মায়েস্থেনিয়া গ্রাভিচ (এম জি) অতি বিরল আমরন এক অসুখ, যার পরীক্ষিত কোন চিকিৎসা বা ঔষধ নেই; আছে কিছু পরীক্ষনীয় ঔষধ। ভয়াবহ সেই অসুখের সাথে যুদ্ধ এবং তা জয় করার সত্য গল্প।
এক
হটাৎ করেই হাইটেকের বাবোলগুলি মিলিয়ে যেতে লাগলো অটোয়ার সিলিকন ভ্যালি থেকে। মে মাসে অকস্মাৎ পুরো ডিপার্টমেন্ট চলে গেলো চায়নাতে। শখের চাকরি, তবুও মনটা খুবই খারাপ হোল চাকরিটি হারিয়ে। কি আর করা, বাসায় এসে ঠিক করলাম যে কোন কোর্সে ঢোকা যায় কিনা দেখি। কপাল ভালো, জুলাই এর তিন তারিখেই একটা কোর্স শুরু হচ্ছে, বাসার পনের মিনিটের দুরের কলেজে প্রতিদিন সকালে, নয়টা থেকে বারোটা। কোর্সের ফি তিনশ ডলার, কিন্ত পার্কিং এর ফি এর দিকে তাকিয়ে একটু থমকে গেলাম। বড়, মেজ দুই মেয়েই ডাউন টাউনে কো-অপ করে তারাই বুদ্ধি দিল, কলেজের ঠিক উলটো দিকে ওসি ট্রান্সপোর্টের পার্ক এন্ড রাইডে আমি অনায়াসেই গাড়ি পার্ক করতে পারি, যেহেতু তাদের মাসিক যাতায়াতের বাস পাসটা আছে। সকালে তারা আমার সাথে গাড়িতে বেজলাইন বাসস্টপে গেলে তাদেরও অনেক সময় বেচে যায়। তারাই তাদের বাস পাস দেখিয়ে লাইসেন্স দেখিয়ে গাড়ির পার্কিং পাসটা এনে দিল, মহা আনন্দে সকালের ড্রাইভিংটাও তারা মাঝে মাঝে হাত লাগালো।
শখ করেই হলেও বুড়ো বয়েসে বই খাতা নাড়া চাড়া করা বেশ ভোগান্তির মনে হোল। স্মৃতিতে জীবনের প্রথম দিনের কলেজ খুব উজ্জল হোয়ে আছে এতদিনেও। মিশ্র অনুভুতি নিয়ে কলেজে ঢুকলাম, ঢুকেই একটি চাইনিজ মহিলার সাথে দেখা। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি রুম টু ও টুর ক্লাসে যাচ্ছি কিনা। ‘হ্যা’ উত্তরে সে আমাকে খুব দ্রুত লাইব্রেরিতে নিয়ে চললো, মুখে সে বললো ‘তাড়াতারি পা চালাও, ক্লাসের আগেই বই কিনে ফেলি, নাহলে বই পাবেনা হয়তো’। বই নিয়ে প্রায় দৌড়ে ক্লাসে আসলাম, ঠিক নয়টায় ক্লাস ভরে গেল, বয়স্ক শিক্ষক এলেন, এসেই নিজের নাম বলে একটা কাগজে সবার ই-মেইল লিখে দেবার জন্য দিলেন। তারপর আমার পিলে চমকাবার পালা। উইক এন্ড বাদ দিলে বাইশ দিনের কোর্স, ফাইনাল, মিড-টার্ম, দুটো টেস্ট মোট চারদিন, হাতে থাকে মাত্র আঠারো দিনে, একুশ চেপ্টারের সিলেবাস কভার করা হবে! পয়লা দিনেই দেড় চ্যাপ্টার পড়িয়ে প্রফেসর যখন আমাদের ছাড়লেন, তখন ঘামছি রীতিমত। গাড়ি নিয়ে সিধা নাক বড়াবর চালিয়ে বাসায় এসে, ধমাধম চার চুলায় ভাত, ডাল, মুরগি, সবজি চড়ালাম, ফাঁকে ফাঁকে বই এবং নোট ঘাটতে লাগলাম।
প্রতিদিনের তিন ঘন্টার ক্লাসের জন্য আমার পাঁচ থেকে সাত ঘন্টা পরিশ্রম করার দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি পায়ের নীচে একটু মাটি পেলাম, প্রথম টেস্টে পচানব্বই নাম্বার পেয়ে খুসিতে মনে হোল যেন আকাশে উড়ছি। দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে হটাৎ অসম্ভব ক্লান্তি লাগতে লাগলো। উইকেন্ডে সেটা আরো বেড়ে গেলো। সোমবার ক্লাসে গেলাম, ফিরলাম অসম্ভব ক্লান্তি নিয়ে। বিকেল্র দিকে আরেক উপসর্গ যোগ হোল, চোখ দুটি আপসে বন্দ হয়ে যাচ্ছে। চোখের পাতাদুটি খুলে রাখতে পারছি না। তাড়াতারি ঘুমুতে চলে গেলাম। পরদিন সকালে উঠে একটু ভালো লাগায় নিজেই ড্রাইভ করে গেলাম। ক্লাস শেষে ফেরার পথে রাস্তার মেরামত কর্মীর সাথে একসিডেন্ট করে ফেলেছিলাম প্রায়। কারন চোখের পাতা খুলে রাখতে পারছিলাম না। অথচ আমি ঘুমুচ্ছি না।
