দুর/দূর, কুজন/কূজন, কুল/কূল, পুত/পূত, পুর/পূর, সুতি/সূতি, অনুপ/অনূপ, অনুদিত/অনূদিত, কুট/কূট, ধুম/ধূম, আহুতি/আহূতি–ইত্যাদি অজস্র শব্দের উচ্চারণই অভিন্ন, তবু বানানের তারতম্যের কারণে অর্থ আলাদা হয়ে যেতে দেখা যায়। বাংলায় নাকি উ-কার ( ু) ব্যবহার হয় হাজারে ১৭টা আর ঊ-কার ( ূ) হাজারে মাত্রই ১টা। তাই 'উ' ব্যবহারকে ঊন বলা না-গেলেও 'ঊ' ব্যবহার কিন্তু সত্যিই
সীমিত। নির্বিবাদে যত্রতত্র ঊ ও তার-কার চিহ্নের 'ব্যবহার' দেখে তা বোঝার উপায় নেই অবশ্য।
সংস্কৃত বানানরীতি অনুযায়ী কিছু কিছু শব্দে ঊ ব্যবহার নইলে নয়, তাই রয়ে গেছে। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের আতঙ্ক যেন কিছুতেই দূর হওয়ার নয়। তাই প্রায়শ বিপদে পড়তে হয় কোথায় উ-কার দেব আর কোথায় ঊ-কার তা ভেবে না-পেয়ে। এর কি কোনো সহজ সমাধান নেই? আছে!
যেসব তৎসম শব্দের বানানে হ্রস্ব ও দীর্ঘ উভয় স্বর (উ, ঊ) অভিধানসিদ্ধ, সে ক্ষেত্রে এবং অ-তৎসম (তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র) শব্দের বানানে শুধু হ্রস্বস্বর (উ ু) প্রযুক্ত হবে। যেমন : নুর, শুটিং, চুরি, খুশি, ছুরি, টুপি, কুমির, বুড়ি, ছুঁড়ি, নিচু, চুন, পুব, ভুখা, মুলা, পুজো, উনিশ, উনচল্লিশ, কুলো, মুড়ি, ঝুড়ি ইত্যাদি।
ক. যেসব তৎসম (সংস্কৃত) শব্দে উ ঊ উভয় শুদ্ধ সেইসব শব্দে কেবল উ এবং তার-কার চিহ্ন উ-কার ব্যবহৃত হবে। যেমন : উর্ণা, উষা, ভ্রু ইত্যাদি।
খ. অনেক সংস্কৃত শব্দ বাংলায় আসার পথেই ব্রাত্য বাংলাভাষীর মুখে মুখে তার কুলীন দীর্ঘস্বর হারিয়েছে। উদাহরণ : [তৎসম > তদ্ভব]
কূপ > কুয়ো, ধূলি > ধুলা/ধুলো, পূজা > পুজো, স্ফূর্তি > ফুর্তি, ভূমি > ভুঁই, ঊনবিংশ > উনিশ, ভ্রূ > ভুরু, সূত্র > সুতো, রূপা > রুপো, পূর্ব > পুব ইত্যাদি।
ক. তৎসম অর্থাৎ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অবিকৃত সংস্কৃত শব্দে ঊ বা ঊ-কার থাকলে কখনোই তা পাল্টানো চলবে না। কারণ এইসব শব্দের বানান ও ব্যাকরণগত প্রকরণ ও পদ্ধতি নির্দিষ্ট রয়েছে। সুখের বিষয় বাংলায় এ জাতীয় শব্দ খুব কমই আছে। অল্প যে কটা আছে অনায়াসেই দেখে দেখে আয়ত্ত করে ফেলা যায়। যেমন : কূল, রূপ, ধূলি, পূর্ব, মূল, শূন্য, পূর্ণ, দূরত্ব, মূর্খ, স্বয়ম্ভূ, মুহূর্ত, মুমূর্ষু, সূর্য ইত্যাদি।
