এ ধরণের ভিলেনোচিত হাসি তারেক ভাই হাসবেন, এ আর নতুন কি? আদিল ভাই জানিয়েছেন, তারেক ভাই নাকি- বালী কী সুমাত্রা দ্বীপের এক নবোঢ়া ত্রিশোর্ধ্বার সাথে আন্তর্জালিক প্রেম ফেঁদে বসেছেন। মহিলা হয়তো কথার প্যাঁচেগোঁচে বালী দ্বীপের বালি নয়তো সুমাত্রীয় ওরাংওটাঙের কস্তুরী ছুঁড়ে মারেন, সেটার খোঁচা খেয়ে তারেক ভাই হাসেন। প্রতিদায়ী তারেক ভাইও কালেভদ্রে- মেজবানের গরুর-গোশত, ঠোঙাভর্তি গণিবেকারীর বেলাবিস্কুট আর তিব্বতের কদুর তৈল- ডাকযোগে ইন্দোনেশিয়ায় পাঠিয়ে থাকেন। কিন্তু ইদানিং তারেক ভাইয়ের বিকট হাসির স্বরগ্রাম দেখি উঁচুই হচ্ছে। চোথার লাইন ধরে কিছুদূর এগুলাম মাত্র, শুনি দড়াম করে একটা শব্দ হল। বুঝতে পারি, তারেক ভাই অত্যুত্তেজনায় কম্পিউটারের টেবিলে পাশবিক আঘাত হানলেন। কণ্ঠের শব্দোচ্চতাও যেন দ্বিগুনিতক হল “হাহাহাহা, ছিক…লোকটা পুরাই ছিক….হাহাহাহাহহা”
আমি এবার মিনমিনিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তারেক ভাই, কে ছিক? কারো জ্বর-টর হইল নাকি?”
“আরে তুই চুপ থাক ব্যাটা দুই-কান-লম্বা, এইসব বুজবিনা তুই” অবজ্ঞাভরে জবাব দিলেন তিনি।
তারেক ভাইকে প্রায়ই দেখি, কম্পিউটারে, একটা সাইটে ঢুকে কী সব লিখে চলেছেন। আমি ধরে নিলাম নিশ্চই পড়াশুনার বিষয়বস্তু, অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্ট করছেন হয়তো। খটকা ছিল এক জায়গায়, তিনি ওগুলো বাংলায় লিখছেন। কম্প্যুকৌশলের অনলাইনগুলো বাংলায় কেন হতে যাবে আবার? একদিন আগ্রহ নিয়ে তারেক ভাইয়ের পেছনে এসে দাঁড়ালাম। শুনি, তারেক ভাই স্বগতোক্তি করছেন, “শালার…..এই ব্যাটায় পুরা একটা…. রাআআজাকার”
প্রথমে ভড়কে গেলাম, ভাবলাম আমাকেই রাজাকার বলল নাকি। ওনার ধূলোপড়া সাদা মনিটরের স্ক্রীনে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, এক ভদ্রলোকের ছবি। লোকটার চশমা দেখা যায়, কিন্তু মুখ ভালোভাবে দেখা যায়না। সে তীর্যক দিকস্থিতি নিয়ে উপরের দিকে যেন তাকিয়ে আছে। ক্যামেরার ফ্রেম গলে যতটুকু মুখাবয়ব চলে এসেছে, তাতে মনে হচ্ছে এই ব্যক্তি নিরতিশয় জ্ঞানী। আগ্রহ ভরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ইনি কে? নিশ্চই আপনাদের ডিপার্টমেন্টের সায়খোবাদ স্যার।”
“হাহাহা…কোত্থেকে এসে আউলফাউল কী যে বলস”, তারেক ভাই যেন আমাকে আবারো উপহাস করলেন। “এইটা হল ‘ত্রিশূল’…সেইইরকম রাজাকার।”
আমি ঢোঁক গিললাম। ভার্চুয়াল জগতের ভুষ্টিনাশ করতে এ কোন ভোলানাথ ত্রিশূল হাতে নেমে এলেন! “এই ব্যাডায় কী গেলমান আজমের নাতি?”, শুধালাম আমি।
“হইতারে। না হইলে গেলমান আজমের গেলমান ছাগলও হইতে পারে। গুয়াজমরা নাকি সবাই জুওফিলিক আছিলো…হাহাহহা”
