রক্তিম সূর্যটা ধীরে ধীরে যেন পদ্মার জলে ডুবে যাচ্ছে । আর সেই অস্তগামী সূর্যটার দিকে অপলক তাকিয়ে রয়েছে সাজু। অথচ প্রতিটি দিনের শেষে ঠিক এভাবেই সূর্য অস্ত যায় ; তখনতো কখনো বুকের ভিতর এমন হাহাকার করে ওঠে না ! তবে আজ কেন সাঁঝ বাতি জ্বেলে দেয়ার পরও তার ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছে না ? নদীর জলে দাঁড়িয়েও সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে ,তার বড় বৌদি গলায় আঁচল দিয়ে তুলসীতলায় পূঁজো দিচ্ছে । পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে শাঁখের আওয়াজ । এতোবছর পর আজই প্রথম সাজু অনুভব করল শাঁখের আওয়াজটা বড় বেশি বেদনাদায়ক ,বড় বেশি করুণ।
সেই বিকেল থেকেই সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তাও আবার হাঁটু পানিতে । তার আর সেখান থেকে নড়তে চড়তেও ইচ্ছে করছে না । কারণ হয়তোবা আর কখনো সে এই জায়গায় এই ভাবে এসে দাঁড়াতে পারবে না । তার কষ্ট গুলোকে নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতে পারবে না । কাল ভোরে তাদেরকে চলে যেতে হবে এই চর ছেড়ে । কোথায় যাবে তা এখনো স্পষ্ট ভাবে জানে না তারা । হয়তো নতুন জেগে উঠা কোন চরে কিংবা সরকারী অনুদানের কোন আশ্রয়কেন্দ্রে । আবার ঐ একই আশ্রয়কেন্দ্রে কিংবা চরে তাদের সবার জায়গা হবে কি না তারও কোন নিশ্চয়তা নেই । এই ভাবনাতেই আচ্ছন্ন হয়ে আছে সাজুর মন আর পদ্মার সান্ধ্যবাতাসে তার চুলগুলো তার ভাবনার মতোই এলোমেলো ভাবে ওড়ছে ।
হঠাৎ কোমল হাতের স্পর্শে পেছন ফিরে তাকাল সাজু। পাশের বাড়ির রবি দাঁড়িয়ে রয়েছে একটু দূরেই । সাজু তার দিকে তাকাতেই রবি বলল,
কি গো,সাজুদা কী হইছে তোমার ?
সাজু বলল,কই কিচ্ছু হয়নায় তো ।
তা হইলে তুমি হেই কহন থ্যাইক্যা এইহানেই দাঁড়ায়া আছ কেন ?
এমনিতেই । পানিতে নামবি না-কি ?
রবি ঠিক এই কথাটি শোনার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল । আর সাজুর কথা শেষ হবার সাথে সাথেই সে এসে সাজুর পাশে দাঁড়াল ।
কাল সকালে তারা এখান থেকে চলে যাবে তার জন্য রবির বিন্দুমাত্র দুঃশ্চিন্তা নেই বরং সে বেশ আনন্দিত। কারণ নতুন একটা জায়গাতে যাবে। সেখানে খেলার জন্য নতুন অনেক বন্ধু পাবে । আর সবচেয়ে ভালো হবে যদি চরের আশেপাশের দু’চার মাইলের মধ্যে কোন স্কুল না থাকে। তবে রবির ভয় শুধু তার এই সাজুদাকে নিয়ে । বাবা মাকে সে কিছু একটা বলে বুঝাতে পারবে । কিন্তু এই সাজুদাটা বড় বেশি গোয়ার। এখানে তো সে স্কুলে যায় এই সাজুদার ভয়েই।একেতো তার পড়াশোনা করতে একদমই ভালোলাগে না তার উপর স্কুল অনেক দূর। নৌকা দিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় । তবে নৌকাতে যেতে ওর বেশ লাগে ।
