আফ্রিকায় বৃষ্টি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ৩১/০৫/২০১১ - ১০:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আফ্রিকায় বৃষ্টি
- সুমাদ্রি শেখর
গতরাতে বৃষ্টি হল পাগলের প্রলাপের মত অবিশ্রান্ত।আফ্রিকার আকাশ বাংলার আকাশের মত সুনীল হলে কি হবে,এর অভিধানে অভিমান শব্দটি নেই।তাই এখানের বৃষ্টি দেখে একবার ও মনে হয়না আকাশের আজ মন খারাপ। মনে আছে যখন আসি এখানে তখন এক কাল বন্ধুকে বেশ গর্বভরে বলেছিলাম আমি বর্ষার দেশের মানুষ। বৃষ্টির জল আমাদের হৃদয়ের ভাষা বোঝে।কি জানি কি ভেবে বন্ধুটি আমার হেসে বলেছিল আফ্রিকার বর্ষা অতোটা রোমান্টিক নয়।এখানের প্রকৃতির সাথে আমাদের শ্যামলিমার অনেক মিল থাকলেও বৃষ্টি-প্রেমের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ কদম ফুলের গাছ কোথাও চোখে পড়লনা এ কমাসে।আহা কদম ফুল!পৃথিবীতে অমন সুন্দর ফুল কটি ফোটে বর্ষাকালে।মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে চারপাশের পাহাড় থেকে যখন ভেসে আসত বুনো কদমের মায়াবী গন্ধ তখন জন কীটস পড়াতে আসা শিক্ষকটি ও হঠাৎ যক্ষের মত বিরহী হয়ে উঠতেন।পৃথিবীর অন্য ভাষায় বর্ষাবন্দনা অমন করে কি হয়েছে কোনকালে?

রাতে বৃষ্টি হলে তারপরদিন সকালে ক্যাম্পের সামনের পাহাড়ে নেমে আসে মেঘের দল।সে এক অপূর্ব,অপার্থিব দৃশ্য।যেন মনে হয় পাহাড়গুলোকে সান্ত্বনা দিতে আসে ওরা,কিংবা অন্য আকাশের অন্য পৃথিবীর গল্প,ঘ্রাণ নিয়ে আসে ওদের কাছে।এই যে পাহাড়গুলো কার অভিশাপে কত হাজার বছর ধরে মাটির সাথে আটকে পড়ে আছে কে জানে,তাদের জন্য ভারী মায়া হয় মাঝে মাঝে।প্রখর রোদে তারা জ্বলে পুড়ে যায়,দূর্দান্ত হাওয়া তাদের শরীর ছিঁড়ে দেয় আর বৃষ্টির প্রচন্ডতার মাঝে তারা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে বিদ্যুতের নকশা দেখে আকাশে।লাবণ্য শব্দটা ঠিক মানায়না এ বর্ষার জন্য।যখন আসি এ দেশে তখন মাঝে মাঝে আকাশে আসতেন 'হারমাটান'।লাল ধূলায় আকাশ ঢেকে ফেলে দানবের মত হুংকার ছাড়তে ছাড়তে তিনি ছুটে যেতেন গ্রাম,শহর আর সাভানার ওপর।আচেবির গল্পে পড়েছি পঙ্গপালের ঝাঁকের আকাশ ঢেকে ফেলার কথা।হারমাটানের কবলে পড়লে আমাদের নাক দিয়ে রক্ত ঝরত,তাই পরবর্তীতে যখনই আকাশে লাল ধূলোর মেঘ দেখতাম আমি ভোঁ দৌঁড় দিয়ে ফিরে আসতাম আমার রুমে,তারপর ঝড় থেমে গেলে খোঁজ নিতাম কার নাক দিয়ে কতটুকু রক্ত ঝরল।

বাংলার বৃষ্টির সাথে অদৃশ্য নুপুরপরা অপ্সরারা নাচে।কান পাতলেই শোনা যায় ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম।গ্রামে টিনের চালে একটা মধুর শব্দ হত,ঝোপ থেকে,ডোবা থেকে অবিরত ব্যাঙেরা প্রণয়গীত গেয়ে যেত।আমরা তখন মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এক দৌঁড়ে উঠোন পেরিয়ে চলে যেতাম আম বাগানে,তারপর বৃষ্টি থেমে গেলে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে আসতাম ঘরে দুপকেট ভরে কাঁচা আম নিয়ে।কখনো কখনো শিলাবৃষ্টি হলে মা বলতেন, আকাশের ওপারে যে দুষ্টু ছেলেদের দল আছে তারা আমাদের হিংসে করে বরফের ঢিল ছুঁড়ে মারছে।তখন ভেবে কূল পেতামনা ওই সব দুষ্টু ছেলেদের সাথে আমাদের কিসের শত্রুতা।মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে শুনতাম,

নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।

এরকম বর্ষামেদুর দিনে কখনো স্কুলে যেতে না হলে,ঘরে বাবা থাকলে আমি দোতলার একলা ঘরে গিয়ে চুপিচুপি আকাশ দেখতাম আর ওপারের দুষ্টু ছেলেদের খুঁজে বেড়াতাম। তখন চোখে পড়ত রজনী জেঠা মাথায় জোঁইর চাপিয়ে বিলের কিনারে ঘাস কাটছেন, ওপাড়ার নীলু ইয়া বড় কচুপাতাকে ছাতা বানিয়ে মাথার ওপর ধরে ঘরে ফিরছে,আর চারদিকে সেই অমোঘ সংগীত।ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম। এ সুর বহুদূরের ওপার থেকে ভেসে আসা সুর।

এখানের বৃষ্টি যেন হুংকার ছাড়ে,আমার প্রিফ্যাবের ছাদে দুমদাম কিল বসায়।ভেকেদের গীতে প্রণয়ের লেশমাত্র ও নেই।আমি খুব আশা করে বসে থাকি কোথাও বাজবে মেঘ রাগ কিংবা রবীন্দ্রনাথের গান।বৃষ্টিতে ভেসে আসে বৃশ্চিক আর সাপ।আতঙ্কে আমরা রুমে নিজেদের বন্দী করে রাখি।আমাদের পোষা হরিণ দুটো মায়াময় চোখে ভিজে যেতে থাকে।জলের তোড় মাটির ওপর দিয়ে গড়িয়ে যেতে যেতে একটা ধারা তৈরী করলে আমার কাগজ দিয়ে নৌকা বানাতে খুব ইচ্ছে করে।ছোটবেলায় এভাবে আমি পাড়ি দিতাম সাগর-মহাসাগর।জানিনা কোন অদ্ভুত কারনে বৃষ্টি এলেই শৈশবটা স্মৃতি থেকে লাফিয়ে পড়তে চায় যৌবনের আঙিনায়।

গতকাল সারাটা রাত অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হল।এটা বর্ষাকাল শুরুর পূর্বাভাষ।এ ঋতুতে এখানে আকাশ ভেঙে ভেঙে পড়ে।কখনো কখনো টানা এক সপ্তাহ।সকালে দেখলাম মেঘগুলো নেমে এসেছে পাহাড়ের কোলে।হয়তো নতুন কোন পৃথিবীর নতুন কোন গল্প নিয়ে।আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করে মেঘ রাগ কিংবা মায়ের কন্ঠ-

নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।


মন্তব্য

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

অসাধারণ আপনার বৃষ্টি বন্দনা। সচলায়ন ভ্রমন সংকলন 'ভ্রমনীয়'-তে ঠাঁই পাওয়া সবশেষের লেখাটিতে আফ্রিকার এমনই একটি বর্ষণমুখর রাতের ছবি ফোটাতে চেয়েছিলাম, আপনার মতো এত নিখুঁত ফোটাতে পারিনি।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমি আফ্রিকার বৃষ্টির বৈশিষ্ট্য আর বাংলাদেশের বৃষ্টির সাথে তার পার্থক্য বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

স্পর্শ এর ছবি

খুব ভালো লাগলো আপনার বর্ণনা।
আপনি বোধ হয় বাংলার পারিপার্শটাকেই মিস করছেন বেশি।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

অপুর্ব হয়েছে বৃস্টি বর্ননা। খুব ভালো লাগলো।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

লেখা ভালো লেগেছে।

একটা ব্যাপার, লেখার 'ক্যাটাগরি' সাবধানে ভেবে লিখুন। ক্যাটাগরি দেয়ার একটা বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে। হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ঢাকায় তো এখন প্রতিদিন বৃষ্টি। দারুণ মজা...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বৃষ্টিময় লেখালেখি আমার বরাবরই প্রিয়। আফ্রিকার বৃষ্টি বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্ন। কিন্তু এই পার্থক্যটা আরেকটু বিস্তারিত লিখলো ভালো হতো। নতুন জায়গার অভিজ্ঞতা নিয়ে দুহাত ভরে লিখুন।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

কবি-মৃত্যুময় এর ছবি

আবহমান বাংলার অপূর্ব বর্ষারূপ এঁকেছেন। আপনার হাহাকার স্পর্শ করতে পারলাম।

কল্যাণ ফৌজদার এর ছবি

আফ্রিকা বলতে কোন দেশের কথা লিখলেন দয়া করে জানাবেন?

সাইফুল এর ছবি

বন্ধু, অসাধারণ। এতো ভালো লাগছে পড়ে, মনে হল ফিরে যাচ্ছি সেই ভার্সিটি জীবনের বর্ষার দিন গুলোতে যখন কাটা পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় আতংকে থাকতাম কখন পাহাড় ভেঙে পড়ে!!

্কানিজ ফাতিমা এর ছবি

লিখাটা ভাল লেগেছে।পড়তে পড়তে আমিও যেন বরষার গান শুনতে পাচ্ছিলাম।কদম ফুল,কচু পাতায় জলের নাচ সব যেন ভেসে উঠছিল জীবন্ত হয়ে।সুন্দর।

অমি_বন্যা এর ছবি

বৃষ্টি আমার খুবি প্রিয়। এখনও বৃষ্টি হলে রাতে আলো নিভিয়ে জানালা খুলে বৃষ্টি দেখি। লেখা পড়ে সেই কথায় আবার মনে পড়ে গেলো। ভাল লাগলো আফ্রিকার বৃষ্টির বর্ণনা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।