দ্বিতীয় সহস্রাব্দে যতগুলো ধারণা সাধারণ মানুষের হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে উঠা চিন্তা ও বিশ্বাসের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ভূ-তত্ত্বের নিরিখে গড়ে উঠা ভূ-তাত্ত্বিক কালপঞ্জি ও বিবর্তনবিদ্যা। পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্রে নয়, গ্যালাক্সির কেন্দ্রে নয় ধারণাটা সাধারণ বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিলেও বিষয়টা ততটা বোধগম্য নয় যতটা বোধগম্য হলো ‘মানুষের উদ্ভব সরাসরি ঘটেনি‘ধারণাটি; কারণ মানুষ বুঝতে পেরেছিল সহজেই শ্রেষ্ঠত্ব বলতে যা সে বোঝে তা আর থাকে না। সে প্রায় ৩৫০ কোটি বছরের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় এক কোষী থেকে বহুকোষী, অমেরুদণ্ডী থেকে মেরুদণ্ডী, মাছ, সরীসৃপ হয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছে। বিবর্তনবাদের ধারণাটির শুরু প্রায় আজ থেকে ২৫শত বছর আগে, অ্যানাক্সিমেন্ডার, এমপিডকলেস, ডেমোক্রিটাসের হাতে। বিবর্তন কোনো তত্ত্ব নয় এটা একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনাটি ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় ঘটে তা বুঝতে আমাদের চার্লস ডারউইন ও ওয়ালেসের প্রাকৃতিক নির্বাচন আবিস্কার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রক্রিয়াটি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে যে প্রমাণগুলো সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে তা হলো ফসিলবিদ্যা ও কৃত্রিম নির্বাচন। প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়াটি ও ভূ-ত্বকের খাজে খাজে জীবাশ্মের আবিস্কার নিয়ে ধর্মতত্ত্ববিদদের সাথে বিজ্ঞানীদের যে পরিমাণ বিরোধে জড়িয়ে পড়তে হয় তা বোধ হয় পৃথিবীর ইতিহাসে আর ঘটেনি।
কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা কুকুর, গরু, ভেড়া ও শাক-সব্জিগুলোর সেইসব পরবর্তী প্রজন্মগুলোকে রক্ষা ও যত্ন করেছি যেগুলো আমাদের মানবজাতির জন্য অধিকতর উপকারী, এর ফলে কুকুর, গরু, ভেড়া ও বিভিন্ন শাক-সব্জির ক্ষেত্রে এক ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে যেমন দক্ষ শিকারী কুকুর পেয়েছি, ভেড়ার রুক্ষ পশম ২০কিলোগ্রামে পৌছেছে, গবাদী পশুর একবার দহনে দুধ দেয়ার পরিমাণ কয়েকশত থেকে বেড়েছে কয়েক লক্ষ ঘন সেন্টিমিটার পর্যন্ত। মাত্র দশ হাজার বছরের কৃত্রিম নির্বাচন এত বড় পরিবর্তন ঘটাতে পারে তাহলে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন‘ যে প্রক্রিয়াটি কোটি কোটি বছর ধরে কাজ করে এসেছে সে কেন সামর্থ্য হবে না? এ প্রসঙ্গে বলা যায় একজন মহান কারিগর বা ঈশ্বর হলো জৈবিক পৃথিবীর একটি প্রাকৃতিক, আবেদনপুর্ণ ও একত্রে মানবজাতির ব্যখ্যা। কিন্তু যেমন ডারউইন এবং ওয়ালেস দেখিয়েছিলেন, আর একটি উপায় আছে, যা সমানভাবে আবেদনপুর্ণ, সমানভাবে মানবিক, এবং অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য: প্রাকৃতিক নির্বাচন, যা যুগে যুগে জীবনগীতি আরও বাঙময় করে তোলে।
