গালে হাত দিয়ে তন্দ্রা মন খারাপ করে বসে আছে সোফায়। পাশে আম্মু। আব্বু আর ভাইয়া উঠে গেছে নিজনিজ ঘরে। এত্ত মনখারাপ হয়েছে যে কী করবে তন্দ্রা খুঁজে পাচ্ছেনা। মন খারাপ হবেই না বা কেনো। কী চমৎকার একটা নতুন পর্ব দিয়েছে আজ টম এন্ড জেরির; আর আম্মু এসে বলা নেই, কওয়া নেই, খুট করে দিলো চ্যানেল বদল করে। আম্মু, আম্মু কিংবা না, না, বলে চিৎকারের সময়ও পায়নি সে। তার আগেই আম্মু বললো, লক্ষীসোনা, রাতে খাওয়ার সময় দেখো বাকিটুকু। এখন আমি নাটক দেখি। নাস্তা ঝটপট খেয়ে গিয়ে ততক্ষণে হোমওয়ার্ক সেরে নাও। আর নাস্তা খাওয়া। তন্দ্রা গাল ফুলিয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষণ।
ভাইয়া আর আব্বু ছিলো এতক্ষণ এইরুমে। তারাও কিছু না বলে উঠে গেলো। আব্বুটা ইদানিং কেমনযেনো হয়ে যাচ্ছে। আগে বাসায় এলেই তন্দ্রার সাথে খেলতে বসে যেতো। কত্ত দুষ্টুমি তার সাথে যে কোনো ইয়ত্তা নেই। অথচ গতবছর প্রাইমারী ইস্কুলে ভর্তি হবার পর থেকেই কেমনযেনো হয়ে গেছে আব্বু। এখন আর তেমন আগের মতো খেলেনা তার সাথে। অথচ পড়ার সময় ঠিকই হাজির থাকে হাতে সকালের পত্রিকা আর একখান টীচার টাইপের মোটা ফ্রেমের চশমা নাকে ঝুলিয়ে। আচ্ছা, বড় হয়ে গেলে কী দূরে সরে যায় আস্তে আস্তে সবাই? কেনোজানি ইদানিং এই প্রশ্নটা তার মাঝে মাঝেই মনে আসে। তারপরও, টম এন্ড জেরি এসে সেই ঘাটতি অনেকটা পূরণ করেছে তার।
আর এক আছে ভাইয়া। আগে তারসাথে কত খুনসুটিই না হতো তার। খেলার সময়, খাওয়ার সময়, ঘুমের সময় এমনকি ঘুমের মধ্যেও একে অপরের দিকে হাত-পা ছুঁড়তো। তখন খেলার সময় ভাইয়া কোনো বেলই পেতো না তার কাছে। কী লুডু, কী চোরপুলিশ, কী কানামাছি সব খেলাতেই ভাইয়া এক্কেবারে গোহারা হারতো। আর এখন কী একখান ক্রিকেট খেলা পেয়েছে, সেটা নিয়েই মেতে আছে সারাক্ষণ একাএকা। তার আবার নাকি ক্লাসের সেরা অলরাউন্ডার! ইস্কুলে তো বটেই, বাসাতেও মেতে আছে তা নিয়ে প্রায় সারাক্ষণ। তন্দ্রা একদিন দেখতে গিয়েছিলো ভাইয়া কেমন খেলে। তাদের বাসার দুই গলি পরেই কলোনির মাঠ। সেখানেই বিকেলে খেলে তারা। তন্দ্রার বান্ধবীরা সেদিন কী এক কাজে প্রায় সবাই কোথায় জানি গিয়েছিলো। তো একা একা বিকেল কীভাবে কাটাবে ভেবে হঠাৎ ভাইয়ার সাথে বের হলো। ভাইয়ার বরাত খারাপ। পরপর দুই ম্যাচে ব্যাটিং এ শূন্যরানে আউট হলো সেদিন সে। তারপর থেকে আর তন্দ্রাকে সাথে নেয়না সে খেলার মাঠে। তন্দ্রা নাকি তার জন্যে কুফা।
আম্মু হপ্ করে বসে থাকা তন্দ্রার দিকে ফাঁকে ফাঁকে দেখছিলেন। একমনে এসব ভেবে যাচ্ছিলো সে। এর মধ্যে নাটকও শেষ হয়ে গেছে। স্টারপ্লাসের হিন্দী সিরিয়াল। এই সময় টানা তিনটি সেরকম নাটক চলে। কোনোটির একপর্ব মিস হয়ে গেলে আম্মুর রাতের অর্ধেক ঘুম হারাম হয়ে যায়। এমনিতে হয় না কিন্তু মাঝে মাঝেই অর্ঘ্যের আব্বু খুব ঝামেলা করে, বিশেষত পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা থাকলে। বলে মধ্যরাতের পরে আবার পুনপ্রচার করবে, তখন দেখে নিও। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়।
