(মীরেশ্বরাই এর আবু তোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ কারী ৪৪ জন শিক্ষার্থীর প্রতি আত্মপক্ষ সমর্থনের অপচেষ্টা)
আমি যখন তোমাদের মত ছিলাম তখন প্রতিদিন বিকেলবেলা স্কুল থেকে এসে নাকে-মুখে কিছু গুজে দিয়ে ছুটতাম মাঠের দিকে । মা পেছন থেকে চিৎকার করে গলা ফাটাতেন, ‘দুটো মিনিট বসলি না পর্যন্ত, সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা, আজ যদি তোকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছি!’ তারপর সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে মায়ের পিটুনি খাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি পড়তে বসে যেতাম । মায়ের কি সংসারের কাজের চাপে বিকেলবেলার কথা মনে আছে! আমি তবু অপেক্ষায় থাকতাম, এই বুঝি সব কথা মার মনে পড়ে গেল ।
আমিও তোমাদের মত স্কুলে থাকতে স্কুল টীমের হয়ে কত ম্যাচ খেলে বেড়িয়েছি ! স্কুল পালিয়ে আমরা অনেক দূরে দূরে চলে যেতাম অন্য স্কুলের সাথে ম্যাচ খেলতে । সারাদিন রোদে পুড়ে শুধুই বুরবাকের মত ঘোরাঘুরি । একদিন তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবলাম, ‘আরে এই নিগ্রোটা আবার কোত্থেকে আসলো !’
তোমাদের এভাবে চলে যাওয়ার কথা ছিল না । এভাবে চলে যাওয়া তোমাদেরকে মানায় না । মায়ের বকুনি খেয়ে পড়ার টেবিলে বসে রাতের সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত মুরগির মত ঝিমাবে তা মেনে নেওয়া যায়। স্কুলের বদরাগী অঙ্ক স্যারের হোমওয়ার্ক করতে না পেরে ঘন্টাখানেক নীল ডাউন হয়ে থাকবে এটা মেনে নেওয়া যায় । কিংবা, জ্যৈষ্ঠের খর দুপুরে আমগাছের মগডাল থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকে ফেলবে তাও মেনে নেয়া যায়। কিন্তু তোমরা ৪৪ জন পানির নিচে একটি বদ্ধ কুঠুরীতে অক্সিজেনের অভাবে তীব্র যন্ত্রনায় হাঁসফাঁস করতে করতে মরে যাবে এটা আমি, আমরা কেউই মেনে নিতে পারিনি । অবশ্য তোমাদের কী দোষ ! আমরাই তো তোমাদের মেরে ফেলেছি । একদম হাতে ধরে গলা টিপে টিপে মেরেছি । তোমাদের জন্য আমরা একটি নিরাপদ পৃথিবী তৈরী করে যেতে পারিনি । তোমাদের খেলার জন্য আমরা একটি সুন্দর বিকেল উপহার দিয়ে যেতে পারিনি । তোমাদের মুখটা নিস্পাপ হাসিতে ভরিয়ে তোলার জন্য আমরা তোমাদের হাতে একটি অনিন্দ্য গোলাপ তুলে দিতে পারিনি । আমরা শুধু তোমাদেরকে বিভীষিকাময়, তীব্র যন্ত্রণাকাতর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পেরেছি ।
তোমরা আমাদেরকে কখনো ক্ষমা করো না । তোমরা আমাদের ব্যর্থতাকে আরও অভিশাপ দিয়ে যেয়ো প্রতিনিয়ত । তোমরা আমাদের অক্ষমতাকে উপহাস করো প্রাণভরে ।
আমরা যারা অক্ষম, দুর্বল, শক্তিহীন, শুধু চোখের পানি ফেলা ছাড়া তোমাদের জন্য আর কিছুই করতে পারিনি, আমরা ভাববো তোমরা ৪৪ জন টগবগে প্রাণ ৪৪টা প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছো এই দেশের পথে-প্রান্তরে । আর ফুলের সুগন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছো এক বাগান থেকে আর এক বাগানে । আমরা অক্ষম, দুর্বলরা শুধু এটুকুই মনেপ্রাণে চাইতে পারি তোমাদের আত্মা যেন অনেক শান্তিতে থাকে । আর কাউকে যেন তোমাদের মত এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে না হয় ।
তোমাদের জন্য অনেক ভালোবাসা । আমাদের সবটুকু ভালো থাকা নিয়ে তোমরা যেন আকাশের উজ্জ্বল তারকা হয়ে বেঁচে থাকো মহাকালের শেষ দিন পর্যন্ত ।
জুয়েল দেব
মন্তব্য
..................
দুঃখে কান্না পেয়ে গেল............
নতুন মন্তব্য করুন