নিলম্বিত গণিতক। পর্ব-৩।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৪/০৬/২০১১ - ৫:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পর্ব-১।

পর্ব-২।

পর্ব-৩

প্রায় পনেরো দিন পরের কথা।
এই পনেরো দিনের মধ্যে নতুন ঘটনা তেমন কিছু ঘটেনি, শুধু নিজাম সাহেবের প্রমোশন লেটারটা ছাড়া। নিজাম সাহেব ভেবে রেখেছিলেন যে যেদিন তিনি লেটারটা পাবেন তার পরদিন আলেয়া আর তিতুকে নিয়ে আশুলিয়ায় বেড়াতে যাবেন। ভেবেছিলেন সারাটা দিন এদেরকে নিয়ে আনন্দ করবেন। তিতুকে ঘাড়ে নিয়ে ঘুরবেন। তিতু নামতে চাইলেও তাকে নামাবেন না। বাসায় ফিরবার আগে আলেয়াকে নিয়ে শাড়ীর দোকানে যাবেন। আলেয়া হাজার আপত্তি করলেও তাকে একটি ভালো শাড়ী কিনে দেবেন। সে শাড়ীটির রঙ হবে টুকটুকে লাল।
অথচ কি থেকে কি হয়ে গেল।

তিতুর শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে এই ক’দিনে। অন্য আর এক বড় চাইল্ড স্পেশালিস্ট এর কাছেও নিয়ে গিয়েছিলেন তিতুকে। তিনিও প্রায় একই কথা বলেছেন। খুব বেশী সময় হাতে নেই আর। চিকিৎসা করা আর না করা একই কথা।

তিতুর এখন প্রায়ই জ্বর থাকে। খেতে পারেনা তেমন, খিদেও থাকেনা প্রায় সময়। অনেকটা শুকিয়ে গেছে সে, সে জন্য তার শীর্ণ মুখে চোখজোড়াকে বেশ বড় লাগে দেখতে। সে চোখে এমন একটি শান্ত ভাব থাকে, যে তার দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।

কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছেন আলেয়াকে দেখে। আলেয়া সব সময়েই একটু ধীরস্থির, শান্ত। কিন্তু নিজাম সাহেব ভেবেছিলেন যে তিতুর শরীর খারাপের কথা শুনে সে একেবারেই ভেঙ্গে পড়বে। তখন তাকে আলেয়া আর তিতু দুজনকেই সামলাতে হবে।

অথচ আলেয়া যেন আরো ধীরস্থির হয়ে গেছে। তার দিকে তাকালে বোঝা যায় যে সে ভিতরে ভিতরে ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে, চোখের কোণে কালি পড়েছে না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। বেশীর ভাগ সময়েই সে তিতুর মাথার কাছে বসে থাকে, চুলে বিলি কাটতে কাটতে নানা রকম গল্প বলে। আবার একই সাথে সে সংসারও সামলাচ্ছে। নিজাম সাহেবকে মাত্র একদিন অফিস কামাই দিতে হয়েছে।

প্রতিদিন বাসায় ফিরবার সময় নিজাম সাহেবের বুকটা একটু কেঁপে ওঠে। আজ কেমন আছে তিতু? তারপর আপনমনে একটু হাসেন। আলেয়া আছে না? সব কিছু ঠিকঠাক থাকবে।

তিতুকে কোন রকম চিকিৎসা করানো হচ্ছেনা। শুধু জ্বর কমানোর জন্যে একটা ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। দুজন ডাক্তারই বলেছেন যে কেমোথেরাপী রোগের এই পর্যায়ে তেমন একটা উপকারে আসবে না, বরং কেমোথেরাপীর কারণে আরো কষ্ট পাবে বাচ্চাটা।

আজ বৃহস্পতিবার। কাল-পরশু ছুটি। বিকেলে বাসায় ফিরে সোজা রান্নাঘরে ঢুকলেন নিজাম সাহেব। এখানে কোথায় কি আছে তা তিনি ভালমতো জানেনও না। তারপরও খুঁজে খুঁজে চা আর চিনি বার করলেন। চুলোর উপর আলেয়ার রান্না করা মাছের চচ্চড়িটা সরিয়ে পানি গরম করতে দিলেন।

ঘর থেকে আলেয়া জিজ্ঞেস করলো, “তুমি রান্নাঘর কি করো? খিদে লেগেছে? আমি কি কিছু একটা বানিয়ে দেবো?”
নিজাম সাহেব বললেন,” তুমি ব্যস্ত হয়োনা। আমি একটু চা বানাচ্ছি।“
“তুমি চা বানাবে? কেন? আমি তো একটু পরেই চা বানাতাম।“
“আমি বানালে অসুবিধা কি? পানি ফুটে গেলে তাতে চা পাতা দিতে হবে এইটুকুই তো কাজ। আমি ঠিকই পারবো।“

চায়ের পাতা ইচ্ছে করেই অনেকখানি দিলেন ফুটন্ত পানিতে। কালো আলকাতরার মতো চায়ের রঙ হয়েছে। নিজের কাপে ইচ্ছে করে দুধ মেশালেন না তিনি। চিনিও দিলেন না। তারপর ওষুধ গেলার মতো মুখ বিকৃত করে গলায় ঢাললেন সেই চা।
তার দেরী দেখে আলেয়া রান্নাঘরে ঢুকছিল। নিজাম সাহেবের চায়ের রঙ সে অবাক হলো।
“কি ব্যাপার-তুমি এই বিশ্রী চা খাচ্ছো কেন? তোমার রাতে তো ঘুম হবে না আজ।“
নিজাম সাহেব হাসলেন। “একজ্যাক্টলি। আজকে আমার ঘুমানোর কোন প্ল্যান নেই।“
“কেন?”
“কেন- আজকে রাতে আমি তিতুর কাছে থাকবো, আর তুমি তোমার বিছানায় শুয়ে ঘুমাবে। কতদিন তুমি ভাল করে ঘুমাওনি। এভাবে চললে তুমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়বে।“
“কে তোমাকে বল্লো যে আমি ঘুমাই না। নিশ্চয়ই তিতু। ছেলেটা শুধু কথা বানায়।“
“তিতুকে বতে হবে কেন? আমার চোখ নেই? আমি কি দেখছি না কোনকিছু? আমার কাল আর পরশু ছুটি। অতএব আজ আর কাল রাতে তোমার ছুটি। আমি আর তিতু আজ সারা রাত ধরে গল্প করবো। তোমার কোন আপত্তিই আজকে শোনা হবে না।“
আলেয়া হাসলো। “আচ্ছা ঠিক আছে। আজকে তিতুর কাছে তুমিই থেকো। কোন কিছুর দরকার পড়লে কিন্তু আমাকে ডাকবে।“
“দরকার পড়বে না।“

নিজাম সাহেব কিছুটা রুটিন মেনে চলা মানুষ। চিরকালই তিনি রাত সাড়ে দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। শেষ কবে তিনি রাত জেগেছেন তা তাঁর মনে নেই।

তিতু বাবাকে কাছে পেয়ে খুশী। “আজকে কিন্তু তোমাকে অনেক গল্প বলতে হবে বাবা।“
“অবশ্যই। আমার গল্প শুনলে তুই একদম পাগল হয়ে যাবি।“
তিতুর চোখ ছলছল করলেও তাতে স্পষ্ট আনন্দের দোলা বয়ে যায়। “আচ্ছা।“

রাত বাড়ার সাথে সাথে আশপাশ চুপচাপ হয়ে আসে। মাঝেমাঝে পাড়ার নাইটগার্ড হোসেন আলীর হুংকার শোনা যায়, “খবরদার। আমি কিন্তু পাহারায় আছি।“

তিতুকে গল্প বলতে বলতে নিজাম সাহেবের হাসি পায় সেই ডাক শুনে। হোসেন আলী রোগা পটকা মানুষ, হাতে অস্ত্র বলতে একটা লাঠি। কিন্তু তার গলার আওয়াজটি বাজখাঁই। কে জানে, চোর ডাকাতেরা সে আওয়াজ শুনে ভয় পেতেও পারে।

রাত তিনটের দিকে তিতু ঘুমিয়ে পড়ে। নিজাম সাহেবেরও একটু তন্দ্রা পায়। তিনি চেয়ারটিতে গা এলিয়ে দেন।

কতক্ষণ তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন খেয়াল নেই, কিন্তু এক সময় তার মনে হলো কে যেন তার হাতের উপর হাত রাখলো। কে যেন তাকে ডাকছে। তিনি ধড়মর করে ঊঠে পড়েন। কিন্তু কই-কেউ তো নেই ঘরে। বিছানায় তিতু অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ওঘরে আলেয়ার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
তাহলে কে ডাকলো তাকে? মনের ভুল।

নিজাম সাহেব আবার চোখ বন্ধ করলেন। এবারে তিনি যেন স্পষ্ট শুনলেন, কে যেন তাকে বহুদূর থেকে ডাকছে।
“আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি।“
নিজাম সাহেব এবারে চোখ খুললেন না। মনের ভুলে মানুষ কত কি শোনে আর কত কি দেখে।

একটু ক্ষণ পরে আরো স্পষ্ট হলো ডাকটি। “শুনছেন- আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?”
নিজাম সাহেব মনে মনে উত্তর দিলেন। “হ্যাঁ শুনছি। কিন্তু আপনি কে?”
কন্ঠস্বরটি যেন এবারে একটু নিশ্চিন্ত হলো। “আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি। আপনি আমার কথা দয়া করে মন দিয়ে শুনুন।“

(চলবে)

-নিলম্বিত গণিতক


মন্তব্য

পাগল মন এর ছবি

হুমম, গল্পের নতুন মোড়?!
দেখি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
চালিয়ে যান, পাশে আছি।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

মর্ম এর ছবি

প্রতি পর্বের শেষে একটা মোচড় থাকছে যা পরের পর্ব পড়ার আগ্রহটা তৈরি করে দিচ্ছে, এ ব্যাপারটা বেশ লাগল।

চলুক তিতুর গল্প চলুক

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

খুব ভালো লাগছে্, পরের পর্বে আশার কিছু শুনবো? কৌতুহলে আছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।