ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষায় বড়সড় একটা ধরা খেলাম। অঙ্কে একেবারে ঢাউস আকৃতির এক জোড়া ডিম! ঢাকা শহরের সবচেয়ে খরুচে স্কুলগুলোর একটায় পড়ে ছেলের এই হাল!! আমার গুরুজনেরা জরুরি সভা ডাকলেন। সভার মূল এবং একমাত্র আলোচ্য বিষয়-- এই বৃহদাকার ডিম্ব উৎপাদনকারী যন্ত্রের যথাযথ প্রতিবিধান। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হল, ইয়ার লস করা চলবে না। আমাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেখানে নানুবাড়িতে থেকে, গ্রামের স্কুলের নবম শ্রেণীতে, পড়াশুনা করে আমি 'মানুষ' হব।
সিদ্ধান্তটা অবশ্যই আমার মন:পুত হয় নি। আরে! মানুষ হব মানে! এক জোড়া ডিম পেড়ে ফেলেছি বলেই আমি কি হাট্টিমাটিম টিম হয়ে গেছি নাকি! বললেই হল! যেই গুরুজনদের কথা বলছি, তাঁরা সবাই মিলে গত জীবনে এরকম ডজনখানেক ডিম যে পারেন নি তার কোন প্রমাণ আছে? কিন্তু কিছুই করার নেই। তাঁরা সিদ্ধান্ত যেহেতু একটা নিয়েছেন, সেটা অবশ্যই বাস্তবায়ন করে ছাড়লেন।
আমার গ্রামে যাবার সময় ঘনিয়ে আসতে থাকল। বন্ধুগুলোতো সব বদের বদ, নানান রকম কথা বলে আমাকে খেপাতে লাগল-- আন্ডা পেড়েছিস, তাই গ্রামে যাচ্ছিস.... কত কথা! আমিও বলে দিলাম,
দ্যাখ্, তোদের এই ঢাকা শহরে একটু নিরিবিলি কোন জায়গা নেই। আর এটাই আমার গ্রামে যাবার একমাত্র কারণ, সেখানে ডিমগুলোতে শান্তিমত তা দেব।
অতঃপর আমার নতুন ঠিকানায়। প্রথম ক'টা দিন প্রাণ জুড়ানো বাতাস আর ডাবের পানি-শাঁশ খেয়ে ভালোই কাটল। কিন্তু এই মধুচন্দ্রিমা শেষ হয়ে গেল জানুয়ারি আসতেই। এক তারিখ নানা মশাইয়ের সাথে স্কুলে গেলাম। প্রসঙ্গত, আমার নানা ওই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তো নবম শ্রেনীর বিজ্ঞান বিভাগের ক্লাসে ঢুকলাম। ঢোকার পর যা হবার তা-ই হল, দশ-বারোটা ছেলেমেয়ে, যে কয়টা ক্লাসে ছিল, সব বড় বড় চোখ করে, মুখখানা হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তবে ওদের ওই চাউনি আমার পছন্দ হল না, বলতে মন চাইছিল,
তোদের এখানে কি নতুন কাউকে অভিবাদন জানাবার এটাই রীতি নাকি!
