উনিশ শতকেই প্রচুর ভারতীয় সাগর পারি দিয়ে পশ্চিমে আসে উচ্চশিক্ষার জন্য। দেশ স্বাধীন হবার পরে মানুষ আরো বেশি আসতে থাকে উচ্চতর শিক্ষার জন্য। মেধায় মননে এরা দুধের সরের মত। গ্রামে মাটির হাড়িতে দুধ জ্বাল দিলেও ঘন সর উপরে জমে, শহরে ধাতব পাত্রে জ্বাল দিলেও স্বরটা উপরেই জমা হয়! ঠিক তেমনি করে দেশ থেকে আগত গ্রাড স্টুডেন্টরা তাদের স্বাক্ষর রাখেন নিজেদের সাবজেক্টে। ডিগ্রি শেষে তাদের চাকরি পেতে মোটেই অসুবিধে হয়নি। স্বীয় সন্মানেই সমাজের মুল ধারায় প্রতিসঠিত হয়েছেন। দেশ নামের স্বপ্নের ভুগোল, আর প্রিয় জনের স্মৃতির ইতিহাস নিয়ে যাপিত জীবনের প্রতিটি দিন যাপন করেছেন বোবা এক দেশ প্রেমের আকুতি, দূরে থাকার গ্লানি নিয়ে।
জীবন চক্রের ধাপে ধাপে নুতন দেশে এসে হাস্পাতালে অভিজ্ঞ ডাক্তার মায়ের মত স্নেহশীলা কর্তব্য পরায়ন নার্সের সুযোগ্য তত্বাবধানে যখন তার প্রথম পিতা মাতা হয়েছেন, কানে কানে আযান দিয়ে স্বপ্নে ছোয়ার মত কোলে নিয়ে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়েই কেটে গেছে কত বেলা! ঘুমন্ত শিশুর হাসি মুখ দেখে মনে করেছেন ‘আমার চেয়ে সুখি কে আছে?’ প্রবাসি বাঙ্গালী সমাজ বরন করে মা এবং নবজাতককে!!আপদে বিপদে আনন্দে তারা বৃহৎ এক পরিবারের মত সাথে থাকে। ঝামেলা হয়েছে দেশে কেমন করে জানাবেন সুখবরটা। সত্তুরের দশকে সামাজিক যোগাযোগ, লাজ লজ্জার রীতি নীতি একটু অন্যরকম ছিল। লজ্জার মাথা খেয়ে হয়তো চিঠি লিখেছেন, ‘মা গত কাল রাতে আপনাদের একটি নাতী হয়েছে, মা এবং শিশু উভয়েই সুস্থ আছে, আপনারা দোয়া করবেন।‘ একই চিঠি শ্বশুর বাড়ীতে পাঠানো হোল। প্রায় তিন সপ্তাহ পরে চিঠি পেয়ে দেশে তখন মিস্টির হাড়ি নিয়ে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে কোলাকুলি করে জানতে চায় এত্তবড় এক খবর কেউ আগেই জানতো কিনা! অত্যান্ত বিস্মিত দুই বিয়েইন মুখে পান গুজে একজন আরেকজনকে শুধায়, ‘আতুর ঘরটা সামলাইলো কেডায়? পোয়াতির কত কিছু খাইতে মন চায়, হেডি না পাইলে তো নাতীর নাল পড়বো গো, তারপর আতুরের চুল, নখ কাটন, নাভীডা কলা গাছের গোড়ায় পোতন লাগে, খ্যাতা বানান, সোরস্যার তেলে কাজল বানানো লাগে।‘ পোয়াতির এবং নবজাতকের করনীয় উপদেশ সহ চিঠি যা দেশ থেকে আসতে আরো বেশি সময় লাগে, সেটা যখন এসে পৌছায় ততদিনে তাঁদের নাতী ক্ষুদে ভদ্রলোক, বাহারি জুতো পোষাক, হ্যাট পরে বাইরে প্রামে করে প্রতিদিন হাওয়া খেতে পার্কে গিয়ে বিদেশিনী বৃদ্ধাদের অতি আদরের একজন হয়ে গেছে!!!
আর ঘরে এসে মায়ের কথায়, স্পর্শে, আদরে, খাবারে বাংলাদেশ যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে তার শিশু মনে। প্রবাসে ধীরে ধীরে দেশের লোক সমাগম বেড়েছে অনেক বেশি, ফলে হবু মায়ের পাতে কারিপাউডারে রান্না ঝোলের পরিবর্তে দেশি সব রকমের মসলায় রান্না, পাঁচফোরন থেকে কাসুন্দি সবই পরছে। সব রকমের দেশি মাছ, কলমি শাক, পুই শাক, সর্শে ইলিশ সহ প্রচুর দেশি বিদেশি খাবারের আয়োজনে ঘটা করে ‘সাধ’ খাওয়ানো হয় বাচ্চা হবার আগে, বেবীশাওয়ার হয়!!
প্রবাসে শিশুটি ধীরে ধীরে বড় হয়, তার কচি কন্ঠে তার স্বপ্নটাকে, ইচ্ছেটাকে কি শুনছেন?