বাইবেলে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে, যেমনঃ বিভিন্ন রাজাদের রাজত্বকাল, মুসার আমলে ইহুদিদের মিশর প্রস্থানের সময়, সুলায়মানের গীর্জা নির্মাণের আমল ইত্যাদি। ধর্মতাত্ত্বিকেরা বাইবেলের এই সকল ঘটনাবলীর সময় নির্ধারণের মাধ্যমে পৃথিবী সৃষ্টির কাল নির্ধারণ করেন। এক্ষেত্রে খুব পরিচিত সিদ্ধান্তগুলোর একটি, রাজা জেমসের টীকাকৃত বাইবেলের অনেক সংস্করণে আজও ছাপার অক্ষরে লেখা রয়েছে। ১৬৩০ সালে ইংল্যান্ডের গীর্জার এক আইরিশ, বিশপ জেমস আশার তার গাণিতিক প্রক্রিয়ায় বাইবেলের ঘটনাবলীর ক্রমপঞ্জী থেকে সৃষ্টির তারিখ নির্ধারণ করেন ৪০০৪ খ্রি পূ। অপর দিকে বাইজেন্টাইনদেশীয় পন্ডিতদের মতে সৃষ্টির তারিখ ৫৫০৮ খ্রিঃপূ। তবে সবচেয়ে স্বাধীন যে মতামত এসেছে ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে, তা ৭০০০ বছরের বেশি বলে ধরা যায়নি। সুতরাং এটা অত্যন্ত সত্য যে, রহস্যজনকভাবে ঈশ্বর কর্তৃক পৃথিবী সৃষ্টি না হলে, বিবর্তনের ধারায় এক একটি প্রজাতি বিকাশের জন্য ঠিক যতটা সময়ের প্রয়োজন এ সময়টা তার জন্য যথেষ্ট নয়।
উল্লেখ্য স্কটিশ প্রকৃতি বিজ্ঞানী জেমস হাট্টন (১৭১৬- ১৭৯৭) স্কটিশ উপকূলে একবার তাঁর বন্ধুদের শিলার গঠন দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা দেখলেন শিলার বয়স যাই হোক না কেন, এক শিলা থেকে আরেক শিলা রূপানতরের অন্তহীন ধারাবাহিকতাই হল লক্ষ্যণীয় বিষয়। এই ভূ-তত্ত্ববিদই ১৭৮৫ সালে Theorg of the Earth নামে প্রথম ভূ-তত্ত্ববিদ্যার ভিত্তিপত্তনকারী একটি বই রচনা করলেন। আধুনিক ভূ-তত্ত্ববিদ্যার এই গ্রন্থে শিলার স্বাভাবিক গঠন পদ্ধতি ও পরিবর্তন সমপর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণাগুলো পৃথিবীর বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে এক নতুন দৃষ্টি খুলে দেয়। সেখানে তিনি ব্যক্ত করলেন যে, প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলো আজ পৃথিবীর রূপ যেভাবে বদলে দিচ্ছে, অতীতের পৃথিবীতেও সেই প্রক্রিয়াগুলো একইভাবে সক্রিয় ছিল। অল্প কথায় যুগ যুগ ধরে এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলো একইভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখানো যায় যেমনঃ সাগরগুলোর লবণাক্ততা ধীরে ধীরে বাড়ছেই। কারণ, প্রতিবছর নদীগুলো লবণ বয়ে নিয়ে আসছে। আর এই বৃদ্ধি চলছে প্রায় একই হারে এবং সাগরের বর্তমান লবণাক্ততা কত বছরে তৈরি হয়েছে, জেমস হাট্টনের পদ্ধতির সাহায্যে তা সহজেই হিসাব করা যায়। অবশ্য ধরে নিতে হবে যে, সাগরের পানি প্রথমে মিষ্টি পানিই ছিল। এভাবে এই হিসাব থেকে সৃষ্টির বয়স হবে প্রায় কয়েক লক্ষ বছর, যা উপরোক্ত হিসাবের ধর্ম প্রবক্তাদের মুলে কুঠারাঘাত হানে। এদিকে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যখন বিভিন্ন শিলারের ধারা অনুসারে, ফসিল পাওয়া যেতে লাগলো, তখন ধর্মতাত্ত্বিকেরা (সময়ের হিসাব এখানে বাদই রাখা হলো) বলতে লাগলো ঈশ্বর ভূ-ত্বকের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে একটা বিশেষ পারস্পরিক বিন্যাস ঘটিয়ে থাকতে পারেন। তখন ভূ-তত্ত্ববিদদের প্রমাণ করার প্রয়োজন বোধ হয়নি যে, সে কাজ কারও পক্ষে শুধু একটা যুক্তিহীন প্রয়াসই হতো না তার পিছনে ব্যাতিক্রমী খেয়ালী ইচ্ছাও থাকতো। সে রকম কিছু হয়ে থাকলে, বলতেই হত এভাবে বিশ্বজগৎ চালনা এক অযোক্তিক পন্থাই।
