গল্পঃ মৃত্যুচ্ছা পর্ব-১
গল্পঃ মৃত্যুচ্ছা পর্ব-২
তখন যেন পৃথিবীর আর সবকিছুকে আমি ভুলে গেলাম। যেন আমি পৃথিবী, তপুকে সূর্য করে প্রদক্ষিণ করছি। যা কোনদিন হবে না ভেবেছিলাম, তা-ই হল। আমি প্রেম সাগরে শুধু হাবুডুবুই খেলাম না, একদম ভেসে গেলাম। প্রেমিক-প্রেমিকাদের যেসব জিনিসগুলো আমার বিরক্তিকর লাগত, আমি ঠিক তাই-তাই করতে লাগলাম। প্রতি ঘন্টায় ফোন করে তপুর সাথে কথা বলা, তপু আমার প্রতি একটু অমনোযোগী হলেই মন খারাপ করা, একটু তীব্র স্বরে কথা বললেই কেঁদে চোখ ভাসানো, রাতে তপুর সাথে কথা না বললে অস্থিরতায় ঘুমাতেই না পারা, সকালে উঠে তপুর গলাই প্রথমে শুনতে চাওয়ার ইচ্ছা—সে এক কঠিন তালিকা যা বলে শেষ করা যাবে না। আরেকটা ব্যাপার যা না বললেই নয় তা হল, আমি নিবিড়ভাবে তপুর পছন্দ-অপছন্দগুলো নিজের করে নিলাম।
আমার নিজের আইডেন্টিটি বলে যেন কিছুই থাকল না। তপু যে সব চাপিয়ে দিয়েছিল, তা বললে মিথ্যা বলা হবে। আমি নিজেই ওর আয়না হবার জন্য উদগ্রীব হয়ে গিয়েছিলাম। তপুর প্রিয় রঙ সবুজ, দেখা গেল দোকানে গেলে আমি শুধু সবুজ জামাই কিনি। তপু মা-বাবাকে মাম্মি-ড্যাডি ডাকাটা বিদেশি আগ্রাসন মনে করে বলে আমি আমার মাম্মি-ড্যাডি কে মা-বাবা ডাকা শুরু করলাম। তপু মেয়েদের ছোট চুল পছন্দ করে না বলে আমার আজীবন বব-কাট চুল কোমর ছুঁল। আরো কত পরিবর্তন হল— স-অব সোৎসাহে। তার মধ্যে একটা পরিবর্তন হল রাতুলের সাথে সখ্যতার ছেদ।
কেন জানি না রাতুল তপুকে পছন্দ করত না। তার চেয়েও আমাকে যা প্রভাবিত করল, তা হল তপু রাতুলকে পছন্দ করত না। ওরা কেউই আমাকে সরাসরি কথাটা বলেনি, কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম। অতঃপর রাতুল আমার পছন্দের তালিকায় নিচের দিকে চলে গেল। তাছাড়া ভার্সিটি লাইফে পড়াশোনা, পার্ট-টাইম চাকরী আর প্রেম করার পর অন্য কিছু নিয়ে ভাবার সময় কই? রাতুলের অভাব আমি একটুও বোধ করলাম না।
