এই গ্রীষ্মে - ক্যালগেরির পথে

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি
লিখেছেন ত্রিমাত্রিক কবি (তারিখ: শনি, ৩০/০৭/২০১১ - ১২:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কানাডায় সামারটা হুটহাট, আর তারচেয়েও হুটহাট করে শুরু করলাম আমি। উইন্টার টু সেশানের শেষ পরীক্ষা ছিল ছাব্বিশে এপ্রিল, আর আমার দেশে যাওয়ার টিকেটও ছিল ওইদিন রাতেই। পরীক্ষার আগে তাই পড়াশোনা গোছানোর চেয়ে ব্যাগ গোছানোর তারা ছিল বেশী, পরীক্ষা থেকে এসে গোসল করেই ছুটতে হবে এয়ারপোর্টে। তো যাই হোক দেশে যাওয়ার গল্প নাহয় অন্যদিন করা যাবে। দেশ থেকে ফিরে এসে কি করলাম আজকে নাহয় সেই গল্প করা যাক।

দেশ থেকে ফিরেই কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্যে মনটা উসখুস করতে লাগল। একদিকে সামার, প্রফেসরও তেমন চাপ দিচ্ছে না, আবার পরের সামারে হয়ত ডিফেন্স টিফেন্সের ঝামেলা থাকতে পারে, তাই এবারই কোথাও না কোথাও যেতেই হবে। ভ্রমণসঙ্গী মোটামুটি আগে থেকেই ঠিক করা, আমরা তিনজন হাউসমেট আর এখানকার এক রনি ভাই আর মনা আপু (ভাবী), তাহলে একটা পাঁচ সিটের কার ভাড়া নিলে খরচটাও অপটিমাইজড হবে।

যাওয়ার টিম তো ঠিক হয়ে গেছে কিন্তু যায়গা আর সময় ঠিক করা বেশ কঠিন হয়ে গেল। একদিকে ভাইয়ার ব্যাস্ততা আর অন্যদিকে হাজারটা যাওয়ার জায়গা। অনেক চিন্তা ভাবনা আর গবেষোণার পর সিদ্ধান্ত হল যাওয়া হবে ক্যালগ্যারি। জুলাই আট থেকে সতের পর্যন্ত ক্যালগেরিতে চলছিল স্টাম্পিড যেটাকে কিনা 'The Greatest Outdoor Show on Earth' ও বলা হয়। প্রতি বছর জুলাই মাসে ক্যালগ্যারিতে বসে এই মেলা। এই স্টাম্পিডেই হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় রোডিও শো, তাছাড়াও আছে আরো হাজার রকম স্টেজ শো, রাইড, আরো অনেক কিছু যেগুলো দেখার জন্যে একটা অর্ডিনারী উইকএন্ডকে একদিন ছুটি নিয়ে লং উইকএন্ড বানিয়ে ফেললাম। আমাদের যাত্রার থীম হল -'সময়ের সর্বচ্চ সদ্ব্যাবহার', তিনদিনের মধ্যে আমরা দেখে ফেলব, স্টাম্পিড আর কানাডিয়ান রকি পর্বতের বিস্ময়কর সৌন্দর্য!

তো থীমের সাথে মিল রাখার জন্যে আমরা রওনা হয়ে গেলাম শুক্রবার ভোর হবার বেশ আগে আগে, ভোর তিনটার দিকে, যাত্রা শুরু হল ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ছোট্ট শহর কেলোনা থেকে। প্রায় সাত আট ঘন্টার ভ্রমণ, পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যালগ্যারি গিয়েই চলে যাব স্টাম্পিডে, এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করা যাবে না। খাবার হিসেবে সাথে নেয়া হল পিয়াজু, চিপস, চকোলেট আর বিস্কুট। আমাদের একমাত্র ড্রাইভার হলেন রনি ভাই, আর আমাদের বাকি চারজনের দায়িত্ব হছে রনি রনি ভাইকে ঘুম থেকে কোনভাবে বাঁচিয়ে রাখা, আর রনি ভাইয়ের দায়িত্ব হল আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা।

DSC_4353
[সকালের আলো তখনো ঠিক ফোটেনি]

সকালের আলো কেবল ফুটছে। আমরা বসে আছি শেভ্রোলেট ইম্পালার এক্কেবারে ঝা-চকচকে একটা গাড়িতে। গাড়ি ছুটে চলছে হাইওয়ে ৯৭ দিয়ে। আমরা যাচ্ছি কিছুটা উত্তরের দিকে, ভার্নন নামের ছোট্ট একটা শহরের মধ্যে দিয়ে। আশে পাশে তাকালেই স্বর্গের মত অনুভূতি। রাস্তার পাশ দিয়ে একটু পরপরই গভীর নীল জলের হ্রদ, হ্রদের ওইপাশে পাহাড়, ভোড়ের সূর্য উঠছে, পাহাড়ের উপর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে হ্রদের গভীর নীল জল। কানাডার এই এলাকাটা খুব স্নিগ্ধ, শান্ত হ্রদ আর ছোট ছোট পাহাড়, মন ভালো না হয়ে উপায় নেই।

DSC_4365
[এরকম লেক পাওয়া যাবে কেলোনা আর ভার্ননের প্রায় পুরো রাস্তা জুড়েই]

হাতের ডানে পার করে গেলাম উড লেক, কালামালকা লেক আর বাম দিকে মারা লেক। হাইওয়ে ৯৭ দিয়ে ততক্ষণে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার পার করে এসেছি। শহর ছেড়ে তখন হাতের ডানে ট্রান্স-কানাডা হাইওয়েতে ওঠার পালা। ইম্পালার গতিবেগ বেড়ে গেল কিছুটা, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আশে পাশের পাহাড়গুলোর উচ্চতা, পাহাড়গুলোর এবার পর্বত হবার পালা। সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে আশেপাশের সৌন্দর্যের রূপরেখা। এতক্ষণের স্নিগ্ধ সৌন্দর্যকে এবার সরিয়ে দিচ্ছে রকি পর্বতের এডভেঞ্চারাস সৌন্দর্য। হাইওয়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আর ডান বামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছি। কোথাও পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসছে ঝর্না, কোথাও পাহাড়ের চূঁড়ায় বরফের আস্তরে সূর্যরশ্মি আছড়ে পড়ে তৈরী করেছে রংধনুর সাত রঙ, কোথাও পাহাড়ের মাঝে মাঝে পানি জমা হয়ে তৈরী করছে হ্রুদ। একসাথে কত কি দেখবো!

DSC_4450
[গাড়ি থামিয়ে এরকম একটা লেকের পাশে কিছুক্ষণ থামলে মন্দ লাগবে কি!]

গাড়ির ভেতরে প্রকৃতিবিলাসের সাথে সাথে চলছে ভোজনবিলাস। সাথে আনা পিঁয়াজু আর চিপস চলছে সমান তালে। সাথে আছে ডাল ভাজা। আর চলছে গানের সঙ্কট, গাড়িতে সিডি প্লেয়ার ছাড়া কিছু ছিল না, কিন্তু অডিও সিডি তো এখন কারো কাছে তেমন থাকে না, আসার সময় তাড়াহুড়া করে নিয়ে আসা দুইটা সিডি কেবল সম্বল। সেই সিডির গানের অবস্থাও বলার মত। বাংলাদেশের বাস ভ্রমণের কালেকশান বলা যায়। সেই সুবাদে অনেক আগের 'সাম যার্নি বাই বাস'এরও কিছু স্মৃতিচারণ হয়ে গেল। গানের অবস্থা যাই হোক ক্যামেরার শাটার কিন্তু থেমে নেই। শাটাশাট চলছে শাটার, অলরেডি মিস করতে শুরু করেছি দেশে ছোট ভাইয়ের কাছে রেখে আসা এসএলআরটাকে।

চলতে চলতে প্রায়ই থামতে হচ্ছে, রাস্তায়, নজরকাঁড়া ক্যানভাস বারবার টেনে ধরছে। এই একটা হ্রদ, বা ঝর্ণায় থামতে হচ্ছে, কোথাও আবার বিশাল পর্বতের পুরোটাই সবুজ পাইন গাছের ক্যানভাসে ঢাকা। রাস্তার খুব কাছেই কোথাও জমা হয়ে আছে মেঘ, কোথাও আবার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে পাহাড়ের চূঁড়া। রাস্তায় থামলেই পাশ দিয়ে সাই সাই করে ছুটে যাচ্ছে আমাদের মতই আরও অনেকে, আমরা এদিকে ক্যানভাসের সাথে নিজেদের মিশিয়ে ফেলছি, আর চলছে শাটার, ফিরে গিয়ে ফেসবুকে আপ্লোড করে মানুষকে হিংসিত করতে হবে না!

jawar-pothe
[পর্বত আর পাইন গাছের সমাহার]

এভাবে আরও প্রায় একশ কিলোমিটার পার করে আসি। ছুটে চলছি ট্রান্স-কানাডা হাইওয়ে ধরে। পেছনে ফেলে আসি রিভারসাইড ন্যাশনাল পার্ক, গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক। এই গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক হল বিসির সাতটা বিখ্যাত ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে একটা। এখানেই আছে রজার্স পাস ন্যাশনাল হিস্টোরিক সাইট। চারপাশে তাকালে চোখে পরে পাথড়ের পর্বত, মাঝে মাঝে ঝর্ণা, আর পাইন গাছের অবারিত প্রান্তর। এডভেঞ্চার প্রিয় মানুষরা এখানে আসে প্রায়ই হাইকিং, স্কিইং এর জন্যে। রাস্তার আশে পাশে ক্যাম্পিং এর সাইনও চোখে পরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এখানকার উচ্চতা প্রায় ১৩৩০ মিটার। এখানকার রাস্তাটা বেশ বিপদজনক বলে বদনাম আছে।

IMG_0394
[এরকম দৃশ্য মোটামুটি পুরোটা পথ জুড়ে]
IMG_0360
[এভাবেই পাহাড় কেটে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ক্যালগেরির পথে]

এভাবে চলতে চলতে বিসির সীমানা প্রায় পার হয়ে আসি। পার হয়ে আসি ইওহো ন্যাশনাল পার্ক। এখানে আছে ছোট্ট শহর 'ফিল্ড', আর একটা নদী নাম 'কিকিং হর্স রিভার'। নদীর নামকরণের কাহিনীটা বেশ মজার। জেমস হেক্টর নামের একজন অভিযাত্রী ১৮৫৮ সালে এই নদীটি যখন খুঁজতে যান, প্যাকহর্স নামের একধরণের ঘোড়া তাকে তাড়া করে, তবে কোনমতে প্রানে বেঁচে যান তিনি, আর ঘোড়াগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখেন চিরকালের জন্যে, নদীর নামের সাথে। এই পার্কটা আরেকটা কারণে বিখ্যাত, আর সেটা হল, এখানে পাওয়া গেছে হরেক রকম দুষ্প্রাপ্য ফসিল। পার্কের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে গেলে দেখা যাবে 'রিভার কমপ্লেক্স' নামের একটা উঁচু যায়গা যেখানে পাওয়া যায় 'সোডালাইট' নামের মূল্যবাণ নীলবর্ণ খণিজ। কানাডিয়ান রকির এই এলাকায় আছে আরো তিনটি বিখ্যাত ন্যাশনাল পার্ক ব্যানফ, কুটিনে আর জ্যাস্পার ন্যাশনাল পার্ক, এগুলো প্রত্যেকটাই ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভূক্ত। প্রতিটা পার্কেই আছে অসাধারণ আর চোখজুড়ানো হ্রদ, ঝর্ণা আর পাহাড়ের ছড়াছড়ি।

IMG_0371
[রাস্তার পাশে বিশাল পর্বতের পাদদেশে পেয়ে যেতে পারেন এরকম রঙ্গিন ক্যানভাস]

