হালকা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ভিজতে কখনই খারাপ লাগে না বাবলার। বিকেল হলে কোয়ার্টার মাঠে ফুটবল খেলা যেত। এখন সন্ধ্যা, তাই ইচ্ছে করলেও খেলা যাবে না।
রাস্তার দুপাশে বিশাল গাছগুলোর ছায়াগুলো বাবলাকে সঙ্গ দেয়। মনে হয়, সে ঠিক যেন এক শিশু, গাছগুলো তাকে জায়গা করে দিচ্ছে, তাকে ছায়া দিচ্ছে। ছায়াগুলো দেখে বাবলা ভয় পায়নি কখনো। এ গাছগুলো তাকে একমুঠো শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় সবসময়। এরা বাবলার বড্ড আপনজন।
বাবার কথা শুনলে তার মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। পৃথিবীতে সে যত মানুষকে ভয় পায়, তার মাঝে বাবা একজন। বাবার সামনে শেষ কবে সে ভাত খেতে বসেছে তা বাবলার খেয়াল নেই। বাবা না থাকলে সে মুক্ত পাখির মতো। কোয়ার্টারের ভেতর-বাহির, স্কুলের বিশাল মাঠ জুড়ে তার বিশাল সাম্রাজ্য। অথচ, বাবার সামনে দাঁড়ালেই সে এতটুকুন হয়ে যায়। কোন কথার জবাব দেয় না। আগে জবাব না দিলে কিছু বকাঝকা জুটত, এখন উত্তম মধ্যমের উপরেই সব চলে। মা কিছু বলেন না। বাবা চলে গেলে খালি আদর করে দেন। পিঠের বেতের বাড়িগুলোর ক্ষতে সেঁক দিয়ে দেন। বাবার সামনে যেন মাও বন্দি পুতুল।
মাঝে মাঝে বাবলার ছোটবেলার কথা মনে হয়। তারা যখন গ্রামে থাকত, তখন বাবা এমনটা ছিলেন না। খুব শান্ত ছিলেন, বাবলাকে খুব আদর করতেন। এমন বর্ষাকালে মাকে নানাবাড়িতে নিয়ে যেতেন। পুরো একটা ট্রলার ভাড়া করে ওরা নানাবাড়ি যেত। দুইঘন্টার পথ, অথচ মনে হত কত তাড়াতাড়ি পথ কেটে গেছে।
আর এখন বাবার সামনে দাঁড়ালে সময় যেন আর চলে না, থেমে থাকে। কথা কখন শেষ হবে সে ভাবনায় থাকে বাবলা, বাবার কথা শোনেও না। শেষ হলে আস্তে আস্তে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ে।
বাবলা রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে থাকে। কোয়ার্টারের বাইরে চলে এসেছে, এখন যাচ্ছে ফ্যাক্টরির দিকে। মাঝে মাঝে ওখানে রনিরা আড্ডা দেয়, যদি ওরা থাকে, তাহলে ওদের সাথে আড্ডা দেবে।
হাইওয়ে পার হল সে। সামনেই একটা বিশাল বড় দালান। এটাই বাবার ফ্যাক্টরি। দুবছর আগে বাবলার বাবা এখানে একটা চাকরি পায়। বাবা গ্রাম থেকে সবাইকে নিয়ে এখানকার কোয়ার্টারে উঠলেন, সবাই মানে মা, দাদী, বাবলা...। আর এখানে এসেই সব কিছু বদলে গেল। হাসিখুশি মা হয়ে গেলেন নিরুত্তাপ মূর্তি, দাদীর অসুখ গেল বেড়ে, আর বাবার মেজাজ গেল বিগড়ে। বাবলার বাসায় আর মন টেকে না। সারাদিন বাইরে খেলে কাটায়। অথবা ঠিক আজ রাতের মতই হাঁটে উদ্দেশ্যহীনতায় ভুগতে ভুগতে।
ফ্যাক্টরির গেটের পাশের ছোট গলিটার ভেতর দিয়ে ঢুকল বাবলা। কারখানার এপাশটায় অফিস, তাই মাথার উপরে তাকালেই এসির পানি টপ করে চোখের উপর পড়ে।এসির জন্য জানালাগুলো বন্ধ থাকে সবসময়, কখনো খোলা হয়না।
কিন্তু বাবলা সামনে একটা জানালা খোলা দেখতে পেল; সেটা থেকে আলোও আসছে। বাবলা জানালার কাছে এসে আস্তে করে উঁকি দিল।
ভিতরে একজন লোক চেয়ারে বসে আছে, ফ্যাক্টরির অফিসার হবে সম্ভবত। আরেকজন লোক মাথার উপরে এসিটা ঠিক করছে। বসে থাকা লোকটা আপনমনে সুর ভাজছে, আর মাঝে মাঝে অন্যজনকে ধমক মারছে, ‘ওই হারামজাদা, ঠিক হইল না এখনও? তাড়াতাড়ি কর, গরমে তো ভিজে গেলাম...’
