সমসাময়িক বেশিরভাগ বন্ধুবান্ধবের মতনই আমার বই-আসক্তির হাতেখড়ি কমিক্স দিয়ে শুরু হয়ে হুমায়ুন আহমেদ-জাফর ইকবালে গিয়ে ঠেকেছিল। বাসায় বই-পড়ার প্রচলন ছিল। মায়ের বই সংগ্রহের একটা বড় অংশজুড়ে ছিল ওপার বাংলার লেখকদের বই। আর ভাইয়া কিনত সমসাময়িক লেখক হুমায়ুন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, শাহরিয়ার কবির—এনাদের লেখা বই। মনে পড়ে বইমেলা থেকে এত বই কেনা হত যে বছরের বাকি অর্ধেকটা সেই বই পড়ে চলে যেত। তারপর চলত এর-ওর থেকে বই ধার নিয়ে পড়ার পালা। মামাতো-খালাতো ভাইবোনদের থেকে বা ভাইয়ার বন্ধুদের থেকে ধার নিয়ে আনা বই( আমার স্কুলের কোন বন্ধুই বই-পোকা ছিল না)অল্প সময়ের জন্য এনে গোগ্রাসে গিলতাম। পড়ার বইয়ের নিচে, লেপের ভিতর টর্চের আলো জ্বেলে, বাথরুমে—কত কষ্ট করেই না বই পড়েছি!
পাঠ্যপুস্তকের বাইরে রবীন্দ্রনাথের শিশু সমগ্র ছাড়া তেমন কোন গল্প-কবিতা পড়া ছিল না। রবীন্দ্ররচনায় আমার কাছে অচেনা শব্দের সমারহই বোধ ছিল এর অন্যতম কারণ। ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি অচেনা শব্দ দেখলে সবসময় অভিধান খুলে অর্থ দেখবার আদেশ দিয়েছিল শিক্ষক-গুরুজন সকলে। কিন্তু কেউ কেন বাংলা শব্দার্থ দেখার পরামর্শ দেয়নি, তা ভাবলে দুঃখ লাগে এখন। কত্ত বাংলা শব্দের একদম যথার্থ মানে জানি না, স্রেফ আলসেমি করে অভিধান না দেখবার কারণে। এখন অফিসের কাজে মাঝে মাঝে কোন কোন ডকুমেন্ট অনুবাদ করতে গিয়ে দেখি শব্দটা অর্থ সম্পর্কে হয়তো ভাসা-ভাসা জ্ঞান আছে!
ছোটবেলায় রবীন্দ্রসংগীত শিখেছিলাম কিছুদিন, কিন্তু গানের অর্থ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাইনি তখন। রবীন্দ্রনাথের সাথে নবপরিচয়ের পেছনে কৃতিত্বটা দিতে হবে আমার ক্লাস এইটের বাংলা শিক্ষিকাকে। আমাদের স্কুলে নিয়ম ছিল প্রতি বছর বাংলায় যে সর্বোচ্চ নাম্বার পেত, তাকে একটা বিশেষ পুরস্কার দেয়া হত। ইস্লামিয়াতের ক্ষেত্রেও একই ধরণের পুরস্কার ছিল। ইস্লামিয়াতের পুরস্কার কখনো না পেলেও বাংলার পুরস্কারটা আমার জন্য বাধা ছিল। কিন্তু তাতে খুব আহামরি খুশি হতাম তা না;প্রতি বছর একই পুরস্কার—একটা অভিধান, কখনো বাংলা টু ইংলিশ,কখনো ইংলিশ টু বাংলা আর কখনো বাংলা টু বাংলা। ভাগ্য খারাপ ছিল কোন একবার-- পরপর দু’বছর একই অভিধান পেয়েছিলাম! অভিধানে বাসা সয়লাব হবার আগেই তা অন্য কাউকে, বিশেষ করে গ্রামের বাড়িতে, পাঠিয়ে দেয়া হত।
ক্লাস এইটে কোন এক অজানা কারণে বাংলার পুরস্কার হিসেবে দেয়া হল সঞ্চয়িতা। আমি যারপরনাই খুশি হলাম। বাসায় যদিও মায়ের একটা সঞ্চয়িতা ছিল, কিন্তু তা-ও আসা রাখলাম যে অভিধানগুলো মতন এ পুরস্কারের গন্তব্য অন্যদের বাড়ি হবেনা।
সঞ্চয়িতা পড়ছি তা প্রমাণ করার জন্য, আমি শীতের ছুটিতে লেপমুড়ি দিয়ে মোটা বইটা নিয়ে বসলাম। কিন্তু প্রথম কবিতা পড়েই হোঁচট খেলাম—একী! এটা কোন ভাষায় লেখা! কিছুই তো বুঝিনা! সেই কবিতাটা ছিল ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী গ্রন্থের কবিতা ‘মরণ’, যেটা রবিঠাকুর কিশোর বয়সে ব্রজবলি(আদি বাংলা ও মৈথেলী ভাষার মিশ্রণে ভাষা)ভাষায় লিখেছিলেন। কিন্তু কিশোরী আমি কি ছাই সে কথা জানতাম! আমার ধারণা হল রবিঠাকুরের সব লেখাই বুঝি এমন; আর কোন কবিতা পড়ার চেষ্টাও করলাম না!
