‘সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হব'

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৪/০৮/২০১১ - ৯:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কবিতা পড়তে তেমন ইচ্ছে করত না সেসময় । একদিন এক সিনিয়র বললেন, “আবুল হাসান” পড়ে দেখ। কবির নামটা অতি সাধারণ মনে হল-এরকম কত নাম ঘুরে আমাদের চারপাশে। তাই পড়া হয়ে উঠলনা তখন।
একদিন সন্ধ্যায় হলের রুমে দেখলাম চার রঙের ছয়টা হাত দিয়ে সাজানো মলাটের-‘আবুল হাসান সমগ্র’। উল্টালাম, দেখি- প্রথম কবিতার নামই ‘আবুল হাসান’- বুঝলাম না, একি পাগলামি নাকি দুর্দান্ত সাহস ! আবার প্রথম লাইনেই চমক, নিজেকে নিয়ে লেখা লাইন- ‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে...’

এরপর পাতার পর পাতা পড়ে গেলাম মুগ্ধতা নিয়ে। মনে হল, আমার পাশে বসেই যেন কবিতাগুলো লেখা। কিছু অনুভূতি আগে ধরতে পারতাম না, ভেতরে জন্মে ভেতরেই মরে যেত। এখন ‘আবুল হাসান’-এ এদের কোনটাকে হয়ত খুঁজে পাই- “আমার কেবলই রাত হয়ে যায়” বা “আমার হবে না,আমি বুঝে গেছি”।

আবুল হাসান না পড়ে আমার কিশোর-তরুণ বয়স কেটেছে। অবশ্য এতে আফসোস নাই। এই বয়সেই এখন আরো ভাল করে বুঝছি আবুল হাসান। বেশি বয়সের ভালোবাসাই তো বেশিদিন টিকে।এখন সবসময় ব্যাগে মাঝারি সাইজের ‘আবুল হাসান’ থাকে। হয়ত থাকবে আরো কিছুদিন।

তাঁর কবিতার মাঝে একটা সহজিয়া ছন্দ আছে। পরিচিত শব্দগুলোই একটু অন্যভাবেই কোমল উপমা দিয়ে সাজানো থাকে। হয়ত কোন ক্লান্ত কিশোর ‘বুকের মধ্যে কঠিন রুক্ষ দুপুর শাসন করে’ ঘুরে বেড়ায়। অথবা কোন অভিমানী নিঃসঙ্গ বালিকা ‘অতটুকু চাইনি...চেয়েছিল একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!’

কবির ভেতরে “অচেনা প্রতিম কেউ সারাজীবনের এই ‘কী-যেন-নেই’-র গান গেয়ে যায়”। তিনি রক্তের,দুঃখের,ভালবাসার,বেদনার,যুদ্ধের,নদীর,নগ্নতার,নিবিড় বৃক্ষের মাতৃভাষা জানতেন না, শুধু জানতেন, “আমি একটি মানুষ,আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা,ক্ষুধা!” তিনি বলে যান- “আমার না পাওয়াগুলি জোড়া দাও/আমি তোমাদের ভাল থাকা হব।”

এখন পড়ে বুঝি, বাংলা কবিতা পাঠকের ‘আবুল হাসান’কে এড়িয়ে যাবার পথ নেই। আমাদেরই তো অভিমানের কথা সেসব- ‘আমাদের পায়ের সমান পৃথিবী কোথাও পাইনি’ অথবা “তোমাকে না ছুঁতে পেরে/আজ নিজ নিয়তির অন্তর্গত রোদনকে বললাম,দেখো/আমি আর কাঁদতে পারব না!”

