জন কীটস-এর ‘Ode to a Nightingale’ বা ‘নাইটিংগেলের প্রতি’ কবিতাটি ইংরেজি সাহিত্যের রোম্যান্টিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। প্রবল ইন্দ্রিয়কাতর ও রূপভারাতুর এই কবিতাটির মুখোমুখি হয়েছিলাম ২০০১ সালের মাঝামাঝি, তখন আমি শৈলশহর শিলং-এ; ‘অৌড টু এ নাইটিংগেল’ ছিলো উচ্চ-মাধ্যমিকের ইংরেজি ক্লাসে পাঠ্য। কবিতাটি সাথে আমার অনেক বিনিদ্র রাত কেটেছে।
‘অৌড টু এ নাইটিংগেল’ অনুবাদ করতে গিয়ে চেষ্টা করেছি বাংলা রোম্যান্টিক যুগের ভাষা-শব্দ-চিত্রকল্প অনুসরণ করার। সাবলীলতা বজায় রাখার জন্যে কিছু কিছু জায়গায় মৃদু পরিবর্তন এনেছি; যেমন- 'Provençal song' হয়ে গেছে 'অঘ্রাণের উৎসব'; 'Hippocrene' হয়ে গেছে 'দক্ষিণ দেশের সোমধারা'; বাইবেলের 'Ruth' হয়ে গেছে বাঙালি 'ভীরু বালিকা মমতা'; 'White hawthorn', 'Pastoral eglantine', 'Violets' 'Musk-rose' এগুলো হয়ে গেছে যুঁথী, সন্ধ্যামণি, মালতি, বকুল, বনগোলাপ, রজনীগন্ধা - ইত্যাদি।
কবিতাটি অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি এখানে, কিন্তু বিশুদ্ধ অনুবাদ কি সম্ভব? বলা যেতে পারে এটি কীটসের হাতে হাত রেখে ‘নাইটিংগেলের প্রতি’ বাংলায় লেখার একটি ব্যর্থ প্রয়াস।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
মূল: অৌড টু এ নাইটিংগেল - জন কীট্স
নাইটিংগেলের প্রতি
১।
কী ব্যথা হৃদয়ে বাজে! সেই সাথে অবশ আবেশ
চেতনা জড়ায়ে আনে - কোনো বিষ করেছি কি পান
অথবা কি আফিমের সুরাপাত্র করেছি নি:শেষ
মুহুর্তেক আগে, তাই বিস্মরণে ছায় মনপ্রাণ!
এ ব্যথা নয় গো নয় তোমার সুখেতে ঈর্ষা হতে,
সীমাহীন সমসুখে এ আনন্দ বেদনা ঘনায়!
ওগো লঘুপক্ষ প্রাণ কোন মায়াময় সুরলোকে
কন্ঠ ভরে অমৃতের স্রোতে -
হৃদয় দিয়েছো ঢেলে নব নিদাঘের বন্দনায়
অগন্য ছায়ায় ভরা বননীল সপ্নিল আলোকে।
২।
আহা, সে মদিরাপাত্র - অন্ধকারে মাটির গভীরে
সঞ্জীবনী সঞ্চয়নে বহুকাল ছিলো যে শীতল
যে আনে শ্যামল স্বাদ অঘ্রাণের উৎসবেরে ঘিরে
নৃত্যগীত উন্মাদনা - সে উল্লাস সূর্যকরোজ্জ্বল।
আহা, সে আধার ভরা দক্ষিণ দেশের সোমধারা
ধারে তার মুক্তোরাশি - বুদবুদের ফেনিল উচ্ছ্বাস,
স্বর্গের সুরভি তার লাজরাগ রক্তিম অধরে;
চলে যাবো আমি আত্মহারা-
সেই সুধা পান করে ছেড়ে যাবো ধরার আবাস
ওই স্বপ্নছায়াময় অরণ্যে - সবার অগোচরে।
৩।
চলে যাবো দূরে আমি ভুলে যাবো পৃথিবীর কথা
বনের গভীরে তুমি পাও নাই পরিচয় যার,
এই শ্রান্তি, জ্বরতাপ, অসহায় দু:খের বারতা
প্রতিকারহীন শুধু বসে শোনা বিলাপ ব্যথার।
নিষ্ঠুর জরার ঘা'তে খসে পড়া পালিত প্রবীণ
মৃত্যুমুখে ঢলে পড়া রোগশীর্ণ কঙ্কাল কিশোর
