১.
কাল থেকেই আমার মালিকের মেজাজে আগুন। আমাকে দেখলেই কেমন উস্কে উঠছে সেটা। আমি তাই আড়ালে আছি আপাততঃ। দু'জনারই নাওয়া খাওয়া হয়নি কাল দুপুরের পর থেকে। অফিসের কাজ শেষে ফিরতে ফিরতে মালিকের সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়। আমি তখন একাই থাকি বাড়িতে। সকালে অফিসে বের হবার আগে আমার দুপুরের খাবার বন্দোবস্ত করে তবেই অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন মালিক।
গতকালও রুটিন মাফিক দুপুরের ব্যবস্হা সেরে, আমাকে বিদায় কালীন স্নেহটুকু দিয়ে শান্তমুখে অফিসে গিয়েছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যা পার করে বাড়ি ফেরার পর থেকেই কোনো এক অজানা কারণে মেজাজ খারাপ করে আছেন। অথচ দুদিন আগেও মালিকের যাবতীয় সুখ দুঃখের ভাগীদার ছিলাম আমি। অফিস থেকে আসবার পর, রাতের খাবারের তোড়জোড় করতে করতে মালিক আমার সাথে কত কথা বলে যেতেন এক নাগাড়ে। এমন কী জেরিন ম্যাডামের সাথে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কতটুকু অগ্রগতি হলো সেটাও বাদ পড়তো না। মালিক আর জেরিন ম্যাডাম খুব শীঘ্রই পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হবেন। এটা নিয়ে আমার খানিকটা অস্বস্তি থাকলেও মালিকের খুশিতে নিজের আনন্দটা জানান দিতে ভুলিনা।
আমার বড় দুর্দিনে আমি এ বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলাম। পথে পথে প্রায় না খেয়েই ঘুরছিলাম। একদিন অফিস ফেরতা এই মানুষটার পেছন পেছন বাড়ি পর্যন্ত চলে আসি। আমাকে তিনিও লক্ষ্য করেছিলেন। অন্যরা যেভাবে চোখ পাকিয়ে কিংবা অদৃশ্য ঢিল দেখিয়ে ভয় দেখায় পেছন ছাড়াবার কৌশল হিসেবে, তিনি এর কিছুই করেননি। বরং বাড়িতে ঢুকবার মুখে আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার? খাওয়া হয়নি বুঝি আজ? আমার মাথায় তার হাতের স্পর্শই জানান দেয় মানুষটা ভীষণ দয়ালু।
সেই থেকেই আছি এ বাড়িতে। আমার সেভাবে মনে পড়ছেনা মালিক আমার উপর কখনো রূষ্ট হয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে আজকের সকাল পর্যন্ত কী এমন সমস্যা ঘটলো যেটা তিনি নিজের মধ্যে নিয়ে একা একাই কষ্ট পাচ্ছেন। আড়ালে বসে তাকে লক্ষ্য করেছি। কী এক অব্যক্ত বেদনায় মালিকের মুখটা ছেয়ে আছে। রাতে ভালো ঘুমও হয়নি তার। আমি তার সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী, কিন্তু এখন দূরে থাকতে হচ্ছে অজানা কারণে।
২
আড়াল থেকে শেরখাঁ যে আমাকে লক্ষ্য করছে সে আমি বিন্দাস আন্দাজ করতে পারছি। আমার মেজাজ কেন বিগড়ালো, কী হয়েছে ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন ওর বোবা চোখে। সে আমি ওকে না দেখেই বলে দিতে পারি। প্রায় তিন বছর শেরখাঁ আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে আছে। আমরা একে অন্যের এই ব্যাপার গুলো বুঝে নিতে পারি। একটা অপার্থিব মায়ার বাঁধনে আমাদের সম্পর্কটা বাঁধা পড়েছে।
অথচ জেরিনের একটাই চাওয়া, এবাড়িতে সে কিছুতেই একটা কুকুরের সাথে বসবাস করতে পারবে না। শেরখাঁকে বাড়ি থেকে তাড়াতে হবে। নইলে জেরিনের পক্ষে একই ছাদের নীচে বসবাসের স্বপ্ন সার্থক করা সম্ভব না। গতকালই সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে জেরিন একথা। সেই থেকে আমার মাথায় আগুন। একটা অসহায় জন্তু, কার কী ক্ষতি করছে যে তাকে তাড়াতে হবে! আর তা ছাড়া, শেরখাঁকে আমি কুকুর হিসেবে দেখিনি। আমার নিঃসঙ্গ জীবনে এতদিন সেই ছিলো একমাত্র নিঃস্বার্থ সঙ্গী।
জেরিনকে সে কথা কিছুতেই বোঝানো গেলো না। মানুষ হয়ে সে আমার এই অনুভূতি বুঝলো না। সে একগুঁয়ের মত বার বারই বলেছে হয় শেরখাঁ, নয় আমি। কাকে চাও তুমি?
আমি দু'জনকেই চাই। একথা শোনা মাত্রই সাপের মত ফোঁসফোঁস করে উঠেছিলো জেরিন। আমার সাথে তুমি একটা কুকুরের তুলনা করলে! বিস্মিত হবার ভাষা খুঁজে পাইনি আমি। ভীষণ অসহায় বোধ করছি সেই থেকে। কাল সকালেই জানাতে হবে জেরিনকে আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা।
সারারাতই ভেবেছি কী করা যায় সেসব নিয়ে। একবার নিষ্ঠুরের মত এটাও ভেবেছি, খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে শেরখাঁকে ঘুম পাড়িয়ে দেই চিরদিনের মত। ভেতরের আমিটা ভীষণ ভাবে বিরোধীতা করেছে। অনেক ভেবে শেষে এক জায়গাতে ফোন করে যাবতীয় কথাবার্তা সেরেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিটি কর্পোরেশনের লোকেরা এসে নিয়ে যাবে শেরখাঁকে।
এছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিলো না। একটা দীর্ঘ সময় একা থাকতে থাকতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। এখন আমার ভেতরটা কাঙ্গালের মত গৃহী হতে চায়। প্রিয়জনের উষ্ণ ছোঁয়া পাবার আকাঙ্ক্ষায় অধীর যেন। মরুভূমির শুষ্ক প্রান্তর পানির জন্য যেমন খাঁ খাঁ করে আমারও তেমন দশা। জেরিন আমার সে আশা পূরণের সুখপাখি। ওর জন্য একটা বোবা প্রাণীর আশ্রয় হারানোটা কি খুব বেশি মূল্যাবান?