স্কুল পাশ করার পর রবীন্দ্র-রচনাবলী ধরে গল্পগুচ্ছ পড়ে রবিপ্রেম জেগে ওঠে এ মনে। সেটাও ভাগ্যবশত! কোন প্রকাশনী যেন কোন জয়ন্তী উপলক্ষে বড় মূল্যহ্রাসে রবীন্দ্র-রচনাবলী বিক্রি করছিল; সেই সুযোগ নিতে আমার এক মামা কিনে ফেললেন ১৮ খন্ডের রচনাবলী। কিন্তু তার ছোট বাসায় সেসব মোটা মোটা বই রাখার জায়গা নেই। অতঃপর রবীন্দ্র-রচনাবলী স্থান পেল আমার ছোট্ট ঘরে রাখা বাসার সব বই-যুক্ত বিশাল বুক-শেল্ভগুলোতে। স্রেফ কোন কাজ নেই বলেই প্রথমে রবীন্দ্রনাথ পড়তে শুরু করেছিলাম; কিন্তু তা যে কবে সুপ্তপ্রেমে পরিণত হল সে এক অন্য গল্প।
সেদিন অনেকদিন পর সঞ্চয়িতা খুলে বসেছিলাম।এখন ইদুর-দৌড়ের কালে আয়েশ করে কবিতা পড়ার সময় কই? হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা আমি তো সেই ক্লাস এইটের পর আর কখনো সঞ্চয়িতার প্রথম কবিতাটা খুলে পড়িনি!
কবিতাটা খুলে পড়লাম, অভিধান খুলে অর্থ বের করলাম অজানা শব্দের। মনে হল রবিঠাকুর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। বৃত্ত আঁকা সম্পূর্ণ হয়েছে।
-শান্তিপ্রিয়
মন্তব্য
ক) রবিবুড়োর 'মনেরে আজ কহো যে,
ভাল -মন্দ যাহাই আসুক... সত্যেরে লও সহজে!'
এই লাইনটায় ভর করে চলার চেষ্টা করি।
খ) গান শিখিনি বলে বড় আফসোস হয়। ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়ে- এমন বন্ধুদের করি দারুণ হিংসে !
গ) লেখায়
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আমি গান গাইতে পারি। পুংমার্জারসঙ্গীত। শিখবা, মামণি?
পুংমার্জারসঙ্গীত
দুটোকেই 'পিট্টা লাল' করে দিতে হবে দেখছি!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আহা, শুভ কাজে দেরী কিসের ?! শুরু হোক, শুরু হোক! হাততালি রেডি আছে
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ইজ দ্যাট রেসপেক্টফুল?
আমি গান শিখেও আফসোস করি; কেন ভাল করে গান শিখিনি। তখন গানের কথার মর্ম বুঝলে নির্ঘাত সিরিয়াসলি গান শিখতাম সুন্দর করে!
ছোটবেলায় রবিদাকে দেখলে আমার মনে হত খুব দাগী বুঝি। আর কী কঠিন ভাষা। কিচ্ছু বুঝি না। তারপরে একদিন পড়তে শুরু করলাম গল্পগুচ্ছ। প্রথম শুরু করেছিলাম ''শাস্তি'' গল্পটা দিয়ে। জটিল একটা গল্প। টান টান উত্তেজনা। তখনই বুঝলাম রবিদা কি জিনিস! এরপর তো তাঁর মাঝেই ডুবে আছি।
কাবুলিওয়ালার পর মনে হয় আমার প্রথম গল্প মনে হয় অতিথি; সেই ভবঘুরে ছেলের মতন হতে ইচ্ছা হয়েছিল খুব!
