বাউলির সমর্থকেরা প্রথম থেকেই নিয়ান্ডারথাল মানব-কে আধুনিক মানব জাতির পূর্বপুরুষ বলতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন । তাদের এই বিরোধিতা নতুন রূপ নেয় বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে । নিয়ান্ডারথাল মানব-এর মত করেই হঠাৎ আবির্ভাব ঘটে পিল্টডাউন মানব-এর । ১৯১২ সালে সৌখিন জীবাশ্মবিদ চার্লস ডাওসন ইংল্যান্ড এর সাসেক্স শহরের পিল্টডাউন নামক স্থানে এই সুবিখ্যাত আবিস্কারটি করেন । নিয়ান্ডারথাল মানব বৈজ্ঞানিক মহলে অত্যন্ত উপেক্ষিত হয়েছিল । পিল্টডাউন মানব-এর ক্ষেত্রে ঘটলো তার উল্টোটাই । মুহূর্তের মাঝে এই নতুন আবিস্কার নিয়ে পৃথিবীজুড়ে আলোচনার ঝড় উঠলো । তার একটি প্রধান কারন ছিল এই যে মানুষের কঙ্কালের সাথে পিল্টডাউন মানব-এর সাদৃশ্য ছিল লক্ষ্য করার মত । বানর প্রজাতির সাথে পিল্টডাউন মানবের সাদৃশ্য ছিল শুধুমাত্র চোয়ালের গঠনের দিক থেকে । কিন্তু, সেটাও বিজ্ঞানীরা আমলে আনলেন না তার চ্যাপ্টা, মসৃন ও সমতল দাঁত দেখে । বাউলির সমর্থকেরা এইবার পিল্টডাউন মানব কে নিজেদের পূর্বপুরুষ হিসেবে সাদরে গ্রহন করলেন ।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই যে, পিল্টডাউন মানব ঘটনাটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত ধোঁকাবাজী । খুব সম্ভবত ডাওসন নিজেই এই প্রতারনার সূচনা করেন । বেশী কিছু নয়, ডাওসন শুধু কিছু মানুষের অস্থি একত্রিত করেন আর তার সাথে যুক্ত করেন একটি ওরান-ওটাং এর চোয়াল । হাড়গুলোকে পুরোনো দেখাতে তিনি কিছু কৌশলের আশ্রয় নেন । সবশেষে গবেষকদের বিপথগামী করতে তিনি সুচারুরূপে ওরান-ওটাং এর দাঁতগুলোর ওপর নিজের চালিয়াতি বুদ্ধি খাটিয়ে দাঁতগুলো সমান ও মসৃন করেন । বলাই বাহুল্য যে ডাওসন এর এই বুদ্ধি কাজে লেগে যায় । দীর্ঘদিন পর ১৯৫৩ সালে কতিপয় বৈজ্ঞানিক পিল্টডাউন মানব-এর দাঁত এর উপর আনুবীক্ষণিক পরীক্ষা চালান এবং এই জালিয়াতির ঘটনা ধরা পরে । অবশেষে নিয়ান্ডারথাল মানব নিজের উপর সমস্ত বৈজ্ঞানিকদের মনোযোগ টেনে নিতে সক্ষম হয় ।
বিজ্ঞানীরা এতদিন শুধুমাত্র নিয়ান্ডারথাল মানবের সাথে আধুনিক মানুষের বৈসাদৃশ্যের তুলনা করছিলেন কিন্তু এবার কিছু সংখ্যক বিজ্ঞানী এগিয়ে আসলেন সাদৃশ্য খোঁজায় । ১৯৫৭ সালে দুই আমেরিকান এনাটমিস্ট উইলিয়াম স্ট্রাউস এবং এ. জি. ই. কেইভ নিয়ান্ডারথাল মানব এর ফসিল নিয়ে নতুন করে গবেষনা শুরু করেন । তারা একটি নির্দিষ্ট নিয়ান্ডারথাল মানব এর জীবাশ্মকে এ কাজের জন্যে বেছে নেন । এর নাম ছিল "লা চ্যাপেল-আউক্স-সেইন্ট", ১৯০৮ সালে দক্ষিন ফ্রান্সে যাকে আবিস্কার করা হয় । আর সবচাইতে বড় কথা হল এই ফসিলের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেই বাউলি নিয়ান্ডারথাল মানব-কে জংলী, অসভ্য ও মানব জাতি হতে ভিন্ন বলে রায় দিয়েছিলেন । স্ট্রাউস ও কেইভ প্রথমেই লক্ষ্য করলেন যে চ্যাপেল-আউক্স-সেইন্ট মানব খুব সম্ভবত আর্থারাইটিস এ ভুগছিল । বাউলি এ জিনিসটা লক্ষ্য করা সত্ত্বেও এরিয়ে গিয়েছিলেন । কিন্তু এখন এই আবিস্কারের ফলে নিয়ান্ডারথাল মানব-এর কুঁজো হয়ে দাড়ানোর পশ্চাদপট উদঘাটিত হয়ে গেল । অন্যান্য অংশ নিয়ে গবেষনা সম্পন্ন করার পর স্ট্রাউস ও কেইভ মন্তব্য করলেন যে আসলে নিয়ান্ডারথাল মানব-এর সাথে আধুনিক মানুষের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই । তারা এই মর্মে বিবৃতি দিলেন যে যদি এমন করা যেত যে একজন নিয়ান্ডারথাল মানব-কে পুনঃর্জীবিত করে গোসল করিয়ে, চুল-দাঁড়ি কেটে, পরিস্কার কাপড় পড়িয়ে নিউইয়র্কের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে তবে খুব সম্ভবত বাউলি-ও তাকে আলাদা করে চিনতে পারবেন না । পিল্টডাউন-পরবর্তী এই সময়ে নিয়ান্ডারথাল মানব-কে নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত পাল্টাতে লাগলো ।
১৯৬০ সাল নাগাদ আমেরিকান এনথ্রপলজিস্ট সি. লরিং ব্রেইস নিয়ান্ডারথাল মানব-দের নিয়ে এক নতুন ধরনের গবেষণা শুরু করলেন । তিনি নিয়ান্ডারথাল মানব-দের ব্যাবহৃত ছোটখাট যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, আবাসস্থল ও জীবনপ্রণালী নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষনা করলেন । ব্রেইস বললেন যে সকল স্থানে নিয়ান্ডারথাল মানব-এর জীবাশ্ম পাওয়া গেছে, সে সব স্থান হতে প্রাপ্ত ছাই হতে বোঝা যায় যে নিয়ান্ডারথাল মানব-রা তাদের সংগ্রহকৃত খাদ্য অগভীর গর্ত করে তাতে রান্না করে খেত যা পরবর্তীকালের মানব জাতিকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিল । এই পথ ধরে আরো অনেকেই এধরনের গবেষণায় আগ্রহী হয়ে উঠলে একসময় প্রমানিত হয় যে নিয়ান্ডারথাল মানব-রা যখন কাউকে কবর দিত তখন সুস্পষ্ট ভাবেই কিছু মানবিক আচার পালন করত । বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে প্রাপ্ত জীবজন্তুর হাড় সুনির্দিষ্ট ভাবে সাজানো থাকতো যা থেকে প্রমাণিত হয় যে নিয়ান্ডারথাল মানব-রা খুব সম্ভবত কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরন করতো । যুগোস্লাভিয়ার ক্রাপিনা নামক স্থানে প্রাপ্ত নিয়ান্ডারথাল মানব-এর খন্ড-বিখন্ড হাড়গুলো ছিল ক্যানিবালিজম এর স্পষ্ট নিদর্শন । এই ঘটনা যতই হিংস্র ও ভয়ঙ্কর হোক না কেন এরকম ছোট ছোট ঘটনা দ্বারাই নিয়ান্ডারথাল মানব-এর সাথে আধুনিক মানুষ-দের সম্পর্ক রচিত হয়ে যাচ্ছিল ।
