আজকাল খুব বেশী মনে পড়ে সেই শিমুল তুলা গাছটার কথা। এখনও কি আছে সেই গাছটা? সেই ছোট্ট বেলায় তার সাথে হয়েছিল পরিচয়। টিলার গায়ে ঘেঁষে ঘেঁষে যখন ঘুড়ি ওড়াতাম কি বিস্ময় নিয়ে দেখে থাকতাম ওই বিশাল মহিরুহটার দিকে। এত প্রকান্ড হতে পারে একটা গাছ! ওর শেকড়গুলো এত উঁচু কেন? আচ্ছা ওই শেকড়ের ফাঁকে কি বড় বড় অজগরের বাসা? কত প্রশ্ন আর আর কত বিম্ময় যে লুকিয়ে থাকত গাছটাকে ঘিরে, বলে শেষ করা যাবেনা। গাছটা আমাদের স্কুল থেকেও দেখা যেত খুব ভাল। আনমনে প্রতিদিনই মন চলে যেত গাছটার কাছে ক্লাসের ফাঁকে। দুপুরের খাঁ খাঁ রোদে হাতে ঝান্ডা নিয়ে যতবারই যেতাম কেটে আসা কোন ঘুড়ি নিজের করে নিতে, ততবারই থমকে গিয়েছি গাছটার নিচে এসে। অজানা শংকায় একটু ভেবে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ভোঁ দৌড়!
কদিন আগে মাহমুদ যখন ফেসবুকে ট্যাগ করে দিল আমার ছোট্টবেলার সেই গাছটার একটা ছবি নিজেকে বড় বেশী স্বার্থপর মনে হল। বরিশালের একটা ছেলে যে কিনা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, মনে রাখল গাছটাকে। আর আমি? পারিনি রহস্যঘেরা অথচ প্রিয় গাছটাকে মনে রাখতে বহু বছর। তাহলে কি মাহমুদই গাছটাকে আমার চেয়ে বেশী ভালবেসেছিল? আমি খুব কনফিউজড এখন।
রেলওয়ে কলোনিতে বাসা ছিল আমাদের ঠিক পাহাড়ের গা ঘেঁষে। একদিন এক যোগী বলেছিল, যদি অস্থির বোধ কর তাহলে চোখ বন্ধ করে প্রিয় কোন স্থানে মনকে বিচরন করালে দেখবে স্থির হয়ে যাবে। সেদিন থেকে মনে প্রিয় জায়গাটা যে আমার ছোট্ট বেলার সেই পাহাড়। তাহলে আমি বাস্তবে যাইনা কেন সেই পাহাড়তলীর পাহাড় দেখতে গত একটা যুগ? তাহলে কি সেই পাহাড়টা আমার প্রিয় কোন জায়গা না? এখানেও আমার কনফিউশন।
বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। জস্ম আমার উত্তরবঙ্গে। সেই সৈয়দপুর। ছ’বছর বয়স পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। বড় হয়েছি চট্রগ্রামে আর আমার দাদা-নানার বাড়ি কুমিল্লা। বড় হয়ে চুপিসারে চলে গিয়েছিলাম একবার সৈয়দপুর। খুব ভাল করে দেখে এসেছিলাম সেই গির্জা, যাদের মিশনারী স্কুলে হয়েছিল আমার হাতেখড়ি। দেখে এসেছি আমার জন্মের সেই আঁতুর ঘর সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতাল আর আমাদের সেই রেলওয়ে কোয়াটার। জীবনের প্রথম ছ’বছরের স্মৃতি আমাকে সব চিনিয়ে দিয়েছিল, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়নি। তাহলে কি আমার ভালবাসাই আমাকে সব চিনিয়ে দিয়েছিল?
দাদার বাড়িতে মানে আমার বাবার পৈত্রিক বাড়িতে বাবার জমি-জমা মনে হয ভালই আছে। আমাদের বাসার সবাই জানে কোনগুলো আমাদের বাবার জমি, আমার কিন্তু কখনই খবর নিতে মন চায়নি। সেই গ্রামের মানুষগুলো আমাকে বিদেশীই ভাবে, অন্তত কথা বললে বুঝতে পারি। তাহলে কি আমি আমার পিতৃ গ্রামকে ধারন করিনা?