তারেক ভাইয়ের মিষ্টিমধুর ব্লগবাজি আমাকে কিঞ্চিত আকৃষ্ট করে। আমিও দেখতে পেলাম, তার লেখনীর একজন সোৎসাহী দর্শক এবং কদাচিৎ পাঠক- এই আমাকে পেয়ে তিনিও লেখনকার্যে খুবই ভালভাবে মনোনিবেশ করলেন। একটা গদ্য লেখেন, নইলে পদ্য লেখেন, মাঝেমধ্যে আমাকে বলেন পড়ে দেখতে, কেমন হয়েছে। কবিতার ‘ক’ এর ব্যাপারে আমি নিতান্তই ‘ক’ অক্ষর গোমাংস। সেই প্রথমদিন থেকেই আমি তারেক ভাই’র কোন কবিতার একটা লাইনও বুঝিনি। তারেক ভাই জানালা ছাপিয়ে আসা বৃষ্টির পানি খান, রোমান্টিক কবিতা লেখেন; কমলাপুরের আধন্যাংটো টোকাই কিম্বা হলেরই হাড়হাভাতে ক্যান্টিনবয়ের তসবির খিঁচেন, সাম্যবাদী কবিতা লেখেন; ওনার আধোয়া লুঙ্গির ভাঁজে, তোষকের কোণায়, ঘুপটি মেরে থাকা পিশাচিনী ছারপোকাদের ভীমসেনী কামড় খান, লেখেন বিদ্রোহী সব পংক্তিমালা; আমার কোন জানারই পছন্দ হয়না। তারেক ভাইয়ের দামীমত একটা নকিয়া এক্সপ্রেস-মিউজিক ফোনসেট ছিল। একদিন সেটা বাগাই। ব্যাচমেট আনজির তার বন্ধু বেনজিরের বগলে মুখ গুঁজে হাঁপরের মত নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিল, মোবাইলে ধরে নেই সেই ছবি। তারেক ভাইকে সেটা দেখিয়ে বললাম, “এবার লেখেন একখান নার্মালেন্ডো গুনিনহো’র মত কোবতে।” তারেক ভাই ছবিটার দিকে শেলসম দৃষ্টি হানলেন। শীতল কন্ঠে বললেন, “ল্যাটিন ভাষা জানিনা। আর শুন, আমার মোবাইলে কোনদিন এইসব বদমাশী ছবি তুলবিনা, খবর আছে কিন্তু।” কবিমনের ক্রোধাগ্নির আঁচ আমি সেদিনই একমাত্র পেয়েছিলাম।
এমনই কোন একদিন তারেক ভাই ডাকলেন, “ওই…একটা লেখা লেখছি, দেখতো কেমন হইছে”
আমি স্ক্রীনের সামনে এসে বসি, লুঙ্গিতে ডাঁটসে একটা রামগিঁঠ কষি। তাকিয়ে দেখি, বোধ’য় নতুন একটা ব্লগসাইট, নাম ‘সচলায়তন’। কবিতার প্রথম দু লাইন পড়ে আমার আক্কেলে গুড়ুম গুড়ুম তোপ দাগে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়ছি নাকি বৈদিক ধর্মাচরণ পড়ছি ঠাওর করতে পারি না। তবুও আমি প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকি সেই কবিতার মর্মোদ্ধারের। কাব্যঝঞ্ঝার তোড়ে কোমরে আলগা হতে থাকা লুঙ্গির বাঁধন একটানে খুলে ফেলি, তারপর ওতে ততোধিক শক্ত একটা মালকোচা দিয়ে জেঁকে বসি। প্রতি ছত্র ধরে ধরে এগুতে থাকি, প্রতি শব্দে শব্দে লুক্কায়িত ব্যাঞ্জনাময় গূঢ়ার্থ ব্যবচ্ছেদে বেশখ ব্যতিব্যাস্ত হই। বর্ণে বর্ণে বর্ণিত দুর্বোধ্য বর্ণনা আমার গেঁয়ো মনকে রীতিমত ধর্ষণ করে ছাড়ে। তবু আমি হারকিউলীয় কোশেশ করে যাই, অর্থ আমাকে বার করতেই হবে। নইলে হয়তো পেতে হবে তারেক ভাইয়ের অন্তর্ভেদী সেই বিষদৃষ্টি, যার অর্থ, ‘গ্রাম থেকে ভেড়া চরিয়ে এসেছিস, কবিতার কি বুঝবি!’
