর্্তদৃষ্টি এমনই! অন্ধকার নেই৷ ঘর আলোকিত৷ স্পষ্ট ঝলমলে সে হৃদিকে পরিষ্কার দেখছে৷ হৃদির ঠোট কাঁপছে৷ হৃদি নিষ্পলক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কাঁদছে৷ তার চোখ থেকে রূপোর ধারা বইছে৷
হৃদি শক্তিহীন কন্ঠে বলল, 'তুমি আমাকে মাড়াও কেন?
কনক নির্বাক৷
'কথা বলছো না কেন? আমার হাতের স্পর্শ তোমাকে কিছু বলে না?
'তোমাকে আমি মাড়াই না৷ মাথায় করে রাখি৷
'এ কেমন মাথায় রাখা? মাথায় থাকতে চাই না৷ পায়ে স্থান হলেই বেশী!
'প্লীজ, এভাবে কথা বলোনা৷ খুব কষ্ট হচ্ছে৷ হৃদি মাথার মনি পায়ে থাকে না৷ সাপের মনি মাথা থেকে কেড়ে নিলে সাপ মরে যায়! জানো?
হৃদি দু'চোখ বন্ধ করল৷ বন্ধ চোখ থেকে পানির ঝরনা বইছে৷
কনক হৃদির কান্না মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেও চোখ বন্ধ করলো৷
তার ভিতরে কিছু কথা প্রবল আন্দোলনে ভেসে উঠতে থাকলো-- 'হৃদি তোমার চোখের পানি মুছে দিয়ে তোমাকে স্পর্শ করি? অনুভব করি তোমাকে? ভালবাসা কোত্থেকে আসে? এগুলো শুধু অনুভব করতে হয়৷ আমি তোমাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করি !!

পুজারীর চিত্রমন্ডপ নেই৷ গায়ের উপত্যকায় নীলপদ্ম ফুটে নেই৷ নীলাম্বরী শাড়ীর নীলপরী হয়ে নয়৷ সাধারন সেলোয়ার কামিজ পরা হৃদির এক জোড়া হাত কনকের এক জোড়া হাতকে ধরে আছে৷ কে কা'কে দেবতার আরতিতে আরাধনা করে? কে কা'র আরধ্য?
কনকের দু'হাতে হৃদির চিবুক-গাল বেয়ে পড়া চোখের পানি টপটপ করে পড়ছে৷ টপটপ - একটা করে ফোটা! কষ্ট! বেদনা! একটা করে ভালোবাসার নির্যাস! ফোটা ফোটা ভালোবাসা! অজস্র ভালোবাসা! ভালোবাসার নদী! কলকল করে যেন নদী বইছে৷

কনক ঘুম থেকে উঠেছে অনেক সকালে৷ ও একা বাসার বাইরে গেল৷ কুয়াসায় ঢাকা রংপুর শহর৷ পৃথিবীর মধ্যেই এ এক অন্য পৃথিবী! গ্রাউন্ড ফগ৷ কনক কুয়াসায় হাটছে৷ কুয়াসাকণা অতিক্ষুদ্র৷ খালি চোখে দেখা যায় না৷ কুয়াসা কণার গতিবেগ মাটির সাথে সমান্তরাল৷ হাটলে কুয়াসাকণা মাথায় বসে৷ সে হাটছে৷
কনকের হাটার ভিতর একটা উদ্দেশ্যহীন তাড়া আছে৷ মাঝে মাঝে উদভ্রান্ত পাগলের মত ঘন কুয়াসার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সে হাটছে৷ কুয়াসার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলীয় বাষ্পকণার মহাসমূদ্র৷ এ মহাসমূদ্রের প্রভাত ফেরীতে হেটে কনক যেন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে৷
ওর চুলে কুয়াসার বিন্দু জমে৷ পানির চুমকি৷ মাথায় পানির চুমকি ঘষে চুল ভিজিয়ে দেয় কনক৷ বার বার হাত নেড়ে সে চুল ভিজিয়ে দেয়৷

হাটতে হাটতে কনক একটা জায়গায় এলো৷ কোথায় এসেছে সে বুঝতে পারল না৷ বাস ষ্টপজের মত মনে হলো৷ মধ্যবয়সী একজন মহিলা ঘন কুয়াসার ভিতর পানি ঢালছেন তার বসার জায়গায়৷ তার সামনে বালতি রাখা আছে৷ বালতিতে রজনীগন্ধার ফুল৷ কনক মনে মনে খুশী হলো৷ ও কিছু একটা খোঁজছিল৷ কি খোঁজছিল যদিও সে তা জানত না৷
সে এখন দিঙমূঢ়৷
'ধন্যবাদ৷
মহিলাটিকে কনক মনে মনে ধন্যবাদ দিল৷
রজনীগন্ধা প্রিয় কাউকে দেয়ার শ্রেষ্ঠ ফুল৷
ফুলগুলো বাসীফুল৷
'হোক বাসীফুল! হোক অন্যের ব্যবহৃত ফুল! অসুবিধা নেই৷ ফুলগুলো তাজা না৷ কিন্তু গন্ধ ধরে আছে৷
'চাচী ফুল বেচবেন?
'জি বাবা বেচবো৷
ঘন কুয়াসা৷ সাত সকালে এভাবে কেউ হাটে? কনকের ক্লান্তি লাগছে৷ সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল৷ কুয়াসা-ই ধুঁয়ো হয়ে তার মুখ থেকে বেরুলো ৷
কনক ফুল কিনে হাতে নিল৷
'চাচী, এখন ঢাকা যাওয়ার বাস আছে?
'একটা বাস তো কিছুক্ষণ আগে চলে গেল৷
'পরের বাস ক'টায়?
'বাবা আমি জানি না৷

কনক রজনীগন্ধার ফুলগুলো নিয়ে বাসায় ফিরল৷ হৃদির চাচী ঘুম থেকে উঠেছেন৷ কনককে বাইরে থেকে হাটতে আসতে দেখে তিনি বললেন,
'বাবা রংপুর কেমন দেখলে?
'চাচী, রংপুর আমার খুব ভাল লেগেছে৷ আবার আসবো৷ তেতুলিয়া যাবো৷ সীমান্তের ওপার দেখবো৷ চাচী আমি এখন ঢাকায় চলে যাবো৷
'বাবা নাশতা কখন করবে?
'হৃদি ঘুম থেকে উঠেছে?
'না৷
'ডাকব?
'হঁ্যা ডাকুন৷

হৃদিকে ওর চাচী ঘুম থেকে জাগালেন৷ হৃদি ধচমচ করে বিছানায় উঠে বসল৷ মনে হলো সে কোন ভয়ের স্বপ্ন দেখছিল৷ দুঃস্বপ্নের ভিতরই তাকে আচমকা ধাক্কা দিয়ে গর্তে ফেলে দেয়া হয়েছে৷ সে আতংক নিয়ে জিজ্ঞাস করল,
'চাচী কি হয়েছে?
চাচী উদ্বেগ নিয়ে বললেন, 'ওমা তোমার চোখ এত ফোলা কেন? বিছা-চেল্লার ছোঁয়া লেগেছে নাকি?
হৃদির কাছেই তার চোখ খুব ভারী মনে হচ্ছে৷ আবেগ নিয়ে কাঁদলে চোখ ফোলে বেশী৷
হৃদি মিথ্যে করে বলল, 'চাচী রাতে স্বপ্নে আমি অনেক কেঁদেছি৷
'হায়! আমি কেমন মরার ঘুম ঘুমালাম গো! কিছুই টের পাইনি৷ মা তোমার বন্ধু তোমাকে ডাকছে৷ ও বলল ঢাকায় চলে যাবে৷
'চাচী ওকে বসতে বলুন আমি আসছি৷