তন্দ্রার আম্মু ঠিক করেছেন সামনে মাসে আরেকটা টিভি কিনে ফেলবেন। কেনোনা এই প্রোগ্রামগুলো মিস করা যাবেনা। তাছাড়া ছোটদের নতুন একনাচের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। অসাধারণ এই অনুষ্ঠানের পিচ্চিগুলো। হিন্দী গানের তালে অবিশ্বাস্যভাবে নাচে এরা। বড় হলে যে কী করবে কেজানে। তন্দ্রা নাচের ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। ভাবছেন তাকে এরকম নাচ শেখাতে পারলে ভালোই হয়। পাড়াপড়শিরা দেখবে তার মেয়ে কত ট্যালেন্ট। তন্দ্রাকে এই অনুষ্ঠানটা দেখাতে হবে নিয়মিত, ভাবেন তিনি।
কিন্তু এই অর্ঘ্য আর তার আব্বুর জ্বালায় ক্রিকেট ছাড়া কোনো কিছু দেখাই ভার। তাও আবার দুইজনেই পাকিস্তানের অন্ধভক্ত। অর্ঘ্যের আব্বুর ক্রিকেট মানেই এককথা, পাকিস্তান। পাকিস্তান ছাড়া আর কিছুই তিনি বুঝেননা। গত বিশ্বকাপের পাকিস্তানের খেলা দেখতে তিনি শ্রীলংকার মাঠে পর্যন্ত গিয়েছেন। আর দেশের মাঠেতো অবশ্যই। এই খেলা দেখার জন্যে পাঁচ হাজার টাকার টিকেট তিরিশ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন তিনি। অর্ঘ্যের আম্মু মাঝে মাঝে একাত্তরের কথা তুলতে চাইলে তুড়ি মেরে বলে ওঠেন, ওসব ফালতু সেন্টিমেন্টের কথা বলো নাতো। কোথায় ক্রিকেট, আর কোথায় রাজনীতি। তেলেজলে মিশ খায় কখনও? তাছাড়া যা হয়েছে তাতো আর ফিরিয়ে আনা যাবেনা। আর এই খেলোয়াড়দের সাথে ঐসব মিলিটারির তুলনা করছো কেনো? এরা তো ক্রিকেটের গৌরব। ঐসময় পাকিস্তানের জায়গায় বাংলাদেশ থাকলেও একই কাজ করতো। কিংবা বাংলাদেশ যদি হেরে যেতো তাহলে এই মুক্তিযোদ্ধারাই তখন মীরজাফর হিসেবে পরিচিত হতো। পাকিস্তান খারাপ কাজ করেছে এটা ঠিক, তবে তা নিয়ে এখন এই ক্রিকেটের আনন্দের মধ্যে তো জল ঢালার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া পাকিস্তানের কী এক সাংবাদিক আছে হামিদ না কীজানি নাম, ওরা তো চেষ্টা করছে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চাইতে। এটা হয়ে গেলেই তো অনেকটা সহজ হয়ে যাবে দুই দেশের সম্পর্ক। ভারতও তো ঐসময় সাহায্য করেছিলো বাংলাদেশকে। আর এখন কী করছে আমাদের নিয়ে? ক্ষমতার জোর না থাকলে আসলে কিছুই নেই কোনো রাষ্ট্রের। তা পাকিস্তান হোক, আর ভারত হোক। আমাদের রাজনীতিবিদদের মেরুদন্ড না হওয়া পর্যন্ত এসব আলোচনায় কোনো লাভ নেই। তন্দ্রার আম্মু কথায় পারেন না। আগেই হাল ছেড়ে দেন। কীজানি, হবেবা হয়ত।
