পথ চলতে গিয়ে অনেকের সাথেই দেখা হয়; সেটা হোক জীবন চলার পথে কিংবা দৈনন্দিনের ক্ষুদ্র গন্তব্যের পথে । কিছু মুখ মনে থাকে, কিছু মুখ হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে । কিছু মুখ ভাবায়, কিছু মুখ জাগায় । এই মুখগুলো জায়গা করে নেয় হৃদয়ের কোনো অজানা কোণে । সবসময় নয়, মাঝে মাঝে হয়তো কোনো একাকিত্বের মুহূর্তে কিংবা কোনো কোলাহলমুখর ক্ষণে এরা ভেসে উঠে মনের পর্দায় ।
ঋতুর বিচারে বর্ষাকাল হলেও গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহ তখনো প্রবলভাবেই বিরাজমান । শিক্ষাজীবনের দীর্ঘসূত্রতাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিতে পি.এল. টা ইলাস্টিক রাবারের ন্যায় টেনে টেনে বাড়ানো হচ্ছিলো । অবশ্য সেটা ইলাস্টিক ছিলো কিনা কে জানে । ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকদের টানাটানিতে হয়তো অনেকদিন আগেই বেচারা তার ইলাস্টিসিটি হারিয়ে ফেলেছে । তো সেই ইলাস্টিক কিংবা প্লাস্টিক পি.এল. এর সদ্ব্যবহার করতে আরও অনেক ভার্সিটি স্টুডেন্টের মত আমিও বেছে নিয়েছিলাম কোচিংয়ে ক্লাস নেয়াটাকে । প্রতিদিনের অভ্যাসকে কাঁচকলা দেখিয়ে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যথারীতি কোচিংয়ে হাজির । তারপর সকাল ৯টা আর ১১টায় টানা দু’টো ব্যাচ পড়ানো । দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়ার স্বপ্নে বিভোর একদল শিক্ষার্থীর কোলাহল ছেড়ে যখন ফার্মগেট থেকে শাহবাগের উদ্দেশ্যে বাসে উঠি, দুপুরের কড়া রোদ তখন মাথার উপরে । প্রচণ্ড গরমে ঘেমেনেয়ে একাকার; সেইসাথে রাস্তায় দীর্ঘ জ্যাম আর বাসের উপচেপড়া ভীড় । এমনি রোমান্টিকতাবৈরী এক পরিবেশে ওকে প্রথমবারের মত দেখেছিলাম । শুধু একপলকের চাহনি, এর বেশি কিছু নয় । কিন্তু আমি যেন তাতেই হারিয়ে গিয়েছিলাম । ভরদুপুরের প্রচণ্ড গরম, রাস্তার জ্যাম, বাসের ভীড় সবকিছুই ভুলে গিয়েছিলাম । কোথা থেকে যেন প্রশান্তির ঠাণ্ডা হাওয়া পরশ বুলিয়ে গিয়েছিলো আমাকে ।
বড় সাধাসিধা একটা মুখ; আর সেই মুখে ফুটে ছিলো এক নিষ্পাপ সরলতায় ভরা দৃষ্টি । বাবার পাশে চুপ করে বসেছিলো । হাতে একটি নামকরা কোচিংসেন্টারের প্রস্পেক্টাস আর ভর্তির খাম ।
শাহবাগ এসে বাস থামল । আমি নামলাম । দেখি ও আর ওর বাবাও নামছে । গাড়িতে বহুবার ভেবেছি, “ইশশ! একবার যদি সুযোগ পেতাম, তাহলে এখনই অফার করতাম ।” বাস থেকে নামার পর ওর বাবা রিকশা খোঁজার জন্য একটু এগিয়ে গেলেন । আমি খানিকটা পিছিয়ে ওর পাশে হাটতে লাগলাম । কিন্তু হায়! আমার গলা শুকিয়ে আসছে কেন? আমি এই অষ্টাদশীর কাছে নার্ভাস হয়ে পড়ছি কেন? আমার এই বাইশবছরের জীবনে কই এমনটিতো আর ঘটেনি ।
ওর বাবা রিকশা ঠিক করে ওকে নিয়ে উঠে পড়ল । আমার কিছুই বলা হলো না । হয়তো আমার চিরকালীন আত্মসন্মানবোধ একটি অপরিচিতার কাছে ভালোবাসা ব্যক্ত করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো কিংবা মুগ্ধতার শিহরণ আর অজানা কোনো অনুভূতি আমাকে আবদ্ধ করে ফেলেছিলো ।
সম্বিত ফিরে পেয়ে আমিও “মামা, জগন্নাথ হল চলো ।” বলে একটা রিকশায় উঠে পড়লাম । দু’টো রিকশাই প্রায় পাশাপাশি যাচ্ছিলো; যদিও ওকে দেখতে পাচ্ছিলাম না । আমার রিকশাটা যে পাশে ছিলো, ও বসে ছিলো তার বিপরীত পাশে । রিকশা হলের দিকে মোড় নিবে, এমন সময় হটাৎ ওর বাবা ডাক দিলেন । খানিকটা হকচকিয়ে গেলাম । ভাবলাম, হয়তো ওনার মেয়েকে ফলো করছি ভেবে ডাকছেন । কিন্তু না ।
“এই যে বাবা, বকশীবাজার কোনদিক দিয়ে যাবে জানো?”