আমি ঢোকার প্রায় সাথে সাথেই ক্লাস শুরুর ঘন্টা বেজে গেল, আমি সামনের দিকে একটা বেঞ্চ ফাঁকা পেয়ে বসে পড়লাম। স্যার এলেন। আলম স্যার, ইংরেজির শিক্ষক। আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ভোঁদাইগুলো আরেকবার আমার দিকে ভ্যাবলাকান্ত স্টাইলে তাকাবার উপলক্ষ পেল। পাঁচটা পিরিয়ড আমার কোনভাবে সেদিন কাটল। সব ক'জন স্যারই ভালো। তবে সবচাইতে ভালো বোধ হয় ছাত্র-ছাত্রীগুলো। তেল দিয়ে চেপে আঁচড়ানো চুল, সবাই আমাকে সম্বোধন করছে 'আপনি' বলে।
সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। ক্লাসের সবার সাথেই এক রকম খাতির হয়ে গেছে, সম্পর্কটা-ও সেই সাথে 'আপনি' থেকে 'তুমি'-তে নেমে এসেছে। এতটা তাড়াতাড়ি এটা করতে পারার কারণ, ক্লাসের ১৫ জন ছেলেমেয়েই প্রায় প্রতিটা দিন স্কুলে আসে, শহরের মত একদিন এসে তিনদিন কামাই দেয় না। খাতির আমার মোটামুটি সবার সাথেই হল, তবে ঠিক 'বন্ধুত্ব' বলতে যেমনটা বোঝায়, তা হচ্ছিল না। তার কারণ, আমি যতই সহজ হবার চেষ্টা করি, ওরা তবু কেমন যেন একটা হীনম্মন্যতায় ভোগে। আমার সাথে যেকোন কথা, মুখটা একটু হাসি হাসি করে, খুব ভদ্রভাবে, শুদ্ধ করে বলার চেষ্টা করে। আর এই মহাযজ্ঞ চালাতে গিয়ে যে দৃশ্যটার অবতারণা ওরা করে, সেটা এক কথায় 'মর্মান্তিক'। এইতো, একদিন রুবেলকে জিজ্ঞেস করলাম, আগের দিন স্কুলে আসে নি কেন। ও জবাব দিল,
"প্যাডে বিষ উঠেছিল।"
হয়ত বা এটা আমারই ব্যর্থতা, আমারই আচরণের কোন একটা দিক হয়ত ওদের এই সমস্যায় ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু এটা যে পুরোপুরি আমার কাঁধে চাপানো যাবে না, তার প্রমাণ শুভ্র।
আমি প্রথম যেদিন স্কুলে গেলাম, সেদিন ও আসেনি, তার পরের তিন-চার দিনও না। যেদিন আসল, ক্লাসে ঢুকেই দেখলাম সবাই ওকে ঘিরে গল্প করছে। গল্পতো না, রীতিমত হট্টগোল। বুঝলাম, এই ছেলে রীতিমত জনপ্রিয় ব্যাক্তিত্ব এখানে। আমাকে দেখে বলল,
"আমি শুভ্র, কেমন আসো?"
"ভালো, তুমি এই ক্লাসে পড়?"
"আরে আর কইও না, জ্বরে এক্কারে কাইত অইয়া গেসিলাম, হেই কতায় এই কয়দিন আর আসতাম পারি নাই। তোমার নাম তো মনির?"
"হুম্ম, 'মুনীর"।
আমার উচ্চারণ সচেতনতায় ও হেসে ফেলল, "ওই একটা অইলেই অইল"।
এই ছিল ওর সাথে আমার প্রথম কথোপকথন। নাম শুভ্র হলেও ওর গায়ের রং অবশ্য ফর্সা ছিল না, ও ছিল শ্যামলা। তবে দাঁতগুলো ছিল যাকে বলে একেবারে দুধ-সাদা। ওই দাঁতের হাসিটাও ছিল অদ্ভুত রকম সুন্দর। ছেলেটাকে আমার ভালো লেগে গেল। প্রথম দেখাতেই আমাকে 'তুমি' বলার জন্যই কি না জানি না, ওর কথায় আমি আন্তরিকতার একটা ছোঁয়া পেলাম। আর দশ জনের মত ও আমার সাথে যান্ত্রিক কোনো ভদ্রতা দেখাতে যায় নি, সহজ ভাবে আমাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই তাই আর সবার চেয়ে ওর সাথেই আমার জমত ভালো। প্রতিদিন স্কুলের পর আমরা