হৃদি বাথরুমের আয়নায় নিজের চোখ দেখল৷ বেমানান ফোলা!
'কেন এ বংশে একমাত্র 'আমি' মেয়েটির জন্ম হয়েছিল? কথাগুলো নিজের প্রতিবিম্বকে জিজ্ঞাস করতে গিয়ে হৃদির চোখ পানিতে ছেপে গেল- এই ভোর সকালে৷

হাতমুখ ধুঁয়ে হৃদি কনকের কাছে এলো৷
'হৃদি আমি ঢাকায় চলে যাবো৷
নির্ঘুম ফোলা লালচে চোখে হৃদি কনককে দেখল৷
'আমার অত্যাচারে?
'অত্যাচারে নয়৷ ভালবাসায়! ভালবাসায় নিয়ন্ত্রন হারানোর ভয়ে!
'নিয়ন্ত্রন হারাতে তো বলেছিলাম৷
'হারালে ওটাকে তখনই মাটি চাপা দিয়ে দেয়া হলো !
'মাটি থেকে বীজটা বড় হয়ে ভালোবাসার মহীরুহ হতো! এর ডালপালায় ফুল ফোটতে পারতো!
'ফুলের সুরভি কতদিন থাকে? গন্ধহীন হয়ে পচে যায় আর সঙ্গে সঙ্গে ভালবাসার মৃতু্য হয়!
'ভালোবাসাকে গন্ধহীন করে তুললে ওটার মৃতু্যতো হবেই? আর নিয়ন্ত্রন হারানোর কথা বললে না? কারোর না কারোর কাছে নিয়ন্ত্রন তো হারাবেই? নাকি হারাবে না?
'যার কাছে হারাবো সে আমার কাছে আরোধ্য বিষয়৷ আমৃতু্য তাকে শুধু আরাধনা করে যাব৷
'মানুষ আমৃতু্য আরাধনা করে শুধু ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য৷
'ঈশ্বর, ভালোবাসা এবং আরধ্য-মানুষ এগুলো আমার কাছে সমার্থক৷
হৃদি হোচট খেলো৷
'বা্বা! তোমার সেই আরধ্য-মানুষ, সে-ই ঈশ্বর মহাভাগ্যবতী রমনীটি কে? সে-কি জন্মেছে?
কনক বলল, 'চোখ বন্ধ করে নিজেকে প্রশ্ন করো?
কনকের উত্তর শুনে হৃদি হাসল৷ কিন্তু সেটা শুষ্ক ঠোটে বিষন্নতায় ভরা মহাকষ্টকর হাসি মনে হলো কনকের কাছে৷
'কনক তোমার সাথে আমিও ঢাকায় চলে যাবে৷ হৃদির চোখমুখ কেমন যেন মেঘমেঘ হয়ে গেল৷
কনক হৃদির দিকে আর তাকাতে পারল না৷
'তুমি আরো দু'একদিন থেকে যাও৷ রাশুর ফ্লাইটের দিন সি অফ করতে ঢাকায় এসো?
হৃদি নির্লিপ্তভাবে বলল, 'আচ্ছা৷ কনক আমার দিকে তাকাও৷
'নাশতা করবে না?
'নাশতা করার মত মানসিক অবস্থা আমার নেই৷ আমি কিছু খাব না৷
সে হৃদির হাতে ফুল দিয়ে বলল, 'হৃদি চলি৷
হৃদির সাথে সাথে কনকের মনটাও খারাপ হয়ে গেল৷

রৌদ্রের তোড় বেড়েছে৷ কুয়াসা কেটে গেছে৷ কনক ভোরে ফুলকেনা সেই বাস ষ্টপজে এলো৷ মনটা ভারী পাথরের মত মনে হচ্ছে৷ কনক অনুভব করল এমন ভারী মন ওর কোন দিন হয়নি৷ একটা বাস আসছে কানফাটা হর্ণ দিয়ে৷ কনক হাত উঠালো৷ বাসটা হেলেদুলে ওর কাছে আসছে যেন ওকে গাড়ীচাপা দেয়াই তাদের উদ্দেশ্য৷ কনকের পায়ের গোড়ায় বাস থামলো৷
'কোথায় যাইবেন?
'ঢাকা৷
কন্ডাক্টর এক টান দিয়ে কনককে বাসের ভিতর তুলে নিল৷ পিছনের চাকার উপর সে একটা সীট খালি পেলো৷ কনক বসলো ওখানে৷ কপালে হাত ঠেকিয়ে সে চোখ বন্ধ করে রইল৷ হৃদিকে রেখে যেতে ওর খারাপ লাগছিল৷ আজই কনক উপলদ্ধি করল তার চোখ ভিজে উঠেছে সম্পুর্ণ অন্য এক কষ্টে৷
'আমার মন জীবনের সমগ্র আকর্ষণ নিয়ে কা'কে ধরে-ছুঁয়ে থাকতে চায়? রাশু, রাশুর বাবা-মা, ইশতান্না বেগম, অমা... সবার... 'আমার প্রতি অন্য রকম বিশ্বাস' কা'র ইচ্ছেটাকে চাপা দিয়ে যায়? কাপুরুষের মতো সে চাপটাকে ঠেলে উপরে উঠতে পারা হয় না কেন? ভিতরের দ্বিতীয় কনকটি বেড়িয়ে আসে৷ সেটাই কহে না কহে৷ এই দ্বিতীয় কনকটি রংপুর থেকে হিমালয় বুকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে৷ কনক চোখ বন্ধ করে নিজেকে অসংখ্য প্রশ্ন করতে থাকলো৷

