বর্ষার খেরোখাতা!!!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০২/০৬/২০১১ - ৮:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কালীদাস থেকে রবীনদ্রনাথ মৌসুমের প্রথম মেঘ এবং বৃস্টি নিয়ে অনেক যল্পনা কল্পনা করেছেন। সাহিত্যের প্রত্যেক শাখায় অনভুতির অবাধ বিচরন করেছেন, লিখেছেন কবিতা, গান, নাটক, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস। বাঙ্গালী মনে ক্ষেত্র প্রস্তুতই আছে। একটু শুধু বর্ষার ছোঁয়া, যাদু বলেই মন মেঘের সঙ্গী হয়ে উড়ে যায় অসীম দিগন্তে!! দুর্গম পাহারে নির্বাসিত প্রেমিক মেঘকে দুত বানিয়ে, বিরহি মনের আকুলতা অপুর্ব সৌন্দর্যে সংস্কৃত শ্লোকে লিখেছিলেন! প্রেমিকার জন্য তার পোষা কবুতর ও ছিলো না, ছিলো না ঘোড়ার, অথবা গাড়ীর স্বাধিনতা, পোস্টাল সার্ভিস তখনও সবার অজানা। আর এখন তো, মুহুর্তেই ই-মেইলে, টেক্সটিঙ্গে পৃথিবীর এ মাথা থেকে ও মাথায় বার্তা চলে যায়, চাইলে ‘নিশিথ রাতের বাদল ধারা,’ বা যেকোন বর্ষার গান ইউ-টিউবে ঘরে বাইরে চলতে ফিরতে সর্বত্রই মন চাইলেই শোনা যায়, পকেটে রাখা স্মার্ট ফোনে, এবং অনুভবে সাড়াও ফেলে দ্যায়। বর্ষার শ্বাশ্বত আবেদন বাঙ্গালীর মনে, অনুভুতিতে স্থায়ী হয়ে আছে।

বাঙ্গালীর ছয় ঋতুর মধ্য দ্বিতীয় হচ্ছে বর্ষা। চলেন যাই ফ্যান্টাসি নয় দৈনিক জীবনে এই ঋতু কেমন ছিলো, সেই সময়ে অর্থাৎ প্রযুক্তির যাদুর মহা উৎকর্ষের বেশ আগে, এই ধরুন সত্তুরের দশকে জীবনটা যখন একটু অন্যরকম ছিলো মনে করুন এটা তখনকার খেরোখাতা। তখন এত উচু উচু ,ঘন, ঘন দালান কোঠা ছিলোনা, ছিলো অনেক ফাঁকা ফাঁকা পাকা দেয়ালের উপর টিনের চাল, যেখানে মুষল ধারায় বৃস্টি পড়ে শব্দ ধবনির যে কি এক অপুর্ব অর্কেস্ত্রা বাজতো!! যে শুনেছে, তার জীবনের স্মৃতিতে তা স্থায়ী হয়ে আছে। তখন ছেলে মেয়েদের ফেসবুকে নয়, আসল মাঠে ময়দানে দাপিয়ে খেলা ধুলায় সময় কাটতো, বর্ষায় সবচেয়ে প্রিয় ছিল বোধহয় বাধাঁনো ঘাটের উপরের সিড়ি থেকে ঝাপ দিয়ে পুকুরে সাতার কাটা। বড়দের ধমক খেয়ে, বাসায় নিশ্চিত মারের ভয়কে তুচ্ছ করে জবার মত লাল চোখ আর কুচকানো চামরা নিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষের মত দল বেধে ছোটরা ঘরে ঢুকতো। এইসব বাঁদরামীর জন্য তারা ঠান্ডা, জ্বরে, কাশিতে শয্যাসায়ী হতো কমই।

