পথ-শিশুদের জন্য ভালোবাসা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২২/০৭/২০১১ - ৩:৪২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(একটি মানবতা মূলক পোস্ট)

আম বোঝাই করে ব্যস্ত রাস্তা ধরে ছুটছে দুটি পিকআপ। একটির যাত্রীরা বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে উড়ে যাচ্ছে, আরেকটি পিকআপের অদম্য তরুণেরা রোদের তাপে ঘেমে-নেয়ে একাকার। একটি পিকআপ চলছে চট্টগ্রামের পথে, অন্যটি ঢাকার রোদজ্বলা রাস্তায়। উদ্দেশ্য একটাই—পথশিশুদের আম খাওয়ানো। যে তরুণেরা একই পিকআপে যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই কিন্তু একে অপরকে আগে থেকে চেনেন না। সবাই একটা ফেসবুক গ্রুপের সঙ্গে জড়িত। গ্রুপটির নাম ‘আমরা খাঁটি গরিব...’। সূত্র

ক্রমাগত দুঃসংবাদের সমারোহে অনেক দিন পর পত্রিকায় ব্যতিক্রমী একটি মহৎ উদ্যোগ দেখলাম। আরও এক বার প্রমাণিত হলও আমাদের ভিতর মানবতা-বোধ কিছুটা হলেও এখনও অবশিষ্ট আছে।

পথ-শিশুরা আমাদের সমাজেরই অংশ, আমাদের মতোই মানব সন্তান। ক্ষেত্র বিশেষে কখনও বা আমাদের ঘৃণার পাত্র, কখনও বা বিরক্তির। এই পথ-শিশুরাই যখন পথে ঘাটে রেল স্টেশনে নাছোড় বান্দার মতো ভিক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে অথবা ক্যান্ডি অথবা ফুল কেনার জন্য চাপাচাপি করে (ঢাবি ক্যাম্পাসের অতি পরিচিত দৃশ্য) তখন এরা হয় বিরক্তির কারণ, যখন চলন্ত ট্রেন একটু ধীরে চলার সময় ইট/কাদা ছুড়ে মারে তখন এরা হয় ঘৃণার বস্তু। আমরা পথে ঘাটে নোংরা পথ-শিশু/টোকাইদের দেখলে সহজেই নাক সিটকাই। একবারও কি ভাবি আমরা এদের এই অবস্থার জন্য জন্মগত ভাবে কি এরা নিজেরা দায়ী, নাকি এদের বাবা-মায়েরা?

এই পথ-শিশুরা নিষ্পাপ, তাদের মাঝে কোনও সাম্প্রদায়িকতার বোধ নেই, তাদের মাঝে কোনও রাজনীতি-বোধও নেই। তারা হিন্দু মুসলিমের মাঝে বিভেদ করতে জানে না, জানে না ওরা আওয়ামীলীগ বিএনপি। তাদের মাঝে একটি বোধই বিদ্যমান তা হলও নিষ্ঠুর জীবনের বেঁচে থাকার সহজাত প্রবৃত্তি। আমরা নিষ্ঠুর মানুষেরা তাদের সেই সহজাত প্রবৃত্তিকেও অনেক সময় ক্ষমা করি না। তাই সুযোগ পেলে আমরা দু'ঘা দিয়ে আমাদের মনুষ্যত্ব-বোধ ঝালিয়ে নিতেও ছাড়ি না, আমাদের দরদ উপচে পড়ে যার খাদ্য চুরি হয়েছে তার জন্য, যে টোকাই একমাত্র বেঁচে থাকার সহজাত প্রবৃত্তিতে খাবার চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পরে মার খায়, তার জন্য আমাদের কোনও করুণা নেই।

রেলস্টেশনে আমরা ভারী সুটকেস যখন শিশু কুলিদের দিয়ে বহন করিয়ে নিজেরা অতি ভদ্রলোকের মতো জমিদারী ভঙ্গিমায় হেঁটে আসি, তখনও আমরা মানুষ। হোক না লাগেজ বহনে কুলিদের মজুরি নির্ধারণ করা আছে, তারপরও যখন ১০-১৫ বছরের একটি শিশু ২৫ কেজির একটি সুটকেস প্লাটফর্মের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় প্রাণপণে টেনে আনে, তখনও টলে না আমাদের মন। ৫ টাকা বেশি চাইলে আমরা অশ্লীল একটা গালি দিয়ে খুব বীরপুরুষ হয়ে যাই, অথচ ওয়েলকাম টোন রেখে মাসে মাসে ফী দিতে আমাদের বাধে না। একটা শিশু একটা ভারী সুটকেস টেনে নিয়ে যাবার সময় আমরা তো পারি, তাকে একটু সাহায্য করতে, মজুরি একটু বাড়িয়ে দিলে আমাদের এমন কোনও ক্ষতি হয়ে যাবে না। কিন্তু আমরা তা করি না। (বৃহৎ অর্থে)