হাই টেকের চাকরির অসম্ভব চাপে থাকা মেয়ের বাবাকে না বলে মেয়েদের বললাম ঘটনাটা। শুনেই বড় মেয়ে দায়িত্বটা কাধে নিয়ে নিল। তাকে শুধু অনুরোধ করলাম গাঁটের পয়সা দেয়া কোর্সটা যেন শেষ করতে হেল্প করে। সে ড্রাইভিং এর কাজটা বোনেদের সাথে মিলিয়ে আমাকে ক্লাসে আনা নেয়ার কাজটা রুটিনে অর্থাৎ কে কখন নামাবে বা তুলবে সেটার সমাধান করলো এবং ডাক্তারের সাথে এপোয়েনমেন্ট করে জিপির কাছে নিয়ে গেল। সব শুনে (কানাডিয়ান ডাক্তার নাদোলোনি) জিপি আমাকেই জিজ্ঞেস করলো ‘তোমার চোখের অসুবিধা তো আমার কাছ এসেছো কেনো? তুমি বরং চোখের ডাক্তারের কাছে যাও’। মেয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেল। তিনি সব রকমের পরীক্ষা করে বললেন, ‘তোমার চোখে দেখার (ভিশানের)কোন সমস্যা নেই। চোখের পাতা বন্দ হয়ে যাওয়াটা চোখের সমস্যা নয়’। পরের এক সপ্তাহ প্রতিদিনই সকালে মোটামুটি থাকলেও দুপুর থেকেই শরীর খারাপের দিকে যেতে লাগলো। এই ভাবে জোড়াতালি দিয়ে কোর্স্টা শেষ করলাম।
অটোয়াতে বাংগালীদের পিকনিক, প্রবাসে ওরাই আমার পরমাতত্বীয়, ছেলে মেয়েরা সকলেই উপভোগ করে এই দিনটি। মহা উৎসাহে সপরিবারে পিকনিকে গেলাম, ঘন্টা দুইয়েক পরেই দেখি আমার খুব খারাপ লাগতে লাগলো, ঝকঝকে রোদ আমার চোখের কস্টটা বেরে গেলো, মনে হোতে লাগলো যেন আগুনের গোলার মধ্যবসে আছি, আশে পাশের প্রিয় মুখগুলির অবয়ব যেন শর্ষে ফুলের মধ্য বিকৃত, অস্পস্ট, দেখতে লাগলাম, কোথা থেকে ও এসে আমাকে নিয়ের এলো বাসায়, সমস্ত ঘরের পর্দা টেনে অন্ধকার করে দিল, ঠান্ডা পানি দিয়ে মাথাটা ধুইয়ে দিল। অবাক ব্যাপার হোল সকালে যখন ঘুম থেকে উঠি, আমাকে দেখলে কেউই বুঝতে পারবেনা যে আমি আদৌ অসুস্থ। পরদিন সবাই চাকরি, ভার্সিটি, স্কুলে চলে গেলে, আমি শুয়ে শুয়েই কাটিয়ে দিতে লাগলাম দিনগুলি প্রায় অচেতন দেহ মনে। মনের সমস্ত শক্তি এক সাথে জরো করে বিকেল তিনটায় ছেলে ঘরে আসার পরে তাকে নিয়ে ভাত, ডাল রান্না করতে লাগলাম। একটা পিয়াজ কাটতে না পারার অক্ষমতা মনকে নিঃস্ব করে দিতে থাকলো।
চলবে----
আসমা খান,অটোয়া
মন্তব্য
ভালো লাগলো লেখাটা। যদি ভুল করে না থাকি তবে সচলে এটা আপনার প্রথম লেখা। সচলে স্বাগতম।
কতগুলো টার্মের সাথে পরিচিত নই। এগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া হলে ভালো হত।
ভালো থাকবেন।
অলস সময়
লেখাটা সময় নিয়ে পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আমি সচলে নুতন। ঠিক কোন কোন টার্ম গুলি বুঝতে পারেননি জানতে পারলে ব্যাখ্যা করা যেত। মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন।
দারুণ লেখা আপনার।
একটা পরামর্শ দেই, গল্পের গতি একটু কমান। পাঠককে সময় দিন আপনার গল্পের সঙ্গে যাওয়ার।
আর অবশ্যই একটু বড় করে লিখুন। পরের অংশ পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
লেখাটা পড়ার জন্য এবং পরামর্শের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। উৎসাহ পেলে নবাগতদের খুব ভালো লাগে।
ভালো থাকুন।
অনার্য সঙ্গীত@
আপনার অনুজীবের পৃথীবি বইটা পড়লাম। এখানে আমি নতুন তাই আপনাকে খুঁজে বের করতে পারছিলাম না। ধন্যবাদ এমন চমৎকার বই লেখার জন্য।