রাতুলকে এমন প্রশ্ন করার ইচ্ছা এত তীব্র হত না যদি না মাঝখানে একটা ঘটনা ঘটত। একদিন হঠাৎ খবর পেলাম, রাতুল এক্সিডেন্ট করেছে। খবরটা তপুই জানাল, ওদের কোন কমন ফ্রেন্ড নাকি তপুকে জানিয়েছে। আমি স্বাভাবিক ভাবেই চঞ্চল হয়ে পড়লাম ওকে দেখতে যাবার জন্য। হাসপাতালের নাম-ঠিকানা জোগাড় করে যখন পৌঁছলাম, তখন রাতুলকে তখনও আইসিইউ থেকে কেবিনে আনা হয়নি, তবে শংকামুক্ত। রাতুলের মা আমায় দেখে কেমন অভিমানী স্বরে বললেন, ‘এখন তো দুঃশ্চিন্তা কেটেছে, গত কাল-পরশু যে ভয়ের মধ্যে ছিলাম! তুমি কোথায় ছিলে এতদিন!’ আমি একটু অবাক হলাম, একটু রাগও হল। আমাকে তো খবর দেয়া হয়নি যে আমি আসব। তখন আমার আর রাতুলের বন্ধুত্বের এমন অবস্থা যে শেষ দেখা বোধহয় তিন-চার মাস আগে হয়েছিল! আমার জানার কথাও না। তবে পুত্রশোকে আক্রান্ত মা বলে কথা, আমি দোষী স্বরে বললাম, ‘ আমি জানলে নিশ্চয় আগে আসতাম’।
আইসিইউ তে সকলের ঢোকার নিয়ম নেই, রাতুলের মায়ের সুপারিশেই আমি যেতে পারলাম। রাতুলের নাকে কেমন একটা নল লাগিয়ে রাখা, চারপাশে বিচিত্র সব যন্ত্র। এর মাঝেও আমার মনে হল রাতুল আমায় দেখে হাসল। তারপর ঘড়ঘর শব্দ করে বলল, ‘তুই কোথা থেকে জানলি?’ আমি কেন যেন বোকার মতন কেঁদে ফেললাম, বললাম, ‘তুই আমায় না জানালেও আমি স-অব জানতে পারি’। রাতুল হেসে আস্তে আস্তে বলল, ‘আমি তো তোকে সব জানাতেই চাই’। গল্প-সিনেমার রোমান্টিক মূহুর্তের মতন ভিলেইনরূপী নার্স তখন কোথা থেকে এসে কড়া গলায় আমার বলল, ‘ রুগীর কথা বলা নিষেধ। দেখা হয়েছে এবার আপনি বিদায় নেন’। আমি আর কিছু না বলেই চলে এলাম দেখান থেকে।
এরপর কেবিনে নেয়ার পর আমি আরো গিয়েছিলাম হাসপাতালে। রাতুলের মতন আমুদের মানুষকে হাসপাতালে দেখতে গেলেও মন ভাল হয়ে যায়। কেউ দেখতে গেলেই রাতুল তাকে সাইন-পেন দিত ওর প্লাস্টারে ছবি আঁকার জন্য! সেদিনের পর রাতুল আর আমায় কখনো কোন দুর্বল কথা বলে নি। তবু আমার সে ঘটনা মনে করে আমার মাঝে মাঝেই মনে হত, কোন গহীন কোণে আমার জন্য কি রাতুলের কোন বিশেষ অনুভূতি ছিল? যদিও সেটা জানতে চাওয়া অমূলক। রাতুলের প্রতি আমার কোন অনুভূতি নেই, আমি তপুকে অনেক ভালবাসি। রাতুল যদি এখন বলেও যে ও আমায় ভালবাসে বা বাসত, কিছুই বদলাবে না। তবু আমার খুব জানতে ইচ্ছা করত!
ডাক্তার যখন আমায় প্রথম আভাস দিলেন যে আমার গলার ঘন ঘন ব্যাথাটা নিছক ঠান্ডা লাগা থেকে নয়, অন্য কিছুর জন্য তখন আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, কোন মরণব্যাধি নয় তো?