লোকটার ঘাম পড়ে দাঁড়ানোর টুলের উপর। লোকটা কিছু বলে না। চুপচাপ কাজ করে যায়।
হঠাৎ স্ক্রু-ড্রাইভার নেবার জন্য নিচু হতে যায়। নিজের কয়েক ফোটা ঘাম গিয়ে পড়ে মনিবস্বরুপ ওই অফিসারের ঘাড়ে। লোকটা রাগে চিৎকার করে উঠে। ‘হারামির বাচ্চা, ঘাড়ের উপর পানি ফেলছিস কেন!!’, বলে কসিয়ে চড় বসিয়ে দিল কর্মচারীর গালে।
লোকটা টুল থেকে সশব্দে মেঝেতে পড়ে গেল। উঠে দাঁড়াবার সময় তার চোখ গেল জানালার দিকে।
এতক্ষণে বাবলা বুঝল লোকটাকে চেনা চেনা লাগছিল কেন।
লোকটা অস্ফুট স্বরে বলে উঠে, ‘খোকা!’
বাবলার বাবার উপর জমে থাকা সকল রাগ উবে গেল। এক নিমিষে বাবলা তার বাবাকে ক্ষমা করে দিল।
__________________________________
মেঘদুত
মন্তব্য
ভালো হয়েছে। একটু খটকা লাগলো, প্রথম লাইনটা পড়ে ভেবেছিলাম বাবলা এই মাত্র বকা খেয়ে বাসা থেকে বের হয়েছে, হিসাব মতে বাবা বাসায় ফিরে বকা দিয়েছে। শেষে এসে বাবাকে অফিসে দেখে একটু অবাক হলাম।
হুম...কিন্তু বাবলার বাবা মনে হয় ওকে বকা দিয়ে আবার একটু বাইরে এসেছিল, বাবলা সেটা খেয়াল করে নাই ...
পড়ার জন্য
গল্পের শুরু আর শেষটায় খটকা কিন্তু এমনিতে বেশ ভালো লাগল গল্পটা।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
খটকাটা দেয়ার পর আমার মনে হয়েছিল, কিন্তু কি আর করা...
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ পাগল মন...
গল্পটা ভালো লেগেছে। লেখতে থাকুন। ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠলে আমরাও একদিন দারুণ সব লেখা লেখবো ঠিক না ভাইয়া? শুভকামনা।
এক্কেরে ঠিক কইছেন আয়নামতি...আপনেরেও অনেকগুলান ...
ভালো থাকুন, আপনার লেখা পড়েছি, আরও লিখুন।
অনেক ভালো লেগেছে।
labin rahman
সুন্দর হয়েছে
...আপনাকেও ধন্যবাদ সাত্যকি।
লিখতে থাকুন, ভালো লেগেছে।
লেখা চলুক।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ভালো, তবে একটু খটকা বিদ্যমান । যে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাবলা ভেতরের কথোপথন শুনছিল সেটা কি খোলা ছিল? আসলে খোলা না থাকার সম্ভাবনাই বেশী ( যেহেতু এ সি রুমের জানালা)। যদি তাই হয় তাহলে বন্ধ জানালার ওপাশ থেকে কথা শোনাটা একটু ডিফিকাল্ট নয় কি? আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যদি আমি ভুল কিছু বুঝে থাকি। ধন্যবাদ।
আপনাকে ধন্যবাদ তুষার শুভ্র।
ভালো লাগসে, চলুক
খটকা-টটকা বুঝি না, গল্প ভালো লেগেছে...
চলতে থাকুক জোরে-শোরে...
নতুন মন্তব্য করুন