গল্পঃ মৃত্যুচ্ছা পর্ব-১

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৯/০৬/২০১১ - ৩:০০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী বলেই মনে হয় তা সম্পর্কে সব মানুষেরই কিছু নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা থাকে। আমার বাবা সবসময় বলতেন উনি সুস্থ অবস্থায় মারা যেতে চান—কোন দুরারোগ্য ব্যাধীতে ভুগে ধুঁকেধুঁকে যেন তাকে মরতে না হয়। আমার বড়ভাইটার সবসময় বড় বড় চিন্তা করতে ভালবাসত; ওর ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর পরও যেন ইতি হাসের অংশ হয়ে অমহয়ে যেতে পারে। আমার ছোটভাইটা চায় ওর মৃত্যুর সময় যেন গার্ড অফ অনার দিয়ে ওর কফিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দিয়ে মোড়ানো থাকে—তাই ওর স্বপ্ন শুধু আর্মিতে ঢোকাই না, আর্মিতে কর্তব্যরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা। রবীন্দ্রনাথ তো মরতেই চাননি, লিখে গেছেন ‘মরিতে চাহিনা আমি এই সুন্দর ভুবনে’। এ সকল মৃত্যুভাবনার পাশে আমার ইচ্ছাটা ছোট নাকি বড়, তা আমি বুঝতে পারতাম না। তবে আমার নিজের কাছে আমার মৃত্যুইচ্ছাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

মৃত্যু সম্পর্কে আমি চিন্তা করলেই সবসময় ভাবতাম, ইশ! আমি যদি মারা যাবার কিছুদিন আগে থেকেই জানতে পারতাম আমি কবে মরে যাব, তাহলে বেশ হত! এসব ইচ্ছা সবাইকে বলা হয় না, কিন্তু দু-একজন যাকেই বলেছিলাম, তারা কেমন যেন শিউরে উঠেছিল। বলেছিল, ‘নিজের আসন্ন মৃত্যু জানার চাইতে ভয়ংকর কিছু আর হতে পারে না’। আমি ভেবে পেতাম না, ভয়ংকরের কি আছে। আগে থেকে মারা যাব জানতে পারলে কত কিছু করে যাওয়া যায়। একমাস পরে মারা যাব জানলে নিশ্চয় আজকে বসের অর্থহীন কথা হাসি-হাসি মুখে শুনতাম না। ধুর ছাই! আর একমাস বেঁচে আছি জানলে তো চাকরীটাই ছেড়ে দিতাম; ব্যাংকে জমানো টাকা খরচ করতাম দুহাতে! ইচ্ছা থাকা সত্তেও পার্টিতে শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে স্বাদটা কেমন না পরখ করে দেখতে দ্বীধাবোধ করতাম না একটুও—যে যা ভাবে ভাবুক না!

আর সারাজীবনের না বলা কথাগুলো, না জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নগুলো উত্তরকারীদের খুঁজে বের করে অবলীলায় জিজ্ঞাসা করতাম। ক্লাস নাইনের বাংলা আপাকে খুঁজে বের করে জিজ্ঞাসা করতাম কেন হুবাহু একই উত্তর( যা কিনা কখনও আমি কারো থেকে টুকে লেখেছি, বা কখনো অন্য কেউ আমার থেকে দেখে লিখেছে) লেখা সত্তেও উনি আমাকে সবসময় বেশি নাম্বার দিতেন। কলেজের তাহের স্যারকে খুঁজে বের করে বলতাম, ‘আপনি কি জানেন আজও আমি যখন কোন কাজ করতে ভয় পাই, তখন চোখ বন্ধ করলে যে চেহারাটা দেখতে পাই, তা আপনার—আপনি বলছেন , “তুমি যদি স্রেফ ভাব যে তুমি পারবে, তাহলে তুমি সত্যি সত্যিই পারবে। আত্মবিশ্বাসের এতটাই শক্তি” । বড়ভাবী কে জিজ্ঞাসা করতাম ঠিক কেন সে ভাইয়ার কাছে আমার নামে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলেছিল; আমার সাথে তো আমার জানা মতে তার কোন শত্রুতা ছিলনা! রাতুলকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতাম, ও কি কোন একসময় এক মূহুর্তের জন্য হলেও আমার প্রেমে পড়েছিল?