রবি সাজুর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে । কারণ আজ সে স্কুলে যায়নি। তবে আশার কথা এই, এখন পর্যন্ত সাজুদা তাকে পড়াশোনার ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি । অন্যান্য দিন তো প্রথমেই পড়ার কথা জিজ্ঞেস করে। রবি সাজুর দিকে তাকাল। সাজু ব্যাপারটা খেয়ালই করল না । সে তাকিয়ে রয়েছে রবির দাদার কবরটার দিকে। বাঁশের ছোট ছোট ফালি দিয়ে কবরের চারপাশটা বেড়া দেয়া । আর পদ্মার জল বেড়ার একেবারে কাছে চলে এসেছে । এই কবরটাকে ওরা বেশ যতœ করে রেখেছিল এতো বছর । কাল থেকে আর কেউ তা করবে না বরং তা অপেক্ষা করতে থাকবে পদ্মার জলে বিলীন হয়ে যাবার জন্য এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে হয়তো তা পদ্মার বুকে বিলীন হয়েও যাবে । যেভাবে বিলীন হয়ে গেছে সাজুদের পূর্ব পুরুষদের বাড়িঘর,জমিজমা সবকিছু । ওদের পূর্ব পুরুষেরা নাকি বেশ অবস্থা সম্পন্ন ছিল । মাঝে মাঝেই এই কথা বলতেন সাজুর দাদা । নদীর কাছাকাছি বেশ বড় বাড়ি ছিল ওদের আর টাকাকড়িও খুব একটা খারাপ ছিল না । কিন্তু ঐ যে কথায় বলে আগুনে পোড়া আর নদীর ভাঙ্গন চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না । ওদেরও তাই হলো । ধীরে ধীরে পদ্মার ভাঙ্গন গ্রাস করে ফেলল ওদের সবকিছু । ভিটেমাটি পর্যন্ত বাদ গেল না এমন কি শশ্মানঘাটও রেহাই পেল না সর্বনাশা পদ্মার কবল থেকে । তারপর থেকে ওদের নতুন আরেকটা পরিচয় হলো - বাস্তুহারা । এখানে সেখানে ঘুরে ফিরে অবশেষে এই চরে জায়গা হলো তাদের । তারপর আরও অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে । সাজুর জন্মও হয়েছে এই চরে ।
মন খারাপ ব্যাপারটা বেশ সংক্রামক । সাজুর মন খারাপ দেখে রবিরও মন খারাপ হতে শুরু করেছে ।
রবি বলল,সাজুদা,বাড়ি যাবা না তুমি ?
সাজু বলল,তুই যা । তোর মা আবার চিন্তা করব ।
রবি বাড়ি চলে যাচ্ছে । কিন্তু বাড়ি ফেরার কোন তাড়া অনুভব করে না সাজু । যার বাড়ি বলতেই কিছু নেই তার আবার বাড়ির প্রতি কিসের টান । অনেকক্ষণ পর নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও পানি থেকে উঠে অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে থাকে সে বালির উপর দিয়ে ।ততক্ষণে রাত নেমে এসেছে চরের মাটিতে । শুক্লপক্ষের চাঁদের আলো চরটাকে কেমন জানি মায়াবী করে তুলেছে । যদিও এসব কোনকিছুই স্পর্শ করছে না সাজুকে । সে হাঁটছে তো হাঁটছেই ।
নারকেল গাছের আড়ালে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে আর চাঁদের আলোয় তার ছায়া পড়েছে বালিতে । সাজু গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল , ক্যাডা ? ঐহানে ক্যাডা ?
প্রথমে কোন উত্তর পাওয়া না গেলেও কিছুক্ষণ পরে একটা ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল ,আমি ।
তবে কণ্ঠস্বরটা যতই ক্ষীণ হোক না কেন সাজু ঠিকই বুঝতে পারছে কে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে । মাধব কাকার মেয়ে মনা । মাঝে মাঝেই এই মেয়েটা সাজুকে বেশ ভয় পাইয়ে দেয় । সাজুর তখন ইচ্ছে করে কড়া একটা ধমকের সাথে কষে একটা থাপ্পড় লাগাতে । অবশ্য এটা শুধু ভাবা পর্যন্তই কিন্তু এই কাজটা কেন জানি সাজু আর করতে পারে না । ঐ লাজুক মুখখানার দিকে তাকালে তার বড় বেশি মায়া লাগে। আর এই মায়া বড় কঠিন জিনিস । তাই হয়তো সাজুর দাদা মাঝে মাঝেই বলতেন,“ কাউরে মায়া করবি না ।মায়া হইছে একটা ফান্দ । তোর সব শেষ কইরা দিব । খবরদার,এই ফান্দে পা দিবি না ।” দাদার কথাই হয়তো ঠিক। গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে মনা বলল,
তোমাগো বাড়িতে গ্যাছিলাম,তোমারে পাই নাই । তার লাইগ্যা ......