খ. স্বরসন্ধির নিয়মের কারণে ঊ-কার উৎপন্ন হতে পারে। ‘উ’-কার কিংবা ‘ঊ’-কারের পর ‘উ’-কার কিংবা ‘ঊ’-কার থাকলে উভয়ে মিলে ‘ঊ’-কার হয়। যেমন :
উ + উ = ঊ----------------------উ + ঊ = ঊ
কটু + উক্তি = কটূক্তি-------------লঘু + ঊর্মি = লঘূর্মি
মৃত্যু + উত্তীর্ণ = মৃত্যূত্তীর্ণ----------তনু + ঊর্ধ্ব = তনূর্ধ্ব
> 'দূর্বল', 'দূর্জয়', 'দূর্ভাগ্য' এগুলো ভুল বানান। দুঃ নামক উপসর্গে হ্রস্ব উ, অতএব কঠিন অর্থে হলে দুর্বল, দুর্জয়ই হবে। দূর (far) বোঝালে দীর্ঘ ঊ-কার।
দু লেখা হবে :
১. দু/দুঃ হচ্ছে একটি উপসর্গ। উপসর্গ সর্বদা কোনো শব্দের পূর্বে বসে এবং নতুন শব্দ তৈরি করে তার অর্থে পরিবর্তন আনে। দু/দুঃ উপসর্গের অর্থ হচ্ছে মন্দ বা খারাপ বা কষ্টকর ধরনের কিছু। যেমন : দুঃসহ, দুরদৃষ্ট, দুরপনেয়, দুরাত্মা, দুঃখী, দুর্গন্ধ, দুর্ভোগ, দুর্জন, দুষ্পাচ্য, দুস্থ, দুস্তর ইত্যাদি।
২. দূ লেখা হবে :
ক. -দূর, দূরত্ব বিষয়ক একটা ধারণা বা চিন্তা থাকলে। যেমন : দূর, দূরপ্রাচ্য, দূরবর্তী, দূরান্বয় ইত্যাদি।
খ. দূত, দূর্বা, দূষণ প্রভৃতি তৎসম শব্দে ব্যাকরণগত বাধ্যবাধকতার কারণে।
> অদ্ভূত, উদ্ভূত, আবির্ভূত, ঘনীভূত, পরাভূত, দ্রবীভূত, বশীভূত, কিম্ভূত, ভূত-ভবিষ্যৎ এসব বানানে প্রায়শ হ্রস্ব উ-কার চোখে পড়ে। পক্ষান্তরে অদ্ভুত, ভুতুড়ে প্রভৃতি বানানে দীর্ঘ ঊ-কার দিয়ে থাকেন অনেকে, যা একটি ভুল প্রয়োগ। ভুত বা ভূত দুটোই শুদ্ধ, তবে 'ভুত' বানানটি প্রমিত এবং শুধুমাত্র 'ভুতুড়ে' বানানটি শুদ্ধ। আরও লক্ষ করার মতো বিষয়, ‘অদ্ভুত’ আর ‘ভুতুড়ে’ শব্দের ভুত ছাড়া সমস্ত ভূতই দীর্ঘ ঊ-কার দিয়ে লিখতে হয়।
> রৌপ্য অর্থে 'রুপা', 'রূপা' দুটি বানানই শুদ্ধ, তবে 'রুপা' বানান প্রমিত। একই কথা প্রযোজ্য 'রুপালি' ও 'রূপালি' বানানের ক্ষেত্রেও। তবে রূপ অর্থ সৌন্দর্য হওয়ায় 'সুন্দরী' অর্থে শুধুমাত্র 'রূপসী' বানানটিই শুদ্ধ, যদিও অনেকে ভুলবশত 'রুপসী' বানান লিখে থাকেন। উচ্চারণ করার সময় ভেবে দেখুন রূ-টা একটু টেনে করা হয় নাকি?