আর চট্টগ্রাম? আমি তো তোমাকে অনেক ভালবাসি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলো যে তোমারে করেছি দান। তবুও তুমি আপন করে নাও নি শুধুমাত্র আমার পিতৃ গ্রাম এখানে নয় বলে।
তাইতো আমার বাড়ি কখনও বলি কুমিল্লা আবার কখনও বলি চট্টগ্রাম। আসলে কোথায় আমার বাড়ি? আমি কোথাকার ছেলে?
ছেলেবেলায় অঙ্কে খুব কাঁচা ছিলাম। বাসার সব মাষ্টারই যখন ফেল মারল অঙ্কে পাশ করাতে, আবদার করলাম ব্যাচে পড়ব ওয়াদুদ স্যারের কাছে। ওয়াদুদ স্যারের বাসাটা ছিল রেললাইনের পাশে। সকাল সাড়ে আটটায় চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনটা যখন যেত হেলতে দুলতে, চেয়ে থাকতাম কি অপার বিস্ময়ে! কি স্বাধীন এখানকার সব প্যাসেঞ্জার! ছেলে আর মেয়ে ট্রেনের সিঁড়িতে একসাথে বসে কত হই-হুল্লুড় আর গান বাজনা করতে করতে যায়! কত স্বাধীন ওরা! ক্লাস এইটেই প্রেমে পড়ি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। পড়েছিলামও সেখানে। প্রেমও চলেছিল এ বিদ্যায়তনের সাথে বেশ কয়েকটা বছর। ভ্রমটা ভেঙ্গে গেল সহসা। আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এর যে দুরত্ব বাড়ছিল দিন দিন। বিষ মাখা মন উঠে গেল এখান থেকে। তাও অনার্স পাশ করলাম কোনমতে। এনথ্রোপলজির প্রতি একটু ভালবাসা ছিল অবশিষ্ট তাই হয়ত সম্ভব হয়েছিল।
তারপর ভাগ্যদেবতা নিযে এসেছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে। এখানেও বরন হয়েছিলাম গভীরতর বন্ধুত্বে। কখন যে অনেক বেশী আপন হয়ে গিয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয় নিজের অজান্তেই, বুঝতে পারিনি। অনেক বড় ফ্রেন্ড সার্কেল কখনও ভাবতেই দেয়নি আমি এখানে নতুন। ধীরে ভূলে যাই আমার পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়। হয়ে উঠি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দুটো ডিগ্রী হয়ে যায় এখান থেকে কালের পরিক্রমায়। আগের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক বেশী সময় কেটে যায এখানে। কিন্তু আবার যে আমার পুরোনো সন্ধি মাথা চারা দিয়ে উঠেছে! শ্রেয়তর হিসাবের মানদন্ডে ভূলে যাওয়া অতীত কড়া নাড়ে মনে। সত্যিই কি তুমি আমায় ভালবাসনা। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম আমি? এখানেও আমার কসফিউশন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে চাকরি করছিলাম বেশ ভালই। বেশ বেশ কয়েকটা জাম্পিং করে বেশ ভাল মাইনের চাকরি জোগার করে ভালইতো কাটছিল। ভাল মানে মাইনেটা ভাল, কিন্তু সুখটাতো ছিলনা মনে। হতে তো চেয়েছিলাম কবি। কলমের ডানায় ভর দিয়ে রং ছিটাবো বলে! হতে তো চেয়েছিলাম ভবঘুরে! পারিনি, হয়েছিলাম এনজিওর কর্মকর্তা। মিটিং, সিটিং আর ইটিং। পারলাম না। দিলাম ছেড়ে একদিন। কাটল সুখে বেশ কয়েকটা মাস। তারপর অভাব এল আর ভালবাসা জানালা দিয়ে পালাল। না হলাম বাউল, না হলাম কবি, না হলাম ভবঘুরে, না হলাম চাকুরে। বন্ধুরা বলে কি তোর পরিচয় এখন? আমি বলি, আইডেনটিটি ক্রাইসিস।