তখন ঘরে ঘরে ফ্রিজ ছিলোনা, ছিলোনা গ্যাসের চুলো, তুমুল বৃস্টিতে পাড়ার কাঁচা বাজার কয়েক হাত পানির তলে। মুদী দোকানের শুকনো চাল দাল, ডিমই সম্বল। বর্ষার সাথে ডাল চালের খিচুরির একটা আলাদা সম্পর্ক আছে। সাথে আলু ভর্তা, ডিম ভাজি, তার সাথে একটু মায়ের হাতে বানানো আচার, অমৃত, বিশ্বাস করুন মুখের মধ্য যেন অমৃত দিলেন, আর সাথে যদি গোল বেগুনের চাকা ভাজি থাকে, তাহলে আর বলতে হবেনা আপনার সব চেয়ে উপাদেয় খাবার কোনটি!!! বর্ষা এমনিতে সম্মৃদ্ধির মাস, ইলিশের প্রাচুর্য, আর তখনকার ইলিশের সাইজ এবং স্বাদের বর্ননা! এত মজার সেই সময়ের শর্ষে ইলিশ, পাতুরি, দোপেয়াজি, মাথা, লেজ, কাটা, টাটা যে তরকারিতেই দেয়া হোত তা সে শষা, ঝিংগে, কচু, লতি, শাক, ডাটা, তা হয়ে যেত অসম্ভব মজার খাবারে! নুতন বৃস্টির পানি পুকুর উপচিয়ে পথঘাট ভাসিয়ে নিয়ে যেত, পুকুরের মাছ রাস্তায় রাস্তায় সাতার কেটে পথচারীর বিস্মিত শিকারে পরিনত হোত। ঘরে ঘরে মাছ ধরার সে কি উৎফুল্ল উৎসব! বৃস্টির পানির সাথে সাথেই কৈ মাছ পুকুর ছাড়তো। রুপালী পুটি মাছে লেজ থেকে মাথা পর্যন্ত মোটা একটি রেখায় লাগতো রংধনুর সব রং। পাড়ার ছোট ছেলে মেয়েরা গামছার দুইপ্রান্তের দুইধারে ধরে থেকে একেক খ্যাপেই চেচিয়ে পাড়া মাতানোর মত পুটি মাছ ধরে আনন্দে উচ্ছাসে বাড়ীর বড়দের তাক লাগিয়ে দিত!

সব সময়েই আম, কাঠাল, পেয়ারা সকলের পছন্দের তালিকায় থাকে। কাঠালের কোঁয়ার চাইতে বিচির কদর অনেক বেশি, এর ব্যাবহার গুনে। যেকোন তরকারিতে কাঠালের বিচি ম্যাজিক করে। কচি ডাটা, শুটকি, নিরামিশ, এমনকি যদি মুরগি বা মাংসের মাঝে দেয়া হয়, স্বাদ বদলে যায় আমুলে!! কাঠালের কোঁয়া চেলে নেয়া রসের সাথে তালের বা আখের গুড়, চালের গুড়ি মিশিয়ে, নারকেল দিয়ে মাখিয়ে কাঠের চুলায় মাটির খোলায় কলাপাতার উপরে বিছিয়ে দিয়ে উপরে আর এক টুকরা কলা পাতা দিয়ে, মাটির ঢাকনা দিয়ে ঢেকে একটা অসম্ভব মজার পিঠে বানানো হোত তখন, নাম ভুলে গিয়েছি, কিন্ত স্বাদটা মনে আছে! বর্ষায় ঝাল মুড়ির আবেদন এত প্রবল যে বিদেশে এসে রাইস ক্রিস পিস দিয়ে দুধের স্বাধ ঘোলে মিটানোর মত কচর মচর করে খেয়েছি, একেবারে খারাপ না!! মনকে মানাতে তো হবে!! এখনো মুশল ধারে বৃস্টি দেখলেই মন চলে যায় সেই স্মৃতির শহরে, যেখানে সামনে ঝাল মুড়ি, ঘুঘনি, পিয়াজি, কাঠাল বিচি ভাজা (গরম বালির মধ্য যেটা ভাজা হোত) নিয়ে সাপ লুডো, বা ক্যারম খেলার দিনগুলিতে!

শুভ্র, সুগন্ধি ফুলের মধ্যে বেলি ফুলের মালা বোধ হয় ঐ সময়ে সব্বার পছন্দের তালিকায় থাকতো। দোলন চাঁপা, গন্ধরাজ, আর কদম ফুল বর্ষার নিজস্ব সুগন্ধি ফুল। ঘরের দাওয়ায় পানি ছুই ছুই, উঠোন, রাস্তাঘাট, সব যখন থৈ থৈ পানির নীচে, বাড়ীটা যখন দ্বীপের মত, নকসি কাঁথায় আপাদমস্তক নিজেকে মুড়িয়ে, দুপুরের ভাত ঘুমে বা আধো জাগরনে, সন্ধ্যায় যখন নিশিথ রাতের মত নিস্তব্ধতায় টিনের চালে, বৃস্টির ছন্দময় পতনের শব্দে ব্যাঙ্গের, ঝি ঝি পোকার ডাকে, ফুলের তীব্র গন্ধে মন চলে যেত, ‘দূরে বহু দূরে, উজ্জয়নি পুরে, শিপ্রা নদী পাড়ে! স্মৃতির শহরে নাইওরে আসা মেয়েদের মনটা যেন কেমন কেমন করতো!!!