যেখানে ভাবনা শুধু আনে দু:খ বেদনার ভার;
হতাশায় চোখ ভাষাহীন -
যেখানে ক্ষনেক পরে ঝরে যায় তারুণ্যের ঘোর
একটি দিনের শেষে প্রেম মুছে ফেলে চিহ্ন তার।
৪।
পিছে থাক এ পৃথিবী, চলে যাবো তোমার ছায়ায়
নয় কোনো ঈশানের মদির নেশায় বিস্মরণ,
উড়ে যাবো ওই বনে কল্পনার অলখ পাখায়
যদিও বাধায় ভরে জীবনের ভারবাহী মন।
এই তো তোমার সাথে আমি এই রাতের আলোতে
আকাশের সিংহাসনে রানীর মতো হাসে চাঁদ
ঘিরে ধরে তারাদল, মাটিতে নিবিড় অন্ধকার;
শৈবাল বিছানো পথ হতে -
দোলায় হঠাৎ হাওয়া ঘননীল সবুজের বাঁধ
অসীমের কোল বেয়ে আলো ভেসে আসে ফাঁকে তার।
৫।
দেখিনা একোন ফুল আমার পায়ের কাছে রয়
কোন ফুল দোলে ঐ ছায়াময় গাছের শাখায়
সুরভিত অন্ধকারে পাই সবাকার পরিচয়
ভেসে আসে প্রতিনাম এই ধীর হাওয়ার পাখায়।
চিনি আমি এই যুঁথী, সন্ধ্যামণি, মালতি, বকুল
ঝোপের আড়ালে ফোটা ওই বনগোলাপের মেলা;
শিশিরের সুধায় আকুল -
কতো সুর আনে বয়ে রজনীগন্ধার এ সুরভি
মৃদু অলিগুঞ্জরণ উদাস নিদাঘ সন্ধ্যাবেলা।
৬।
অন্ধকারে পাতি কান; মনে হয় যেনো কতোবার
আমাকে পেতেছে তার প্রেমডোরে মধুর মরণ!
বাতাসে মিলায়ে নিতে এই শেষ নি:শ্বাস আমার
কতো প্রিয় নামে তারে কতো সুরে করেছি বরণ!
মনে হয় কী পরম শুভ এই বিদায় সময়;
ব্যথাহীন থেমে যাওয়া এই মাঝরাতে অপরূপ!
তখনো তোমার গান ঝরে যাবে দূর হতে দূরে
ভরে দেবে সবার হৃদয় -
আমি শুধু র'বো এক প্রাণহারা মৃত্তিকার স্তুপ
শ্রবণ পাবে না সাড়া সে অসীম আনন্দের সুরে।
৭।
মরণ তোমার তরে কভু নয় হে অমর পাখি
ক্ষুধিত মানব যারে পারে নাই চরণে নামাতে
কতো যুগ আগে তুমি এই সুরে ডেকেছো একাকী
রাজপ্রাসাদের কোণে, সেই সুর শুনি আজ রাতে।
শুনে ছিলো এই গান সেই ভীরু বালিকা মমতা
স্বদেশ স্বজন হতে বহুদূরে ধানখেতে একা
অশ্রুভারে ছলোছলো চোখ, মুখ বেদনা-মলিন;
এই সুরে কতো রূপকথা -
দুর্গম সিন্ধুর তীরে মায়াপুরী বাতায়ন রেখা
মন চলে সেই দেশে - চিরজনহীন, উদাসীন।
৮।
'উদাসীন'! এই কথা যেনো এক ধ্বনির আঘাতে
আমাকে ফিরায়ে আনে তোমার স্বপ্নের দেশ হতে,
বিদায়! কল্পনা-মায়া পারে না তো জীবন ভোলাতে
ছলনায় ভরে শুধু ভাসে মন ক্ষণিক আলোতে।
বিদায়! বিদায়! শুনি চলে যায় দূরে চলে যায়
ধানখেত পার হয়ে সকরুণ ও গান তোমার
পার হয়ে ছোটো নদী যেইখানে প্রান্তর নিঝুম!
পাহাড়ের ওপারে হারায় -
সেই সুর! ওকি শুধু স্বপ্ন - শুধু ভাব কল্পনার?
চলে গেছে সেই গান? একি জাগরণ? একি ঘুম?
---
(ভাষান্তর: সুমন তুরহান)
মন্তব্য
ভাল প্রচেষ্টা! কয়েকটি জায়গায় বেশ অসাধারণ হয়েছে । তবে, রোমান্টিক কীটসকে অনুবাদ করা সহজকর্ম নয়। আপনি হুমায়ুন আজাদের করা অনুবাদটি দেখেছেন কি?