এই গল্পটা লুব্ধকের। নিজেকেই নিজে মনে করিয়ে দেয় নিজের গল্পটা।
পৃথিবীতে কেউ কেউ আছে যারা নিজেদের পরিচয় দিতে পারেনা, ভাবতে থাকে লুব্ধক।
হয়ত অস্থির এই সময়টায় আইডেনটিটি ক্রাইসিস কোন মানুষের একক কোন সমস্যা নয় এখন আর, নিজেকে নিজে বলতে থাকে সে।
ভাবে, এটা হতে পারে সমাজ আর তার গতিশীলতায় প্ররিপ্রেক্ষিতে ভিন্নতর।
হয়ত এমন পৃথিবী একদিন হবে যেখানে আইডেনটিটি নিয়ে কেউ ভাববেই না। এমন পৃথিবীর কথা ভাবতে ভাবতে সকালের আলো ফোটা দেখতে থাকে লুব্ধক।
লেখকের নাম Saif Jewel
মন্তব্য
ঠিক একি সমস্যার সাথে আমিও দিনাতিপাত করি।দাদা-নানার বাড়ী ফেনীতে।চোখেও দেখিনি কখনো সে বাড়ী। আমার জন্ম,বেড়ে ওঠা সবই চট্টগ্রামে।শেকড়ের পুরোটাই সেখানে প্রোথিত। তবুও সেখানকার মানুষগুলোর কাছে আমি বহিরাগত।অন্যজেলার মানুষ।সাইফ ভাই বোধহয় ‘বইঙ্গা’ কথাটার সাথে পরিচিত?????এখন আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।অবস্থাটা এমন যে ঢাকায় থাকলে আমার বাড়ী চট্টগ্রামে। আর চট্টগ্রামে থাকলে ফেনীতে।নতুন করে গড়ে উঠতে থাকা আন্ঞ্চলিকতার অন্যরকম একটা রুপ....
অবস্থাটা এমন যে ঢাকায় থাকলে আমার বাড়ী চট্টগ্রামে। আর চট্টগ্রামে থাকলে ফেনীতে।নতুন করে গড়ে উঠতে থাকা আন্ঞ্চলিকতার অন্যরকম একটা রুপ....
এই রকম একটা কথা লিখার ইচ্ছা করছিল। কিন্তু তখন মনে আসেনি। আনেক ধন্যবাদ অরুপ।
অনেক ভাল লাগল আপনার লেখাটা। পড়তে পড়তে কয়েক জায়গায় নিজের কথা মনে হচ্ছিল। কেউ যখন প্রশ্ন করে বাড়ি কোথায় তখন দাদা বাড়ির কথা বলি কিন্তু জানি আমি ঐ জায়গায় অনেকটা বিদেশী। আবার বড় হওয়া হয় নি নির্দিষ্ট কোন শহরে। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে প্রায় বছর আমাদের শহর বদলে যেত। ছয় সাতবার স্কুল বদলাবার পর হোস্টেলে চলে যাওয়ায় আর স্কুল সংখ্যা হয়ত বাড়ে নি নাইলে দশ ছাড়িয়ে যেত নিশ্চিত। আবার নতুন স্কুলে গেলে ঐ নতুন মুখ, চুপ থাকার অভ্যাস আর স্থানীয় ভাষায় অদক্ষতা সব মিলিয়ে নিশ্চিত বন্ধু সংখ্যা থাকত সীমিত। যখন হয়ত একটু খাপ খাইয়ে উঠতাম ঠিক তখন আবার নতুন স্কুল, নতুন শহর। কিছুদিন আগে তাসনীম ভাইয়ের স্মৃতির শহর পড়তে গিয়ে খেয়াল করলাম আমার কোন স্মৃতির শহর নেই। চিন্তা করতে গেলে আমার স্মৃতির শহরে রাস্তা আসে এক শহরের, স্কুল আরেক শহরের কিংবা খেলার মাঠটা ভিন্ন আরেক শহরের।
অনেক কথা বলা হয়ে গেল। ভাল থাকবেন আর বেশি বেশি লিখবেন। পাঠক হিসেবে অপেক্ষায় থাকলাম
