সালেক খোকন
দিনাজপুরের একপ্রান্তে এক চৌরাস্তার মোড়। সবার কাছে এটি চিরিরবন্দর মোড়। মোড় থেকে সোজা পূর্বদিকে চলে গেছে পিচঢালা একটি রাস্তা। দুপাশে প্রহরী বেশে দাড়িয়ে বড় বড় সব গাছ। গাছগুলোর অবয়বই বলে দেয় এরা শতবর্ষি।
এই রাস্তাটি ঠেকেছে চিরিরবন্দর উপজেলাতে। সুখ সাগরকে পেছনে ফেলতেই মিলে গর্বেশ্বরী নদীর বেইলিব্রীজটি। তারও পরে ছোট্ট আত্রাই নদী। দুই উপজেলারই সীমানা এই নদীটি। এপাশে দিনাজপুর সদর। আর অন্যপাশে চিরিরবন্দর উপজেলা। নদীর উপর লম্বা একটি ব্রিজ। সবার কাছে এটি বেকিব্রিজ। এক সময়ে এখানকার ব্রিজটি ছিল বেশ বাঁকা। বাঁকা ব্রিজের কারণে জায়গাটিরও নাম হয়ে যায় বেকিব্রিজ।
আত্রাই নদীর উপর সেই বাঁকা ব্রিজটি এখন আর নেই। বাঁকা ব্রিজের জায়গায় বসেছে আধুনিক গড়নের লম্বা ব্রিজ। কিন্ত তাতেও নাম বদলায় নি জায়গাটির। ঠিক এরকমভাবে দিনাজপুরের অনেক জায়গার নামের মধ্যেই রয়েছে ঐতিহাসিকতার ছোয়া।
চিরিরবন্দরের ভিয়াইল ইউনিয়নের তিনটি গ্রাম তালপুকুর, বাজিতপুর ও নানিয়াটিকর। ১৯৪৬ সালের ৪ জানুয়ারিতে ব্রিটিশ পুলিশ ও জোতদারদের লাঠিয়ালদের সাথে তেভাগার সৈনিকদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় এই গ্রামগুলোতে। সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হয় তালপুকুর-বাজিতপুর গ্রামের শিবরাম মাঝি ও সমিরউদ্দিন নামের দুই বর্গাচাষি। এটি ছিল এ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের প্রথম গুলিবর্ষনের ঘটনা।
দিনবন্ধু রায় এক তেভাগা সৈনিক । তার সম্মুখেই ঘটেছিল গুলিবর্ষনের ঘটনাটি। তিনি এখনো বেঁচে আছেন নানিয়াটিকর গ্রামে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত (প্রথম আলো: ০৬ জানুয়ারি ২০১০) এমনই একটি খবরের দিকে চোখ পড়ে আমাদের। আমরা আর দেরি করি না। স্থানীয় যুবক পুলককে নিয়ে রওনা হই নানিয়াটিকর গ্রামের দিকে।
বেকিব্রিজের পাশ দিয়ে আত্রাই নদীর কোল ঘেষে চলে গেছে একটি মেঠো পথ। পুলকের মটরসাইকেলটি এগোতে থাকে সেদিক দিয়ে। কাউগা স্টেশন পার হয়ে ধানক্ষেতের আইল ধরে আমরা নানিয়াটিকর গ্রামের পথ ধরি। দুপাশে দৃষ্টির সীমানায় শুধুই ধানক্ষেতের সবুজ প্রান্তর। পুলক জানালো এক সময় এখানে জনবসতি ছিল অতি সামান্য। সবুজের ভেতর দিয়ে দোল খেতে খেতে আমরা এগোই। যেতে যেতে মনে করার চেষ্টা করি তেভাগার ইতিহাস নিয়ে মেহরাব আলীর লিখাগুলো।
অবিভক্ত দিনাজপুর ছিল তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। তেভাগা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী থানার লালবাড়ী গ্রামে। সেটি ১৯৩৮ সালে। সে সময়ে অধিকাংশ জমির মালিক ছিল জোতদার ও জমিদাররা। ৭০ ভাগ লোকই ছিল ভূমিহীন গরিব কৃষক। তারা আধিয়ার খাটতো জোতদারদের জমিতে।
ভূমিহীন এই কৃষকেরা চাষের সমস্ত খরচ বহন করে ফসলের আধা ভাগও পেত না। তাছাড়া জোতদাররা জোরপূর্বক নানা খরচ কেটে রাখতো কৃষকদের ভাগ থেকে। যে স্থানে ফসল মজুদ ও মাড়াই করা হতো তার ভাড়া বা খোলানী খরচ ছাড়াও আধিয়ারকে ডাকাডাকি করায় নিযুক্ত লোকের বেতন বা বরকন্দাজি, খোলান পরিষ্কার রাখার জন্য লোকের মজুরী বা ঝড়দারী, ফসল পাহারা দেয়ার জন্য নিযুক্ত লোকের বেতন বা পাহারবাদীর, ফসল ওজন করার জন্য নিযুক্ত লোকের বেতন বা ওজনী এবং জোতদারদের সেলামীসহ সমস্ত কিছু আদায় করা হতো আধিয়ারের ফসলের অংশ থেকে। ফলে ফসল ওঠার পর জোতদারের পাওনা মিটিয়ে কৃষকদের সংসার চালানোর মতো কিছুই থাকতো না।
জমি যদিও জোতদারের কিন্ত লাঙ্গল, গরু, চাষ, নিড়ান ও পরিশ্রম সবই ছিল আধিয়ারের। তাই তাঁদের ন্যার্য দাবী ছিল ফসলের তিনভাগের দুভাগ হবে তাদের, একভাগ হবে জোতদারদের।
নানিয়াটিকর গ্রামে ঢুকতেই এক যুবক দেখিয়ে দেয় তেভাগার বীর দিনবন্ধুর বাড়িটি। বাড়ির ভেতরে দেখা মিলে তাঁর। বয়স ৮৫ বছর। কিন্ত শারীরিক গড়ন এখনো বেশ সুঠাম। একধরণের বিপ্লবী ছাপ চোখেমুখে। বাড়ির উঠানে বসে স্মৃতির রাজ্য থেকে দিনবন্ধু তুলে আনেন তেভাগার সময়ের নানা কথা।
নানিয়াটিকর গ্রামের ঘন্টেশ্বর রায় ও বুধু মনির তৃতীয় সন্তান দিনবন্ধু রায়। তেভাগা আন্দোলনের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর। বাবা ছিলেন গরীব কৃষক। আধিয়ার খাটতেন অন্যের জমিতে। সে সময়ে দিনাজপুরের কৃষক সমিতির নেতা ছিলেন গুরুদাস তালুকদার। তার হাত ধরেই দিনবন্ধুর কাকা বেনি মাধব তেভাগা আন্দোলনে সক্রিয় হন। কাকার সাথেই দিনবন্ধু ঘুরে বেড়াতেন গ্রামে গ্রামে। দিনবন্ধুর ভাষায়,‘আমরা তখন লাল জান্টিটা কাধে নিয়ে বেড়াই’। দিনবন্ধুর সাথে ছিলেন মধু কমরেড, পমেশ্বর, খোকাসহ আরো অনেকে। সভা হলে কৃষকদের সাথে কথা বলতে দিনাজপুর থেকে আসতেন সুধির সমাজপতি। তার প্রাণময় বক্তব্যে জোটবদ্ধ হতো এ অঞ্চলের কৃষকসমাজ।
সে সময়কার স্লোগানগুলো জানতে চাইলে দিনবন্ধু উচ্চ কন্ঠে বলতে থাকেন;
‘আধি নাই তেভাগ চাই’, ‘পুলিশ জুলুম বন্ধ কর, নিজ খোলানে ধান তোলো’, ‘বেআইনি আদায় বন্ধ কর’, ‘লাল জান্টি কি জয়’, ‘কৃষক সমিতি কি জয়’ প্রভৃতি।
পুলিশের সাথে সংঘর্ষের সেদিনটির কথা জানতে চাইলে দিনবন্ধু খানিকটা চুপ হয়ে যান। তার চোখের কোণে জমে ওঠে দু’এক ফোটা জল। থেমে থেমে তিনি বলতে থাকেন সে দিনের ঘটনাটি।
স্থানীয় জোতদার ছিল মহেন্দ্রলাল চৌধুরী, মতি লাল রায় চৌধুরী, যোগেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী, রাজেন্দ্র নাথ চৌধুরী ও দেবেন্দ্র নাথ চৌধুরী। সে সময় তেভাগার আন্দোলনকারী কৃষকরা আমন ধান কেটে জোতদারের খোলানে না তুলে নিজের খোলানে তোলেন। এতে ক্ষেপে যান তালপুকুর গ্রামের জোতদার যোগেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী, রাজেন্দ্র নাথ চৌধুরী ও দেবেন্দ্র নাথ চৌধুরী। তারা মামলা করেন তালপুকুর দক্ষিণপাড়ার কংস, শশি, খগিন, চেল্লাসহ বহু প্রান্তিক কৃষকের বিরুদ্ধে।
তেভাগার আন্দোলনকারী কৃষকদের আগেই সিদ্ধান্ত ছিল কোথাও কোন বিপদ হলে নাগড়া বাজাতে হবে। নাগড়ার শব্দ শুনে শুনে সবাই চারদিক থেকে চলে আসবে। জানুয়ারির ৩ তারিখ মধ্যরাত। তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে একদল পুলিশ। বিপদ দেখে নাগড়া বাজাতে থাকে কৃষকেরা। দিনবন্ধুসহ তেভাগার প্রায় ৪০০ কৃষক লাঠি আর তীর ধনুক নিয়ে ঘিরে ফেলে পুলিশদের। বাজিতপুর বেরুয়াতলী আসতেই পুলিশের সাথে তেভাগার সৈনিকদের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশও এলোপাতারী গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সাঁওতাল কৃষক শিবরাম ও সমিরউদ্দিন। শিবরাম সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। একদিন পরে মৃত্যুবরণ করে সমিরউদ্দিন। এটি ছিল বাংলার তেভাগা সংগ্রামের প্রথম গুলিবর্ষন ও শহীদ হওয়ার ঘটনা।
দিনবন্ধু খানিকটা চুপ হয়ে যান। তারপর আবার বলতে থাকেন। তেভাগার সৈনিকদের আত্মহুতির কথা কেউ মনে রাখেনি। তবু তিনি হতাশ নন। তিনি আশা করেন সবকিছুকে বদলে দিবে নতুন প্রজম্ম।
দিনবন্ধু জানালেন বছর কয়েক আগে স্থানীয় যুবকদের উদ্যোগে এক এনজিওর সহযোগিতায় শহীদ শিবরাম ও সমিরউদ্দিনের স্মরণে তালপুকুরে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়া প্রতি বছর ৪ জানুয়ারিতে এখানে পালন করা হয় তেভাগা দিবস। শোভাযাত্রা বের করাসহ স্মৃতি সৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় স্থানীয়রা।
দিনবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ঘুরে দেখি বাজিতপুরে গুলি বর্ষণের স্থানটি। নির্ধারিত স্থানটিতে জায়গা না পাওয়ায় স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে তালপুকুরে।
তেভাগার সৈনিক দিনবন্ধুর সাথে কথা হয় বর্তমান বাংলাদেশ ও রাজনীতি নিয়ে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন এক সময় আমরা ভালো মানুষদের পরামর্শে চলতাম। এখন সবাই নিজেকে ভালো মানুষ মনে করে। দিনবন্ধু মনে করেন বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এদেশের কৃষকরা তেভাগা আন্দোলন করলেও স্বাধীন দেশে এখনও ধনী-গরিবের ব্যবধান বিস্তর। বর্তমান রাজনীতি নিয়ে দিনবন্ধু বলেন, ‘এখনকার রাজনীতি হলো স্বনির্ভর হওয়ার রাজনীতি। কিভাবে নিজের উন্নয়ন হবে সেদিকেই যেন ঝোক সবার’। তিনি বলেন তেভাগার সময় নাগড়া বাজালেই সবাই চলে আসতো। এখন মানুষের বিপদে ডাকলেও মানুষকে পাওয়া যায় না। এখন কারো সাথে কারো মেলামেশা নেই। ও বড়লোক হবে, আমি হবো না। এ নিয়েই চলে হিংসা,বিদ্বেষ। অন্যকে দেখে নিজের সুখ খোঁজার প্রবণতা আমাদের শেষ করে দিচ্ছে।
দিনবন্ধুর কথাগুলো আমরা তন্ময় হয়ে শুনি। বর্তমান প্রজম্মকে নিয়ে বুকভরা আশা এই বীরের। তিনি মনে করেন যারা বিবেকী, অন্যকে সম্মান দেন তারাই প্রকৃত সম্মানিত ব্যক্তি। তার মতে দেশের স্বার্থে দশের স্বার্থে সকলকে এক থাকতে হবে। স্বনির্ভর হওয়ার রাজনীতি মাথা থেকে বাদ দিতে হবে।
ছেলে নীরাঞ্জনের সংসারে থাকেন দিনবন্ধু রায়। নিজের বষষ্কভাতা আর ছেলের টিউসনির টাকায় চলছে সংসারটি। তবু কোন চাওয়া পাওয়া নাই তাঁর। শুধু চান এ দেশটাকে অন্যরকম দেখে যেতে। যে দেশে ধনী গরীবের ব্যবধান থাকবে না, একজন পাশে থাকবে আরেকজনের, স্বনির্ভর রাজনীতি নয় বরং রাজনীতি হবে দেশের জন্য সেই সুখী দেশের স্বপ্ন দেখেন তেভাগার বীর দিনবন্ধু রায়।
তালপুকুরের স্মৃতিসৌধ থেকে আমরা বিদায় নেই দিনবন্ধুর কাছ থেকে। ফেরার পথে চোখের সামনে বার বার ভেসে ওঠে দিনবন্ধুর মুখখানি। কানে বাজে তেভাগার গান ‘হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও সান হো, জান কবুল আর মান কবুল, আর দেবনা আর দেবনা, রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো’। মনে মনে বারকয়েক বলি দিনবন্ধু তোমাকে লাল সালাম।
সালেক খোকন ছবি : লেখক
মন্তব্য
চমৎকার তথ্যবহুল লেখা। আমি দিনাজপুরের ছেলে হয়েও এই ইতিহাস জানতাম না। আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ এই লেখার জন্য।
আজব পোলা
লিখাটি পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
তেভাগা আন্দোলনের জীবিত মানুষ বোধহয় খুব বেশী নেই। আপনার সৌভাগ্য একজনকে পেয়ে গেছেন। দিনবন্ধুর স্বপ্ন আলো দেখুক!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আপনাকে ধন্যবাদ।
ছবি দেখা যাচ্ছে না...
উনার বয়স এখন কতো?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
তথ্যবহুল লেখা।
দিনবন্ধু রায়ের জন্যে আমার সেলাম। সাথে সাথে স্মরণ করি তেভাগা আন্দোলনের শহীদদের।
ধন্যবাদ সালেক খোকন আপনাকে এই অজানা কথাগুলো তুলে আনার জন্যে।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
লেখা ভালো লাগলো।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
নতুন মন্তব্য করুন