অপরাহ্ণ সুসমিতো
স্টেশনে নামতেই টিকেটের সাথে স্টেশনের নামটা আবারো মিলিয়ে নিলাম । ভুরঘাটা । পুরানো ভাঙ্গাচোরা আদ্দিকালের এক স্টেশন,বাংলাদেশের আর পাঁচ দশটা রেল স্টেশনের মতোই । চারিদিকে পান বিড়ি পান শব্দের আনাগোনা । ভাবছি বেরিয়েই রিক্সা নেব । আপাতত সার্কিট হাউজ । সার্কিট হাউজে পৌঁছে চমৎকার এক গোসল,তারপর ধোঁয়া ওড়ানো ভাত,আহা,তারপর লম্বা এক ঘুম । এরকম ভাবতে দারুন এক আবেশ লাগে । এক পা সামনে বাড়াতে হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন আমার ডাক নাম ধরে ডাক দিল । অবাক হয়ে গেলাম । এই অচেনা জায়গায় কে আবার আমার নাম ধরে ডাকে । পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি অচেনা এক মানুষ । বিবর্ণ,বিভৎস পোশাক । ডান হাতের অর্ধেকটা নেই । প্যান্ট ময়লা,হরেক রঙের তালি । ফুল হাতা জামা,ডান হাতের অর্ধেক নেই বলে হাতাটা ঝুলছে । আমি তো অবাকে থ’ । ওই জায়গাটায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম । কে এই শ্রীমান ? একদম আমার ডাক নাম ধরে ডাকল ।
শ্রীমান খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আমার খুব কাছে এল । ও আমার চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছে যে আমি ওকে একদম চিনতে পারছি না । ও আরো কাছে এসে আমার কাঁধে জোরে সোরে একটা চাটি মেরে বলল
: দোস্ত চিনতে পার নাই বুইজা ফালাইছি,আমি কুদ্দুস । আরে শালা মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস । ৪৩৭,শাহজালাল হল । দে দে সিগ্রেট দে ।
এক সেকেন্ডের এক দশমাংশ সময়েই আমি চিনে ফেলি,আমার বন্ধু কাম রুমমেট ছিল । অই স্টেশনে প্রায়-সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিক আমি ডুব দেই অতীতে ।
তখন একাত্তেরর মাঝামাঝি । যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে । আমি আর কুদ্দুস একই রুমে থাকতাম । পঁচিশে মার্চ রাতে গণহত্যার পর আমরা পালিয়ে দু’জন একসাথে ভারতে চলে যাই । আমি খানিকটা দোনোমনো করলেও কুদ্দুসের প্রচন্ড জেদ,পীড়াপীড়িতে আমাকেও যেতে হলো । ট্রেনিং এর পর আমরা একই সেক্টরে যুদ্ধ করি । স্মরণাতীত কালের ভয়াবহ সে যুদ্ধ । যুদ্ধে কু্দ্দুসের ডান হাতের পুরো অর্ধেক উড়ে যায় । দেশ স্বাধীন হলে যে যার মতো জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি । কুদ্দুস বাড়ি ফিরে দেখে ওদের বাড়ির কোন চিহ্ণ নেই । গ্রামের লোকদের মুখে শুনে-পাকিস্তানী সেনাবাহিনীরা ওর বাবাকে তাৎক্ষণিক বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারে । রাজাকাররা ওর মা’র গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ছোট বোনকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় । পরে বোনের লাশ পাওয়া যায়,তেতুল গাছের নীচে । মৃত ।
জীবন চলে যায় বহতা নদীর মতো । কুদ্দুসের সাথে যোগাযোগ ক্ষীণ হতে হতে ক্ষীণতর হয়ে আসে । এক সময় ধূসর পান্ডুর হয়ে যায় সংযোগাযোগ ।
হঠাৎ সিগারেট জ্বালাবার শব্দে বর্তমানে ফিরে আসি । আমার সামনে সেই কুদ্দুস । চেহারায়,চুলে সবকিছুতেই বয়সের ছোবল । চোখের কোনে বড় ঈগলের পায়ের ছাপ । আমাদের সামনে হামাগুড়ি দিয়ে কালো ওড়নার মতো সন্ধ্যা নামে । আমার কেন যেন একটু অস্বস্তি লাগছিল । কুদ্দুস বলে –
: একটু সামনে যাবি দোস্ত ? জরুরী কথা ছিল ।
সামনেই ঢালু রাস্তা । দু’জনেই এগোই । হাঁটতে থাকি এক সময়কার দু’জন সাহসী পুরুষ । একটু নীচের দিকে নামতে একটা নির্জন জায়গার কাছাকাছি আসতে কুদ্দুস থামে । কুদ্দুসের জলদ গম্ভীর গলা-
: দোস্ত,আমার মনে হয় তোমারে বেশী কিছু কওন লাগবো না । যা আছে ঝটপট দিয়া ফালাও । দেরী কইরো না । পরে আবার এদিকে লোকজন আইয়া পড়তে পারে ।
তাকিয়ে দেখি ওর বাম হাতটা ডান হাতের চেয়ে দ্বিগুন লম্বা । বাম হাতে অস্ত্র । নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগে । মাথা নীচু হয়ে যায় । দীর্ঘ যাত্রা ভ্রমনের ক্লান্তি সমস্ত শরীরে হঠাৎ করে ভর করে । ভারী,হ্রস্ব লাগে সব । আমি আমার মানিব্যাগ,ব্রিফকেস খুব ধীরে ধীরে ওর পায়ের কাছে রেখে দেই,পূজার বেদীতে ফুল রাখার মতো করে । মনে মনে বলি : উৎসর্গ,তোমাকে বন্ধু ।
সব কিছু রেখে চলে আসব,রওয়ানা দিতেই কুদ্দুসের গলা-
: দোস্ত,ঘড়িটা ।
মন্তব্য
প্লট ভালো। নির্মাণে কিছু ত্রুটি আছে।
অজ্ঞাতবাস
চেষ্টা চালিয়ে যান। আমরা হতাশ হবো বলে মনে হচ্ছে না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সহমত পোষণ করে গেলাম ষষ্ঠ পাণ্ডবের সাথে।
গল্পের প্লটটা ভালো লাগলেও উপসংহারে আসতে না পেরে একটু অস্বস্তিতে আছি। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও চোর ডাকাতও ছিল, আবার যুদ্ধ থেকে ফিরে চাকরী বাকরী না পেয়ে অনেকে চোর ডাকাতের খাতায় নাম লিখিয়েছে। কুদ্দুস কোন কাতারের মুক্তিযোদ্ধা বুঝতে পারছি না।
তবে এত বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসমেটের দেখা পেয়ে তার সর্বস্ব ছিনতাই করে নিল, ব্যাপারটা কেমন অস্বাভাবিক না? অস্বস্তিটা বুঝতে পারছি এখন। গল্পটার বিশ্বাসযোগ্যতা একটু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এখানে কি কুদ্দুস এর মধ্যে কোন অভিমানের ব্যাপার বোঝাতে চাওয়া হয়েছে। লেখা ভাল, কিন্তু কেন যেন অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে।
নতুন মন্তব্য করুন