সাজু বিরক্ত হয়ে বলল,ক্যান খুঁজতেছিলি এই বার ক দেহি ?
সাজু খুব ভাল ভাবেই জানে এই প্রশ্নটার কোন জবাব মনা দেবে না আর কেন তাকে খুঁজছিল এই কারণটাও তার অজানা নয় । তবুও প্রতিবার ঐ একই প্রশ্ন করে সাজু । অন্যান্য দিন যখন মনার সাথে দেখা হয় তখন মনা সারাক্ষণ বকবক করতেই থাকে । তবে আজ সে একেবারেই চুপ ।
সাজু আবার জিজ্ঞেস করল, কী হইছে তোর ?
এবারও মনা নিশ্চুপ ।
সাজু এবার একটু কাছে এসে বলল, মনডারে শক্ত রাখবি সবসময় । সাহস হারাবি না ।
মনা এবার প্রথম কথা বলল,আমরা কোন জায়গায় যাইমু তা কি ঠিক হইছে ?
না ।
আমরা কী এক জায়গায় থাকবার পারমু ?
কি জবাব দিবে সাজু ? কারণ এই প্রশ্নের উত্তরটা সে যে নিজেও জানে না । এক জায়গাতে হয়তো মনা আর সাজুর থাকার ব্যবস্থা হবে না । আজ হোক কাল হোক বিছিন্ন তাদেরকে হতে হবেই ।
মনা আবার জিজ্ঞেস করল,আর কি আমাগো দেখা হইব না?
জানি না । এই বলে সাজু মনার মাথায় হাতটা রাখতেই সে ঢুকরে কেঁদে উঠল আর পরক্ষণেই দৌড়ে পালাল । আর সাজু মনার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট ভাবে বলল,হায়রে মায়া । ক্যানে তুই আমারে এইভাবে জড়াইলি ।
সাজু ঘরে ফিরে দেখে বৌদি তার জন্য খাবার ঢেকে নিয়ে বসে আছে । মা মারা যাবার পর এই বৌদিটিই তাকে মায়ের মতো করে বড় করেছে । দুঃখ কষ্টের সংসারে নিজে আধপেটা খেয়ে তাকে খাইয়েছে ।
বৌদি জিজ্ঞেস করল,এতো দেরি করলি ক্যান ?