এ প্রশ্নের উত্তর দেবার সাহস আমার আপাততঃ নাই। এখন আমি র্নিমমভাবেই একজন স্বার্থপর মানুষ। আর মানুষের অসাধ্য কিছু নাই। এসব জটিল ভাবনা আমাকে আরো বেশি ক্ষিপ্ত করে তুলছে। রাগটা আমার হচ্ছে নিজের উপরেই। নিজের অক্ষমতা ঢাকতেই মেজাজ খারাপের বাহানা।
-আয়নামতি
মন্তব্য
সুপার্ব!!
অসংখ্য ধন্যবাদ!
চমৎকার লিখেছেন।
আমার তো মনে হয় বেটার অপশন ছিলো, সিটি কর্পোরশনে না দিয়ে পশুপাখির দোকানে।
অতীত
এই অপশনটা নিয়েও ভাবনার অবকাশ ছিল তো! ভাবতে হলে ঘটে কিছু থাকতে হবে তো নাকি
অনেক ধন্যবাদ পড়ে মন্তব্য করবার জন্য।
বাহ, চমৎকার! কনফ্লিক্টের বুননটা নিখুঁত হয়েছে। আরেকটি অধ্যায় জুড়ে দিয়ে জেরিনের ভাবনাগুলো শোনাতে পারলে কেমন হয়? বেচারী জেরিন, ও কোন ফ্লোর পেল না।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
কেউ ফ্লোর পেয়েও সব হারিয়ে ফেলে, কেউ ওটা না পেয়েও সব কেড়ে নিতে জানে! আপনার ভাবনার প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলি, জেরিনকে নিয়ে আরো একটা অধ্যায় করা যেত হয়ত। কিন্তু সেটা হ্যান্ডেল করবার মত দক্ষতা আমি এখনো অর্জন করতে পারিনি ভাইয়া। এখনো অনেক শিখবার বাকী আমার.....
আপনার ভালো লেগেছে জেনে সত্যিই আনন্দবোধ করছি অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া সহৃদয় মন্তব্যের জন্য।
আপনার এই স্টাইলটা তো দারুণ!! দ্বিতীয় পর্বে না আসলে বোঝারই উপায় নেই কার কথা বলা হচ্ছে!! দুই খন্ডের যোগসুত্রটা চমৎকার।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এতটা বললে যে আমি আনন্দে ফিট খাবো ট্যাগ খেয়াল করেছেন তো? ভয়ে আমি অণুগল্প ট্যাগটাও দেইনি এখন সাহস পাচ্ছি আপনাদের মন্তব্যে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অসাধারণ.........!!
........অসংখ্য ধন্যবাদ মৌনকুহর।
বিন্দাস অনুগল্প । চমৎকার । অপূর্ব অপূর্ব অপূর্ব ।
আসলেই কী এতটা প্রশংসা পাবার মত লেখা এটা!( কানে কানে বলি শোনেন, আসলে কিন্তু এমনটাই আমি শুনতে চাই....এভাবেই বললেন কেমন? ) আপনার জন্য ধন্যবাদ এবং (গুড়)
গল্পে সবার অনুভুতিই খুব সুন্দর ভাবে এঁকেছেন। চমৎকার লেখা। খুব ভালো লাগলো।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপা আপনি নতুন লেখা দিচ্ছেন কবে? শুভেচ্ছা জানবেন।
অসংখ্য ধন্যবাদ ধৈবত
লেখা ভাল হচ্ছে, আরো ভাল হবে নিশ্চয়ই।
চলুক
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
দারুন লেখা।
ভালো লাগলো।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
আপনি কি ই. এম. ফরস্টারের লেখা-টেখার ভক্ত নাকি?
গল্পে লেখায়
লেখা চলুক।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
বাহ্ দারুণ অনুগল্প, দ্বিখণ্ডন সার্থক কারণ পাঠককে চমৎকৃত করতে পেরেছে!!!
ভাবনাটা চমৎকার। আরো অনেক লেখা পড়তে চাই
দীর্ঘ একটা সময়ের পর পুরোনো পোষ্টের মন্তব্য করাটা কেমন জানি! আবার না করাটাও অভাব্যতা হয়ত। তাই যাদের মন্তব্যের উত্তর করা সম্ভব হয়নি, তাদের সবার প্রতি মন্তব্যের জন্য বিনীত কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
মানুষগুলো এমন কেন? মানে জেরিন, শেরখাঁর মালিক সব মিলিয়ে....... আর আপনিই বা এমন কেন? এমন ভালো লেখা, তারচেয়েও এমন ভালো একটা বিষয়
দেবদ্যুতি
আয়নামতি আর গল্প লেখে না কেন? বা লিখলেই পড়তে পারি না কেন? চমৎকার বললেও কম হবে। এত্ত অল্প কথায় গল্প বলার মুন্সিয়ানা যার জানা সে কি আমাদের বঞ্চিত করছে না?
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
নতুন মন্তব্য করুন