আমরাও বুঝি – ‘একটা কিছু মারাত্মক ঘটছে কোথাও,নইলে মানুষের দরোজায় টোকা দিলে কেন আজ দরোজা খোলে না?’ আমাদের বন্ধুরাও কৈশোরে নারকেল বনের পাশে বসে আত্মহত্যার মত বিষণ্ণ উপায়ে উষ্ণ মেয়েদের গল্প করত। অথবা আমরাও ভালবাসি ‘যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙ্গুল’।আমাদের মধ্যবিত্ত বাবাদের মনে হয় ‘চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ’। আমাদেরও “একসময় ইচ্ছে জাগে, এভাবেই অরণ্যে অরণ্যে ঘুরে যদি দিন যেত।” ‘চারপাশে ভেঙ্গে যাওয়া ভুল অন্ধকারে’ আমরাও ‘নোখের ভিতর নষ্ট ময়লা নিয়ে ঘুরি’ আর চারপাশে ‘কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি’। এখনো ‘মানুষেরা সমিতিতে মালা পেয়ে খুশি’।আমরাও ব্যক্তিগত পোশাক পরলে কেউ কাউকে আর চিনি না। আর শার্টের তলায় নিজস্ব গোপন ছুরি নিয়ে চলাফেরা করি।
চারপাশ দেখে রাগ হতে থাকে, আর মাথায় আবুল হাসান ঘুরতে থাকে- “আর মানুষকে যতবার তুমি মারো/যতবার পরাও শৃঙ্খল/মানুষ তবুও তার বজ্র মুষ্টি থেকে/আগুনের রত্ন ছুঁড়ে দেবে।আগুনে পড়বে ভস্ম এবং শৃঙ্খল”। কবিতার আবেশ তাই শেষ হতে চায়না।

“অবশেষে জেনেছি মানুষ একা ! / জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা !” কী অবলীলায় বলে দেন ‘অবশেষে’ শব্দটি, মাত্র ২২/২৩ বছর বয়সে। একাকীত্বের কী চমৎকার উপমা পেয়ে যাই ‘ চিবুকের কাছেও’ শব্দ দিয়ে।

দুঃখের আর নিঃসঙ্গতার আরেক নাম ‘আবুল হাসান’। আবুল হাসানে মজে থেকে,তাই,অন্য সবাইকে পানসে লাগে। জীবনানন্দের পর তিনি হয়ে উঠেন আমার প্রিয় কবি।

হঠাৎ করে থেমে যেতে হয় কোথাও, এটা কি ১৯৭৪ সালে মুদ্রিত কোন লাইন নাকি আজকের? “মানুষকে মারা আজ কোনো সহজ ব্যাপার নয়,সব সহজ”।
১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট কবির জন্ম।’৬৫ তে ঢাকা আসেন, ’৭১ এ অসুস্থ হন আর ’৭৫ এ মারা যান। মাত্র আঠাশ বছর বয়সে। অথচ কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক এখনো।

যেকোন একটা পাতা খুলেই পড়ে ফেলা যায় তাঁর যেকোন লাইন, আর মূহুর্তে তৈরি হয়ে যায় ভালোলাগা- “গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর আমিও ভবঘুরেদের প্রধান ছিলাম...তুমি সেরে ওঠো তোমাদের পথেই আমাদের পথে কখনো এসো না,/আমাদের পথ/ভীষণ ব্যর্থ আমাদের পথ।” আবার একই কবিতায় পাওয়া যায়, ফাতিমা ফুপুর প্রভাতকালীন কোরানের মর্মায়িত গানের সুর আর সরজু দিদির হরিকীর্তনের নদীভূত বোল। আমাদের কথাগুলো আমাদের আগেই লিখে যায় কেন কেউ? “তোমার চিবুক ছোঁব,কালিমা ছোঁব না”- এমন সুন্দরের ব্যাখ্যা নেই।

আর কবিতার কিছু লাইন কখনো পুরনো হয়না। মাত্র তিন লাইনের কবিতা ! অথচ কী শক্তিশালী !
“ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো,ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও!”

‘আবুল হাসান’ পড়ে কেবল মুগ্ধ হতে থাকি। এত বিশ্লেষণ দরকার নেই, কেবল পড়ে যেতে হয়। “ভিতরে রহস্য আছে,ছুঁতে পারবো না, আমি ছুঁতেও চাই না”

আবুল হাসান শুধু আবুল হাসানই !

-প্রিয়ম

ছবি: 
10/08/2007 - 5:26am

মন্তব্য

মৌনকুহর এর ছবি

পড়তে হবে তো...... চিন্তিত

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

তাসনীম এর ছবি

আবুল হাসানকে বাংলা কবিতার পাঠকের এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। আসলেই নেই...

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

pathok এর ছবি

ধন্যবাদ আমার কবি কে নিয়ে লিখবার জন্য

engr. rasel এর ছবি

How can I Get this book " Abul Hasan"...?