এরকম কত প্রশ্নের উত্তর জানার আছে! যদি মরেই যাই, এ আজব প্রশ্নগুলো করতে তো কোন দ্বীধা নেই! পরিনামস্বরূপ কে কি ভাবল তাতে আমার কি যায় আসে। আমি তো মরেই যাব! সত্যি বলতে কি আমাদের পুরো জীবনটাই কাটে ভবিষ্যতের জন্য। আমি কাল মারা যাব জানলে নিশ্চয় আজ কষ্ট করে পরীক্ষার পড়া পড়তাম না বা অফিসে বসে বিরক্তিকর কাজ করতাম না; কিংবা ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য লোভনীয় চর্বিযুক্ত গরুর রান্নাটি অল্প করে খেতাম না। পপুলার কালচারে যতই ‘বর্তমানে বাঁচো’, ‘লিভ এট দি প্রেজেন্ট’ বা ‘হাসো জিও মুসকোরাও; কেয়া বারা কাল হো না হো’ টাইপ বানী দেয়া হয়, তবুও একটু পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যায় যে সবচেয়ে কষ্ট করে আমরা যে কাজগুলো করি তা সবই কালকের জন্য।

এসব ভেবে প্রায়ই আমার মরে যেতে ইচ্ছা করত। হঠাৎ করে টুপ করে হার্টফেইল করে মৃত্যু না; সেই নাটক-সিনেমার মতন করে মরা—যেখানে ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বলবে, ‘লাস্ট স্টেজ, আপনার জীবনে আর এক মাসের বেশি সময় নেই’।

কোন এক অদ্ভুত কারণে আমার এ ইচ্ছাটার কথা আমি রাতুলকে বলেছিলাম।

-শান্তিপ্রিয়

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03am

মন্তব্য

অপ্রকৃতিস্থ১ এর ছবি

নি:সন্দেহে আপনি ভালো লেখেন। আপনার এই লেখাটা আমি মডারেশন থাকা অবস্হাতেই পড়েছিলাম। দ্রুতই সচল হয়ে উঠুন।

একটা খটকা লেগে আছে। লেখাটা কি আরেকটু বড় ছিলো না?

অমিত আহমেদ এর ছবি

মৃত্যুর সময় আগে থেকে জানার আগ্রহ পাই না কারণ থেকে জেনে ফেললেই দৈনন্দিন রুটিনে পরিবর্তন আসবে। কী দরকার!

লেখা ভালো লেগেছে।

অতিথি লেখক(শান্তিপ্রিয়) এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ। মন্তব্য পেয়ে উৎসাহ পেলাম।

@অপ্রকৃতিস্থ১ঃ প্রথমে পুরো গল্পটা পোস্ট করেছিলাম, কিন্তু তা অনেকক্ষন ধরেও লোড হলনা। তারপর খুব বেশি বড় পোস্ট ভেবে ভেঙে ভেঙে দিচ্ছি। প্রথমটা পোস্ট হয়েছিল কিনা, আর সেটাই আপনি পড়েছিলেন কিনা বুঝতে পারছি না।

@অমিত আহমেদঃ হুম আমারও তা-ই মত। কাল কি হবে জানি না বলেই জীবন নিয়ে এত আগ্রহ; জানলে বোধহয় আগ্রহ চলে যেত। এটা কিন্তু শুধুই গল্প-- আমার কাহিনী নয় হাসি

অমিত আহমেদ এর ছবি

এটা যে গল্প সেটা ট্যাগ দেখেই বুঝেছি। আপনার লেখা পড়ে মনে হলো বলে বললাম।

অন্য মন্তব্য প্রসঙ্গে - প্রথমপাতা থেকে আপনার লেখাটি সরে গেলেই তবে কিস্তি দিতে পারেন। প্রথমপাতায় এক লেখকেই দুই পোস্ট না থাকাই শ্রেয়।

