১.
জহির সাহেব এর মেজেজ খারাপ। তার টেবিলের ওপাশে বসে থাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ির ছোটোখাটো শুকনো গড়নের মানুষটির দিকে তাকিয়ে অনর্থক কয়েকবার গলা খাঁকড়ি দিলেন। তাতেও কোনো কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। মনে মনে বললেন ‘বেকুব কোথাকার’। নিজের উপর ও এখন তার রাগ হচ্ছে। এতদিনেও তিনি ঘুষ খাওয়াটা ভালমত রপ্ত করতে পারেন নাই। অথচ তার টেবিলের উত্তর দিকের টেবিলটায় বসা রহমত সাহেব কি অবলিলায় পান চিঁবুতে চিঁবুতে চোখের পলকে বাম হাতের কাজ সেরে ফেলেন।
শোনা যায় ঢাকাতেই তার দুইটা পাঁকা বাড়ি আছে। তার একটা আবার পাঁচতলা, দশতলা ফাউন্ডেশন। তাকে দেখলে বোঝার উপায় নেই এর মাঝেই ব্যাংক-এ তিনি কত টাকা জমিয়ে ফেলেছেন। ইচ্ছে করে কিছুক্ষন ফাইল ঘাটাঘাটি করতে করতে তিনি আরেকবার লোকটির দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। মনে হচ্ছে আজ তার ভাগ্যটাও খারাপ। তিনি বাজি ধরে বলতে পারেন এই লোকের কাছ থেকে শ’পাঁচেক টাকা বের করতে তার জান বেরিয়ে যাবে। একমাত্র জহির সাহেবই জানেন এই টেবিল পর্যন্ত আসতে তার কাছ থেকে কত টাকা বেরিয়ে গেছে। এদিকে তার ছেলেটিও বড় হচ্ছে। তার বউ এর কথা মনে হতেই মনটা বিষিঁয়ে গেলো। এমনিতে তার বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখী পরিবার। কিন্তু মাঝে মাঝে তার বউ এর কিছু আবদার আর ছেলের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। তারপরও তিনি হাসিমুখে সব মেনে নিয়েছেন। কিন্তু বিনিময়ে এই অপকর্মটি তাকে করতেই হয়। হ্যা, এটাকে তিনি অপকর্মই ভাবেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তিনি পরেন। নামাজ না পরলে তার বুক ধরফর করে। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে লোকটির দিকে তাকিয়ে তিনি বাধ্য হয়ে মুখ খুলতে গেলেন।
২.
মারুফ সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। তার ডান হাত পকেটে। তিনি সেই হাত দিয়ে পাঁচশত টাকার কয়েকটা ময়লা নোট শক্ত করে ধরে আছেন। অনেকের কাছে হয়ত এই টাকা কিছুই না। কিন্তু একমাত্র তিনি জানেন কত কষ্ট করে তাকে এই টাকা জোগাড় করতে হয়েছে। টানাপোড়েন এর সংসারে তার একমাত্র ছেলেটির মেট্রিক পরীক্ষার এই ফিস জোগার করার জন্য আক্ষরিক অর্থেই তিনি হাতে পায়ে ধরেছেন। কিন্তু যে কাজে তিনি এই অফিসে এসেছেন সেটাও না করলেই নয়। এই টাকা কিছুতেই তিনি হাতছাড়া করতে চান না। সামনে বসে থাকা লোকটির ভাবভঙ্গিও তার ভালো মনে হচ্ছে না। মারুফ সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তিনি মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকছেন। ঈশ্বর-এ তার কখনোই বিশ্বাস ছিল না। তার সহজ যুক্তি- ঈশ্বর বলে কেউ যদি থাকতেন তবে তার সারা জীবনে এত কষ্ট, এত লাঞ্চনা, অত্যাচার তিনি শুধু দেখে যেতে পারতেন না। কিংবা বলা যায় ঈশ্বর-এ বিশ্বাস স্হাপনের সুযোগটুকু তার হয়নি। জন্মানোর সময়-ই তার মা মারা যায়। সৎ মায়ের সংসারে মানুষ হওয়া মারুফ সাহেবরা কখনো ঈশ্বর এর দেখা পান না। কিন্তু এই জীবনে তিনি অন্যায় কিছু করেছেন বলে তার মনে পড়েনা। সামনের লোকটি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই তিনি নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
৩.
২০ বছর পরের কথা। জহির সাহেব এখন মৃত্যুশয্যায়। বেশ কিছুদিন যাবতই তিনি বিছানায় পরে আছেন। কিন্তু ইদানিং তিনি বেশ বুঝতে পারছেন তার সময় শেষ হয়ে আসছে। জীবন বাজী রেখে যে ছেলেকে তিনি মানুষ করেছেন কিংবা বলা ভালো শিক্ষিত করেছেন সে ছেলে আজ পাঁচ বছর যাবত আমেরিকায়। সেখানেই বিয়ে করে সে স্যাটল। বাবার মৃত্যুশয্যায় উপস্হিত হতে না পারা ব্যস্ত ছেলের উপর বাবার কোনো অভিমান নেই। শুধু জহির সাহেবরা যখন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন সেটা হয়ে রয় একটা দীর্ঘশ্বাস……
৪.
মৃত্যুর কড়াল গ্রাস মারুফ সাহেবকেও রেহাই দেয়নি। সেদিনের মেট্রিক পরীক্ষা দিতে না পারা সেই ছেলেটি তার নগন্য আয়ে বাবার চিকিৎসা করাতে না পেরে তাকে বাসায় নিয়ে আসে। ছেলের সেবা শত কষ্টেও মারুফ সাহেবকে তৃপ্ত করে। যখন মারুফ সাহেব পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় তার ঠোঁটের কোনে একটা হাসির রেখা কারো চোখ এড়ায় না।
৫
জহির সাহেব ও মারুফ সাহেব এর মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি, কখনো জানা যায়না। জানা হয়না স্রষ্টায় অগাধ বিশ্বাসী সমাজ আর পরিবারের দায়ে ঘুসখোর হয়ে যাওয়া জহির সাহেবদের তার ঈশ্বর কোথায় স্হান দেন। মারুফ সাহেবদেরই বা কি হয়??????
<অদ্ভুত সেই ছেলেটি>
মন্তব্য
<অদ্ভুত সেই ছেলেটি> মানে কী?
এই ছেলে কী করেছে?
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
'অদ্ভুত সেই ছেলেটি'ই এই অসাধারন লেখার লেখক
গল্প ভাল্লাগলো।
আপনার চন্দ্রবিন্দুগুলো পা ফেলছে উল্টোপাল্টা জায়গায়, একটু সামলে রাখতে হবে।
ছবিটার কোন প্রয়োজন আছে কি? আমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলো।
লিখুন আরো।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
শুকরিয়া
অনেক ভাল লাগল । আরও পড়তে পারলে খুশি হব।
ধন্যবাদ
গল্প ভালো লেগেছে
- আয়নামতি
থ্যাংকু
__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!
ছবিটা বাদে লেখার বাকি অংশটুকু ভালো। সচলে মনে হয় আপনার প্রথম লেখা, তাই না?
সচলে স্বাগতম।
অ.ট. হঠাৎ আপনার মাথায় ছবি দেয়ার বুদ্ধি আসলো কোথা থেকে?
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
থ্যাংকু.....শুধরে নিব
ধন্যবাদ
দারুণ!!!
অতীত
ধন্যবাদ
নতুন মন্তব্য করুন