সুরঞ্জনা এর ছবি

কত অল্প সময়ের মাঝেই যে কত গভীর ছাপ রেখে যাওয়া যেতে পারে, কয়েকজন যুবক সেটা প্রমাণ করে গেছেন।
আবুল হাসানের কবিতার সাথে আমার পরিচয়ও বেশিদিনের নয়, মুগ্ধ হয়েছি পড়ে।

লেখাটা ভালো লাগলো আসলেই। আরো অনেক, অনেক লিখুন।
হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

হাততালি

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

তাঁর সম্পর্কে কিছু বলার নেই। সেই চেষ্টা করাও বৃথা। যে আবুল হাসানকে জানতে চায় সে যেন তাঁর প্রতিটি কবিতা পড়ে...

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অদ্রোহ এর ছবি

আবুল হাসান একজন নিঃশব্দ আততায়ী, এর বেশি আর বলার নাই। খেদ শুধু এটুকুই, লোকটার সাথে পরিচয় হল একটু দেরিতেই।

লেখা চলুক

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

মৃত্যুময়-ঈষৎ এর ছবি

চলুক চলুক উনি অনন্য, মুগ্ধকর।

তানিম এহসান এর ছবি

মুগ্ধতা টিকে থাকুক!

অপবিত্র এর ছবি

আমি অবশ্য বেশ কিছুদিন হইল চিন্তা করতেসিলাম আপনি লেখালেখি করেন না কেন । যাই হোক আজকে হাতেনাতে পাইলাম । কবিতা বিষয়ক আরও লেখেন । আমাদেরও মনে হয় কবিতা পড়ার বয়স হচ্ছে হাসি

বন্দনা কবীর এর ছবি

আবুল হাসান পড়ে শুধু মুগ্ধ হতে থাকি, এতো বিশ্লেষনের দরকার নাই, কেবল পড়ে যেতে হয়'...সত্যি, কেবল পড়েই যাই...

লেখাটা চমৎকার হয়েছে।

বইখাতা এর ছবি

চলুক চলুক আবুল হাসান পড়ে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই...।

লেখা পোস্ট করার আগে প্রতিটি বিরাম চিহ্ণের পরে স্পেস দিয়েন, এতে লেখাটা পড়তে আরাম লাগে।

চুপচাপ থাকি এর ছবি

আবুল হাসানকে নিয়ে লেখার কিছু নেই। তার কবিতাগুলোই যথেষ্ঠ।
এই প্রসংগে একটা কথা বলি। অনেক আগের কথা। বোধকরি ১৯৭৬ সাল। আবুল হাসান মারা গেছেন কয়েক মাস আগে। সে আমলের একটি দৈনিক পত্রিকায় "ক খ জোয়ার্দার" নামের একজনের একটি লেখা পড়েছিলাম আবুল হাসান যখন মারা যান সেই সময়ের উপর। পুরো লেখাটিতে কি ছিল তা আজ মনে নেই, তবে এইটুকু মনে আছে যে (প্রয়াত) কবি সুরাইয়া খানম কাঁদতে কাঁদতে আবুল হাসানের লাশের কপালে (নাকি ঠোঁটে) চুমু খেয়েছিলেন।
আজকে সেই লেখাটি বড্ড পড়তে ইচ্ছে করছে। জানিনা তা পাওয়া যাবে কিনা।

অর্ক রায় চৌধুরী এর ছবি

আমার ভূল হতে পারে, কিন্তু মনে হয় এর একটা কাবতাও আমাদের পাঠ্য নয়।
লেখা ভালো লেগেছে।

অশুভাকাঙ্ক্ষী নই এর ছবি

৩ দিন পর অন্যকোথাও/অন্য ব্লগে দেওয়ার নিয়ম। সচলের নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিৎ নয় কি?

যদিও লেখাটি চমৎকার।

নিবিড় এর ছবি
স্বাধীন এর ছবি

চমৎকার লেখা। চলুক চলুক

আবুল হাসানের কবিতাগুলো কি অন-লাইনে পাওয়া যায় কোথাও?

pathok এর ছবি
pathok এর ছবি
সন্দেশ এর ছবি

সচলায়তনের নিয়ম ভঙ্গ করায় প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে দেয়া এবং মন্তব্যের অপশন বন্ধ করে দেয়া হোলো। অনুগ্রহ করে ভবিষ্যতে সচলায়তনের নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন।