অন্য জগত

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ৩০/০৭/২০১১ - ২:১৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মেডিকেল সেন্টারের দোতলার বারান্দার কোনাটায় রকের মত জায়গাটাতে বসলেই অনেক দুর পর্যন্ত দেখা যায়। অবশ্য বড় সীমানা প্রাচীরটার কারনে খুব কাছাকাছি কোন কিছু দেখতে পাওয়া না গেলেও দুরের আকাশটা আর ওখানে উড়তে থাকা পাখিদের দেখতে কিন্তু বেশ ভালোই লাগে লুব্ধকের। বেশ দুরে কয়েকটা চার-পাঁচ তলা বিল্ডিং থাকলেও এগুলোর ছাদে কখনই কেউ ওঠেনা বিকেলে। মাঝে মাঝে ভাবতে ভালো লাগে, যদি কোন পরী দাঁড়ায় একটা ছাদে আর ডাক দিয়ে বলে আসো! যদি পাখা থাকত থাহলে তাহলে রোজ ওই আকাশে পাখিদের সাথে চলে যেত অজানা দেশে লুব্ধক। কখনওবা রঙ্গিন ঘুড়িদের সাথে মেতে উঠত খেলায়।

লুব্ধক এখানে এসেছে কয়েক মাস হলো। প্রথম প্রথম একেকটা দিন মনে হতো একেকটা বছর। প্রথম পনের দিনই কষ্ট হয়েছে খুব, এখন আর হয়না। কবে যে সাতটা মাস চলে গেল! বাব্বা! সাত মাস! নিজেই চমকে ওঠে লুব্ধক। বাড়িতে ঘুম ছাড়া একটা ঘন্টাও থাকা হতোনা। একটা দিন ক্যাম্পসে না গেলে মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়া লুব্ধক এখানে আছে সাত মাস!

জায়গাটা এখন একটু একটু করে অনেক আপন হয়ে গেছে। বন্ধু-বান্ধবও জুটে গেছে বেশ। লুব্ধকের কদরটাও ভাল এখানকার বন্ধুমহলে। লেখাপড়া জানে বলে, মানুষজন একটু আধটু ইজ্জত সম্মানও করে। সবাই একটু অন্য চোখেই দেখে। লুব্ধক অবশ্য খুব আন্তরিকতার সাথেই মিশতে চেষ্টা করে সবার সাথে। তাও কোথায় যেন একটা ফাঁক?