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
নিবিড় আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি লেখালেখির লাইনে নতুন। এখন অন্যেকোন কাম নাই তাই লিখি। তবে লিখার চেষ্টা করব আরো।
জুয়েল, লেখাটা পড়তে শুরু করে পাহাড়তলীর কথা আসতেই মনে হলো এটা জুয়েল নয়তো? তাড়াতাড়ি নিচে যেয়ে দেখি তাই। আমি অসম্ভব খুশী আপনি আপনার লেখার মনোযোগ অন্য দিকে দিয়েছেন দেখে, খুবই খুশী, দাঁত বের করে হাসতেছি। সচলে আপনি নতুন, অনেক গর্ব নিয়ে বলতে ইচ্ছে করতেছে যে এই লেখার লেখকের অনেক অবুঝ দোষ কিন্ত মানুষ হিসেবে তার বোধের জায়গাটা অসাধারন এবং আমরা বন্ধু .....কনসালটেন্সি নামক একটা চরম চামবাজী করতেছেন এখন এইটা বললেননা
আইডেন্টিটি কখনো ক্রাইসিস তৈরী করেনা, ক্রাইসিস তৈরী করে পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের মানসিক দৃঢ়তা এবং সক্ষমতা!
তানিম ভাই, বলছিতো। ওই যে বললাম, "তারপর অভাব এল আর ভালবাসা জানালা দিয়ে পালাল"। আপনার ভাললাগা আমার জন্য অনেক আনন্দের।
ট্যাগে মনস্তত্ব দেখে আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। গল্পের মূল বিষয়বস্তু কি আইডেন্টিটি ক্রাইসিস? তাহলে বলবো লেখায় বিষয়টি তেমন সবলভাবে উঠে আসেনি। অন্তত আমি একটু হতাশ হয়েছি। সম্ভবত গল্পের নামই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস দেখে একটু বেশি আশা করেছিলাম। যাইহোক, এমনিতে ভালো লেগেছে। লেখালেখি চলতে থাকুক।
বইখাতা, আমি এই লাইনে নতুন। যা ভাবে আসে তাই লিখি। তবে হ্যাঁ আরো অনেক লিখব।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নজরুল ভাই, অনেক ধন্যবাদ।
লেখার থিমটাই কেমন ঘোর লাগিয়ে দিল।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
অনেক ধন্যবাদ। মন্তব্যটা খুবই ভাল লাগল। অনুপ্রেরনা বোধ করলাম।
সব নদী বেচে থাকে বয়ে যাওয়ার নামে, আমরা মরে যাওয়ার স্বাদ দিয়ে বেচে থাকা খুজে ফিরি..... মনে নেই কত আগে হারিয়েছি বহতা....
কিছুই হতে পারিনি বেঁচে থাকার শ্রমিক ছাড়া।
অনেক ধন্যবাদ। যাক তার পরেও তো আ্ইডেনটিটি ঠিক করতে পারছেন।
খুব গুছিয়ে, খুব সুন্দর করে লিখেছেন।
অনেক ধন্যবাদ দিহান।
অনেক ধন্যবাদ
আপনার ভিতরের বিষাদটা আমাকে ও ছুঁয়ে গেলো সাইফ। সচলে আপনার যাত্রা শুভ হোক।
লিখতে চাই আরো অনেক।
অনেক ধন্যবাদ
অনেক ধন্যবাদ
আমাদের যাদের বাবারা বদলীর চাকুরী করতেন, তাদের সবার গল্পই বুঝি এরকম।
সাইফ, আপনার লেখার হাত চমৎকার। প্রশংসা না করে পারছি না। নিয়মিত লিখুন। ভালো থাকবেন।
ধন্যবাদ ফারুক ভাই। চেষ্টা করব লিখতে।
লেখার ধরন ভাল্লাগসে।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ
নতুন মন্তব্য করুন