ঘটনাটা আপনার নিজের জীবনের নাকি আপু? এখন কেমন আছেন আপনি? অনেক শুভকামনা থাকলো আপনার জন্য।
সুস্হ থাকুন। আপনার লেখায় স্বতস্ফূর্ত একটা গতি আছে। নববর্ষের শুভেচ্ছা থাকলো।
ঠিকই ধরেছেন। এটা আমার অন্য রকমের জীবন, ভালো আছি। আপনিও ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।
শুভ নব বর্ষ।
আপনার লেখা খুব খুব ভালো লাগলো। যুদ্ধজয়ের গল্প বিস্তারিত লিখুন।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
বেঁচে থাকাটাই একটা যুদ্ধ আসলে। অনেক দোয়া আর শুভকামনা।
::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::
ভাল লেগেছে। বাকিটি পড়ার আশা রাখি।
নিজের ছোটো ছোটো কাজ গুলোর জন্যও যদি প্রায়শই অন্য কারোর উপর নির্ভরশীল হতে হয় তবে আসলেই তা বেশ কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাড়ায়; খুব দৃঢ় প্রত্যয়ী যোদ্ধা ছাড়া এ যুদ্ধে জয়ী হওয়াটা হয়তো সম্ভব না। তবে কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র মনে হয়না এতো সহজে হার মানবে........ মধ্যবয়সে এসে শখের চাকরী যাওয়ার পরেও কোর্সওয়ার্কের জন্য দিনে পাঁচ সাত ঘন্টা পরিশ্রম করতে পারাটা তার যথেষ্ট দৃঢ়তার সাক্ষী, আমার মতে।
আপনার লেখা বেশ সুন্দর, জীবনযুদ্ধের কাহিনী শুনতে ভালো লাগে, নিজের কাজে নিজের জীবনে প্রেরণা পাওয়া যায়। লেখায় যাকে উল্লেখ করেছেন তার প্রতি রইলো আন্তরিক শুভকামনা।
সুমিত রহমান
আরো লিখবেন আশা করি। সুস্থতার জন্য লড়াই আমরা কে না করি?
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
‘মায়েস্থেনিয়া’ শব্দটি দেখেই হৃস্পন্দন বেড়ে গেল। রুদ্ধশ্বাসে পড়লাম সবটা, আক্ষরিক অর্থেই। আমাকেও যে যুদ্ধ করতে হয়েছে এই ভয়ংকর দানবের সাথে, পরিবারের অত্যন্ত প্রিয় একজনকে বাঁচাতে। সে এক প্রাণপন যুদ্ধ, আপাতত যুদ্ধবিরতি চলছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান ভয় দেখায়, এ যুদ্ধের নাকি শেষ নেই। তাই শব্দটি দেখলেই এগিয়ে যাই।
আপনার লেখা বেশ সুন্দর, সুপাঠ্য। তীব্র আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম পরের পর্বগুলো পড়ার জন্য।
আগ্রহ নিয়ে পড়ছেন জেনে খুব ভালো লাগলো। আপনার সেই আত্বিয়ের অবস্থা সমপর্কে যদি একটু বিস্তারিত জানাতেন, খুব খুশি হতাম, তিনি কোথায়?
তিনি এখন ভাল আছেন। ঢাকার বাইরে থেকে চাকরি করছেন। সব মিলিয়ে দু’বছরের মতো বাসা-হাসপাতাল করে কেটেছে। বাংলাদেশ ভারত মিলিয়ে পাঁচ দফায় প্রায় সাত কেটেছে হাসপাতালে। এর মধ্যে প্রায় ছয় মাস নাকে নল দিয়ে খাবার দিতে হয়েছে। একটা সময় কথাও বলতে পারতেন না, লেখা আর ইশারায় ভাব প্রকাশ করতেন।
এখন ভাল আছেন, অনেক ভাল আছেন, এটুকু ভাল থাকা আমাদের অনেক পাওয়া!
আরও অনেক কথা বলা যায়, আপনি চাইলে, ই-মেইলে (shashankabroy@yahoo.com)।
অনেক সুন্দর থাকবেন।
বাহ, সরল্র লৈখিক প্রকাশ। সাবলীল, তবে দ্রুতযানের গতি। মাঝে মধ্যে একটি কি দুটো ইষ্টিশনে একটু থেমে গেলে আমার মতো অপটু যাত্রীদের একটু সুবিধে হত।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। পরের পর্বে মনে মনে রাখব আপনার উপদেশটি, ধন্যবাদ।
সচলে স্বাগতম
লেখা চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ, লেখার চেস্টা করছি।
নতুন মন্তব্য করুন