এখনে একটা লাইব্রেরী আছে। বইপত্র খুব একটা নেই। তাও যা আছে তাই পড়ে লুব্ধক। মামুন প্রথম বলেছিল লাইব্রেরীটার কথা। জাহাঙ্গীর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল লাইব্রেরীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাটের সাথে। লোকটার সাজা হয়েছে ২৬ বছরের। সবগুলো বই আনেকবার করে পড়া লোকটার। খাতির জমানোর চেষ্টা করেছিল লুব্ধক। লোকটা কথা খুবই কম বলে। লাভ হয়নি। তবে বই নিতে কখনও বাধা দেয়নি কখনও। একটা রেজিষ্ট্রার খাতা এগিয়ে দেয়। হাজতী কার্ড দেখে নাম, তারিখ আর হাজতী নম্বর লিখতে হয়। বিকেলের লকআপ খুললে পরে লুব্ধক যায় ওখানে বই আনতে। এখানে রাতে বাতি নেভেনা তাই অনেক রাত পর্যন্ত পড়লেও ঝামেলা নেই।
সাধারন ওয়ার্ডে সকালে ৭টা থেকে ৮টা আর বিকেলে ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত লকআপ খোলা থাকে। ওই সময়টা খুব মজার। সবাই প্রতিক্ষায় থাকে ওই দুটো ঘন্টার। সব বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। বেশ ভাল একটা আড্ডা হয়। মাঝে মাঝে অন্যদের ওয়ার্ডে যাওয়া হয়। কারো বাড়ি থেকে দেখা আসলে তো কথাই নেই। পার্টি হবে মাস্ট। বাড়ী থেকে কেউ দেখতে আসলে সিগারেট দিতে হবে অবশ্যই। এখানকার বিনিময় মাধ্যম সিগারেট, টাকা না। যার বাড়ী থেকে যত বেশী দেখতে আসে তার কদর তত বেশী। সবার বাড়ী থেকে তো আর দেখতে আসেনা। যত দিন যেতে থাকে ততই ভূলে যেতে থাকে বাড়ির মানুষগুলো। লুব্ধকেরও প্রথমদিকে দেখা আসত সপ্তাহে দুই-তিন বার। তারপর আসত সপ্তাহে একবার আর এখন মাসে একবার। তাও মা ছাড়া কেউ আসেনা। কিযে মলিন লাগে মাকে? কি যে কষ্ট লাগে তখন লুব্ধকের বলে বোঝান যাবেনা। ওর মা চৈত্রের খড়রোদে দাঁড়িয়ে থাকে হাজার মানুষের ভীড়ে উনুনের মত তপ্ত দেখা করার ঘরটার পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা। তারপর দেখা হয়। এপাশে লব্ধক আর ওপাশে মা। ফেল ফেল করে চেয়ে থাকে অপলক দুজন দুজনার দিকে, কথা হয়না তেমন। মা শুধু সান্তনা দেন, ‘চিন্তা করিসনা বাবা, ভালো উকিল ধরছি এইবার, জামিন, পেয়ে যাবি’। একটা চিন্তা দুঃস্বপ্নের মত মনে উঁকি মারে, আচ্ছা মার তো হাই ব্লাডপ্রেসার! ‘মা, তুমি আর কষ্ট করে এসো না’ বলে লুব্ধক। মা কাঁদে, লুব্ধকও কাঁদে।
লুব্ধক জানে, মা আবার আসবে। বারবার মা’ই আসবে। তাছাড়া কেউতো আর আসেনা। মা বিস্কুট, মুড়ি, চানাচুর আর সিগারেট দিয়ে যায় সারা মাসের। এখানে রুটি দেয়া হয়, সেটা মুখে নেয়া যায় না। একবেলা ভাত। রাতে। সাথে কোন দিন এক টুকরা ভাজা মাছ অথবা মাংস। পঁচা মাছ, তাই ভাজা। আর মাংস, সেতো ছেড়ার কায়দা নেই। তাই নিয়েই কতনা কাড়াকাড়ি! কেউ কেউ কম খেয়ে ভাতে পানি দিয়ে রেখে দেয় সকালে খাবে বলে। সকালের নাস্তা হলো ভুষির রুটি আর পাতলা ডাল, মুখেই যে তোলা যায়না! দুপুরের খাবার? দুটো ভুষির রুটি আর জঘন্য সবজি। লুব্ধক এই সাত মাসেও এই স্পেশাল ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চে অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি। তারপরও মানুষ খাচ্ছে। ‘এখানে যারা থাকে তারা তো মানুষ না!’ ভাবে লুব্ধক।

একটা ওয়ার্ডে একটা পায়খানা। প্রথম ক’দিন তো ওটা দেখে ঈশ্বর দয়াবশত লুব্ধককে বড় চাপ থেকে মুক্ত রেখেছিলেন। আর ছোটটা? চোখ-মুখ বন্ধ করে সারা হতো। আর কয়দিন খিঁচে থাকা যায়? শেষে সয়ে গেছে।
আর গোসল সেটা সবার ভাগ্যে জোটেনা এখানে। মাসে ৫ প্যাকেট গোল্ড লিফ সিগারেট দিতে হয় জলকলের ম্যাটকে। সবার কি আর সে ভাগ্য হয়। লুব্ধক প্রত্যেকবার বেশী করে সিগারেট আনতে বলে মাকে। মা’ও জানেন এখানে সিগারেটের কি কদর! সিগারেট থাকলে এখানে সাত খুন মাফ। নগদ টাকা দিলেও হয়। কিন্তু একশ টাকা ঢোকাতে একশ ঘুষ দিতে হয়। তাছাড়া ধরা পড়লেও তো সাজা অনেক কঠিন। পরদিন সকালে কেস ফাইলে নিয়ে সোজা পড়িয়ে দেবে ডান্ডাবেড়ী। এখানকার সাজা বড় কঠিন। প্রত্যেকদিন সকালে কেইস ফাইল বসে। জেলার হন বিচারপতি আর সুবেদার কেস উত্থাপন করে। ছোট খাট অপরাধ করলেই কয়েকশ ঘা অথবা অনিদ্দিষ্ট কালের জন্য ডান্ডাবেড়ী। প্রথম প্রথম এসব লুব্ধককে খুব ইমোশনাল করে তুলতো। এখন অনুভূতি ধীরে ধীরে ভোতা হয়ে যাচ্ছে।