বাস ঢাকায় চলছে৷ গতিবেগ স্বাভাবিক৷ পাশের একজন যাত্রী খুক্ কাশি দিল৷ একাগ্রভাবে নিজের ভিতর ডুবে থাকলে মানুষ তার অস্তিত্বের কথা ভুলে যায়৷ তাকে কে দেখছে? কনক পাশের যাত্রীর কাশির খুক্খুক্ শব্দে সতর্ক হলো৷
কাশি সবাই দেয়৷ কাশির দৃশ্য দেখার মত কিছু না৷ কুয়াসা বেশী পড়লে কাশি বাড়তে পারে৷ কাশিটা যদি অবারিত গতিতে চলে তবে মানুষ তাকায়৷
কনক আড়চোখে পাশে তাকালো৷ পাশের যাত্রী একজন মহিলা৷ মেয়েদের কফ রিফ্লেক্স কি (সেনসিটিভিটি) পুরুষের চেয়ে বেশী? তিনি এভাবে কাশছে কেন? কনক মনোযোগ ফিরিয়ে নিলো৷
মহিলাটা আবার খুক্ করে কাশি দিল৷৷ এটা উদ্দেশ্যমূলক কাশি৷ কনক তাঁর দিকে ভাল করে তাকাল৷ ফর্সা ধবধবে এ মহিলা৷ তাঁর মুখ দিয়ে লালা ঝরছে৷
মহিলাটা একজন প্রতিবন্ধী৷ কনক তাকানোর জন্য মহিলাটি হেসে দিল৷ প্রতিবন্ধী একজন মহিলাকে কাশির মতো ব্যাপার নিয়ে কিছু বলা যায় না৷ প্রতিবন্ধীরা নাকি ইন্নোসেন্ট হয়? কনক সামনের সীটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বেঁকে বসে র'ল৷
ধবধবে মহিলাটি আবার কাশি শুরু করল৷ এ কেমন মহিলা!
আবার, 'খুক্খু্ক!
'চুঃ! উনি কি আমাকে নিয়ে খেলছেন?
কনক ঘাড় উঠিয়ে হাত উপরে তুলে আড়মোড়া দিল৷ সে চারদিক সুস্থিরভাবে দেখলো৷ সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে৷ কনকের সামনের কয়েক সীট পর্যন্ত সবাই প্রতিবন্ধী৷ কেউ মুখ বাঁকা করে হাসছে কেউবা ঘাড় বাঁকিয়ে হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ প্রতিবন্ধীরা কি নরমাল মানুষকে এবনরমাল ভাবে? সবাইকে প্রতিবন্ধী ভাবে?
কনক ঘাড় ঝাঁকিয়ে ইশারায় পাশের প্রতিবন্ধী যাত্রীকে জিজ্ঞাস করল,
'কি-ই খ..ব..র? আপনারা কেমন আছেন?
পাশের যাত্রীটি এবার খুক্খু্ক করে না কেঁশে বাঁকা মুখে খক্খক্ করে হাসি জুড়ে দিল৷ খক্খক্ করা পূর্ণিমা রাতের জোত্‍স্নার জোয়ারের মত উথলে পড়া সে হাসি! অথৈই অথৈই সত্য সুখের হাসি! অনিয়ন্ত্রিত হাসি!
কনকও হাঁ - হাঁ - হিঁ - হিঁ - করে অট্রহাসিতে ফেটে পড়ল৷ সে তো অট্রহাসির দেবতা৷
হাঁ - হাঁ - হিঁ - হিঁ--
'ওরা কোথায় যাচ্ছে?
'ঢাকায়?
'ওরা জানে? ওদের জীবনের কোন দিক নেই? উদ্দেশ্য নেই? জীবনের স্বপ্ন ছাড়া ওরাও তো হাসছে!
কনকের মনে হল ওদের মনে দুঃখ বলে কিছু নেই? আছে?
বাসে গান বাজলে ভাল হতো৷ আবেগের সাথে মিশে যাওয়া যেত৷ যদি এমন একটা গান হতো ----
কোথায় চলেছি মনে
অন্ধকারে অরণ্য বনে৷
কি আছে মনে?
আশা নেই নিরাশা নেই
আসক্তি নিরাসক্তি!
কি আছে মনে?
কোথায় চলেছি মনে?
অন্ধকারে অরণ্য বনে৷

এটা গান হলো? না হলে না হোক! যার কোন কিছু হয় না তার আবার গান?

বাসের গতি বেড়ে গেছে৷ বাসটার পিছনে আর একটা বাস৷ ডাউস সাইজের ড্রাইভার তার পিছনের বাসটাকে সামনে যেতে দিবে না৷ কিছুতেই না! সে এক্সলেটরে পা চেপে ধরেছে৷ শোঁ..শোঁ.. বাস চলছে৷
শোঁ শোঁ শোঁ শোঁ ........ ........ ........

থাই এয়ারে রাশুর ফ্লাইট দুপুর আড়াইটায়৷ ব্যাংকক হয়ে জাপানের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট 'কানসাই'এ৷ সমূদ্রে মাটি ফেলে মাটির ভেলা 'কানসাই' এয়ারপোর্ট করা হয়েছে৷ চারদিক সমূদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে৷ বিমানের রানওয়ে আর পানি একাকার হয়ে আছে৷ কানসাই থেকে আমেরিকার হনলুলু৷
ইশতান্না বেগমের পরিকল্পনা হলো হৃদি আর রাশু ব্যাংকক যাবে৷ এয়ারপোর্টের ট্রেনজিট লাউঞ্জে ইতমামের সাথে রাশুকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে হৃদি ইতমামের কাছে থেকে যাবে৷ ইশতান্না বেগম নিজে যাবেন না৷ তাঁর স্বাস্থ একদম ভালো না৷ তাঁর মনে হচ্ছে তিনি বেশী দিন বাঁচবেন না৷ শরীর ঠিক হলে তিনি হৃদি-ইতমামের ওখানে বেড়াতে যাবেন৷ তিনি ভাবছেন ওটাই হবে তাঁর শেষ যাওয়া৷
শ্বাশুড়ীর পরিকল্পনায় হৃদির কোন মন্তব্য নেই৷ হৃদির মনোভাব এমনঃ হোক না শ্বাশুড়ীর মঞ্চ পরিকল্পনা? ঘূর্ণিঝড় এসে মঞ্চটাকে না ভাঙ্গলেই কি নয়? পৃথিবীর জীবন-মঞ্চে প্রতিটি মানুষ না কি একেকজন অভিনেতা অভিনেত্রী?

রংপুর থেকে ফিরে এসে হৃদির মনটা কেমন হয়ে গেছে! কেউ মাপতে পারছে না৷ তবে তার চোখের অশ্রুগ্রন্থির নালীগুলো বন্ধ হয়ে আছে৷ অথবা চোখের পানি শুকিয়ে গেছে৷ তার চোখমুখও আগের মত সংবেদনশীল মনে হচ্ছে না৷ তাকে নিয়ে কথা উঠলে এখন আর চোখ ভিজে উঠে না৷
কায়েস ইশতান্না বেগম আর হৃদিকে নিয়ে খিলগাঁ এলো৷ কনক কিছুক্ষণ আগে এখানে এসেছে৷ সে রাশুকে বিদায় দিতে এয়ারপোর্টে যাবে৷
রংপুর থেকে আসার আজই প্রথম হৃদির সাথে কনকের দেখা হল৷