এরপর ডাক্তার যখন বায়োপ্সি করতে দিলেন, আমি তখন বুঝলাম আমার সমস্যাটা ক্যান্সার-বিষয়ক কিছু। এ চিন্তা মাথায় আসতেই হঠাৎ সে কথনটি মনে পড়ে গেল, খোদার কাছে না ভেবে কিছু চাইতে নেই,কখন খোদা ইচ্ছাগুলো পূরণ করে তা বোঝা যায় না।
রিপোর্ট নেবার দিন ডাক্তার বারবার আমার কোন অভিভাবক— বাবা-মা,ভাই-বোন,স্বামী—কাউকে আনতে বলেছিলেন। আমি আনিনি, ক্যান্সার পেশেন্টদের থেকে কিভাবে সত্যি লুকানো হয় আমার জানা আছে। আমার আপন নানী ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন। শেষ দিন পর্যন্তও উনি জানতেন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে উনি হজ্জ করতে যাবেন। অথচ আমরা জানতাম উনি আর কোনদিনই বাড়ি ফিরবেন না।
আমার এমন লুকোচুরি পছন্দ নয়। তাই নিজের রায় নিজেই জানতে এসেছিলাম।
রিপোর্ট দেখে ডাক্তার ইতস্ততভাবে জানালেন আমার লেভেল ফোর ক্যান্সার—কেমন যেন অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম। কেমোথেরাপি দিলে জীবন দীর্ঘমেয়াদী করা যাবে, সে কথাগুলো নেহায়েৎ ছেলেভুলানো গল্প মনে হচ্ছিল।
কিন্তু নিজেকে যত শক্ত ভাবতাম, ততটা বোধ হয় নয় আমি। ভেবেছিলাম, ক্যান্সার ধরা পড়লে আমি আমার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা অভিযানে নামব। কিন্তু বাস্তবে তা হল না।
মূহুর্তের মধ্যে আমায় জুড়ে ভর করল প্রচন্ড হতাশা। কিছুই তো করা হল না জীবনে। তপু আর আমার কত্ত স্বপ্ন ছিল। কতদিন মিছেমিছি ঝগড়া করেছি আমাদের মেয়েটার নাম রুমঝুম হবে না রিমঝিম হবে, তা নিয়ে! সে মেয়ে কখনো জন্মই নেবেনা? কত্ত ভেবেছি বাবা-মার পঞ্চাশতম বিবাহ-বার্ষিকী কত ধুমধাম করে পালন করব! সে কি দেখে যেতে পারব? ভেবেছিলাম যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, তার মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্যাতিত নারীদের সঠিক সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করব। পৃথিবীটা ঘুরে দেখারও বড় শখ ছিল; বা অন্তত বাংলাদেশ আর পাশের দেশ ভারতটা।
সেগুলো কিছুই করা হবে না? কিচ্ছু না? মৃত্যু নিয়ে ভাবা আর সত্যিকারের মৃত্যুর মধ্যে এত পার্থক্য? আমার বুকটা হুহু করতে লাগল।
মন্তব্য
শান্তিপ্রিয়র লেখা ভালো লেগেছে।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ধন্যবাদ
সবাই খালি মন খারাপের গল্প লেখে কেন?
ভাল লেগেছে। কিন্তু লেখকের নাম কই?
ধন্যবাদ; নাম দিতে ভুলে গেছিলাম।
ভুলে গেছি দিতে
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য
আপনার লেখা ভালো। লেখাটা ভালো লেগেছে। আপনার লেখার গুণেই এটাকে প্রেম-হতাশার প্যানপ্যান মনে হয়নি। আরো লিখুন। নতুন নতুন বিষয়ে, নতুন নতুন গল্প।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ধন্যবাদ। নতুন বিষয়ে লিখতে পারব কিনা জানিনা;কিভাবে যেন আমার সব গল্পই প্রেম-ভালবাসা টাইপ হয়ে যায়। আগের লেখা সব গল্প নিয়ে একটা মোটা খাতা আছে আমার, সেটার নাম দিয়েছিলাম, বোকা বোকা সব প্রেমের গল্প! নিজের ইমেজ রক্ষা করতে সেসব গল্প কখনো কাউকে পড়তে দেইনি, কোথাও ছাপানোর কথা তো দূরে থাক! এটা সেই সময় লেখা একটা অর্ধেক গল্প ছিল, যা হয়তো এখন শেষ করেছি বলেই প্রেম-প্রেম গন্ধটা একটু কমে গিয়েছে। উৎসাহ দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভালো লাগলো... লিখুন আরো...
তবে অবশ্যই লেখার আগে পরে নিজের নাম দিয়ে দিবেন, নয়তো আমি কিন্তু বেনামে এসে নিজের লেখা বলে দাবী করে বসবো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নাম দিতে ভুলে গেছিলাম তো! সবাই এমন থ্রেট দিচ্ছে কেন
ধন্যবাদ; আশা করি আরো লিখব
এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়া সরলতা মাখা গল্প পড়ে খুব ভালো লাগলো!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন