গত প্রায় তিনটা বছর মিটফোর্ডে পড়াশুনা করতে গিয়ে প্রতিদিনই যে অভিজ্ঞতাটা পেতে হচ্ছে, তা হল পুরনো ঢাকার 'খুবই বিখ্যাত' জ্যাম পার হওয়া। ঢাকা শহর যেমন দিন দিন লোহালক্কড়ের অচল নগরীতে পরিণত হচ্ছে তাতে করে শুধুমাত্র পুরান ঢাকার জ্যামটাকে এভাবে উল্লেখ করাটায় আপত্তি হতে পারে। কিন্তু দিন কয়েক যদি কারো ওদিকে যাওয়ার সৌভাগ্য(!) হয়ে থাকে তাহলেই বুঝতে পারবেন আমি কেন এমনটা বলছি। তবে সত্যি বলতে বছর খানেক আগের থেকে এখনকার অবস্থা আরেকটু ভাল হয়েছে, একটু কম সময়ে আপনি ওখানে পৌঁছে যেতে পারেন এখন।
পুরান ঢাকায় একটা বাহনই খুব বেশি চোখে পড়বে, রিকশা। রিকশার এমনই রাজত্ব সেখানে,বাকিদের চলাফেরা করাটা অনেকটা দায় হয়ে পরে।রিকশার সাথে সাথে রিকশাওয়ালাদের দৌরাত্ব তাই কোন অংশেই কম নয়। অনেক বড় গাড়ি নিয়ে আসলে ওখানে না ঢুকাটাই শ্রেয় । এত ছোট আর অপ্রশসস্ত রাস্তাগুলো, খুব অভিজ্ঞ না হলে গাড়ির বারটা বেজে যেতে পারে।অভিজ্ঞ হলেও যে পার পেয়ে যাওয়া যায় তা নয়, ওখানে আসলে নিজের থেকে অন্যদের উপরই বেশি ভরসা রাখতে হয়, কারণ কখন কে লাগিয়ে দেবে তার কোনই গ্যারান্টি দেয়া সম্ভব না।বড় রাস্তাগুলো বাদে এমন অনেক 'মাইনকা চিপা' আছে, যেখানে একসাথে দুইজন মানুষ চলতে পারেনা! একজনকে রাস্তার মাথায় অপেক্ষা করতে হয়, আরেকজন হেঁটে শেষ করলে তবে এগুতে পারে।
সকাল থেকেই শুরু করি। আমার ক্লাস সাড়ে সাতটায় শুরু হওয়ার সুবিধায়( নাকি অসুবিধায়) সক্কাল সক্কালই ঐ গলিঘুপচিগুলোর সাথে দেখা হয়ে যায়। একটা খুব মজার ব্যাপার ঘটে সকাল বেলাটায়, রাস্তাগুলো এত ছোট তবুও ঐ রাস্তার দুই পাশেই ভোর ছটা থেকেই বসে যায় পুরনো কাপড়ের বেচাকেনার মহোৎসব। চানখাঁরপুলের রাস্তাটা থেকে আরেকটু ভেতরে ঢুকলে যখন জেলখানাটা অতিক্রম করা হয়,সেই নাজিমুদ্দিন রোডের মাথা থেকেই দেখা যায় এই জমজমাট পসরা । তিলধারণের জায়গা থাকেনা তখন রাস্তাটাতে । আমরা প্রতিবছর যে নানা রকম ব্যবহার করা কাপড়চোপড় ফেলে দি বা কাউকে দিয়ে দি, তার অধিকাংশই মনে হয় এই সকালের স্ট্রীট মার্কেটটাতে পাওয়া যাবে।ক্রেতার পরিমাণ ও নেহাত কম নয়। ঐ সময় রাস্তাটায় একটা রিকশা যে এগিয়ে যাবে, তার জো থাকেনা। বারবার বেল টিপতে টিপতে আর একটু একটু করে আগাতে আগাতে আমাকে কলেজে পৌঁছাতে হয়। সে এক বিরাট হ্যাপার কাজ বাবা!