কনক এগিয়ে কথা বলল৷
'হৃদি তোমাকে রংপুর একা ফেলে চলে এসেছিলাম৷ আমি দঃখিত৷
হৃদির চোখ কেঁপে উঠলো৷ কিন্তু ভিজে উঠলো না৷ আশাহত মানুষের চোখ এভাবে কেঁপে উঠে৷
রাশু এসে বলল, 'তোকে নিয়ে বাসার মানুষগুলো চিন্তায় বাঁচে না! আর কাউকে না বলে রংপুর চলে গেলি?
'রাশু, আমি কনককে ঢাকায় ফোন করে জানিয়ে দিতে বলেছিলাম৷ ও ফোন করল না৷
'মাঝে মাঝে মানুষকে টেনশনে ফেলে বুঝতে হয় তোর জন্য কা'র কত দরদ? হৃদি রংপুর থেকে কবে এসেছো?
'তিনদিন পরই চলে এসেছিলাম৷ কনক, ব্যাংকক পেঁৗছে যাত্রাবাড়ীতে ফোন করব৷ তুমি যাত্রাবাড়ী থেকো৷ থাকবে তো?
'হঁ্যা থাকবো৷ ক'টায় ফোন করবে?
'রাত আটটার দিকে
রাশু বলল, 'যাত্রাবাড়ী যাস্৷ তোর সাথে আমিও কথা বলব৷
কনক হৃদিকে বুঝতে পারলো৷ কিছু কিছু ঘটনা মানুষের জীবনে কেন যে ঘটে? যাকে সপ্তাহের একদিন না দেখলে মনটা উদাসীনতায় গুম হয়ে যেতো সেই হৃদি সামনে থেকে ভিতরে চলে গেল? কনকের মনে হলো হৃদি একদম আগের ফর্মে চলে গেছে৷ বুকের মধ্যে ফুজি নয় এবার সত্যি হিমালয় নিয়ে সে রাশুদের বাসায় এসেছে৷ ফর্সা হৃদিকে রক্তশূণ্য বিবর্ণ লাগছে৷
বাইরে গাড়ীর হর্ণ বেঁজে ঊঠলো৷ এজিএম হান্নান এসেছেন৷ সাথে সেড্রিক নয় এবার তাঁর ডাবল-ব্রেকার নিজস্ব গাড়ী৷ তিনি দরজায় এসে বললেন, 'কনক! রাশু তোমরা রেডি হয়েছো?
কনক বলল, 'হঁ্যা বস্ চলুন৷ রাশু বেরিয়ে আয়৷

কায়েস আর এজিএম হান্নান - সবাইকে নিয়ে এয়ারপোর্টের ডিপার্চার লাউঞ্জে এলেন৷
এজিএম হান্নান বললেন, 'রাশু তোমাকে আমি ভি.আই.পি. লাউঞ্জ দিয়ে বের করে দিব৷ আশা করি ভি.আই.পি. হয়ে দেশে ফিরবে৷
'বস্, ভি.আই.পি. লাউঞ্জের পাশ এনেছেন?
'তোমরা এখানে দাঁড়াও৷ আমি আসছি৷
এজিএম হান্নান পনের মিনিটের ভিতর ফিরে এলেন৷ সংগে একজন ইমিগ্রেশন অফিসার৷ যে যার যার পরিচয় দিল৷
'রাশু উনি তোমাকে ভি.আই.পি.র নির্ভেজাল পেসেজ দিয়ে নিয়ে গিয়ে তোমার সীটে পৌঁছে দিবেন৷
ইমিগ্রেশন অফিসারটি শুধু ওয়েলকাম বলে চলে গেল৷
তিনি কনককে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'কনক কি বুঝলে? তাঁর চোখেমুখে তৃপ্তির হাসি৷
'বস্, মাতৃভূমির যে স্থানটিতে এসে এদেশের মানুষের মন বেদনায় হাহাকার করে উঠে বা আনন্দে ঝলমল করে উঠে সে-ই স্থানে এসে যদি কারোর দুর্ব্যবহার পেতে হয়! তার চেয়ে দুঃখজনক আর কি-ই আছে?
'কনক তুমি এয়ারপোর্টের কথা বলছো?
'জি, সেই স্থানটিতে হলো এই এয়াপোর্ট! বস্ আপনি সুন্দর একটা কাজ করেছেন! আমি খুব খুশী হয়েছি৷
'কনক? রাশু? ইউ বোথ হ্যাভ এ লং ওয়ে টু গো, টু মেজার এজিএম হান্নান৷ তোমরা দু'জনই শোন৷ ইট ইজ এন এডভাইস৷ অর্বাচীন ডট চৌধুরী এখানে থাকলে আরো ভালো হত৷ জল বায়ু'র মতই মানুষ মানুষের জন্য অপরিহার্য৷ দ্যাট ইজ, হিউম্যান ইজ ইনডিসপেস্যবু্যল৷ মানুষকে কখনো ফেলে দেয়া যায় না৷ সবারই সবাইকে লাগে জীবনের কোন না কোন সময়ে৷ কথাগুলো পুরাতন হলেও আমার কাছে চির নতুন লাগে! চির নতুন!!
রাশু বলল, 'বস্ আপনার বলা কথা, ব্যক্তি-আপনার কথা আমার অনেকদিন মনে থাকবে৷ আমি আপনাকে মিস করব৷
এজিএম হান্নান তাঁর প্যান্টের পকেটে হাত দিলেন৷
'তোমার জন্য রাখা সেই মন্টব্ল্যান্ক কলমটা৷ আমেরিকায় এ কলম দিয়ে লিখবে৷ কষ্ট করে আমাকে মনে করতে হবে না৷ এ কলমটাই এজিএম হান্নানকে মনে করিয়ে দিবে৷ আমি বাইরে যাচ্ছি৷ খালাম্মাদের সময় দাও৷ বাই বাই৷
বাই বাই বলে এজিএম হান্নান আবার ফিরে এলেন৷
'রাশু, এজিএম হান্নান মানেটা যেন কি?
'এ গ্রেট মাইন্ডেড হান্নান (ধ মত্‍বধঃ সরহফবফ ঐধহহধহ)৷
'থ্যাংক ইউ৷
'বস্ খুব খুশী হয়েছি৷ খোদা হাফেজ৷
'খোদা হাফেজ৷

নিজ দেশও পরদেশ হয় ইমিগ্রেশনে ঢুকলে৷ বিদেশ যাত্রীর মন খারাপ হওয়া শুরু হয় এ জায়গা থেকেই৷
কনক দু'হাতে রাশুকে জাপটে ধরে বলল, 'যেখানে থাকিস যেভাবে থাকিস যোগাযোগ রাখিস৷
চোখে পানি নিয়ে রাশু বলল, 'রাখব৷
'আমাদের বাসার দিকে খেয়াল রাখিস্৷ এ ক'টা দিন অমার খোঁজ খবর নিস ৷
কনক ভেজা চোখে নিঃশব্দে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল৷

রাশুর বাবা ছেলের বিদায়ের ব্যাপারটাকে খুব কষ্টকর একটা ঘটনা মনে করেন৷ তিনি এয়ারপোর্টে আসেন নি৷ রাশু মনোযোগ দিয়ে তার মা'র দিকে তাকালো না৷ তাকালে বিদায় দিতে আসা লোকজনের চেয়ে রাশু নিজেই আম্মা বলে চিত্‍কার দিয়ে হুহা করে কেঁদে উঠবে৷
রাশু অন্যদিকে তাকিয়ে তার মাকে বলল,
'আম্মা তুমি আমার জন্য চিন্তা করবে না৷ আমি ভাল থাকবো৷ রেশমা তুই মন দিয়ে লেখাপড়া করবি৷
অমা ফ্যাল ফ্যাল করে তার চলে যাওয়া স্বামীকে দেখছে৷ তার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকানোয় কি আরাধনা ছিল তা একমাত্র রাশু জানে৷
উচ্চ শিক্ষার নাম করে রাশু এই প্রিয় মাতৃভূমিকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে৷ এদেশের মাটি জল বায়ু খেয়েতো সে বড় হয়েছে৷ তার ভিতরটা বিধ্বস্ত! চোখ লাল হয়ে গেলো৷ ঈশ্বর এই মাটির গন্ধ কেন যে দিয়েছিলেন!
'হৃদি চলো৷ আর দেরী করা যাবে না৷
রাশু ভিতরে ঢুকে গেল৷