কিছুক্ষণ পর তারেক ভাই আপনা থেকেই জিজ্ঞেস করেন, “কীরে, কবিতা পড়তে এতক্ষণ লাগে নাকি, বাড়ি মারি মাথা…ফ্ফাটাই ফেলব একদম”
“হ্যাঁ হ্যাঁ…আর একটু…দাঁড়ান”, বললাম আমি। “হ্যা..পড়া শেষ”
“কেইরম হইসে?”
এ পর্যায়ে আমি মাথা চুলকালাম, কীভাবে মূল্যায়ন করব বুঝতে পারছিনা। “আরে ফাট্টাফাটি হইসে, একদম রবীন্দ্রনাথের মত।”
তারেক ভাইয়ের গোঁফ ফুঁড়ে মৃদু স্মিতরশ্মি বিচ্ছুরিত হল। “রবীন্দ্রনাথের মত….হাহাহাহহাহাহা। তো, রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতার মত?”, আমোদের সুরে বললেন তিনি।
আমি আবারো মাথা চুলকাই। পাঠ্যবইয়ে চয়িত কবিগুরুর দুএকটা গল্প-কবিতা ছাড়া তো আমি শব্দ তিলেকও পড়িনি। হঠাৎ আল্লার অশেষ রহমতে মাথা খেলে গেল। চটপটে জবাব দিলাম, “ওই, একটা কবিতা আছেনা, একটা বাচ্চাপোলা শামছুকোপানি কোপাইয়া কতগুলান ডাকাইতের কল্লা ফেলাইয়া দেয়…ওইটার মত।”
তারেক ভাই তড়াক করে মনিটরের সামনে ঝুঁকে পড়েন। মুখের হাসিও বেমালুম উধাও। কীবোর্ড-মাউস হাতড়ে, এক দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে কবিতা পুনঃনিরীক্ষণ করতে লেগে পড়েন তিনি। আমি ফ্যাকড়াটা বুঝতে পারি। লুঙ্গির গোঁচ ঝেড়ে ফেলে মানে মানে কেটে পড়ি। একটা শিশুতোষ কবিতার সাথে তুলনা করাতে হয়তো তারেক ভাই পেরেশানীতে পড়েছেন। নিশ্চই সচলায়তনের সব পাঠক অ্যাডাল্ট কবিতা পড়ে।
এরপর তারেক ভাই যতবারই ডেস্ক ছেড়ে উঠে চা-বিড়ি খেতে গিয়েছেন, জিয়েফের সাথে মুঠোফোনে ফাইট দিতে গিয়েছেন, আমি লুকিয়ে সচলায়তনে ঢুকেছি, অ্যাডাল্ট কবিতা পড়ার মানসে। আমি যে সবসময় হতাশ হয়েছি, তা বলিনে- তবে সেখান থেকেই আমার সচলাভিযান শুরু। ঘেঁটেঘুঁটে দেখার পর, অনেক সচলের অনেক লেখাই আমার মনে ধরে যায়। এরপর প্রায় নিয়মিতই আমি সচলের নীরব একজন পাঠক। একজন সুবোধ নীরব পাঠক হয়েই থাকব আশা করি।
ধৈবত
মন্তব্য
ধৈবত
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
প্রায় দুই বছর দুইজনের লগে একরুমে থাকিলেও কিছুই টের পাইলামনা। গুরুদের থেকে কোনো দৈবজ্ঞানও লাভ করিতে পারিলামনা। মোর চাহিতেও এই জগতসংসারে অভাগা আর কেহ কি আছে?