এক সাথে বাসায় ফিরতাম, রং-বেরঙ্গের আলাপ করতে করতে। নানা সাইকেল দিয়ে আমাকে নিয়ে আসতে চাইতেন, আমি ওর সাথেই হেঁটে আসতাম। ওদের বাড়িটা ছিল আমার নানুবাড়ির অল্প দুরে, স্কুলে যাওয়া-আসার পথেই পড়ত। রাস্তার ধারে, টিনের দেয়াল আর ছাউনিতে ওদের বাড়ি। ওর বাবা মোটামুটি অবস্থাপন্ন গেরস্ত, নিজের অল্প জমি-জমা চাষ করে টেনে-টুনে সংসার চালান। মা মারা গেছেন ওর অনেক ছোটবেলায়।
বিকেল বেলায় শুভ্র আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হত। গ্রামের এখানে-সেখানে, বিভিন্ন জায়গায় গল্প করতে করতে চলে যেতাম আমরা। কখনো কখনো যেতাম স্কুলের মাঠে। ওই সময়টায় গ্রামের মোটামুটি সব ছেলেপিলের একটা জটলা বেঁধে যেত ওখানে। শুভ্রের সাথে মাঠে গিয়ে আমি হা-ডুডু শিখলাম, গোল্লাছুট শিখলাম। ওরা ক্রিকেট, ফুটবলও খেলত মাঝে-মধ্যে। আমি ক্রিকেটের খুব ভক্ত, খেলিও খারাপ না। কিন্তু মুশকিল বাঁধল অন্য জায়গায়। ওরা এক খণ্ড কাঠকে ব্যাট বানিয়ে খেলে, ওটা দিয়ে কেমনে জানি আবার চার-ছয়ও হাঁকায়। কিন্তু আমি ওটা দিয়ে ব্যাট করতে গিয়ে একেবারে মান-ইজ্জত নিয়ে টানাটানি। প্রথম বলটা কোনভাবে ঠেকালাম। টেপ-টেনিস বল, দ্বিতীয় বলটা বুক সমান উঁচুতে উঠতেই সজোরে করলাম পুল। কিন্তু কীসের পুল, আমার হাত ফসকে ওই ব্যাট গিয়ে পড়ল দশ-বারো হাত দূরে, মাঠের মাঝে ঘুর ঘুর করতে থাকা কুকুরটার গায়ে। ওটা কী বুঝলো কে জানে, সঙ্গে সঙ্গে বিকট এক আওয়াজ করে, লেজ তুলে দৌড়ে পালালো। আর বলটা! ওটা ততক্ষণে আমার নাকটাকে গোল-আলু বানিয়ে দিয়েছে।
ওই রকম ঘটনার পরদিন কোন বুদ্ধিমান লোক একই খেলা খেলতে মাঠে যাবে না। কিন্তু বিকেল হতেই শুভ্র এসে হাজির। হাতে ব্যাট, ব্যাট মানে ওই মার্কা-মারা ব্যাট নয়, একেবারে সত্যিকারের ক্রিকেট ব্যাট। জিজ্ঞাসা করলাম,
"কই পেলে?"
"সকালে আব্বায় সদরে গেসিলো, হ্যারে খুব কইরা কইলাম, আইনা দিল।"
আমি মুগ্ধ হলাম, এত ভালো বন্ধু আমার তাহলে এখানে আছে!
শুভ্র ছেলেটা আসলে যাকে বলে একেবারে গণবন্ধু। সবার সাথেই ওর সহজ সম্পর্ক, এমনকি স্যারদের সাথেও। একদিন আলম স্যার ক্লাসে অ্যাপ্রপ্রিয়েট প্রিপজিশন পড়াচ্ছেন। ডাউরি, মানে যৌতুক নিয়ে একটা শূন্যস্থান পূরণ করাচ্ছিলেন। তো শূন্যস্থানের একটা লাইনে আসল, Somewhere in Bangladesh, a bride is even beaten ___ dowry। সবাই বলল শূন্যস্থানে for হবে, শুভ্র বলল, না, with হবে। for দিলে অর্থ হয়, বাংলাদেশের কোথাও কোথাও বউকে যৌতুকের জন্য পেটানো পর্যন্ত হয়। with দিলে অর্থটা দাঁড়ায়, বাংলাদেশের কোথাও কোথাও বউকে যৌতুক দিয়ে পেটানো পর্যন্ত হয়। সহজভাবেই বোঝা যায়, এখানে for-ই হবে। কিন্তু শুভ্র ওর কথায় অনড়, ওর দাবি এখানে for-ও সঠিক। স্যার বললেন,
"হ্যাঁরে গাধা, যৌতুকের জন্য অনেকে হয়ত বউ পেটায়, কিন্তু যৌতুক দিয়ে কেমনে মারবে?"
শুভ্র বলল, "ক্যান স্যার? যৌতুক যদি মুলি বাঁশ টাইপের কিছু হয়?"
আরেকদিনের কথা। সামাজিক বিজ্ঞানের ক্লাস নিচ্ছিলেন সুলাইমান স্যার। ভূগোলের কোন একটা চ্যাপ্টার পড়াচ্ছিলেন। পড়ানোর এক পর্যায়ে বললেন,
"বুঝলি, আমার যদি অনেক টাকা-পয়সা থাকত, আমি গোটা পৃথিবীটা একবার ঘুরে আসতাম। তোদের কারও এমন ইচ্ছে হয় না?"
শুভ্র আমার পাশেই ছিল, আমায় চোখ টিপে হাত তুলল। স্যার বললেন,
"কিরে, তোর কই যেতে ইচ্ছে করে?"
শুভ্র বলল, "স্যার, টয়লেটে যাই?"
এমনি একটা অদ্ভুত ছেলে ছিল শুভ্র। কিন্তু কোন স্যার ওর এমন কাজ-কর্মে রাগ করেননি কোনদিন, বিরক্তও হননি। কারণ ওর এসব দুষ্টুমি ও পড়াশুনা দিয়ে শোধ-বাদ করে দিত। মাথাটা খুব ভালো ছিল, কম্পিউটারের মত নির্ভুলভাবে একটার পর একটা অঙ্ক কষে যেতে পারত। অঙ্ক, মানুষ কীভাবে এত সহজে করে ফেলে-- আমার মত গোল্লা পাওয়াদের কাছে তা তো রীতিমত তখন রহস্য! অঙ্কে আমার গোল্লা মারার কথা ও জানত না, একদিন বললাম। ও যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল, যেকোনো অঙ্ক না বুঝলে ওকে বলতে, ও দেখিয়ে দেবে। নানা বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন, বাড়িতে অঙ্কটা উনি-ই দেখিয়ে দিতেন। কিন্তু শুভ্রের কাছে ক্লাসে একদিন লগারিদমের একটা অঙ্ক নিয়ে গেলে ও এমন ভাবে বুঝিয়ে দিল, মনে হল ও আমার নানা মশাইয়েরও মাস্টার হবার যোগ্য।
এমনি অসংখ্য ঘটনার মাঝে দুইটা বছর কখন যেন শেষ হয়ে এলো। এস এস সি এসে পড়ল। স্কুল জীবনের শেষ ক্লাসটাও একদিন হয়ে গেল। সেদিনও আমি আর শুভ্র এক সাথে বাড়ি ফিরছিলাম। বললাম,
"কিরে শুভ্র! কেমনে কেমনে দুইটা বছর পার হয়ে গেল, না রে?"
"হুম্ম।"
"এই সেদিন এলাম। একটু ছোটাছুটি করলাম, ঘোরাঘুরি করলাম। আর অমনি সময় কেমন ফাঁকি দিয়ে চলে গেল!"
"জীবনটাই তো এরকম রে দোস্ত!"
শুভ্রের মুখে অমন দার্শনিক মার্কা কথা শুনে আমি অভ্যস্ত নই, একটু চমকে গেলাম, ভুতের মুখে রাম-নাম শুনলে যেমনটা হবার কথা আরকি। ও আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল,
"কি হইল?"