খোকার সাধ।
এ দেশেতে জন্ম মোদের, শিকড় বাংলাদেশে,
মায়ের স্মৃতিই স্বপ্ন হয়ে সামনে দাঁড়ায় এসে।
এইখানেতে আধেক বছর শীতের ঠিকানা,
হীরের মতন বরফকুচি পরে দানা দানা।
আর আধেকে জাগে সবাই মাতায় প্রানের শহর,
এইখানেতে বসত আমার, এই আমাদের ঘর।
মাগো, স্কুলেতে আমি এবার সবার সেরা হবো,
আমার সমাজ তুলবে মাথা, আমারই গৌরবে।
আইস হকির অলিম্পকে, আনবো আমি সোনা জিতে,
কিম্বা হবো, ইগলু গড়া এস্কিমোদের মত,
তেপান্তরের মাঠটি আমি স্লেজ গাড়ীতে করবো পদানত।
মেরুচুড়ায় লিখবো আমি আমার দেশের নাম,
বুকের মাঝে সোনার বাংলা, ম্যাপল পাতায় দেই সালাম!!
এবং মৃত্যু----
অন্যায় ভাবে চাপিয়ে দেয়া একাত্তরের যুদ্ধে এক পিতা তার সতেরো বছরের ছেলের ঘরের বাইরের দিকের দরজাটির দুই পাশের পিলারে আড়াআড়ি ভাবে কাঠ দিয়ে পেরেক ঠুকে পাকাপাকি ভাবে বন্দ করে দেন। ভিতরের দরজার সামনে খোলা বারান্দায় মাটিতে বিছানা করে রাতে পাহারা দিয়েছেন ছেলেকে। যুদ্ধে যেতে চাওয়া ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন ‘তুমি যদি যুদ্ধে যাও তাহলে আমার বুকের উপরে পা দিয়ে যেতে হবে, আর যদি রাজাকার, বা পাক সেনা তোমারে নিতে আসে, তাদেরও আমার বুকে পা দিয়ে নিতে হবে আমার ছেলেকে‘। পুরো নয় মাস, বৈশাখি ঝড়ে, মৌসুমি বর্ষায়, ভাদ্রের প্রচন্ড গরমে, ডিসেম্বরের শীতে ঐ ভুমিশয্যায় রাত জেগে ছেলে পাহারা দিয়েছেন তিনি!!
যুদ্ধের পরে সেই বিদ্ধস্ত বাংলাদেশে সেই ছেলে সের দরে পুরোনো টাইম, রিডার ডাইজেস্ট, এবং ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ে, বি বি সি, ভোয়া শুনে টোফেলে খুব ভালো স্কোর এনে তার পিতাকে রাজি করায় ‘সব পেয়েছির দেশ’ আমেরিকাতে পড়তে যাবার জন্য। সে আমেরিকাতে এসে দুই সেমিস্টার শেষ করার পর রাতের শিফটে এক পেট্রল পাম্পে কাজ করার সময়ে এক আততায়ীর গুলিতে প্রান হারায়! পার্ট টাইম চাকরির ইন্সুয়েরেন্স যা দেয়, বাকি পয়সা প্রবাসীরা সবাই জোগার করে মৃতদেহটি দেশ পাঠান।
বিদ্ধস্ত হিমালয়।
বিদেশ থেকে ফিরে এলো, এক মেহগনি কফিন,
ফিরে এলো দেহ তার, সে তো নেই, মৃত্যুতে হীম,
এলো তার লাশ। তার স্বপ্নেরা কোথায়?
এভাবেই জীবন চলে যায়, এই অবেলায়?
চৌকাঠে শুয়ে পাহারায় ছিল বাবা
ঘরে তরুন পুত্র, যেন বন্দি লখিন্দর।
শীতে গ্রীস্মে ঝড়ো রাতে জেগে থাকা,
দুঃসহ স্মৃতির সেই যুদ্ধের একাত্তর।
স্বস্তি মিলেছিলো, দিয়েছিলো প্রতিশ্রুতির গান।
বিদেশে আছে সব সব সব কিছু, শান্তি অফুরান,
ভর্তির খামে এসেছিল রঙ্গিন স্বপ্নেরা কত কত!!
আঁচলে চোখ মুছে তবু মা করেন ইতস্তত!!
‘তুমি দূরে গেলে বাবা, তোমার স্মৃতি যত,
কত বড় হবে আমার দুঃখের ক্ষত,
বলো কে দাঁড়াবে আমার পাশে, ঠিক তোমারই মত?’
বজ্রের মত তীব্র এই শোকে, পাষানের মত বেহুলা এসেছে
শুধু সাদা থান টুকু পড়ে
ভীড় করে, কত শোকাহত লোক, সব আলো মুছে গেছে,
থম থমে এই দুঃখের আঁধারে।
শুভ্র কাফনে মোড়ানো পুত্রের লাস,
সামনে নতজানু পিতা, বিদ্ধস্ত হিমালয়,
ক্ষমা চায়, ক্ষমা চায়, ক্ষমা চায়, কার কাছে?
দুঃখের লাভা বুঝি স্তবদ্ধ হয়ে রয়,
মেঘের আকাশ কি, নামে সাগরের পােশ?
আসমা খান, অটোয়া।
মন্তব্য
"এভাবেই জীবন চলে যায়, এই অবেলায়?"
খুব ভালো লাগলো, জীবনের গল্প।
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
অনেক অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য। শুভেচ্ছা রইলো।
didi...lekha ta pore onek valo laglo...karon amra jara desh theke ai khane porte asi, sobay mone
kore ki na moha suke achi...ak akta din je kmne jai, ta keu jane na ba bose na, sudu jara desh
er baire ase thakse tarai bose .
অনেক ধন্যবাদ আপনার লেখাটি সম্পর্কে অনুভুতি জানানোর জন্য। কস্ট করে পড়াশোনাটা শেষ করেন, দেখবেন অনেক ভালো লাগবে। শুভেচ্ছারইলো।
নতুন মন্তব্য করুন