পর্ব-১
নিজাম সাহেব একজন নির্ভেজাল সুখী মানুষ। তার সুখের মূল কারণ তার স্ত্রী আলেয়া বেগম।
নিজাম সাহেব ছেলে বেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়েছেন। এক দূর সম্পর্কের মামার বাড়ীতে মানুষ। মামার সামর্থ্য বেশী ছিলনা, কিন্তু তবুও তিনি নিজাম সাহেবকে কলেজ অবধি পড়িয়েছিলেন। আলেয়ার সাথে বিয়ের প্রস্তাবটিও মামাই নিয়ে আসেন।
‘বুঝলি নিজাম, আলেয়া মেয়েটি খুব ভাল। চেহারায় সে অত সুন্দরী না, পড়াশুনাও বেশী করেনি, কিন্তু মেয়েটির স্বভাব বড়ই নরম। তোর সাথে ভাল মানাবে।’
সে প্রায় আট বছর আগের কথা। তখন নিজাম সাহেব চাকরির জন্যে এদিক সেদিক দরখাস্ত করছেন। তিনি একটু আমতা আমতা করেছিলেন, ‘মামা, আমার তো এখনো কোন চাকরি-বাকরি কিছুই হয়নি। আর কিছুদিন পরে এইসব নিয়ে চিন্তা করলে হোতনা?’
‘অন্য কোন মেয়ে হলে আমি তোকে দেরী করতেই বলতাম, কিন্তু চাকরির জন্যে অপেক্ষা করলে এই মেয়েটির সাথে হয়তো তোর বিয়ে টা আর হবেনা।’
‘তাতে অসুবিধা কি? বাংলাদেশে কি আর কোন মেয়ে নেই? এই মেয়ের সাথে বিয়ে না হলে অন্য মেয়ের সাথে হবে। একদম বেকার অবস্থায় একটা মেয়ের দায়িত্ব নিতে ভয় লাগছে।’
‘আরে-আমি তো আছিই। তুই আমার একটা কথা শোন্। আলেয়াকে বিয়ে করে ফেল। চাকরি একসময়ে না এক সময়ে হবেই।’
মামার কথার অমান্য করেননি নিজাম সাহেব। দেড়মাসের মধ্যে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পরদিনই রেজিস্টার্ড মেইলে চিঠি এলো নিজাম সাহেবের নামে। তার চাকরির চিঠি।
মামা খবরটা পেয়ে মিটিমিটি হেসেছিলেন। ‘আলেয়ার জন্যই তোর চাকরি হয়েছে। ওকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, সেদিনই আমার মনে হয়েছিল সে মেয়েটি সুলক্ষণা। যা-ওর জন্য মিষ্টি নিয়ে আয়। তারপর ওকে কাছে বসিয়ে নিজের হাতে মিষ্টি খাওয়াবি।’
নিজাম সাহেব চাকরি করেন অগ্রণী ব্যাংকের ঝিকাতলার ব্র্যাঞ্চে। তিনি সাড়ে সাত বছর ধরে এখানে আছেন। ছোট চাকরি, কিন্তু মনে হয় খুব শিগগিরই তার একটা প্রমোশন হবে। দু’দিন আগে ম্যানেজার কুতুবুদ্দিন সাহেব তাকে এইরকম একটা আভাস দিয়েছেন। ‘বুঝলেন নিজাম সাহেব, আমাদের হাতে তো তেমন কোন ক্ষমতা নাই। তবে আমি আপনার নামে খুব ভালো একটা সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দিয়েছি হেড অফিসে। এখন বাদ বাকী আল্লাহ্র হাতে। বাসায় যেয়ে ভাবীকে নফল নামাজ পড়ে মোনাজাত করতে বলবেন। ইনশাল্লাহ্- এইবার আপনার প্রমোশনটা হয়তো হয়েই যাবে।’
নিজাম সাহেব সেদিন হাতে আধা কেজি মিষ্টি নিয়ে বাড়ী ফিরেছিলেন। সামর্থ্য থাকলে হয়তো আরো বেশী মিষ্টি কিনতেন। আলেয়ার হাতে মিষ্টির বাক্সটা তুলে দিয়ে তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। আলেয়া স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো, “হঠাৎ তুমি মিষ্টি কিনতে গেলে? কোন বিশেষ কিছু হয়েছে নাকি?”
নিজাম সাহেব কথা না বলে মিটিমিটি হাসেন। “আন্দাজ করতো দেখি। তুমি নাকি আমার মুখ দেখেই আমার মনের কথা বলে দিতে পারো।“
আলেয়াও হাসে। “পারিই তো। মাঝেমাঝে মুখ না দেখেও বলে দিতে পারি।“
“ঠিক আছে, বলো তাহলে।“
“তোমার কাজের জায়গায় কিছু ভাল একটা খবর পেয়েছো হয়তো।“
নিজাম সাহেব জামা খুলতে খুলতে বলেন,”তোমার অনুমান করার ক্ষমতা দুর্দান্ত। আজকে ম্যানেজার সাহেব বললেন যে আমার নাকি একটা প্রমোশন হতে পারে। তোমাকে নফল নামাজ পড়ে মোনাজাত করতে বললেন।“
“এ জিনিস অনুমান করতে বুদ্ধি লাগেনা। তুমি কাজ আর বাড়ী ছাড়া আর কোথায়ই বা যাও? মিষ্টির প্যাকেট মানেই তোমার চাকরির কোন ভাল কিছু খবর। আর তাছাড়া আমি জানতাম যে আজকে কোন ভাল একটা খবর পাবো।“
নিজাম সাহেব ঘুরে দাঁড়ান। “তুমি জানতে মানে? আমার চাকরির খবর আমিই জানিনে, তুমি বাসায় বসে সে খবর কিভাবে জানতে?”
“চাকরির ভাল খবর পাবো তাতো বলিনি। বলেছি ভাল খবর পাবো।“
“কিভাবে?”
“ছেলেটার শরীরটা আজকে ভাল নেই। অল্প জ্বর। কিছুই খায়নি বলতে গেলে। হঠাৎ দুপুর বেলায় আমাকে ডেকে বললো যে সে মিষ্টি খেতে চায়। আমিতো অবাক। যে কোনদিন মিষ্টি খায় না সে আজকে মিষ্টির বায়না করলো। ঘরে দুধ ছিল অল্প, চিনিও তেমন ছিলনা। ওই দিয়েই কোনমতে একটু পায়েস বানিয়েছি। পায়েস বানানোর সময়েই আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল যে আজকে কোন ভাল কিছু একটা হবে।“
“তিতুর শরীর খারাপ নাকি?”
“এমন কিছু না। অল্প জ্বর। তুমি তো ওর স্বভাব জানোই। মুখে কিছু বলবে না শুধু চুপ করে শুয়ে থাকবে।“
“তা সে পায়েস খেয়েছে?”
“নাহ-তোমার সাথে খাবার জন্যে বসে আছে।“
তিতুর ভাল নাম আরশাদ নিজাম। তার বয়েস পাঁচ বছর। স্বভাবে সে মায়ের মতোন শান্ত। সে মাস কয়েক আগে স্কুল শুরু করেছে। নিজাম সাহেব বাসায় ফিরলে সে প্রতিদিন তাকে স্কুলের গল্প শোনায়। বেশীর ভাগ গল্পই অন্য বাচ্চাদের নিয়ে। তারা কিভাবে কথা বলে, কিভাবে মারামারি করে। তার নিজের তেমন কোন বন্ধু নেই। তা বোধকরি তার শান্ত স্বভাবের জন্যে।
তিতুর ঘরটি ছোট। ছোট্ট একটা তক্তপোশ, পাশে আরো ছোট একটা পড়ার টেবিল। টেবিলে পিরিচ দিয়ে ঢাকা একটি বাটি। মনে হয় পায়েসের বাটি।
তিতু চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। পায়ের শব্দে সে চোখ খোলে। তার চোখ ছলছল করছে। নিজাম সাহেব তার পাশে বসেন। কপালে হাত রেখে জ্বর মাপার চেষ্টা করেন। আলেয়া ঠিকই বলেছিল। অল্প জ্বর।
“কিরে তিতু, শরীর খারাপ লাগছে?”
তিতু মাথা নাড়ে। “বেশী না। অল্প।“
“আমি দোকান থেকে মিষ্টি এনেছি। চমচম। খাবি?”
তিতু আবার মাথা নাড়ে। “দোকানের মিষ্টি খাবো না। মা পায়েস বানিয়েছে, সেটা তুমি আর আমি মিলে খাবো।“
নিজাম সাহেব পায়েসের বাটি তুলে নেন। আলেয়া তিতুকে ধরে বসিয়ে দেয়। চামচে করে তিতুর মুখে পায়েস তুলে দেবার সময় নিজাম সাহেবের হঠাত কেন যেন চোখে জল আসে।
আলেয়া আর তিতুকে নিয়ে তার ছোট্ট একটু পৃথিবী। তাদের অনেক কিছুই নেই, কিন্তু এই ছোট্ট সংসারে সুখের কোন কমতি নেই।
নিজাম সাহেব জামার আস্তিনে চোখ মোছেন। আলেয়া তিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। সে স্বামীর কারণে-অকারণে চোখ মোছার স্বভাবটি জানে। মানুষটির মনটা বড় নরম, একটুতেই কাতর হয়ে পড়ে।
তিতু বলে,”বাবা-তুমি কিন্তু পায়েস খাচ্ছো না।“
কোথায় যেন একটা তীক্ষ্ণ হুইশ্ল বাজে। তার আওয়াজটি শুধু নিজাম সাহেব শুনতে পান। তিতু আর আলেয়ার দিকে তাকিয়ে তার কেন যেন মনে হয় যে একটা মহা বিপদ তাদের এই সুখের সংসারের দিকে ধেয়ে আসছে।
প্রচন্ড ভয়ে নিজাম সাহেবের বুকের ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে আসে।
(চলবে)
-নিলম্বিত গণিতক
মন্তব্য
ভাল্লাগছে !
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম ।
পড়তে ভালই লাগছিল। চলুক
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
উত্তেজনাটা রেখে দিলেন?
ভাল্লাগছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
নতুন মন্তব্য করুন