"না কিছু না।"
এরপর আবার ওর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে নানান রকম কথা বলতে লাগল।
এস.এস.সি শুরু হলো, আমাদের স্কুলের ছাত্রদের সিট পড়ল পাশের গ্রামের স্কুলে। নানা বললেন, তুই আমার সাইকেলটা নিয়ে যা, আমি বরং হেঁটে হেঁটে চলে যাই। আমি না করলাম না, ওই স্কুলটা মাইল দেড়েক দূর, হাঁটতে গেলে ঠেলা বের হয়ে যাবে। পথে শুভ্রদের বাড়িতে গেলাম। ওর বাবা বললেন, একটু আগে বেরিয়ে গেছে। খানিকটা এগুতেই পেয়ে গেলাম ওকে, সাইকেলে তুলে নিলাম। ও চিরচেনা হাসিটা দিয়ে বলল,
"দেইখো, আমারে শুদ্ধা আবার ক্ষেতের মইধ্যে পইড়ো না, তাইলে দুইজনের পরীক্ষা দেওয়াই কিন্তু গাছে উঠব!"
একটা-দু'টো করে সব ক'টা পরীক্ষা শেষ হলো। শেষ হলো প্র্যাকটিকালও। সর্বশেষ পরীক্ষার দিন শুভ্রকে বললাম,
"এ প্লাস পাবা তো?"
"জানি না, এই গেরামে অ্যাহনও পর্যন্ত তো কেউ পায় নাই--"
"এতদিন তো কোন শুভ্র-ও পরীক্ষা দেয় নাই।"
ও হেসে ফেলল, "আসলে পরীক্ষা তো মোটামুটি ভালোই দিলাম, বাকিটা আল্লাহ্ জানে। তোমার অবস্থা কী?"
"সবগুলোই তো হলো মোটামুটি। কিন্তু অঙ্কটা নিয়ে একটু ভয় আছে, আশি না-ও আসতে পারে।"
"আরে কী কও না কও! অবশ্যই আইবো, আশির আব্বারে শুদ্ধা আইবো। আচ্ছা, তুমি ঢাকা যাইতেসো কবে?"
এমন সুরে বলল কথাটা, যেন ও আমার ঢাকায় চলে যাবার জন্যই সাগ্রহে অপেক্ষা করছে। ওর মুখের দিকে তাকালাম, দেখি বত্রিশ দাঁত বের করে হাসছে। একটু দুঃখই পেলাম। জানতাম, পরদিনই চলে আসছি, তবু বললাম, "জানি না, কাল-পরশু যেকোন দিন।"
ওর বাড়ি পর্যন্ত এসে পড়লাম, ও বিদায় নিল। একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছি, তাই বিদায়সূচক কিছু বললাম না। খানিকটা এগিয়ে তবু কী মনে করে যেন পেছনে তাকালাম, দেখি ও তখনও দাঁড়িয়ে। কিছু বলব ভাবলাম, কিন্তু আমাকে ঘুরতে দেখেই ও আচমকা বাড়ির ভেতর চলে গেল। স্পষ্ট বুঝলাম, ও চোখের জল গোপন করল। কিন্তু তাতে কি আর লাভ হয়, আমার দু'চোখ বেয়েই তখন একেবারে পাহাড়ি ঝরণার স্রোত বইতে শুরু করল, অযথাই। বাড়িতে ফিরতে নানা বললেন,
"কিরে! তোর এই অবস্থা কেন? মার-টার খেয়ে এসেছিস নাকি!"
উত্তরে আমি কান্না চেপে অনেক কষ্টে একটু হাসলাম-- মুখে হাসি, চোখে জল। নানা মনে হয় বুঝলেন, একটু হেসে চুপ মেরে গেলেন।
স্টেশন থেকে ঢাকার বাস ছাড়বে বিকেলে। ওই বাস ধরতে নানুবাড়ি থেকে বিকেলের আগেই বের হওয়া চাই। পরদিন সকালের নাস্তা সেরে তাই আমার ক্লাসের সবার সঙ্গে দেখা করতে বের হলাম। সবার শেষে গেলাম শুভ্রের বাড়িতে। উদ্দেশ্য, সময় আর যতক্ষণ আছে, ওর সাথেই একটু ঘুরে-টুরে কাটাব। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে দেখি ও নেই। কি একটা কাজে ও নাকি সকালেই সদরে গেছে, ফিরতে সন্ধ্যা হবে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ধ্যাত্তেরি! ওর সাথে আমার যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরির ঢংটা না করলেই পারতাম আগের দিন!
ঢাকায় এলাম। তিন-চারদিন কাটল একটা ঘোরের মধ্যে। টানা দু'বছর খোলামেলা জায়গায় থেকে, শহরের এই ছোট্ট ফ্ল্যাটটাকে মনে হচ্ছিল মুরগির খোপ। তবে এটা বেশিক্ষণ থাকল না, পুরনো বন্ধুরা সব আমার ফেরার খবর পেয়ে ভিড় জমাতে লাগলো। এদের সাথে আবার শহুরে আমোদ-ফুর্তিতে মেতে উঠলাম আমি-- যে আমোদ-ফুর্তিতে অন্তরের চেয়ে যন্ত্রের অনুসঙ্গতা বেশি। সাথে যোগ হল কলেজের ভর্তি-যুদ্ধের প্রস্তুতি। এসব কিছুর মাঝে আমি হারিয়ে গেলাম, মন থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকল আমার দুই বছরের গ্রাম্য জীবনের সব স্মৃতি। মাঝে-মধ্যে শুভ্র অবশ্য আমার মনের জানালায় একটু উঁকি-টুকি দিত, মনে হত চিঠি-টিঠি লিখি। কিন্তু একটা পর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেল সেটাও। বেমালুম ভুলে গেলাম ওসব কথা, আবার পুরোদস্তুর 'শহুরে' হয়ে উঠলাম এই আমি।
মাস তিনেক পর একদিন রেজাল্ট বের হল। নানা বাড়ি থেকে ফোন দিয়ে মাকে জানালেন,
"তোর ছেলে তো এ প্লাস পেয়েছে। মুনীর আর শুভ্র নামের এক ছেলে এবার এই প্রথম এই গ্রাম থেকে এ প্লাস পেল। কিন্তু ছেলেটা দেখে যেতে পারল না রে..."
মা আমাকে নানার সাথে কথোপকথনটা হুবুহু বর্ণনা করলেন। খুশিতে আটখানা হলাম, দিলাম লাফ। কিন্তু মা'র শেষ দুইটা বাক্য মাথায় ঢুকতে ধাক্কা খেলাম। আরে, শুভ্রের কথা তো এই ক'দিনে একদম ভুলেই গিয়েছিলাম আমি! এটাকে কী বলা যায়? সভ্য সমাজের অসভ্যতা? হবে হয়ত। কিন্তু কথা তো সেটা না, আমার ততক্ষনে পালপিটিশন শুরু হয়ে গেছে নানার শেষ বাক্যটা শুনে, কী বোঝাতে চাইলেন নানা? মা বললেন,
"কিরে, কী হল তোর? খুশিতে হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল নাকি?"
"মা, 'দেখে যেতে পারল না' মানে? কে দেখে যেতে পারল না?"
"কই কী দেখে যেতে পারল না?!"
"নানা যে বলল?"
"ও আচ্ছা, বাবা বললেন, ছেলেটা দেখে যেতে পারল না।"
"মানে কী?"
"মানে আবার কী! বাবা মনে হয় বোঝাতে চেয়েছেন গ্রামে সবাই তোদের দু'জনকে নিয়ে খুব খুশি। তুই সেই বাড়াবাড়ি রকমের আনন্দটা দেখে আসতে পারলি না।"
মা'র এই ব্যাখ্যা আমার মনঃপুত হল না। আমি নানাকে আবার ফোন দিলাম, কিন্তু লাইন পেলাম না। এই এক সমস্যা, গ্রামে থাকতেও দেখেছি। হয় টানা চার-পাঁচদিনের লোডশেডিং-এর জন্য মোবাইলের ব্যাটারি চার্জ করতে পারে না, নয়তো নেটওয়ার্কই থাকে না। আর তখন তো এমনিই ঝড়-বাদলের মৌসুম। এরকমই কিছু একটা হয়ত হয়েছে। রাত পর্যন্ত অন্তত আরো দশ-বারো বার ফোন দিলাম, পেলাম না। সারা রাত আমার ঘুম হল না। সকালে উঠে আবার ফোন দিলাম, একই অবস্থা। ঠিক করলাম, সশরীরেই নানুবাড়ি যাব। মাকে বললাম,
"মা, নানু বাড়ি যাব।"
"মানে?"
"মানে-টানে বুঝি না, এখন সাড়ে সাতটা বাজে, আমি নয়টার বাসে নানুবাড়ি যাব।"
"দু'দিন পর তোর ভর্তি পরীক্ষা, বাড়ি গেলে কী পরীক্ষা দিবি?"
"জানি না, নাস্তা দেবে নাকি না করেই যাব?"
"তোর হয়েছে কী বল তো?"
"কিচ্ছু হয়নি, আমি নানু বাড়ি যাব।"
"আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, নাস্তা করে নে।"
রওয়ানা হলাম। মনের মধ্যে তখন ভয়ানক খারাপ এক চিন্তা। কান্না পাচ্ছিল খুব। এ প্লাস পাওয়ায় বাবার কাছ থেকে ওয়াদামত একটা মোবাইল ফোন পেয়েছি, সেটার হেডফোন কানে দিয়ে পছন্দের একটা গান শোনার চেষ্টা করলাম। আরো বেশি কান্না পেল তাতে। সেটা বন্ধ করে আবার ফোন দিলাম নানাকে, মড়ার ফোনের একই হাল। রাগে-দুঃখে মোবাইল জিনিসটার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করলাম।
বিকেল নাগাদ পৌঁছলাম গ্রামে। আকাশ কালো করে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সোজা ছুটলাম শুভ্রদের বাড়িতে। রাস্তা, দু'ধারের ক্ষেত-- কোথাও একটা মানুষ দেখলাম না। বুকটা ধুকপুক করছে, কাদায় পা আটকে যাচ্ছে-- তবু সর্বশক্তি দিয়ে ছুটলাম। শুভ্রদের বাড়ি পৌছে ওর নাম ধরে ডাকলাম, কোন জবাব নেই। জোরে জোরে দরজা ধাক্কালাম, জিজ্ঞাসা করলাম, বাড়িতে কেউ আছেন-- তা-ও কোনো সাড়া নেই। আমার ধুকপুকানি বেড়ে গেছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। হলোটা কী! শুভ্রদের ক্ষেতের ওখানে গেলাম, সেখানেও খা-খা, কোন মানুষ নেই। বৃষ্টিটা তখন দ্বিগুন জোরে পড়ছে, দশ হাত সামনেও দেখা যাচ্ছে না ভালো মত। ছুটলাম স্কুলের দিকে। এবার দেখলাম, কেউ একজন আসছে ওদিক থেকে। দৌড়ে কাছে গেলাম, চিনলাম, রউফ নানা, আমার নানার বন্ধু মানুষ।
"আরে মুনীর না? তুমি এই ঝড়ের মইধ্যে ছাতা-টাতা ছাড়া এইহানে? কবে আইলা ঢাকাত্তন?"
"এই তো নানা, কিছুক্ষণ আগে। আচ্ছা নানা, শুভ্রের খবর কী?"
নানার মুখটা কালো হয়ে গেল। বললেন, "শুভ্র? ক্যান তুমি শোন নাই কিছু?"
