সকাল থেকেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকটা এগুতেই শুরু হয়ে গেল তুমুল বৃষ্টি। ছাতা-টাতা নিই নি সাথে, স্কুলে পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভিজে একেবারে জবজবে হয়ে গেলাম। ও মা! দেখি ক্লাসে না গিয়ে সবাই মাঠে দাপাদাপি করছে!
কী মজা! আজ হেড স্যার ‘রেইনি ডে’ করে দিয়েছেন! ফুর্তি দেখে কে! নেমে গেলাম মাঠে-- মাথায় ঝুম বৃষ্টি, পায়ে গোড়ালি পর্যন্ত কাদা। কোত্থেকে একটা জাম্বুরা খুঁজে আনল ধ্রুব, ওটা দিয়েই শুরু হয়ে গেল টানটান উত্তেজনাময় ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা ফুটবল ম্যাচ। কিসের ডিফেন্স, কিসের অ্যাটাক-- যেখানেই জাম্বুরা, সেখানেই আমরা সবাই।
খেলা শেষে একেকজনের চেহারা হল দেখার মত। সবগুলো যেন যমজ ভুত-- মায়েরও সাধ্যি নেই তার মানিক-রতনকে আলাদা করে। ছুটলাম পাশের দীঘিতে। মাতলাম আরেক খেলায়-- এক শ্বাসে কে কতক্ষন ডুব মেরে থাকতে পারে তার প্রতিযোগিতা। জলের তলেও গুণ্ডামি-- এদিকে শামীম সাইফকে মোহাম্মদ আলী মার্কা পাঞ্চ ছোড়ে তো ওদিকে রানা রাতুলের পশ্চাৎদেশে রিভালদো মার্কা শট নেয়। প্রতিযোগিতা আর শেষ হয় না, জেদের চোটে দম না ফুরোতেই উপরে উঠে আসে একেকজন।
বাঁদরামির ষোলকলা পূর্ণ করে সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরি। চোখ রক্তিম লাল, নাকে তুমুল ফ্যাঁচফ্যাঁচানি। ঘরে ঢুকতেই মা ঠুণ্ডা ঝাড়ু নিয়ে তেড়ে আসেন-- কিন্তু ধোলাই দেন না, শাড়ির আঁচলটা দিয়ে মাথার চুল মুছে দিতে থাকেন সযত্নে।
************************************
ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙ্গে। আবিষ্কার করি, আমি শুয়ে আছি সোয়ান ফোমের ম্যাট্রিক্সে, আমার উপর শুয়ে আছে ইট-পাথরের ছাদ। মা আমার ঘুম ভাঙ্গাতে চুলে আঙ্গুল চালাচ্ছেন আর বাবাকে ঝাড়ছেন সমানে-- “ছেলেবেলার গল্প করে ছেলেটাকে তো ঘুম পাড়িয়ে রেখেছ, এদিকে যে ওর ক্লাস মিস হবার যোগাড়, বলি সে খবরটা কি আছে......”
ঘড়িতে ঢং ঢং করে সাতটা বাজে। আড়মোড়া ভেঙ্গে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। মুষলধারে বৃষ্টি। খুব ইচ্ছে হয় একটু ছুঁয়ে দেখি। কিন্তু গ্রিল ছুঁয়ে যাওয়া ১১০০০ ভোল্টের বলয় আমি ছেদ করতে পারি না। বড় সাধ জাগে, দু'চোখ মেলে বর্ষণমুখর দিনের আকাশটা একবার দেখি। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আঠারো তলা দানব ছাড়িয়ে আমার দৃষ্টি আকাশ পর্যন্ত পৌঁছায় না। পাঁচতলায় দাঁড়িয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টায় আমার দৃষ্টি পৌঁছায় দানবের আট কি নয় তলা পর্যন্ত, যেখানে দেখি নিষ্ফল আক্রোশে ডানা ঝাপটায় খাঁচায় বন্দি আরেকটি অসহায় প্রাণ-- একটি টিয়া পাখি।
স্কুলের জন্য তৈরি হই। কাঁধে তুলি আধ মণ ভারি ব্যাগ। ভারি তো একটু হবেই-- এ যে সন্তানকে নিয়ে এক জোড়া প্রাণের দুই জোড়া নয়নের গগনচুম্বী স্বপ্ন-ভার! আমি স্কুলের পথে পা বাড়াই। মা ছুটে আসেন-- গায়ে চাপিয়ে দিয়ে যান আজানুলম্বিত একটি রেইনকোট।
মৌনকুহর
১৬.০৬.২০১১
মন্তব্য
যে ক'টা পড়েছি, তার মধ্যে আমার চোখে আপনার সেরা লেখা এটাই।
লেখা দিন দিন ভাল হচ্ছে। লিখতে থাকুন।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
হুম
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
আরে 'হাচলদি' যে!!
ছোট বেলার কথা'তো পড়তে বেশ মজা লাগে তা, গল্প হোক আর এমনি কিছু কথাই হোক..
শুভেচ্ছা রইলো।
হুম্ম.........
সবার ছোটোবেলাই এত উচ্ছলময় যে এটাকে না মিস করে পারা যায়না।অনেক ভালো লাগলো, বর্ণনাগুলো খুবি ঝরঝরে।
হুম্ম.........
ভালো হয়েছে।
[আর আমাদের কতদিন এইভাবে পোস্টের শেষে পূর্ব পোস্টের লিংক দিয়ে যেতে হবে জানি না!!! কবে যে ভাসমান অতিথি স্টেইট থেকে মুখ হা করে হলেও দাঁড়িয়ে একটুখানি চলতে পারব!!!]
অসাধারণ, আর তাই পাঁচটি তারার তিমির এঁকে দিলুম!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
নতুন মন্তব্য করুন