ধন্যবাদ।
এম আব্দুল্লাহ
(নতুন করে কমেন্ট করতে হচ্ছে। কেনো যেনো মন্তব্যের প্রত্যুত্তর দিতে পারছিনা, অতিথি একাউন্ট বলে বো্ধ হয়।)
@ এম আব্দুল্লাহ - ধন্যবাদ ভাই। হুমায়ুন আজাদ স্যারের করা অনুবাদটি পড়েছি তাঁর অসামান্য গ্রন্থ 'আমার অবিশ্বাস'- এ। স্যার কবিতাটি বিশ্লেষণ করেছেন যথার্থই হুমায়ুন আজাদীয় ভঙ্গীতে, যার কোনো তুলনা নেই। তবে স্যারের করা অনুবাদটি ছিলো ছন্দ-অন্তমিল বর্জিত, তাই পড়ার পর কিছুটা অতৃপ্তি রয়েই গিয়েছিলো। (অবশ্য 'আমার অবিশ্বাস' কবিতা অনুবাদের বই নয়, তাই হয়তো স্যার অনুবাদের পেছনে খুব একটা সময় ব্যয় করেননি।)
বহুবার পড়লাম, প্রতিবারই অসাধারণ বলে মনে হলো!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
আমার কবিতা পড়া হয়েছে খুবই কম, তারই মাঝে কীটস আমার সবচাইতে প্রিয়দের একজন। আমি মাঝে মাঝেই পড়ি বের করে; ”আওওয়ে! আওওয়ে! ফর আই উইল ফ্লাই টু দি” - এই কবিতায় আমার সবচাইতে প্রিয় লাইন।
শুধু একটা কথা বলি - একেকজনের হাতে একেকরকমভাবে আসে, আপনার হাতে যা আসছে তা মনোমুগ্ধকর! অভিনন্দন, অভিনন্দন!!
খুব ভালো লাগল অনুবাদ-ছন্দ!!! আমিও কালই একটি ঔদ এর প্রথম অংশটুকু অনুবাদ করেছিলাম, হয়তো অতটা ভালো হয় নি, বাকিগুলো সামনে করবো।
কল্যাণ হোক।
পরীক্ষা কেমন হইতেছে সেইটা বইলা যান, জনগনের মনে এই ব্যাপারে আগ্রহ আছে। প্রশ্ন হোক যথাতথা উত্তর হোক ভালো
'কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা' পরীক্ষা ছিল তানিম ভাই, আসলেই প্রশ্নে সমস্যা ছিল- অতিদীর্ঘ ছিল, তয় সব মিলায় ভালোই হইছে..................
বাহ বাহ, ছেলে আমাদের পড়ালেখায়ও ভালো বটে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জিনিসটা আমার মনে ব্রাট কৌতুহলের জন্ম দিয়া দিলো, আইজকাল বুদ্ধিমত্তা কিরতিমভাবে জাগ্রত করার চেষ্টা শুরু হইছে ? ”কন কি মশয়” (কপিরাইট ভানু)! তা কিভাবে আপনাদের দিয়ে এই মহৎ কাজটি সম্পাদিত হইয়াছে তাহা যদি আমাদিগকে জানান তবে আমাদের আকুলিবিকুলি করা মনখান শান্ত হয় ..
পড়ালেখা ঠিকমত করেন মিয়া, পরীক্ষা লইয়া ঠাট্টা মশকারী করা ঠিকনা কইলাম
@ রোমেল চৌধুরী - অশেষ ধন্যবাদ রোমেল ভাই। আপনার মন্তব্যে সাহস পেলাম।
@ মৃত্যুময় ঈষৎ - ধন্যবাদ ভাই। আপনার অনুবাদটা ভালো হয়েছে। আমি নিজেও একটা অনুবাদ করেছিলাম 'অৌড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড' - এর। পরে একসময় শেয়ার করবো।
@ তানিম এহসান - আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো ভাই। কে যেনো একবার বলেছিলেন 'অনুবাদ হচ্ছে বিপরীত দিক থেকে দেখা সূচিকর্ম।' কবিতার ক্ষেত্রে কথাটা আরো সত্যি। আপনার সাথে সহমত - প্রত্যেকের অনুবাদই স্বতন্ত্র। একটি বিদেশি কবিতার পরিপূর্ণ স্বাদ পেতে কখনো কখনো একাধিক অনুবাদকের করা ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদ পড়তে হয়। তাই, আমার মতে, একই লেখার যতো বেশি অনুবাদ হয় ততোই ভালো। শুভেচ্ছা জানবেন।
- সুমন তুরহান
আমি কি তথ্যসূত্র উল্লেখ করে অনুবাদের অংশ বিশেষ মি কীটসের জীবনী লেখায় ব্যবহার করতে পারি??
নতুন মন্তব্য করুন