প্রতি বছর এই সময় সুইডেনের প্রায় সব গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের ছেলে মেয়েদের মাঝে ইন্টার ইউনিভার্সিটি ব্রানবল টুর্নামেন্ট হয়। ব্রানবল খেলার সাথে ক্রিকেটের কিছু মিল খুঁজে পাওয়াতে কিছু না বুঝেই আগ্রহী হয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টিমে নাম দিয়ে ফেলি! এবারের হোস্ট আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। আগেই বলে নেয়া ভালো এই টুর্নামেন্টটি মোটেই কোন সিরিয়াস টুর্নামেন্ট না। এটা মূলত সবাই মিলে মজা করার একটা উপলক্ষ মাত্র। তবে কিনা, মজা করার ফাকে ট্রফিটা হোস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জিতে নেয়াও একটা ঐতিহ্য। সেটা নিশ্চিত করতেই বোধহয় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি টিম আসলেও হোস্টরা চাইলে একাধিক টিম নিয়ে খেলতে পারে!
ক্রিকেটের সাথে খেলাটির যেটুকু মিল:
১। ব্যাটসম্যান সজোরে বলে ব্যাট চালাবে, প্রতি বলে ছক্কা-চার এর মত করে মারার চেষ্টা করবে।
২। ব্যাটবলে ঠিকঠাক মত টাইমিং করে দূরে দিতে পারলেই রান নেয়ার জন্য ছুটতে হবে।
৩। উইকেট কিপারের মত একজন থাকে যে কিনা আউটিং বেস (ভাবুন ক্রিকেটের স্ট্যাম্পের বদলে একটি চাকতি মাটিতে ফেলে রাখা) এর সামনে দাড়িয়ে থাকে এবং ফিল্ডারদের কাছ থেকে বল ফেরত পেলে হাতে বল ধরে শরীরের যে কোন অংশ সেই প্লেটের সাথে লাগিয়ে ব্যাটসম্যানকে ব্রানড (ভাবুন রান আউট) করার চেষ্টা করে।
৪। ক্যাচিং টিম (ফিল্ডার) ফিল্ডিং করে এবং ক্যাচ ধরে।
ক্রিকেটের সাথে অমিল:
পুরোটাই প্রায় ক্রিকেটের সাথে অমিল কিন্তু যেগুলো মিলতে মিলতেও মিলে নাই-
১। বার্নার (ভাবুন উইকেট কিপার) ব্যাটসম্যানের পেছনে না দাঁড়িয়ে সামনে দাড়ায়।
২। ক্যাচ ধরলে ব্যাটসম্যান আউট হয়না কিন্তু ক্যাচিং টিম পয়েন্ট পায়। এক হাতে ধরলে ৩ পয়েন্ট আর দুই হাতে ধরলে ১ পয়েন্ট।
৩। ব্যাটসম্যান একজন একজন করে না নেমে এক সাথে সবাই নেমে ব্যাটিং করার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
৬। পুরো খেলাটা ৩০ মিনিটের! ১৫ মিনিট ফিল্ডিং, ১৫ মিনিট ব্যাটিং।
৭। দুই রকমের ব্যাট আছে, একটা বেস বলের ব্যাটের মত আরেকটা অনেকটা তক্তা কেটে বানানো ক্রিকেট ব্যাটের মত। যেটা দিয়ে খুশি ব্যাটিং করা যায়।
৮। কোন জার্সি নাই। বরং খেলার সময় যেমন খুশি তেমন সাজো টাইপের একটা ব্যাপার প্রচলিত।
৯। দলে অন্তত তিনজন মেয়ে খেলোয়াড় রাখা বাধ্যতামূলক।
এসব আপাত সহজ নিয়ম কানুন শুনে বীরবিক্রমে ক্রিকেট মূর্খ সুইডিশদের একটি দলে যোগ দিলাম। তারাও আমাদের বিশেষ মর্যাদায় টিমে স্থান দিলো; বিশেষ করে বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়ান ছাত্রদের। কেননা ওদের ভাষায়, আমরা ক্রিকেট নামক সাংঘাতিক এক খেলায় প্রতি পক্ষের ভয়ঙ্কর গতিতে ছুঁড়ে মারা কাঠের বলও হিট করে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারি। আর এখানে তো নিজেই ইচ্ছামত একটা লোপ্পা বল বানিয়ে শুধু বাড়ি মারতে হবে। যাই হোক ট্রফি নিশ্চিত করার জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বমোট ৩টি দল গঠন করা হয়েছে। ২টি হার্ড-কোর সুইডিশ টিম যারা কিনা ছোটা বেলা থেকে ব্রানবল খেলার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন; আর আমাদের টিম, যেখানে সুইডদের সাথে আমারা আছি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, আজারবাইজানের ছাত্র ছাত্রিরা। এই দলে বেশির ভাগই ক্রিকেট স্পেশলিস্ট! শুধুমাত্র ৩ জন দলে পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন খেলোয়াড়। বাকিরা আমরা জীবনেও এইসব খেলা চোউক্ষে দেখি নাই।
টুর্নামেন্টের আগের উইক-এন্ডে প্র্যাকটিস করতে নেমে বুঝতে পারলাম ক্রিকেট খেলার সাথে ব্রানবলের কিছুই মিল নাই। মুখে বর্ণনা শুনে সহজ মনে হলেও ইহা মটেই কোন সহজ জিনিশ নয়। নিজ হাতে উপরে বল ছুঁড়ে দিয়ে ব্যাটে লাগানোই বিড়াট সমস্যা হইয়ে দাঁড়ালো। লাগলেও বল ফিরিয়ে দেয়ার আগে চারটি বেইস এর বাইরে দিয়ে দৌরে আবার আগের যায়গায় ফিরে আসাটা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের অবস্থা দেখে এই দলের উপর সবাই আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্কল্প ছিল- বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্রমেদিনী। আমাদের দল অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি দল কে হারিয়ে শেষমেশ কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌছায়। অবশ্য আমারা বাদ পড়লেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরই বাকি দুটি দলের একটি ফাইনালে চ্যাম্পিয়ন হইয়ে ঐতিহ্য বজায় রাখে।
সংক্ষেপে খেলার নিয়ম কানুন:
ব্যাটসম্যান ছবিতে মার্ক করা যায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেই এক হাতে বল কিছুটা উপরের দিকে ছুড়ে দিয়ে সজোরে ব্যাট চালিয়ে যতদূর সম্ভব দূরে পাঠানোর চেষ্টা করবে এবং সাথে সাথে ব্যাট ফেলে দৌড়ে ১, ২, ৩ নং পজিশন গুলো ঘুরে আসতে হবে। ব্যাটিং করার পর ক্যাচিং টিম বল কুড়িয়ে আউটিং বেইস এ ফেরত পাঠানোর আগেই ব্যাটস ম্যান ১,২,৩ ঘুরে ৪ নং রেগুলার বেইস এ ফিরে আসতে পারলে একটি হোম রান, অর্থাৎ ৫ পয়েন্ট। যে কোন দুটি রেগুলার বেইস এর মাঝখানে থাকা অবস্থায় আউটিং বেইস এর সামনে দাঁড়ানো খেলোয়াড় বল ধরে আউটিং প্লেটে পা রেখে ব্রানড বলতে পারলে সেই ব্যাটস ম্যান আউট। তার মানে সে পেছনের রেগুলার বেইস এ ফেরত যাবে। ক্যাচিং টিম একটি পয়েন্ট পাবে। ব্যাটিং করার পর এক দৌড়ে সব গুলো রেগুলার বেইস পার হবার আগেই আউট হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকলে যে কোন একটি বেইস এ দাঁড়িয়ে গেলে নিরাপদ থাকবে। এভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ৪ নং বেইস এ ফিরে আসলে ১ পয়েন্ট করে পাবে। অন্য ব্যাটসম্যানরা তার পেছনে পরের বার ব্যাট করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। ছবিতে দেখানো পিঙ্ক রং এর দাগ দিয়ে করা কোনের মত মাঠে একটি কাল্পনিক কোন ভেবে সীমানা ঠিক করে নিতে হবে এবং ব্যাটিং এর পর সেই সীমানার ভেতরে বল থাকতে হবে। সামনের দিকে কোন সীমানা থাকবে না। ব্যাটস ম্যান প্রথম বার ব্যাটে বলে এক না করতে পারলে অথবা ঐ গোলাপি কাল্পনিক কোনের ভেতর বল না রাখতে পারলে আরও দুবার বার ব্যাট করার সুযোগ পাবে। সময় অপচয় করা যাবে না। কারণ প্রতি টিমের জন্য সময় নির্দিষ্ট। তারপরও কেউ ব্যাটে বলে সংযোগ ঘটাতে না পারলে ১ নং বেইস এ দাঁড়িয়ে থাকবে। পরবর্তী ব্যাটসম্যান ব্যাটং করলে তখন দৌড়ে রান নিতে পারবে। খেলার জন্য পূর্বনির্দিষ্ট সময় এর মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাটসম্যানরা হোমে ফিরে আসতে থাকবে অর্থাৎ হোমে কেউ না কেউ ব্যাটিং করার মত কেউ থাকবে ততক্ষণ খেলা চলতে থাকবে। কোন ফিল্ডার এক হাতে ক্যাচ ধরলে ক্যাচিং টিম ৩ পয়েন্ট পাবে আর দুই হাতে ধরলে পাবে ১ পয়েন্ট। তবে ব্যাটসম্যান রান নেয়ার মধ্যবর্তী সময় ব্রান এর কাছে ফেরত পাঠাতে না পারলে ব্যাটস ম্যান আউট হবে না। সাধারণত প্রতি টিম ১৫ মিন করে ব্যাটিং এবং ১৫ মিনিট ফিল্ডিং করে থাকে। সর্বমোট খেলোয়াড়ের সংখ্যার উপর নির্ভর করে সময় কমানো বাড়ানো যেতে পারে।
ছবিঃ এই দলটি নিজেদের কে বড় বড় বাক্সের ভেতর ভরে নিয়ে এসেছিলো। তারা ফিল্ডিং করতে গিয়ে একবার শুয়ে পড়লে আর উঠতে পারতো না। তাদের সাথেই আমাদের প্রথম জয়টা এসেছে!
নিকঃ ছাইপাঁশ
রকিবুল ইসলাম কমল
মন্তব্য
পোস্টে বাক্সবন্দি খেলোয়াড়দের ভালো মত বোঝা যাচ্ছে না। তাই এই দুটি ছবি সংযোগ করলাম।
-ছাইপাঁশ
ব্র্যায়েনবোল জিনিসটার সাথে ক্রিকেট থেকে বেইযবলের মিল বেশি।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
হ্যাঁ, চার বেইসে, রান, হোমরান, ক্যাচিং ইত্যাদির প্যাটার্নে তাই মনে হয়। খালি পিচারের বদলে নিজেই বল তুলে মারতে হয়, আর কিপার (?) সামনে দাঁড়ায়।
বেসবল খেলাটা মোটেই বুঝতাম না একসময়। এখন মোটামুটি বুঝি।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
নতুন মন্তব্য করুন