থাই বিমান টেক অফ করেছে৷ সেই বারান্দা! রাশুর সেই মেঘ ছুঁয়ে যাওয়া স্বপ্ন! সেই সাদা সার্ট! নীল মেঘ! সার্টকে নীল করে দেয়া! রাশুর বিমান ঢাকার আকাশ ছেড়ে নিমিষেই চলে গেল৷ রৌশনারা এবার হুহা করে কেঁদে উঠলেন৷ রাশু সত্যিই তুই বহু দুরে চলে গেলি রে!
তাঁর চোখের জলের ধারা বাঁধ ভেঙ্গেছে৷

এজিএম হান্নান বাদে সবাই খিলগাঁ রাশুদের বাসায় ফিরে এসেছে৷ অমার মনটা ভারী হয়ে আছে৷ কনক অমাকে ডেকে কাছে বসালো৷
'অমা মন খারাপ করার কিছু নেই৷ তুমি ভাগ্যবতী৷ রাশু খুব ভাল ছেলে৷ ওকে আমার ভাললাগে কেন জান?
অমা শূণ্য দৃষ্টিতে কনকের দিকে তাকাল৷
'ওর লোভহীন সরলতা৷ তোমরা খুব ভাল থাকবে৷ ব্যাস্৷
'ভাইয়া দোয়া করবেন৷
এ কথাটার বেশী অমা কিছু বলল না৷ সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷

বিদায় যন্ত্রনার সমার্থক৷ রাশুর বাসায় বিদায়োত্তর আলোচনা হচ্ছে৷ অবুঝ প্রাণী মারা গেলে জটলা বেঁধে কি যেন বলাবলি করে? আর মানুষ! সে তো অগাধ ইমোশন নিয়ে জন্ম নেয়া এক মহাবিষ্ময়কর প্রাণী! যে লোকটি এ ঘরে হাটতো কথা বলতো ঘুমাতো সে নেই৷ কিন্তু তার অস্তিত্ব ঘোরাঘোরি করে৷
কনক অমাকে এসে কথবার্তা বলতে বলল৷ অমা এলো কিন্তু কথা বলল না৷ সে নির্বাক হয়ে সবার আলোচনা শুনছে৷
অমার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরুল৷
'কনক ভাইয়া সাড়ে ছ'টা বেজে গেছে৷ চলুন যাত্রাবাড়ী যাব৷ ও ফোন করবে৷
কনক হাসল৷
'রাশুর বিমান ল্যান্ড করতে এখনো অনেক সময় বাকী৷ রাশু এখনও আকাশে৷ আগে ভূ-পৃষ্ঠে নামুক?
মেয়ের মন খারাপ দেখে ইশতন্না বেগম বললেন, 'অমা কনককে নিয়ে বাসায় যা৷ আমি বিয়াই বিয়াইনের সাথে গল্প করব৷ কায়েস তুই পরে এসে আমাকে নিয়ে যাস্৷

অমা-কনককে নিয়ে কায়েস যাত্রাবাড়ীর উদ্দেশ্যে খিলগাঁ থেকে চলে গেল৷
অমা গাড়ীতে বলল,
'কনক ভাইয়া, ভাবী আপনাকে একটা চিঠি দিয়েছেন৷
'কখন?
'এয়ারপোর্টে আমার ভ্যানিটিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন৷ খেয়াল নেই আপনাকে বলতে৷ চিঠিটা এখন দিব?
'দাও৷
অমা হৃদির চিঠিটা কনকের হাতে দিল৷
ভালবাসার কষ্ট আই মুভমেন্ট কি কমিয়ে দেয়? চক্ষুগোলকে চোখ নড়ে না কেন? অমা গাড়ীর জানালায় বাইরে তাকিয়ে আছে৷ তার চোখের পলক পড়ছে না৷ পলকহীন চোখ এমনিতেই জ্বলে৷ এর সাথে যোগ হয়েছে রাশুকে ভালবাসার জ্বলনি৷ কিভাবে কি হলো? একদিনের কথা থেকে বিয়ে৷ হৃদি ভাবীরও এমন হয়েছিল৷ সবার কপালে হঠাত্‍ ঘটে যওয়া ঘটনার সুফল দীর্ঘস্থায়ী হয় না৷ কারো কারোর কপালে হয়৷

কনক কায়েসের পাশে বসে হৃদির দেয়া চিঠিটা পড়ছে৷

রাতুল,
কহে না কহে কনক তোমাকে আজ রাতুল নামে ডাকলাম৷ নিক নেইমের চেয়ে তোমার আসল নাম- রাতুল আহমেদই আমার কাছে ভাল লাগতো৷ অসম্ভব ভালো৷ রাতুল তোমাকে আমি ভালবাসতাম৷ ঠিক এরকম গতিতে ইতমামকেও এক সময় ভালবেসেছিলাম৷ ইতমাম আমাকে ঠকালো৷ ভালোবাসাকে কলংকিত করল৷ যে ঠকানোটা বেঁচে থাকতে পোষাবে না৷ তোমার কাছে ঠকে জিততে চেয়েছিলাম৷ কিন্তুু পারিনি৷ তুমি ঠকালে না৷ রাতুল আমি আমার জীবন, আমার সাধ ইচ্ছে,স্বপ্ন....সব কিছু নিয়ে বিয়ের পরের নির্বাসিত জীবনটা একটা কোষের ভিতর নিয়ে শক্ত সিষ্ট অবস্থায় ছিলাম৷ যা রাতুল তোমাকেই আমি প্রথম বলেছিলাম৷ তোমার সাথে পরিচয় হলো- অচেনা মানুষকে নতুন করে চিনতে শুরু করলাম৷ আমার সিষ্টের চারিদিকের শেলটা ভাংগতে শুরু করেছিল৷ কেন তা হলো জানি না! কিন্তু হলো৷ মন নতুন করে উড়তে চেয়েছিল৷ একি জীবনের বৈশিষ্ট না? অনেক জীবনের বৈশিষ্ট্য বিকশিত হয় না৷
অন্য প্রসংগে আসছি- আম্মা জানেন, অমা-রাশু জানে এবং তুমিও জান আমি ব্যাংকক থেকে যাচ্ছি৷ আসলে তা না৷ ইতমামের সাথে রাশুর দেখা করিয়ে দিয়েই আমি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে শেফিল্ডে আব্বা-আম্মার কাছে চলে যাব- যা করতে আমার সবসময়ই অপছন্দের ছিল৷ ইতমামের সাথে আমার সম্পর্কেও ইতি ঘটে গেছে৷ সেটা আমি-ই করেছি৷ একটা খবর- ইতমামের বিদেশী বউয়ের আরো একটা ছেলে সন্তান হয়েছে৷ এজন্য আমি তাকে শেষবারের মত অভিনন্দন জানিয়েছি৷ আমি তাঁকে অভিনয়মুক্ত সংযত মন নিয়ে চলতে বলেছি৷ যাত্রাবাড়ী বাসায় থেকো৷ থাকবে তো? টেলিফোনে কথা বলব৷ আমার ভালো লাগবে৷ জীবনে আর যদি কোনদিন কথা না হয়? দেখা না হয়?
ইতি
হৃদি