দুপুরবেলাটায় আবার যখন ঐ রাস্তাটা দিয়ে ফিরতে হয় তখন অবস্থা হয় আরও খারাপ। এবার পড়তে হবে জ্যামের সামনে। যে সে জ্যাম নয়, একবার যদি এই গ্যাঁড়াকলে পরেছেন তাহলে একেকটা জায়গায় অন্তত করে আধাঘণ্টা সময় দিতে হয়ে। তাতে করে মাত্র ১৫ মিনিটের রাস্তাকে আপনার অনন্তকালের রাস্তা মনে হলেও হতে পারে।
বর্ষাকালের কথা তো না বললেই নয়। ঢাকাশহরের স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা কোন আদ্যিকালের পর্যায়ে আছে তা নিজ চোখে দেখতে হলে একবার বৃষ্টিতে পুরান ঢাকায় ঘুরে আসলেই চলবে। তবে সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে একটা প্লাস্টিকের লম্বা পাঢাকা জুতা গলাতে হবে, আরও সাবধানতা হিসেবে রিকশা নিয়ে ওখানে পৌঁছানোই ভাল। একটু বৃষ্টি হলেই ছোট ছোট রাস্তাগুলো পানির নিচে পুরোপুরি চলে যায়,প্রায় হাঁটু ছুঁইছুঁই অবস্থা।রাস্তার দুই পাশের ড্রেনগুলোতে কোন আবরন নাই, খোলা ড্রেনের ময়লা হলুদ পানি আর বৃষ্টির পানি একসাথে গলাগলি করে আটকে থাকে। পুরান ঢাকার মানুষদের আবার এই পানি নিয়ে দেখেছি কোন বিকার নেই। জলনিমগ্ন অবস্থাতেই তারা নির্বিকার ভাবেই সব কাজ করে যায়, কারো গায়েই লাগেনা কিছু।আজব ব্যাপারটা হচ্ছে বৃষ্টি থামার মাত্র দুতিন ঘণ্টার মধ্যে আবার পানি নেমে যায়, কেমন করে এটা হয় বুঝার অনেক চেষ্টা করেছি, কেবলই নিস্ফল চেষ্টা।
তবে সবচেয়ে অন্যরকম হচ্ছে পুরান ঢাকার মানুষদের ট্রাফিকজ্ঞান। আইন কানুন কোন কিছু না মেনেই কেমন করে রাস্তাগুলোতে গাড়িগুলো চলছে, তাও একটা আজব ব্যাপার। কোন একটা ফাঁক পেলেই হল, সেখানে রিকশাটাকে ঢুকিয়ে দেয়া, তাতে করে শুধু নিজে নয়, বাকিদেরও ভয়াবহ জ্যামে আটকে যেতে হয়। কিন্তু কোন বিকার ছাড়াই এই কাজটা প্রত্যেকটা রিকশাওয়ালা মিনিটে মিনিটে করে যায়, বলতে গেলে উল্টো ওরা আপনাকেই ভুল প্রমাণ করে ছাড়বে, এবং রাস্তার মাঝখানেই বিরাট ঝগড়া বাঁধিয়ে দিবে। তাই ওদের ঘাঁটাতে না যাওয়াটাই ভাল ।
এত কাহিনি সত্ত্বেও একটা কথা সত্য, কোন বিপদে পরলে ওখানে নিজেকে একা মনে করতে হবেনা। মানুষগুলো অনেক ভাল, কোন প্রয়োজন হলেই সাহায্য করতে চলে আসে।জানিনা পুরনো ঢাকা তার ঐতিহ্য কতদিন ধরে রাখতে পারবে, তবে এখনও যে ওরা আমাদের মত 'রোবট' হয়ে যায়নি, এই ব্যাপারে নিশ্চিন্ত করে বলতে পারি।
-আফরিনা হোসেন রিমু
মন্তব্য
পুরনো ঢাকায় জীবনের অনেক তাৎপর্য্যপূর্ণ একটা সময় কাটিয়েছি, এখনও মাঝে মাঝে জাবর কাটাতে যাই। পড়তে পড়তে মন খারাপ হচ্ছিলো, শেষ প্যারাতে এসে মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। সব খ্রাপ কথাবার্তা বইলা শেষ কল্লে খবরই আছিলো আপনের! ইমানদারী কইতাছি, খবরই আছিলো!
