মনের আনন্দে গাইছে শিশুটি, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপের বাহির হলে জননী...
প্রিয় গানটি শুনে হঠাৎ আমার চোখ দুটো ভিজে ওঠে। জন্মান্ধ এই শিশুটি কোনোদিন অপরূপ জননী আর রূপসী বাংলাদেশের রূপ দেখতে পায় নি চোখ মেলে!
৭ বছর বয়সী শিশুটি খাবারের থালা হাতে হোস্টেলের ডাইনিংয়ের দিকে যাচ্ছিল গান গাইতে গাইতে। চট্টগ্রামের মুরাদপুরে সরকারি দৃষ্টি ও বাক্-শ্রবণ প্রতিবন্ধী স্কুলের ছাত্রী হোস্টেলের করিডোরে দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো, নিয়তি কারো কারো জীবনে খুব বেশি নিষ্ঠুর! প্রতিবন্ধিতা, দারিদ্র আর নারীত্ব এই তিনটি বৈশিষ্ট্য একত্রিত হলে জীবনটা যে কতটা সংগ্রামময় হয়, তা কেবল সেই সংগ্রামীই জানে! ছোট্ট শিশুটির জীবন এই তিনটি বৈশিষ্ট্য নিয়েই এগুচ্ছে...।
স্কুলটির অবস্থা যেরকম ধারণা করেছিলাম, এসে দেখি অবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি করুণ! যে সময়ে শিশুদের শ্রেণী কক্ষে ক্লাস করার কথা, সে সময় তারা ব্যস্ত অন্য কাজে। যেসব কাজ স্কুলের কর্মচারীদের করার কথা, কর্মচারী না থাকায় সেসব কাজ শিশু শিক্ষার্থীদেরই করতে হয়। ঝাড়ু দেওয়া, বাগান পরিষ্কার করা, রান্নার কাজ, পানির মোটর পরিচালনা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজ করতে হয় দৃষ্টি ও বাক্-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থীদের। কী অমানবিক!
স্কুল চত্বরে দেখা গেল, ক্লাস চলাকালীন কিছু শিশু শিক্ষার্থী বিভিন্ন কাজ করছে, কিছু শিশু আবার ক্লাসে বসে আছে, শিক্ষক নেই। জানা গেল, শিক্ষক অন্য ক্লাসে পড়াচ্ছে। যেহেতু পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, তাই একটা ক্লাস চললে, অন্য ক্লাসের শিক্ষার্থীদের বসে থাকতে হয়।
১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির কার্যক্রম বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে চলছে। স্কুলের পাঁচটি ভবন থাকলেও এর বেশির ভাগ অংশ সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ। দরজা- জানালা ভেঙে গেছে, পলেস্তারা খসে পড়েছে। সামান্য বৃষ্টিতে ডুবে যায় নিচতলার কক্ষগুলো। স্কুল গেটের ভেতরে ইটের তৈরি ভাঙাচোরা সরু রাস্তা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের চলাচল উপযোগী নয়। দারোয়ান না থাকায় স্কুল চত্বরে যখন তখন যে কেউ প্রবেশ করতে পারে। বিকেলে স্কুল মাঠে চলে বখাটেদের আড্ডা। মেয়ে শিশুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথাযথ নয়। আছে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ। স্কুলের পাশেই সমাজসেবা কার্যালয় থাকলেও কোন তদারকি নেই। সরকারীভাবে প্রদত্ত
সব সুযোগ সুবিধা কাগজে কলমে বন্দী। সমাজসেবা কার্যালয় শোনায় সেই পুরনো সংলাপ-- বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই স্কুলে প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত দৃষ্টি ও বাক প্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তি করানো হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে সারাদেশে এরকম আটটি স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, ঢাকা, ফরিদপুর ও চাঁদপুরে এই স্কুলগুলোর অবস্থান। এসব স্কুলে গত বছর থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাক প্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তি করানোর নির্দেশ জারি হলেও চট্টগ্রামের এই স্কুলটিতে ভর্তি করানো হয় নি কোনো শিক্ষার্থী। ফেরত গেছে গত অর্থ বছরে বরাদ্দকৃত বাজেট। ফেরত যাবে এ বছরের বাজেটও। বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীর অভাবে চালু করা যায় নি, অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম। অথচ কত প্রতিবন্ধী শিশু একটু সুযোগের অভাবে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত! প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য চট্টগ্রামে আছেই একটিমাত্র সরকারী বিদ্যালয়। আর সেটির এমন দূরাবস্থা।
প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই, কর্মচারী নেই। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত দৃষ্টি ও বাক প্রতিবন্ধী শাখায় ৭জন করে শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ২জন করে শিক্ষক। কর্মচারী না থাকায়, কর্মচারীর কাজগুলো প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষার্থীদের করতে হয়।
শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আছে নানা অভিযোগ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অভিভাবকের অভিযোগ, এখানে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে টাকা নেন প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম পাটোয়ারী। শুধু ভর্তি প্রক্রিয়ায় নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। স্কুল ভবনগুলোর যথাযথ সংস্কার হয় না। অভিযোগ আছে, তিনি প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দেন নির্মমভাবে। যথারীতি নজরুল ইসলাম পাটোয়ারী সব অভিযোগ অস্বীকার করে বললেন, আমি কারো কাছ থেকে টাকা নেই নি। আমাদের জনবল সংকট আছে বলে যেসব শিশু হোস্টেলে থাকে, তাদের নিজেদের কাজ নিজেদের করতে হয়। আমরা জনবল চেয়ে প্রতিমাসে উচ্চ পর্যায়ে চিঠি পাঠাই। সরকার থেকে জনবল না পেলে আমাদের কী করার আছে? আর স্কুলের যথাযথ সংস্কার হয় না, কারণ সংস্কারের জন্য বাজেট আসে প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য।
স্কুলভবনের সংস্কার না হলেও স্কুলভবনকে দিব্যি নিজের বাসভবন বানিয়ে ফেলেছেন তিনি। স্কুলটিতে সব মিলিয়ে হোস্টেল থাকার কথা চারটি, আছে তিনটি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ে ও ছেলে শিশুদের জন্য পৃথক দুটি হোস্টেল আর বাক প্রতিবন্ধী ছেলে শিশুদের জন্য একটি হোস্টেল আছে। বাক প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুদের জন্য হোস্টেল সুবিধা নেই। হোস্টেলের পরিবেশ খুব অপরিচ্ছন্ন ও মানবেতর। শিশুদের যত্ন করার জন্য কোনো কর্মী নেই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েদের হোস্টেলে যদিও বা একজন নারী কর্মী আছে, বাবুর্চি না থাকায় তাকে রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। সব হোস্টেলের শিক্ষার্থীদের রান্না তাকেই করতে হয়। আর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুরা পালা করে রান্নার কাজে তাকে সাহায্য করে।
রান্না ঘরে গিয়ে দেখা গেল, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুরা সব্জি কাটছে, চাল-ডাল ধুচ্ছে এবং রান্না শেষে পরিবেশনের কাজ করছে। ছোট ছোট শিশুদের জন্য এসব কাজ খুব ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বটিতে হাত কাটতে পারে, গরম পানি বা গরম তরকারি পড়ে ঝলসে যেতে পারে কোমল শরীর। খাবারের ক্ষেত্রে পুষ্টিমান তদারক করা হয় না। অধিকাংশ শিশু ভুগছে পুষ্টিহীনতায়। বেশ কিছু শিশু চর্মরোগে আক্রান্ত। চিকিৎসা নেই। ছেলে শিশুদের হোস্টেলে একটি রুমে মানসিক প্রতিবন্ধী কয়েক যুবক পড়ে আছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। সমাজসেবা কার্যালয় থেকেই তাদের এখানে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের চিৎকার-চেঁচামেচি ও ভাঙচুরে ভীত হয় শিশুরা। তারপরও এই ছোট ছোটো শিশুরাই তাদেরকে পৌঁছে দেয় খাবারের থালা। এইসব শিশুদেরও আছে মানবিক বোধ, যা সমাজের সুস্থ পরিপক্ব অনেক মানুষের মাঝেও দেখা যায় না।
এই স্কুলের নতুন নামকরণ হয়েছে--সরকারী দৃষ্টি ও বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। অথচ স্কুল গেটে এখনো ঝুলছে পুরনো সাইনবোর্ড--সরকারী অন্ধ ও মূক-বধির বিদ্যালয়।
যে কাজে আমি ওখানে গিয়েছিলাম, সে-কাজ শেষ করে বেরিয়ে আসি। ভাগ্যবঞ্চিত এইসব অসহায় শিশুর কথা ভেবে খুব বিমর্ষ লাগে। ভাগ্য ওদের বঞ্চিত করেছে; রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে যেটুকু অধিকার প্রাপ্য, তা থেকেও বঞ্চিত ওরা!
মন্তব্য
এই সব ভাগ্য বঞ্চিত শিশুদের কথা পড়ে নিজের উপরই কেমন রাগ হচ্ছে! আপনি/আপনারা এদের নিয়ে আরো বেশি বেশি লেখুন আপু প্লিজ! যদি কোনভাবে টনক নড়ে, অসাড় বোধহীন কর্তৃপক্ষনামের অবিবেচকদের, নজরুল ইসলাম নামের লোকটিরও!
জানি না, কতদিনে বিবেকহীন মানুষগুলোর বোধোদয় হবে!
সুমিমা ইয়াসমিন
আয়নামতিদির সাথে সহমত...... লেখায়
ধন্যবাদ, মৌনকুহর।
সুমিমা ইয়াসমিন
সহমত ।
ধন্যবাদ
আমরা সবাই যদি সোচ্চার হই তবে অবশ্যই বদলাবে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। সুমিমা আপনি তো তাও ভেবেছেন। ভেবেছেন বলেই লেখার মাধ্যমে আরো অনেকের কাছে মনের অনুভূতি জানিয়েছেন। অনেকে তো এসব নিয়ে কথাও বলতে চায় না। আমার হাত যদি আরেকটু লম্বা হতো আমি এদের জন্যে অবশ্যই কিছু করার চেষ্টায় পিছপা হতাম না। স্কুলের নামটা ঠিক করার জন্যে কিছু করা যায় কিনা দেখবেন প্লিজ? এছাড়া আর কি করা যায় এদের জন্যে... উপর মহল থেকে চাপ দিয়ে যদি বাচ্চাগুলোকে প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আনা যায় আছেন কি কেউ এখানে?
সাবরিনা সুলতানা
স্কুলটার সমস্যা নিয়ে আমি কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি, যদি কিছু করা যায়...
আসলে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার নিশ্চিতে সামাজিক সচেতনতা গড়ে ওঠা খুব প্রয়োজন। আমি জানি, এ ব্যাপারে আপনি অনেক কাজ করছেন। একদিন নিশ্চয় পরিবর্তন আসবে।
সুমিমা ইয়াসমিন
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নজরুল ইসলাম পাটোয়ারী নামক অমানুষ লোকটার শাস্তি হওয়া উচিত। আপনি তো মনে হয় পত্রিকাতে কাজ করেন। এই বিষয়টা নিয়ে পত্রিকাতে লিখুন।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশের পরও ওই অমানুষটার কোনো শাস্তি হলো না, তাসনিম ভাই।
নতুন মন্তব্য করুন