কনক চিঠিটা পড়ে হাতেই শক্ত করে ধরে রাখলো৷
চিঠি না, লেখিকার হাত তার মুঠিতে শক্ত করে আটকে আছে৷ কনক চোখ বন্ধ করল৷ ঈশ্বর এমন চিঠি কেন আসে?
চোখ খোলে কনক পিছনে অমাকে দেখলো৷ অমা অপলক বাইরেই তাকিয়ে আছে৷
'কি অমা মন খারাপ?
অমাও কনকের দিকে তাকাল৷
'হঁ্যা ভাইয়া খুব খারাপ লাগছে৷
অমা শুন্য দৃষ্টিতে আবার বাইরে তাকিয়ে রইল৷

কায়েস গলির মাথায় কনক অমাকে নামিয়ে দিল৷

কেবল সন্ধের অন্ধকার৷ গলির পথটায় কোন মানুষ চোখে পড়ল না৷
'অমা কি ব্যাপার মানুষজন দেখছি না যে? দোকানপাট সব বন্ধ! ভিডিওর দোকানটাও বন্ধ দেখছি৷
'হঁ্যা ভাইয়া, তাইতো!
'যাক্ অমা, একটা ব্যাপার আমার খুব ভাল লাগছে৷ এই ভেবে যে, রাশুর সবকিছু অবশেষে ঠিকঠাক মত শেষ হলো৷
'ভাইয়া, ও সব সময় আপনার কথা বলতো৷ আপনি না থাকলে বিয়েটা ভালোভাবে শেষ হতে খুব কষ্ট হতো!

কনক আর অমা কথা বলতে বলতে গলির অর্ধেক রাস্তা চলে এসেছে৷

ভুত দেখার মতো গলির পাশ থেকে চারজন লোক বেরুলো৷ অন্ধকারে বুঝা যাচ্ছে না লোকগুলি উলঙ্গ কিনা খালি গায়ে আছে৷ যত কাছে আসছে ততো বুঝা যাচ্ছে লোকগুলি উলঙ্গ না৷ টাইটফিট কালো পোশাক তাদের গায়ে৷ লেবাননের দ্রুজ মিলিশিয়ারা এই ধরনের পোশাক পড়ে থাকতো৷ এম্বুশ অপারেশনে এ পোশাকগুলোর ইম্প্যাক্ট ভালো৷ ঢাকা শহর আধুনিক হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে এর মানুষগুলোও বিচিত্র হয়ে উঠছে৷ না হলে পুরুষদের কানে দুল, ভ্রুতে রিং দেখা যাওয়ার কথা না৷
ওগুলোর দিকে না তাকানোই ভালো৷
কনক অমা যে যার নিজের পথ দেখছে বাসার দিকে৷ কাছে আসতেই লোকগুলোর একজন আচমকা একটা ঝটকা টান দিয়ে অমার হাত ধরলো৷ তাদের চোখ রৌশনারা বেগমের আংটিটি৷ হঠাত্‍ করে ডেজার্ট স্টর্ম - বালির ঝড়৷ লোকগুলোর এম্বুশ অপারেশনের টারগেট নিরস্ত্র অমা কনক৷
অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য! কনকের মাথায় রক্ত উঠে গেছে৷ ভালুকের আক্রমন থেকে রক্ষা পেতে হলে ভাল্লুকের চেয়ে হিংস্রমূর্তিতে আগ্রাসী হতে হয়৷ বিশ্ববিদ্যালযে পড়ুয়াদের মাঝে একটা হিরোইজম মানসিকতা কাজ করে৷ তারাই শক্তিশালী! বাঘ ভালুক কি?
কনক প্রচন্ড মেজাজ খারাপ করে বলল, 'আপনারা কি করছেন?
তাদের একজন বলল, 'দেরী করলে আংগুলটা কেটে নি৷
মুহুর্তেই ধস্তাধস্তি৷ কনকের দু'হাত দু'জনে ধরে ফেললো৷ মাথার পিছনে একটা কিছু ধরা আছে৷
'মাংগের পুত যা আছে সব দে! টাকা দে! মানি ব্যাগ দে!
'এই মাগী আংটি দে!
'সব নেন৷ আমার আংটি দিব না৷
'আংটি দে! ভ্যানিটি দে! কনককে বলল শালা একটা কথা বলবি ছুরি পুশ করব৷ গুলি করব! গুলি! মুহুর্তেই শেষ হয়ে যাবি৷

ফোর ভার্সাস টু৷ টু এর একজন নারী৷ কে পারে কা'র সাথে? অমার খোপা টেনে ধরে ঘাড় পিছনের দিকে বাঁকা করে ফেলা হয়েছে৷ তার মসৃন মুখ একজন চেপে ধরে আছে৷
'অমা রাশুর বউ৷ অমার মা ইশতান্না বেগম যাঁর চোখের জল নিয়ে কনক গোসল করে অসম্ভব প্রাণশক্তি ফিরে পেতে চেয়েছিল৷ অমা হৃদির প্রাণ৷ তার হাতে হৃদির চিঠি৷ হৃদি তার আরাধ্য ঈশ্বর৷ ঈশ্বরের চিঠিটা একটা ঈশ্বর৷ চিঠিটা একটা জীবন্ত হাত হয়ে তাকে স্পর্শ করে আছে৷ আরো অনেক কিছু মনে হলো৷
কনকের মাথায় টর্নেডো বয়ে গেল৷ বিপথগ্রস্ত কনক দু'জনের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অমাকে আগলে ধরল৷
'এই শালারে শেষ করে দে৷
ক্যাচ্ করে একটা শব্দ হলো৷ ওদের একজনের পুশ করা ছুরি কনকের ঘাড়ে লেগেছে৷ কনক কেঁকিয়ে নেতিয়ে পড়ল৷
বোমার শব্দ হলো৷ ধোঁয়া৷ বোমা৷ ৷ ধোঁয়ার ঝড়৷ সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল৷ কোন পরিসথিতিতে যে কোন মানুষই সাহসী হয়ে উঠে৷ অমার সাহস যতটুকু হলো তাতে সে জ্ঞান হারালো না৷
সে চিত্‍কার দিয়ে উঠলো৷
'কায়েস !! ভাবী ভা--বী--ই--ই--? ভাবী কনক ভাইয়াকে কে যেন মেরে ফেলল!
কায়েস অমার চিত্‍কার বোমার শব্দ শুনতে পেয়ে দেঁৗড়ে এসে দেখল অন্ধকারে অমা কনকের পাশে বসে উপুর হয়ে কাঁদছে৷
'ভাইয়াকে তাড়াতাড়ী গাড়ীতে নি৷ কায়েস, ভাবীকে খবর দে৷ যা! যা!! যা!!!