ইতোমধ্যে একটা নাটক শেষ হয়ে আরেকটা শুরুর পালা। তন্দ্রা তখনও বসে আছে। আম্মু তন্দ্রাকে কাছে টেনে আদর দিয়ে গালে হঠাৎ চুমু খেয়ে বললেন, লক্ষীমণি, রাগ করোনা। রাতে তোমার সাথে বসে আমিও দেখবো। এখন যাও। তন্দ্রার ততক্ষণে সম্বিত ফিরে এসেছে। আম্মুর কর্মকান্ডে হঠাৎ মুচকি হেসে ফেলে সে। উঠে যায় আস্তে আস্তে আর যাওয়ার সময় বলে যায়, আমার সাথে বসে দেখতে হবে কিন্তু।
কিছুদিন পরে কলোনিতে আয়োজিত হবে নববর্ষ উপলক্ষে দিনভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর তাই আগের সাত দিন ধরে চলে জাঁকজমক মহড়া। অর্ঘ্য আর তন্দ্রা খুব ব্যস্ত সময় কাটায় এই সাতদিন। অনুষ্ঠানসূচী তাদের আগে থেকেই জানা। সকালে কলোনির সবাই মিলে একসাথে রমনা যাবে, সেখানে পান্তা-ইলিশ খেয়ে আর র্যালী শেষে দুপুরে ফিরে আসবে বাসায়। দুপুরের পরে কলোনির মাঠে অনুর্ধ্ব বারো বছর বয়সী ছেলেদের ক্রিকেট ম্যাচ কলোনির মাঠে, আর মেয়েদের তারপরে দড়ি খেলা, বালিশ নিক্ষেপ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেইসাথে মাঠের কোণাজুড়ে দেশীয় পণ্যের মেলার আয়োজন থাকবে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি। তন্দ্রাও সেখানে গান গাইবে আর নৃত্য প্রদর্শন করবে। উত্তেজনায় তার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। গান আর নাচ নিয়ে তেমন টেনশন না। টেনশন হলো আইটেম সং নিয়ে। তন্দ্রার আম্মু অনুষ্ঠানের চমক হিসেবে একটা আইটেম সং এর ব্যবস্থা করেছেন যেটায় তন্দ্রা নাচবে। উত্তেজনা এটা নিয়েই। কারণ আইটেম সং-টা হিন্দী, প্রথম কলি “শীলা কি জওয়ানী” না কীজানি। আর তন্দ্রা হিন্দী ভালো বোঝেনা। ফলে তাকে কসরত করতে হচ্ছে নাচের মুদ্রা মুখস্ত রাখতে। বাংলা গান হলে কথার প্রেক্ষিতেও অনেক নাচের মুদ্রা নিয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু যেকথার মানেই ঠিকমতো জানানাই, তা নিয়ে নাচবে কীভাবে? তন্দ্রা এ নিয়ে চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। আম্মু দিনভর সাধ্যমত তাকে ট্রেনিং দিয়ে যাচ্ছেন। উপরি হিসেবে হরলিকস, কমপ্ল্যান কোনোকিছুই বাদ যাচ্ছেনা।
নতুন বছরের প্রথমদিন কলোনিতে খুব জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়। সারাদিনরাত মেতে থাকে সবাই প্রাণের আনন্দে। অনুষ্ঠানের শেষে পুরস্কার বিতরণী। ক্রিকেটে অর্ঘ্য আর নাচে তন্দ্রা সেরা হয়। আব্বু-আম্মুর আনন্দ আর ধরেনা। তন্দ্রাকে আর অর্ঘ্যকে কাঁধে তুলে বাসায় আসেন আব্বু। কানফাটা আওয়াজে আনন্দে চিৎকার করতে থাকে দুইজন। বাসায় এসে আব্বু অর্ঘ্যকে বলেন, সাবাস, বেটা। ক্রিকেট খেললে এমনই খেলবি, আফ্রিদির মতো। পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের মতো হওয়ার চেষ্টা কর। তাইলে বাংলাদেশের ভাগ্যে কিছু কাপ আসবে। যারা আছে এরা ঝড়ে বক ফেলে। এদের দিয়ে কিছু হবেনা। ঐদিকে আম্মু তন্দ্রাকে নিয়ে টিভিরুমে চলে গেছেন