১৯৭১ সালে নিয়ান্ডারথাল মানব-দের খ্যাতি শীর্ষে পৌছালো যখন র্যালফ সোলেকি তার গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করলেন । তার গবেষণার স্থান ছিল ইরানের শানিদার নামক এক গুহায় । সোলেকি এই গুহায় অবস্থিত নিয়ান্ডারথাল মানব-দের গোরস্থান হতে মাটির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে প্রচুর পরাগরেণুর উপস্থিতির প্রমান পেলেন । তিনি বললেন যে এই পরিমাণ পরাগরেণু বাতাসে ভেসে আসা সম্ভব নয় বা কোনো প্রাণীর পক্ষে বয়ে নিয়ে আসাও সম্ভব নয় । কাজেই তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, শানিদার গুহার নিয়ান্ডারথাল মানবরা খুব সম্ভবত তাদের প্রিয়জন-দের কবরে ফুল দিত । তিনি এ বিষয় নিয়ে একটি বই লিখে তার নাম দিলেন “The First Flower People” । বাড়তি প্রমান হিসেবে সোলেকি তার বই এ আরো যোগ করলেন যে এই গুহায় প্রাপ্ত একটি জীবাশ্ম ছিল বৃদ্ধ এক নিয়ান্ডারথাল মানবের যার একটি হাত ছিল অকেজো এবং যার একটি চোখ অন্ধ ছিল । কাজেই স্বাভাবিক বুদ্ধিবোধ অনুসারে বলা যায় যে তৎকালীন আদিম সমাজে তার অতি দ্রুতই মৃত্যুবরণ করার কথা । কিন্তু তার বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হওয়া প্রমান করে যে তার পরিবার ও গোত্র তার ভরন-পোষন করেছিল । সোলেকির এই বই দ্বারা নিয়ান্ডারাল মানব-দের রুপান্তর সম্পূর্ন হল । বাউলির কল্পনাপ্রসূত জংলী, আদিম ও বানরসদৃশ নিয়ান্ডারথাল মানব-কে এখন সহজেই আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ আখ্যা দেয়া যাচ্ছিল ।
এসময়ই সূচনা হল “Regional Continuity Theory” বা “আঞ্চলিক নিরবিচ্ছিন্নতা মতবাদ” এর । এই মতানুসারে আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ ছিলেন নিয়ান্ডারথাল মানবরাই তবে সেটা শুধু ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য । অনুরুপভাবে অন্যত্র একইরূপ প্রাচীন মানবগোষ্ঠী হতে আধুনিক মানবজাতির উদ্ভব হয়েছে । কিন্তু নিয়ান্ডারথাল মানব তত্ত্ব ও আঞ্চলিক নিরবিচ্ছিন্নতা মতবাদের সামনে আরো অনেক পথ বাকী ছিল । আরো অনেক বিতর্ক পাড়ি দিয়ে তাদের সামনে এগোতে হবে ।
প্রত্নতাত্ত্বিকেরাও নন, নৃতাত্ত্বিকেরাও নন । এবারে বিতর্কের সূচনা করলেন অনুজীববিদরা ।
( চলবে )
অজ্ঞ বালক
মন্তব্য
প্রথম পর্বের মতই দারুণ। দারুণ !!
এবার অনুজীববিদ-দের মল্লযুদ্ধ দেখার অপেক্ষা।
একটু অপেক্ষা করুন । অনুজীববিদ দের মল্লযুদ্ধ দেখার আমন্ত্রণ রইলো । সবশেষে ধন্যবাদ ।
ভাইজান, খুবই চমৎকার হচ্ছে। কিন্তু এতো ছোট কেনো?
ভাই রে, দুই তিন পাতার বেশি লেখতে খুবই বিরক্ত লাগে । তাই ধীরে ধীরে দিচ্ছি আর কি । দুঃখিত । একটু কষ্ট করে সাথে থাকুন । আর মাত্র দুই পর্ব ।
আরেকটু বড় করে দিলেই পারেন....
