পূর্বপুরুষ কথা (প্রথম পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১৪/০৫/২০১১ - ৮:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৮৫৬ সালের অগাস্ট মাসের রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক প্রভাত । উত্তর-পশ্চিম জার্মানির নিয়ান্ডারথাল উপত্যকার চুনা-পাথরের খনিতে সেদিনের কর্মব্যস্ততা মাত্র শুরু হয়েছে । হঠাৎই এক শ্রমিকের শাবল শক্ত কিছুতে বাড়ি খেয়ে ঠং করে আওয়াজ করে উঠল । শ্রমিকটি আগ্রহী হয়ে আরেকটু খুড়েই দেখতে পেলো কিছু হাড়-গোড় । হয়তো পাহাড়ী ভালুকের হাড় এই ভেবে সে সেগুলো পাশে সরিয়ে রাখলো পরে দেখার জন্যে । ওই দিনই খনি শ্রমিকটি হাড়গুলো দেখাতে নিয়ে গেলো জোহান ফুলরোট এর কাছে । ফুলরোট তখন ঐ অঞ্চলের একটি স্কুলে পড়ান আর অবসর সময়ে শখের প্রাণীতত্ত্ব চর্চা করেন । তিনি এক নজর দেখেই বুঝতে পারলেন এ কোনো ভালুকের হাড় নয়। এ আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু । তিনি দেখলেন এর করোটির আকার সাধারন মানুষের করোটির মত হলেও আকৃতিতে রয়েছে অনেক অসামঞ্জস্যতা । কপালের হাড় ঢালু হয়ে নেমে এসে চোখের উপর উঁচু আকার নিয়েছে । নাকটা যেনো অনেক খাড়া আর সামনের পাটির দাঁতগুলো অদ্ভুত রকমের লম্বা । তার উপর আবার চোয়াল পেছন থেকে স্ফীত হয়ে সামনের দিকে এসেছে । শরীরের অন্যান্য যেসকল হাড় পাওয়া গিয়েছে সেগুলোও সাধারন মানুষের মত কিন্তু আরো খাটো, গাট্টাগোট্টা ও শক্তিশালী । সবকিছুই যেনো ইঙ্গিত করছিল এই হাড় বিশেষ কিছু । ফুলরোট অনুধাবন করতে পারলেন ঐ ভূ-গর্ভস্থ খনির মধ্য হতে পাওয়া এ হাড়গুলো অসামান্য প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব ধারন করছে ।
ফুলরোট তখন নিকটবর্তী বন বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের প্রফেসর হেরমান শ্যাফহোজেন এর শরণাপন্ন হলেন । শ্যাফহোজেন-ও মুহূর্তেই স্বীকার করে নিলেন যে এই হাড়গুলো আসলেই অসাধারন । তিনি হাড়গুলোকে বর্ণনা করলেন তখন পর্যন্ত অনাবিস্কৃত এক প্রাকৃতিক উপযোজন বলে । শ্যাফহোজেন এই হাড়গুলোর মালিক কে ‘নিয়ান্ডারথাল মানব’ নাম দিয়ে বললেন এরা হয় মানব-জাতির নতুন কোনো প্রকরণ অথবা প্রাচীনতম উদাহরন । তিনি এমনকি নিজের সন্দেহের কথাও স্বীকার করলেন যে ‘নিয়ান্ডারথাল মানব’-ই খুব সম্ভবত আমাদের আদি-পুর্বপুরুষ । কিন্তু ফুলরোট ও শ্যাফহোজেন হতাশ হয়ে লক্ষ্য করলেন তাদের এই আবিস্কার তেমন একটা আশানুরুপ সাড়া ফেলতে পারছে না । তখনো ডারউইন তার বিখ্যাত বিবর্তনবাদ প্রকাশ করেন নি ( ‘The Origin Of Species’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ সালে, আরো ৩ বছর পর ) । অধিকাংশ বৈজ্ঞানিকই এই কথা স্বীকার করতে চাইলেন না যে মানব-জাতি অন্য কোনো প্রজাতি হতে বিবর্তিত হয়ে এসেছে । তারা ‘নিয়ান্ডারথাল মানব’-তত্ত্ব হেসেই উড়িয়ে দিলেন । তখনকার এক সুনামধন্য প্যাথোলজিস্ট রুডলফ ভিরশোও নিয়ান্ডারথাল মানবের হাড়গুলো পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে রায় দিলেন এগুলো সাধারন মানুষেরই হাড় যে কি না বিশেষ ধরনের কোনো হাড়ের রোগে ভুগছিলো । অন্যান্য বিশেষজ্ঞরাও তার পথই অনুসরন করলেন । উনিশ শতকের শেষে অবশ্য ডারউইন-এর বিবর্তনবাদই বৈজ্ঞানিক বলয়ে সুদৃঢ় অবস্থান নেয় । কিন্তু ফ্রান্সের গ্যাব্রিয়েল ডি মার্তিলির মত কিছু বৈজ্ঞানিক তা মানতে চাইলেন না । তারা তাদের দাবীতে অটল থাকলেন যে নিয়ান্ডারথাল মানব ই আমাদের আদি পূর্বপুরুষ ও আধুনিক মানুষের উৎপত্তিস্থল ।
পরবর্তীতে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও জার্মানিতে আরো কিছু নিয়ান্ডারথাল মানবের জীবাশ্ম আবিস্কৃত হল । কার্বন ডেটিং পরীক্ষায় দেখা গেল যে এই সব জীবাশ্মের বয়স কম করেও ১,১০,০০০ হতে ৩৫,০০০ বছর । কাজেই এটা প্রমাণিত হল যে তারা নতুন কোনো প্রজাতি নয় কিংবা রোগাক্রান্ত কোনো মানুষের হাড়-ও নয় । কিন্তু মার্সেলি বাউলি নামক আরেক ফরাসির নেতৃত্ত্বে অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক নিয়ান্ডারথাল মানব-কে মানবজাতির আদি পূর্বপুরুষ আখ্যা দিতে অস্বীকৃতি জানালেন । তারা বললেন যে একটি পুরাতন কঙ্কাল এই প্রমান করে না যে তারাই আমাদের আদি পূর্বপুরুষ । বাউলি বললেন বাঁকা হাটু, দাবানো ঘাড় আর ধনুকের মত মেরুদন্ড নিয়ে নিয়ান্ডারথাল মানব যতটা না মানুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তার চাইতে বানরের সাথে সাদৃশ্যতাই বেশি । বাউলি এমন কি এও স্বীকার করতে চাইলেন না যে নিয়ান্ডারথাল মানব আমাদের নিকটতম আত্মীয়ও হতে পারে । বাউলি নিজের বক্তব্যের সমাপ্তি টানলেন এই বলে যে বড়জোর এটা হতে পারে আমাদের প্রকৃত পূর্বপুরুষরা নিয়ান্ডারথাল মানবদের প্রজাতিকে বিপদজনক হিসেবে গন্য করে নিশ্চিহ্ন করে দেন ।
বিংশ শতাব্দী জুড়ে বিজ্ঞানের এই বিতর্ক শুধু বাড়তেই থাকলো । একদিকে ছিলেন মার্তিলির সমর্থকেরা যারা নিয়ান্ডারথাল মানবকে আমাদের সরাসরি, আদি এবং প্রাচীনতম পূর্বপুরুষ হিসেবে স্বীকার করলেন আর অপরদিকে ছিলেন বাউলির সমর্থকেরা যারা নিয়ান্ডারথাল মানবকে খুব বেশি হলে আমাদের সুদূরতম আত্মীয় বলতে রাজী ছিলেন যাদের নিয়তিই ছিল আধুনিক মানব প্রজাতির হাতে নিজেদের বিবর্তনের সমাপ্তি টানা ।
অবশেষে এই দুই মতের মধ্যে সেতুবন্ধন শুরু হল । (চলবে)
অজ্ঞ বালক