ততক্ষণে। আজ মেয়ে যা দেখবে তাই দেখবেন মেয়ের সাথে। দরকার হলে কালকে পুনপ্রচার দেখে নেয়া যাবে। কিন্তু তন্দ্রার এখন টিভি দেখতে ভালো লাগছেনা বলে। সে বলে আজ সারারাত গল্প শুনবো। আব্বু-আম্মু তাদেরকে নিয়ে বাসার ছাদে চলে যান। সেখানে ডিমলাইটের নীলচে আলোর সাথে চাঁদের আলো মিলে এক অপার্থিব আবহ। মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে শুরু হয় গল্প। একটি সুখী-শান্ত পরিবারের গল্প।
২
দুইঘন্টা হলো বৃদ্ধ আজিজ বসে আছে তার পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রীকে সাথে নিয়ে এই মাঝরাতে নদীটির পাড়ে। পাড় ঘেঁষে সারিসারি কয়েকটা প্রাচীন কবর। নদীর ক্রমাগত ভাঙ্গনে এগুলো এখন প্রায় যায়যায় অবস্থা। সামনের বার আর কবরগুলো পাওয়ার আশা নাই। অবশ্য ততদিন আজিজ কিংবা তার স্ত্রী-ই বাঁচে কিনা তারই ঠিকনাই। দুজনের শরীরও নড়বড়ে। আজিজ আগে থেকেই পঙ্গু, সেই একাত্তর থেকে। ডান-পা প্রায় পুরোটাই নেই। তার অসুস্থ স্ত্রীও নির্বাক, সেই একাত্তর থেকেই। মাঝরাতে কবরগুলো ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছেনা। আজিজ ছেঁড়া কাঁথার ভেতরে থেকে হাত বের করে গোনার চেষ্টা করে, মাঝখান থেকে সঠিক চারটি কবরের অবস্থান বের করতে। ঠিকমতো ধরতে পারেনা। ঠান্ডা বাতাস বইছে। সেইসাথে চামড়া কুঁচকানো হাতের আঙ্গুল কাঁপছে। তার স্ত্রী একমনে তাকিয়ে আছে ঐদিকে। কবরগুলো শনাক্ত করতে পেরেছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। দুইজনেই প্রচন্ড ক্লান্ত। সারাদিন শহরে ভিক্ষা করে রাতে এখানে হেঁটে হেঁটে এসেছে প্রায় বিশ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে।
সেদিনও পাড়ি দিয়েছিলো হেঁটে প্রায় তিরিশ মাইল পথ, ক্লান্তি ছাড়াই ভরপুর মনের আনন্দে আজিজ। বছরের প্রথম দিন। বাড়িতে যাচ্ছে। গ্রামে ঠিকমতো খবর নিয়েই রওনা দিয়েছে। খানরা ঐদিকে তখনও যায়নাই। কিন্তু ভয় পাশের গ্রামের কাদের মোল্লাকে নিয়ে। সে শান্তিকমিটির সদস্য। ইতোমধ্যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরিয়ে দিয়েছে খানের হাতে। তাকে বাগে পেলে জন্মের মতো সিধে করে দিতো আজিজ। কিন্তু ব্যাটা বড়ই ধুরন্ধর। সবসময় খানদের ছত্রছায়ায় থাকে। নিজবাড়ীতে পাওয়াই যায়না। বেলাল খবর পাঠিয়েছে কাদের মোল্লা কয়েকদিনের জন্যে শহরে গেছে। তাই এখন তেমন ভয় নেই।
বাড়ীতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় মাঝরাত হয়ে যায়, সোজা পথে না এসে বিভিন্ন মাঠ-ঘাট ঘুরে আসে বলে। উঠোনে এসে আজিজ দেখে আব্বা-আম্মা তনু আর মুক্তিকে নিয়ে পাটি পেতে বসে আছে তারই জন্যে, গল্প করছে নিজেদের মধ্যে। আমেনাকে দেখা যাচ্ছেনা। বাবার উপস্থিতি টের পেয়েই দুইজনে উঠে গিয়ে এক লাফ দেয় একইসঙ্গে, আব্বা বলে ডাক ছেড়ে। আজিজ তাল সামলাতে না পেরে ধপ্ করে উলটে পড়ে দুইজনকে নিয়েই। একজন দশ বছরের ছেলে আর একজন সাত বছরের মেয়ের ভার একসঙ্গে আটকানো অসম্ভব প্রায়। উলটে পড়ে তিনজনই হাসিতে ফেটে পড়ে। মুক্তির দাদীমা দেখোতো দেখোতো বলে ছুটে যায় কারও কোথাও লাগলো কিনা এই দুশ্চিন্তায়। আজিজের আব্বাও ছুটে আসে। এদিকে শোরগোল শুনে আমেনাও বের হয়ে আসে দাওয়া থেকে। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ।
খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই গোল হয়ে বসে। তনু আর মুক্তি আব্বার কাছে যুদ্ধের গল্প শুনতে চায়। খানরা কেমন দেখতে, তাদের কয়টা দাঁত, গুলি করে কীভাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা একই গল্প আগেও শুনেছে আব্বার কাছে। কিন্তু প্রতিবারই আজিজকে এরকম গল্প শোনাতে হয়। তনু আর মুক্তি পরম আগ্রহে শোনে তা। তনুর দাদীমা থাকতে নিষেধ করে আজিজকে। যেকোনোসময় বিপদ হতে পারে। আমেনা ইতস্তত এদিকে ওদিকে ফিরে চায় একটু পরপর। যদিও ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই, তবুও কিসের শংকায় জানি তার একটু পরপর বুক কেঁপে ওঠে। আজিজ বলে, চিন্তার কোনো কারণ নেই। কাদের বাড়ীতে নেই। তাছাড়া ভোরের আগেই সে চলে যাবে।
কিন্তু আচমকা বাড়ীর পেছন থেকে টর্চ ফেলে একটু পরেই দলবলে হাজির হয় কাদের মোল্লা, সাথে সাথে ঘিরে ফেলে সবাইকে। ভয়ে তৎক্ষনাৎ সবার জান শুকিয়ে যায়, আজিজ ছাড়া। সাথে দুইজন খানসেনাও আছে। বেলালকে পিছমোড়া করে বেঁধে এনেছে। মুখে গামছা দিয়ে আটকানো। মনে হয় ছুরিও মেরেছে। পিঠ হতে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আমেনাকে দেখে হঠাৎ খানসেনাদ্বয়ের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কিছু না বুঝে তনু আর মুক্তি হঠাৎ ভয়ে আজিজকে জড়িয়ে ধরে। আজিজের বাবা কাঁপতে কাঁপতে কাদেরের দিকে এগিয়ে যেতেই গুলি করে খানদের একজন। আজিজের মা চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়ে আজিজের বাবাকে ধরতে গিয়ে। সেই অবস্থায় তাকেও গুলি করে খান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হ্যাচকা টানে আমেনাকে ধরে ফেলে কাদের; আর তার দলের একজন আজিজকে বাঁশের লাঠি দিয়ে জোরে গুঁতো মেরে ফেলে দেয় মাটিতে, একইসাথে দুই-তিনজন মিলে জাপ্টে ধরে তাকে। তনু আর মুক্তি ভয়ে কেঁদে দেয় চিৎকার। ছুটে আসে মায়ের দিকে। আমেনাও জোরসে চিৎকার দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পরমুহূর্তেই বন্দুকের পরপর দুটো আওয়াজ নিথর করে দেয় তাকে। আজিজ টেনে হিঁচড়ে ছুটে আসে। মাথায় বাঁশের এক প্রচন্ড আঘাতে মূর্ছা যায় পরমুহূর্তেই। আমেনা নিষ্পলক চেয়ে দেখে ধীরে ধীরে থেমে আসা তনু আর মুক্তির হৃদস্পন্দন। তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হয়না আর। বেলালও থেমে যায় একসময়। আজিজকে জানে মারেনা তারা। মুক্তির তথ্য লাগবে। তাকে কাঁধে নিয়ে আর আমেনাকে টানতে টানতে নিয়ে চলে যায় সবাই। পেছনে সারিবদ্ধভাবে পড়ে থাকে আজিজের বাবা, মা, তনু আর মুক্তি।
আজিজকে মারতে পারেনি খানরা। জ্ঞানফিরে কোনো কিছু স্বীকার না করায় বা কোনো তথ্য না দেওয়ায় পরেরদিন আরও ধরে আনা মুক্তিসেনাদের সাথে লাইনে দাঁড় করিয়ে ফায়ার করে একসঙ্গে। গুলি লাগে ডান উরুর উপরের হাড়ে, কোমরের নিচের দিকে। গুলির ঝটকায় মূর্ছা যায় আবার সে। সবলাশ কাদের মোল্লা তার বাহিনী নিয়ে বয়ে নদীতে ফেলে দেয়। সেখান থেকে উঠে আসে সে আবার, তিনগ্রাম পরে। যুদ্ধ করার ক্ষমতা আর থাকেনা। তাকে চেনার মতো কেউ থাকেনা। আস্তে আস্তে লোকমুখে শোনে, তার পরিবারের কাহিনী। পরের রাতে অন্ধকারে গ্রামের কিছু বৃদ্ধ মহিলা তার বাবা, মা, তনু আর মুক্তিকে নাকি নদীর পাড়ের কাছে একটা বাগানে কবর দিয়ে এসেছে। কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে আসে তার।
কাদের মোল্লা মুক্তিবাহিনীর হাতেই প্রাণ খোয়ায়। আমেনাকে ফেরত পায় যুদ্ধ যখন প্রায় শেষ তখন। ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করা কিছু নারীর সাথে পাওয়া যায় তাকে। নড়েনা, বলেনা কিছু। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। লোকলজ্জার ভয়ে আজিজ আমেনাকে নিয়ে চলে আসে গ্রামের ত্রিসীমানা ছেড়ে। তারপর প্রায় চল্লিশটা বছর কেটে গেছে। জীবন কখনও তাদের সঙ্গে নেয়নি, আবার কখনও মুক্তি দেয়নি।
প্রতিবছর এইদিনে যেখানেই থাকুক, আজিজ তার স্ত্রীকে নিয়ে আসে রাতের আঁধারে, লোকচক্ষুর আড়ালে। যদিও দিনে লোকের কাছে থেকেই জেনেছে কবরের ঠিকানা। কিন্তু নিজে দেখেনি বলে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা কোন চারটা কবর তার পরিবারের। তাই প্রতিবার নিজের কল্পনামতো সাজিয়ে নেয় চারটি কবর অনেকগুলোর মধ্যে থেকে। আমেনা কিছু বলেনা। শুধু চেয়ে থাকে আগের মতোই ফ্যালফ্যাল করে। আর সারারাত আজিজের চলতে থাকে পরিবারের সাথে গল্প। একটি বিশেষণহীন পরিবারের গল্প।
-অতীত
মন্তব্য
এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হলে খুব অসহায় লাগে
অদ্ভুত সুন্দর একটি লেখা, আপনার বর্ণনা এত সুন্দর যে মনে হচ্ছিল নিজের চোখের সামনে সব ঘটনা দেখতে পারছি, গল্পে পুরোপুরি মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে এত চমৎকার একটি লেখা উপহার দেয়ার জন্য।
সুমিত রহমান
অসাধারণ, অসাধারণ, অসাধারণ!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
মন্তব্য এর প্রতিমন্তব্য করতে গিয়ে ঝামেলা হচ্ছে; মজিলা খালি চরকি খায় অতিথি একাউন্ট এ ঢুকে মন্তব্যের অপশন আর পাচ্ছিনা, কাহিনী কী? অতিথি লেখক অবস্থাতেই ব্যান খাইলাম নাকি?