ভালো লাগল।
ব্রজবলী > ব্রজবুলি
ধন্যবাদ...ইশ বানানটা নিয়ে সন্দেহ হচ্ছিল; পরে বলী মনে হল কেন জানি!
"চমৎকার, ধরা যাক দু'একটা ইঁদুর এবার"
রবি পড়তে গেলে আমার এই মনে হয়।
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
খোমাখাতা
"চমৎকার, ধরা যাক দু'একটা ইঁদুর এবার"
কোটেশন দেখে বুঝছি কোন চেনা লাইন; কিন্তু আমি চিনছি না...কিসের লাইন?
''যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের...মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা!
এই জেনে অশ্বথের শাখা করেনি কি প্রতিবাদ ?
জোনাকির ভিড় এসে সোনালী ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে, করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে বলেনি কি;
বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে........
চমৎকার!
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!''
#আট বছর আগের এক দিন
জীবনবাবুর লাইন, আমার তৃতীয় প্রেমিক।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
তিথী তোমার এই নতুন প্রো-পিকটা কী জিনিস? দেখতে হাঙ্গর মাছের dorsal fin-এর মতো লাগে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমারও মনে একই কথা এসেছে কিন্তু জিজ্ঞেস করতে আলসি লাগে তাছাড়া আমি কিন্তু হাসিও নাই।
[ ]
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
পাণ্ডবদাও প্রোপিক খেয়াল করেন জেনে মজা লাগল।
আশাদি তো নয়া মানুষ। থাকগে..
কৌস্তুভ এবং পছন্দনীয়--
'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!'
খাড়ান.. মাইর কিনতুক একটাও মাটিতে পড়বো না!!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
এইও, সাধু সাবধান !!!
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
এই দাঁড়িওয়ালা শয়তান মাথায় ভর করলে কিন্তু খবর আছে। আমরণ এর হাত থেকে রেহাই নেই। তবে বাংলা সাহিত্য পড়েছেন কিন্তু এই শয়তান তাকে আছর করেনি এমন মানুষ বোধহয় একজনও নেই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
রবি বুড়া খুপখ্রাপ লুক। খালি খালি মাথা আউলা করে, কোন মানে হয়না। সংবিধানে এর শাস্তি হওয়া উচিত।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
সঞ্চয়িতা আমি উপহার পেয়েছিলাম ক্লাস এইটে থাকতেই, আমার জন্মদিনে সেবার বাবা-মা'র পক্ষ থেকে দেয়া হোলো গীতবিতান, আর বড়-ফুপির পক্ষ থেকে সঞ্চয়িতা।
'মরণ' পরে আমি মুগ্ধের চেয়ে অবাক হয়েছিলাম বেশি। কারণ, কবিতাটা একটা চেনা-কিন্তু-অচেনা ভাষায় লেখা।
অলস বলেই হয়তো অভিধান দেখার চেয়ে নিজের মতো করে মানে করে নেয়া আমার বরাবরের অভ্যাস। তখন নিজের মতো করে মানেই করে নিয়েছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে-
পড়ে পুলকিত হয়েছিলাম। আমাদের হিন্দি ছবির প্রতি টান কে এ কারণে কিছুটা ধন্যবাদ দিই, ওই উচ্চারণ হবে আন্দাজ করে মানেটা বুঝে নিয়েছিলাম। বিসরবি টা যে বাংলায় বিস্মরণ এর সমার্থক, সেটা বোধহয় হিন্দি শোনার ফলেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম।
রবীন্দ্রনাথ একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন এটা কখনো ভুলতে পারি না। সব মানুষের মতোই তিনিও কখনোই সমালোচনার উর্ধ্বে নন। কিন্তু একটা মানুষ কি পরিমাণ গুণী হলে এত বিপুল পরিমাণে এবং এত উৎকৃষ্ট মানের শিল্প তৈরী করে রেখে যেতে পারেন, ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়।
লেখা ভালো লাগলো।
............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্ চিনে।
সুরঞ্জনার মন্তব্যের তৃতীয় প্যারার সাথে তীব্রভাবে সহমত লেখায়
নতুন মন্তব্য করুন