"না তো! কিছু হয়েছে ওর??"
"অয় আর অর আব্বায় তো গত সপ্তাহে ঝড়ের মধ্যে ক্ষেতে কাজ করার সময় মাথায় বাজ পইড়া গ্রামের আরো ছয়জনের লগে--"
আর কিছু আমার কানে গেল না। দু চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, আকাশ-পাতাল সব নিয়ে চক্কর দিল মাথাটা। এটা কী করে সম্ভব! চিৎকার করে উঠলাম,
"এ কেমন করে সম্ভব??"
চারিদিক থেকে প্রতিধ্বনি হয়ে আমার প্রশ্নটাই ফিরে আসতে লাগলো বারবার। উত্তর পাব কোথায়, এ প্রশ্নের যে আসলেই উত্তর দিবার কেউ নেই। মাথা আর কাজ করছিল না। দুনিয়াটা এত নিষ্ঠুর! আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হচ্ছে, আর আমার মনের রাজ্যে তখন কাল বোশেখী ঝড় শুরু হয়ে গেছে। মন-গঙ্গার সমস্ত জল যেন সেই ঝড়ে ফুলে-ফেঁপে উঠে আমার দু-চোখ দিয়ে উপচে পড়তে চাইছে। এটা দুনিয়ার কেমন খেলা হল?!
শুভ্র রে, দোস্ত, তোর কথাটাই বোধ হয় ঠিক, "জীবনটাই এরকম।"
মৌনকুহর
১৭.১০.০৯
মন্তব্য
গত কালই প্রথম অংশটুকু পড়েছিলাম, আজও কীর্তিকলাপে গিয়ে আগেই পুরোটা পড়া শেষ । শুরুটা আর শেষটা ফাটাফাটি হয়েছে, মাঝ খানটা অল্প একটু স্লিম হলে বোধ হয় বেশি ভালো লাগত ।
কথা ঠিক, স্লিম হলে আসলেই ভালো হত। একবার ভেবেছিলাম ভাগ করে দিই, কিন্তু মডু-মামারা ওটাও কবুল করলেন না।
মন্তব্যের জন্য
খুব ভালো লেগেছে!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
খুব ভাল লেগেছে। আবার সেই সাথে শুভ্রর জন্য খারাপ লেগেছে। আমিও একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়েছি। এর আনন্দটাই অন্যরকম।
ভাল লেগেছে।
কিন্তু সব গল্পই ট্র্যাজেডি দিয়ে কেন শেষ হয়............
কেন যে হচ্ছে আমিও জানি না, এই স্টাইল থেকে বের হতে পারছি না.........
মন্তব্যের জন্য
কেন যে হচ্ছে আমিও জানি না, এই স্টাইল থেকে বের হতে পারছি না.........
মন্তব্যের জন্য
কেন যে হচ্ছে আমিও জানি না, এ স্টাইল থেকে বের হতে পারছি না.........
মন্তব্যের জন্য
এটা কি সত্য কাহিনী নাকি শুধু ই গল্প ??
যদি শুধু গল্প ও হয়ে থাকে লেখকের উদ্দেশ্যে বলছি HATS OFF.....
দুইটার মিশেল......
যা বললেন!!
এত সাবলীল একটা লেখা, জীবন্ত!!
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
ভালো লিখেছেন।
ভালো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
লেখাটি ভাল। তবে সবচেয়ে ভাল লেগেছে গ্রামের স্কুলের প্রতি লেখকের শ্রদ্ধাবোধ।
গল্পের আকার দেখে প্রথম ভয় খেয়েছিলাম পড়তে পড়তে শেষ হয়ে গেলো কখন বুঝিনি! খুব ভালো লাগলো
ভয় খেয়েছিলেন??!!
এক কথায় দারুন লেখা...শুভ্রের জন্য খুব খারাপ লাগছে ।
nawarid nur saba
নতুন মন্তব্য করুন