আমি একবার ফিরে দেখলাম, তারপর হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলাম ।
ওদের রিকশাটা চলে গেলো । সেই শেষবার ওকে দেখেছিলাম । এরপর কতবার মনের অজান্তেই আশেপাশে খুঁজেছি । আর দেখিনি । কে জানে কোথায় আছে, কেমন আছে ও । হয়তো আর দেখবো না, হয়তো আবার দেখবো । হয়তো ও কোনোদিনই জানবে না, কেউ একজন তাকে খুজে ফিরছে নিজেরই অজান্তে…।
--বাংলামায়ের ছেলে
মন্তব্য
ভালো লাগলো...সুন্দর উপস্থাপন...
হ। সেরকম পুরা। কোট করতে চাইছিলাম, কিন্তু পুরা লেখাই দেখি কোট করা লাগে তাইলে!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
তাই!!! জেনে ভালো লাগলো।
আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকা হোক।
ইস জানানো উচিত ছিলো ।। একদম ঠিক হয়নাই । লিখা খুব ভালো লাগলো।
হুমম...সেই আফসোসেই আজো পুড়ি...............
যা পাওয়া যায়না, তাই বেশী ভাল লাগে । তাইতো কবি লেখে গেছে ন:
Hear melodies are sweet, but those unheard sweeter..
এম আব্দুল্লাহ
ভালো
লেখা ভালো লাগলো। কিন্তু...জানবে নাই বা কেন ? হাতে না ভর্তির কাগজ ছিল ? ঐ সুত্র ধরে খোঁজার জন্যে শহরটা খুব বড় না কিন্তু
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
একটি লেখার শুরু এবং শেষ যদি আকর্ষনীয় না হয় তাহলে পুরো লেখাটাই মাটি। আপনার লেখার শুরুটা চমৎকার হয়েছে...আরো লিখুন।
বাসে একবার দেখে দেখে, না্মটাও না জেনে 'অফার' করার জন্য 'ফাল' দিচ্ছিলেন, সেটা পড়ে আবার লোকজন তালিয়াও দিয়ে গেছে।
বড় বিনোদিত হইলাম বস।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
বয়সের একটা ধর্ম আছে, সেটা যে মানুষ কোনো কারনে সময়মত পালন করতে পারে না, সুযোগ পায় না, কিম্বা করতে জানে না - তার চেয়ে দূর্ভাগা খুব কমই আছে! তা সেটা শৈশব, কৈশোর, যৌবন বা প্রৌঢ়ত্ব যাই হোক না কেন (বার্ধক্যের কথা জানি না)। এই লেখাটা যদি গল্প না হয়ে সত্যি ঘটনা হয়, তাহলে আমি বলবো লেখক বুদ্ধিমান ও সৌভাগ্যবান। আমি তার এই স্বাভাবিক সৌভাগ্যে আনন্দিত। তাকে অভিনন্দন। আর এটা নিছকই গল্প হলে বলবো - এমন গল্প যেন সকলের জীবনেই যথাসময়ে মাঝেমধ্যে সত্যি হয়। মানুষ যেন বেশি জানা-বোঝার বয়স আসার আগেই বেশি-বেশি জানতে-বুঝতে না শিখে এবং না বুঝেই বোকার মত একটু-আধটু 'ফাল' পাড়তে সাহস করে এই প্রার্থনা করি।
****************************************
নতুন মন্তব্য করুন