ইভা বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছেন৷ ইভা এ দৃশ্য দেখে শিউরে উঠলেন৷ অমার শরীরে শক্তি নেই৷
'হায় খোদা! কিসের ভিতর কি হয়ে গেল!!
এ সমস্ত ভয়ংকর পরিসথিতিতেও দু'একজনের মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়৷ ইভা অমাকে বললেন, 'অমা তুমি বাসায় যাও৷
অমা কেঁদে কেঁদে বলল, 'ভাইয়াকে এভাবে রেখে বাসায় যাব?
'হঁ্যা যাবে৷ রাশু ফোন করেছিল৷ আবার করবে৷ ওর ফোন রিসিভ করবে না?
'এখন!
'হঁ্যা৷
'রাশু বাসায় তোমাকে না পেলে খুব কষ্ট পাবে৷ আমেরিকা পর্যন্ত পুরোটা পথ মন খারাপ করে যাবে৷ সে কষ্টের মূল্য কিছু দিয়েই শোধ করা যাবে না৷ তুমি টেলিফোনে দু'মিনিটে কথা শেষ করে হাসপাতালে এসো৷ আমি কনককে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি৷ সব আমি দেখবো৷ তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না৷ বাসায় যাও!

কনকের মাথা কোলে রেখে ইভা কায়েসকে নিয়ে হাসপাতালের ইমর্াজেন্সীর দিকে চলে গেলেন৷
অমা অক্ষত৷ রাশুর পছন্দের শাড়ীটা কনকের রক্তে ভিজে আছে৷ মানুষের এত তাজা রক্ত সে কোনদিন খালি চোখে দেখে নি৷ কনকের ঘাড় থেকে থেকে বের হওয়া ফিনকি রক্ত দেখে অমার মাথায় ঘূণর্ী খেয়েছে৷ তাজা গরম রক্ত৷
অমা বাসায় এসে বসে আছে৷ রাশু ফোন করবে ব্যাংকক থেকে৷

দশ মিনিটের মধ্যে রাশুর ফোন এলো৷ অমা নিজেকে প্রস্তুত করল৷
হৃদি ব্যাংকক থেকে ফোন করেই বলল,
'হ্যালো ও...ও ৷ অমা রাশুকে দিচ্ছি৷ ওর সাথে কথা বল৷ ওর কথা শেষ হলে আমি কথা বলব৷
রাশু জিজ্ঞাস করল, 'অমা কেমন আছ? মনে হচ্ছে অনেকদিন হলো তোমার আমার সাথে দেখা হয় না৷ কথা হয় না৷ এমন মনে হচ্ছে কেন? অমা শুনছো! অমা, আমি বিমানে কেঁদেছি!
অমা আস্তে করে মুখ খুলল৷
'কেন?
'কেন কান্না এলো জানি না৷ অনেক্ষণ কেঁদেছি৷ হৃদিও খুব কেঁদেছে৷ এই অমা, তোমার খারাপ লাগছে? অমা চুপ করে আছ কেন? কথা বলো?

অমার আবার অষ্ফুট গলা৷
'তুমি বলো আমি শুনবো৷
'অমা, কনক কোথায়?
অমার বুকের মধ্যে একটা অগ্নুত্‍পাত হলো৷ ভিতর থেকে দলার মত জিনিস চাপ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ আগ্নেয়গিরির চাপ!
সমস্ত চাপ শক্ত করে ধরে রেখে সে এবার বলল, 'কনক ভাইয়া এয়ারপোর্ট থেকে চলে গেছেন৷
'আরে ষ্টুপিডটাতো থাকার কথা ছিল? যাক্ যে ক'টা দিন দেশে আছো কনককে মাঝে মাঝে ফোন করো৷ ওকে আমি খুব ভালবাসি৷ অমার দু'চোখ থেকে পানির ধারা ঝড়ছে৷
'এই অমা তোমার গলা ওমন লাগছে কেন?
'শাড়ী মাখা রক্তটা কনক ভাইয়ার শরীরের রক্ত৷ মিথ্যে করে বলতে হলো কনক ভাইয়া এয়ারপোর্ট থেকে চলে গেছেন৷
অমার হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে৷
'কনক একা হয়ে গেল৷ ও যেমন আমাকে ছাড়া খুব লোনলী ফিল করে৷ আমিও তেমনি৷
'ইতমাম ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছে?
'এখনও হয় নি৷ ইমিগ্রেশন পাস করি নি৷
'ভাবী কোথায়? ভাবীকে দাও৷
'হৃদির মন খুব বিষন্ন! ঐ যে একটু দূরে হাটছে৷
'ভালো থেকো৷ হনলুলু পৌঁছে ফোন করো৷
'অমা চিঠি দিও৷ তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকবো৷ অমা হৃদির সাথে কথা বল৷

রাশু ওপাশে হৃদিকে কথা বলতে দিল৷

শতশত মাইল দুর থেকে অবিশ্বাস্য ভাবী-ননদ সম্পর্কের এক আবেগ৷ পাশাপাশি শুয়ে কানের কাছে কান রেখে হাসিকান্নার হাজার হাজার কথা হয়েছে৷ হৃদি টেলিফোন ধরার সাথে সাথে অমার কান্নার আবেগ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো৷
দু'জন মানুষ পাশাপাশি বসে কাঁদলেও দু'জনের কাঁন্নার অর্থ এক হয় না৷
হৃদি জিজ্ঞাস করল, 'অমা কাঁদছ কেন? আমরা খুব ভালো আছি৷
অমা জবাব দিল না৷
'এই পাগলী ছয় মাস দেখতে দেখতে চলে যাবে!
'ভাবী বিমানে তুমি কেঁদেছ কেন?
'কে বলেছে আমি কেঁদেছি? রাশু মিথ্যে বলেছে৷
'আমার ভালো লাগছে না৷ পাশে কনক আছে? প্লীজ, কনককে একটু দাও না৷
অমা ফুঁপিয়ে বলল, 'ভাবী, কনক ভাইয়া নেই!
টেলিফোনে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হলো৷
'ভেবেছিলাম থাকবে৷ দেখা হলে আমার কথা বলো৷ আম্মা কোথায়?
'খিলগাঁ আমার শ্বাশুড়ীর সাথে গল্প করছেন৷ রাতে ফিরবেন৷
'অমা তুমি কাঁদছ কেন? কেঁদ না লক্ষী বোন আমার!
অমার মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না৷ সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁধছে৷

টিং করে টেলিফোনে একটা আওয়াজ হলো৷
'অমা কার্ড ফুরিয়ে যাচ্ছে৷ আর কথা বলতে পারব না৷ তোমরা ভাল থেকো৷
অমা কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল, 'আচ্ছা..স্লামুআলাইকুম৷