চলুক।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আপনার লেখা ভালো লেগেছে।

প্রথম প্যারাটি না থাকলে সবচে ভালো হতো। প্রথম প্যারাটি পড়লে লেখককে কাঁচা/দুর্বল মনে হয়! লেখাটাকেও। লিখতে থাকুন।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অতিথি লেখক(শান্তিপ্রিয়) এর ছবি

@ অনার্য সঙ্গীত: মন্তব্য পেয়ে খুব ভাল লাগল। লেখা ভাল লেগেছে সেটার চেয়েও বেশি লেখা সম্পর্কে পরামর্শ পেয়ে বেশি ভাল লাগল। কিন্তু একটু যদি বুঝিয়ে বলতেন কেন প্রথম প্যারাটা না থাকলে ভাল হত, তাহলে আরো বেশি খুশি হতাম। ভবিষ্যতে চেষ্টা করতাম এমন অংশের পুনরাবৃত্তি না ঘটাতে। অসংখ্য ধন্যবাদ।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আপনার মন্তব্য পছন্দ হলো।
প্রথমত আমি সমালোচক নই। গদ্যের কলকব্জা আমি বুঝিনা। সেই হিসেব করে ব্যাখ্যা করাও তাই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সচলে অনেকেই আছেন যাঁরা সাহিত্য অনেক ভালো বুঝতে পারেন, বলতে পারেন। তাঁরা আপনাকে সাহায্য করবেন আশা করি। আমি কেবল বলতে পারি পাঠক হিসেবে আমার কাছে কেমন লেগেছে এবং কেনো কেমন লেগেছে!

প্রথম প্যারাটা পড়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় লেখক তার দর্শণ জ্ঞান জাহির করতে চাচ্ছেন। ওই প্যারার কথাগুলো খুব শক্ত নয় এবং প্রয়োজনীয়ও নয়। কিছুটা আবেগী এবং হাস্যকর! প্রথম প্যারার সব লাইন ফেলে দিয়ে শেষ লাইনটা রাখলে আমার ভালো লাগতো!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

বইখাতা এর ছবি

গল্পটা কি শেষ?

অতিথি লেখক(শান্তিপ্রিয়) এর ছবি

@ অনার্য সঙ্গীতঃ পরীক্ষার আগের দিন পড়তে না ইচ্ছা করার কারণে খাতার পেছনে লেখা বেশিরভাগ গল্পগুলোর শুরুই মনে হয় এ গল্পের আঙ্গিকে। এ প্রথম সেগুলোর কোন একটি জন্সম্মুখে এল, তাই আপনার মন্তব্য খুব গুরুত্বে সঙ্গে নিচ্ছি। আবার ধন্যবাদ।

@বইখাতাঃ নাহ! গল্পটা শেষ নয়। (চলবে) লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম। গল্পটা একটু বড়-- সম্ভবত তিন পর্ব পর্যন্ত যাবে।এখনো প্রথম পর্বটা প্রথম পাতায় থাকায় দ্বীতিয় পর্বটা পোস্ট করব কিনা বুঝছিনা, ভুল পোস্ট দিয়ে নিয়ম লংঘনও করতে চাচ্ছিনা। এখনই পরের গুলো পোস্ট করব কি?

মর্ম এর ছবি

কাল সকালে আপনার লেখাটা পড়ে দিন শুরু হয়েছিল।
ভাল লেখা মন ভাল করবে এটাই স্বাভাবিক।

গল্প কোন দিকে যায় তা দেখায় অপেক্ষায় থাকলাম।

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

অতিথি লেখক(শান্তিপ্রিয়) এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

কোন এক অদ্ভুত কারনে আমার এ ইচছাটার কথা আমি রাতুলকে বলেছিলাম (চলবে...)।

এই অংশটুকু সবচেয়ে ভালো লাগলো।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।