যাইহোক, আয়নামতি, সুমিত ভাই আর রোমেল ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ কষ্ট করে লেখার পুরোটা পড়ার জন্যে এবং সুন্দর মন্তব্যের জন্যে।
না চাইলেও কিছু নিয়তি আমাদের জাতির জন্যে আজ সবচেয়ে বীভৎস রূপ নিয়ে খেলা করে যাচ্ছে। আমাদের নিজেদের কোনো আত্মসম্মানবোধ না থাকার দরূন। উপরের গল্পএর অনেকটাই জীবন থেকে নেওয়া, মানে সত্যি। অথচ আমি প্রাণপণে চাই, এরকম গল্প আমাদের জাতির জন্যে যেনো কল্পনাতেও গল্প হিসেবে স্থান না পায়, অন্তত তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জীবনে কখনও আর।
মন্তব্য এর প্রতিমন্তব্য করতে গিয়ে ঝামেলা হচ্ছে; মজিলা খালি চরকি খায় অতিথি একাউন্ট এ ঢুকে মন্তব্যের অপশন আর পাচ্ছিনা, কাহিনী কী? অতিথি লেখক অবস্থাতেই ব্যান খাইলাম নাকি?
যাইহোক, আয়নামতি, সুমিত ভাই আর রোমেল ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ কষ্ট করে লেখার পুরোটা পড়ার জন্যে এবং সুন্দর মন্তব্যের জন্যে।
না চাইলেও কিছু নিয়তি আমাদের জাতির জন্যে আজ সবচেয়ে বীভৎস রূপ নিয়ে খেলা করে যাচ্ছে। আমাদের নিজেদের কোনো আত্মসম্মানবোধ না থাকার দরূন। উপরের গল্পএর অনেকটাই জীবন থেকে নেওয়া, মানে সত্যি। অথচ আমি প্রাণপণে চাই, এরকম গল্প আমাদের জাতির জন্যে যেনো কল্পনাতেও গল্প হিসেবে স্থান না পায়, অন্তত তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জীবনে কখনও আর।
-অতীত
শ্রদ্ধাবনত....
অসাধারণ। প্রথমটা এত বেশি মিলে যায় আশেপাশের সাথে যে ধাক্কা লাগে মনে। না ভাল লাগলেও কত কিছু যে আমরা মেনে নেই!
::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::
গুরু, যা দিলেন না... সিরাম... আপনার রচনার প্রতিভা তো পৃথিবী ছেড়ে অন্তরীক্ষের পথে...
রচনার শিল্প গুণ মারাত্মক হয়েছে। অসম্ভব সাবলিল, প্রাঞ্জল একটি রচনা। বিষয়বস্তু হৃদয়গ্রাহী। গুরুর আদর্শের সাথে আমার আদর্শ ও একই সুরে অণুরনিত হয়েছে... গুরুকে সংগ্রামী লাল সালাম...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নতুন মন্তব্য করুন