নারে ভাই, আমারো যে পুরান ঢাকা সম্পর্কে খালি খারাপ কথাই মনে আসে, তা না। হঠাৎ পুরান ঢাকার জ্যাম নিয়ে লিখতে ইচ্ছা হল,তাই লিখলাম। আমার কাছে প্রত্যেকদিন ওখানে যাওয়াটা একটা অ্যাডভেনচার মনে হয়।
পুরান ঢাকা আমারও খুব প্রিয় জায়গা। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়তো দিনে একবার ঐখানে খাইতে না গেল দিনটাই মাটি হয়ে যাইতো। জ্যামটা আছে সত্য কিন্তু আরো অনেক অনেক ভালো কিছুও ঐখানে আছে।
ভাল লেগেছে। ড্রেনের পানির রং কি আসলেই হলুদ হয়?
কটকটে হলুদ তো আর হয়না, হলুদ বাদামি এমন একটা রঙ হয়( এহ, আমি দেখি ড্রেনের ব্যাপার স্যাপার ভালই খেয়াল করেছি)...
আমার জন্মই পুরান ঢাকায়। শৈশব ওখানেই কেটেছে। তারপর এক সরকারি বিদ্যালয়ে চান্স পাবার পর ঢাকার মাঝামাঝি স্থানান্তর হয়ে চলে আসি। অনেক স্মৃতি আছে ওখানকার। তখন অবশ্য এরকম জ্যাম ছিল না!!! এখনতো কোথায় জ্যাম নেই বলুন। রাত ১১টাতেও ঢাকার রাস্তা ফাঁকা হয় না। কোন শুক্র/শনিবার নেই।
আর যারা ঢাকার স্থানীয় তথা ঢাকাইয়্যা তারা কখনই তাদের এত বৈচিত্র্যপূর্ণ ঐতিহ্য হারাবে বলে মনে হয় না। চাইও না হারাক। তারা সত্যিই অনেক আপন আচরণ করে।
ওহে মৃত্যুময় ইষৎ, পুরনো ঢাকার কোথায় ‘কবি মৃত্যুময়’ এ র জন্ম হয়েছিলো? তার ‘পোয়েট অব ডিমাইজ‘ নামধারনই বা ঘটেছিলো কোথায়? মাথায় কত উল্টাপুল্টা প্রশ্ন আসে, মাইন্ড করলা নিকি?
পরীক্ষা শেষ, ঘুরতে যাবানা কোথাও?
তানিম ভাই, এখনো যদি আমাকে আপন না ভাবতে পারেন তাহলে আর কী বলব!!! মাইন্ড করব এইটা কোন কথা হইল!!!
ভাইয়া আমার জন্মস্থান গেন্ডারিয়া, ধূপখোলা মাঠের আশে পাশের এলাকায়। ভাইয়া ঐ নিক গুলোর কথা আর বইলেন না, কত নিক নিলাম। সবনিকের জন্ম ফেইসবুকে। 'পোয়েট অব এ ডিমাইজ' আসছে 'সিস্টেম অব এ ডাউন'(আমার প্রিয় একটা ব্যান্ড) থেকে, ফেইসবুকে এটাই আমার বহুল ব্যবহৃত নিক। আর প্রথমদিকে ব্লগে লেখালেখির নিক ছিল 'কবি মৃত্যুময়'। সেটা এক সময় করে ফেললাম 'মৃত্যুময় ঈষৎ'। ইদানিং এটাই ব্যবহার করছি।
আর ভাইয়া ঘুরাঘুরি প্রচুর করি। এই সেদিনো শেষ পরীক্ষার আগের পরীক্ষা দিয়ে এসেই নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলাম স্কুল বন্ধুদের সাথে। গেলাম মুন্সিগঞ্জের কোনেক গাঁয়ে, তারপর মাওয়া ঘাটে। আমরা এই দলটা প্রচুর ঘুরি। কিন্তু এখন যাওয়া হবে কিনা বলা মুশকিল। কারণ আমার ঘুরাঘুরি দলের বন্ধুরা একেক জন একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সবার একসাথে ভ্যাকেশন কম হয়। তবে কোনভাবে সময় বের করতে পারলেই দেই ছুট...........নিরুদ্দেশে...............
মাওয়া ঘাটে আমরাও চান্স পাইলে যাই রাত করে। শুনে ভালো লাগলো। অনেকদিন তোমার লেখা পাচ্ছিনা ভাইয়া!