ডিসকাশন প্রজেক্ট এর বক্তৃতায় বিবর্তন নিয়ে কথা বললে অনেকে জিজ্ঞেস করেন, এই যে এত পরিবর্তনের কথা বলেন তা আমরা চোখের সামনে দেখছি না কেন? বিবর্তনের যে সময়কালগুলো তার তুলনায় মানবজীবন এত ক্ষুদ্র সময় অধিকার করে থাকে এটা চোখের সামনে দেখা খুবই অসম্ভব। তারপরও যে ২/১টি উদাহরণ নেই তা নয়। যেমন ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি ঘটে অত্যন্ত দ্রুত, তাদের মিউটেশনের হারও অত্যধিক আর তার ফলে তাদের মধ্যে বিবর্তন ঘটতে থাকে অকল্পনীয় দ্রুত গতিতে। ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে যে বিবর্তন ঘটতে লাগে ২০ মিনিট, মানুষ প্রজাতিতে সেই বিবর্তন ঘটতে লাগে ২০ বছর। আর মনে রাখতে হবে ঘটনার মানে হচ্ছে সময় প্রবাহ। ঘটনাই হলো পরিবর্তনশীলতা বা বিবর্তন।
এখন আমরা জানি উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতে আজ এত সৌন্দর্য ও বৈচিত্র তা এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে। এর ফলেই আমরা এই সংস্কৃতিক বোধের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম যে মানুষ ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে অতি নিম্নতর প্রাণী থেকে এই পর্যায়ে এসেছে। তখন আমাদের সংস্কারবোধ এইভেবে শান্তি পেয়েছিলো যে আমরা হলাম প্রাণী বিবর্তনের শ্রেষ্ঠ ফসল। আর কেউ চিন্তা বা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে না। কিন্তু ইদানিংকালে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে শিম্পাঞ্জিদেরও সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে চলেছে, তিমিরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান প্রাণী, পৃথিবী দুই প্রান্তে দুটো তিমিকে রেখে দিলে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে, আমরা এখনও জানি না কি কথা বলে তারা? তবে এদেরও নিজস্ব সমাজ ও ভাষা আছে এটা নিশ্চিত। আর আমরা মানুষেরা এদের সবার বিকাশকে শুধু বাধাগ্রস্থই নয় অনেক ক্ষেত্রে ধ্বংসই করে ফেলেছি, অথচ এই পৃথিবীতে অধিকারতো সকল প্রাণীর জন্য সমান। আমাদের মানব প্রজাতির বিবর্তন নির্ভর করেছিল ডাইনোসরের বিলুপ্তির উপর এবং বরফ যুগের ফলে বনভূমির পশ্চাদসরণের উপর। তারা যদি ধুমকেতুর পতন বা মহাজাগতিক কোন বিপর্যয়ের কারণে ধ্বংস না হতো তাহলো সবুজ চামড়া বিশিষ্ট চার মিটার লম্বা মনুষ্য আকৃতির এক ধরনের ডায়নোসর ছিল যাদের আমাদের মতো উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটানোর সম্ভাবনা ছিল; তখন তারাই হয়তো বলতো আমরাই সৃষ্টির সেরা। এই সমস্ত বোধ ও উপলব্ধি দ্বিতীয় সহস্রাব্দে শেষার্ধে এসে অর্জন করতে শুরু করেছি যা তৃতীয় সহস্রাব্দে আন্তঃপ্রজাতির ক্ষেত্রেই মানবিকতা প্রসারিত হবে না শুধু, বরং বর্হিজাগতিকদের সন্ধান পেলে আন্তঃনাক্ষত্রিক সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে কাজে আসবে।
আসিফ
ডিসকাশন প্রজেক্ট
discussionproject@gmail
www.discussionprojectbd.org
মন্তব্য
ধন্যবাদ,ভালো লাগলো।ইউএফও এবং পৃথিবী বাইরে প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে আপনার কোনো লেখা পেলে আরো ভালো লাগবে।
ভালো লাগল। একটা অনুরোধ, প্যারাগ্রাফগুলির মাঝে যদি আরেক লাইন করে ফাঁক দেন, তাহলে পড়তে আরাম হয়।
আসিফ ভাইকে স্বাগতম
নিয়মিত লেখার অনুরোধ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সচলে স্বাগতম আসিফ ভাই।
নিয়মিত লিখবেন আশা রাখি।
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
নতুন মন্তব্য করুন