অমা হৃদি-রাশুর সাথে টেলিফোনে কথা সেরে ছটফট করতে থাকলো৷ কায়েস এসে হাসপাতালে নিয়ে যাবে৷ শাড়ীতে ছোপছোপ রক্ত৷ শাড়ী পাল্টিয়ে অমা সেলওয়ার কামিজ পড়ল৷ বিয়ের আংটিটা লোকগুলো জোর করে নিয়ে গেছে৷ লোকগুলো এত নিষ্ঠুর! অমা ওর মধ্যমায় আংটি বসে যাওয়ার দাগটায় ঠোট ছুঁয়ে কাঁদতে থাকল৷ মধ্যমা শক্ত করে কামড়ে ধরল৷ ঠোট কামড়ে ধরলে কান্নার বেগ কমে৷ কিন্তু অমা কান্না থামাতে পারছে না৷

কনক হুঁশ হারাল৷ হুঁশ হারানোর আগে অমাকে কয়েকটা কথা বলেছিলে৷ কথাগুলো কষে মনে লাগার মত৷
হৃদির চিঠিটা অমার হাতে দিয়ে সে বলেছিল,
'অমা, আমি মারা গেলে আমার লাশটা বাসায় পেঁৗছে দিও৷ আমি এক বড়-আপার মাতৃহারা ছোট ভাই! তাঁর পবিত্র বুকে মুখ রেখে আমি অসংখ্য রাত নির্ভয়ে ঘুমিয়েছি৷ এই বোন'র ঋণ আমি শোধ করে যেতে পারলাম না৷ আমাকে মাফ করে দিতে বলো!
'কত সাধারনভাবে কি করুন কথা! এই মানুষগুলো তাড়াতাড়ি মরতে পারে? না, পারে না!
অমা কাঁদতে থাকল৷

রক্তাক্ত একটা চিঠি খুলে অমা পড়তে থাকলো৷ চিঠি না এটা অন্য কিছু! চিঠিটা পড়ে অমার কান্নার বেগ আর শব্দ বেড়ে গেল৷ জ্বলোচ্ছাসের মত তীব্রতা সে কান্নায়৷ কান্নার শব্দে অমার গলা ভেঙ্গে গেছে৷ সে হৃদিকে হারিয়েছে৷ হৃদি চলে গেছে যাত্রাবাড়ী থেকে৷ এ দেশ থেকে৷ প্রতিষ্ঠিত আত্মিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে পরিবারে কারোর মৃতু্য হওয়া! অমার কাছে হৃদি মারা গেছে৷
অমা দু'হাতের মুঠিতে চুল খামছে ধরে শূণ্যে তাকিয়ে বলল, 'জীবন এমন কেন হয়?
তার চিত্‍কার শুনে ঘরের ছাদ-দেয়াল সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনি পাঠালো৷
'জী-ব-ন এ-ম-ন কে-ন হ-য়?

হঁ্যা অনেক জীবন এমনই হয়৷
কনক নেই৷ ঘাড়ের রক্তনালী কেটে যাওয়াতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সে হাসপাতালেই মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েছিল৷ ফুলতলি প্রজেক্টের পোল্ট্রি ফার্ম কোনদিন চালু হয় নি৷ মন্টু চিল্লা দিয়ে-ই বেড়াচ্ছে৷ এজিএম হান্নানের খোঁজ কারো জানা নেই৷ দীপক দুর্ঘটনায় নিহত পাইলট ভাইয়ের ছেলেমেয়েকে স্কুলে নেয়া-আনার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে আর পিংপং বল পিটাচ্ছে৷ মালেক আগের মতই আছে৷ কোন কিছুই তার ভালো লাগে না৷ ডট চেীধুরী সাংবাদিকতা করছে৷
লক্ষ যুবকের কয়টা স্বপ্ন দিক খুঁজে পায়? তারপরও সব স্বপ্নইতো দিকহীন নয়! দিঙমূঢ় নয়!
রাশু আমোরিকার নাম করা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে৷


মন্তব্য

ফ্রুলিক্স.. এর ছবি

ইন্নালিল্লাহ................এতো লম্বা। ট্রেন তো চলে গেলো
আগামীতে কাজ ফাকি দিয়ে পড়তে হবে।

এবিডিভিলিয়ার্স এর ছবি

এটাতো ব্লগে না লিখে একটা উপন্যাস হিসেবেও ছাপানো যেতো। হিসেব করে দেখেছি, ওয়ার্ড ডকুমেন্ট হিসেবে ফন্ট সাইজ ১২ রেখে এই পোস্টের দৈর্ঘ্য হয় ২২৪ পৃষ্ঠা

নিবিড় এর ছবি

১২ ফন্টে ২২৪ পৃষ্ঠা অ্যাঁ

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

এটা কি উপন্যাস? প্রথম দিকে ইতমাম নামক লোকটার অতিরিক্ত লুলামি সহ্য করতে পারিনি বলে পড়তে পারিনি বেশিদূর। বলতে পারেন ওই লোকের আচরণে বিরক্ত হয়ে তাকে ত্যাগ করলাম!

আমার ধারণা এটা সচলায়তনের সর্বকালের সবচেয়ে লম্বা লেখা! হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ভেঙ্গে ভেঙ্গে দিতেন!

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

অনেক লম্বা, পুরো পড়ার সময় করতে পারলাম না। পরে পড়তে হবে। তবে কয়েকটা পার্টে দিলে ভালো হতো।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

অনুপম ত্রিবেদি এর ছবি

অ্যাঁ ইন্নালিল্লাহ ... এটার কয়েকটা পর্ব করে দিলেই তো পারতেন।

==========================================================
ফ্লিকারফেসবুক500 PX

নিবিড় এর ছবি
অতিথি ১ এর ছবি

ইতমাম এর লুলামি একটু কম করে দিলেই মনে হয় ভালো হত। ওনার ছোক ছোক করা স্বভাব দেখে পড়ার আগ্রহ চলে গিয়েছে। অবশ্য, এটা আমার ব্যক্তিগত মত।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

দিঙ মূঢ় মানে কী?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মহা. জাতক এর ছবি

সচলে প্রথম উপন্যাস! আমি লেখা মোটামুটি ধৈর্য নিয়ে পড়ার চেষ্টা করি, কিন্তু, এটা আমায় ফেল করিয়ে দিয়েছে।

তুলিরেখা এর ছবি

কাহিনি পড়লাম মাঝে মাঝে স্কিপ করে করে। কে লিখলেন কেন লিখলেন সচলে এটা তার প্রথম প্রচেষ্টা কিনা কিছুই তো জানা গেল না! লেখক কে ?

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

এম তানজিরুল আজিম এর ছবি

স্ক্রলবার এর দৈর্ঘ্য দেখে পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। কিন্তু লেখক কে?

একজন পাঠক এর ছবি

সিরাম।

রণদীপম বসু এর ছবি

আমি শেষ !!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

গৌতম এর ছবি

মন্তব্য করে পেজটাকে আরেকটু লম্বা করে দিলাম।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

এত্ত বড় ক্যান? রেগে টং

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।