তবে সবসময় কি আর পাথর হয়ে থাকা যায়? সেদিন ভীষম ঘোরের জ্বরে যেতে হয়েছিল জেলখানার মেডিকেল সেন্টারে। ম্যাটকে দুই প্যাকেট করে সিগারেট দিতে হয়েছে প্রতিরাতের জন্য বেডে থাকতে। এখানে থাকেন সব মেম সাহেবের পাছা মালিশ করে ধনী সৌখিন হাজতী, যারা আসেন জেলখানায় বেড়াতে। টাকা দিলে এখানে বাঘের চোখ মেলে। এদের টাকা লেনদেনও হয় প্রকাশ্যে। এদের বিলাস দেখে জ্বরের ঘোর ছুটে গিয়েছিল লুব্ধকের। কি মহান বিলাসী জীবন এদের! প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কাজ করার জন্য ফালতু আছে এদের। ফালতু কথাটার মানে যে কাজের ছেলে এটা লুব্ধক জেনেছে জেলে এসে। এখানে হোমরা চোমরারা ফালতু রাখে। এইসব ফালতুরা দরিদ্র পরিবারের ছেলে। অনেক দিন ধরে জেলে আছে, কেউ নেই জামিন করানোর। এরা এখানে একটু ভাল থাকার আশায় ফালতু হয়। জেল মেডিকেল সেন্টারে ফালতু ছাড়াও থাকে গরু। গরু যে মানূষ হতে পারে তাও লুব্ধক জেনেছে জেলখানায় এসে। এই গরুরা হলো, টাকাওয়ালা হাজতী যাদের ্আবার মেম সাহেবের পাওয়ার নেই। এরা ভাল থাকার জন্য এখানে একেবারে অস্ট্রেলিয়ান কাউ হয়ে যায়। অনেক দাম এদের। জেলখানার সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা পন্য এরা। লুব্ধক খেয়াল করে দেখেছে, গরুদের বেশীরভাগই আবার নারী নির্যাতন মামলার আসামী।

দুই রাত মেডিকেলে লুব্ধক একটা ফোটাও ঘুমাতে পারেনি। কি করে ঘুমাবে? খাটে শুয়ে আছেন নেতারা আর গরুরা। আর খাটের নীচে রোগীরা। এইসব রোগীদের আবার যন্ত্রনায় কাতরানো মানা। তাহলে যে সাহেবদের ডিস্টার্ব হবে! এতকিছুর পরও পাথর হয়েই ছিল লুব্ধক। কিন্তু মাথাটা বিগড়ে গেল যখন দেখল ওই হারামজাদা ম্যাট শিশু ওয়ার্ড থেকে চিকিৎসা করতে আসা একটা ১২/১৩ বছরের বাচ্চা ছেলেকে প্রকাশ্যে বলাৎকার করছে। সবাই শুয়ে শুয়ে না দেখার ভান করছে। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল লুব্ধক, ‘ঈশ্বর আমায় শক্তি দাও’, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পাষন্ডটার উপর। তারপর কি হয়েছিল খেয়াল নেই। যখন বোধ এসেছে তখন দেখেছে পাষন্ডটা রক্তার্ত হয়ে পড়ে আছে।

তারপর থেকে লুব্ধক এখন একাকী একটা নির্জন সেলে। এই সেলটাকে বলে টিবি সেল। আগে যক্ষারোগী হাজতীদের সব হাজতী থেকে আলাদা করে রাখা হতো এই সেলে। এখন এখানেই সবার থেকে আলাদা লুব্ধক। হয়ত আর কখনও ছাড়া পাবেনা এই নির্জন সেল থেকে। এযে জেলের ভেতর জেল। জেল মার্ডারের শাস্থি যে বড় ভয়ঙ্কর।

লেখেকর নাম Saif Jewel


মন্তব্য

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

মন খারাপ


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

শ্রীকৃষ্ণ এর ছবি

চলুক

মৌনকুহর এর ছবি

ফুটিয়ে তুলেছেন অনেক কিছুই। চলুক

কিন্তু একটা ব্যাপার। শেষে একাকী নির্জন সেলে গেছে জেল মার্ডারে। কিন্তু ও জেলে আসল কোন অপরাধে?

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।