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে এই সব পথ-শিশুদের ভিক্ষুক হতে অথবা ফেরিওয়ালা হতে বরাবরই উৎসাহিত করে এসেছে তাদের বাবা-মা। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় ৩ বছরের বাচ্চাটা ক্যান্ডি বিক্রির সময় তার ভিখারি মাতা দূর থেকে লক্ষ্য করছে। সেই ভিখারি মাতাও অসহায়, শিশুপুত্রকে শ্রমে না লাগিয়ে তারও উপায় নেই, কারণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা হয়ে তাকে তার শিশুকে শ্রমে লাগানো ছাড়া আর উপায়ও নেই।

এই হলও তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ ও দেশের মানুষের প্রকৃতি, আমারদের বাংলাদেশ।

আমাদের দেশে দারিদ্র্য একটি ক্রনিক ব্যাধির মতো যা কখনই নিরাময় হবার নয়। যে যত বড় কথা বলুক আর যেকোনো সরকার যত বড় আশা দিক না কেন, দারিদ্র্য কে আমাদের দেশ থেকে চিরতরে দূর করা কখনই সম্ভব নয়। এই দেশে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে দারিদ্র্য, বেড়ে চলেছে ভাসমান নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যা। যাই হোক, আমার এই পোস্ট দেশের দারিদ্র্য সমস্যা নিয়ে লিখা নয়, তাই এই প্রসঙ্গ আপাতত এখানে আলোচনা করছি না।

আমরা কি পারি না এই পথ শিশুদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে? বৃহৎ পরিসরে না হোক, আমরা ব্যক্তিগত ভাবে তো তাদের প্রতি আমাদের একটু মমতা; একটু ভালবাসা প্রদর্শন করতে পারি। পথ-শিশুদের পুনর্বাসন ও শিক্ষাদানের মতো অতি জটিল বিষয়ে আমরা না হয় নাই গেলাম, যেহেতু এটা সরকারের দায়িত্ব (সরকার কিছু করতে পারলে অনেক আগেই করতো, এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি গোচর করাটা আমার দৃষ্টিতে অর্থহীন)। কমিটি করে কিছু করতে গেলেও বিষয়টা জটিল ও সময় সাপেক্ষ। সবচেয়ে ভাল হয়, যদি প্রত্যেকে আমরা ব্যক্তিগত ভাবে কিছু করার চেষ্টা করি। তেমন কঠিন কোনও কাজ নয়; মজুরির সাথে সামান্য বখশিশ দিলে আমাদের এমন কোনও ক্ষতি হবে না, পথে ঘাটে আইসক্রিম খাবার সময় টোকাই ভিক্ষুক আইসক্রিমের উচ্ছিষ্ট খেতে চাইলে তাকে আস্ত একটি আইসক্রিম কিনে দেয়া যায়, তার জন্য আপনাকে হাজী মোঃ মহসীন হতে হবে না, এমনি পারবেন। আমাদের পুরনো পোশাক পরিচ্ছদ আমরা পথ-শিশুদের দিয়ে দিতে পারি, প্রতি বছর আমরা শীতের সময় গরম কাপড় কিনি, পুরনো গুলো আমরা ফেলে না দিয়ে অথবা ঘর মোছার ন্যাকড়া হিসেবে ব্যবহার না করে টোকাইদের দিতে পারি। খুবই সহজ কাজ। এরকম আরও অনেক কিছু আমরা চাইলেই করতে পারি। আমাদের একটু মমতা; একটু ভালবাসা এই অসহায় পথ-শিশুদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। নিষ্পাপ শিশুদের মুখের নির্মল হাসির চেয়ে মধুর এই পৃথিবীতে আর কি হতে পারে! আমরা কি পারি না ক্ষণিকের জন্য এই নিষ্ঠুর জগত সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা হলেও পালটে দিতে?
পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

-অ্যালবেট্রস

ছবি: 
02/06/2007 - 3:11pm

মন্তব্য

The Reader এর ছবি

আমরা পারি অনেক কিছুই , কিন্তু আসলে করি না । যখন দেখি ছোট্ট একটা শিশু বিশাল ভারী সুটকেস নিয়ে টলতে টলতে এগিয়ে যায় আর শক্ত সমর্থ সুটকেস এর মালিক আরামে হেলতে দুলতে আগায় , তখন লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে । একটু মানবতা খুব প্রয়োজন , মানুষ মানুষের জন্য কথা টা ভুলে গেলে চলবে না ।

পোস্ট টির লেখক কে সাধুবাদ জানাই ।

মৌনকুহর. এর ছবি

মন খারাপ
এই লেখাটা ঝুলিয়ে দিয়ে গেলাম।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ছোট ছোট মহৎ চেষ্টাগুলিকে যদি একটু সুনজরে দেখা হয়, তাহলে অনেক বড় অর্জনও সহজ হয়ে যায়।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ফারুক হাসান এর ছবি

চলুক

আমরা নিজেরা যদি একে একে বদলে যাই, যদি দায়িত্ব নেই একটি শিশুর ভবিষ্যতের তাহলেও কিন্তু অনেক করা যায়। আসুন, প্রতিজ্ঞা করি, আমি নিজে কখনো কোনো শিশুকে শ্রমে খাটাবো না। যদি একেবারেই কোনো সামর্থ্য না থাকে, তবু মুখের হাসিটুকু যেনো বরাদ্দ থাকে গরীব শিশুগুলির জন্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।