আমি পুরনো ঢাকায় কাজ করি। তাই লেখিকার বক্তব্য হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছি। এখানকার রিকশা চালকেরা রাস্তায় চলাকালে একটাই নীতি অবলম্বন করে, তাহলো 'নাক-নীতি', অর্থাৎ কোনভাবে যানবাহনের অগ্রভাগকে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই হলো ! আর সঙ্গে 'খিস্তি-খেউর' তো রয়েছেই। পুরনো ঢাকায় যে এককালে নবাবদের বসবাস ছিলো, তা এখানকার রিকশাওয়ালাদের দেখলে ঢের বোঝা যায়! আমিতো অনেক সময় নবাবী বোল-চাল সহ্য করতে না পেরে, হাঁটা শুরু করি। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই 'মাইনকা চিপা' রাস্তাগুলোতে রিকশা-গাড়ি ইত্যাদি যানবাহন এমন জট তৈরি করে যে, এমনকি হাঁটার জন্যও এক চিলতে ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায় না। আর উপরি পাওনা হিসাবে রয়েছে দোকান-পাটের ঝাড় দেয়া ধুলো, ঘন-বসতি দালানগুলো হতে থুথু নিক্ষেপ, রডের কৌণিক সংস্পর্শ, বিশাল সাইজের ডাস্টবিনগুলোর মন বিষানো দুর্গন্ধ এবং তারই মাঝে কতিপয় মানুষের 'ভ্যানগাড়ি রেস্তেরা' থেকে 'সুপ', 'চাউমিন' ইত্যাদি আহারের মাধ্যমে রসনা বিলাসের দৃশ্য! পুরনো ঢাকা নিয়ে লেখিকার কাছ থেকে আরও মজাদার পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
একদম ঠিক বলেছেন। পুরান ঢাকাটা অনেক মজার,ইচ্ছা করলে অনেক কিছু লেখা যায়। আরও কিছু লিখব সামনে আশা করছি।
জীবনের শৈশব-কৈশোর পুরোটা কেটেছে পুরনো ঢাকায়। ওখানকার মানুষদের যেদিকটা সবচেয়ে ভালো লাগে, সারাদিন এটা-ওটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে যতই ঝামেলা থাকুক, কেউ একজন কোন বিপদে পড়লেই মুহূর্তে সব একাট্টা!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
নান্না মিয়ার বিরিয়ানি, হোটেল স্টার ...আহ মনে পরে গেল, কতদিন খায় না ওই স্বাদের খাবার। আর যে কবে কপাল হবে খাবার তাও জানিনা। thanks for reviving the memory
পুরান ঢাকার কথা মনে পড়লে আমার খালি খাওয়ার কথা মনে আহে। হেহে!!!
আফরিনা, পুরান ঢাকার এক বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার সময় খুবই বিরক্ত হতাম। কিন্তু ওখানকার খাবার মুখে দেবার পর সব ভুলে যেতাম...আপনার একটা কথা খুব সত্যি, ওরা এখনো রোবট হয়ে যায়নি।
ঠিক বলেছেন। খাবারের বেলায় পুরান ঢাকাকে কেউ টেক্কা দিতে পারেনি কেউ, পারবেও না সহজে। যারা পুরান ঢাকার খাবার খায়নি, তারা এটাও জানেনা তারা কি মিস করছে।
বারো/তেরো বছর আগে একবার শাঁখারী বাজার যাইতেছি... ব্যাপকজ জ্যাম... অনেক কষ্টে কান্নি খায়া খায়া চলতেছি... মানুষের মাথা চেহারা আর রিকশার হুড দেখতে দেখতে যাইতেছি... হঠাৎ দেখি আই লেভেলে মানুষের পা আর রিকশার চাক্কা...
আমি তো অবাক... কাহিনী কী?
নিজেরে আবিষ্কার করলাম ম্যানহোলে
তবে যতো যাই বলেন পুরান ঢাকা একটা স্বর্গ... আমার তো এখনি মিতালীর কালাভূনা, নূরানীর শরবত আর আগামসী লেনের সব খাবার খেতে ইচ্ছে করতেছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পুরান ঢাকা মানেই খেতে যাওয়া। আমরা তারা মসজিদের ওখানে এক মামার দোকানে যেতাম ফুচকা খেতে। মামার হাতের ফুচকা আমার খাওয়া শ্রেষ্ঠ ফুচকা।
আমার পছন্দের স্টার। আর ফালুদা।ইয়াম!
বুঝতে পারলাম, খাবার দাবার নিয়েও একটা লেখা দিচ্ছি শিগ্রি।
নতুন মন্তব্য করুন