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

চমৎকার! শিঘ্রী বাকি পর্বগুলো চাই কিন্তু। হাসি

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

যার লেখার ভক্ত তার থেকে প্রশংসা পেলে ভালো লাগে বই কি । অসংখ্য ধন্যবাদ মোর্শেদ ভাই । পর্বরা আসছে ।

কবি-মৃত্যুময় এর ছবি

এন্থ্রোপোলজি সবসময়ই আকর্ষণ করে। লেখাটি সাবলীল হয়েছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

এনথ্রপলজী আমারো পছন্দের বিষয় । অনেক অনেক ধন্যবাদ । সাথে থাকবেন আশা করি ।

ধৈবত(অতিথি) এর ছবি

পরের পর্ব জলদি রিলিজ করেন

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

দুইটা দিন ধৈর্য্য ধরেন । আসিতেছে । দেঁতো হাসি

রু (অতিথি) এর ছবি

ভালো লাগলো।

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

ধন্যবাদ । সাথে থাকবেন আশা করি । হাসি

মাহবুব রানা এর ছবি

মাত্রই গতকাল হিস্ট্রি চ‌্যানেলের Ape to Man দেখে শেষ করলাম আর আজকেই আপনার এই পোস্ট, দরুন তো! সাধারন পাঠক গুবলেট করে ফেলতে পারে (যেমনটি হয়েছিলো আমার) এই আশংকায় খুটিনাটি তথ্যগুলো এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ রইলো।
'মিসিং লিংক' এর খোঁজ-খবর চলুক। চলুক