বাংলা লেখায় আগে অভ্যস্ত হইয়া নেই । তারপর বড় পোস্ট দিতে পারব। তার আগ পর্যন্ত একটু কষ্ট করে সাথে থাকুন ।
বাংলা বেশি লেখতে ভালো লাগে না তাই এই অবস্থা । একটু কষ্ট করে সাথে থাকুন ।
মানব-প্রাগিতিহাস-ভ্রমণ জারি থাকুক। চমৎকার । পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
আপনাদের দেয়া উৎসাহই আমার পথ চলার প্রেরণা । অশেষ ধন্যবাদ । সাথে থাকুন ।
___________________
রাতের বাসা হয় নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি
বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি
অশেষ ধন্যবাদ । সাথে থাকুন ।
পূর্বপুরুষেরা কম নাকানি চুবানি খাওননি দেখি! নিজেরাও খেয়েছেন অবশ্য ডাওসনের মত পাজি লোক সব যুগে সব সময়ই জ্বালিয়ে মারে দারুণ লাগলো যথারীতি! পরের পর্ব শীঘ্রই আসুক। শুভেচ্ছা।
পূর্বপুরুষরা বেশিই খেয়েছেন ধরা । তবে আমরাও কম অন্ধকারে নেই এখনো । আর ডাওসনের বুদ্ধির প্রশংসা কিন্তু করাই লাগে । আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য । পরের পর্ব আর দুই দিন পর । একটু অপেক্ষা করুন । শুভেচ্ছা রইলো ।
এবারে ফরম্যাটিং সুপাঠ্য, পরিমাণেও বেশি দিয়েছেন। এইরকমই ঘন ঘন পর্ব দিতে থাকুন।
আপনার পরামর্শ মাথায় ছিল । তবে এরকম আর লিখতে পারবো কি না জানি না । আগেরটাই আমার লিমিট । চেষ্টা করবো । সাথে থাকুন ।
কিন্তু আপনার প্রথম পর্বটি তো এখনও প্রথম পাতায় আছে। নীতিমালা তো বলে, এক লেখকের একটিই মাত্র লেখা নীড়পাতায় থাকতে পারে কোনো সময়। মডুদের চোখ এড়িয়ে গেছে হয়ত।
খুব সম্ভবত অতিথি লেখকদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য না ।
আমাদের জীবাণুদা কই?
তাহারা আপাতত আমার মাথার ভেতরে ড্যান্স মারিতেছে ।
অনুজীববিদদের বিতর্ক শোনার অপেক্ষায় থাকলাম। ভালো লেগেছে।
দিন দুইয়েকের মধ্যে আসিতেছে । একটু অপেক্ষা করুন । সাথে থাকবেন আশা করি । সেই সাথে অসংখ্য ধন্যবাদ ।
জ্ঞানদীপ্ত এবং সুখপাঠ্য, তবে এক লহমায় শেষ হয়ে যায়। আরেকটু বড় করে লেখা যায় না?
আপনার ভাল লেগেছে জেনে আমারো ভালো লাগলো । ধন্যবাদ । আসলে বড় করে লেখতে আমার প্রবল অনীহা । আমি অলস প্রকৃতির মানুষ ।
আমাদের পূর্বপুরুষ খাটি নিয়ান্ডারথাল হবার কথা না,
আমাদের পূর্বপুরুষের কেউ পিল্টডাউন ভেজাল করে গেছিল ইতিহাসের কোথাও।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
কি যে বিভ্রান্তকর এই বিষয়টা । একটা জিনিশ নিয়ে ঘাটাঘাটি শেষ আর তখন জানা যায় ওইটা পুরাই ভুয়া । আবার নতুন করে পড়া । উফফফ । তবে খুবই আকর্ষনীয় । সাথে থাকুন পরে পর্বগুলোতেও ।
নতুন মন্তব্য করুন