> 'পূনর্বিন্যস্ত', 'পূনর্মিত্রতা' এগুলো ভুল বানান। পুন/পুনঃ হচ্ছে একটি শব্দ। এটি সর্বদা কোনো শব্দের পূর্বে বসে এবং নতুন শব্দ তৈরি করে তার অর্থে পরিবর্তন আনে। পুন/পুনঃ শব্দের অর্থ হচ্ছে পুনরায় বা আবার বা দ্বিতীয় বার। যেমন : পুনঃপুন, পুনরাগমন, পুনর্যাত্রা, পুনর্মূষিকোভব, পুনর্মিত্রতা, পুনর্বিন্যস্ত ইত্যাদি।
> 'ভু' নয়, 'ভূ' শব্দের অর্থ হচ্ছে পৃথিবী। তাই 'ভুগোল', 'ভুমি', 'ভু-পৃষ্ঠ', 'ভুমিষ্ঠ', 'ভুপতি' এগুলো সবই ভুল বানান। লিখতে হবে 'ভূগোল', 'ভূ-পৃষ্ঠ', 'ভূমিষ্ঠ', 'ভূপতি'। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যে 'ভুবন', যার অর্থও পৃথিবী, বানান করতে হয় হ্রস্ব উ-কার দিয়ে।
সহায়ক গ্রন্থ :
১. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান
২. হায়াৎ মামুদ (বাংলা লেখার নিয়মকানুন, মে, ২০১০)
পূর্ববর্তী পর্ব :
১. ই-কার বনাম ঈ-কার
২. ও কি এল, ও কি এল না
৩. হ্রস্বস্বর বনাম দীর্ঘস্বর
৪. 'অনুস্বার' বনাম 'ঙ', সাথে 'এ' বনাম 'অ্যা'
৫. দন্ত্য-ন বনাম মূর্ধন্য-ণ
৬. বাংলার তিন 'শ'—দন্ত্য-স, মূর্ধন্য-ষ আর তালব্য-শ
৭. বাংলা হরফ বনাম রোমান হরফ—জ বনাম J, Z, G
৮. পাঠ্যবইয়ে বাংলা একাডেমীর বানানরীতি মেনে চলতে হবে
৯. ব-য় শূন্য 'র' বনাম ড-য় শূন্য 'ড়'
১০. কখন কি লিখব, কখন কী লিখব
১১. সংস্কৃত বানানরীতি বনাম বাংলা বানানরীতি
১২. বাংলা ভাষার ব্যাকরণ কবে তৈরি হবে?
১৩. বাংলা ভাষায় বাঙালিয়ানা কতটুকু?
১৪. বাংলা ভাষা এল কোথায় থেকে
১৫. বিনির্মাণের ভাষা, বাংলা ব্যাকরণের ভিন্নপাঠ
১৬. স্পেস নিয়ে ভাবনা / আর না আর না
কুটুমবাড়ি
মন্তব্য
এই কঠিন কঠিন শব্দের ধাক্কায় পড়েই আর ব্যাকরণটা শেখা হলো না । দুধ-দাঁত যতদিন ছিলো ততদিন এসব পড়ার মত বয়স হয়নি। যখন হলো তখন আর দুধ-দাঁত নেই, কিসের ভরসায় পড়বো?
আর তাইতে তৎসম এবং সেই তৎসম থেকে আসা একই অর্থের তদ্ভব (কূপ - কুয়ো) , দুই-ই দিব্যি জাঁকিয়ে বসে আছে, প্যাঁচ তো লাগবেই
হা হা.. কিন্তু আপনি ব্যাকরণ শেখা নিয়ে চিন্তিত কেন বুঝতে পারলাম না। ব্যাকরণ না-জেনেও শুদ্ধভাবে লেখা সম্ভব, অন্তত আমার কাছে তা-ই মনে হয়। তা ছাড়া বানানায়তনের উদ্দেশ্যও কিন্তু ছিল ব্যাকরণাতঙ্কিত লোকেদের বানান-ভীতি দূর করা। এ কারণে সব সময় চেষ্টা করি ব্যাকরণকে পাশ কাটিয়ে বানানালাপ করার। সফল যে খুব একটা হই না তা আপনার মন্তব্য পড়েই বুঝতে পারছি। তবে পছন্দনীয় ভাই, প্রশিক্ষণ বিনে কোনো কাজই সম্ভব হয় না, এমনকি শুদ্ধভাবে কথা বলা পর্যন্ত যায় না - সেইখানে কোনো চেষ্টা ছাড়াই শুদ্ধভাবে লিখতে পারব এমন আশা করাটা কি ঠিক?