আমাদের আজকের গন্তব্য যেহেতু এক্কেবারে ক্যালগেরি শহর, তাই এসব পার্কে আর থামা হয় না। হাইওয়ে দিয়ে চলতে থাকি, ইওহো পার্ক পার করে, পেছনে ফেলে আসি বিসির সীমানা, ঢুকে পড়ি ব্যানফ ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে দিয়ে আলবার্টায়। চলতে থাকে ম্যাড়মেড়ে গান আর ঝড়ঝরে আড্ডা। রাস্তায় মাঝে মাঝে ভ্রমণবিরতি আর ক্যামেরাবাজি।

এভাবে পার হয়ে আসি অনেকটা পথ। সূর্যও বেশ মাথার ওপর চড়ে বসেছে। শুকনো খাবার দাবার আর পেটের চো-চো শব্দ দমিয়ে রাখতে পারেনা। ব্যানফ ন্যাশনাল পার্কের শেষ সীমা পার হয়ে আসি, অতিক্রম করি ছোট্ট শহর ব্যানফকে হাতের ডানে রেখে, আর বোধ হয় ঘন্টা-দুয়েক লাগবে ক্যালগেরি পৌছুতে। কানাডিয়ান রকির রাজত্বও প্রায় শেষের দিকে। আশে পাশে অনেকটাই সমতল, এতক্ষণের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের রাজত্বের পরে আশে পাশের রাস্তাকে অনেকটাই বিচ্ছিরি ভাবে খাপছাড়া লাগে। রাস্তাও এখন আগের মত ঘোঁড়েল নয়, স্বভাবতই গতি বেড়ে যায় ইম্পালার। (চলবে)

________________
ত্রিমাত্রিক কবি
ই-মেইলঃ


মন্তব্য

কৌস্তুভ এর ছবি

তাড়াহুড়োয় শুধু ছবি দেখে গেলাম, কয়েকটা দুর্দান্ত। দুয়েকটায় এত বেশি ফটোশপ না করলেও চলত। জিপিএস-ওয়ালা ছবিটা দেখে নিড-ফর-স্পিড গেমটার কথা মনে পড়ে গেল।

স্বপ্নাদিষ্ট (অতিথি) এর ছবি

লেখা এবং ছবি দুটোই চরম উপভোগ্য। ক্যানাডা যেতে ইচ্ছা করে মন খারাপ । লেখায় চলুক

-স্বপ্নাদিষ্ট

ত্রিমাত্রিক_কবি এর ছবি

ধন্যবাদ কৌস্তুভদা

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

প্রথম ছবি দেখেই কাইত...
প্রচণ্ড টায়ার্ড লাগছে, তাই লেখা পড়লাম না
কিন্তু ছবি দেখেই পাঁচতারা

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মৃত্যুময়-ঈষৎ এর ছবি

খুব ভালো লেগেছে ছবিগুলো............. চলুক

তানিম এহসান এর ছবি

চলুক

মৌনকুহর এর ছবি

ছবিগুলো দুর্দান্ত! চলুক

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

বন্দনা এর ছবি

কানাডা যাইতে মন চায়, ছবি দেখে তো পুরাই মাথা আউলা হয়ে গেছে, এত অসাধারন।

ত্রিমাত্রিক_কবি এর ছবি

এইমাত্র ক্যাম্পিং থেকে ফিরলাম দেঁতো হাসি
ধন্যবাদ সবাইকে ...
বন্দনাঃ কানাডা চলে আসেন ... অন্তত রকি মাউন্টেন দেখার জন্যে হলেও আসা উচিৎ

shoptorshi এর ছবি

অদ্ভুত, অসাধারন, অতুলনীয়।
সত্যিই মন কানাডা চলে গেছে।

রানা মেহের এর ছবি

প্রথম ছবিটা খুব সুন্দর

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

ত্রিমাত্রিক_কবি এর ছবি

ধন্যবাদ, রানা আপা

guest_writer এর ছবি

ভাল, কানাডা তো যেতেই হয়!!! শুভেচ্ছা- অণু

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

অণু ভাই, চলে আসেন ... আপনার তো ঘোরাঘুরিতে বিস্তর অভিজ্ঞতা ... আরেকটু না হয় বাড়িয়ে নিলেন!

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।