[b]মেঘের কাছে বৃস্টি চিঠি!!!

বিষন্নতার পিওন বানাই মৌসুমের এই মেঘটাকে
তোমায় বলার কথা গুলি দেই যে গুজে ফাঁকে ফাঁকে
জানি আমি খুজছো তুমি বইএর মাঝে, সকাল, সাঁঝে,
প্রতি দিনের প্রতি কাজে, ঘর দুয়ারের ভাজে ভাজে,
বিচ্ছেদেরই স্মৃতি বাজে। শোকগুলি সব ঝরতে থাকে,
বিষন্নতার কান্না হয়ে, বৃস্টি হয়ে, বিরহেরই সময়টাতে।
বন্দি হয়ে, দুই শহরের ম্যাপের পাতায়, বৃস্টি মাথায়,
স্মৃতির ছাতায়, আমার মতই তোমার তখন
চোখের কোনায় অশ্রুকনা ছল ছলায়???

মেঘে মেঘে আকাশ ঢাকা এই জুনে,
বর্ষারাতে অভিমানের দিন গুনে,
এইখানেতে দিন দুপুরে, বৃস্টি নামে রবীর সুরে,
থাকবে তুমি আর কতদিন? কত দূরে??
কালীদাসের সেই চিঠিতে, অনুভবের মন দুটিতে,
যায় না ভাবা।
আষার মাসের এই ছুটিতেই, খুশীর আভা,
আসবে তুমি আমার কাছে!!!
মেঘের কাছেই বৃস্টি নামের চিঠি আছে!!

আসমা খান, অটোয়া।


মন্তব্য

মৌনকুহর. এর ছবি

"প্রযুক্তির যাদুর মহা উৎকর্ষের বেশ আগে" বিধাতা কেন যে পৃথিবীতে পাঠালেন না...... মন খারাপ

লেখায় চলুক

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যর জন্য। প্রিয় স্মৃতিগুলি ছড়িয়ে দিতে চাই, সেই সময়ে বার বার ফিরে যেতে চাই, যদি সেই অনুভুতি কাউকে ছুয়ে যায়, খুব ভালো লাগে শুনতে।

কৌস্তুভ এর ছবি

আহহা, খিদে পেয়ে গেল যে!

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

প্রবাসে এসে আমরা কি হাভাতে হয়ে যাচ্ছি? যাক কি খেতে ইচ্ছে করছে?

অপছন্দনীয় এর ছবি

উঁহুঁ, প্রবাস বা নিবাস বলে কথা নয়, পেটুক মানুষের সবসময়েই খিদে পায়। সচলে এরকম একটা গ্রুপ পাবেন, গ্রুপসুদ্ধ পেটুক...এই যেমন ধরুন আমি...

ওডিন এর ছবি

তারপরে ধরেন, আমি পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

আমিও যে আপনাদের সাথেই আছি, সারাক্ষন খাই খাই, প্লেট ছোট সাইজের, তার মধ্য সবুজ পাতাই অর্ধেক! বাকী অর্ধেকে নুন কম তেল কম আহা কী সাধের খাবার!!! ইন্সুলিনের সুই ফুটাই আর মনে মনে বলি এই গরমে যদি এক গ্লাস লাচ্ছি পাইতাম!

কৌস্তভ, ওডিন, অপছন্দনীয় মনে মনে খেয়ে ফেলেন যা মন চায়, স্বপ্নে যখন পোলাও রাঁধবেন, বেশী করে ঘী দিতে ভুল্অবেন না, আমার প্রিয় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী বলে গেছেন।

অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যর জন্য, ভালো থাকবেন।

আশালতা এর ছবি

বর্ষা কিন্তু এখনো ভীষণ সুন্দর । এই কদিনের ছুটিতে প্রাণ ভরে বর্ষা যাপন করেছি, তাই ছুটি শেষে বিচ্ছিরি শহরটায় ফিরে মন খারাপ ছিল। আপনার লেখাটা পড়ে আবার ফিরে গেলাম পুরনো দিনে......কী ভালো যে লাগল...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।