এই বার এই পোস্টের পেছনের মাজেজাটা একটু বলি। আমরা অহরহ লিখছি 'দূর্নীতি'। রাস্তায় সাইনবোর্ডে দেখি "দূর্ঘটনা' থেকে বাঁচার উপায় জানিয়ে সতর্ক করা হয়। আরও লেখা হয় 'বাংলার মাটি দূর্জয় ঘাঁটি'। দীর্ঘস্বরের এই অহেতুক আগ্রাসন দেখে আমি স্বস্তি পাই না। এসব কারণে একটু বিরক্তি ছিল মনের মধ্যে, লেখাতেও মনে হয় সেটা চলে এসেছে। আপনি যে লাইনটি কোট করেছেন সেটি জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের 'পাঠ্যবইয়ের বানান' (নভেম্বর, ২০০৫) শীর্ষক বই থেকে নেয়া। আপনার বোঝার সুবিধার্থে এখানে শব্দার্থ ও টীকা যোগ করে দিচ্ছি-
বাংলা ভাষার সমস্ত শব্দ তৎসম আর অ-তৎসম এই দুই ভাগে বিভক্ত। এই বিভক্তিটা জরুরি, কারণ তৎসম শব্দে সংস্কৃত বানানরীতি মেনে চলা হয়, আর অ-তৎসম শব্দে বাংলা বানানরীতি। দীর্ঘ ঊ বা তার কার-চিহ্ন সংস্কৃতের নিজস্ব সম্পদ, বাংলা বানানরীতিতে এর স্থান নেই। কিন্তু সব বিশেষজ্ঞই এই মত দিয়ে আসছেন, যে তৎসম শব্দের বানান ও ব্যাকরণগত প্রকরণ ও পদ্ধতি নির্দিষ্ট। অতএব, এর ব্যত্যয় ঘটিলে বানানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। তাই কষ্ট হলেও আমাদের দেখে দেখে বানান শিখে নেয়ার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
তৎসম = 'তার' সম অর্থাৎ 'সংস্কৃত' শব্দ
অ-তৎসম = তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দ
তদ্ভব = 'তা' থেকে অর্থাৎ 'সংস্কৃত' থেকে উদ্ভূত শব্দ
দেশি = অজ্ঞাতমূল ভারতীয় শব্দ
বিদেশি = ইংরেজি, আরবি, ফরাসি, ফারসি, চাইনিজ, তুর্কি প্রভৃতি ভাষা থেকে আগত শব্দ
মিশ্র = দুটি ভিন্ন ভাষার শব্দের মিশ্রণে উদ্ভূত শব্দ
না না, প্রশিক্ষণ বা চেষ্টা ছাড়া শুদ্ধভাবে লেখার কথা তো বলিনি... খালি মানে যে সব ব্যাপারের ভয়ে ভেগে যেতাম সেগুলোই আপনার অতি উপভোগ্য বানানের ক্লাসে এসে ঢুকলো ভেবে আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলাম...
হুম.. এখন বুঝতে পারলাম কী বলতে চেয়েছিলেন। ঠিকাছে, তা-ই সই। কেতাবি ভাষা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করব এর পর থেকে। আফটার অল, দাঁতের মায়া আমার নিজেরও কিছু কম নেই। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
যথারীতি আরেকটা কাজের পোস্ট। ধন্যবাদ।
এই পোস্টটা আরো ব্যবহার উপযোগী করা যেতে পারে-
সমস্ত ভুল বানান ও প্রয়োগকে নীল রঙ করে। তাতে এক নজরে ধারণা পাওয়া যাবে।
একটা ছোট ভূমিকা জুড়ে দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের উক্তিটা প্রথমে না দিয়ে শেষে দিয়ে।
ট্যাগে বানানভ্রান্তি না দিয়ে "বানান ভুল" ব্যবহার করে।
ট্যাগে " উ কার" ও "ঊ কার" যোগ করে। (খুঁজে পেতে সুবিধা হবে)।
চালিয়ে যান।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
আপনার পরামর্শগুলো বেশ কাজের। অনেক ধন্যবাদ।
'দাদা, বাঙলা কী কঠিন!'
পোস্টে
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
'তবু বাংলা কী প্রিয়, তাই না দিদি?'
মন্তব্যের জন্য
নতুন মন্তব্য করুন