আফ্রিকায় সন্ধ্যা
- সুমাদ্রি শেখর।
লাইবেরিয়া সীমান্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের যে পাহাড়গুলো তাদের ওপর পৌঁছালে সূর্যটা একটু বিরাম নেয়।আফ্রিকা সূর্যের মহাদেশ। তার তেজ পুড়িয়ে দিয়েছে মানুষের গা, পাহাড়গুলোকে করেছে পাথুরে, মাটিকে বানিয়েছে রুক্ষ লালরঙা নুড়িসর্বস্ব।সারাটা সকাল, সারাটা দুপুর আর সারাটা বিকেল গনগনে আগুন ঢেলে দিয়ে আকাশের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় চক্কর মারে সে উদ্ধত ভঙ্গীতে। এখানে কাউকে পরোয়া করেনা সে,ভাবখানা এমন যেন বলছে," আমার রাজত্বে আমার যেমন খুশি তেমন সাজব।" সূর্য আফ্রিকায় কারো দাসত্ব মানেনি কখনও। কিন্তু কী তার খেয়াল কে জানে, লাইবেরিয়া সীমান্তের ঐ পাহাড়গুলোর উপর পৌঁছালেই তার রাগ পড়ে যায়,ভীষ্মের শিখন্ডি দর্শনের মত সে তখন দুপাহাড়ের মাঝে নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে।আফ্রিকায় তার একটু পরই সন্ধ্যা নামে।
এখানে সন্ধ্যা ঝুপ করে নামে না, বরং সে আসে ধীর লয়ে।পাহাড়ের মাঝে সিঁদুরের টিপটি হয়ে সূর্য যখন আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, আকাশে তখন বিচিত্র রঙের রথ ছুটে যায় এদিক ওদিক। মার্গারিট ফুলগুলো তখন আরো ঊজ্জ্বল হলুদ হয়ে হাসতে থাকে।ঝোপ থেকে বেরিয়ে ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়তে থাকে বিভিন্ন রঙের ছোট পাখি।হলুদ,সবুজ,নীল,ধূসর।তাদের নামগুলোও বিচিত্র।সেনেগালী,সুইমাঙ্গা,তিসেরাঁ,অংগুলভঁ,মোয়ানিউ।আর উড়ে আসে প্রজাপতির দল।মনে হয় যেন বিচিত্র বর্ণের ফুলেরা দলবেঁধে উড়ে চলেছে ফুলবাগানের খোঁজে।ক্যাম্পের সামনে বুক চিতিয়ে থাকা পাহাড়টা ও যেন বহুরূপী হয়ে পড়ে এসময়।তার কোলে থাকা গ্রামের গোলগোল ঘরগুলির মাথা দিয়ে গলগল করে সাদা ধোঁয়া বেরিয়ে আকাশে মিইয়ে যায়।কোথাও কোথাও বেজে ওঠে তাম্বুর*, বুঝি গুনিন কোথাও মুখোশ পড়ে নাচছে আর অশুভ আত্মাদের গ্রাম থেকে চলে যাবার জন্য হুংকার ছাড়ছে।সড়ক জুড়ে এসময় দেখা যায় হাতে মাচেত* আর পায়ে গামবুট পড়া ক্লান্ত কফি আর মানিয়ক চাষীদের।পিঠে অবুঝ শিশুকে বিশেষ কায়দায় বেঁধে নিয়ে মহিলারা আসেন আমাদের ক্যাম্পের বাইরে খাবার পানি নিতে।তাদের মুখে লেগে থাকে পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলোর মত মৃদু সলাজ হাসি।
মাঝে মাঝে দুপুরে ঘুমিয়ে সন্ধ্যার এই সময়ে জেগে উঠলে কেন জানিনা মনটা ভীষন ভারী হয়ে উঠে।তখন বাড়ীর কথা মনে পড়ে,মা'র মুখটা ভুস করে ভেসে ওঠে মনের মনিকৌঠায়।আমাদের প্রিফ্যাবের সামনের সোনালু ফুলগাছের ওপর বাসা তৈরী করা ধনেশ পাখিটা রোজ এই সময় করুণস্বরে একটানা ডেকে যায়।হয়ত সে বেচারাও বড় নিঃসঙ্গ।মাঝে মাঝে দলবেঁধে ক্যাম্পের বাইরে হাঁটতে যাই।ঘাসবনের ভেতর দিয়ে বাতাস বয়ে যায়,মেঠোপথ দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায় সবুজ সাপ,তার পিঠে চিকচিক করে উঠে সোনালী আলো।বনের ভেতর কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনলে বুঝি শিকারীরা কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে আগুতিদের* পেছনে।আজ রাতে তবে ঝলসানো মাংসের ভোজ হবে দারুণ।গ্রামের কাছাকাছি গেলে বুবু* পড়া বুড়ো মোড়ল হাত নাড়িয়ে বলে," বোঁ সোয়া "। *
তারপর পাহাড়গুলোর ওপারে লাইবেরিয়ার অন্য কোন গ্রামের ওপর সূর্যটা গিয়ে দাঁড়ালে আমাদের আইভরীয়ান আকাশে রঙের রথগুলো ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়।তখন একটি দুটি তিনটি করে ফুটে ওঠে সন্ধ্যাতারারা।আমার তখন অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়।বড্ড একা লাগে।ধনেশ পাখিটা ডেকেই চলে।
* তাম্বুর - আফ্রিকান ঢোল।
* আগুতি- বড় ইঁদুরসদৃশ প্রাণী।
*বুবু- ইয়াকুবা গোত্রের গ্রামের মোড়লদের পরিহিত বিশেষ আলখাল্লা।
* বোঁ সোয়া- শুভ সন্ধ্যা।
মন্তব্য
চমৎকার লাগল আপনার বর্ণনা, মনে হল যেন আমিও আপনার সাথে আছি সেখানে।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
ধন্যবাদ কষ্ট করে লেখাটা পড়ার জন্য। ভাল লেগেছে জেনে আরো ভাল লাগল। চেষ্টা করবো লিখে যেতে।
ভালো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
কাব্যিক গদ্য। ভালো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
মন ভরে পড়লাম কয়েকবার। কানে মধু ঢেলে দেয়া চমৎকার বর্ণনা। আপনার দেখবার চোখ আছে মশাই। লেখনি যাতে ঝিমিয়ে না পড়ে। এমন মুগ্ধস্নানের সুযোগ প্রায়ই করে দেবেন আশারাখি।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
স্পেস আর বানান নিয়ে সাবধান হওয়া প্রয়োজন যেন এমন ভালো লেখা মাঠে মারা না পড়ে।
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
খুব ভালো লাগলো। নিয়মিত পড়তে চাই আপনার লেখা।
সুমিমা ইয়াসমিন
ধন্যবাদ।
facebook
নতুন মন্তব্য করুন