সাজু তার জবাবে একটু মলিন হাসি হাসল আর কিছু বলল না ।
বৌদি আবার বলল,মনা তোরে খুঁজতেছিল । ওর সাথে একটু দেখা করিস তো । অনেকক্ষণ বইসা ছিল ।
দেখা হইছে ।
সাজুর আর খেতে ইচ্ছে করছে না তাইতো সে খাবার রেখে উঠে পড়ল।
বৌদি বলল, খাবারডা শেষ কর।
সাজু বলল, ভাল লাগতেছে না বৌদি । তার চাইতে তুমি জিনিসপত্তর গোছাও আমি বইসা থাকি ।
তুই আর বড় হইলি না ।
এই বলে বৌদি বাসন কোসন গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সকাল বেলা তারা এখান থেকে চলে যাবে তারপরও এই গৃহবধূটি তার রান্না ঘরটি পর্যন্ত ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে রাখছে ।
সাজু বলল,এতো পরিষ্কার কইরা কি লাভ,বৌদি ? সকালে তো সব কিছু ফালাইয়া চইল্যাই যাইতে হইব ।
বৌদি বলল,এই ঘরের বউ হইয়া আসনের পর থ্যাইক্যা তো এইসব কামকাজ করতেছি তাই অভ্যাস হইয়া গ্যাছে। আর ঘরডারেও বড় আপন মনে হয় রে।
সাজু বলল,আর আপন মনে কইরও না । তার চাইতে ভাল হয় যদি সব মায়া মমতা মন থ্যাইকা ঝাইরা ফেলতে পারো ।
বৌদি বলল, হেইডা কি এতোই সহজ । তুই বইস্যা আছিস ক্যান ? যা ঘুমাইতে যা।
সাজু ঘুমাতে গেল । কিন্তু ঘুম আসছে না তার। শুয়ে শুয়ে ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিকে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে সে । তার পাশেই শুয়ে আছে তার ভাইয়ের ছেলে । অথচ এসবের কিছুই টের পাচ্ছে না ছেলেটা । অঘোরে ঘুমোচ্ছে,পরম শান্তির ঘুম। দুইজন একই বিছানায় শুয়ে আছে । কিন্তু একজন ঘুমে বিভোর আর অন্য জনকে ঘুম স্পর্শ করতে পারছে না । সাজু বাইরের দিকেই তাকিয়ে রইল । ক্রমেই রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে । চরের রাতগুলো এমনিতেই খুব নিস্তব্ধ হয় । আজ আরও বেশি মনে হচ্ছে । সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে মাঝে মাঝে নদী থেকে মাঝিদের গানের সুর ভেসে আসছে । আর চাঁদের আলোয় চরের বালিগুলো চিকচিক করছে । সাজুর খুব ইচ্ছে করছে সেই বালির উপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকতে । আর সত্যি সত্যিই এক সময় সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল । বালির উপর শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো এই চরটা তার বড় বেশি আপন ।
ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল । সাজুর জন্মের পর তার জীবনের প্রথম সূর্যটা সে দেখেছিল এই চরে। সে ছোট থেকে বড়ও হয়েছে এই চরেই। ভেবেছিল তার নিজের সংসারটাও শুরু করবে এখানেই । তার মতো তার সন্তানও জীবনের প্রথম সূর্য দেখবে এই চরে। তারপর এখানকার বালি,মাটিতে সে বড় হবে । কিন্তু সবসময় সবকিছু নিজের ইচ্ছেমতো হয় না। কারণ প্রকৃতি বড় ভয়াবহ,বড় নিষ্ঠুর । মুহূর্তের মধ্যেই মানুষের মনের গভীরে পরম যতেœ লালন করা স্বপ্নগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। আবার এই প্রকৃতিই মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়,ভালোবাসতে শেখায় । কি অদ্ভুত একটা ব্যাপার ! কিন্তু কেন এমন হয় ? কেন নিম্নবিত্তের আটপৌঢ়ে স্বপ্নগুলো বারে বারে এভাবেই শেষ হয়ে যায় ? এই চাওয়াটা কি খুব বেশি ?
এই প্রশ্নগুলোই সাজুর মনের ভিতর ঘুরপাক খায় । আর সে তাকিয়ে থাকে ভোররাতে আলো জ্বেলে চলতে থাকা একটা স্টীমারের দিকে ।
- শামীমা রিমা
ইণ্টার্ণ চিকিৎসক,ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ।
মন্তব্য
ভালো লাগল
ধন্যবাদ ।
শামীমা রিমা
ধন্যবাদ ।
শামীমা রিমা
গল্প টা ভাল লেগেছে । লেখনি শৈলী ও সুন্দর ।
ডাক্তাররাও সাহিত্য চর্চা করে?
আমি যদি ভুল জেনে না থাকি তাহলে বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়), নীহাররঞ্জন গুপ্ত পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। আর চিকিৎসা পেশার সাথে সাহিত্যচর্চা সাংঘর্ষিক হয় কীভাবে?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
রিমা আপু, চরম হয়েছ। চালিয়ে যান।
excellent.
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ সবাইকে।
শামীমা রিমা
মন্তব্যের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
শামীমা রিমা
নতুন মন্তব্য করুন