নিলম্বিত গণিতক। পর্ব-২।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৮/০৫/২০১১ - ২:৫০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পর্ব-১

পর্ব-২

ঢাকা শহরে মাথা ঠান্ডা রাখা খুবই কঠিন। এমনকি নিজাম সাহেবের মতো মানুষের জন্যেও এটা একটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। সারা শহর জুড়ে কেবল মানুষ আর মানুষ। ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ে গোটা শহর ধুঁকছে। পনের মিনিটের পথ যেতে লাগে দু ঘন্টা।

তিতুর জ্বরটা যাচ্ছেনা। ওষুধপত্র খেলে দুদিন ভাল থাকে, কিন্তু তারপর আবার বাচ্চাটা আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিছানায় বড় বড় চোখ মেলে চুপ করে শুয়ে থাকে।

শিশুবিশেষজ্ঞ এক ডাক্তারের কথা বলেছিল অফিসের এক কলিগ। সেখানে ফোন করে অনেক কাকুতি-মিনতি করে তারপর একটা এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেল। সেই ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিজাম সাহেব বুঝতে পারলেন যে এই শহরে অনেক কিছুই তার অগোচরে বদলে গেছে।

তিনি শেষবার ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন তিতুর জন্মের সময়। তারপর আর যেতে হয়নি আজ পর্যন্ত। আলেয়ার জ্বরজারি তেমন একটা হয়না, শুধু মাঝেসাঝে মাথা ব্যথায় একটু কষ্ট পায় সে। সেটাও তেমন গুরুতর কিছু একটা না। দুটো এসপিরিন খেলেই ঠিক হয়ে যায়।

এখনকার ডাক্তাররা কেমন যেন। প্রথম ভিজিটের সময় তিতুকে ভাল করে না দেখেই এক গাদা টেস্ট করিয়ে আনতে বললেন প্রথমে। এ আবার কেমন ডাক্তার? রোগী দেখে কিছু একটা বলবে না?

নিজাম সাহেব তাও জিজ্ঞেস করেছিলেন,”ডাক্তার সাহেব, কোন সিরিয়াস কিছু না তো?’
ডাক্তার এ প্রশ্নে বিরক্ত হয়েছিলেন,”দেখেন-আমি টেস্ট এর রেজাল্ট না দেখে কোন ডায়াগনসিস করি না। বাচ্চাদের নিয়মিত জ্বর অনেক কারণেই হতে পারে। তার কোনটা সিরিয়াস, কোনটা মামুলী।“
“তাতো বটেই। তারপরও বাচ্চাটাকে নিয়ে আপনার কাছে এলাম। একদম কোন কিছু না জেনে আবার চলে যাবো বাসায়? টেস্ট এর রেজাল্ট না আসা পর্যন্ত এ কয় দিন কি করবো তাহলে? কোন ওষুধ-বিষুধ কি দেবো তিতুকে? সেই জন্যেই জিজ্ঞেস করছিলাম আপনাকে।"
ডাক্তারের বিরক্তি আরো বাড়ে। “আপনাদের এইরকম প্রশ্নের কি কোন জবাব হয়? আপনারা সবাই এক এক জন ছোটখাট ডাক্তার। নিজেরাই নিজেদের চিকিৎসা করেন। তারপর ঝামেলা হয় যখন তখন আমাদের কাছে এসে বলেন যে রোগী ভাল হচ্ছে না কেন। সব দোষ যেন আমাদের।"

নিজাম সাহেব চুপ করে ছিলেন। এমনিতেই তিনি স্বল্পকথার মানুষ, তার উপর ডাক্তার আর ঊকিলের সাথে নাকি তর্ক করতে নেই।

সেটা ছিল প্রায় সাত-আট দিন আগের কথা। টেস্টের রেজাল্ট নিয়ে আজকে তিনি একাই এসেছেন। তিতুর জ্বর তেমন ছিলনা, সাথে করে তাকে আনা যেত। কিন্তু এই গরমের মধ্যে এতখানি পথ পাড়ি দিতে বাচ্চাটা আরো অসুস্থ হয়ে পড়তো।
কাউন্টারে রিপোর্টগুলো জমা দিয়ে বসে আছেন প্রায় চল্লিশ মিনিট হোল। কখন ডাক্তার সেগুলো দেখবেন, আর কখনই বা তাকে ডাকবেন, তার কোন ঠিক নেই। পাশের মসজিদে মাগরিবের আজান দিচ্ছিল পনেরো মিনিট আগে। বাইরে সন্ধ্যা নেমে আসছে দ্রুত।

রাত করে বাসায় ফিরতে নিজাম সাহেবের ভাল লাগেনা। আলেয়ার সাথে বসে ঠিক সন্ধ্যের সময় তিনি এককাপ চা খান। যেদিন বাসায় ফিরতে তার সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়, সেদিন তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আলেয়া ছোট ছোট চুমুকে চা খায় বলে তার একটু সময় লাগে। নিজাম সাহেব আগুনগরম চাও দুই চুমুকে শেষ করে বসে থাকেন, তারপর চুপ করে তাকিয়ে থাকেন আলেয়ার দিকে। আলেয়া কেন যেন এতে খুব লজ্জা পায়। সে না দেখার ভান করে দেয়ালের কাবাশরীফের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। সব মিলিয়ে হয়তো পাঁচ-সাত মিনিটের ব্যাপার। এই সময়ে তেমন কোন কথা হয়না দুজনের মধ্যে। কিন্তু নিজাম সাহেবের কাছে দিনের ওই সময়টুকু বড় প্রিয়।

“নিজামুর রহমান”। কাউন্টারের মেয়েটি তাকে ডাকছে। নিজাম সাহেব উঠে দাঁড়ান।
“যান-ভিতরে যান, স্যার আপনার সাথে কথা বলবেন।“

ডাক্তারের মন-মেজাজ আজকে ভাল মনে হয়। তিনি বিশাল বড় একটা কফি মগে চুমুক দিতে দিতে রিপোর্টগুলো দেখছিলেন। ঘরে কফির খুব হাল্কা একটা পোড়া পোড়া গন্ধ। নিজাম সাহেবকে দেখে ডাক্তার অল্প হাসলেন।
“আসুন নিজাম সাহেব। বসুন। আমি এই সময়টাতে এক কাপ কফি খাই। আপনাকেও এক কাপ দিতে বলি? কফি খেতে না চাইলে চাও খেতে পারেন। আপনার ইচ্ছা।“
“না না থাক। চা কফি কিছুই লাগবে না।”
“এই কফিটা কিন্তু ভাল। একদম ফ্রেশলি বানানো। ইন্সট্যান্ট কফি না।“
“আমি আসলে চা-কফি কোনটাই তেমন খাই না। আপনি তিতুর রিপোর্টটা কি দেখেছেন?”
“জ্বি-দেখেছি একটু আগেই।”
“ওর কি শরীরটা বেশী খারাপ?”
ডাক্তার এই প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব দিলেন না। একটু যেন অন্যমনস্ক ভাবে ধরা গলায় বললেন,“মাঝে মাঝে টেস্টগুলোও এত উল্টোপাল্টা রেজাল্ট দেয়, যে সেগুলোর উপর ভালমতো ভরসাও করা যায় না। আমাদের দেশে এই এক সমস্যা। কোন কিছুর উপর নির্ভর করা যায়না। ”
নিজাম সাহেব চুপ করে থাকেন। তার বুকের ভিতর আস্তে আস্তে একটি ঠান্ডা অনুভূতি নড়াচড়া করে। কি হয়েছে তিতুর? খারাপ কিছু? কত খারাপ?
ডাক্তার এবারে “নিজাম সাহেব-কি ভাবে কথাটা আপনাকে বলবো তাই ভাবছি। তিতুর টেস্টের রেজাল্ট ভাল না।”
“কেন-কি হয়েছে ওর?”
“আমাদের ডাক্তারী ভাষায় একে বলে লিমফোব্ল্যাস্টিক নন-হজকিন লিমফোমা। এক ধরণের ক্যান্সার। খুব মারাত্মক ধরণের না এটা যদি আর্লি স্টেজে ধরা পড়ে। আনফরচুনেটলি তিতুর ক্যান্সারটা বেশ অনেকখানি এগিয়ে গেছে। মাঝেমাঝে এই ধরণের ক্যান্সার খুব দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। আমি সাধারণতঃ এই রকম সময়ে একটা বায়োপ্সি করার পরামর্শ দেই, কিন্তু আমার এতদিনকার অভিজ্ঞতা থেকে যা মনে হচ্ছে যে তিতুর ক্ষেত্রে তেমন কিছু করবার নেই। আপনি চাইলে আমরা কেমোথেরাপী আর রেডিয়েশন থেরাপী দু এক দিনের মধ্যেই শুরু করতে পারি, কিন্তু তাতে যে খুব একটা কাজ হবে তা মনে হচ্ছে না আমার।”

নিজাম সাহেব ফ্যালফ্যাল করে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার মাথায় কথাগুলো শুধু এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়ায়, কোন অর্থ বহন করেনা।

যে সব দিন বাসায় ফিরতে দেরী হয় সে সব দিনে বাস থেকে নেমে নিজাম সাহেব রিকশা করে বাড়ী ফেরেন। তার বাসা বাসস্টপ থেকে বেশী দূরে না। হেঁটে গেলে বারো মিনিট, রিকশায় গেলে পাঁচ-সাত মিনিট কম লাগে। কিন্তু ওইসব দিনে তার ওইটুকু দেরীও আর সহ্য হয়না।

আজ বাস থেকে নেমে তার বাসায় ফিরতে ইচ্ছে হোলনা। আস্তে আস্তে পথ হাঁটেন তিনি মাথা নীচু করে। কি বলবেন তিনি আলেয়াকে? তিনি বা আলেয়া তো কোনদিন কারো কোন ক্ষতি করেননি। তবু কেন আল্লাহ তাদেরকে এত বড় শাস্তি দিলেন?

দরজায় টোকা দিতেই আলেয়া দরজা খুলে দিল। যেন সে দরজার ওপাশেই নিজাম সাহেবের জন্যে বসে ছিল। নিজাম সাহেবের দিকে একবার তাকিয়েই সে আঁচ করতে পারলো যে খুব খারাপ কিছু একটা হয়েছে।
“কিগো ডাক্তার কি বললো?”
নিজাম সাহেব কোন কথা বলতে পারলেন না, তার গলা আটকে গেল। শুধু তিনি আলেয়ার দুটি হাত জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন।

(চলবে)

-নিলম্বিত গণিতক


মন্তব্য

ফাহিম হাসান এর ছবি

নিলম্বিত গণিতক -অর্থ কী?

পাগল মন এর ছবি

ভাই (অথবা বোন, জানিনা) এরকম দুঃখের কাহিনীর দিকে এগোচ্ছেন কেন? মন খারাপ
পড়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

প্রতিচ্ছবি (শূন্য)   এর ছবি

প্রথম পর্ব পড়ে তো ভালই লেগেছিল কিন্তু এই পর্ব পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল, কি বলব বুঝতে পারছি না!
তারপর ও অপেক্ষায় থাকলাম পরের পর্বের জন্যে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।