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

হা হা হা । এরই নাম কাকতাল । আপনার পরামর্শ সাদরে গৃহীত হল । চলতে থাকুক খোঁজ উৎস সন্ধানের । হাসি

আয়নামতি1 এর ছবি

পূর্বপুরুষদের কথা পড়তে বেশ লাগছিল, কিন্তু ছোট্ট পোষ্ট দুম করেই শেষ হয়ে গেল ওঁয়া ওঁয়া

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

ইকটুশ খানি অপেক্ষা করেন । দ্বিতীয় পোস্ট আসবে শিগগিরি । সাথে থাকুন ।

guest_writerকৃত্যদাস এর ছবি

ধুম করে শেষ হয়ে গেল!!!! জানার ছিল অনেক কিছু। বাকি অংশ চাই শীঘ্রই। হতাশ করবেন না আশা করি। ধন্যবাদ

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

বেশী ছোটো হয়ে গেছে না কি ? বুঝতে পারি নি একদম । মন খারাপ পরের পর্ব আগামিকাল প্রকাশিতব্য । সাথেই থাকবেন আশা করি । হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

পরের পর্বের অপেক্ষায়

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

কাল্কেই পোস্ট করতে পারবো আশা করি । সাথে থাকুন এই কামনায় । হাসি

সজল এর ছবি

ভালো লিখেছেন। আর বিষয়টা আমার এত প্রিয়। "বিকামিং হিউম্যান" নামের ডকুমেন্টারি দেখেছেন? না দেখে থাকলে দেখে নিতে পারেন। আর, এর পরের পর্ব লিখার সময় প্রিভিউতে দেখে নিবেন, প্যারাগ্রাফগুলো আলাদা দেখা যাচ্ছ কিনা, দরকারে একবার বেশিই রিটার্ন/এন্টার কী চাপুন।

আর নিয়মিত লিখুন।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

আগে ধন্যবাদ নিন এত চমৎকার মন্তব্যের জন্যে । চলুক আসলে প্রথমবার তো তাই ভুল হয়ে গেছে । পরের বার সুধরে নেব । চেষ্টা করবো নিয়মিত হওয়ার । সাথে থাকবেন আশা করি । ভালো কথা , ডকুমেন্টারি টার কোনো লিঙ্কু দিতে পারবেন কি ? হাসি

সজল এর ছবি

এখানে পাবেন। আর যদি এক্সেস করতে না পারেন, টরেন্টে খুঁজলেই পেয়ে যাবেন।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

লাখ লাখ না না কোটি কোটি ধন্যবাদ নিয়েন । দেঁতো হাসি

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

বাকি পর্বের অপেক্ষায় আছি।

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

সবাই এভাবে বলছেন যে এখন চিন্তায় আছি কতটুকু ভালো লিখতে পারবো । সাথেই থাকুন । পর্ব ২ আশছে । হাসি

কৌস্তুভ এর ছবি

এইটা খুব ইন্টারেস্টিং বিষয়। নিয়মিত লেখেন।

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

আমারো দারুন লাগে বিষয়টা নিয়ে পড়তে তাই অল্প বিস্তর যা জানি তাই লিখছি । দ্বিতীয় পর্ব দিলাম । পড়বেন আশা করি । হাসি

পূর্বপুরুষ কথা ( দ্বিতীয় পর্ব )

সাফি এর ছবি

টেস্ট

সাফি এর ছবি

দারুন লাগলো

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

ধন্যবাদ। আশা করি পরের পর্বটাও ভালো লাগবে । সাথে থাকুন । হাসি

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

এই বালককে অজ্ঞ বলবো কেন?

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অজ্ঞ বালক ( অতিথি ) এর ছবি

হা হা হা । মজা পাইলাম । হো হো হো আসলেই বালক অজ্ঞ । কিন্তু ভাবিস্ট মানুষ তাই ভাব নেয় বিজ্ঞের । গড়াগড়ি দিয়া হাসি

নাশতারান এর ছবি

আমার প্রিয় বিষয়। চলুক।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।