-অতীত
যিনি ইতোমধ্যেই সর্ববিষয়ে মোক্ষলাভ করিয়াছেন তাহাকে আবার পালিয়া পুষিয়া সবকিছু শিখাইয়া দিবার জরুরত আছে কী? তাই, অবশিষ্ট আমাকেই কবিসাহেব শিষ্য বানাইয়া লইয়াছেন।
ধৈবত
গান্ধার ও ধৈবত যদি পাশাপাশি থাকে, হায়, তাইলে কী হয়???
তুলি-ওয়ান, তুলি-কান কে যে কথা বলল!! ধৈবত
জোস হইছে।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
ধন্যাবাদ রাতঃদা
সুন্দর লেখা
আপনাকে দিয়ে হাস্যরসাত্মক লেখা ভালো হবে মনে হয়।
হা হা। ধন্যবাদ PPদা
লেইখা যান......ফানপোষ্টের বড়ই অভাব......আপনি ভাল রম্যকাহিনী লিখতে পারবেন......বাই দা অয়ে,আপ্নি কোন ডিপার্টমেন্ট...
ধন্যবাদ। - মেকা-
ধৈবত
লেখা চরম মজারু হইছে। রিপিটের গল্পে আমার এক ফ্রেন্ডের কাহিনী মনে পড়ে গেলো। মেকানিক্যাল নাকি সিভিল ড্রয়িংয়ের প্রথম ক্লাসে তারটা দেখে স্যার কোনো চিহ্ন না দিয়েই ফেরত দেন; কিন্তু অন্য আরেকজনের ড্রয়িংয়ে R লিখে দেন। সে তখন আর এর মানে জানে না; স্যারকে গিয়ে বলে, "স্যার, ওকে আর দিয়েছেন, আমারটায় দেন নাই।" স্যার ব্যাটাও পাজি, একপলক তাকিয়ে থেকে তাকেও আর দিয়ে দেন। পরে মর্মোদ্ধার হয় আর মানে রিপিট।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
মেকা কোন ব্যাচ?
০৬
বাহ! লিখুন লিখুন, অনেক লিখুন।
............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্ চিনে।
ধন্যবাদ সুরাপু
আপনার রম্য লেখার হাত খুবি ভালা। এই তারেক কি তারেক রহিম?
ধন্যবাদ শুভদা। এইখানে উল্লেখিত 'তারেক' একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র। কবি তাড়েক ড়হিমের সাথে এর সাদৃশ্য কল্পনা সম্পূর্ণ অসঙ্গত।
ধৈবত
রসে টইটুম্বর!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
ধন্যবাদ
ধৈবত
লেখা ভাল হইসে,মজা পেলাম্।
কবি ত্রাকড়হিমকে এভাবে পচানোয় তীব্র আনন্দ প্লাম।
লেখায় প্লাস। আপনার লেখার হাত নিদারুণ!
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
এইখানে উল্লেখিত 'তারেক' একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র। কবি তাড়েক ড়হিমের সাথে এর সাদৃশ্য কল্পনা সম্পূর্ণ অসঙ্গত।
ধৈবত
লেখায়
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
ধন্যবাদ
ধৈবত
ধন্যবাদ নিয়াজ ভাই। 'সেই-রকম' ডায়লগটাও পরিচিত মনে হচ্ছে
ধৈবত
পড়ে সেই-রকম মজা পেলাম।
টুইটার
কবি তাড়েক ড়হিমরে নিয়ে মস্করা করার জন্য লেখককে তীব্র ধিক্কার। তবে লেখা অতিশয় সু"রম্য" হয়েছে।
--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
এইখানে উল্লেখিত 'তারেক' একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র। কবি তাড়েক ড়হিমের সাথে এর সাদৃশ্য কল্পনা সম্পূর্ণ অসঙ্গত। উরপে দেখ, ছদ্মবেশি একজন আমারে 'গান্ধার+ধৈবত' কইতে চায়।
ধৈবত
নতুন মন্তব্য করুন